প্রজাপতি উৎসব পর্ব-২৫+২৬

0
257

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ২৫

আজ আমাদের বাসর রাত। আকাশে ভুবন ভাসানো চাঁদ উঠেছে। ঘরের ভেতর বেলি ফুলের মদির ঘ্রাণ। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। মোহন পাশে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলো। আমি আবেগে কম্পিত কণ্ঠে বললাম,
-দ্যাখো, আমাদের বিয়ের দিনে কী সুন্দর চাঁদের আলো। এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো।
মনে হচ্ছে মোহন কোন একটা রোমান্টিক কথা বলবে। কিন্তু মোহন বললো,
-এই জানালার কাছে মোবাইল নেটওয়ার্ক একদম খারাপ। এ জন্য এখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না।

কিছু বোঝার আগেই মোহন টান মেরে পর্দাটা আটকে দিলো। আমি ওর দিকে তাকাতেই বললো,
-রাস্তা থেকে ধুলো আসছে। হাঁপানি হয়ে যাবে।

বুঝলাম জোছনা নিয়ে ওর খুব একটা আগ্রহ নেই। আমার তলপেটে ক্রাম্প হচ্ছে। কিন্তু আজ বাসর রাত। এই দিনটাকে আবেগ ভালোবাসায় স্মরণীয় করে রাখতে হবে। আমি মোহনকে বললাম,
-মোহন, একটা কবিতা শুনবে?

মোহন হেসে বললো,
-কবিতা? কি বলছো এসব?

-কেন?

-কবিতা শোনার জন্য কি বাসর রাত?

আমি বুঝতে না পেরে বললাম,
-কেন, বাসর রাতে কবিতা শোনা যায় না?

-মনে আছে তুমি ইউনিভার্সিটির কবিতা উৎসবে নিয়ে গিয়েছিলে?

-হ্যাঁ।

-উহ, দাঁতে দাঁত চেপে ওদের আবোল তাবোল বকবকানি হজম করেছিলাম। কারণ আমি জানতাম কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে, ওসব করে করে একদিন তোমাকে কাছে পাবো। এখন কাছে পেয়ে যদি আবার কবিতাই শুনতে হয় তাহলে কিন্তু মেজাজ পুরো খিচড়ে যাবে। আমি আর সংযম রাখতে পারছি না, প্লিজ বিছানায় চলে এসো।

-কেন?

মোহন হেসে বললো,
-উফ, রূপা, ছ্যাবলামো করো না। একটা ছেলে একটা মেয়ে বিয়ের রাতে বিছানায় কেন যায় বুঝো না? তুমি শিশু নাকি?

আসলেই আমি বুঝিনি মোহন এত তাড়াতাড়ি এমন করবে। একটু আগে আমার পিরিয়ড শুরু হয়েছে। আমি তৈরি ছিলাম না। বাথরুমে গিয়ে কোন রকমে একটা কাপড় দিয়ে শরীর সামলে রেখেছি। আমি মন খারাপ করে বললাম,
-মোহন, আমার পিরিয়ড হচ্ছে।

মোহন বিরক্ত কন্ঠে বললো,
-কী? সত্যি নাকি বানিয়ে বলছো?

-বানিয়ে বলবো কেন, নানা চাপে আমার সাইকেল চেঞ্জ হয়ে গেছে ।

-এতদিন ধরে নিজেকে সামলালাম, এখন তো এসব সাইকেল চেঞ্জের কথা বললে হবে না রূপামণি।
মোহন ভদ্রলোকের মত ঠান্ডা গলায় কথাটা বললো। ও সহজে রেগে যায়না, সবেচেয়ে খারাপ কথাটাও মিষ্টি করে বলতে পারে আমি বললাম,
-তাহলে এখন কি চাইছো আমার কাছে?

মোহন কোন উত্তর না দিয়ে আমার শাড়ি টেনে খোলা আরম্ভ করলো। আমি অস্ফুট স্বরে বললাম,
-মোহন, প্লিজ, আজ এই অবস্থায় না। আমার মাথা ব্যথা করছে, আমি ঘুমিয়ে যেতে চাই।

মোহন আমাকে বিছানায় টেনে নিতে নিতে বললো,
-বিয়ের আগে কি তোমাকে কখনও জোর করেছি? করিনি। কারণ আমি একজন ভদ্রলোক। কিন্তু আজ তো আমার প্রাপ্য আমাকে বুঝে নিতে হবে রূপা।

-আজ না প্লিজ। শরীর খুব খারাপ লাগছে।

-রূপা, আই অ্যাম ইওর হাজবেন্ড। আই নিড ইট নাও। খামোখা নাটক করো না প্লিজ। এটা তোমাদের জাহাঙ্গীরনগরের মুক্ত মঞ্চ না। এটা আমাদের পুষ্পশয্যা।

মোহন এবার আমার ব্লাউজ টেনে খুলে ফেললো। মোহন আমার স্বামী। ওর দায়িত্ব আমাকে সব রকম অস্বস্তি আর বিপদ থেকে রক্ষা করা। অথচ মোহনই আমার উপর জুলুম করছে। আমার এখন মোহনকে ভয় করছে।

তারপরের আধঘণ্টা তাণ্ডবলীলা বয়ে গেলো। আমাকে বেআব্রু করে মোহন ওর দাবী দাওয়া কড়ায়গন্ডায় বুঝে নিলো। যা সহজ, সুন্দর, আনন্দঘন হবার কথা ছিল তা কেমন বিশ্রী আর তিতা হয়ে গেলো। আমার সারা গায়ে ওর দাঁতের দাগ বসে গেছে। ওর অত্যাচারে আমার ব্লিডিং বেড়ে গেছে। আমি কোন রকমে কাপড় চেপে অসাড়ের মত বিছানার এক কোণে পড়ে রইলাম। মোহন ওর কাজ সেরে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে। একটু পরই ওর নাক ডাকার বিকট শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে গেলো। আমি অন্ধকার সিলিং-এর দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবলাম। জানি না আমি কী করবো। আমার বাবাকে এসব বলে বিরক্ত করতে চাই না, দিলশাদ আর অতন্দ্রিলা শুনলেও খুব কষ্ট পাবে। আমার দু চোখ বেঁয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

ভোরবেলা মিনুকে আমার পিরিয়ডের কথা বললাম, মিনু তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করে ফেললো। গোছল সেরে নিজেকে গুছিয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখলাম বুয়া পরোটা।, ডিম আর আলুভাজি সাজিয়ে রেখেছে। আমি শাশুড়ি মার পাশে গিয়ে বসতেই উনি বললেন,
-বসো মা, তোমার শ্বশুর সাহেব তো উঠতে পারেন না, খাবার দিয়ে আসতে হয়। উনি আরও আধঘন্টা পড়ে নাস্তা করবেন।

আমি বললাম,
-আজ বাবাকে আমি নাস্তা দিয়ে আসবো মা।

শাশুড়ি মা খুশী হয়ে বললেন,
-তুমি দেবে? তাহলে তো উনি খুব খুশী হবেন।

মোহন এইমাত্র ফর্মাল জামাকাপড় পরে পরিপাটি হয়ে টেবিলে বসেছে। আমি পরোটা আর ডিম উঠিয়ে মোহনের পাতে দিলাম। মোহন মুখে হাল্কা হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
-থ্যাঙ্ক ইউ, রূপা।

মোহনকে দেখে মনে হচ্ছে একজন ভদ্র মার্জিত এবং রুচিবান পুরুষ। কেউ বিশ্বাস করবে না কাল রাতে লোকটা পাগলা কুকুরের মত আচরণ করেছে। খাবার শেষে মোহন বললো,
-মা, বুয়াকে বলো আমাদেরকে ঘরে চা পাঠিয়ে দিতে।

মিনু ঠাট্টা করে বললো।
-কেন, ভাবীকে নিয়ে একান্ত সময় কাটাতে চাও?

মিনুর কথায় পাত্তা না দিয়ে মোহন আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-রূপা, তুমি একটু ঘরে এসো, কথা আছে।

আমি একটু পর ঘরে যেতেই দেখলাম মোহন মোবাইলে কাউকে টেক্সট করছে। আমাকে দেখে মোবাইল পকেটে রেখে বললো,
-কাল রাতের তোমার সঙ্গে একটু জোর করেছি। আশা করি রাগ করোনি।

আমি কোন জবাব দিলাম না। মোহনের রুচি এবং মানসিকতার উপর এক রাতেই আমার আস্থা উঠে গেছে। খামোখা কথা বলে ওর ভেতরের নোংরাটা আবার বের করে আনতে ইচ্ছে করছে না। তাড়াহুড়া করে বিয়ে করে সত্যি সত্যি নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছি।

বুয়া এই মাত্র ট্রেতে চা এনে বেডসাইড টেবিলে রেখেছে। মোহন চায়ের কাপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
-নাও রূপা, চা খেয়ে নাও।

আমি চুপ করে আছি দেখে মোহন বললো,
-প্লিজ সোনামণি, আর গাল ফুলিয়ে থেকো না। চা খেয়ে নাও।

-আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে না এখন।

-প্লিজ খেয়ে নাও। আমি তোমার পায়ে পড়ছি। প্লিজ খাও।

বুঝলাম না চা খাওয়ার মত সামান্য ব্যাপারে পায়ে পড়ার কি আছে। আমি চা না খেলে মোহনের সমস্যা কী? বললাম,
-আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে না মোহন।

মোহন আমার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বললো,
-রূপা, বিয়ের আগে অন্য ব্যাপার ছিল, আমি যথেষ্ট ভদ্রতা দেখিয়েছি। কিন্তু এখন তুমি আমার ওয়াইফ। সামান্য চা খেতে বলছি, সেটাই শুনছো না, পরে কী করবে কে জানে। তোমার কাছে এমন ব্যবহার আশা করি না।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। মোহন আমার কপালে চুমু দিয়ে বললো,
-এই তো। গুড গার্ল। খুব কি কঠিন ছিল কাজটা করা? খামোখা আমার মাথা গরম করিয়ে দিয়েছিলে।

এর মাঝে মা এসে দরজায় টোকা দিয়ে বললেন,
-রূপা, তোমার বাবার নাস্তা রেডি হয়েছে। তুমি দেবে নাকি বুয়াকে পাঠাবো?

আমি হাঁফ ছেড়ে বেঁচে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে গেলাম। নাস্তা নিয়ে বাবার ঘরে গিয়ে দেখলাম উনি পত্রিকা পড়ছেন। আমাকে দেখে বললেন,
-তুমি কষ্ট করে নাস্তা আনলে কেন, বুয়াকে বললেই হতো।

-না, বাবা, ঠিক আছে, এই সুযোগে আপনার সঙ্গে একটু গল্প করা যাবে।

বাবা ডান হাত নাড়াতে পারেন। বাবাকে অল্প উঠিয়ে বিছনার পেছনে হেলান দিয়ে বসালাম। একটা বেডটপ টেবিলে খাবার প্লেট রাখলাম। বাবা খেতে খেতে বললেন,
-আমি তো অথর্ব হয়ে গেছি মা। আমার মতামতের জন্য এই বাড়ির কোন কিছু থেমে থাকে না। খুব ভয়ে ছিলাম মোহন কেমন মেয়ে ঘরে তোলে। কিন্তু তোমাকে দেখে তো আমি অবাক।

-কেন বাবা, অবাক কেন?

বাবা আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন,
-আমার এই ছেলের রুচি নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এই প্রথম সে একটা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বুঝলাম মোহনকে নিয়ে বাবার ইম্প্রেশন খুব একটা সুবিধার না। কে জানে মোহনের আর কী কী সমস্যা আছে।

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ২৬

আমাদের ভার্সিটি আপাতত বন্ধ। মোহন চাচ্ছে না আমি পড়ালেখা চালিয়ে যাই। অথচ আমার শুধু ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা বাকি। মোহন বেরিয়ে যাবার পর মা ঘরে এসে আমার কাছে বসলেন। আমার হাত ধরে বললেন,
-শোন বউ মা, তোমাকে একটা কথা পরিষ্কার করে বলে রাখি।
আমি সাবধান হয়ে বললাম,
-জি মা, বলুন।
-মোহন সাত বছর থাকতে ওর মা মারা যায়। তার এক বছর পর আমি এই সংসারে আসি। মোহন, মিনু আর প্লাবনকে বলতে গেলে আমি এক হাতে মানুষ করেছি। কেবল মিনু আমার নিজের পেটের মেয়ে। তুমি তো প্লাবনকে দেখেছ বিয়েতে?
-জি।
-প্লাবন বাড়ির বড় ছেলে। সে ডাক্তার, চট্টগ্রাম থাকে, সরকারী চাকুরী করে। এ কারণে বিয়েতে এসেই আবার চট্টগ্রাম ফিরে গেছে। যা হোক, যেটা বলছিলাম, তুমি মোহনকে দেখেশুনে বিয়ে করেছো। আমি শুধু একটা কথাই জানিয়ে রাখি।
-কী কথা মা?
-মোহনের ভেতর একটু মহব্বতের অভাব আছে। এই যে এত বছর ধরে ছেলেটাকে বড় করলাম, কখনো আমাকে জিগেস করে না আমার ভালোমন্দ কোন শখ আছে কিনা, আমি কোথাও বেড়াতে যেতে চাই কিনা। তাই কখনো যদি মনে হয় ও একটু হার্টলেস, সেটা কিন্তু ও সবার সঙ্গেই। এটাই ওর স্বভাব।

জানি না কী বলবো। ছেলে আর সৎ মার কোন দ্বন্দ্ব আছে কিনা সেটাও এখনো জানি না। আমার ভাবনায় বাঁধা দিয়ে মা বললেন,
—বউমা, আশা করছি তোমার সঙ্গে থেকে ও একটু নরম হবে। কিন্তু যে কথা আমি তোমাকে বলতে এলাম তা হলো, তুমি কখনো ভুলেও রান্নাঘরে যাবে না।
-কেন মা?
-এ বাড়ির রান্নাবান্না সোমা করে, তাকে খুব হাই স্যালারি দেয়া হয়। আমার মিনু ঘরে যেমন থাকে, তুমিও তেমন থাকবে। কোন সময় যেন না ভাবো সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছো।

শাশুড়ির মার কথায় মন ভরে গেলো। মোহন যেমনই হোক, আমার শ্বশুর শাশুড়ি মনে হচ্ছে অনেক ভালো মানুষ। শাশুড়ি মা বেরিয়ে যেতেই আমার মোবাইলে রিং বেজে উঠলো। অতন্দ্রিলা ফোন করেছে। আমি ফোন ধরতেই অতন্দ্রিলা বললো,
-জাহাঙ্গীরনগরে বসে তোর জন্য মন খারাপ লাগছে রে। প্লিজ চলে আয়। এখুনি।
-কী বলছিস, হুট করে আমি কীভাবে আসবো? তুই চলে আয়।
-ঠিক আছে, তাহলে দরজা খোল।
-মানে?
-আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, তোদের নীচের কেঁচি গেটে তালা লাগানো, উপরে আসতে পারছি না।
হঠাৎ খুশীতে আমার মন ভরে গেলো। বুয়াকে বলতেই বুয়া গিয়ে অতন্দ্রিলা আর দিলশাদকে উপরে নিয়ে এলো। অতন্দ্রিলা যথারীতি কালো শড়ি, কালো লিপস্টিক দিয়ে এসেছে। অতন্দ্রিলা ঘরে ঢুকেই বললো,
-আমাদের দুলাভাই কোথায়?

-একটা কাজে বেরিয়েছে, চলে আসবে ঘন্টাখানেক পর।

-ইস, দুলাভাইকে মিস করলাম। খবর শুনেছিস?

-কী খবর?

-রঞ্জন আর ওর রুমমেট দুজনেই নাকি রেপের সঙ্গে জড়িত। ওই যে ট্রাংক পাওয়া গেলো, ওটা ওদের দুজনেরই। ভেতরের আন্ডারগার্মেন্টে রঞ্জনের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।

আমার গা গুলিয়ে এলো, মনে হলো বমি করে দিই। রঞ্জন এত নীচে নামতে পারে ভাবিনি। নিজেকে কোন রকমে সামলে নিয়ে বললাম,
-পুলিশ কীভাবে জানলো?

-মনে আছে ইন্সপেক্টর লাবণি চন্দ্রিমা আর ক্রমেলা নামের দুজন মেয়েকে আন্ডারকভার হিসেবে আমদের হোস্টেলে রেখেছিল?

-হ্যাঁ।

-ওরা ক্যাম্পাসে কিসব নাইটভিসন ক্যামেরাট্যামেরা বসিয়েছিল?

-হ্যাঁ

এবার দিলশাদ বললো,
-একটা ক্যামেরায় ধরা পড়েছে রঞ্জন খসরুকে স্ট্যাব করছে। ইন্সপেক্টর লাবণি এটা ক’দিন আগেই জেনেছিলেন কিন্তু প্রকাশ করেননি। রঞ্জনকে অনুসরণ করে পুরো গ্রুপটাকে ধরার চেষ্টায় ছিলেন।
-সবাই ধরা পড়েছে?

-হ্যাঁ, বেশীরভাগই আউটসাইডার। এমনকি রঞ্জন নিজেও আউটসাইডার। শুধু একজন জার্মানি পালিয়ে গেছে। উনিভার্সিটি আডমিন ব্যাপারটাকে আপাতত কনফিডেনশিয়াল রাখতে অনুরোধ করেছে।

রঞ্জন আউটসাইডার শুনে অবাক হয়ে বললাম,
-কী বলছো? রঞ্জন ফিজিক্সের ছাত্র না?

-মোটেও না। ও একটা পলিটিকাল পার্টির শেল্টারে ছিল।

-ইন্সপেক্টর লাবণি জানতেন এসব?

-বললাম না উনি আস্তে ধীরে জাল গুটাচ্ছিলেন। এখন সব রুইকাতলা জালে আটকা পড়ে গেছে, এভিডেন্সসহ। তবে পলিটিকাল প্রেসারে আবার কী হয় কে জানে। তুই বড় বাঁচা বেঁচে গেছিস। রঞ্জন নির্ঘাত তোর কোন ক্ষতি করতো।

রঞ্জনের খবর আজ হোক কাল হোক পত্রিকায় আসবে। পত্রিকায় এলে মোহন আমাকে জড়িয়ে কী বলবে কে জানে। আমরা কথা বলার সময় মিনু ট্রেতে চা নিয়ে এলো। আমি মিনুকে অতন্দ্রিলা আর দিলশাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মিনু মোহনের মত না, এখন পযন্ত ওকে দেখে সহজ সরল হাসিখুশী মেয়ে বলেই মনে হয়েছে। ও হোম ইকনমিক্স কলেজে পড়ছে। মিনু অতন্দ্রিলার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপনার গেট আপ কিন্তু আমার দারুণ লেগেছে, অল ব্ল্যাক। মনে হচ্ছে মহিলা ব্যাটম্যান।

অতন্দ্রিলা হেসে ফেললো। আমাকে বাদ দিয়ে ওরা দুজনই গল্পে মেতে উঠলো আমার ভারী মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। ওরা চলে যেতেই মোবাইলে টুং ওরা আওয়াজ হলো। টিটু ভাই ইমেইল করেছেন।

প্রিয় রূপা,
তুমি আমাকে জানাওনি কিন্তু অন্যদের কাছে খালাম্মার অসুস্থতার খবর শুনে খুব কষ্ট পেলাম। তোমার স্বামী বিয়ের আগেই খালাম্মার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন শুনে ভালো লাগলো। উনি নিশ্চয় একজন উদার মনের মহৎ প্রাণ মানুষ। একজন মহৎ মানুষ তোমার জীবনসঙ্গী হবে জেনে স্বস্তি পাচ্ছি। আজ বলতে বাঁধা নেই রঞ্জন ছেলেটিকে আমার কখনোই বিশেষ ভালো লাগেনি। নিজে যেমন দেখেছি আর অন্যদের কাছে যেমন শুনেছি, ছেলেটাকে ধুরন্ধর প্রকৃতির মনে হয়েছে,

রূপা, তুমি বলেছো বিয়ের পর আর যোগাযোগ রাখতে পারবে না। তুমি একাগ্র চিত্তের মেয়ে। নিজেকে যেখানে দাও, পরিপূর্ণভাবে ঢেলে দাও। জানতাম তুমি ও কথাই বলবে । না বললেই বরং অবাক হতাম। আমিও চাই তুমি যে সিদ্ধান্তই নাও না কেন, সেই সিদ্ধান্তের কারণে সুখী কিংবা দুঃখী যাই হওনা কেন, সত্য এবং নিষ্ঠা নিয়ে যেন জীবনটাকে বহন এবং যাপন করতে পারো।

ভালোবাসার উপর কারো হাত থাকে না। এই যে আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেলাম, আনন্দে রঞ্জিত আর বেদনায় বিবর্ণ হলাম, এটা কিন্তু ভেবেচিন্তে হিসেব করে হয়নি। আমার চেতনা যখন যুক্তি দিয়ে বলেছে আমার জীবন জনগণের মুক্তির জন্য নিবেদিত, আমার অবচেতন তখন আমাকেই ফাঁকি দিয়ে হৃদয়ের সিঁধ কেটে তোমার দিকে ঝুঁকেছে। বসন্তের মৃদু কিন্তু মদির হাওয়া এসে আমার ঔচিত্যবোধে বন্দী জীবনকে সৌরভে মন্থিত করেছে।

রূপা, যতদূর বুঝি নানা পার্থিব কারণ বিবেচনা করে তুমি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছ। আমার চেতনা এবং যুক্তি বলছে তুমি ঠিক কাজটিই করেছো। অথচ আমার অবচেতন মন বিষাদ আর যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেছে। অকারনে অশ্রু গ্রন্থীর উপর নিদারুণ চাপ সৃষ্টি হয়েছে, কি একটা বিড়ম্বনার ব্যাপার বলো তো।

রূপা, ভার্সিটি থাকতে অনেকদিন তুমি আমার সাথে কাজ করেছো, আমাদের লিফ্লেটগুলো হলে হলে তুমিই বিলি করেছো। তবু তুমি অধরাই ছিলে, মনে পড়ে না কখনো কোন ছুতায় তোমার আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়েছি। কিন্তু তুমি যে এখন অধরারও অধিক দূরের হবে, তোমাকে শব্দ সাজিয়ে পাঠাতে পারবো না, সে কথা ভাবতে মন ভেঙ্গে যাচ্ছে।

রূপা, আমি বিশ্বাস করি কেউ যদি সত্যি সত্যি কাউকে ভালোবাসে, তাহলে সে সর্বান্তকরণে তার আনন্দে দেখতে চায়। বাগানের হাল্কা রোদে পাপড়ি মেলে দেয়া ফুল দেখে যে আনন্দ পাওয়া যায়, সেটাই ভালোবাসা। সেই ফুল ছিঁড়ে এনে ফুলদানিতে সাজানোটা লোভ। তুমি আমার মনের বাগানে ফুল হয়ে থাকবে।

রূপা, আমি সমস্ত ভালোবাসা নিয়ে সব সময় তোমার পাশেই আছি। অনেক সুখী হও রূপা, অনেক আনন্দে থাকো।

ইতি
রূপামুখী টিটু

টিটু ভাইয়ের ইমেইল পেয়ে আমি বাথরুম গিয়ে ট্যাপ ছেড়ে দিলাম। সেই শব্দের আড়ালে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। ভাবলাম, মানুষের জীবনটা এমন কেন।

(চলবে)