প্রজাপতি উৎসব পর্ব-৩১+৩২

0
274

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩১
আমার একটা জেদ ছিল যে আমি সংসারটা টিকিয়ে রাখবো। জানি না এ রকম জেদ ভালো কিনা কিন্তু এটাই আমি।
আমি বিশ্বাস করি মানুষ অমৃতের সন্তান। তাই মনের ভেতর যত অন্ধকার থাকুক না কেন মোহন একদিন ঠিকই ভালো হয়ে যাবে। ফেরেশটার মত অতিরিক্ত ভালো না। যে কোন স্বাভাবিক হাজবেন্ডের মত গড়পড়তা ভালো। ওইটুকুই আমার চাওয়া।
আমার ধারণা ভুল হয়নি। মোহন আগের থেকে অনেক বদলে গেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য মোহন আর কখনো আমার গায়ে হাত তুলেনি। উল্টাপাল্টা জোরজবরদস্তি করেনি। পুরনো প্রেমের কথাও মোহন শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছে। নানা কারণে একটা মানুষের বিয়ের আগে এক বা একাধিক প্রেম হতেই পারে। কিন্তু মোহন বলেছিল প্রেমিকা তো দূরের কথা, ওর কোন মেয়ে বন্ধুও নেই। মোহন দাবী করে আমাকে ইম্প্রেস করবার জন্য সে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না ভাব ধরেছিল। মোহন কথা দিয়েছে সে মিথ্যে কথা বলা কমিয়ে ফেলবে।
মোহন সুদর্শন যুবক, টল অ্যান্ড হ্যান্ডসাম। মোহন হাসলে ওর গালে অদ্ভুত সুন্দর একটা টোল পড়ে। দেখলেই মনটা কেঁপে ওঠে। অথচ এমন মোহনীয় ছেলের মনের ভেতর লুকিয়ে ছিল একটা আদিম পিশাচ। সেই পিশাচটা আমাদের জীবন জারাজারা করে দিয়েছিল। মাঝে মাঝে নিজেকেই প্রশ্ন করি, আমি তো ওর কাছে নাও ফিরতে পারতাম? তাহলে কেন ফিরলাম? মোহনকে নিয়ে এত ধৈর্য ধরবার কী দরকার ছিল আমার?
নিজেকে বিশ্লেষণ করে বুঝলাম আমি অতন্দ্রিলার মত দুঃসাহসী বেপরোয়া মেয়ে না। আমি অতি সাধারণ মেয়ে, অতি ঘরোয়া। আমার স্বপ্নগুলো অতি ছোট ছোট। আমার আরও দুর্বলতা আছে। আমি ঝুঁকি নিতে ভয় পাই। আমি একবার হ্যাঁ বলে তারপর আর না বলতে পারি না। আশেপাশের লোকজন কী বলবে সেটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যই আমি চেয়েছি আমার সংসারটা টিকে থাক, মোহন ভালো হয়ে যাক, কেউ আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করুক।।
মাঝে মাঝে মনে হয় যে মানুষটি সত্যি আমাকে ভালোবাসতো, তার আবেগের কোন মূল্যই আমি দিতে পারিনি। সহসা সেই প্রেম এসেছিল মহাসমারোহে। কিন্তু সময়টা ছিল প্রতিকূল। এ জন্যই বলে টাইমিং ইজ এভরিথিং। যাক, যা গেছে তা যাক। আমি আমার সংসারটা আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাই। এ কারণে টিটু ভাইয়ের শেষ চিঠির কোন জবাব দিইনি। প্রতিটা উত্তর মানেই টিটু ভাইকে কোন নতুন আশায় ঝুলিয়ে রাখা। সেটা ঠিক না। টিটু ভাই লিখেছিল,
প্রিয় রূপা,
জানি এই ইমেইলটা করা উচিত হয়নি। কিন্তু করে ফেললাম। অনেকেটা ইউক্রেনে রাশিয়ার সীমা এবং সীমান্ত লঙ্ঘনের মত।আশ্চর্য ব্যাপার হলো অর্ধেক রাশানরা বিশ্বাস করতে চায় না যে রাশিয়া সত্যি সত্যি ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। বাকি অর্ধেক অবাক এবং আহত হয়ে ভাবে এটা কী হলো।
ঠিক তেমনি আমার অর্ধেক মন এখনো বিশ্বাস করে না যে তুমি কারো বিবাহিত স্ত্রী। বাকি অর্ধেক মন অবাক এবং আহত হয়ে ভাবে এটা কী হলো। দুই অর্ধেক মনই নানা টালবাহানায় আমাকে চিঠি লিখতে বসায়। আমি যে আজও মনের অধীন।
রূপা, এখন গভীর রাত। চারদিকে নিবিড় নিস্তব্ধতা। শুধু আমার মনের জলাজংলায় শিশিরের মত টুপ টুপ করে ঝরছে তোমার স্মৃতি। আমার তৃষার্ত মন চাতক পাখীর মত সেই শিশিরের জলে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।
মনে আছে অনেক আগে লুদমিলা নামের একটা মেয়ের কথা বলেছিলাম? টিপিকাল রাশান মেয়েদের মত সেও ভীষণ লাবণ্যময়ী। লুদমিলা অনেকদিন ধরে আমার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে। গতকাল রাখঢাক না করে বলেই ফেললো,
-টিটু আমি তোমার মনটা চাই।
আমি বললাম,
-আমার মন তো আমি বাংলাদেশে রেখে এসেছি।
লুদমিলা অবাক হয়ে বললো,
-বাংলাদেশে কার কাছে রেখে এসেছো?
আমি বললাম,
-রূপার কাছে।
লুদমিলা নিশ্চিত হবার জন্য জিগেস করলো,
-সে কি তোমার মনের যত্ন নিচ্ছে নাকি অনাদরে, অবহেলায় ফেলে রেখেছে?
প্রশ্নটা আমারও। রূপা, তুমি কি আমার মনটা অনাদরে অবহেলায় ফেলে দিয়েছো? নাকি পুরনো কাপড়ের মত তিন চার ভাঁজ করে কয়েকটা ন্যাপথলিনসহ মনের সিন্দুকে উঠিয়ে রেখেছো?
ইতি
রুপামুখী টিটু।
টিটুর সেই চিঠির আমি কোন উত্তর দিইনি। কান্না এসেছে কিন্তু ভালোই করেছি উত্তর না দিয়ে। ভুল হোক, ঠিক হোক, মন এক যায়গায় পুরোপুরি দেয়াই ভালো। যদি কোন দিন মন উঠিয়ে নিতে হয়, পুরোটাই উঠিয়ে নেবো।
কদিন আগে ঢাকার সব অম্লমধুর স্মৃতি ভুলে আমরা লন্ডন চলে এসেছি। লন্ডনে মোহন আর ইলোরাকে নিয়ে আমার নতুন জীবন শুরু হলো। ইলোরা এখনও আমার পেটে। সব ঠিক থাকলে আর তিন মাস পর রয়্যাল লন্ডন হাসপাতালে ইলোরা পৃথিবীর আলো দেখবে। আমি যখন দ্বিতীয়বারের মত কন্সিভ করলাম, মোহন আগের মত বিরক্তি দেখালো না। অতি উচ্ছাস প্রকাশ না করলেও, গতবারের দুর্ব্যবহারের ক্ষতি পুষিয়ে দেবার জন্য মোহন নিয়ম করে ফলমূল এটাসেটা এনে যত্নআত্নি করেছে।
তবে গত ক মাসে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছি যেটা আগে নজরে পড়েনি। আমি অন্য কোন পুরুষের দিকে তাকালে, কিম্বা অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে হেসে কথা বললে মোহন কেমন নিষ্প্রভ হয়ে যায়। ব্যাপারটা অন্যরা বুঝতে পারে না কিন্তু আমি মোহনের চোখমুখের সূক্ষ্ম পরিবর্তন দেখে দেখে আঁচ করতে পারি। বিয়ে বাড়িতে, জন্মদিন কিংবা অন্য কোন অনুষ্ঠানে গেলে সামাজিকতার খাতিরে অনেকের সঙ্গে আলাপ করতেই হয়। সেটাই স্বাভাবিক। এই তো সেদিন মোহনের এক ক্লাসমেটের বিয়েতে গেলাম। মোহন ওর বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। ওদের ভেতর বিমানের পাইলট খালেদ ভাই আমার সঙ্গে একটু বেশী আগ্রহ নিয়েই গল্প করছিলেন। আমিও ভদ্রতা করে ওনার কথা শুনছিলাম। এছাড়া উপায় কী? মোহন স্মিত হাসি দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল।একটু পর মোহনের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম ও ঈর্ষা বোধ করছে। বাসায় ফিরেও মোহন কেমন থম মেরে রইলো। অনেক জোরাজুরির পর বললো,
-শাড়ি পড়লে তোমাকে অন্যদের থেকে বেশী সুন্দর লাগে।
আমি খুশী হয়ে বললাম,
-সেটা তো ভালো যে তোমার স্ত্রী সুন্দরী।
-খালেদ সারাক্ষণ তোমার দিকে হা করে তাকিয়েছিল। ভালো হতো তুমি ওকে ইগ্নোর করলে। না হলে পরে পেয়ে বসবে, ভাববে প্রশ্রয় দিচ্ছো।
-সেটা তো আগে বলোনি?
-হুম, আগে তো বুঝিনি খালেদ তোমাকে দেখে ক্রেইজি হয়ে যাবে।
-ঠিক আছে নেক্সট টাইম ব্যাপারটা খেয়াল রাখবো।
স্বামী তো আর সন্যাসী না, স্বামী হলো সংসারী। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না স্বামী হিসেবে মোহনের এই অতিরিক্ত অধিকারবোধ ভালো নাকি মন্দ? নিজের স্ত্রীকে অবহেলা করার চেয়ে তাকে নিয়ে অতিসচেতন থাকাটাই কী ভালোবাসার লক্ষণ?
আমরা লন্ডন যাবার আগের দিন দিলশাদ, অতন্দ্রিলা আর মিলি এসেছিল দেখা করতে। ওদের সবার মন ভীষণ খারাপ। এই যে দেশ ছেড়ে যাবো, আবার কবে সবাই একসাথে হবো কে জানে। এভাবেই বন্ধুরা আস্তে আস্তে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়, সময় আর দূরত্বের কারণে সম্পর্কের সুরটা হয়তো কেটে যায়। তাই ওদের সঙ্গের সময়টা আমি ভীষণ উপভোগ করছিলাম। দিলশাদ বললো ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে, হবু বর বারডেমের ডাক্তার। দিলশাদ শুরু থেকেই বিয়ের ঝামেলা ওর বাবামায়ের কাঁধে ছেড়ে দিয়েছিল। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে সে বেশ উত্তেজিত। মিলি মিলির মত ভালো আছে, ওর হাজবেন্ড ওকে পাগলের মত ভালোবাসে। ফিরে যাবার সময় দিলশাদ আর মিলি আগেই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গিয়েছিল। অতন্দ্রিলা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে বলেলো,
-সত্যিই চলে যাচ্ছিস রূপা?
-হুম, কিন্তু এখন তো চাইলেই মেসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপে কল দেয়া যায়।
-মায়া করে জড়িয়ে ধরা তো যায় না।
-তা যায় না।
-এখন তুই কোন বিপদে পড়লে আমি চাইলেও ছুটে আসতে পারবো না। ব্যাপারটা খুব প্যাথেটিক।
-হ্যাঁ, সেটা সত্যি।
-আচ্ছা রূপা, একটা কথা কখনো ভেবেছিস?
-কী কথা?
-একটা মেয়েও আরেকটা মেয়েকে গভীরভাবে ভালোবাসতে পারে, এটা কখনো মনে হয়েছে তোর?
-হ্যাঁ, কেন না? সবাই সবাইকে ভালবাসতে পারে।
-আমি সেটা মিন করিনি রূপা,আমি মিন করেছি… আচ্ছা বাদ দে, ভালো থাক তুই।
অতন্দ্রিলার মত শক্ত মেয়ে যে যাবার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু এখনো অনেক গোছগাছ বাকি। অত ভাবারও সময় নেই আমার হাতে।
মোহনের অ্যাকাউন্টিং কোর্সের ক্লাস সেপ্টেম্বরে আরম্ভ হবে। কোভিডের প্রকোপ এখন আর আগের মত নেই। আমরা লন্ডনে চলে এলাম জুলাই মাসে। কদিন বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্টে থেকে আমরা ইজলিংটনে একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করলাম। প্রতিদিন টিউবে করে আমরা চলে যাই ঝকঝকে আয়নার মত ওয়েস্ট লন্ডনে। সেদিন লন্ডন আই-এ চড়লাম। আমি প্রেগন্যান্ট বলে কিনা জানি না, লন্ডন আইকে দেখে মনে হচ্ছিল গর্ভবতীর সামান্য সামনে হেলে থাকা পেট। উটপাখীর ডিমের মত কাঁচের ক্যাপ্সুল্টা যখন উপর দিকে উঠছিল, পুরো লন্ডন শহরটা ধীরে ধীরে চোখের সামনে উন্মোচিত হচ্ছিল। আমি শক্ত করে মোহনের হাত ধরেছিলাম কারণ এত সুন্দর দৃশ্য কারও উষ্ণ হাতের স্পর্শ ছাড়া উপভোগ করতে ভালো লাগে না।
(চলবে)

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩২
আজ টাওয়ার হ্যামলেটে বাঙ্গালীদের অনুষ্ঠান আছে। মোহনের বন্ধু মাসুম ভাই আমাদেরকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়েছে।
অনুষ্ঠানে ঢুকে মনে হলো আমরা বাংলাদেশেই আছি। রঙ্গিন শাড়ি আর পাঞ্জাবী পরা মহিলা পুরুষে অডিটোরিয়াম সরগরম। আমি চেয়ার টেনে বসতে বসতে টের পেলাম কেউ প্রমিত বাংলায়, কেউ ঢাকার ভাষায় আবার কেউ সিলেটি টানে আড্ডা জুড়ে দিয়েছে। আমাদেরকে দেখে এক আপা এসে বললো,
-আপনাদের তো আগে দেখিনি? এই প্রথম এলেন নাকি আমাদের প্রোগ্রামে?
আমি বললাম,
-জি, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি মাত্র একমাস হলো।
-আমি সাদিয়া। আমি সিলেটে বর্ন অ্যান্ড ব্রটআপ। ইন্টারমিডিয়েটের সময় বিয়ে হয়ে চলে আসি এখানে। তবে ঢাকাইয়া ভালো মাতবার পারি।
-আমি রূপা, আর ইনি আমার হাজবেন্ড মোহন।
-আপনাদের নিয়ে কিন্তু খুব টানাটানি পড়ে যাবে। বিশেষ করে আপনাকে নিয়ে রূপা।
-কেন টানাটানি পড়বে?
-কেন কী আবার? শাড়ি পড়ে আপনাকে এত সুন্দর লাগছে, মনে হচ্ছে কোন ক্লাসিক উপন্যাস থেকে উঠে এসেছেন। তবে মোহন সাহেব যখন আছে ভয় নেই। উনি আপনাকে রক্ষা করবেন। আপনারা কি সেটল করছেন এখানে?
মোহন বললো
-সে রকম তো কিছু ভাবিনি। আমি মাস্টার্স করতে এসেছি, অফিস থেকে এক বছরেরে ছুটি পেয়েছি।
-উহ, সবাই ভাবে ফিরে যাবে, কিন্তু কেন যেন ফেরা হয় না। কীভাবে কীভাবে এখানে শিকড় গেঁড়ে যায়। পনেরো বছর হয়ে গেলো আমি এ দেশে। কিন্তু মনে হয় এই সেদিন গাট্টিবচকা নিয়ে এসেছি। আপনারাও দেখবেন চোখের পলকে সময় কোথায় উধাও হয়ে গেছে।
-তাই?
-জি, তবে এখানে একটা সমস্যা আছে।
আমি বললাম,
-কী সমস্যা?
-ইস্ট লন্ডন মানে হোয়াইট চ্যাপেল, টাওয়ার হ্যামলেট, ব্রিকলেন এসব যায়গায় আমাদের একটা কমফোর্ট জোন তৈরি হয়েছে। বাংলা কথা, বাঙ্গালী খাবার, বাংলা সাইনবোর্ড, এমনকি বাঙালি চাকুরী। এটা একটা মিনি বাংলাদেশ বলতে পারেন। একবার এখানে অভ্যস্ত হয়ে গেলে আর ইউকের মেইনস্ট্রিমে মেশা হয়ে ওঠে না। পার্সোনাল ডেভেলপমেন্ট আটকে যায়।
-আমরা ইজলিংটনে থাকি, ওখানেও অনেক বাঙ্গালী কিন্তু ব্রিকলেন কিংবা গ্রিন স্ট্রিটের মত না।
আপু এবার আমার পেটের দিকে তাকিয়ে বললো,
-কবে এক্সপেক্ট করছেন?
-নভেম্বরে।
-কংগ্রাচুলেশন্স। বেশী দিন নেই তো।
-জি, বেশী দিন বাকি নেই।
-গাড়ি কিনেছেন?
মোহন বললো,
-এখনো কেনা হয়নি। বাংলাদেশের লাইসেন্সে মনে হয় মাত্র ছয় মাস চালাতে দেয়। এক মাস তো চলেই গেলো।
-তাড়াতাড়ি গাড়ি কিনে ফেলাই ভালো। এখন তো রূপা চালাতে পারবেনা কিন্তু আপনি চাইলে ড্রাইভিং লেসন নিতে পারে। এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ভালো হলেও দরকারে বেদরকারে একটা গাড়ি থাকা লাগে।
-হুম, ভালো অ্যাডভাইস দিয়েছেন।
সাদিয়া আপা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-যতদিন গাড়ি নেই, যে কোন প্রয়োজনে আমাকে কল করবেন, আমার ফোন নম্বর দিয়ে দেবো।
সাদিয়া আপুর বয়স বোঝা যায় না। শরীরের আঁটো গড়ন দেখে মনে হয় বয়স পঁয়ত্রিশ। আবার চোখের কোণে বলিরেখা জানান দেয় ওনার বয়স পঁয়তাল্লিশও হতে পারে। তবে সাদিয়া আপু এই কমিউনিটির কেউকেট গোছের কেউ হবেন। সবাই ওনার সঙ্গে একবার করে কথা বলে যাচ্ছে। মোহন ওর বন্ধুর সঙ্গে অন্যদিকে চলে গেলো। সাদিয়া আপু আমাকে মেয়েদের ভিড়ে দিকে নিয়ে গেলো। যেতে যেতে একটা মেয়েকে দেখিয়ে বললো,
-ওই যে মেয়েটা দেখছেন না, সবুজ শাড়ি পরা।
-হ্যাঁ, ভেরি প্রিটি।
-ও এলিটা। ওর সঙ্গে হাই হ্যালো করবেন কিন্তু বেশী মিশবেন না।
-কেন?
সাদিয়া আপু আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো,
-দুষ্টু প্রকৃতির মেয়ে। অনেক গল্প আছে, পরে বলবো।
সাদিয়া আপাকে আসতে দেখে লাল শাড়ি আর কালো হিজাব পরা একটা মেয়ে এসে বললো,
-আপা, আমার গানটা আগে দেয়া যায় না?
-সব তো স্কেজুল করা, তোমাকে আগে দিলে অন্যরা কাউমাউ করবে।
-আমাকে চারটায় আরেক যায়গায় যেতে হবে, সেমিনের মেয়ের জন্মদিন।
-আচ্ছা দেখি কী করা যায়। এনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে?
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপনাকে বোধহয় আগে দেখিনি। আমি শাপলা।
-আমি রূপা, এক মাস হলো এখানে এলাম। আগে কোন প্রোগ্রামে আসিনি তো।
-অনেক দিন তো কোন অফলাইন প্রোগ্রাম হয়নি, কভিডের জন্য সব অনলাইন ছিল। আপনি সময় মতই এসেছেন।
শাপলা ওনার হাজবেন্ডের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদদ্রলোক মহা আগ্রহে গল্প জুড়ে দিলো, সঙ্গে যোগ দিলো ওনার আরেক বন্ধু। এভাবে কে কখন এসে গল্প করে গেলো আমি ঠাওর পেলাম না।
একটু পর হঠাৎ মোহন আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে এক পাশে ডেকে নিলো। থমথমে গলায় বললো,
-রূপা, একটা রিকোয়েস্ট করবো?
-হ্যাঁ, শিওর।
– টয়লেটে গিয়ে ঠোঁটের লিপস্টিক মুছে এসো।
-কেন?
-অনেক লোক তোমার সঙ্গে এসে গল্প করছে।
-আমি কী করবো এরা কথা বললে? আমি তো না করতে পারি না।
-ডোন্ট গেট মি রং, আমি মানুষ ধুয়ে খেয়েছি, এগুলা সব খবিশ লোক।
-কীভাবে বুঝলে?
-একটু আগে লাল শার্ট পরা একজন কথা বললো না তোমার সঙ্গে?
-হ্যাঁ, বাতেন ভাই।
-অতো ভাই ভাই করো না। চেহারা দেখলেই বুঝা যায় লম্পট লুম্পেন লোক একটা। আমি তো তোমাকে হিমালয় পাহাড়ে উঠতে বলছি না। জাস্ট লিপস্টিক মুছে আসো, খামোখা মানুষ অ্যাট্রাক্ট করার দরকার নেই।
মোহনের সঙ্গে তর্ক করতে গেলে সিন ক্রিয়েট হবে। আমি টয়লেটে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটা টিস্যু পেপার দিয়ে লিপস্টিক মুছে ফেললাম। পাশে একজন মহিলা চোখে কাজল দিচ্ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন,
-আমি কাজল লাগাচ্ছি আর আপনাকে দেখি লিপস্টিক মুছে ফেলছেন।
-বুঝলাম না, হঠাৎ এলার্জিক রিয়েকশন হয়েছে।
-অনেক সময় হয়, সব তো কেমিকেল দিয়ে বানানো। আমারটা ইউজ করে দেখবেন?
-না, না ঠোঁট চুলকোচ্ছে এখন।
-আপনাকে দূর দেখে দেখলাম। সঙ্গের ভদ্রলোক কি আপনার হাজবেন্ড, ওই যে নীল পাঞ্জাবী পরা?
-জি।
-ওনাকে চেনা চেনা লাগছিল, উনি কি মোহন ভাই?
-জি, আপনি কীভাবে চেনেন?
-তাই তো বলি, গোঁফ কেটে ফেলায় কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। আমার এক বান্ধবী ছিল রাবেয়া, তার ফেন্ড নায়লা। নায়লার সঙ্গে অনেকেবার দেখেছি ডিইউ-এ।
-আপনি ঢাকায় ছিলেন?
-হ্যাঁ, দু বছর হলো এসেছি। হাজবেন্ড প্ল্যাব দিলো। এখন উইকফোর্ডে জিপি।
-আপনার হাজবেন্ড ডাক্তার?
-হ্যাঁ। আমি সুমাইয়া। আমি কিন্তু ডিইউতে সোশিওলজি পড়েছি।
-আমি জাহাঙ্গীরনগরে ছিলাম, ডিইউতে ফ্রেন্ডরা ছিল কিন্তু অত যাওয়া হয়নি। আচ্ছা আপনি যে নায়লার কথা বললেন। নায়লা এখন কোথায়?
-নায়লা তো আমার মতই বিয়ে করে ইউকে চলে এলো।
কথাটা আমার ভালো লাগলো না, কেমন অশনি সংকেতের মত শোনালো। বললাম,
-আপনি যে বললেন মোহনের সঙ্গে কিছু ছিল? আপনি কীভাবে জানলেন?
-ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই জানতো। এগুলো কি ঢেকে রাখা যায়?
-ওরা বিয়ে করলো না কেন?
-ভার্সিটি লাইফে কত কিছুই হয়। সবাই একটা এক্সপেরিয়েন্স চায়। কিন্তু বিয়ে করার সময় অনেক মেয়ে বুঝে বিয়ে করে, ঠিক কিনা?
-আমি শিওর না। আমি অত হিসেব করে কিছু করিনি কখনো।
-আমি শুনেছি নায়লার হাজবেন্ড সাউথাম্পটন নাকি নটিংহ্যাম কোথায় জেনারেল প্র্যাকটিস করছেন। আমার হাজবেন্ডেরর মতই।
-ওহ আচ্ছা।
আমার ম্লান মুখ দেখে সুমাইয়া বললেন,
-আসলে আমার এই প্রসঙ্গ ওঠানো উচিত হয়নি। আপনাকে খামোখা চিন্তার ভেতরে ফেললাম। মোহন ভাইকে দেখে চেনা লাগলো তো, তাই এত কথা বললাম।
-আপনি তো ওকে আগে থেকেই চেনেন। চলুন আবার পরিচয় করিয়ে দিই, ও হয়তো আপনাকে দেখে অবাক হয়ে যাবে।
-আরে না,আমি মোহন ভাই বলছি ঠিকই কিন্তুই আমি ওনাকে সরাসরি চিনি না। এত মেয়ের মাঝে উনি আমাকে আলাদা করে মনে রেখেছেন বলে মনে হয় না।
সত্যই মোহন সুমাইয়াকে চিনতে পারলো না। একটা ছোট মেয়ে গাইছিলো, প্রজাপতি, প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গিন পাখা। শুনে মনে হচ্ছিল আমিও নির্ভার রঙিন পাখা মেলে চঞ্চল হাওয়ায় উড়ে বেড়াই। কোন নজরদারি থাকবে না, শুধুই আমি।
সেদিন রাতে বিবাহিত জীবনের যুগল শয্যার বেদীতে নিজেকে বিসর্জন দিতে দিতে ভাবছিলাম, মোহনকে কি জানে বসন্তের মৃদু বাতাসকে চার দেয়ালে আটক ফেললে তা কেমন গুমোট আর স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায়?
(চলবে)