প্রণয়িনী পর্ব-০১

0
1265

#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|১ম পর্ব |

কাজী অফিসের সামনে এক এক করে ছয়টা প্রাইভেট কার এসে থামল। কী এমনটা ভেবেছেন আপনারা? ভুল ভেবেছেন, কাজি অফিসের সামনে শুধুমাত্র একটা প্রাইভেট কার এসে থামল। আর তাঁর পেছনে টেম্পু থুক্কু দুইটা বাইক। প্রাইভেট কার থেকে দু’জন দেহরক্ষী মহিলা আমাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে কাজী অফিসের ভেতরে প্রবেশ করালো। আমি বেচারি ক্যাবলাকান্তের ন্যায় ছোট চোখে এদিক-ওদিক শুধু তাকিয়ে দেখছি।

আমরা কাজী অফিসের ভেতরে প্রবেশ করতে’ই দেখতে পেলাম, চার থেকে পাঁচজন কালো স্যুট পরিহিত লোক দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারলাম এরাও দেহরক্ষী। আমার মনে হচ্ছে কালো রঙয়ের পোশাক এদের জন্ম-জন্মান্তের কোড, নয়তো দেহরক্ষীদের কালো’ই পরতে হবে কেন? কালো ছাড়া আরো অনেক রঙ’ই তো আছে। আমি যদি এদের মালিক হতাম তো একেকদিন একেক রঙের পোশাক পরাতাম। বড়োলোক বলে কথা! একটা বিষয় খেয়াল করলাম, দেহরক্ষীদের প্রত্যেকের চোখে কালো চশমা এবং তাঁরা দুই হাত টান টান করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদের যে কেউ দেখলে বলবে এরা প্রকৃত দেহরক্ষী, মালিকের একনিষ্ঠ ভক্ত।

সময় এখন সকাল নয়টা বাজে চল্লিশ মিনিট। সেই সকাল ছয়টায় জগিং করতে বের হয়েছিলাম। পড়াশোনা শেষ করে বাসায় শুয়ে বসে কাঁটাই এখন। মাকে কত করে বললাম বিয়ে দিয়ে দাও শুনলো’ই না।
সে যাইহোক, যার জন্য আমাকে এখানে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে দেখতে পাচ্ছি না কোথাও। আমার কত দিনের ইচ্ছে ছিলো রূপকথার রাজকুমারদের মত একটা রাজকুমার এসে আমাকে পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে দূর অজানায় নিয়ে যাবে; যেখানে আমি আর সেই থাকবো। কিন্তু আমার স্বপ্নটা এভাবে ব্যতিক্রম হয়ে যাবে তা ভাবতে পারছি না। বিয়ে হবে বুঝলাম তাই বলে এভাবে?
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে জগিং-এর জন্য বের হয়েছিলাম। দুনিয়ার সকল মানুষ যেখানে বের হয় জগিংয়ের পোশাক পরিধান করে সেখানে আমি একমাত্র এলিয়েন যে কিনা আজ শাড়ি পরিধান করে বের হয়েছি। জগিং মূলত বাহানা; আসলে এত সকালে মা আমাকে বের হতে দিবে না তাই’ই তো এত বাহানা। আমার আবার প্রকৃতির বাতাস গ্রহণ করতে খুব ভাল লাগে কিন্তু আম্মুর জন্য পারি না। আম্মুর কথা, ‘এত সকাল-সকাল বাহিরে বের হলে ঠান্ডা লাগবে।’ যাইহোক এত কথা বাদ দেই আমার স্বপ্নের রাজকুমারকে দেখার জন্যে মন আকুপাকু করছে। কিন্তু কোথায় সে!

অবশেষে হুড়মুড় করে কাজী অফিসের সেই ছোট্ট ঘরে প্রবেশ করল একজন হ্যান্ডসাম ছেলে কিন্তু এই ছেলেটিকে দেখে আমার পছন্দ হলো না। কেননা এই ছেলেও বাকি দেহরক্ষীদের মত একই পোশাক পরিহিত এবং চোখে কালো চশমা। এদের দেখে আমার কালো চশমা গানটা গাইতে ইচ্ছে করছে।
মনে মনে গেয়ে নিলাম,

“গোরে গোরে মুখড়ে পে কালা কালা চাশমা”
হা হা হা

– ম্যাম আপনি ঠিক আছেন তো?

কালা চশমা গান গেয়ে আপন মনে হাসছিলাম ঠিক তখন’ই হ্যান্ডসাম বলা সেই ছেলেটির মুখে ম্যাডাম বলে ডাক শুনে বুঝতে পারলাম যে আমার সেই কাঙ্খিত রাজকুমার এই লোকটি নয়। মনে মনে বিশবার আলহামদুলিল্লাহ বললাম। ছেলেটিকে একটা ভেংচি কেঁটে বললাম,

– আমি আমার বর ছাড়া আর কারো সাথে কথা বলব না।
আমার কথা শুনে ছেলেটির আচমকা কাশি শুরু হয়ে গেল। এদিকে কাজী সাহেবের দিকে লক্ষ্য করে দেখতে পেলাম, থরথর করে কাঁপছেন কাজী। সামনে টেবিলের উপর রাখা পানির পাত্র থেকে ঢকঢক করে পানি পান করে চুপটি করে বসে রইলেন আবার। কাজী সাহেবের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ছেলেটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আর আমার উদ্দেশ্যে বলল,

– রাদ স্যার কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে।

ছেলেটির কথায় রাগ হলো। রেগে বোম্বাইমরিচ হয়ে ছেলেটিকে ঝাঁঝালো কন্ঠস্বরে বললাম,

– ধুরু মিয়া, রাখেন তো আপনার স্যারগিরি। এখন’ই ফোন দিন তাঁকে আর বলুন যে আমি এত সময় অপেক্ষা করতে পারব না। তাকে দেখার জন্য আমার মন উতলা হয়ে আছে।

আমার কথা শুনে ছেলেটি এবার চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল। ছেলেটি আমাকে আর কিছু বলবে তখনই পেছন থেকে কারো গম্ভীর কণ্ঠে শোনা গেল,

– মাসুদ, কি বলে এই মেয়ে?
ও বুঝলাম এই ছেলেটির নাম মাসুদ। ছেলেটি ভয়ার্ত কন্ঠস্বরে উওর দিলো,

– রাদ দেখ আমার ভাই, তুবার কথায় কান দিবি না। মেয়েটা একদম বাচ্চা।

– হয়েছে মাসুদ এই মেয়ের সাফাই গাইতে হবে না। আমি জানি মেয়েটা কেমন।

গম্ভীর কণ্ঠস্বর ওয়ালা ব্যক্তিকে দেখার জন্য মনটা আকুপাকু করছে। মানুষটা দেখতে কেমন হবে!আমার স্বপ্নের রাজকুমারের মত যদি দেখতে না হয় তাহলে বিয়ে করব না। নিজে নিজে এসব ভাবছি আর নক কামড়াচ্ছি তখন’ই সেই গম্ভীর মানুষটার কণ্ঠস্বর আমার কানের কাছে শুনতে পেলাম।

– এই মেয়ে, তোমার মধ্যে ভদ্রতা বলতে কিছু নেই নাকি? একটা বড়ো মেয়ে হয়েও দাঁতে নখ কামড়াচ্ছো? তুমি জানো না নখে কত জীবণু থাকে?

আমার সামনে দাঁড়ানো মানুষটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত আস্তে আস্তে আমার নজর উপরের দিকে নিচ্ছি। মুখে এখনও আংগুল তথা নখ বিদ্যমান। লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে কুটুস করে নখে কামড় বসালাম ফলস্বরূপ নখ এখন আমার দুই দাঁতের ঠিক মধ্যখানে; থুথু ফেলে হবু স্বামীর উদ্দেশ্যে বললাম,

– ও সাদা বিলাই, এই দিনের বেলায় মাক্স পরে আসলেন কেন? আমি কি পরনারী নাকি? আপনার হবু বউ। আমাকে আপনার চেহারা দেখালে আপনার পর্দা নষ্ট হবে না।

কথাগুলো বলে সাদা বিলাই ওরফে রাদের দিকে তাকালাম। আমার সামনে এসেছে মাক্স পরে যেন তার চেহারা না দেখি। কিন্তু আমি তার চোখ দেখে’ই ফিদা হয়ে গিয়েছি সেটা তাকে কে বুঝাবে! আর অতিরিক্ত ফর্সার জন্য নাম রাখলাম সাদা বিলাই। সুন্দর না! খানিকটা কেশে হাতে এগিয়ে দিলাম পরিচয় দেবো বলে।

– যাইহোক হবু বর; আমার পরিচয়, আমি আয়মান তুবা। রেজিস্ট্রি কাগজে কিন্তু শুধু আয়মান লিখবেন না তুবাও লিখবেন।

আমার কথা শুনে রাদ ক্ষিপ্ত সিংহের ন্যায় গর্জে উঠল। ফোস ফোস করে আমার উদ্দেশ্যে বলল,

– গড প্রমিস, আমি তোমাকে শেষবারের মত সাবধান করে দিলাম। আর একটা ফালতু কথা বলবে তো তোমার হাত-পা ভেঙে এখানে বসিয়ে রাখব।

রাদের কথা শুনে মনে মনে ইচ্ছেমত বকতে লাগলাম,’ ইশ হাত-পা ভেঙে বসিয়ে রাখবে। বললেই হলো! সাদা বিলাই কোথাকার?’ আমার বিড়বিড় কথা বলা দেখে ভ্রু কুঁচকে রাদ আমাকে জিজ্ঞেস করল,

– কি বললে তুমি?

আমি ভেংচি কেঁটে ‘কিছু না’ বলে কাজী সাহেবকে বললাম,
– নেন কাজী সাহেব বিয়ে পড়ান!

কাজী সাহেব চমকালেন আমার কথা শুনে; অবাক হয়ে আমার পানে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। কাজী সাহেবের চেহারা দেখে বুঝে ফেলেছি যে সে হয়তো মনে মনে বলছে,” এমন পাজি মেয়ে আমি জীবনেও দেখিনি যে বিয়ের জন্য এত পাগল।”

কিন্তু কাজী সাহেব তো আর জানে না যে কেন আমি বিয়ের জন্য পাগল হয়েছি। ছোটকাল থেকে আমার স্বপ্ন ছিল একদম খাঁটি ছেলেকে বিয়ে করব। রাদের চেহারা দেখিনি তো কি হয়েছে! কিন্তু বডি ফিটনেস দেখে বুঝতে পেরেছি ছেলেটি হ্যান্ডসাম হবেই হবে।

যথারীতি আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল। রাদ মোহরানা হিসেবে আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিলো। রেজিস্ট্রি কাগজে দেখলাম রাদের পুরো নাম,” ফায়রাজ রাদ” লিখেছে। এত কম মোহরানা দেখে মনে মনে বললাম,”বেটা দেখতে শুনতে ভালো হলে কি হবে মনের দিক দিয়ে একদম ছোট; যাকে বলে কিপ্টা। এমন জামাই নিয়ে সারা জীবন কিভাবে সংসার করব?”
এসব ভাবতে ভাবতেই আবারো দেহরক্ষীরা আমাকে টানতে টানতে গাড়িতে উঠিয়ে নিল। আমি চিল্লিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেলেছি এই বলে যে ,” আমাকে আস্তে টানো ব্যথা পাচ্ছি।” কিন্তু কে শোনে কার কথা! রাদকে দেখলাম অন্য গাড়িতে উঠতে। গাড়িতে উঠার সাথে সাথে রাদের উদ্দেশ্যে বললাম

– ও সাদা বিলাই, আমি আম্মুর কাছে যাবো, তোমাদের সাথে যাবো না। আমি আম্মুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারপর শ্বশুর বাড়িতে যাবো। কতদিনের শখ ছিলো আম্মুর থেকে বিদায়ের সময় কান্নাকাটি করে তারপর যাবো!

আমার কথাগুলো কারো কানে পৌঁছলো না উল্টো আমার মুখে একটা কালো টেপ লাগিয়ে আমাকে স্টপ করে দিল।

আমার একটা অভ্যাস আছে গাড়িতে উঠলেই ঘুমিয়ে যাই এখনও তাই করলাম। ঘুমিয়ে গেলাম। যখন আমার ঘুম ভাঙলো তখন অনুভব করতে পারলাম যে আমি কারোর কোলে। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম রাদ মাস্ক পরিহিত অবস্থায় এখনও এবং সে আমাকে কোলে নিয়ে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। এক নজরে তাকিয়ে আছি রাদের চোখের দিকে। এত সুন্দর চোখের মালিকের পুরো চেসারা কতই না সুন্দর হবে এই ভেবে আস্তে আস্তে আমার হাতখানা রাদের মুখের দিকে আগাতে লাগলাম। মুখ থেকে মাক্স টান দেয়ার আগেই রাদ আমার হাত আটকে নিলো। রাগান্বিত চোখে আমার পানে তাকি আমাকে জমিনে ফেলে দিলো।

– ও আল্লাহ, আপনি মানুষ না গন্ডার। এভাবে আমাকে ফেলে দিতে পারলেন? ব্যথা পেয়েছি তো!

রাদ আমার কাছে বসে আমার উদ্দেশ্যে বলল,

– আমার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করবে না; আমি খুবই ভয়ঙ্কর।

– ভয়ংকর না ছাই। আমাকে আম্মুর কাছে দিয়ে আসেন। আমি কান্নাকাটি করে তারপর শ্বশুর বাড়িতে যাবো। এভাবে আমাকে নিয়ে আসলেন কেনো?

এবার রাদ আমার হাত ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

– তোমাকে তোমার শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে এসেছি।

কথাটি বলে রাদ আমাকে টানতে টানতে একটি কামরার ভেতরে নিয়ে গেল। জানালা বিহীন এক কামরায় রাদ আমাকে আটক করে চলে গেল বাহিরে।

রাদের এই ব্যবহার দেখে খুবই রাগ হলো। চিল্লিয়ে বললাম,

– তোর কোনদিনও বিয়ে হবে না সাদা বিলাই।

চলবে……