প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩৭
-ঠিক করে বলুন তো আপনারা কোথায় ছিলেন যখন বাচ্চাটা সমুদ্রে ডুবে গেলো?
কোস্টগার্ড আমাদের সাথে শান্ত কন্ঠে কথা বলছেন। কিন্তু এমনভাবে তাকাচ্ছে্ন মনে হচ্ছে আমরা কতগুলো নির্দয় পাষণ্ড, ঠান্ডা মাথার খুনি। এমন দুঃসময়ে ও রকম দোষী সাব্যস্ত করা ছুরির ফলার মত দৃষ্টি আমি নিতে পারছিলাম না। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
-আমি তাবুতে ছিলাম। ওর বাবা ওকে নিয়ে তীর ধরে হাঁটছিল। ওর বাবা একটু সামনে এগিয়ে গিয়েছিল আর তখুনি ঢেউ এসে পদ্মপাতাকে ভাসিয়ে নিলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাবু থেকে দৌড়ে গিয়েছি পদ্মপাতাকে বাঁচাতে কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে।
এলিটা আমার পাশে চোরের মত দাঁড়িয়ে আছে। আমি এলিটার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকালাম। এই মেয়ে মোহনের নারী ভার্সন। কেন যেন আমি কোস্টগার্ডকে এলিটার কথা বলতে পারলাম না। মনে হলো এলিটার কথা বলা মানে পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়া আমার স্বামী আমার প্রতি আর আকৃষ্ট না, আমি মোহনকে মায়ার বাঁধনে জড়াতে পারিনি। আমি একজন ব্যর্থ স্ত্রী।
-আপনারা কি ব্রাইটন অ্যান্ড হোভ সিটি কাউন্সিলের ওয়েবসাইট দেখে আসেন নাই?
-না। কী দেখবো?
-আমাদের ওয়েবসাইটে পরিষ্কার করে বলা আছে পুরো ইউকের মধ্যে ব্রাইটন সি বিচে সর্বোচ্চ সংখ্যক লোক সমুদ্রে ডুবে মারা যায়। আর বাচ্চাদের মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশী। নিরীহ নিরালা ঢেউ চোরের মত এসে বাচ্চাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
মোহন এবার মুখ খুললো,
-আমরা জানতাম না ব্রাইটন সি বিচে ক্যাজুয়াল্টি সবচেয়ে বেশী। জানলে হয়তো গ্রেট ইয়ারমাউথ কিংবা সাউথেন্ড অন সি-এ যেতাম। কিন্তু এখন এ কথাগুলো বলে কী হবে? যা হবার তা তো হয়েই গেছে। কী ফর্মালিটিজ করতে হবে সেটা বললে ভালো হয়।
-ফর্মালিটিজ বলতে আমরা ভিক্টিমকে হাসপাতালে পাঠাচ্ছি। আপনাদের গাড়ি আছে না?
-হ্যাঁ, আছে।
-আম্বুলেন্সের পেছনে পেছনে অথবা আলাদা করে ব্রাইটন হাসপাতালে চলে যান। ওখান থেকে ভিক্টিমকে বুঝে নেবেন।
আমার মনটা হুহু করে উঠলো, কোনভাবেই কান্না সামলাতে পারলাম না। আহারে আমার পদ্মপাতা, আহারে আমার চাঁদের আলো। আমার কেন বারবার এমন হয়? আমি কেন এত দুর্ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসলাম?
আমরা হসাপাতালে পৌঁছে দৌড়ে ইমারজেন্সিতে গেলাম। আমাদের পরিচয় দিলাম। একজন নার্স এসে আমাদের দিকে আর্দ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আমাকে ফলো করুন। নার্সের পেছন পেছন আমরা একটা ঘরে ঢুকলাম। দেখলাম আমার পদ্মপাতার শান্ত শরীরটা সাদা চাদরে ঢাকা। শুধু মুখের অংশ খোলা। পদ্মপাতার মুখটা যেন আমার মুখ কেটে বসানো। মাতৃমুখী মেয়েরা কি দুর্ভাগা হয়?
পদ্মপাতার মুখে এখন অক্সিজেন মাস্ক বসানো। ডাক্তার বললেন,
-যদিও কোস্টগার্ড সময়মত কৃত্রিম শ্বাস দিয়েছে, সিপিআর করেছে তবু আমরা নিশ্চিত হতে চাই ওর ব্রেইনে যথেষ্ট অক্সিজেন যাচ্ছে। তাছাড়া বেশ অনেকক্ষণ তো সে পানিতে ডুবে ছিল, আমাদের এম আর আই স্ক্যান করে নিশ্চিত হতে হবে ব্রেইনের কোন ক্ষতি হয়নি।
আমি মনে মনে বললাম, হে আল্লাহ, আপনার কাছে হাজার শোকর আমার মেয়েটা বেঁচে আছে। প্রিয় কাউকে পেয়ে হারানোর মত কষ্ট পৃথিবীতে আর কি হতে পারে?
রাতে আমার সোনাপাখি পদ্মপাতাকে ঘরে নিয়ে এলাম। মোহন আজ সত্যিই একটু মিইয়ে গেছে। মিথ্যা মোহের খেসারত কীভাবে দিতে হয় তার একটা আভাস আজ সে পেয়েছে। কাবার্ডে হুইস্কির বোতল আছে। আজ সেটা মোহন ছুঁয়েও দেখলো না। কিচেনে গিয়ে ইনস্ট্যান্ট সুপ গরম পানিতে গুলিয়ে একটা বাটিতে করে সে পদ্মপাতার জন্য নিয়ে এসেছে। এই প্রথম মোহন কিছু একটা নিজের হাতে রাঁধল।
কিন্তু মোহনের এই সংযত আচরণে আজ আর আমার মন দ্রব হলো না। এতদিন ধরে চিকন সুতার একটা বন্ধনে আমি আর মোহন কোনরকমে বিজড়িত ছিলাম। সেই বন্ধনটি আজ ছিন্ন হয়ে গেলো। মোহনের প্রতি আমার মন চিরতার রসের চেয়েও তিতে হয়ে গেছে। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আর মোহনের সঙ্গে ঘর করবো না।
আশ্চর্য ব্যাপার হলো এই সিদ্ধান্ত নেবার পর আমার ভেতরের সব অস্থিরতা কর্পূরের মত উবে গেছে। আমি অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করছি। মোহনের উপর আমার আর রাগ হচ্ছে না। কারণ মোহন এখন থেকে আমার কেউ না।
ব্রাইটনের ঘটনার পর দু সপ্তাহ চলে গেছে। হঠাৎ মনে হচ্ছে, আমাকে শিক্ষা দেবার জন্য সমুদ্র সৈকতের ঘটনাটি মোহন ইচ্ছে করে ঘটায়নি তো? সে তো কখনোই সন্তান চায়নি, আমার চাপে পড়ে সন্তান নিয়েছে। তা না হলে গত পরশু সে আবার কেন পদ্মপাতার গায়ে হাত তুললো? তরকারিতে ঝাল বেশী হওয়া এমন কী অপরাধ ছিল? ভাগ্যিস আমার পিএইচডি স্কলারশিপ হয়ে গেছে। এখন আমি নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারবো।
গ্রসারি শপে আমি এখন বুধ এবং বৃহস্পতিবারও কাজ করি। ওই সময়টা পদ্মপাতা একটা ডে কেয়ার সেন্টারে থাকে। আজ দুপুরে হঠাৎ সোশাল সার্ভিসের দুজন মহিলা একজন পুলিশসহ বাড়িতে এসে হাজির। কী ব্যাপার জানতে চাইলে ওরা উল্টো জিগেসে করলো,
-আপনি কি পদ্মপাতার মা?
-জি।
-আমরা কি ভেতরে আসতে পারি?
-জি আসুন।
ওদেরকে লিভিং রুমে নিয়ে সোফায় বসতে বললাম। বয়স্ক মহিলাটির নাম মিসেস পার্কার। মিসেস পার্কার বললেন,
-আপনার জন্য একটা ব্যাড নিউজ আছে।
আমি বিচলিত হয়ে বললাম,
-কী নিউজ?
-পদ্মপাতার নার্সারি থেকে পুলিশে জানিয়েছিল পদ্মপাতার শরীরে অনেকগুলো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। যতবার জিগেস করা হয়েছে কেউ মারে কিনা, পদ্মপাতা ওর বাবার কথা বলেছে।
পুলিশের লোকটির নাম মিস্টার জোন্স। মিস্তার জোন্স বললেন,
-আপনার হাজবেন্ডকে আমরা অফিস থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ স্টেশনে নিয়ে গেছি। উনি স্বীকার করেছেন যে মেয়েকে মারেন। ওনাকে পুলিশ কাস্টডিতে রেখে কাল আদালতে নেয়া হবে।
মিসেস পার্কার বললেন,
-আপনি কি পদ্মপাতাকে একা দেখে রাখতে পারবেন? না পারলে সোশাল সার্ভিস কিছুদিন টেক কেয়ার করবে।
আমি আঁতকে উঠে বললাম,
-জি না, আমি পারবো।
মিস্টার জোন্স বললেন।
-আপনার হাজবেন্ড তো এখানে ওয়ার্ক ভিসায়?
-জি।
-আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, আদালতে অভিযোগ প্রমানিত হলে আপনার হাজবেন্ডকে এখান থেকে ডিপোর্ট করা হবে। সে ক্ষেত্রে আপনাকেও দেশ ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে। আমি রেকমেন্ড করবো আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোন ইমিগ্রেশন লইয়ারের সঙ্গে কথা বলুন।
ওরা চলে যাবার পর আমি কিছুক্ষণ থ হয়ে রইলাম। ঘটনার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতা বুঝতে আমার অনেকক্ষণ লেগে গেলো।
(চলবে)
প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩৮
আমার এখন অতন্দ্রিলার কথা খুব মনে পড়ছে।
বাংলাদেশে থাকলে অতন্দ্রিলা এসে শক্ত করে আমার হাত ধরে বলতো, তোর কিছু ভাবতে হবে না রূপা, আমি দেখছি। এখানে অতন্দ্রিলা নেই কিন্তু শিখী আছে। আমি শিখীকে ফোন করে সব জানালাম। শিখী শুনে বিরক্ত হয়ে বললো,
-এ রকম একটা লোককে এতদিন সহ্য করলে কেন?
আমি বললাম,
-সব কেনর জবাব হয় না, শিখী। আমি খুব কনভেনশনাল মেয়ে। আমি শেষ পর্যন্ত সংসারর টিকিয়ে রাখতে চেয়েছি। চাইলেই তো লাথি মেরে চলে আসা যায়, হাজবেন্ডের নামে ম্যারিটাল রেপের কেইস করা যায়। এসব কি আমি জানি না?
-তো?
-কিন্তু কেন জানি আমি অন্য মেয়েদের মত সব ভাইঙ্গা ফালা টাইপের রিঅ্যাক্টিভ না। একটা কিছু গড়া থেকে ভাঙ্গা অনেক সহজ। আমি ভাবি মানুষ ভুল করে, মানুষ অন্যায় করে। কিন্ত একদিন না একদিন সে ঠিক পথে ফিরে আসে যদি প্র-অ্যাক্টিভভাবে তাকে ভালো করার চেষ্টা করা হয়। তাছাড়া সংসার ছাড়তে হলে নিজেরও শক্তি সঞ্চয় করতে হয়, আবলাছাবলা বেধড়ক দৌড় দিয়ে খাঁদে পড়লে তো হবে না।
-কিন্তু পদ্মপাতার গায়ে ও যে হাত তুললো, তুমি সেটা সহ্য করলে কীভাবে?
-মোহন বেশীরভাগ সময় পদ্মপাতাকে মারার ভয় দেখিয়েছে। কখনো তুলে আছাড় দিতে চেয়েছে, কিন্তু দেয়নি। আমাকে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করাতে চাইলে এটা ছিল ওর ট্যাক্টিক। আমি মাত্র একবারই দেখেছি মোহন পদ্মপাতাকে কানমলা দিয়েছে, আরেকবার বোধহয় বিছানায় ছুড়ে মেরেছিল।
-মাত্র একবার কানমলা দিয়েছে?
-হ্যাঁ। তুমি তো জানো এই দেশে আমি এ কথা বললে পুলিশ আর সোশাল সার্ভিস এসে ওয়ার্নিং দিয়ে চলে যাবে।
-কিন্তু এখন তো ঠিকই ধরে নিলো।
-এখন চাইল্ড কেয়ার থেকে কমপ্লেইন করেছে দেখে ওরা ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিয়েছে।
-চাইল্ডকেয়ারে যে দাগগুলোর কথা বললো, তুমি গোছল করানোর সময় ওগুলো দেখোনি?
-না, মোহন হয়তো আজ সকালেই কাজটা করেছে। পিঠে জোরে চিমটি বসিয়ে দিয়েছে। পদ্মপাতা ব্যাপারটা ওখানে কাউকে জানিয়েছে।
-তার মানে তুমি বলছ মোহন পদ্মপাতাকে নিয়মিত অত্যাচার করে না, শুধু ভয় দেখায়?
-হ্যাঁ। ভয় দেখানোও একটা অ্যাবিউজ কিন্তু সেটা কাউকে জেলে পাঠাবার মত বড় অপরাধ না কারণ এদেশে রিজোনেবল স্ম্যাকিং অ্যালাউড সেটা তুমি জানো।
– তুমি কি সোনার সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য এখনও মোহনকে সাপোর্ট করে যাবে? তোমার রাগ হয় না?
-কে বললো আমি সংসার টিকিয়ে রাখতে চাইছি? আমি আমার শেষ চেষ্টা করেছি। আমাদের বিয়ের মাত্র চার বছর হয়েছে। সব চেষ্টা শেষে এখন বুঝে গেছি মোহন ভালো হবে না। এ জন্যই তোমাকে ফোন দিলাম। তোমার কোন চেনা ইমিগ্রেশন ল-ইয়ার আছে? আমার কিছু অ্যাডভাইস লাগবে।
বিকেলে শিখী আমাকে গ্রিন স্ট্রিটে ওর পরিচিত ইমিগ্রেশন ল-ইয়ার আহমেদ সলিসিটর্স-এর অফিসে নিয়ে গেলো। আহমেদ সাহেব সব শুনে বললেন,
-ব্যাপারটা যখন আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, আপনার হাজবেন্ড বিরাট ঝুঁকিতে আছেন। অপরাধ প্রমানিত হলে মোহন সাহেব চিল্ড্রেন অ্যান্ড ইয়াং পারসন্স অ্যাক্ট ১৯৯৩-এ দশ বছর পর্যন্ত জেল খাটতে পারেন।
-দশ বছর?
– আপ টু টেন ইয়্যার্স। তবে এখানে একটা ব্যাপার আছে।
-কী ব্যাপার?
-আমরা যে সব কেইস হ্যান্ডেল করি তার তুলনায় এই কেইসটা অত সিভিয়ার না। আমার মনে হয় উনি বড় জোর তিন থেকে ছয় মাস জেল খাটবেন।
-তারপর?
-জেলের মেয়াদ শেষ হবার পর ওনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হবে। আপনি যেহেতু ভিসা ডকুমেন্টে ওনার ডিপেন্ডেন্ট, আপনাকেও তখন বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে।
আমি বললাম,
– কিন্তু আমার তো স্কুল অফ আফ্রিকান অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে পিএইচডি স্কলারশিপ হয়েছে। আমার এখনকার ভিসা স্টুডেন্ট ভিসায় ট্রান্সফার করা যাবে না?
উনি আমার পিএইচডি স্কলারশিপের কথা শুনে খুশী হয়ে বললেন,
-এই কথা আগে বলবেন না? সোয়াশ তো লাইসেন্সড স্টুডেন্ট স্পন্সর। তবে যেহেতু ডিপেন্ডেন্ট ক্যাটাগরি থেকে কনভার্ট করে স্টুডেন্ট ক্যাটাগরিতে যাবেন, বাংলাদেশে ফিরে না গিয়ে সেটা করতে হলে সামান্য কমপ্লিকেসি আছে। আপনি চাইলে সেটা আমরা হ্যান্ডেল করতে পারবো।
-আচ্ছা আপনারাই করুন প্লিজ, আমি এসব কাগজপত্রের ঝামেলায় যেতে চাচ্ছি না।
-আপনার পাসপোর্ট, অ্যাডমিশন ডকুমেন্ট, স্কলারশিপ লেটার এসবের কপি নিয়ে আসুন, আমরা ফাস্ট ট্র্যাকে ভিসা করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবো। আমাদের একটা প্রসেসিং ফি আছে, তবে সেটা এমন বেশী না।
গ্রিন স্ট্রিট থেকে ফেরার সময় শিখী বললো,
-রূপা, তুমি ড্রাইভিংটা শিখে নাও। আমার চেনা একজন ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর আছে, অনেক কম খরচে শিখিয়ে দেবে।
-আমিও সেটা ভেবেছি। এখন ডিসিশন নিতে হবে ম্যানুয়াল নাকি অটোতে চালানো শিখবো।
-ম্যানুয়াল দরকার নেই, অটোতেই শিখো, তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। ইলেক্ট্রিক গাড়ি দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। আর পাঁচ বছর পর তো এমনিতেই লন্ডনের রাস্তায় সেল্ফ ড্রাইভিং কার চলবে। ম্যানুয়ালের দিন শেষ। আমি শুনেছি নর্থ আমেরিকায় কেউই ম্যানুয়াল চালায় না।
পদ্মপাতাকে ডে কেয়ার থেকে তুলে আমি বাড়ি ফিরে এলাম। মোহন নেই। মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেছে, পারলে বাড়ির ছাদে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দিই।
আজ অনেকদিন পর কোন বিশ্রী ঝগড়ার ভয়ে তটস্থ থাকতে হবে না। ভাত বেশী নরম হলো কি শক্ত হলো তা নিয়ে কেউ পদ্মপাতাকে আছাড় দিতে চাইবে না। মোহনের মত তিন বেলা ভাত খেতে আমার মোটেও ভালো লাগে না। আজ মনের আনন্দে পিতজা অর্ডার করবো।
ডোমিনজে অর্ডার করবার জন্য ফোন হাতে নিতেই উল্টো ফোনের রিং বেজে উঠলো। ডিসপ্লেতে তাকিয়ে দেখি হায় আল্লাহ, মোহন ফোন করেছে। চরম বিবমিষা নিয়ে ফোন ধরতেই মোহন বললো,
-রূপামনি, আমি খুব বিপদে পড়ে গেছি।
আমি জানি কী বিপদ, তবু মোহনের মুখে শুনতে চাইলাম,
-তাই, কী বিপদ?
-ওর আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে।
আমি হাল্কা বিদ্রুপ করে বললাম,
-কারা ধরে নিয়ে এসেছে? শায়লা লায়লা,নাকি নায়লা?
-না, না, না, ওরা না। পুলিশ।
-পুলিশ কেন ফেরেশতার মত একটা মানুষকে ধরবে?
মোহন আমার ঠাট্টা বুঝতে না পেরে বললো,
-সেটাই তো রূপামনি। ওরা ভেবেছে আমি চাইল্ড অ্যাবিউজার। আর কেউ না জানুক, তুমি তো জানো মনে মনে আমি কত ভালো একটা মানুষ? এখন শোনো রূপা, ওরা তোমার কাছে এসে জানতে চাইবে আমি পদ্মপাতাকে মারি কিনা, অ্যাবিউজ করি কিনা। তুমি প্লিজ বলবে তোমার মোহন ওরকম খারাপ কাজ করতেই পারে না।
-ওরা যদি জিগেস করে পদ্মপাতার শরীর ব্রুজ এলো কীভাবে?
-রুপামনি,আমার জান, প্লিজ বলবে তুমি পদ্মপাতাকে মেরেছো, ঠিক আছে?
-আমি বলবো আমি পদ্মপাতাকে অ্যাবিউজ করি?
-হ্যাঁ, সব দোষ তুমি নাও। প্লিজ রূপামনি। তুমি না সব সময় পরের উপকার করতে চাও? তুমি দোষ নিলে কী লাভ হবে জানো?
-কী?
-আমার ভিসা বাতিল হবে না। আমার ভিসা বাতিল হলে তোমাকেও ওরা বের করে দেবে রূপামনি।
-আমি যদি বলি আমি পদ্মপাতাকে মেরেছি, ওরা আমাকে জেলে ভরে রাখবে?
-হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি ভালো ল-ইয়ার দিয়ে তোমাকে ছাড়িয়ে আনবো।
-আমি জেলে থাকবো আর পদ্মপাতা তোমার সাথে থাকবে?
-একদম ঠিক বলেছো রূপামণি। আমি তো জানি তুমি একটা এঞ্জেল। প্লিজ এতটুকু করো আমার জন্য।
-তুমি পদ্মপাতাকে মারবে, ভয় দেখাবে আর আমি সেই দোষ নিয়ে জেলে যাবো? তুমি কী মনে করো আমাকে মোহন? আমি কি একটা আহম্মক?
-উফ, এতদূর এসে আবার ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ানে চলে এলে? ভুলে গেছো রূপামনি, তোমার আম্মুর জন্য কতকিছু করেছি আমি?
-হ্যাঁ, করাপ্ট ডাক্তার দিয়ে ভুল অসুখ দেখিয়ে আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলে।
-পুরনো কথা বাদ দাও রূপামনি, জানো তো তোমাকে ছাড়া আমি কখনো চলতে পারিনি? জানো না তুমি?
আমি নরম গলায় বললাম,
-মোহন, সত্যিই তুমি চাও আমি তোমার পাশে থাকি?
-হ্যাঁ রিনিঝিনি, আমি সব সময় চাই আমার কানে তোমার মনের নূপুর বাজুক।
-না, সেজন্য তুমি আমাকে চাও না।
-তাহলে কেন চাইবো তোমাকে রিনিঝিনি আমার?
– তুমি চাও তোমার পাশে আমি থাকি যেন তোমার সব ব্যর্থতার জন্য তুমি আমাকে দায়ী করতে পারো।
-কী বলছো এটা?
-কথা শেষ করিনি। তুমি চাও তোমার পাশে আমি আর পদ্মপাতা থাকি যেন তোমার সব রাগ ক্ষোভ মেটানোর জন্য আমাদেরকে পাঞ্চিং ব্যাগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারো।
– কী আবোলতাবোল কথা বলছো? একজন রোমান্টিক মানুষকে নিয়ে এমন কথা বলতে নেই।
-তোমার ভেতর রোমান্টিক কিছু নেই মোহন। তুমি একটা ঠান্ডা মাথার পিশাচ অথবা সাইকো। এখন আবার বলছো তোমার জেল আমি খাটি আর তুমি অন্য মেয়েদের সাথে ফুর্তি করে বেড়াও। ইউ নিড সায়কায়াট্রিক ট্রিটমেন্ট মোহন। জেল থেকে তোমাকে পাগলা গারদে পাঠানো দরকার।
আমি মোহনের ফোন কেটে দিয়ে শিখীকে ফোন করে বললাম।
-একটা কথা জিগেস করতে ভুলে গেছি শিখী।
-শিওর, বলো।
-তোমার কোন চেনা ডিভোর্স ল-ইয়ার আছে?
(চলবে)