পূর্ণিমাতিথি পর্ব-৫২+৫৩+৫৪

0
604

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৫২

তুই নিজের লাইফে মুভ অন করেছিস এটা দেখার পর নিজেকে অনেকটা হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে একটা অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেলাম। তুই ভাবির সাথে ভালো আছিস, সুখে আছিস এটা জানার পর আমাদের থেকে বেশি খুশি হয়তো কেউ হয়নি। এতোদিন ধরে একটা অপরাধবোধ আমাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। মনে হতো আমাদের জন্যই তোর লাইফটা এমন হয়ে গেছে। তুই তো প্রথমে অরির সাথে রিলেশনে যেতে চাসনি। আমাদের জন্যই রাজী হয়েছিলি। তুই যদি লাইফে কোনো দিন মুভ অন না করতি। তাহলে হয়তো আমরা নিজেদের কোনো দিন ক্ষমা করতে পারতাম না।

রুদ্র হাত দিয়ে নাইম ভাইয়াকে থামিয়ে দিল।

চুপ কর। এসব পুরোনো কথা না টানাই ভালো। আমি আমার লাইফে অনেক হ্যাপি আছি। তবে আমি অরির কাছেও কৃতজ্ঞ এবং তোদের কাছেও কৃতজ্ঞ। অরি যদি আমাকে ছেড়ে না চলে যেতো তাহলে হয়তো আমি রিয়ার মতো কাউকে নিজের জীবন সঙ্গিনী হিসেবে পেতাম না। তোরা তো আমার ভালোর জন্যই বলছিলি। তোরা কী আর জানতি অরি এমন টাইপ মেয়ে। আমি আমার লাইফ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। রিয়ার মতো কাউকে নিজের লাইফ পার্টনার পাওয়ার পর কেউই আর খারাপ থাকতে পারে না। জীবনে হয়তো কোনো ভালো কাজ করেছিলাম তার বিনিময়ে হয়তো রিয়াকে পেয়েছি। মেয়েটা আমাকে ছাড়া কিছু বুঝে না। তার সব ভালো লাগা খারাপ লাগা আমাকে ঘিরেই।

ইলান ভাইয়া একটু আগ্রহী হয়ে বলেন, তোকে আমি প্রশ্নটা আগেও জিঙ্গেস করেছিলাম। আজকে আবার জিঙ্গেস করছি। তুই কী রিয়াকে ভালোবাসিস?

ভালোবাসা রং বদলায়। সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসা কমে যায় বা বেড়ে যায়। বাট সি ইজ মাই লাইফ। এই যে বুকের বা পাশটা দেখতে পাচ্ছিস। এখানে সবটা জুড়েই ওর বসবাস। রিয়া আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছে। ওকে ছাড়া আমার পক্ষে বাঁচা সম্ভব না। জানিস ওর চোখের এক ফোটা অশ্রু আমি সহ্য করতে পারি না। ওর অশ্রুতে টই টম্ভুর চোখ দুটো দেখলে বুকের বা পাশে চিন চিন ব্যথা হয়। ওর চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রু যদি আমার জন্য গড়িয়ে পড়ে তাহলে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে।

এনাম ভাইয়া আলতো হেসে বলেন, ইলান আমাদের বন্ধু ভাবির প্রেমে মজনু হয়ে গেছে। এই যুগের মজনু ড. আরাফ আয়মান রুদ্র। এই শহরের প্রতিটি বিল বোর্ডে আমি লিখে দিব এই যুগের মজনু ড. আরাফ আয়মান রুদ্র শুধু রিয়ার।

আমি আমার ওখানে দাঁড়ালাম না। দ্রুত পা চালিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। সোফায় এসে বসতে না বসতেই আমার ফোনটা বেজে ওঠলো। ফোনটা আর কেউ নয় ত্রয়ীই করেছে। আমি ফোনটা রিসিভ করতেই ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্নার শব্দ আমার কর্ণগোচর হলো। আমি অস্থির হয়ে বলে ওঠলাম,

এই ত্রয়ী কী হয়েছে? তুই কাঁদছিস কেনো? বল আমাকে।

ঐ রিয়া।

কী?

আজকে আমাকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসছে। আমি এখন কিছুতেই বিয়ে করবো না।

গাধা মেয়ে দেখতে আসলেই কী বিয়ে হয়ে যাবে? ওরা তো যাস্ট তোকে দেখতে আসছে। পছন্দের একটা ব্যাপার স্যাপার আছে না। তোকে ওদের পছন্দ হলে পরে তো বিয়ের কথা। তোদেরও তো পাত্র পছন্দ হতে হবে।

আমি এতকিছু বুঝি না। পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে আসলে আমি সুইসাইড করবো।

কথাটা বলেই ত্রয়ী কল কেটে দিল। আমি ত্রয়ীকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বার বার ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। এখন আমার টেনশন হচ্ছে। ত্রয়ী যা জেদী মেয়ে। জেদের বশে কিছু করে না বসে। আন্টি ফোন দিচ্ছে। আমি ফোনটা রিসিভ করলাম।

আসসালামু আলাইকুম আন্টি।

ওয়ালাইকুম আসসালাম মামুনি। কেমন আছো তুমি?

এই তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আন্টি আপনি কেমন আছেন?

আছি এক রকম মা। এই পাগল মেয়েকে নিয়ে কী আর ভালো থাকা যায়। মেয়েটা আমার একটা কথাও শুনে না।

আমি বিষয়টা জানি তবু না জানার ভাণ করে জিঙ্গেস করলাম,

কী হয়েছে আন্টি? কোনো সমস্যা।

আর বলো না ত্রয়ীর জন্য একটা ভালো বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ছেলেটা ডক্টর। তুমি হয়তো চিনবে। তোমাদের মেডিক্যালেরই ডক্টর। ছেলেটার নাম ইফাদ। কিন্তু মেয়ে আমার এখন কিছুতেই বিয়ে করবে না। আমি বললাম তোকে এখন বিয়ে করতে তো আমরা বলছি না। তুই পাত্রপক্ষের সামনে যা। ছেলেটাকে দেখ। যদি পছন্দ না হয় আমাদের বলে দিবি। আমরা উনাদের না করে দিব। আমরা তো আর তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে ছেলেটার সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দিব না। কিন্তু মেয়ে তো আর আমার কথা শোনার পাত্রী না। ওর এক কথা না এখন বিয়ে করবে আর না পাত্রপক্ষের সামনে যাবে। রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। তুমি একটু এসে ত্রয়ীকে বুঝাও। জানি এখন তোমার বিয়ে হয়ে গেছে এভাবে হুট হাট শ্বশুরবাড়ি থেকে আসা যায় না। কিন্তু আমি নিরুপায় হয়ে তোমাকে ফোন করেছি। ও যদি এখন বিয়ে করতে না চায় তাহলে আমরাও বিয়ে দিব না। কিন্তু পাত্রপক্ষের সামনে না গেলে আমাদের মান-সম্মান থাকবে না।

আমি হাসিমুখে বললাম, আন্টি এটা আমার শ্বশুরবাড়ি না আমার খালামনির বাড়ি। যখন তখন যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারি।

আচ্ছা তাহলে তুমি আসো।

জ্বী আন্টি আমি আসছি।

ফোনটা রেখে আমি মামুনিকে উদ্দেশ্য করে বললাম, মামুনি আমি একটু ত্রয়ীদের বাসায় যাচ্ছি।

রুদ্রকে সাথে নিয়ে যা। রুদ্র না গেলে ড্রাইভার নিয়ে যাবি। রিক্সা করে যাওয়ার একদম চেষ্টা করবি না আর সাবধানে যাবি।

আচ্ছা।

__________________

আমি দ্রুত রুমে চলে আসলাম। এনাম ভাইয়া, ইলান ভাইয়া, নাইম ভাইয়া আর রুদ্র আড্ডা দিচ্ছে। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে কাবার্ড থেকে জামাকাপড় বের করতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। ড্রেস নিয়ে পিছনে ফিরতেই রুদ্রকে দৃষ্টিগোচর হল। রুদ্র আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, তুমি কী কোথাও বের হচ্ছো?

আমি কিছু বলার আগেই ঐ পাশ থেকে নাইম ভাইয়া বলে ওঠলেন, হ্যাঁ গো মজনু তোমার লাইলি এখন বের হবে।

রুদ্র উনাদের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাল। কিন্তু এতে উনাদের কোনো হেলদুল নেই। উনারা উনাদের মতোই হাসিতে মত্ত। রুদ্র আবার আমাকে প্রশ্ন করল,

কোথায় যাবা?

ত্রয়ীদের বাসায়। ইফাদ স্যার বিয়ের প্রস্তাব পাঠাইছে ত্রয়ীদের বাসায়। ত্রয়ী রেগে গিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে।

চল আমি যাই।

আপনি কোথায় যাবেন?

কেনো তোমার সাথে ত্রয়ীদের বাসায়।

আপনি গেলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে না।

আমি কী তোমাকে একা যেতে দিব নাকি? তোমাকে আমি একদম একা ছাড়ব না। ত্রয়ীদের বাসায় না যাই তোমাকে ত্রয়ীদের বাসা পর্যন্ত ঢ্রপ করে দিয়ে আসি চল।

অহো বউয়ের প্রতি কতো প্রেম।

তিনজন একসাথে সুর মিলিয়ে বলে ওঠলো। আমি লজ্জা পেয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম।

_________________

উনি শেষ পর্যন্ত আমার সাথেই আসলেন। এক ধ্যানে আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবতেই অবাক লাগে এই সুদর্শন পুরুষটা শুধু আমার। এই মায়াময় মুখশ্রী দেখার অধিকার শুধু আমার আছে আর কারো নেই। হুট করে গাড়ি থেমে যাওয়া আমার ভাবনাচ্ছেদ হলো। আমি প্রশ্নসুচক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকাই। উনি কিছু না বলে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন মাথা থেকে উড়নাটা সরিয়ে খোপা করা চুলগুলো এক টানে খুলে ফেললেন। আমি ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনার কোনো কর্মকাণ্ডই আমার বোধগম্য হচ্ছে না।

এতোদিন ধরে দুজন একসাথে থাকি। কিন্তু এতোদিনেও তোমার এই সৌন্দর্যময় চুলের হদিস পাইনি। গতরাল রাতে যদি না দেখতাম। তাহলে তো জানতেই পারতাম না আমার প্রেয়সীর চুল এতো সুন্দর।

উনার হাতের বেলি ফুলের মালাটা আমার চুলে জড়িয়ে দিলেন। ভালোবাসাময় কন্ঠে বলে ওঠলেন,

আমার এলোকেশরী কন্যা।

চলবে……..

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৫৩

এতক্ষণ আন্টির মিষ্টি কথায় হচ্ছিল সেখানে আমি এসে কিছু কলিজা জ্বলানো কথা বলতেই ত্রয়ী এসে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলে দিতেই আমি ত্রয়ীকে ধাক্কা দিয়ে রুমে ঢুকে পড়লাম। আমার পিছন পিছন আন্টিও আসলো। আন্টি মোলায়েম গলায় বলল,

ত্রয়ী মা আমার কথাটা একটু শুন।

আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না।

আন্টি এই মেয়ে ভালো কথা শোনার মেয়ে না। মিষ্টি কথা বলেও লাভ নাই। মিষ্টি কথা বলে তো কোনো কাজ হয়নি এখন আপনার উচিত ওকে ঠাস ঠাস করে দুটো থাপ্পড় মেরে বুঝানো ।

রিয়া তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে আমার সাথে এমন করছিস?

তুই এমন ঢং করছিস কেনো? দেখতে আসলেই কী বিয়ে হয়ে যায়? নাকি তুই নিজেকে বিশ্বের সেরা সুন্দরী মনে করিস? যে তোকে কেউ দেখতে আসলে তোকে বিয়ে না করে তোর বাসা থেকে এক পা নড়বে না।

দেখতে আসলেই কী বিয়ে হয়ে যায়? এই কথা ওপর ভরসা করেই বাংলাদেশের ৫০% মেয়ে ফেসে যায়।

আন্টি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম থেকে চলে গেলেন। উনি হয়তো বুঝে গেছেন উনার মেয়েকে বুঝানোর সাধ্য কারো নেই। আন্টি রুম থেকে চলে যেতেই আমি দুই হাত ত্রয়ীর গাল আঁকড়ে ধরলাম।

এই মেয়ে আমার দিকে তাকা আচ্ছা যা তাকাতে হবে না। আমার কথাটা তুই একটু শোন। তুই ছাড়া তোর বাবা মার আর কোনো সন্তান নেই। তুই জানিস তোর বাবা অসুস্থ। আর কতদিন বাঁচবে তার গ্যারান্টি নেই। আংকেল তোর চিন্তায় চিন্তায় আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তুই শুনলে হয়তো অবাক হবি আংকেল এর সপ্তাহ আগে আমার কাছে ফোন দিয়ে কান্না-কাটি করেছে। আংকেলের কন্দনরত গলা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। উনি বার বার একটা কথায় বলছিলেন, আজ আমার যদি কিছু হয়ে যায় আমার স্ত্রী আর মেয়েকে কে দেখবে? কে ওদের খেয়াল রাখবে? কে ওদের এই স্বার্থপর ভয়ঙ্কার সমাজ থেকে রক্ষা করবে? আমি মারা গেলেও ওদের টাকা পয়সার অভাব হবে না। আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে অনায়সে ত্রয়ী আর ত্রয়ীর মার সারা জীবন কেটে যাবে। হয়তো তোমার মনে হচ্ছে আমি মেয়েদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছি। তা কিন্তু মোটেও নয় আমাদের এই সমাজ যতই বলুক নারী এবং পুরুষের সমান অধিকার। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তা হয় না। কারণ এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এই সমাজে মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু। একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের ভালো দেখতে পারে না। তোমার আন্টিই বা আর কয়দিন বেঁচে থাকবেন। একা একটা মেয়ে বেঁচে থাকা যে কতোটা কঠিন সেটা আমার মেয়ে বুঝতে পারছে না। তুমি জানো আমি যে কাজ করতাম সেই কাজে আমার শত্রুর অভাব ছিল না। এখন নেই তা কিন্তু নয়। সুযোগ পেলেই আমার পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে ওরা পিছপা হবে না। প্রতিশোধের নেশায় ওরা অন্ধ হয়ে আছে। এরকম একটা অবস্থায় নিজের স্ত্রী ও মেয়েকে ফেলে রেখে যে আমি মরেও শান্তি পাব না। আমি তো ত্রয়ীকে বিয়ে দিয়ে মেয়ের জামাই না একটা ছেলে নিয়ে আসতে চাইছি। যে আমার অবর্তমানে ত্রয়ী আর ওর মায়ের খেয়াল রাখবে।

আমি ত্রয়ীর মুখটা নিজের দিকে ঘুরালাম, এখনো চুপ করে থাকবি কিছু তো বল। আংকেল তোর জন্য টেনশন করতে করতে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আংকেলকে এই সময় টেনশন মুক্ত রাখতে হবে।

ত্রয়ী কিছু বললো না বুঝলাম মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। আমি ত্রয়ীকে কালো রঙের একটা শাড়ি পড়িয়ে দিলাম। ত্রয়ীকে হালকা করে সাজিয়ে দিলাম। এর মাঝে আন্টি একবার এসে দেখে গেছে। ত্রয়ীকে রেডী হতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণ পর আন্টি এসে বলল উনারা চলে এসেছেন। আর ত্রয়ীকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।

আমি ত্রয়ীকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এলাম। ত্রয়ী মাথা নিচু করে আছে। মাথা নিচু রেখেই সালাম দিল। আমি ত্রয়ীকে সোফায় বসিয়ে দিলাম। হুট করে ত্রয়ী সামনে তাকাল বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না ত্রয়ী ইফাদ স্যারকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেছে। ত্রয়ী ইফাদ স্যার আর আমার দিকে একবার তাকিয়ে হন হন করে ড্রয়িংরুম ত্যাগ করলো। আমিও সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে ত্রয়ীর পিছনে দৌড় দিলাম। ত্রয়ী বিছানায় উল্টো ঘুরে বসে আছে। আমি রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললাম,

এসবের মানে কী ত্রয়ী? তুই এভাবে চলে এলি কেনো? এটা কোন ধরনের অসভ্যতামো?

ত্রয়ী আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টো আমাকে প্রশ্ন করে বসলো, তুই সবকিছু আগে থেকেই জানতি তাই না? তুই জানতি ইফাদ স্যার আমাকে দেখতে আসছে?

আমি ত্রয়ীর প্রশ্নের কী জবাব দিব ভেবে পাচ্ছি না। মিথ্যা বলেও লাভ নেই। আমতা আমতা করে বললাম, হ্যাঁ।

আমার হ্যাঁ বলতে দেরি হলেও ত্রয়ীর আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়তে দেরি হলো না। ত্রয়ী আমার দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে বলে, তুই আমার সাথে এটা কী করে করতে পারলি? আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে আমার সাথে এমন বেঈমানি করতে পারলি।

ওর কোনো দোষ নেই। যা করার আমি করেছি।

ইফাদ স্যারের কন্ঠসর কর্ণগোচর হতেই ত্রয়ী তড়িৎ গতিতে উল্টো ঘুরে গেল। আমি পিছন
ফিরে তাকালাম। ত্রয়ী শক্ত গলায় বলে,

আপনি এখান থেকে চলে যান। আমি আপনার সাথে কোনো কথা বলতে চাই না। আপনি এখান থেকে চলে যান।

আমি তোমার সাথে আলাদা করে কিছু কথা বলতে চাই।

আমি চলে আসতে নিলেই ত্রয়ী আমার হাত ধরে আটকে দিল। ত্রয়ী আমার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে, খবরদার তুই যদি এখান থেকে এক পা নড়িস তোর পা ভেঙে আমি ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিব।

রিয়া তুমি থাক। তোমার সামনেই বলতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমি কী দেখতেই এতোটা খারাপ যে আমাকে ভালোবাসা যায় না? আমার ভালোবাসাটা হয়তো কোনোদিন তোমার সামনে প্রকাশ করা হয়নি। আমার ভালোবাসার গভীরতা মাপার ক্ষমতা তোমার নেই। তোমার যদি আমার প্রফেশন নিয়ে প্রবলেম হয়। তাহলে আমি ছেড়ে দিব আমার প্রফেশন। তোমার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি। আর যদি প্রবলেমটা আমাকে নিয়ে হয়ে তাহলে আমাকে না হয় নিজের মতো করে গড়ে নিয়ো। আর না হয় আমিই তোমার মনের মতো হয়ে ওঠবো। আমাকে দুইটা মাস সময় দাও। তুমি যখন কিছু বলছো না তখন আমি মৌনতাকেই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিলাম। আসি। ভালো থেকো।

__________________

আমি রুমে আসতেই উনি ধাক্কা দিয়ে আমাকে বিছানায় ফেলে দিলেন। আমাকে ফেলে দিয়ে নিজেও আমার পাশে শুয়ে পড়লেন।

কী করছেন কী আপনি?

হুসস। নো মোর টক। তোমার সবার দিকেই খেয়াল আছে শুধু আমার দিকেই নেই। সারাদিনে একবারও তোমার এই রুদ্র নামক ব্যক্তিটার কথা মনে পড়ে না তাই না?

আপনাকে ভুলে গেলাম কবে যে আপনার কথা মনে পড়বে?

মাঝে মাঝে তো ভুলেই যাও যে তোমার একটা বর আছে। যে চাতক পাখির ন্যায় তোমার অপেক্ষায় বসে থাকে।

তিনি আমার গালে আলতো করে আঙ্গুল ছুঁয়ে দিতে দিতে কথাগুলো বললেন। উনি আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে আরেকটু কাছে টেনে নিলেন। আমার গলায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলেন। আমি উনার শার্ট খামছে ধরলাম।

________________

রুদ্র শুধু রিসেপশনের কথা বলতেই সেই কথার ঘোর বিরোধীতা করলেন এনাম ভাইয়া আর নাইম ভাইয়া। উনাদের মতে রুদ্র বিয়েতে কেউ উপস্থিত থাকতে পারেনি তাই বিয়ের সকল অনুষ্ঠানই করা হবে। অনুষ্ঠান হিসেবে সিলেক্ট করা হয়েছে শহর থেকে অদূরে নাইম ভাইয়াদের বিলাশ বহুল দাদার বাড়ি। নাইম ভাইয়ারা সপরিবারে দেশের বাইরে থাকে। তাই ঐ বাসা খালিই পড়ে আছে।

চলবে…………

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৫৪

রুদ্র শুধু রিসেপশনের কথা বলতেই সেই কথার ঘোর বিরোধীতা করলেন এনাম ভাইয়া আর নাইম ভাইয়া। উনাদের মতে রুদ্র বিয়েতে কেউ উপস্থিত থাকতে পারেনি তাই বিয়ের সকল অনুষ্ঠানই করা হবে। অনুষ্ঠান হিসেবে সিলেক্ট করা হয়েছে শহর থেকে অদূরে নাইম ভাইয়াদের বিলাশ বহুল দাদার বাড়ি। নাইম ভাইয়ারা সপরিবারে দেশের বাইরে থাকে। তাই ঐ বাসা খালিই পড়ে আছে।

ডিসিশন হলো আগামীকাল সকাল সকাল আমরা সবাই মিলে নাইম ভাইয়াদের ঐ বাসায় যাব আর অনুষ্ঠান চলবে পাঁচদিন ব্যাপী।

রুদ্র রেডী হচ্ছে হসপিটালে যাওয়ার জন্য। উনি হসপিটালে ছুটি জন্য যাচ্ছেন আর সবাইকে ইনবাইট করার জন্য। আমিও রেডী হয়ে নিলাম। আমাকেও তো ছুটি নিতে হবে। দুজনেই একসাথে বের হলাম।

__________________

স্যারের রুম থেকে বের হতেই দেখতে পেলাম আমার থেকে কিছুটা দূরেই ইফাদ স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। উনার সাথে একজন মহিলাও আছে। একটু এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারলাম মহিলাটা ইফাদ স্যারের মা। আরেক পা এগিয়ে যেতেই ইফাদ স্যারের মার কথা শুনে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম।

তুই যেই মেয়েকে পছন্দ করেছিস, যাকে বিয়ে করতে চাস। সে তো তোকে সহ্যই করতে পারে না। জোর করে বিয়ে করে তো আর সুখী হওয়া যায় না। আর আমাকে যদি জিঙ্গেস করিস আমার ত্রয়ীকে কেমন লেগেছে? তাহলে আমি বলবো ত্রয়ী মেয়েটা হয়তো একটু সুন্দরী। কিন্তু আমার ওর বান্ধবী রিয়াকেই বেশি ভালো লেগেছে। মেয়েটা কতো হাসিখুসি। চঞ্চল, মিশুক। কতো সহজেই মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে। তুই তো জানিস তোর পছন্দই আমার পছন্দ। তোর কোনো কিছুতেই আমি কোনো দিন আপত্তি করিনি। তোর স্বাধীনতাই হস্তক্ষেপ করি নাই। এবারও করতাম না। কিন্তু ত্রয়ী মেয়েটা তো তোকে পছন্দ করে না। আমার মনে হয় রিয়াই তোর জন্য একদম পারফেক্ট।

আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউযুবিল্লাহ। আম্মু তুমি তওবা করো তাড়াতাড়ি। যে কথা বলেছো সেই কথা আর মনেও এনো না। রিয়া ড. রুদ্রর ওয়াইফ। বেচারা নিজের ওয়াইফকে নিয়ে কতোটা পসেসিভ তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আমি ওর সাথে যাস্ট একটু কথা বলতাম দেখে ড. রুদ্র আমার দিকে যেভাবে তাকাতেন মনো হতো আমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন।

আমি আর ঐদিকে পা বাড়ালাম না। আলতো হেসে ওখান থেকে চলে এলাম।

__________________

ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে সকাল সকাল দল বেঁধে রওনা দিলাম। ইফাদ স্যারকে স্পেশালি দাওয়াত করা হয়েছে। তবে ইফাদ স্যার আমাদের সাথে যাবেন না। উনি আলাদা যাবেন। ত্রয়ী যদি জানতে পারে ইফাদ স্যারও আমাদের সাথে যাচ্ছেন তাহলে ত্রয়ী বেঁকে বসতে পারে। হয়তো ত্রয়ী শেষ পর্যন্ত যাবেই না। ত্রয়ী জানে ইফাদ স্যার বিয়ের দিন যাবেন। ইফাদ স্যার আমাদের সাথে যাওয়ার প্ল্যানটা অবশ্য রুদ্রর। উনিই সব ব্যবস্থা করেছেন। উনার মতে ইফাদ স্যারের এখন ত্রয়ীর আশেপাশে থাকার দরকার।

_________________

নাইম ভাইয়াদের বাসায় যাওয়া হবে বাসে করে। এই প্ল্যানটা অবশ্য এনাম ভাইয়া আর ইলান ভাইয়ার। বাসে করে যাওয়ার কথা শুনেই রুদ্র নাক মুখ কুঁচকে ফেলেন। উনি কিছুতেই বাসে করে যাবেন না। বাসে করে না যাওয়ার জন্য উনি বিভিন্ন বাহানা করা শুরু করেন। বাসে যাওয়ায় কতো প্রবলেম হবে সেগুলো দেখাতে শুরু করেন। রুনা আপু প্রেগনেন্ট, এনাম ভাইয়ার আম্মু অসুস্থ। এই অবস্থায় উনাদের বাসে চড়া একদম ঠিক না। রুনা আপুর কথা বলতেই ইলান ভাইয়া দমে যায়। কিন্তু এনাম ভাইয়াকে কোনো মতেই দমাতে পারেননি। এনাম ভাইয়া ঠিক করেন রুনা আপু আর উনার আম্মু গাড়ি করে যাবেন আর সবাই বাসে করে। সেখানে বাদ সাধে রুনা আপু। উনি কিছুতেই গাড়ি করে যাবে না।
সবাই আনন্দ করে যাবে আর সে বরিং জার্নি করবে তা হতে পারে না। ইলান ভাইয়া চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই রুনা আপু চুপসে যায়।

বাসে ওঠতে গিয়েই রুদ্র নাক মুখ কুঁচকে ফেলে। তা দেখে ইলান ভাইয়া এসে ফেলে। নাইম ভাইয়া রুদ্রর পিঠ চাপড়ে বলে,

তুই কিন্তু গাড়ি করে যেতে পারিস। তুই বরং রুনাদের সাথে গাড়ি করেই চলে যা। আমি ইলান আর এনামকে ম্যানেজ করে নিবো।

রুদ্র আমার এক হাতে আগলে ধরে বলে, চলো রিয়া আমরা বরং গাড়ি করেই যাই।

ইলান ভাইয়া আমার আরেক হাত চেপে ধরে বলেন, তোকে যাওয়ার পারমিশন দিয়েছি রিয়াকে না। রিয়া আমাদের সাথেই যাবে।

রুদ্র ভ্রু কুচকে বলে, আমার বউ তোদের সাথে যাবে কেনো? আমার বউ আমার সাথে যাবে।

তুই বরং রিয়াকেই জিঙ্গেস কর রিয়া কাদের সাথে যেতে চায়?

ইলান ভাইয়া আমি অবশ্যই আপনাদের সাথে যাব। আমার বাসে করে জার্নি করতে অনেক ভালো লাগে। নাচ, গান হই হুল্লোড় উফ ভাবতেই খুশি খুশি লাগছে।

রুদ্র আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়। আমি উনার দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি দিয়ে বলি,

আপনার তো বাসে চড়তে ভালো লাগে না। আপনি বরং গাড়ি করেই যান। আমি বাসে করেই যাব।

কথাগুলো বলেই আমি দুই লাফে বাসে ওঠে পড়লাম। আমি মাঝখানে সিটে বসতে গেলেই রুদ্র আমার হাত টেনে ধরে পিছনে নিয়ে এসে বসিয়ে দেয়।

এই আপনি আমাকে পিছনে নিয়ে আসলেন কেনো?

তোমার জন্য আমাকে বাসে করে যেতে হচ্ছে। ভাবছো আমি তোমাকে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দিব। এখন রোমান্স চলবে। বাসে করে যাচ্ছি পাশে একজন হট এন্ড…….. চোখ মেরে বলে, বুঝতেই তো পারছো।

ছিঃ আপনি এসব কী ভাষা করছেন? আপনি আগেই ভালো ছিলেন।

আমি কখনোই ভালো ছিলাম না। আমি তো অন্য কাউকে বলছি না। নিজের বিয়ে করা বউকে বলছি। তোমাকে সবকিছু বলার লাইসেন্স আমার আছে। ইউ আর লুকিং হট।

ছিঃ।

আমি নাক মুখ কুচকে অন্য দিকে ঘুরে গেলাম। ঠিক তখনি উনার অট্টহাসি আমার কানে এলো। আমি উনার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালাম।

আরে বাবা আমি মজা করছিলাম। তুমি সিরিয়াসলি নিচ্ছো কেনো? তোমার সাথে এই ওয়ার্ডগুলো যায় না। তোমাকে দেখে কেউ বলবে না ইউ আর লুকিং হট। তোমাকে দেখে বলবে গুলুমুলু বাবুটা। বেবিডল। বুঝছো?

আপনি আমাকে অপমান করছেন কিন্তু।

আহা বাবুটা মান অপমানও বুঝে।

আমি উনার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাই। উনি আমার চোখ রাঙানো দেখে হো হো করে হেসে দেন।

_____________________

নাইম ভাইয়াদের আলিশান বাড়ি। এই জায়গাটাকে ঠিক শহরও বলা চলে না আবার গ্রাম বলা যায় না। কিন্তু জায়গাটা অসধারণ। বাড়িটার মাঝে একটা জমিদার টাইপ জমিদার টাইপ ভাব আছে। এই বাড়িটা দেখে কেউ বলবে না যে এখানে কেউ থাকে না। সারা বাড়ি ঝকঝকে তকতকে। বাড়ির সামনে বিশাল সাইজের বাগান। নাইম ভাইয়ার দাদু এই বাগানটা সখ করে করেছিলেন। এখানে চার পাঁচ জন কাজের লোক আছে। তারা এই বাড়ির আর বাগানের দেখাশুনা করে।

বাসে সবাই লাফালাফি করে টায়ার্ড হয়ে গেছে। এখানে এসেই যে যেখানে পেরে শুয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার মাঝে কোনো টায়ার্ডনেস কাজ করছে না। আমি ফ্রেশ হয়ে রুদ্রকে টেনে তুললাম।

কী ব্যাপার রিয়া? এমন টানাটানি করছো কেনো?

ঘুরতে যাব তাই।

আমি প্রচন্ড টায়ার্ড। কোথাও ঘুরতে যেতে পারবো না।

আপনি না নিয়ে গেলে কিন্তু আমি একাই চলে যাব।

__________________

উনি সাইকেল চালাচ্ছেন। আর আমি সাইকেলের সামনে উনার কোমড় জড়িয়ে ধরে বসে আছি। মৃদু বাতাস বইছে। কেমন অদ্ভুত শির শির অনুভূতি হচ্ছে। মাঝে মাঝে আমি হাত দিয়ে উনার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছি। গ্রামের মতোই আঁকাবাঁকা পথ। হুট করে উনি ব্রেক করাই আমি হালকা সামনে ঝুঁকে গেলাম। উনি এক হাতে আমাকে সামলে নিলেন। উনার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই আমি চমকে গেলাম। উনি অস্পষ্ট বললেন,

বিহান।

চলবে……..