প্রজাপতি উৎসব পর্ব-২২+২৩

0
319

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ২২

রঞ্জন কাল আমিনবাজারের কাছে মোটর সাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ওর বাঁ হাতের কব্জি ভেঙ্গে গেছে। পুলিশ বলেছে ও একটা চোলাই মদের দোকানে অতিরিক্ত পান করে মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিল। রঞ্জনের বাবা মা অনেক বলে কয়ে ওকে থানা থেকে ছাড়িয়ে এনেছে। তাতেও ওর শিক্ষা হয়নি। কাল রাতে [email protected] থেকে ইমেইলে শাসিয়েছে ওকে যেন অবহেলা না করি। আমি ওই চোরের মত ইমেইল অ্যাড্রেসটা ব্লক করে দিয়েছি। রঞ্জনের অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে অতন্দ্রিলা খুশি হয়ে বলেছে, এটা আল্লার বিচার।

আজ মোহনের সঙ্গে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। আমি সাভার স্মৃতিসৌধে পৌঁছে দেখি মোহন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ও কি সব সময় ফর্মাল জামা কাপড় পরে? আজ ছুটির দিন, তাও সে পাটভাঙা সাদাকালো চেক শার্ট আর নেভি ব্লু প্যান্ট পরেছে, পায়ের কালো জুতোটা পলিশ করা গ্রানাইটের মত চকচক করছে। । ওর চুল রঞ্জনের চুলের মত কোঁকড়ানো না, বরং রেশমের মত মসৃণ। মোহন হাসলে গালে হাল্কা জলতরঙ্গের মত টোল পরে, সুন্দর লাগে।

মোহন জলাধারের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমাকে দেখে শশব্যস্ত হয়ে কাছে এগিয়ে এসে বললো,
-দুঃখিত, আমি একটু আগেই চলে এসেছি। আপনি আবার ভাববেন না আপনার দেরী হয়েছে।

আসলে আমার পাঁচ মিনিট দেরী হয়েছে কিন্তু মোহন আমাকে গিল্টি ফিলিং দিতে চাচ্ছে না, তাই ওভাবে বলা। আমি বললাম,
-আমি তো আসলেই পাঁচ মিনিট দেরী করেছি, বাজারের কাছে ট্রাফিক জ্যাম ছিল, কিন্তু ওটা কোন এক্সকিউজ হতে পারে না, আমার আরও আগে রওনা হওয়া উচিত ছিল।

মোহন প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
-স্মৃতিসৌধে এলে আমার সব সময় ভালো লাগে। জায়গাটা এত খোলামেলা, প্রচুর বাতাস পাওয়া যায়। কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগে স্মৃতিসৌধটা। কীভাবে কতগুলো বিচ্ছিন্ন কাটা কাটা ত্রিভুজ টাইপের শেপ একটার পেছনে একটা সাজিয়ে সাবলীল কার্ভ বানিয়ে ফেলেছে। এটা যেন বলছে চাইলে কাটা কাটা কঠিন বাস্তব থেকেও যেকোন স্বপ্ন নির্মাণ করা যায়। এই যেমন আপনাকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছি।

আমি লজ্জা পেলাম। বললাম,
-আপনি বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। আব্বু নিশ্চয় জানিয়েছেন আমাদের ফ্যামিলি ব্যাপারটা বিবেচনা করছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে দুজন দুজনকে আরেকটু জেনে বুঝে নেয়া প্রয়োজন। আমাদের পছন্দ আর বিরক্তিগুলো মিলে কিনা, এসব আরকি।

-হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই। বিয়ে তো একটা সারা জীবনের ব্যাপার। একবার ভুল হলে শেষ।

পাশ দিয়ে ঝালমুড়িওয়ালা যাচ্ছিল, মোহন সেদিকে দেখিয়ে বললো,
-ঝালমুড়ি খাবেন?

আমি বললাম,
-একটা অন্তত মিল পাওয়া গেছে, ঝালমুড়ি আমারও ভীষণ পছন্দ।

চানাচুরওয়ালা খুব যত্ন করে সরিষা তেল, টমেটো, ধনুয়া পাতা, পিয়াজ, মরিচ মাখিয়ে মুড়ি বানিয়ে দিলো। আমরা ঝালমুড়ি খেতে খেতে স্মৃতিসৌধের দিকে এগোলাম। আমি মোহনের দিকে তাকিয়ে বললাম,

-আপনি উপন্যাস পড়েন?

-কী বলেন, আমি তো উপন্যাসের পাগল। বাসে কিংবা গাড়িতে কোথাও যাবার সময় একমনে উপন্যাস পড়তে থাকি। সময়টা বোঝার আগেই কেটে যায়।

-বাহ, আমিও। আপনার ফেভারিট রাইটার কে?

-একেক জনের একেক লেখা পছন্দ। রবীন্দ্রনাথ, মাণিক, বিভূতিভূষণ, তারাশংকর, সুনীল, সমরেশ, ইলিয়াস, হুমায়ুন আহমেদ সবই পড়ি।

-একদম ঠিক বলেছেন। একজনের সব লেখা সব সময় ভালো লাগে না। বরং দেখা যায় যারা বেশী লেখে তারা একই লেখা সামান্য ভেঙ্গেচুরে বারবার লিখছে, মানে লেখা রিসাইকেল করছে। ও রকম লেখা একদম বোরিং হয়ে যায়। আপনি কবিতা পড়েন?

-একটু আধটু পড়ি, সবার সব কবিতা বুঝি না। কেমন আবছায়া, বোধের কাছাকাছি এসে আবার পিছলে যায়।

-অনেকে তো বলে যা বোঝা যায় না, যা কুয়াশামাখা, তাই কবিতা। বুঝে ফেললে ওটা গদ্য।

-ওহ, তাহলে কবিতা না বোঝা দোষের কিছু না, ওটাই ক্রেডিট।

আমি হেসে ফেললাম। নিজের অজান্তেই আমি মোহনের সঙ্গে সহজ হয়ে যাচ্ছি। চানাচুরের ঠোঙ্গাটা বিনে ফেলে বললাম,

-আপনি কী রাশি?

-কেন, আমার সিভি দেখেননি?

-নাহ, এখনো দেখা হয়নি।

-আমি বৃশ্চিক, আপনি তো কন্যা?

-সে তো দেখতে পাচ্ছেন, আমাকে কি ছেলের মত লাগে?

-না, মানে আপনি তো কন্যা রাশি।

আমি হাল্কা হেসে বললাম,
-হ্যাঁ, বৃশ্চিকের সঙ্গে কন্যা কোন রকমে যায়। আমি যদিও রাশি বিশ্বাস করি না, কিন্ত রাশির ম্যাচিং চেক করি, মানুষ যেমন ভুত বিশ্বাস করে না কিন্তু ভূতের ভয় পায়।

মোহন এবার সামান্য গম্ভীর হয়ে বললো,
-আপনার ব্যাপারে আমি অনেক খোঁজ নিয়েছি। সবাই বলেছে আপনার মত ভালো মানুষ হয় না। তবে রঞ্জন বলে একটা ছেলে বোধহয় আপনাকে পছন্দ করতো, আপনিও করতেন মনে হয়।

আমার মুখ কালো হয়ে গেলো, হঠাৎ করে এরকম প্রশ্ন আসবে ভাবতে পারিনি। বললাম,
-হ্যাঁ, রঞ্জনকে আমি পছন্দ করতাম। কিন্তু যখুনি বুঝেছি ওর পছন্দটা মেকি তখুনি সরে গেছি। রঞ্জন একবার হুট করে আমার কপালে চুমু বসিয়ে দিয়েছিল, এ ছাড়া ওর সঙ্গে আমার কখনোই কিছু হয়নি।

-হ্যাঁ, সবাই বলে আপনি অন্যরকম, এ জন্যই আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।

-আপনাকে যদি একই প্রশ্ন করি?

-আমি? প্রেমিকা তো দূরের কথা, আমার কোন মেয়ে বান্ধবীই নেই।

-সেটা কিন্তু আবার বেশী বেশী।

-কিন্তু সেটাই আমি। জানেন তো আমার আসল মা ছোট বেলায় মারা গেছে, সৎ মায়ের হাতে মানুষ, বাবা প্যারালাইজড বহুদিন ধরে, পিঠাপিঠি ছোট দুই ভাইবোনকে বড় ক্রতে করতে কখন সময় কেটে গেছে টেরও পাইনি। ঢাকায় যে বাড়ি সেটা কিন্তু আমার করা, বাবার অনেক আগে একখণ্ড জমি ছিল, তার উপর।

মোহনের জন্য মায়া লাগলো। এ রকম হ্যান্ডসাম ছেলে নিশ্চয় অনেক মেয়ের পছন্দের ছিল, কিন্তু বেচারা জীবনের আবেগের দিকটা পরিবারের কথা ভেবে উপেক্ষা করেছে। আমি বললাম,
-বুঝতে পারছি আপনার একটা স্ট্রাগ্লিং লাইফ গেছে। কিন্তু তার বিনিময়ে এখন আপনি প্রতিষ্ঠিত।

-তা ঠিক। এতদিন পর নিজেকে নিয়ে ভাববার সময় পেয়েছি। কিন্তু তাই বলে আপনি কোন চাপ নেবেন না প্লিজ। আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর করুন। আরেকটু ভাবুন, তারপর সিদ্ধান্ত নিন।

আরও বেশী মায়ায় জড়ানোর আগেই সেদিন আমি স্মৃতিসৌধ থেকে চলে এসেছিলাম। ফিরে আসতেই অতন্দ্রিলা বললো,
-বোকার মত মন প্রাণ সঁপে দিয়ে আসিসনি তো?

-আরে না, আরেকটু বোঝার চেষ্টা করলাম। এটা তো আর প্রেমের বিয়ে হচ্ছে না, দুই পরিবার কথা বলে বিয়ে হচ্ছে।

-মোহনকে কেমন বুঝলি?

-ভালোই তো মনে হচ্ছে। রঞ্জনের মত সুযোগ পেলেই গা ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করেনি। তাছাড়া সে তো বিয়েই করতে চাচ্ছে।

-তো এই মোহন কি রমণীমোহন।

-চেহারাই কি সব? চেহারা নিয়ে যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে আমার।

-তারপরও, দেখতে কেমন বল না।

-দেখে তো ভালোই লাগে।

-হুম, তো পছন্দ হয়েছে মনে হচ্ছে।

-মা’র জন্য বিয়ে করতে হবে বলে করা, এখন দোয়া করিস ছেলেটা যেন ভালো হয়।
-অ্যারেঞ্জ ম্যারেজই যদি করবি, তাহলে আরও ছেলে দেখলে ক্ষতি কী ছিল?

-আরও প্রপোজাল ছিল, বায়োডাটা পাঠিয়েছে অনেকে, কিন্তু এই একটাই শর্টলিস্ট করতে পেরেছি। তাছাড়া এই ছেলেটা নিজেই খুব আগ্রহী। আমার চেয়ে আব্বু আম্মুর সঙ্গেই ওর সম্পর্ক ভালো।

-বাই দা ওয়ে, তোর রঞ্জন কাল আমার এক ফ্রেন্ডকে ভাইবারে মেসেজ পাঠিয়েছে, হ্যাং আউট করতে চায়।

-রঞ্জন আমাকে ইনিয়েবিনিয়ে লম্বা ইমেইল করে শেষে হুমকি দিয়েছে। রঞ্জন অন্য কাউকে টেক্সট করলে করুক, আমার পেছনে না লাগলেই হয়।

-বড় বাঁচা বেঁচেছিস শয়তানটার হাত থেকে। দিলশাদ বলেছে ইন্সপেক্টর লাবণি এখনো ওকে অবজার্ভ করছে। এমন হতে এই শয়তানটাই খসরুকে মেরেছে। ওর রুমেই ট্রাংক পাওয়া যাবে, ওর রুমমেটই খুন হবে, এত কইন্সিডেন্স রিয়েল লাইফে হয় না।

রঞ্জনের কথা শুনলেই এখন আমার গা হাত পা গুলিয়ে ওঠে, চেহারা যে কত বিভ্রান্তিকর হতে পারে রঞ্জন তার প্রমাণ। ভাগ্যিস রঞ্জনের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে ভুল পথে পা বাড়াইনি। আমি জানি না কোন একটা দুর্ঘটনা হয়ে গেলে আমি মিতির মত উঠে দাঁড়াতে পারতাম কিনা।

সেদিন বিকেলে বাসায় গিয়ে দেখলাম আব্বু বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। কাজের বুয়া ফিরে এসেছেন, রানাবান্না ঠিকমত হচ্ছে, ঘরদোর ছিমছাম গোছানো। একজন কেয়ারার মাকে সবসময় দেখছেন। আমি নিজেই গত সপ্তাহে তিনদিন ছিলাম আব্বুআম্মুর সঙ্গে, এতটা ম্যানেজ করতে পারিনি।

সন্ধ্যায় গরম ভাত দিয়ে তৃপ্তি করে ইলিশের সাদা ভুনা খেলাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তুই এতদিন ধরে এখানে পড়ে আছিস, পড়ালেখায় সমস্যা হয় না?

মা’কে কীভাবে বলি আমি আজ বিকেলে এসেছি? মন খারাপ চেপে রেখে বললাম,
-অসুবিধা নেই মা, এখন পড়ালেখার প্রেশার কম। কাল ঘুম থেকে উঠেই ভার্সিটি চলে যাবো।
খাবার পর আমি আর বাবা ড্রইং রুমে বসলাম। বাবা মুখ কালো করে বললেন,
-ডাক্তার বললেন তোর মার অবস্থা দিনদিন খারাপের দিকেই যাবে। আত্মীয়স্বজনরা ভয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে না। খোঁজ নিলে আবার কি সাহায্য করা লাগে। মোহন ছেলেটা না থাকলে বিরাট বিপদে পড়ে যেতাম। ও নার্সিং হোমের সাথেও কথা বলে রেখেছে।

-আব্বু তুমি বিয়েটা ফাইনাল করে ফেলো।

-তুই মন থেকে বলছিস তো?

-হ্যাঁ, আব্বু, আম্মুর এই অবস্থায় আর কী বলার থাকতে পারে?

-ছেলেটার সাথে কথা বলে কোন খারাপ ফিলিং আসেনি তো?

-না।

-আচ্ছা তাহলে এই ডিসেম্বরে বিয়ের আয়োজন করে ফেলি।

-আচ্ছা।

রাতে ঘরে গিয়ে ইমেইল চেক করলাম। টিটু ভাই আরেকটা ইমেইল পাঠিয়েছে,

-প্রিয় রূপা,
পুতিন একটা ফাঁদে পা দিলো। সমস্যাটা শাঁখের করাত। কিছু করলে বিপদ, না করলেও বিপদ। পূর্ব জার্মানি আর পশ্চিম জার্মানি এক করার সময় আমেরিকা একটা কথা দিয়েছিল। একত্রীকরণে বাঁধা না দিলে পুরস্কারস্বরূপ পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোর ভৌগোলিক আয়তন আর এক ইঞ্চিও বাড়াবে না। ওদের কথা বিশ্বাস করে রাশিয়া পূর্ব ইউরোপীয় জোট ওয়ারশ’কে ভেঙ্গে দিলো। পশ্চিমারা কী করলো জানো, সব প্রতিশ্রুতি ভেঙ্গে ন্যাটোকে বড় করে রাশিয়া ঘিরে ফেললো। দু হাজার সালে ক্ষমতায় আসার পর পুটিন রাশিয়াকে ন্যাটোর মেম্বার করতে চাইলো, কিন্তু ন্যাটো সেই সুযোগটা নিলো না। একদিকে ইউক্রেইন ন্যাটোর সদস্য হবে মানে রাশিয়া পশ্চিমাদের সহজ টার্গেটে পরিণত হবে অন্যদিকে দেশটা নিওনাজিদের দখলে চলে যাচ্ছে। পশ্চিমা ডেইলি মেইল পত্রিকায় ছবি দিয়েছে ওদের ইউনিফর্মে হিটলারের সোয়াস্তিকা সাইন বসানো। তারপরও যে কোন যুদ্ধ আমাকে বিষণ্ণ করে। বিরাট মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়লো ইউক্রেইনের সাধারণ জনগণ।
সব কিছু মিলিয়ে আজ মনে ঝড় বইছে । শুধু তোমাকে চিঠি লেখার সময় মনটা কেমন দীঘির জলের মত শান্ত হয়ে যায়।

ইতি,
টিটু

টিটু ভাইয়ের এমেইল পড়ে মনটা কেমন ভারী হয়ে গেলো। আমি উত্তরে লিখলাম,

টিটু ভাই,
আমার মনেও ঝড় বইছে। এই ডিসেম্বরে আমার বিয়ে। তারপর তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ঠিক হবে না। কারণ, আমি যাকে বিয়ে করবো, তাকে কোনভাবেই ফাঁকি দেবো না।
ইতি,
রূপা

(চলবে)

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ২৩

আজ সন্ধ্যায় আমার বিয়ে। অথচ এমনটা হবার কথা ছিল না।

সোমবার দিন আম্মুকে চেক আপের জন্য ডক্টর রুহুল আমিনের ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডক্টর রুহুল আমি বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট। ঢাকা শহরে ওনার ব্যাপক পসার। তিন মাসের আগে ওনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া মোটামুটি অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু মোহন কাকে কাকে ধরে দুদিনের ভেতর অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করে ফেললো। বাইরে থেকে ওনাকে যত ব্যস্ত লাগে, সামনা সামনা উনি তার উল্টো পরিমান শান্ত । ডাক্তার সাহেব আম্মুর সাথে প্রায় বিশ মিনিট ধরে গল্প করলেন আর কাগজে কী সব টুকে রাখলেন। পরীক্ষা শেষ আমার কাছে এসে বললেন,
-দেখুন আমি কতগুলো কুইক টেস্ট নিলাম। শর্ট এবং লং টার্ম মেমোরি, অ্যাটেনশন স্প্যান, কথা বলার ক্ষমতা এসব পরীক্ষা করলাম। তাছাড়া উনি স্থানকাল এবং সময় আন্দাজ করতে পারেন কিনা তাও দেখলাম।

-কী বুঝলেন?

-আপনারা বললেন আর্লি স্টেজ। কোন ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?

আমাকে অস্বস্তিতে পড়তে দেখে উনি বললেন,
-যাকেই দেখিয়ে থাকেন, আমার মনে হয়েছে রোগ অনেক প্রগ্রেস করে গেছে। তবে কয়েকটা টেস্ট করালে কনফার্ম হয়ে বলতে পারবো।

ওনার পরামর্শমত লিভার ফাংশন, কিডনি ফাংশন, থাইরয়েড ফাংশন, হিমোগ্লোবিন এ১সি, ভিটামিন বি ১২ লেভেল পরীক্ষার জন্য ব্লাড টেস্ট করালাম, ব্রেইন এম আর আই আর পিইটি স্ক্যান করালাম।

সাতদিন পর সব রিপোর্ট দেখে ডাক্তার সাহেব বললেন,
-রোগের ক্ষেত্রে খারাপ খবর না দেয়াটাও অন্যায়, আপনার মা’র আরপিডি হয়েছে।

-আরপিডি মানে?

-র‍্যাপিডলি প্রগ্রেসিং ডিমেনশিয়া। রোগটা খুব তাড়াতাড়ি খারাপের দিকে যাবে।

-কত তাড়াতাড়ি?

-এক বছর ধরে যে ক্ষতি হতে পারতো তা এক সপ্তাহ থেকে এক মাসের ভেতর হয়ে যেতে পারে।

-আপনি কী ক্ষতি বোঝাচ্ছেন? কপ্লিট মেমোরি লস? মানে এপ্রিল মাস থেকে আর কাউকেই চিনবে না?

-না, তার থেকেও খারাপ।

আমি অবাক হয়ে বললাম,
-তাহলে কী বলতে চাইছেন?

-আমি মিন করেছি এপ্রিল মাসের শুরুতেই আপনার মা মারা যেতে পারেন, আবার ভাগ্য ভালো হলে আরও কিছুদিন বাঁচতেও পারেন।

আমি কান্না চেপে বললাম,
-আর আমাদেরকে মনে রাখা? আর কদিন আম্মু আমাদেকে মনে রাখতে পারবে?

-এক দু সপ্তাহ পর আপনাদেরকে আর চিনবে বলে মনে হয় না। কিন্তু ওনাকে বাঁচিয়ে রাখাই যখন কঠিন, মনে রাখা না রাখা ভেবে কী হবে? এখন মোস্ট ইম্পট্যান্ট হলো প্যালিয়েটিভ কেয়ার, উনি যেন ডিগনিটি নিয়ে গন্তব্যে যেতে পারেন।

আম্মু পাশের ঘরে অপেক্ষা করছিল, সঙ্গে কেয়ার গিভার সুরাইয়া। আমি আম্মুর কাছে যেতেই আম্মু বললো,
-ডাক্তার সাহেব খুব সুন্দর সুন্দর কথা বললেন। ওনার কাছে না এলে ভাবতাম আমার আবার অসুখ বাঁধলো কিনা।

আমি এবার আর চোখের পানি সামলাতে পারলাম না। মাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললাম। মা বললো,
-কী হয়েছে? আবার পরীক্ষায় ফেল করেছিস? ঠিক মত পড়ালেখা না করলে কলেজে উঠবি কী করে?

এই কদিন মোহন ওর গাড়িটা আমাদের ব্যবহারের জন্য দিয়ে রেখেছে। তা না হলে কী যে একটা অবস্থা হতো। গাড়িতে উঠতেই মোহনের ফোন এলো,

-ডাক্তার কী বললেন?

-ভালো না, খুব খারাপ খবর। পড়ে বলবো। এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

বিকেলে বাবার সঙ্গে কথা সেরে অতন্দ্রিলাকে সবকিছু জানালাম। অতন্দ্রিলা শুনে বললো,
-তার মানে তোর বিয়েটা ডিসেম্বরে না, বরং এখুনি সেরে ফেলতে হবে।

-হ্যাঁ, আমার খুব নার্ভাস লাগছে।

-কিন্তু কিছুই করার নেই। মোহনকে জানিয়েছিস?

-মোহনকে জানাবো একটু পর। কিন্তু বিয়ে নিয়ে আমি নিজে থেকে কিছু বলবো না। ও বলুক আগে।

-ঠিক আছে। আমি একটা কথা বলবো?

-বল।

-বিয়ের সময় অনেক কাজের চাপ পড়ে। কত রকমের আয়োজন। কিন্তু ওসব নিয়ে একদম টেনশন করবি না। কেনাকাটা থেকে শুরু করে তোকে সাজিয়েগুজিয়ে বিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিলশাদ আর আমার। তবে খবরদার, রঞ্জন যেন কিছু জানতে না পারে।

অতন্দ্রিলার কথায় শান্তি পেলাম। আম্মুর স্বাস্থ্যের আকস্মিক অবনতির কথা শুনে আমার মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আম্মু আব্বুকে বলেছিল, রূপার বিয়ে না দেখে আমি মরবো না। ছোট একটা শখ। কিন্তু আব্বুর মনে সেই কথাই গেঁথে আছে। বিকেলে মোহন ফোন করে বললো,
-রূপা, তোমার আব্বুর সঙ্গে কথা হয়েছে। তোমার আম্মুর জন্য খুব মন খারাপ লাগছে। এত তাড়াতাড়ি এমন অবস্থা হবে ভাবতেও পারিনি। আমি সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারের ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করেছি। আগামী বুঝবার রাতে একটা স্লট পেয়েছি। এখন তুমি ভেবে দ্যাখো কী চাও। তোমার মাকে খুশি করার জন্য আমরা জাস্ট বিয়ে রেজিস্ট্রি করে ফেলতে পারি , কিংবা বিয়ে বৌভাত মিলিয়ে একটা অনুষ্ঠান করতে পারি।

-মা নিশ্চয় জরির শাড়ি, আলোর রোশনাই, আত্মীয়দের হৈচৈ আর ক্যামেরার ঝলকানি দেখতে চেয়েছিলেন। বিয়ে হলে ধুমধাম করে ঠিকমত হোক।
তারপরের সাতদিন আম্মুর অসুস্থতার ভয়াবহতা ভুলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লো বিয়ের আয়োজনে। আমার ছোট ভাইটা খড়গপুর থেকে পরীক্ষার পড়া ফেলে চলে এলো। অবশ্য আম্মুর এই অবস্থায় ওর না এসে উপায় ছিল না। মিলি প্রেগ্নন্যান্ট বলে তেমন সাহায্য করতে পারলো না। কিন্তু ঢাকা জাহাঙ্গীরনগর করে করে দিলশাদ আর অতন্দ্রিলার নাভিশ্বাস উঠে গেলো। রঞ্জনের কাছে থেকে লুকোতে চাইলেও শেষমেশ ওর কানে আমার বিয়ের খবর পৌছুলো। শেষ চেষ্টা হিসেবে রঞ্জন এখানে ওখানে বলে বেড়াচ্ছে আমি নাকি ওর সঙ্গে বেডে গেছি। ভাগ্যিস ইন্সপেক্টর লাবণি ওকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবার উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। ওর কোন কথাই এখন কেউ বিশ্বাস করে না।

বিয়ের দিন বিকেলে দিলশাদ আর অতন্দ্রিলা আমাকে সাজাবার জন্য পার্লারে নিয়ে গেলো। শীতের সিজন না বলে পার্লার মোটামুটি ফাঁকা। ওরা আমার মুখে প্রাইমার স্প্রে করে গভীর মনোযোগে একটার পর একটা রঙের পরত চড়াতে লাগলো, শেষে ব্লাশন দিয়ে গোলাপি আভা আনলো। ভ্রু প্লাক করলো, ভ্রু আঁকলো, চোখে আইল্যাশ লাগাল, মাসকারা দিলো, কাজল দিলো। ঠোঁটে লিপালাইনার দিয়ে সীমানা টেনে, টকটকে লাল লিপস্টিক মাখালো। শেষে চুলে ফুল দিয়ে খোঁপা করলো। আয়নায় তাকিয়ে নিজেরই লজ্জা পেলাম। দিলশাদ বললো, তোকে দেখে মনে হচ্ছে সাত সাগরের তের নদীর পার থেকে আসা কোন রাজকন্যা।

আম্মু তার বিয়ের লাল কাতান শাড়িটা অনেক বছর ধরে নেফথলিন দিয়ে উঠিয়ে রেখেছিল। আমি আম্মুকে বলেছিলাম আমার বিয়ের সময় আমি আম্মুর বিয়ের শাড়ি পরবো। আজ সেই সুযোগ এলো। বাড়ি ফিরে আসার পর আমার বউয়ের সাজ দেখে মা পাশের ঘরের দরোজার দিকে তাকিয়ে হাঁক দিলেন,
-এই রূপা এদিকে এসে দেখে যা, ঘরে একটা নতুন বউ এসেছে।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– তুমি কোন বাড়ির বউ গো মা?

আমার ভাই ছুটে এসে বললো,
-মা, এটা রূপাপু, আজ বিয়ে না? একটু পর আমরা বিয়ে বাড়ি যাচ্ছি, তুমিও তো রেডি হয়েছো।

মা, আবার স্মৃতি ফিরে পেয়ে বললেন,
-হ্যাঁ হ্যাঁ, রূপাই তো। না হলে কে হবে? সবাইকে এখুনি রেডি হতে হবে, আমরা একটু পর বিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। তোর বাবা কোথায়?

(চলবে)