প্রজাপতি উৎসব পর্ব-৩৫+৩৬

0
304

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩৫
সাদিয়া আপুর বাসায় আজ রাতে দাওয়াত ছিল। মোহন ড্রাইভিং টেস্ট পাশ করে একটা গাড়ি কিনেছে। দশ বছরের পুরনো, সত্তর হাজার মাইলেজের বিএমডাব্লিউ । রূপালী রঙের হ্যাচব্যাকটা নিয়ে আমরা সন্ধ্যা ছটায় সাদিয়া আপুদের বার্কিং-এর বাসায় হাজির হলাম।
সাদিয়া আপুর হাজবেন্ড সেলিম ভাই ব্ল্যাক ক্যাব ট্যাক্সি চালান। লন্ডনে ব্ল্যাক ক্যাব ট্যাক্সি ড্রাইভারের আয় অনেক চাকুরীজীবীর আয়ের চেয়ে বেশী। সেটা ওদের বাড়ি দেখলেও বোঝা যায়। তিন বেডরুমের দোতালা বাড়িটা পেছেনে বর্ধিত করে বড় একটা লাউঞ্জ বানানো হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখলাম পরিচিত আরও অনেকেই এসেছে। আমাকে দেখে সাদিয়া আপু এগিয়ে এসে বললেন,
-আল্লাগো, যে বালা লাগে তুমি যে আমরার গরো আইসো।
এখন আমি মোটামুটি সিলেটি বুঝতে পারি কিন্তু বলতে পারি না। আমি সাদিয়া আপার হাত ধরে বললাম,
-আপনি ইনভাইট করেছেন বলে আমরাও খুশি। আমার তাইনে তো আবার সিলটি বুঝইন না।
-আহা তাই তো। আসুন মোহন ভাই। ওখানে আমার হাজবেন্ড আছেন। তাইন তো আফনেরে কুব বালা ফাইন।
মোহন হেসে বললো,
-সে তো হবেই আপা। একজন ভালো মানুষ আরেকজন ভালো মানুষকে পছন্দ করবে ওটাই স্বাভাবিক।
মোহন সেলিম ভাইয়ের সাথে গল্প করতে চলে গেলো। সাদিয়া আপু বললেন,
-এলিটা এসেছে। জানো তো ওর বিয়ে?
-না জানি না তো।
-কেন তোমাকে ইনভাইট করেনি?
-আমার সঙ্গে তো ওনার পরিচয় নেই, আপনি সাবধান করার পর আমি আর আগ বাড়িয়ে ওনার সঙ্গে মিশিনি।
-এলিটা বাংলাদেশ থেকে ছেলে বিয়ে করে আনছে।
-ভালোই তো। কিন্তু এখানে কাউকে পেলো না?
-ওর বাবা মা ওদের রিলেটিভের সঙ্গে ওর বিয়ে দিতে চাচ্ছে।
-এলিটা রাজি আছে।?
-অরাজি নেই। কিন্তু ছেলে খুব সিরিয়াস। মেয়ের কোন আগের সম্পর্ক থাকতে পারবে না।
-তেমন হতেই পারে। যার যেমন শর্ত। বলেকয়েই তো বিয়ে হচ্ছে।
সাদিয়া আপু এবার আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন,
-এলিটার কত বয়ফ্রেন্ড ছিল জানো?
-নাহ। আমি কীভাবে জানবো আপু?
-আমি নিজেই তো ওকে তিনটা ছেলের সাথে মিশতে দেখেছি। তার ভেতর একটা ছেলের সঙ্গে কিছুদিন লিভ টুগেদারও করেছে।
-এলিটার হবু স্বামী তো শর্ত দিয়ে রেখেছে। তাহলে তো বিয়ের রাতে…
-সেটাই তো। বিয়ের রাতে তো সব মিথ্যা ফাঁস হয়ে যাবে। এজন্য এলিটা কী করেছে জানো?
-কী করেছে?
-টার্কি গিয়ে সার্জারি করিয়ে এসেছে।
-সার্জারি মানে? কীসের সার্জারি?
-উফ বুঝো না কেন। সেই সার্জারি?
-কোন সার্জারি?
সাদিয়া আপু কপালে হাত দিয়ে বললেন,
-উফ। হাউমেনোপ্লাস্টি। আবার সে নতুন করে ভার্জিন হবে। ছি, কী অবস্থা ভাবতে পারো?
আমার কান গরম হয়ে গেলো। অস্বস্তি নিয়ে বললাম,
-আপু আমার ভালো লাগছে না এসব শুনতে। আমারএতে কোন আগ্রহ নেই।
আমার অনাগ্রহে সাদিয় আপু একটু নিভে গিয়ে বললেন,
-তুমি তাহলে লিভিং রুমে গিয়ে গল্প করো। আমার কিচেনে কিছু কাজ আছে। একটু পর আসছি।
-আমি কি হ্যান্ড দিতে পারি আপু?
-না, না, লাগলে বলবো। যাও গিয়ে অন্যদের সাথে গল্প করো।
আমি লিভিং রুমে গিয়ে দেখলাম এলিটা আর শাপলা আলাপ জুড়ে দিয়েছে। শাপলা আমাকে এলিটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো,
-এলিটাকে চেনেন?
আমি বললাম,
-আগে দু একবার দেখেছি কিন্তু পরিচয় হয়নি।
এলিটা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপনাকেও চেনা লাগছে আপু। আমি এলিটা। ওই হ্যান্ডসাম ভদ্রলোক কি আপনার হাজবেন্ড?
এলিটার কথায় আমি সাবধান হয়ে বললাম,
-কে মোহন?
-জি জি মোহন ভাই।
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। শাপলা খুশী হয়ে বললো,
-আমার সঙ্গে একটু আগে মোহন ভাইয়ের গল্প করলেন। ইস উনি এত সুন্দর করে কথা বলেন। উনি কিন্তু খুব সুইট অ্যানফানি । আপু, মোহন ভাইকে নিয়ে একবার আমার বাসায় আসবেন কিন্তু। আচ্ছা আপু, উনি অ্যাকাউন্ট্যান্ট তাই না?
আমার কোলে পদ্মপাতা কান্না শুরু করেছে। তার উপর এই মেয়ের মোহনকে নিয়ে এত ফ্যানফ্যানানি আমার কেন যেন ভালো লাগছে না। আমি না চাইতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো,
-আপনি নাকি টার্কি গিয়ে কী সার্জারি করিয়ে এসেছেন বিয়ের জন্য?
মুহুর্তের ভেতর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
– আমার বিয়ে আপনি কীভাবে জানলেন?
-খেয়াল নাই কে বলেছে। সার্জারি হয়েছে ঠিকমত?
-আর বলেন না, সার্জারি বলতে একটা দাঁতে রুট ক্যানেল করে ক্যাপ বসানো। এখানে এত খরচ, তাই টার্কি গিয়ে করে এলাম। বিয়ের কথা কিন্তু ফাইনাল হয়নি। ফাইনাল হলে আপনাকে জানাবো। মোহন ভাইকে নিয়ে আসবেন কিন্তু।
বুঝলাম এলিটা মেয়েটা একটু ঘোড়েল প্রকৃতির। এর থেকে সাবধানে থাকা ভালো। আরেকটা মেয়ে এসে এলিটার সাথে গল্প জুড়ে দেয়ায় আমি এ যাত্রা বাঁচলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম মোহন বারবার ঘুরে এলিটাকে দেখছে।
নর্থ সার্কুলার রোড দিয়ে গাড়িতে বাড়ি ফেরার সময় মোহনকে বললাম,
-এলিটা মেয়েটা খুব অ্যাট্রাক্টিভ, তাই না?
মোহন অবাক হয়ে বললো,
-এলিটা কে?
-ওই যে বডি হাগিং লাল সিল্কের গাউন পরে যে মেয়েটা এসেছে। এলিটা তো বললো তোমার সঙ্গে ওর অনেক গল্প হয়েছে।
-ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। ওর নাম এলিটা নাকি? খুব ফানি কিন্তু মেয়েটা।
-আমি জানি না ফানি নাকি, আমার অত কথা হয়নি।
মোহন হঠাৎ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো,
-তোমার মাস্টার্স কোর্স কেমন চলছে?
বুঝলাম মোহন এলিটাকে নিয়ে কথা বলতে চাইছে না। না চাইলে নাই। আমি বললাম,
-ভালোই তো চলছে।
-প্রথম কিস্তির টাকা তো আমি দিলাম। দ্বিতীয় কিস্তির টাকা কবে দিতে হবে?
কোন অপ্রিয় প্রসঙ্গ এলেই মোহন টাকার কথা তুলে আমাকে দুর্বল করে দেয়। আমি বললাম,
-গ্রসারি শপের কাজ থেকে তো টাকা জমাচ্ছি। আর দ্বিতীয় সেমিস্টারেরে টাকা দিতে এখনো অনেকদিন বাকি আছে।
বাড়ি ফিরে মোহন হুইস্কির বোতল নিয়ে বসলো। আগে সে প্রায় রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরতো। কখন ফিরবে, কী আচরণ করবে এ নিয়ে চিন্তায় পড়ে যেতাম। একদিন মাতাল অবস্থায় ডাইনিং টেবিল থেকে দেয়ালে চায়ের কাপ ছুঁড়ে মেরেছিল, অল্পের জন্য পদ্মপাতার গায়ে কোন টুকরো এসে বেঁধেনি। এরপর মোহনকে বলে কয়ে রাজি করিয়েছি ড্রিংক করলে অন্তত ঘরে বসে যেন করে। এখন মোহন মাঝে মধ্যে ঘরে বসে ড্রিংক করে আবার কখনো রাত করে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে। একবার মাতাল হলে মোহনের আচরণ সেই আগের মত হয়ে যায়। রাতে ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার উপর হামলে পড়ে। সবচেয় বড় কথা কোন কারণে মাতালকে বাঁধা দিতে গেলে সে পদ্মপাতার ক্ষতি করবে বলে শাসায়।
পদ্মপাতা এখন তার তুরুপের তাস।
(চলবে)

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩৬

আমার শাড়ি পরতে দারুণ ভালো লাগে।

আমার ভঙ্গুর মনকে জগতের ম্লানিমা থেকে আড়াল করবার জন্য আমার পল্কা শরীরকে একেক দিন ঘিরে থাকে একেক রঙের শাড়ি।

তাই যে কোন নিমন্ত্রণে যাবার আগে আমি যত্ন করে শাড়ি পরি, কপালে শাড়ির রঙ্গ মিলিয়ে গোল টিপ দিই, ঠোঁটে খুব হাল্কা করে মাখি ওষ্ঠরঞ্জনী। পৃথিবীতে কে না চায় তাকে সুন্দর দেখাক? যে নিজেকেই সুন্দর দেখতে চায় না সে কীভাবে পৃথিবীকে সুন্দর দেখতে চাইবে?

কোথাও গেলে মেয়েরা আমার পরিমিত সাজের প্রশংসা করে। ছেলেরা মুগ্ধ হয়ে তাকায়। মোহন প্রশংসা করে না। আবার মন্দও বলে না। সে একটা গৌতম বুদ্ধ টাইপের নির্বিকার ভাব নেয়। জানি না কেন। অথচ রাতের অন্ধকারে আমার শরীর নিয়ে মোহনের লোলুপতার শেষ নেই। তো দিনের আলোয় আমার দিকে একটু মুগ্ধ চোখে তাকায় না কেন? একটু সুন্দর করে প্রশংসা করে না কেন? ওদিকে অন্য কোন লোক আমার সৌন্দর্যের প্রশংসা করলে সে তটস্থ হয়ে ওঠে, যেন রূপবতী হয়ে আমিই কোন অন্যায় করে ফেলেছি।

আজ সন্ধ্যায় লাল সিল্কের শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজেছিলাম। হঠাৎ ইচ্ছে করছিল সৌন্দর্যের মূর্ছনায় মোহনকে মোহিত করতে, ওর মায়া পেতে। মোহন ফিরলো একটু রাত করে, ঘড়িতে তখন রাত পৌনে এগারোটা। পদ্মপাতা ঘুমিয়ে পড়েছে। দরজা খুলতেই মোহন হাল্কা মাতাল কন্ঠে বললো,
-কী রূপা, খুব মৌজ করছো? বসন্ত এসে গেছে বুঝি?

-মানে?

-কার জন্য সেজেছো?

আমি আহত হয়ে বললাম,
-কার জন্য সাজবো আবার? তোমার জন্য।

-তুমি জানো আমি ড্রিংক করলে দেরীতে ফিরি। কে আসে তখন ঘরে?

-কে আসবে ঘরে? কেউ আসে না। একদিন সাদিয়া আপু এসেছিল সেটা তো তোমাকে বলেছি।

-শাক দিয়ে মাছ ঢাকো, অ্যাঁ? সাদিয়া দিয়ে লম্পট বাতেনকে ঢাকো?

কবে আমাদের কমিউনিটির বাতেন ভাই আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করেছেন, ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন, মোহন সেটা নিয়ে এখনও লেগে আছে। আমি তো ভদ্রতার সীমা রেখেই বাতেন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপট করিনি। আমি আহত কন্ঠে বললাম,
-মোহন, তুমি আমার হাজবেন্ড। আমি কি তোমার জন্য সাজতে পারি না? একটা মেয়ে তো তার বরের জন্যই সাজে।

মোহন অবিশ্বাসের হাসি দিয়ে বললো,
-আমার সঙ্গে এসব লুলামি করো না প্লিজ। মেয়েরা কখন কেন আবেদনময়ী সাজ দেয় সব আমার জানা। তোমার এই নটিগিরি আমার জন্য না। প্লিজ, বলো আমি না থাকলে কে আসে বাড়িতে? লুচু বাতেন নাকি নতুন কোন নাগর?

মোহনের কথায় আমার কান লাল হয়ে গেছে। পদ্মপাতা ঘুমিয়ে ছিল। হৈচৈ শুনে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। পদ্মপাতা বিছানায় উঠে বসেছে। ও আমাদের দুজনের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মোহন বিছানার কাছে গিয়ে ছোঁ মেরে পদ্মাপাতাকে দু হাতে পাতালি করে উঠিয়ে বললো,
-ঠিক করে বলো, কে এসেছিল? নইলে তোমার মেয়েকে মেঝেতে আছাড় মারবো।
পদ্মপাতা কি শুধু আমার মেয়ে, ওর কেউ না? আমি পুলিশে খবর দিতে পারি কিন্তু পুলিশ এলে ও উল্টো ইনিয়েবিনিয়ে বলবে আমিই পদ্মপাতাকে মেরেছি। আমি মোহনের কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বললাম,
-বিশ্বাস করো, কেউ আসেনি। তুমি পদ্মপাতাকে জিগেস করে দ্যাখো।

পদ্মাপাতা এখন ভয়ে কাঁদছে। পদ্মপাতার কান্না শুনে বোধহয় মোহনের সম্বিত ফিরলো। আমি মোহনের কাছে থেকে পদ্মাপাতাকে আমার কোলে টেনে নিলাম। পদ্মপাতা আমার ঘাড়ে মুখ গুঁজে রেখেছে। ওর শরীরটা আতঙ্কে কাঁপছে। আমি পদ্মপাতাকে বিছানায় নিয়ে অনেকক্ষণ চেষ্টা করে ঘুম পারালাম। পদ্মপাতা ঘুমিয়ে যাবার পর মোহন আমার কাছে এসে বললো,
-স্যরি রূপা, তুমি তো জানো আমার মাথা হঠাৎ আওলায়ে যায়, প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। আর এমন হবে না। বিছানায় চলো, খুব ইচ্ছে করছে, প্লিজ।

আমি কোন উত্তর দিলাম না। আমি জানি এটা একটা চক্রের মত। প্রতি এক দু সপ্তাহ পরপর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। প্রতিবারই ওর অত্যাচারের মাত্রা একটু একটু করে বাড়ছে। প্রতিবারই সে ক্ষমা চাচ্ছে। এর শেষ কোথায়? এভাবে আর কতদিন? প্রতিবার ভাবি, আর না, এবার সংসার ছেড়ে চলে যাবো। আবার মনে হয়, একবার চলে গেলে পদ্মাপাতা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে হয়ে বড় হবে। সে কথা ভেবে মন দমে যায়।

দেখতে দেখতে সুখেদুঃখে এ দেশে প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেলো। সোয়াস মানে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে আমার মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে গেছে। মোহন যে মাঝপথে আমার পড়া থামিয়ে দেয়নি সেটা বড়ই আশ্চর্য ব্যাপার। এ দেশে মাস্টার্সের ক্লাস সপ্তাহে একদিন কি দুদিন, আর থিসিস তো চাইলে ঘরে বসেই লেখা যায়। মোহন কিছু বুঝার আগেই আমার কোর্স শেষ হয়ে গেছে। রেজাল্টও খুব একটা খারাপ হয়নি। থিসিসে ডিস্টিংকশন ছিল, ওভারঅল মেরিট পেয়েছি।

আমার থিসিস সুপারভাইজর মিসেস বেকহাম একটা বড় রিসার্চ গ্র্যান্ট পেয়েছেন। ওনার রিসার্চ প্রজেক্টের কাজ হলো ইউকেতে দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙ্গালীদের বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং বাংলা ভাষার প্রতি তাদের মনোভাব বিশ্লেষণ করা। প্রজেক্টে একজন ফান্ডেড পিএইচডি স্টুডেন্ট নেয়া হবে। মিসেস বেকহাম আমাকে অ্যাপ্লাই করতে বলেছিলেন। আমি অ্যাপ্লাই করেছি কিন্তু এখনো মোহনকে জানাইনি। আগে থেকে মোহনকে জানালে ও হয়তো কোন ভুজুংভাজাং দিয়ে আমাকে অ্যাপ্লাই করতে মানা করবে। এই প্রোগ্রামের একটা এসেনশয়াল ক্রাইটেরিওন হলো ক্যান্ডিডেটকে বাংলা জানতে হবে এবং সিলেটি বুঝতে হবে। গতকাল জানলাম আমি শর্ট লিস্টেড হয়েছি। মঙ্গলবার দিন জুম ইন্টারভিউ । দেখা যাক কী হয়।

কাজটা পেলে চার বছরের টিউশন ফি ইউনিভার্সিটি দেবে। তারচেয়ে বড় ব্যাপার হলো প্রতি বছর ষোল হাজার পাউন্ড ভাতা পাওয়া যাবে, মানে মাসে তেরশ পাউন্ডেরও বেশী। এ দেশে স্কলারশিপের উপর কোন ট্যাক্স নেই। এই টাকা আর গ্রসারি শপের আয় মিলিয়ে আমি একটা স্টুডিও আপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকতে পারবো। মোহন হঠাৎ শায়লা, নায়লা কিংবা লায়লার সঙ্গে চলে গেলে আমি অন্তত মেয়েকে নিয়ে পথে পড়বো না। বৃত্তিটা পেলে মোহনের ভিসার উপর আমি আর ডিপেন্ডেন্ট থাকবো না। আমার ভিসা কনভার্ট করে আমি স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে নেবো। মঙ্গলবার আসতে এখনো চারদিন বাকি। তারপর বোঝা যাবে আমার ভাগ্যে কী আছে।

একটু আগে আমরা ব্রাইটন সি বিচে ডে ট্রিপে এসেছি। আমরা তিন ফ্যামিলি, আমি, মোহন আর পদ্মপাতা, সাদিয়া আপু আর সেলিম ভাই, এলিটা আর ওর হাজবেন্ড রাজু। শেষ পর্যন্ত এলিটা বাংলাদেশেই বিয়ে করেছে। ওর হাজবেন্ড রাজুর দুটো শর্ত ছিল, ওকে ইউকের সিটিজেনশিপ ম্যানেজ করে দিতে হবে আর এলিটাকে কুমারী হতে হবে। এলিটা টার্কিতে সার্জারি করে কুমারী হয়ে এসেছে, এখন শুধু রাজুর সিটিজেনশিপের অপেক্ষা। হয়তো সিটিজেনশিপের কারণেই রাজু এলিটাকে খুব সমঝে চলে।

বাইরে চড়া রোদ। আমি আধঘন্টা সৈকতে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে তাবুতে বই হাতে বসেছি। সমুদ্রের তীরে শর্টস আর বিকিনি পরে অনেক ছেলে মেয়ে হাঁটছে, দৌড়ুচ্ছে, সাঁতার কাটছে। সমদ্রের উপর দিয়ে সি গাল দল বেঁধে উড়ছে, ভাসছে, ডানা ঝাপ্টাচ্ছে। রোদের প্রতাপে সিবিচের বালু চকচক করছে।

মোহন পদ্মাপাতাকে নিয়ে সমদ্রের তীরে পা ডুবিয়ে হাঁটছে। হাল্কা ঢেউ ওদের দিকে আসতেই ওরা লাফ দিয়ে ঢেউকে ফাঁকি দিচ্ছে। এই মাত্র এলিটা মোহনের দিকে হেঁটে গেলো। মোহন কি চকিতে এলিটার পিঠে হাত রেখেই হাত সরিয়ে নিলো নাকি আমি ভুল দেখলাম? ওরা দুজনএখন মন খুলে হাসছে। হাসতে হাসতে ওরা সামনে এগোচ্ছে। পদ্মপাতা পেছনে পড়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওরা খেয়াল করছে না, ওরা দুজন দুজনে মশগুল।

হঠাৎ একটা প্রবল ঢেউ এসে পদ্মপাতাকে সমুদ্রে টেনে নিলো।

(চলবে)