প্রণয়াসক্ত পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
450

#প্রণয়াসক্ত
#অন্তিম_পর্ব
#Sumaiya_Sumu(লেখিকা)

“দেখতে দেখতে কে’টে গেছে ৭ দিন। আজ আমার আর আরাফের গায়ে হলুদ। পুরো বাড়ি খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ঘর ভর্তি মেহমান। কাজিন’রা আমার রুমে শাড়ি, গহনা দিয়ে ভরে রেখেছে। সকাল থেকে আরাফের সাথে কথা বলার একটুও সূযোগ পাই নি। মন’টা ভালো লাগছে না। আরাফ দু’বার কল দিয়েছিলো কিন্তু কাজিন’রা ধরতে দেয় নি। ওদের কথা, দুলাভাইয়ের সাথে কালকে থেকে সারাদিন কথা বলতে পারবি, আজকে না বললেও কিছু হবে না। ওরা ফোন নিয়ে নিয়েছে। এখন আর কি করার! চুপচাপ বসে আছি। হঠাৎ আম্মু এসে তাড়া দিয়ে গেলো রেডি হওয়ার জন্য কিন্তু আমার কিছুতেই মন বসছে না। কাজিন’রা ধরে বেঁধে আমাকে মেকাপ করাচ্ছে। মেকাপ শেষ হতেই একটা লাল আর হলুদের কম্বিনেশনের একটা জামদানী শাড়ি পড়লাম। শাড়ি, ভারি মেকাপ, কাঁচা ফুলের গহনা, হাত ভর্তি মেহেদী আর খোলা চুলে নিজেকে অপূর্ব লাগছে। আমি আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখছি। ইচ্ছে করছে নিজের সাজ সবার প্রথমে আরাফ’কে দেখাই। যেই ভাবা সেই কাজ! সবার চোখের আড়ালে ফোন’টা সরিয়ে ফেললাম। তারপকর কাজিন’দের ঠেলে-ঠুলে রুম থেকে বের করে ফটাফট কয়েকটা সেলফি তুলে আরাফকে পাঠিয়ে দিলাম। সাথে সাথে আরাফ সিন করলো। আমার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি উঁকি দিলো। আরাফ ছবিগুলো দেখে’ই আমাকে কল করলো”। আমি কল ধরে কানে দিতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো….

‘সকাল থেকে সবাইকে পেয়ে তোমার একমাত্র ইনোসেন্ট জামাইকে ভুলে গেছো বাহ্’।

‘ভুলে গেছি বেশ করেছি’।

‘বেশ করেছো তাই না? কালকে একবার শুধু তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি তারপর মজা বুঝাবো’।

‘কি করবে শুনি’?

‘ভালোবাসা’ময় অ’ত্যা’চা’র।

‘ইসসসস’।

‘ইসসস কি হ্যা’?

‘জানি না’।

‘আচ্ছা এতো সেজেছো কেন? আমাকে মা’র’তে চাও নাকি’?

‘ওমা আমি মা’র’বো কিভাবে’?

‘এই রূপ দেখে নিজেকে ঠিক রাখা যায়’?

…….

‘কি হলো? এখন কথা বলছো না কেন’?

‘কি বলবো’?

‘যা ইচ্ছে’।

‘তাহলে বলি কি, এখন রাখছি পরে কথা বলবো সবাই ডাকছে’।

“এটুকু বলেই আরাফকে কোনো কথার সূযোগ না দিয়ে কল কে’টে দিলাম। এখন যদি ওকে কথা বলতে দিতাম তাহলে ও আমাকে লজ্জায় ফেলে দিতো তাই আর কি! এর মধ্যে সবাই চলে আসলো আমাকে নিয়ে যেতে। হলুদের আয়োজন ছাঁদে করা হয়েছে। সবাই আমাকে নিয়ে গিয়ে স্টেজে বসিয়ে দিলো। তারপর একে একে সবাই এসে আমাকে হলুদ মাখিয়ে দিলো। হলুদের পর্ব শেষ হতেই কাজিন’দের নাচের পর্ব শুরু হলো। ওরা খুব সুন্দর করে নাচলো। সবাই আনন্দ করতে করতে ১২.৩০ বেজে গেছে। আমার অনেক ক্লান্ত লাগছিলো তাই আমি সবাইকে বলে রুমে চলে এলাম। রুমে এসে দরজা লাগিয়ে সামনে ঘুরতেই কে যেনো পিছন থেকে আমার কোমর চেপে ধরলো। স্পর্শ’টা আমার বড্ড চেনা। আমি জানি এটা আরাফের স্পর্শ। কিন্তু ও এখন এখানে কিভাবে? আমি চোখ বন্ধ করে আছি। আরাফ আমাকে ওর দিকে ঘুরাতেই আমি পিটপিট করে চোখ খুলে সামনে তাকালাম। হ্যা যা ভেবেছিলাম তাই, এটা আরাফ”। আমাকে চোখ খুলতে দেখেই বলে উঠলো….

‘আমার বউকে সবাই হলুদ মাখিয়ে ফেললো শুধু আমি মাখাতে পারলাম না’।

‘আমি অবাক হয়ে বললাম, তার আগে বলো তুমি আমার রুমে আসলে কি করে’?

‘বেলকনি দিয়ে’।

‘মানে’?

‘মানে পাইপ বেয়ে উপরে উঠেছি। উফ এখন এসব কথা রাখো আমাকে হলুদ মাখাতে দাও’।

“এটুকু বলেই আরাফ ওর পিছন থেকে ডান হাত বের করলো। ডান হাতে বেশ কিছুটা হলুদ”। আমি ওকে বললাম…

‘বাসার থেকে নিয়ে এসেছি’।

“আমাকে আর কিছু বলার সূযোগ না দিয়ে আরাফ হলুদ নিয়ে আমার গালে, কপালে হলুদ মাখিয়ে দিলো। আরাফের স্পর্শ পেয়ে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। হঠাৎ পেটে আরাফের স্পর্শ পেয়ে আমি কেঁপে উঠলাম। আরাফের হাত শাড়ি ভেদ করে আমার উন্মুক্ত পেটে ঘুরাঘুরি করছে। আমি আরাফের পাঞ্জাবি খা’ম’চে ধরলাম। হঠাৎ কে যেনো দরজায় নক করলো। আমরা দু’জন দু’জনের থেকে ছিটকে কিছুটা দূরে সরে গেলাম। আমার সব কথা কেমন যেনো গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। এখন আরাফকে আমার রুমে দেখলে সবাই কি বলবে? আরাফকে চলে যেতে বললাম। কিন্তু ও জেদ ধরেছে এখন যাবে না। আমি পড়লাম মহা জ্বা’লা’য়! আরাফকে অনেক বুঝিয়ে বেলকনি দিয়ে নিচে নামিয়ে দিলাম”। তারপর নিজে একটু ঠিকঠাক হয়ে দরজা খুলতেই কাজিনা’রা হুড়মুড়িয়ে সব ভিতরে ঢুকে বললো…

‘এই এই তোর সাথে কে ছিলো রে’?

‘কক..কে থাকবে’?

‘না আমরা শুনেছি তুই কারো সাথে কথা বলছিলি’।

‘ভুল শুনেছিস’।

‘আচ্ছা শোন আজকে রাতে তোর সাথে ঘুমাবো। আর কোনো রুম খালি নাই’।

‘ঠিক আছে ঘুমা’।

“তারপর সবাই ফ্রেশ হয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে সবার হ’ই’চ’ই এর কারনে ঘুম ভে’ঙে গেলো। যতই হোক বিয়ে বাড়ি বলে কথা, হ’ই’চ’ই তো হবেই। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে একটু খেয়ে নিলাম”।

“আজকে থেকে সারাজীবনের জন্য আরাফের সাথে থাকতে পারবো। যখন ইচ্ছে হবে ওকে ছুঁতে পারবো। এসব ভেবে মনটা নিমিষেই ভালো হয়ে গেলো। আবার একটু খারাপও লাগছে আব্বু-আম্মুকে ছেড়ে চলে যাবো। এসব আকাশ-পাতাল ভাবছিলাম হঠাৎ কাজিন’রা কিছু পার্লারের লোক নিয়ে রুমে ঢুকে বললো ‘এখন তোকে সাজানো হবে’। আমি কিছু বললাম না”।

“দুই ঘন্টা ধরে সাজিয়েই চলেছে। বিরক্ত লাগছে আমার। এতো সাজানো লাগে? বসে থাকতে থাকতে কোমর ব্যাথা হয়ে গেলো। আমার মো’চ’ড়া’মু’চ’ড়ি দেখে পার্লারের লোকগুলো বিরক্ত হয়ে আমাকে ছেড়ে দিলো। আমি যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। সাজ কমপ্লিট হতেই আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব’র দিকে তাকালাম। মেরুন কালার লেহেঙ্গা, ভারি মেকাপ, ভারি ভারি অলংকারে নিজেকে সাজিয়ে তুলা হয়েছে। অপূর্ব লাগছে দেখতে। একে একে সবাই রেডি হয়ে নিলো”।

“হঠাৎ সবাই বলছে ‘বর চলে এসেছে, বর চলে এসেছে’। কথাটা শুনেই মনের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছেয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ পর সবাই এসে আমাকে নিয়ে গিয়ে আরাফের পাশে বসিয়ে দিলো। আমি আঁড়চোখে আরাফের দিকে তাকিয়ে দেখি ও আমার দিকেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। সবার চোখের আড়ালে আরাফ ফিসফিস করে বললো’আজকে তুমি শেষ ঝ’গ’ড়ু’টে রানী’। কথাটা শুনেই আমি লজ্জায় চোখ সরিয়ে ফেললাম। কাজি সাহেব এসে আবার আমাদের বিয়ে পড়ালেন। হাসি-আনন্দের মাঝেই সারাদিন কে’টে গেলো। সবার থেকে বিদায় নিয়ে আরাফের সাথে শ্বশুর বাড়ি চলে এলাম। আরাফের ফ্যামিলি খুব ভালো। আমাকে একদম আপন করে নিয়েছে। এখানে এসে মনেই হচ্ছে না আমি কোনো নতুন পরিবেশে এসেছি। সবার সাথে খুব সুন্দর করে মানিয়ে নিয়েছি”।

“রাত ১১.৩০ মিনিট। আমি ফুল দিয়ে সাজানো বিছানায় বসে আছি। গোলাপ আর রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে রুম’টা সাজানো হয়েছে। ফুলের গন্ধে চারদিকে মৌ মৌ করছে। আমি একরাশ ভালোলাগা নিয়ে আরাফের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে হ’ই’চ’ই এর আওয়াজ ভেসে এলো। সবাই আরাফকে আটকে রেখেছে। টাকা ছাড়া কেউ আসতে দিবে না আর আরাফও টাকা দিবে না। সবাই জোড়াজুড়িতে ২০ হাজার টাকা দিয়েছে কিন্তু তাদের দাবি ৫০ হাজার। আরাফ আর না পেরে শেষ পর্যন্ত আরও ১০ হাজার টাকা দিয়েছে। ঘরে বসে এসব শুনে আমি হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছি। আরাফ ঘরে ঢুকে দেখে আমি এখনো হাসছি”। তাই আরাফ আমার সামনে এসে চোখ ছোট ছোট করে বললো….

‘এভাবে হাসছো কেন’?

‘ওরা এভাবে তোমার ৩০ হাজার টাকা মে’রে দিলো হিহিহি’।

‘আরাফ বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বললো, ওরা আমার পকেট খালি করে দিলো আর তুমি এভাবে হাসছো’?

‘বেশ করেছে। তুমি এতো কিপ্টামি করো কেন? ছোট ভাই-বোন টাকা চেয়েছে দিতেই পারতে’।

‘আমি কিপ্টে’?

‘তা নয় তো কি? ওদের টাকা দিয়েছো এখন আমাকে কিছু টাকা দাও’?

‘শুধু টাকা? তোমার জন্য তো আমার জীবনও দিতে রাজী বউ’।

‘ইসসস ঢং’।

‘ঢং না গো প্রিয়তমা আর আজকে সারারাত তোমাকে’….

“আমি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে আরাফের মুখ চেপে ধরলাম। উফফ এই মানুষটা যখন তখন আমাকে লজ্জা দেয় অ’স’হ্য। আরাফ ওর মুখ থেকে আমার হাত সরিয়ে মুচকি হেসে আমার হাতের উল্টো পিঠে একটা আলতো করে চুমু খেয়ে বললো, তাহলে মুখে কিছু না বলে সরাসরি সব করে ফেলি কেমন”?

(তারপর আমিও আর কিছু জানি না কেমন?🙈)

————–

“কে’টে গেছে ৩ বছর। অনেককিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। আরাফের পড়ালেখা শেষ হয়ে গেছে। এখন আরাফ আর ওর বড় ভাই মিলে বিজনেস সামলায়। আমি এই পরিবারের সবার অনেক আপন হয়ে উঠেছি। সবাই আমাকে একদম মেয়ের মতো ভালোবাসে”।

“আজ আমি অনেক খুশি। আমার আর আরাফের ভালোবাসার ফল হিসেবে আমাদের আনাগত সন্তান আসছে। কয়েকদিন ধরেই শরীর’টা খারাপ যাচ্ছিলো তাই আরাফকে না জানিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে টেস্ট করিয়েছে আজ তার রিপোর্ট পেলাম। রিপোর্টের পজেটিভ। মা হওয়ার অনুভুতি যে এতো মধুর সেটা আজ অনুভব করতে পারলাম। আরাফ জানার পর ওর রিয়েকশন কেমন হবে আমি শুধু তাই ভাবছি”।

“রাতে আরাফ অফিস থেকে এসে খাওয়া-দাওয়া করে রুমে গিয়ে রেস্ট নিচ্ছে। আমি সব কাজ শেষ করে রুমে গিয়ে কিছু না বলে শুধু রিপোর্ট’টা ওর হাতে দিয়ে মাথা নিচু করে রইলাম। আরাফ রিপোর্ট’টা দেখে হা করে কিছুক্ষণ রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে থেকে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আমিও আরাফকে জড়িয়ে ধরলাম। হঠাৎ ঘাড়ে ভিজা ভিজা অনুভর করলাম। আরাফের মাথা তুলে দেখি পা’গ’লটা কাঁদছে। আমার চোখেও পানি চলে এলো। আরাফ আলতো হাতে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো ‘আমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। বাবা হওয়ার আনন্দ যে এতোটা সেটা আজ শুধু তোমার জন্য উপলব্ধি করতে পারছি। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ বউ, আমাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার’টা দেওয়ার জন্য। ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে’। আমি কিছু না বলে আরাফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম আমাদের জীবনে যেনো সবসময় এমন সুখ-শান্তি, খুশি’ই থাকে। আপনারাও ওদের সুখের সংসার আর অনাগত বাচ্চার জন্য দোয়া করবেন”।

~~~~~~~~~সমাপ্ত~~~~~~~~~