পূর্ণিমাতিথি পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0
515

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৪৬

উনি একটু থামলেন। উনার চোখে অভি চিকচিক করছে। উনি ঠোঁট কামড়ে ধরে অন্যদিকে তাকালেন। আমার বুকের ভিতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মনের মাঝে একটাই প্রশ্ন জাগছে উনি কী এখনো অরি আপুকে নিজের জীবনে ফিরে পেতে চান? বুকটা কেঁপে ওঠলো। উনি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন,

এভাবে কোচিং শেষ হলো। বিভিন্ন মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা দেই। ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টের জন্য যখন অপেক্ষা করতে থাকি। তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো নিয়ে যখন মরিয়া হয়ে বসে ছিলাম এক্সামের ফলাফল জানার জন্য। ঠিক তখনি খবর পাই অরির বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমাকে খবরটা দিয়েছিল অরির এক বান্ধবী। খবরটা বিশ্বাস না করলেও মনের মাঝে একটা ভয় কাজ করছিল। নিজেকে বার বার সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম এটা বলে যে, অরি বান্ধবী আমাদের সম্পর্কে মেনে নিতে পারেনি। আমাদের দুজনকে আলাদা করতে চায়। কারণ অরির বান্ধবী আমাকে পছন্দ করতে। নিজেকে যতই সান্ত্বনা দেই অবাধ্য প্রেমিক মন কী আর তা মানতে চায়? প্রেমিকাকে হারানোর ভয় প্রতিটা প্রেমিকের বুক কাঁপে। নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে আমি অরিকে ফোন দেই। অরি অকপটে সব স্বীকার করে নেয় যে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এটা শোনার পর নিজেকে কেমন কেমন পাগল পাগল লাগছিল। আমি ওর সাথে একবার দেখা করতে চাই ও রাজিও হয়ে যায়। আমি উন্মাদের মতো ছুটে যাই। আব্বু পিছন থেকে বার বার ডেকে বলে আমার ঢাকা মেডিক্যালে চান্স হয়েছে। কিন্তু আমি তা কর্ণগোচর না করেই ছুটে যাই। অরিকে আমি অনেক বুঝায় ও বুঝতে নারাজ ছিল। ওর লাস্ট কথাগুলো এমন ছিল।

আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। শুধু ভালোবাসা থাকলেই মানুষ সুখী হয় না। ভালোবাসা ধুয়ে তো আর আমি পানি খাব না। ভালোবাসা মানুষের সাথে কুড়েঁ ঘরেও শান্তি এসব যাস্ট লোক দেখানো কথা। আমি আবেগে ভেসে যাওয়ার মতো মেয়ে না। তুমি কবে না কবে ডক্টর হবে সেই আশায় তো আমি পথ চেয়ে বসে থাকতে পারবো না। আদৌও তুমি ডক্টর হবে কী না তারও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদিও ডক্টর হও। আমি যাকে বিয়ে করছি তার সমকক্ষ কোনো দিন হতে পারবে না। ও বিরাট বড় বিজন্যাসম্যান। বিয়ের পর আমাকে নিয়ে কানাডা চলে যাবে। আমি এই আরাম আয়েশের জীবন ছেড়ে তোমার সাথে টিপিক্যাল বাঙালি বউদের মতো সংসার করতে পারব না। যদি বলো তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা। সরি টু সে সেটা আমি কোনো দিনও চাইবো না। কেউ একজন বলেছিল, যদি ভালো থাকতো চাও তাহলে স্বার্থপর হয়ে যাও। ভালো থাকার জন্য একটু স্বার্থপর হওয়াই যায় কী বলো? একচুয়ালি আমি তোমার টাইপ না। পারলে নিজের টাইপ কাউকে খুঁজে নিও। আসি ভালো থেকো।

অরির কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। নির্বিকার তাকিয়ে ছিলাম ওর যাওয়ার দিকে। আস্তে আস্তে ও আমার দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। কিন্তু আমি ওকে কিছু বলতে পারি নাই। এই অরি আমার সেই চেনা অরি ছিল না। সম্পূর্ণ অচেনা অরি ছিল। ওর বিয়ের দিনও আমি ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। কিন্তু অরির বাবা আমাকে অরির সাথে দেখা করতে দেয়নি। আংকেল আমাদের সম্পর্কের কথা জানতেন। উনি আমাকে কথাও দিয়েছিলেন অরির সাথে আমার বিয়ে দিবেন। অরির বাবাও হয়তো অরির মতো স্বার্থপরই ছিল। তাই তো বড় লোক মেয়ের জামাই পেয়ে আমাকে দেওয়া কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। আমি আংকেলকে অনেক অনুরোধ করি। আমার কাকুতি মিনতি উনার কর্ণগোচর হয়নি। উনি আমাকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। আমি একটা বার অরির সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। অনেক কাকুতি মিনতি করেছিলাম। শুধু পায়ে পড়ায় বাকি ছিল। আমার চোখের সামনে দিয়েই অরি বধূ বেসে অন্য একটা ছেলের হাত ধরে চলে যায়। এরপর থেকে আমি প্রচণ্ড ডিপ্রেশড হয়ে পড়ি। নিজেকে ঘর বন্দি করে ফেলি। আগের আমিটা পুরো চেইন্জ হয়ে এই আমিটাই পরিণত হয়। প্রাণবন্ত ছেলেটা হুট করেই চুপ করে গেলো। চরম ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম ঠিক তখনি আমার বন্ধুর মতো আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল আমার মা। আম্মুর একটা কথা আমার আজও মনে পড়ে। আম্মু বলেছিল,

তুমি প্রতিষ্ঠত হও। মানুষের মতো মানুষ হও। যখন তোমাকে সবাই এক নামে চিনবে। তখন অরির মতো হাজারটা মেয়েসহ তার বাপ তোমার পিছনে লাইন লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

কথাটা অনেকেই নেগেটিভ মাইন্ডে নিবে। ভাববে মেয়েদের এখানে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। তা কিন্তু মোটেও না। মেয়েদের ক্ষেত্রেও সেইম। একটা মেয়ে যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন ছেলেরা তো সেই মেয়েকে বিয়ে করতেই চায়, তার সাথে ছেলের বাবা-মা ও ঐ মেয়েটার পিছনে পড়ে নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে। আম্মুর কথার মর্ম সেদিন বুঝার ক্ষমতা আমার ছিল না কিন্তু আমি আজ বুঝি।

আপনি এই কথাগুলো আমাকে আগে কেনো বলেননি?

তোমাকে হারানোর ভয়ে। ভয় হতো যদি এসব শুনে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও।

আপনি তো অরি আপুকে অনেক ভালোবাসতেন। আজ যদি অরি আপু ফিরে আসে নিশ্চয়ই আপনি নিজের জীবন থেকে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবেন?

আমার কথা শুনে উনি আলতো হাসলেন। তবে কিছু বললেন না। ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে বাইরের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর আমার আমার দিকে তাকালেন। মৃদু কন্ঠে বলে ওঠলেন,

সেটা কখনোই সম্ভব না। অরি আর কখনোই ফিরে আসবে না। আজ থেকে দুই বছর আগে অরি মারা গেছে। মারা গেছে বললে ভুল হবে। ওকে খুন করা হয়েছিল। খুনটা তার হাজবেন্ডই করেছিল। কানাডা গিয়ে অরির হাজবেন্ডের থেকেও বড় বিজন্যাসম্যানের সাথে অরির পরিচয় হয়। অরি জড়িয়ে যায় পরকীয়া নামক অবৈধ রিলেশনে। এটা জানার পর অরির হাজবেন্ড মেনে নিতে পারেনি। অরির হাজবেন্ড অরিকে ভীষণ ভালোবাসতো। তাই উনি মেনে নিতে পারেননি তার স্ত্রী তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসে। ঐ ভদ্রলোক তাই নিজের হাতে অরিকে খুন করে। এখন অবশ্য ঐ ভদ্রলোক মেন্টাল এ্যাসাইলামে আছেন। প্রকৃতপক্ষে অরি কাউকেই ভালোবাসেনি। অরি সবার টাকাকে ভালোবেসেছে। তিন তিনটা ছেলের জীবন নিয়ে খেললো। আর রইলো তোমাকে নিজের জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার কথা সেটা আমি কোনোদিনও পারবো না। কারণ তোমাকে নিজের জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হলে যে আমাকে নিজের শরীর থেকে যে নিজের আত্নাটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে।

আমার চাহনি নির্বিকার। এই লোকটা ভালোবাসি না বলেও কতো সুন্দর করে বুঝিয়ে দেন উনি আমাকে কতোটা ভালোবাসেন। আমি নিঃশব্দে ঐ স্থান ত্যাগ করলাম।

________________

দিনটা শুক্রবার। চারদিকে সূর্যের আলো ঝলমল করছে। আর মৃদু মন্দ বাতাস বইছে। সকাল সকালই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। আজকে আমি আর রুদ্র দুজনেই বাসায়। মাঝে আর একটা দিন বাকি রমজান মাস শুরু হওয়ার। ছোটবেলায় রমজান মাস নামটা শুনলেই কেমন যেনো একটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করতো। রমজান মাসের পরই আসবে ঈদ। ঈদে নতুন জামা কিনবো। সবার কাছ থেকে সালামি নেওয়া। ঈদের আগের দিনে রাতে তো এক্সাইটমেন্টে আমার ঘুমই হতো না। কাজিনদের মাঝে প্রতিযোগিতা হতো ঈদের দিন সকালে কে সবার আগে ঘুম থেকে ওঠতে পারে তার। ছোটবেলার পাগলামিগুলো মনে পড়লে এখন হাসি পায়।

নিজের কোমড়ের দুই পাশে বলিষ্ঠ হাত জোড়ার স্পর্শ পেয়ে আমি কেঁপে ওঠলাম। নিঃশব্দের উনি আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আমার কাধে থুতনি রাখলেন। উনার নিঃশ্বাস আমার কান, গাড় ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার নিশ্বাস দ্রুততর হয়ে আসছে। শরীর অসাড় হয়ে আসছে।

চলবে……..

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৪৭

নিজের কোমড়ের দুই পাশে বলিষ্ঠ হাত জোড়ার স্পর্শ পেয়ে আমি কেঁপে ওঠলাম। নিঃশব্দের উনি আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আমার কাধে থুতনি রাখলেন। উনার নিঃশ্বাস আমার কান, গাড় ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার নিশ্বাস দ্রুততর হয়ে আসছে। শরীর অসাড় হয়ে আসছে। আমি দুই হাতে বেলকনির রেলিং খামছে ধরি।

খালামনি, মামা তোমরা কই? এই দেখো আমি চলে এসেছি।

নিধির কন্ঠ শুনে উনি আমার থেকে ছিটকে দূরে সরে গেলেন। নিধি কোমড়ে দুই হাত দিয়ে বেলকনির দরজার সামনে দাঁড়ায়। আমাদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলে,

তোমরা দুজন এখানে কী করছো বল তো? আমি সেই কখন থেকে তোমাদের ডেকে চলেছি। তোমাদের ডাকতে ডাকতে আমার গলা ব্যথা হয়ে গেলো।

রুদ্র কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে এসে নিধিকে কোলে তুলে নিল। নিধির এক গাল টেনে বলে,

আমার মামুনিটা অনেক বড় হয়ে গেছে । তা মামুনি তুমি কেমন আছো?

নিধি রুদ্রর চুল টেনে ধরে বলে, আমি অনেক ভালো আছি। আমি খালামনির কোলে যাব।

রুদ্র একটু অবাক হয়ে বলে, খালামনির কোলে যাবে কীভাবে? তোমার খালামনি কই?

নিধি আমার দিকে ইশারা করে বলে, ঐ তো আমার খালামনি।

ও তো তোমার খালামনি না। ও তোমার মামিমনি।

নিধি চোখ ছোট ছোট করে বলে, তুমি আমাকে উল্টা পাল্টা শিখাচ্ছো। আম্মু বলেছে রিয়া খালামনি আমার খালামনি।

আমি তোমার কী হই?

মামা।

মামার বউ তোমার কী হবে?

মামি।

রিয়া তো আমার বউ। তাহলে রিয়াকে তুমি কী বলে ডাকবে?

খালামনি।

একটু আগে না বললে মামার বউকে মামি ডাকতে হয়। তাহলে রিয়া তোমার খালামনি হয় কী করে হয়? রিয়াও তো তোমার মামি।

রিয়া খালামনি আমার খালামনি, খালামনি, খালামনি।

রুদ্র বিভিন্ন কলা কৌশলে নিধিকে বোঝানো চেষ্টা করছে আমি তার খালামনি না তার মামি। নিধি বুঝতে নারাজ। তার এক কথা আমি তার খালামনি। নিধি আর রুদ্রর কান্ড দেখে আমি ঠোঁট টিপে হাসছি।

_______________

নিধি আসাতে যেনো বাসাটা পরিপূর্ণ লাগছে। আর যেখানে নিয়াম ভাইয়ার মতো একজন মানুষ সেখানে হই হুল্লোড় হবে না। এটা হতেই পারে না। সবাইকে হাসিয়ে মারার জন্য উনি একাই যথেষ্ট। উনি ভীষণ ভোজন রসিক। তাই তো মামুনি বাহারি রকমের রান্না করেছেন।অবশ্য সবগুলো আইটেমই আমার চেক করা হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা আইটেমই জাস্ট অসাধারণ হয়েছে। ইতিমধ্যে সবাই লাঞ্চ করতে বসে গেছে।

লাঞ্চ করার জন্য আমিই সবার শেষে বসলাম। আম্মু ফোন দিয়েছিল তাই আমার একটু দেরি হয়ে গেছে। আমি আসতেই সবাই খাওয়া শুরু করে দিল। হুট করেই খাওয়ার মাঝেই পায়ে সুড়সুড়ি অনুভব করলাম। আমি টেবিলের নিচে তাকালাম রুদ্র নিজের পা দিয়ে আমার পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছেন। উনি বিপরীত দিকে আমার সোজাসুজি বসেছেন। আমি উনার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালাম। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। উনার কোনো হেলদুল নেই। উনি এক মনে খেয়ে যাচ্ছেন।

আমি পা টা সরিয়ে নিতে চাইলে রুদ্র নিজের পা দিয়ে আমার পা চেপে ধরেন। আমি একটু খাচ্ছি বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মান-সম্মান সব প্লাস্টিক হয়ে যাবে। লজ্জায় আর কারো সামনে আসতে পারবো না। আমি তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শুরু করলাম। খাওয়া শেষ করে এখান থেকে যেতে পারলেই বাঁচি। উনি পা ছেড়ে দিয়ে আমার পায়ের ওপর নিজের পা দিয়ে স্লাইড করতে শুরু করলেন। প্লাজু পড়ে থাকাই প্লাজু বেশ খানিকটা ওপরে ওঠে গেলো। আমি চমকে গিয়ে লাফিয়ে ওঠলাম। উনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। এমন কিছু হবে যে উনি হয়তো ভাবতে পারেননি।

খাওয়ার মাঝে এভাবে লাফিয়ে ওঠায় গলায় খাবার আটকে গেলো। আমি কাশতে কাশতে শুরু করলাম। মামুনি দ্রুত এসে আমার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল। নিয়াম ভাইয়া হালকা কাশি দিয়ে বলেন,

রিয়া তোমার কথা হয়তো কারো মনে পড়ছে। তুমি হয়তো কারো বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে খেতে বসেছিলে।

নিয়াম ভাইয়া মিটিমিটি হাসছে। কথাটা শোনার সাথে সাথেই মুখ থেকে পানি ছিটকে বেরিয়ে এলো। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না নিয়াম ভাইয়া পুরো বিষয়টা অবলোকন করেছেন। আমার আর এখানে এক দন্ড দাঁড়ানোর সাহস হলো না। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। নিয়াম ভাইয়ার সামনে ছিঃ ছিঃ। সবাই আমাকে পিছন থেকে অনেক ডাকলো কিন্তু আমি কারো কথা পাত্তা না দিয়ে রুমে চলে এলাম।

______________

উনি রুমে আসতেই আমি উনার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম।

আপনার কী হয়েছে বলুন তো? আপনি এমন অদ্ভুত বিহেইভ কেনো করছেন বলুন তো?

আমার কী হয়েছে আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। আমি নিজের হাত, পা, ঠোঁট, নাক, কান, চোখ কিছুই কনট্রোল করতে পারছি না। এই দেখ না তোমাকে দেখেই আমার এখন ঠুস ঠাস চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।

উনার দিকে আমি গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছি। আমি উনার কথা শুনে অবাক হয়নি। মোটামুটি শকড হয়েছি। উনি আমার কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বলেন,

এই ধরো এখন ইচ্ছে করছে তোমাকে জড়িয়ে ধরে……. উনি থেমে গিয়ে চোখ টিপ দিয়ে বলেন, আমি কী মিন করছি তুমি বুঝতে পারছো তো?

ছিঃ কী অশ্লীল কথা বার্তা। আপনি দূরে যান। আপনার ইনটেনশন আমার একদম ভালো ঠেকছে না।

আহা এসব বললে চলে নাকি? এখন কী দূরে দূরে থাকার সময়? এখন তো সময় কাছে আসার।

উনি আমার অনেকটা কাছে চলে আসেন। ঘাড়ের পিছনে এক হাত রাখেন। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। কারো ঝংকার তুলা হাসির শব্দ শুনে ঝটপট চোখ খুলে ফেলি। আমি চোখ খুলতেই উনি হাসি থামিয়ে দিয়ে ঠোঁট চেপে ঠোঁট চেপে ধরে আমার নাকটা হালকা টেনে বলেন,

আমার ইনটেনশন ভালো না নাকি তোমার ইনটেনশন ভালো না? হুম? বাচ্চা মানুষ বাচ্চার মতোই থাকবা। এতো বেশি ভাবতে যেয়ো না।

উনি পকেটে হাত গুঁজে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি আহাম্মকের মতো উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। এতক্ষণ কী হয়েছে কিছুই আমার বোধগম্য হয়নি। উনি কী আমাকে বোকা বানালেন? ছিঃ আমি এসব কী ভাবছিলামা?

________________

ড্রয়িংরুমে আড্ডা বসেছে। আড্ডা দিচ্ছি আমি, রুদ্র , নিয়াম ভাইয়া আর রিদি আপু। নিধি ঘুমিয়ে পড়েছে। আড্ডার মাঝেই নিয়াম ভাইয়া এক গাল হেসে বলেন,

শালাবাবু বেডরুম নামক একটা জায়গা আছে। রোমান্স করার জন্য তোমাদের বেডরুম আছে। রোমান্স বেডরুমে করার জিনিস পাবলিকলি ডাইনিং টেবিলে বসে করার জিনিস না।

নিয়াম ভাইয়ার কথা শোনা মাত্রই লজ্জায় আমার গাল দুটো রক্তিম হয়ে ওঠলো। নিয়াম ভাইয়া যে দুপুরের ঘটনাটাকেই এভাবে টেনে টুনে বলছেন। সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। রুদ্র একটা গা জ্বালানো হাসি দিয়ে নির্লজ্জের মতো বলে ওঠে,

আমি জানি রোমান্স বেডরুমে করার জিনিস। কী বলো তো বাসায় একটা বাচ্চা আছে হুট হাট রোমান্স টাইমে চলে আসে। বাচ্চাদের সামনে তো আর রোমান্স করা যায় না।

রুদ্রকে বলতে না দিয়েই নিয়াম ভাইয়া বলে ওঠে, আমার দুঃখের কথা তোমাকে আর কী বলবো? মেয়ে হয়ছে না যেনো আমার রোমান্সের শত্রু হয়ছে। ঐ বিচ্ছু মেয়ের জন্য আমি আমার বউয়ের হাতটা পর্যন্ত ধরতে পারি না।

রিদি আপু নিয়াম ভাইয়ার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে, তুমি মুখে লাগাম দিবে। ছোট ভাই-বোনদের সামনে কীসব কথা বার্তা বলছো।

ছোট ভাই বোনদেরই তো মনের দুঃখ শেয়ার করতে হয়। আমার মনে এতো দুঃখ আর আমি ওদের বলবো না।

চলবে………

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৪৮

রিদি আপু নিয়াম ভাইয়ার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে, তুমি মুখে লাগাম দিবে। ছোট ভাই-বোনদের সামনে কীসব কথা বার্তা বলছো।

ছোট ভাই বোনদেরই তো মনের দুঃখ শেয়ার করতে হয়। আমার মনে এতো দুঃখ আর আমি ওদের বলবো না।

হুট করেই রুদ্র বলে ওঠে, আপু তুমি কিন্তু কাজটা মোটেও ঠিক করো নাই।

রিদি আপু ভ্রু কুচকে বলে, আমি আবার কী করলাম?

তুমি নিধিকে কেনো বলছো রিয়াকে খালামনি ডাকতে? রিয়া আমার বউ। তাহলে নিধি তো রিয়াকে মামি ডাকবে তাই না?

নিয়াম ভাইয়া সুর টেনে বলে, এখানে উপস্থিত সকলেই জানে রিয়া তোমার বউ। তাই রিয়া আমার বউ এমন করে বলতে হবে না। রিয়া তোমার বউ হওয়ার আগে তোমার খালাতো বোন ছিল। সেই হিসেবে রিদিরও বোন। তাই রিদি নিধিকে বলেছিল রিয়াকে খালামনি ডাকতে।

সে যাইহোক আপু তুমি নিধিকে বলবা রিয়াকে মামিমনি ডাকতে।

রিদি আপু বিরক্ত হয়ে বলে, তুই এমন করছিস কেনো? নিধি রিয়াকে খালামনি ডাকুক আর মামিমনিই ডাকুক তাতে তোর কী? রিয়ার যদি সমস্যা না হয় তোর কী সমস্যা?

আমিও রিদির আপুর সাথে তাল মিলিয়ে বললাম, সেটাই তো আমার যখন সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে আপনার এতো সমস্যা কেনো হচ্ছে? আমি নিধির মামিমনি হওয়ার আগে খালামনি আর নিধির মুখ থেকে খালামনি ডাক শুনতে তো আমার বেশ লাগে।

নিয়াম ভাইয়া আলতো হেসে রুদ্রর পিঠে চাপ্পড় মেরে বলে, এই বেয়াদব মহিলাগুলো আমাদের মতো অসহায় প্রেমিক পুরুষের দুঃখ কোনোদিন বুঝবে না। ওরা বুঝতেই পারছে না তুমি যে ইনসিকিউর ফিল করছো।

আমি ভ্রু কুচকে বলি, খালামনি ডাকের সাথে ইনসিকিউর ফিল করার কী আছে?

ভাই সত্যিই বলছো। বউরা স্বামীর মন বুঝে না আর যদি হয় বাচ্চা বউ তাহলে তো কথায় নাই। যেখানে বুঝার দরকার নাই সেখানে ‘ক’ বলতেই কলকাতা বুঝে যাবে আর যেখানে বোঝার দরকার সেখানে কলকাতার ‘ক’ টাও বুঝবে না। রিয়া একদিন নিধিকে নিয়ে স্কুলে গেল। নিধিকে সবার কাছে রিয়াকে খালামনি বলে পরিচয় করিয়ে দিল। রিয়া যে বিবাহিত সেটা তো রিয়াকে দেখে মনে হয় না। নিধির স্কুলের কোনো টিচার যদি রিয়াকে প্রোপোজ করে বসে বা বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে তখন।

রুদ্রর কথা শুনে আমি কপালে হাত দিয়ে বসে পড়লাম। একটা খালামনি ডাক থেকে উনি বিয়ের প্রস্তাব পর্যন্ত চলে গেছেন। রিদি আপুর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে রিদি আপু রুদ্রর ওপর মহা বিরক্ত।

রুদ্র তোর মনে হয় না তুই একটু বেশিই অদ্ভুত আচারণ করছিস? বউ কী শুধু তোর একারই আছে? আর কারো বউ নেই?

সবার বউ থাকলেও আমারটার মতো এমন রসগোল্লা টাইপ বউ কারো নাই। তাই আমি কোনো রিস্ক নিতে পারবো না।

____________

অফ পিরিয়ডে হুট করেই ইফাদ স্যার ডেকে পাঠায়। ইফাদ স্যার ডেকে পাঠিয়েছে এটা শুনেই আমার আত্না কেঁপে ওঠে। রুদ্র যদি জানতে পারে তাহলে তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিবে। পরে ভাবলাম ত্রয়ীকে নিয়ে যায়। রুদ্রর কিছু বললে বলে দিব ত্রয়ী আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। আমার সেই আশাতেও জল ঢেলে দিল ইফাদ স্যারের এসিট্যান্ট। স্যার নাকি আমাকে একা যেতে বলেছে।

আমি ধুরু ধুরু বুকে ইফাদ স্যারের রুমের সামনে আসি। বার বার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি আশেপাশে কোথাও রুদ্র আছে কী না। যদি থাকে আর আমাকে যদি ইফাদ স্যারের কেবিনে যেতে দেখে। তাহলে আমার খবর আছে। কেবিনের দরজায় নক করতেই স্যার ভিতরে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেন। আমি পা টিপে টিপে রুমে প্রবেশ করলাম।

সিট ডাউন।

স্যার বলার সাথে সাথেই আমি বসে পড়লাম। আমি বসতেই স্যার ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলেন। টিস্যু দিয়ে বার বার কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুচ্ছেন। উনি অস্বস্তিতে হাসফাস করছেন।

স্যার আপনি কী কিছু বলবেন?

উনি দ্বিতীয় বারের মতো আরো এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলেন। উনি আমতা আমতা করে বলেন,

একচুয়ালি তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল। কীভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। তুমি আমার ছাত্রী তোমাকে এই কথাগুলো বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না।

স্যার আপনি র্নিদ্বিধায় বলতে পারেন।

উনি কিছু বললেন না। কিন্তু বেশ কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে নিলেন। রুম জুড়ে পায়চারী করছেন। উনার কর্ম কান্ডে আমি অল্প বিস্তর বিরক্ত হলাম। এটা কোন ধরেন বিহেইভিয়ার বুঝতে পারছি না। রুমে ডেকে এনে বসিয়ে রাখলেন। আমার সামনেই একের পর এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলেন। এখন আমাকে বসিয়ে রেখেই রুমময় দৌড়াদৌড়ি করছেন। বিরক্ত হলেও নিজের বিরক্তিটা প্রকাশ করতে পারছি না। ইফাদ স্যার হালকা কাশি দিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবার আমতা আমতা শুরু করলেন। এদিকে আমি অধির আগ্রহে স্যারের মুখপানে তাকিয়ে আছি।

একচুয়ালি ….. একচুয়ালি আমি ত্রয়ীকে পছন্দ করি। পছন্দ করি বললে ভুল হবে আমি ত্রয়ীকে ভালোবাসি।

কথাটা আমার কানের কাছে বজ্রপাতের ন্যায় বাঁজল। উনার কথাটা শোনা মাত্রই আমি চমকে ওঠলেন। হয়তো উনি আরো কিছু বলছিলেন সেগুলো আমার কর্ণগোচর হলো না। আমি নিরবে স্যার কক্ষ থেকে প্রস্থান করলাম। এদিকে আমি ভাবছি এই কথাটা ত্রয়ী জানলে কী হবে? ইফাদ স্যারের জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে। স্কুল লাইফে ত্রয়ীর প্রাইভেট টিউটর ত্রয়ীকে প্রোপোজ করেছিল। সেটা নিয়ে ত্রয়ী যা কান্ড করেছিল। ইফাদ স্যারের কথা জানলে তো ইফাদ স্যারের কী অবস্থা করবে সেটা আল্লাহ ভালো জানে।

কীরে স্যার তোকে কী বললো? এতক্ষণ ধরে তোরা কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করলি?

ত্রয়ী আমার কাধে হালকা ধাক্কা দিয়ে কথাটা বললো। ত্রয়ীর কথা পাত্তা না দিয়ে আমি হাঁটতে শুরু করলাম।

কীরে বলবি না? এই ব্যাটায় তোরে প্রোপোজ টোপোজ করে ফেলেনি তো? আমার কী মনে হয় জানিস এই বেয়াদব ডক্টর তোকে পছন্দ করে। যদি তোকে প্রোপোজ করে তাহলে তুই ঠাস ঠাস করে দুইটা থাপ্পড় মারবি। তুই না পারলে আমাকে বলবি।

ত্রয়ীর কথা শুনো আমি থেমে গেলাম। ত্রয়ী তো আর জানে না তার বেয়াদব ডক্টর আমাকে না তাকে পছন্দ করে। তাকেই প্রোপোজ করার প্রিপারেশন নিচ্ছে।

__________________

বাসায় আসতেই আমার পুরো গোষ্ঠীকে ডয়িংরুমে বসে থাকতে দেখে আমি চমকে ওঠলাম। চমকা-চমকি সাইডে রেখে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলাম।

তোমরা সবাই হুট করে একসাথে আমার শ্বশুরবাড়িতে হামলা করেছো। কাহিনী কী?

ভাইয়া একটু ভাব নিয়ে বলে, কাহিনী কিছুই না। তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে। তাই এই খানদানি ফকিরের দল খেতে আসছে।

এর মাঝে আমার বিয়ে পাগল কাজিন বলে ওঠে, আজকে অপমান করছো। কিছু বলবো না। বিশেষ ছাড় দিলাম। ছ্যাঁকা না খেয়েও ছ্যাঁকা খাওয়ার ফিলিংস হচ্ছে। আমাদের এক বারই বিয়ে হয় না। সেখানে রিয়া আমাদের ছোট বোন হয়ে দুই দুইবার বিয়ে করে ফেলবে।

সবার কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সবাই এসব কী বলছে? আমার আবার বিয়ে মানে কী?

তোমরা এসব কী বলছো? আমার আবার বিয়ে এসবের মানে কী?

মামুনি এসে বলে, রিয়া তুই কলেজ থেকে এসেছিস রুমে যা। একটু ফ্রেশ হয়ে অল্প কিছু খেয়ে নে। এদের কথায় পাত্তা দিস না। বিয়ে হবে না তোর আর রুদ্রর রিসেপশন হবে।

মানে কী এসবের? বিয়ের এতদিন পর রিসেপশন। তোমার ছেলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?

আমি কিছু জানি না বাবা তোদের ব্যাপার তোরাই বুঝে নে।

চলবে……..