প্রজাপতি উৎসব পর্ব-১১

0
268

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ১১
লেকচারশিপ পাবার কদিন পরই রায়হানের কমনওয়েলথ স্কলারশিপ হয়ে গেছে। এতে সবচেয়ে খুশী হয়েছে মিতি। ও রায়হানের জন্য ইস্টার্ন প্লাজা থেকে একটা ওয়াটারম্যান কলম কিনে এনেছে। ওরা আনন্দ দীঘির সামনে বসেছিল। রায়হান ভাই মিতির হাত ধরে বললো,
-থ্যাঙ্কস মিতি, এটার কী দরকার ছিল?
-তুমি এত বড় মানুষ হয়ে যাচ্ছো, একটা গিফট করবো না? তোমার আমার লালনীল সংসারের এটাই প্রথম উপহার।
রায়হান স্তব্ধ জলের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে। মিতি বললো,
-কী, হঠাৎ উদাস হয়ে গেলে?
-মিতি একটা ব্যাপার মনে হয় আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।
-কী ব্যাপার?
-এত তাড়াতাড়ি কমনওয়েলথ হয়ে যাবে আমি নিজেও ভাবিনি। এই সুযোগ ছাড়াও যাচ্ছে না। এডিনবরা যাবার মাত্র একমাস বাকি। এ সময় বিয়ের ঝামেলায় না জড়ানোই ভালো।
মিতি আহত কন্ঠে বললো,
-বিয়ের ঝামেলা মানে? কার জন্য ঝামেলা?
-দুজনের জন্যই। টাইমিংটা ঠিক হচ্ছে না।
-কী বলছো, আমার শরীরের অবস্থা জানো না?
-জানি। সে জন্যই আমাদেরকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
-কী কঠিন সিদ্ধান্ত?
-এখন বাচ্চা নেয়া যাবে না। কমনওয়েলথের টাকা দিয়ে বড়জোর একজনের পড়ালেখা থাকা খাওয়ার খরচ চলবে। বাচ্চা নিয়ে বিপদে পড়বো নাকি? তার উপর পিএইচডি নিজেই একটা স্ট্রেসফুল ব্যাপার।
-বাচ্চা নিকে সমস্যা হতে পারে আগে বুঝোনি?
-আহা মিতি, ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট ছিল, তুমিও জানো। সব কিছু কি হিসেব করে হয়?
মিতি হঠাৎ মরিয়া হয়ে বললো,
-আমাকে যাবার আগে বিয়ে তো করবে? নাকি?
-মিতি, আমি এডিনবরা গিয়ে বুঝি কী অবস্থা। কমনওয়েলথের কন্ডিশন হলো আমাকে পড়া শেষে দেশে ফিরে আসতেই হবে। সুতরাং আমি হারিয়ে যাচ্ছি না। এদিকে তোমার লেখাপড়াও শেষ হয়নি।
-আমি লেখাপড়া নিয়ে ভাবি না। আমি একটা সংসার চাই।
-আচ্ছা, আচ্ছা, বিয়ে নিয়ে পরে ভাবা যাবে। দরকার হলে আমি এনগেজমেন্ট করেই যাবো। এখন আগে একটা ক্লিনিক খুঁজে বের করো প্লিজ, বেশী দেরী হলে রিস্কি হয়ে যাবে।
মিতির এসব প্যাঁচঘোঁচ ভালো লাগছে না, ওর চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন কিছুই করার নেই। রায়হান এডিনবরা গেলে ও থামিয়ে রাখতে পারবে না। চোখের পানি মুছতে মুছতে মিতি বললো,
-আচ্ছা আমি দেখবো বন্ধুদের জিগেস করে কোথায় ক্লিনিক আছে। আমি তো তারপর তোমার সঙ্গে এডিনবরা যেতে পারি? পারি না?
-কেন যাবে না, আমি আগে গিয়ে সব বুঝি, তারপর তোমাকে নেয়ার ব্যবস্থা করবো।
রায়হান আর বেশী কথা বাড়াতে চায়নি। ও এখন লেকচারার, ব্যস্ত মানুষ। রায়হানের এখন সাফল্যের সিঁড়ি বেঁয়ে ওপরে ওঠার সময়।
মিতির যখন রুমে ফিরে রায়হানের কথা বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো, আমি মায়া করে বললাম,
-তোকে তো বলেছিলাম মিতি, সম্পর্কের একটা সীমা রাখিস। সম্পর্ক শরীরে গড়ালে তার খেসারত মেয়েদেরকেই দিতে হয়, তুই শুনিসনি।
মিতি হঠাৎ পেটে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-আমি এখন কী করবো রূপা? এ তো আমাদের ভালোবাসার ফসল, আমার নিজের বাচ্চা, ফেলে দেবো? রায়হান এটা কীভাবে বললো?
-রায়হান ভাই নিশ্চয় টিচার হবার পর চাচ্ছেন না তোর প্রেগ্ন্যান্সিরর খবর বাইরে চাউর হোক। তুই যখন ওনার সাথে এ রকম একটা সম্পর্কে গেছিস, তোর সবগুলো কন্সেকুয়েন্স ভাবা উচিত ছিল।
মিতি বালিশে মাথা গুঁজে কাঁদছে। এর ভেতর আমার মোবাইলে টুং করে শব্দ হলো। রঞ্জন মেসেঞ্জারে টেক্সট করেছে, সঙ্গে ব্যাংককের অনেগুলো ঝলমলে ছবি। রঞ্জন লিখেছে,
রূপামণি,
উফ, কী বলবো। ব্যাংককে ঘোরার মজাই আলাদা। বিশেষ করে মধ্যরাতে। ক্লাব পাড়ার পুরো রাস্তা জুড়ে ঝাকানাকা লাইটিং, ধুমধারাক্কা গানাবাজনা, মানুষের চিৎকার চ্যাঁচামেচি, দাউ দাউ করে জ্বলছে লেলিহান আনন্দের শিখা, সব জ্বালিয়েপুড়িয়ে ছাড়খার করবে। হাঁটতে হাঁটতে রক্তে কেমন নেশা ধরে যায়। সেই তুলনায় ঢাকা শহর এলাচির মত ম্যারম্যারে আর বাঙ্গির মত পানসে। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির কথা নাই বা বললাম, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে, হা হা হা।
রূপা, ভালো করেছো এই ঝকমারিতে না এসে। কাল আমার বন্ধু জঙ্গি আমাকে জোর করে তিন চারটা নাইট ক্লাবে নিয়ে গেলো। উন্নত বক্ষা, স্বল্পবসনা, ক্ষীণ কটির মেয়েদের ঢেউ খেলানো নাচে মাথা নষ্ট হবার দশা। আমার মত অ্যানম্যারিড নিষ্পাপ ছেলেদের জন্য এ যেন চোখের হজমি।
তোমাকে কিন্তু সত্যিই মিস করেছি রূপামণি। ব্যাংকক থেকে ফিরে তোমায় নিয়ে শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর আস্তানায় ঘুরে আসবো। কখনো সুযোগ পেলে কুষ্টিয়ায় লালন সাঁইজির আখড়ায় গান শুনবো ,খাঁচার ভিতরে অচিন পাখী। তোমাকে ওসব জায়গাতেই ভালো মানাবে। হা, হা, হা, ঠাট্টা করলাম, রাগ করলে না তো?
এখন কাজের কথায় আসি। তুমি জেনে খুব খুশী হবে। আব্বা যে মেডিকেল ইকুইপমেন্ট কিনতে পাঠিয়েছিল সেটা ত্রিশ পার্সেন্ট ডিস্কাউন্টে পেয়েছি। বাংলাদেশে প্রতিটা ইকুইপমেন্ট পাঁচগুন দামে বিক্রি করা যাবে। দেশের সব মেডিকেলে এটা সাপ্লাই দিতে পারলে আমরা লাল হয়ে যাবো। তোমার কোন খালু না চট্টগ্রামে কাস্টমস অফিসে আছেন? ওনাকে বলে কি কাস্টম ডিউটি কমানো যাবে? তাহলে লাভের উপর লাভ। প্লিজ একটু বলে দেখো না, প্লিজ, প্লিজ।
কাল ভোরের স্বপ্নে তোমার দেখা পেলাম। এত বেশী উত্তেজনাকর স্বপ্ন, শরীরটা চটচট করে উঠলো। কী দেখলাম তার গ্রাফিক ডিটেলস বলবো না। বললে সেদিনে মত কথা বন্ধ করে দেবে। মিসিং ইউ ডার্লিং। মিস ইউর বেন্ডস অ্যান্ড কার্ভস।
ইতি
রঞ্জন
রঞ্জনের কথাবার্তা সব সময় আমাকে বিভ্রান্ত করে। কোন কারণে ওর রুচির মান একটু নীচের দিকের। আবার ওর স্পষ্টবাদীতা আমার ভালো লাগে। অতন্দ্রিলা অবশ্য রঞ্জনকে পছন্দ করে না, সে জোর দাবী করে,
– রঞ্জন যে উল্টাপাল্টা কাজের ফিরিস্তি দিয়ে সত্যবাদী সাজে, ওটা কিন্তু টিপ অফ দা আইসবার্গ। ভেবে দ্যাখ রঞ্জন আসলে তার কতগুন কী করে?
-আমি এত অবিশ্বাস করতে পারি না তন্দ্রা, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।
-উফ, তুই আর তোর বিশ্বাস। আমাদের ভেতর সবচেয়ে বেশী কষ্ট পাবি তুই, আমার কথা গোঁটা গোঁটা অক্ষরে লিখে রাখ।
রঞ্জনের মেসেজের বিষয় দেখে আমার হঠাৎ কেমন মন খারাপ হয়ে গেলো। রঞ্জনের মেসেজের জবাব না দিয়ে একটা কাগজ কলম নিয়ে টিটু ভাইকে চিঠি লিখতে বসলাম,
টিটু ভাই,
আমার শ্রদ্ধা নেবেন।
আপনি মস্কোর হিম, হেমন্ত আর হরিদ্রাভ বসন্তের কত গল্প বলেন, হিরন্ময় ভুবনের হাতছানিতে আমি হরষিত হই।
এই সুযোগে জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটির খানিকটা খবর জানিয়ে রাখি। একেবারেই ভুল কারণে আমাদের আদরের ক্যাম্পাস এখন সারা দেশের আলোচনার কেন্দ্রে। কিছু অজ্ঞাতনামা পশু কয়েকটি মেয়েকে সন্ধ্যায় আক্রমণ করেছে, ওরা মেয়েগুলোকে লাঞ্চিত করেছে। তাই সন্ধ্যা নামলেই চারিদিক কেমন থমথমে হয়ে যায়। প্রথম আক্রমণের সময় কী আপনি এখানেই ছিলেন? আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।
এই পশুগুলো আমাদের ভার্সিটির ছাত্র নাকি বহিরাগত সে নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। তবে বিখ্যাত ইন্সপেক্টর লাবণি এখন কোভার্ট অপারেশন আরম্ভ করেছেন। আশা করি দ্রুত এই দুঃস্বপ্ন কাটবে।
এইসব বিচ্ছিন্ন বীভৎসতার আড়ালে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির প্রকৃত মাহাত্ম্য ঢাকা পড়ে গেছে। আমার কাছে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন স্যারের পদধূলি মাখা বিস্তৃত রঙ্গমঞ্চ, স্থাপত্য আচার্য মাজহারুল ইসলাম স্যারের মহান স্থাপত্যযজ্ঞের ত্রিমাত্রিক ক্যানভাস। শুধু কি তাই, কতজন বুদ্ধিজীবী আনু মুহাম্মদ স্যারের মত বাংলাদেশের তেল, গ্যাস আর খনিজ সম্পদ লুটেরাদের হাত থেকে বাঁচাতে কশেরুকাসমেত এগিয়ে এসেছে? হ্যাঁ, এটাই আমার প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর।
টিটু ভাই আপনি বারবার এত আবেগভরে চিঠি লিখেন, একবারও প্রত্যুত্তর না দিলে নিজের কাছে নিজেকে অভব্য লাগবে। কিন্তু জবাব দিতে গিয়ে ভাবছি কী বলতে পারি, কী বলবো?
টিটু ভাই, আপনি বড্ড দেরী করে ফেলেছেন। বাদল দিনের কদমফুল শীতকালে ফুটলে কি বাঁচতে পারে?
আপনি হয়তো বলবেন যার বোধ যত গভীর তার প্রকাশেও তত বেশী সময় লেগে যায়। হয়তো কথাটা সত্য। এ জন্যই ডুবো জাহাজ চোখের আড়ালে থাকে আর পল্কা ছিপ নৌকা পালে হাওয়া লাগিয়ে লোকের মনোরঞ্জন করে।
কিন্তু রূপসাগরে ডুব দিয়ে আনা এই অরূপ ভালোবাসা নিয়ে আমি কী করি বলুন তো ?
আমি তো সময়ের জালে আটকে গেছি টিটু ভাই। রঞ্জন যখন ডাকাতের মত ঢাকঢোল, ভেরী বাজিয়ে মঞ্চে অবতীর্ণ হলো, দিনের পর দিন চিঠির পর চিঠি দিয়ে মঞ্চ মাতালো, আমি ওর সৌন্দর্য আর পাগলামীতে প্রলুব্ধ হলাম। আমার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। আমি ওর প্রবল ডাকে সাড়া দিয়ে ফেললাম।
টিটু ভাই, আপনার ভালোবাসা শাঁখের করাত। অগ্রাহ্য করা অসম্ভব আবার গ্রহণও করতে পারছি না। পরতে গেলে লাগে, ছিঁড়তে গেলে বাজে।
একটু আগে উপমা দিয়ে বলেছিলাম আপনার বিলম্বিত নিবেদন যেন অঘ্রাণে ফোটা বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল। ভুল বলেছি। আপনার ভালোবাসা বকুল ফুলের মত। লুকিয়ে লুকিয়ে বিকশিত হয়ে একা একাই শুকিয়ে ঝরে গেছে। আপনি সেই অজস্র বিস্রস্ত ভালোবাসা সযত্নে জমিয়ে গেঁথেছেন শুকনো বকুলের মালা। ওর ঘনীভূত ঘ্রাণ আরও বেশী মন কেমন করা।
আপনি যেমন প্রকাশে বিলম্ব করেছেন, আমিও আপনার অপ্রকাশিত ভালোবাসা পড়তে পারিনি। সে আমার ব্যর্থতা। কীভাবে বুঝবো মাসের পর মাস বিপ্লবের ইস্তেহার নয়, আপনি আমাকে ভূর্জপত্রে ভালোবাসা বিলিয়েছিলেন?
আমি তো সামান্য মানুষ টিটু ভাই, কোন এক মায়াবী অতলের সাক্ষাৎ পেয়ে সময়মত চিনতে পারেননি বলে কবি জয় গোস্বামী পর্যন্ত লিখেছিলেন,
অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে
হৃদি ভেসে যায়, চোখ ভিজে যায়, হঠাৎ কত কী যে দ্বিধা আসে মনে, ভাবি ভুল করছি না তো? কিন্তু রঞ্জনকে দেয়া কথা আমি রাখবো। কথা দিয়ে কথা না রাখলে জীবন থেকে সত্য হারিয়ে যায়। ইন্টিগ্রিটি থাকে না। ক্ষমা করবেন আমাকে।
ইতি,
রূপা
(চলবে)