প্রণয় পর্ব-২৯+৩০

0
378

#প্রণয়
#পর্বঃ২৯
#তানিশা সুলতানা

দিনগুলো হঠাৎ করেই পরিবর্তন হয়ে গেলে। সব মানুষ গুলোর মধ্যেও চলে এসেছে পরিবর্তন। যেমন বড়মা আগের মতো তানহার সাথে কথা বলে না। সূচক বাড়ির কারো সাথে কথা বলে না। এমনকি তানহার সাথেও না। মধ্যে রাতে বাড়ি ফেরে আবার ভোর সকালের খাবার খেয়েই চলে যায়।
তানহার পাগল পাগল লাগে নিজেকে। লোকটা কেনো পাল্টে গেলো? কেনো কথা বলে না?
অনেক রাত ওবদি জেগে থেকেও তানহা সূচকের দেখা পায় না।

বড়মা আর বড় বাবার সম্পর্কটাও ঠিক যাচ্ছে না। আগের মতো কেয়ার করে না বড় মা বড়বাবার। বড় মা সূচক তোহারও খেয়াল রাখে না। কি খেয়েছে? খেয়েছে কি না কোনো দিকেই মন নেই তার। কেমন যেনো উদাসীন উদাসীন একটা ভাব। সব সময় কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করতল থাকে।

সেদিন রাস্তায় বড় মা একটা কথাও বলে নি। বাড়ি ফিরে সূচক কে শুধু বলেছে “কথা আছে রুমে এসো”

বন্ধ রুমের মাঝে বড় মা বড় বাবা আর সূচকের মধ্যে কি কথা হয়েছে কারোর জানা নেই।
কিন্তু তার পর থেকেই সব কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে।

আজকে একদম স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না তানহার। কিন্তু তবুও জোর করে রেডি হয়েছে। কারণ তোহা যাবেই। আর তোহা চলে গেলে তানহা একা বাড়িতে কি করবে?
তার থেকে ভালো স্কুলে গেলেই ভালো হবে। হয়ত মনটা ভালো হবে।

তাজ আজকে কোনো মতেই স্কুলে যাবে না তার পড়া হয় নি। আর স্যার বলেছে যাদের পড়া হবে না তাদের কান ধরিয়ে স্কুলের মাঠে দাঁড় করিয়ে রাখবে। মানসম্মান বাঁচানোর ভয়ে সে বাড়িতেই থাকবে।

তানহা তোহা রেডি হয়ে রুম থেকে বের হয়।
সূচক তমাল আর তাহের খাচ্ছে। দাদিমা ওদের খাবার বেরে দিচ্ছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। তানহা আর তোহা নিঃশব্দে গিয়ে দুটি চেয়ার টেনে বসে পড়ে।

তানহা সূচকের দিকে তাকায়। বুকটা ফেটে যায় তানহার। একটু কথা বললে কি হয়? কেনো কথা বলে না? এখন তাকায়ও না তানহার দিকে। এতোটাই অপছন্দের হয়ে গেছে তানহা।
চোখ দুটো ভিজে ওঠে তানহার। পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে নেয়। খেতে একদম ইচ্ছে করছে না।

তোহার পাতে দাদিমা আলুভাজি আর রুটি তুলে দিয়েছে। এবার তানহার প্লেটে দিচ্ছে।
তানহা না করবে দিতে

“একদম চুপচাপ খাবারটা শেষ কর।

সূচক নিজের প্লেটের দিকে নজর রেখেই ধমক দিয়ে বলে। সবার খাওয়া থেমে যায়। তানহা আর সূচকের দিকে এক পলক করে তাকায়।
তানহার আর উঠার সাহস হয় না। মাথা নিচু করে চুপচাপ খেতে থাকে।

” দাদু মা কাকিমা কোথায় গো?

তোহা খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করে।

“ব্যাংকে গেছে।

তমালের পাতে আরও একটা রুটি দিয়ে বলে মমতা বেগম।

” ব্যাংকে কেনো?

তানহা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।

“তোর এতোকিছু জানতে হবে কেনো? চুপচাপ খেতে থাক।

সূচক পূনরায় ধমক দিয়ে বলে। তানহার এবার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। একেতে কথা বলে না তারপর যা বলবে তাতেই ধমক। এতো নেওয়া যায়?

” কথাটা তো স্বাভাবিক ভাবেও বলা যেতো।

তমাল চোখ পাকিয়ে বলে।

“হুম বলা যেতো। কিন্তু ও বুঝতো না।

আর কেউ কোনো কথা বলে না। তানহার কান্না পাচ্ছে। আর গলা দিয়ে খাবার নামবে না। তাই উঠে যায়। দুই টুকরো রুটি খেয়েছে শুধু।
ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে চোখ মুছতে মুছতে একদম বাড়ির বাইরে চলে যায়।
তোহা পুরো অর্ধেক রুটি মুখে পুরে পানি দিয়ে গিলে ফেলে।

” বাবা আজকে বেশি করে টাকা দাও। টিফিনে ক্যান্টিনে খাবো।

তোহা হাত ধুতে ধুতে বলে। তমালের হাতে একটা টাকাও নেই। কালকে দোকানের জন্য নতুন মাল কিনে পুরো হাত ফাঁকা। আজকে দোকানে কেনাবেচা হলেই টাকা হবে।
মেয়েকে না ও করতে পারছে না।
তাহের পকেট থেকে দুই টাকা বের করে তোহার হাতে দেয়। আর একশত টাকা সূচকের সামনে রাখে।
তোহা এক গাল হেসে চলে যায়।
সূচক টাকাটা না নিয়েই হাত ধুয়ে উঠে যায়।

🥀🥀
ইদানীং ইমন খুব জ্বালাচ্ছে তোহাকে। যেমন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে,বাসায় ফেরার সময় পেছন পেছন ঠিক বাড়ি ওবদি চলে আসে।
আজকেও স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তবে আজকে গাড়ি নেই সাথে।
তানহা তোহাকে দেখে এক গাল হেসে এগিয়ে আসে। তানহাও মুচকি হাসে। ইমনকে বেশ লাগে ওর।

“ভাইয়া আপনার কি কোনো কাজ নেই?

তোহা দাঁত কটমট করে বলে।

” আছে তো। তোমাকে বিয়ে করা।

ইমন এক গাল হেসে বলে। তানহাও ফিক করে হেসে ফেলে।

“ভাইয়া বিয়ে পর কিন্তু কাজ করাতে হবে এই অলস টাকে দিয়ে।

তানহা বলে ওঠে।

” তা তো অবশ্যই করাবো। তুলতুলে পটি পরিষ্কার করাবো ওকে দিয়ে।

তোহা নাক সিঁটকায়। তানহা খিলখিল করে হেসে ওঠে।

“গেলাম আমি।

তোহা ইমনের দিকে কটমট চাহনিতে তাকিয়ে স্কুলের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ইমন হাতে থাকা এক প্যাকেট তানহার হাতে ধরিয়ে দেয়।

” কি আছে এতে ভাই?

তানহা প্যাকেটটা উল্টে পাল্টে দেখে বলে।

“বিরিয়ানি। দুজনে ভাগ করে খেয়ে নিও। কেমন?

ইমন তানহার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায়। তানহা বিরিয়ানির দিকে কিছুখন তাকিয়ে থাকে। মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। সূচক তো বিরিয়ানি খেতে খুব ভালোবাসে। অনেক দিন বাড়িতে রান্না করা হয় না। ইসস সূচককে যদি খাওয়াতে পারতো এই বিরিয়ানি। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তানহা।

🥀🥀

দুইশত টাকার একটা টাকাও খরচ করে না ওরা। আর ভাগ্যও খুব ভালো ছিলো তাই দোকানের প্রায় অর্ধেক মালাই বিক্রি হয়ে যায়। তমাল দারুণ খুশি। বাজার থেকে গরুর মাংস বাসমতী চাল আর প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনে নিয়ে আসে। বাচ্চারা বিরিয়ানি খেতে দারুণ ভালোবাসে। আজকে বিরিয়ানিই হবে।

বিকেলে বাসায় ফিরে তোহা ফোন নিয়ে বসে পড়ে। তমা বেগমের শরীর খারাপ তাই সে শুয়ে আছে। তানহাকে বলেছে বড়মায়ের সাথে রান্নায় সাহায্য করতে।

সাদিয়া বেগম পেঁয়াজ কাটছে। তানহা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলার সাহস হচ্ছে না। আচ্ছা যদি ধমক দেয়?
চোখে পানি টলমল করছে তানহার।

” বড়মা

তানহা অস্ফুরণ কন্ঠে বলে।
সাদিয়া বেগমের হাত থেমে যায়। কিন্তু তাকায় না তানহার দিকে।
তানহা এবার ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলে। আরও একটু সাহস করে সাদিয়া বেগমকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তানহার।

“আমার সাথে কথা বলো না কেনো তুমি? জানো কতোটা কষ্ট হয় আমার? আমি কি খুব বেশি ভুল করে ফেলেছি? আমাকে শাস্তি দাও তুমি। তবুও মুখ ফিরিয়ে রেখো না আমার থেকে।

শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে তানহা। সাদিয়া বেগমের চোখেও পানি চিকচিক করছে। তানহার মাথার সাথে নিজের মাথাটা ঠেকায়, হাতের ওপর হাত রাখে।

” বাবু বলেছে তাড়াতাড়ি ফিরবে। বাবা কাকারাও চলে আসবে। মাংস ধুয়ে দে আমায়।

তানহার হাতে চুমু দিয়ে বলেন উনি। তানহার মুখে হাসি ফুটে। বড়মা ভালোবেসেছে ওকে।

“আজকে আমি রান্না করবো। তুমি শুধু বলে দিবা। কেমন?

সাদিয়া বেগম হেসে ফেলে। তানহা কোমরে ওড়না বেঁধে নেমে পড়ে রান্নায়। সাদিয়া বেগমের সাথে গল্প করতে করতে রান্না শেষ করে। পুরোটা একাই করেছে তানহা। সাদিয়া বেগম আজকে অনেকদিন পরে প্রাণ খুলে হেসেছে।

তানহার খুব সাধ জেগেছে সূচককে নিজে হাতে খাবার বেরে খাওয়াবে। দশটা বেজে গেছে। সবাই খেতে বসেছে। কিন্তু সূচক আসছে না।
দীর্ঘ এক মাস পড়ে আজকে বড় মা সবাইকে খাবার বেরে দিয়েছে।
সূচকের জন্য বিরিয়ানি তুলে রেখেছে। তানহা ভীষণ খুশি। কতোদিন পরে সূচক বিরিয়ানি খাবে। কিন্তু লোকটা এখনল আসছে না যে।

সবাই খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। দাদিমা আর তমা বেগমের খাবার রুমেই দিয়ে আসে সাদিয়া বেগম।
তাজকে নিজে হাতে খাইয়ে দিয়েছে। তোহা খাচ্ছে আর তানহার দিকে তাকাচ্ছে।
তানহা খেতে বসে নি। বলে দিয়েছে পরে খাবে।
তমাল তাহের তাজ সবাই খুব প্রশংসা করছে তানহা।

” তোহা তুই কিছু বল?

তানহা একটা ভাব নিয়ে বলে।

“এতো ভাব নেওয়ার কিছু হয় নি। হয়েছে কোনো রকম।

তোহা মুখ বাঁকিয়ে বলে। সবাই নিঃশব্দে হেসে ওঠে। তোহা কখনোই তানহার প্রশংসা করে না।

” তানহা বাবুকে খাবার বেরে দিস তুই। আমি ঘুমতে গেলাম।

সবার খাওয়া শেষে প্লেট গুছিয়ে ধুয়ে সাদিয়া বেগম তানহাকে বলে।
তানহা মাথা নারায়। একটা বই নিয়ে সূচকের রুমে চলে যায়। আজকে চোখে কস্টিপ লাগিয়ে হলেও জেগে থাকবে। সূচকের সাথেই আজকে খাবার খাবে ও। সে যত রাতই হোক আর যতই ঘুম পাক।

চলবে

#প্রণয়
#পর্বঃ৩০
#তানিশা সুলতানা

রাত বারোটা বেজে গেছে। এখনো সূচক আসছে না। ঘুমে তানহার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। খুব কষ্টে জেগে আছে। একটু পর পর চোখে পানি দিয়ে আসছে।
সূচকের পড়ার টেবিলের ওপর মাথা এলিয়ে দেয় তানহা। সামনে প্লেট ভর্তি বিরিয়ানি আরেকটা প্লেট দিয়ে ঢেকে রেখেছে।

রাত একটা ছুঁই ছুঁই তখন সূচক বাড়িতে আসে। দুই তিন বার বাড়ির মেইন দরজায় কড়া নারতেই ঘুম ঘুম চোখে তমাল দরজা খুলে দেয়। সূচক বাবার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। তমাল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে রুমে চলে যায়।

সূচক রুমে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ভীষণ ক্লান্ত সে। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে। পেটে ভীষণ খিধে তবুও খেতে ইচ্ছে করছে না।
এতো পরিশ্রম আগে কখনো করে নি ও।
হঠাৎ চোখ পড়ে জানালার পাশে থাকা টেবিলে ওপর মাথা এলিয়ে দেওয়া তানহার দিকে। চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমচ্ছে। চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে। ক্লান্তি অনেকটা চলে যায় সূচকের। উঠে বসে। গা থেকে ঘামের গন্ধ আসছে। জুতো জোড়াও খুলে নি। আনমনে হাসে সূচক।
এলোমেলো চুল গুলো বা হাতে পেছনে ঠেলে জুতো জোড়া খুলে রুমের এক পাশে রাখে। শার্টটা খুলে গায়ে গামছা জড়ায়।
তারপর তানহার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুখন তানহার ঘুমন্ত মুখ টার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর চুল ধরে জোরে টান দেয়।
তানহা চোখ মুখ কুঁচকে উহহহ শব্দ করে ওঠে। কয়েকবার পাপড়ি ঝাঁপড়ে চোখ খুলে। সূচককে সামনে দেখে ঘুম উবে যায়। বড়বড় চোখ করে তাকায়। চোখে মুখে ফুটে ওঠে খুশির ছায়া।

“জলদি খাবার রেডি কর। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

বলেই সূচক ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। তানহার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এলোমেলো চুল গুলো হাত খোপা করে ফ্লোরে মাদুর পেতে নেয়। তারপর সেখানে দুটো প্লেট জগ গ্লাস সব কিছু নামিয়ে দুই প্লেটেই বিরিয়ানি বেরে তাতে শশা পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে সূচকের।

কিছুখন পরেই সূচক বেরিয়ে আসে চুল মুছতে মুছতে। পরনে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর হাতা কাটা গেঞ্জি।

হাতের ভেজা গামছাটা তানহার ওপর ছুঁড়ে মেরে খেতে বসে যায় সূচক। তানহার বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে মুখের ওপর থেকে গামছা সরিয়ে সেটা বারান্দার দড়িতে মেলে দেয়।
তারপর এসে সূচকের পাশে বসে নিজের প্লেটটা হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করে।

সূচক কোনো কথা না বলে একমনে খেয়ে যাচ্ছে। যেনো কতোদিন অনাহার ছিলো। তানহার মনটা প্রশংসা পাওয়ার জন্য আকুপাকু করছে। কখন সূচক বলবে ” কে রান্না করেছে রে?”

কিন্তু সূচক বলছে না। গপগপ করে এক প্লেট বিরিয়ানি খাওয়া শেষ করে গামলা থেকে আবারও নিচ্ছে। কিন্তু প্রশংসা করছে না।
তানহা সূচকের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খাবার মুখে দিচ্ছে। সূচকের পাতের শশা শেষ। তানহা একটা শশাও খায় নি। আসলে ও ভুলেই গেছে।
সূচক তানহার পাতের শশা নিয়ে খেতে থাকে।

“রান্নাটা আমি একা একাই করেছি। একদম একা একা।

সূচকের থেকে রেসপন্স না পেয়ে নিজেই বলে তানহা। সূচক এক পলক তাকায় তানহার দিকে।

” হুমম

শুধু এটুকুই বলে সূচক। তানহার মনটা একদম ভেঙে যায়। খাওয়ার ইচ্ছেটাও মরে গেছে। একটুও প্রশংসা করা যেতো না কি?
নাক ফুলিয়ে প্লেট রেখে উঠে দাঁড়ায় তানহা।

“এক পা নরলে ঠ্যাং ভেঙে দেবো আমি। চুপচাপ খাবারটা শেষ কর।

সূচক তানহার কামিজের এক অংশ শক্ত করে ধরে চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়ে বলে।
তানহা চোখে এবার পানি চলে আসে। অভিমানে মুখটাকে একটুখানি করে বসে পড়ে। সূচকের দিকে মাথা তুলে তাকাচ্ছেও না। চুপচাপ নাক টানছে আর মুখে খাবার পুরছে।
সূচক খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। তানহা প্লেট গুছিয়ে চলে যেতে নেয়।

” এভাবে রাত জেগে থাকবি না। দশটার মধ্যেই খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বি। আর একদিন দেখলে আমি আর বাড়িতেই ফিরবো না।

চোখ বন্ধ করে খুব শান্ত গলায় বলে সূচক। তানহার ছোট্ট মনটা ভীষণ ভাবে আঘাত পায়। গাল বেয়ে টুপটাপ করে পানি পড়তে থাকে।

“হ্যাঁ একদম রাত জাগবো না। সামনেও যাবো না আপনার। পঁচা বেডা।

তানহা দাঁতে দাঁত চেপে বলে চলে যায়। সূচক নিঃশব্দে হেসে ফেলে।

সারা রাত ঘুমায় নি তানহা। বিছানার এক কোনায় বসে কান্না করে গেছে। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না। এতো অবহেলা কেনো করছে উনি? ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে।

অশান্ত মনকে অবশেষে ফজরের আজানের সময় শান্ত করে। মনে মনে কড়া সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। একদম কথা বলবে না সূচকের সাথে। আশেপাশেও ঘেসবে না। তানহাকে ইগনোর করেছে? এবার তানহাও করবে। তখন দেখবে কেমন লাগে???

সাত সকালে ইমনের কল পেয়ে মেজাজ বিগড়ে যায় তোহার। ভোর ছয়টা বাজে। এখন কল দেওয়ার সময়? তোহার তাজা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলো?
দাঁতে দাঁত চেপে তোহা কলটা রিসিভ করে ফোন কানে দেয়।
কিছু বলবে তার আগেই ইমন বলে ওঠে

“তোমার ভাই আমার তাজা ঘুম ভাঙালো। তাই আমি তোমার তাজা ঘুম ভাঙালাম। হয়ে গেলো না ইকুল ইকুল?

এক গাল হেসে বলে ইমন। তোহা কিচ্ছু বলে না। দাঁতে দাঁত চেপে সয্য করে।

” ভাবছি প্রেম করবো। সিঙ্গেল থাকা যাচ্ছে না আর। পরে না হয় তুমি যখন বিয়েতে রাজি হবে তখন বিয়ে করে নেবো।
তো এখন মেয়ে খুঁজে দাও তুমি। নাহলে তুমি নিজেই রাজি হয়ে যাও।

সাধের ঘুম বাদ দিয়ে ইমনের সাথে খেজুরে আলাপ করার টাইম একদমই নেই তোহার। তাই খট করে কল কেটে দিয়ে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করে।

তানহা নামাজ পড়ে রান্না ঘরে চলে গেছে। রাতে মায়ের মাথা ব্যাথা ছিলো। এতসকালে কখনোই উঠবে না। বড়মা একা একা রান্না করবে। তাই তানহা সাহায্য করতে গেছে।

সারা রাত কান্না করার ফলে চোখ মুখ ফুলে কলা গাছ হয়ে গেছে।

মাথায় ওড়না টেনে কিচেনে পা ফেলতেই সামনে পড়ে সূচকের। সূচকের হাতে গরম কফি। তানহা এক পলক সূচকের হাতের দিকে তাকিয়ে এক পাশে দাঁড়ায়।

“এতো সকালে উঠেছিস কেনো?

সূচক ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে।

তানহা উওর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কিছুটা অবাক হয় সূচক। কিন্তু পাত্তা দেয় না। এখন একে পাত্তা দিল গেলে বের হতে দেরি হয়ে যাবে।
তাই কফির মগের চুমুক দিতে দিতে রুমে চলে যায়।

পৃথিবীতে রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও একটা গভীর সম্পর্ক আছে। যাকে বলে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। একজন প্রকৃত বন্ধু আরেক জন বন্ধুর জন্য সব করতে পারে।
এই যে ইমন সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে কোচিং এর দরজা খুলে বসে আছে।
মশা তাড়াচ্ছে। বাবার অঢেল সম্পদ থাকার পরেও সে সূচকের সাথে ভাগে কোচিং সেন্টার খুলেছে।
বিশ দিন হলো এই কোচিং সেন্টারের বয়স। বাবার থেকে টাকা নিয়ে কলেজের পাশে একটা টিনের ঘর ভাড়া নিয়েছে। তাতে ব্রেঞ্চে টেবিল বোর্ড মার্কার বই সব কিছু ইমন কিনেছে।
সূচকের হাতে দশটা টাকাও ছিলো না। তাই সে টাকা দিতে পারে নি। ইমনের থেকে নিতেই ইতস্তত বোধ করছিলো। পরে ইমন ওকে স্বাভাবিক করার জন্য বলেছে ” আমি আর তুই তো ভাগে খুলছি কোচিং সেন্টার। মাস শেষে স্টুডেন্টরা টাকা দিলে না হয় আমাকে বেশি টাকা দিস”
তার পরই রাজি হয়েছে সূচক।

বারো জন স্টুডেন্ট নিয়ে শুরু করেছে কোচিং সেন্টার। পাঁচ জন্য ইংলিশ পড়ে বাকি সাত জন্য আইসিটি।

তবে ইমনের বিশ্বাস সামনে মানে একশত স্টুডেন্ট হবেই। কিন্তু সূচক ভরসা পাচ্ছে না।

সাতটা থেকে আইসিটি পড়ানো হয়। সূচকে পড়াই। ইমন স্টুডেন্টের মতো বসে থাকে।

সাতটায় স্টুডেন্টরা চলে আসে। সাথে সূচকও আসে। সূচকের সাত জন স্টুডেন্টের মধ্যে পাঁচ জন মেয়ে আর দুই জন ছেলে। একজন স্টুডেন্টও একদিনও কামায় দেয় না। প্রতিদিন পড়তে আসে।

_________

আজকে সূচক ব্রেকফাস্ট না করেই বেরিয়েছে বলে সাদিয়া বেগম ভীষণ চিন্তিত। কোথায় যায় ছেলেটা?
এমনিতে তো প্রতিদিন খাবারটা অন্তত খেয়ে যায় আজকে কি হলো?
তানহারও ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। সূচক খায় নি বলে ওরও খেতে ইচ্ছে করছে না। তাই না খেয়েই স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে নেয়।

চলবে____