প্রণয়িনী পর্ব-০৩

0
716

#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|৩য় পর্ব |

– ওগো আমার আম্মু, তোমাকে অনেক মিস করছি। আম্মু তোমার ওই লাবণ্যময় চেহারাকে খুবই মিস করি। তোমার নাকের ঐ ছোট ছোট ছিদ্র দেখা খুব মিস করি। আলুর পরোটার মত চিকচিক গালগুলোকে মিস করি। আম্মু তুমি জানো! পরোটার মধ্যেও ততটা তেল থাকে না যতটা তোমার ঐ নরম গাল দুটোর মধ্যে থাকে। জানবে কীভাবে! আমি তো এতদিন তোমার গালগুলোর প্রশংসা করিনি। তোমার ঐ মিষ্টি মিষ্টি কথা গুলোকে খুব মিস করি তুমি কি আমাকে মিস করো?
আরেকটা কথা, পাশের বাড়ির পেয়ারা গাছে মই লাগিয়েছে তো! আমি কিন্তু কাউকে বলিনি যে তুমি প্রতিদিন চুরি করে পেয়ারা খাও থুক্কু নিয়ে আসো।
ফরিদ আঙ্কেলের সাথে কম কথা বলবা, চিঠিপত্র দিলেও লুকিয়ে নিবা। তুমি তো জানো না, আমি তোমাকে দেয়া সব চিঠি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে ফেলছি। হি হি হি।

ও আমার আম্মু প্রেসারের বোতলের ঔষধ কি একসাথে পুরোটাই খেয়ে ফেলেছো, যে এখনও আমাকে খুঁজে পাচ্ছো না! নাকি তোমার নাকের ডগা খাটো হয়ে গিয়েছে। তোমার নাকটা ইঁদুরের মতো হলে তো আমার ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে খুঁজতে পারতে তাই না! কতদিন বললাম নাকের সার্জারি করো, করলে না। তুমি আমার মা না। তুমি একটুও ভালো না।
আজ এই পর্যন্তই। একটা খচ্চর সাদা বিলাইয়ের সাথে তোমার এই নিরীহ বাচ্চাটার বিয়ে হয়েছে। আর আজ আমাদের বাসর রাত। দোয়া করিও।
ইতি
তোমার ভোলাভালা গাঁধীর মা।

রাত আড়াইটা বাজে। আমি এখন অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছি সাদা বিলাইয়ের সামনে। রাদ আমার সুন্দর হাতের সুন্দর লেখা পড়ে যাচ্ছে জোরে জোরে একনাগাড়ে। একা একা কোন কাজ পাচ্ছিলাম না তাই আলমারির ভিতরে খুঁজে খুঁজে একটা খাতা আর একটা কলম পেয়েছিলাম। ব্যস আমার কাজ শুরু করেছি। সারাদিনের যত বকবকানি আছে সব খাতার মধ্যে লিখে ফেলেছি। আর সর্বশেষে আম্মুর নামে একটা চিঠি লিখেছি। আর সেটাই এতক্ষণ জোরে জোরে পড়ছিল রাদ।

রাদের চিঠি পড়া শেষ হতেই আমার পানে রাগান্বিত চোখে তাকাল। আর আমি আমার বত্রিশ দাঁত কেলিয়ে প্রশ্ন করলাম,
– কেমন হয়েছে? জানেন সাদা বিলাই, আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো আম্মুকে চিঠি দেয়ার। আজ পূরণ হলো। জানেন আমার আম্মু না! সোনার আম্মু আমাকে,,,,

– স্টপ তুবা, কোন কথা না। আর এটা কি তুবা! এটা কি কোন চিঠি? তোমার চিঠি পড়ে ইচ্ছে করছে তোমাকে উগান্ডায় পাঠিয়ে দিতে। তুমি কি আদৌও পড়াশোনা করেছ?

সাদা বিলাইয়ের কথায় অপমান বোধ করলাম। ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়া পর্যন্ত ফার্স্ট গার্ল ছিলাম। আর এখন কিনা শেষ বয়সে এসে এত অপমান? সহ্য হলো না আর, এক আঙ্গুল উঁচিয়ে রাদের উদ্দেশ্যে ক্ষিপ্ত স্বরে বললাম,

– মুখ সামলিয়ে কথা বলুন সাদা বিলাই। আপনি জানেন, আমার পড়াশোনা শেষ! আপনার থেকে ভালো ছাত্র আমি। এই চিঠির মধ্যে তো আমার মনের কথাগুলো বললাম যা আম্মুর সামনে বলতে পারি না হে হে হে।

সাদা বিলাইকে তো এতো এতো ভাষণ দিলাম তো ঠিক কথা কিন্তু পরবর্তীতে আমার সাথে কী হবে তা রাদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছি। কি করব ভেবে না পেয়ে ক্যাবলা মার্কা এক হাসি রাদকে উপহার দিয়ে আবারও বললাম,

– দেখুন সাদা বিলাই, একদম ঐ সিংহের ন্যায় চোখে আমার দিকে তাকাবেন না। আপনি জানেন! ঐ বিলাই চোখে আমার পানে তাকালে আপনাকে হনুমান দেখতে লাগে! ভয় পাচ্ছি তো সাদা বিলাই!

রাদকে দেখলাম বিছানা থেকে নেমে আমার দিকে এগুচ্ছে আর আমি রাদের আগানো তে ক্রমশ পিছনের দিকে যাচ্ছি। রাদ এবার আমার উদ্দেশ্যে বলল,

– কি যেন বলছিলে এতক্ষণ! আমি অশিক্ষিত, আমি বোকা! পড়াশোনা করিনি? এই মেয়ে তুমি জানো? আমি আমেরিকা থেকে পড়াশোনা করে এসেছি! তোমার চেয়ে হাজারগুন বুদ্ধি মাথায় নিয়ে ঘোরাফেরা করি। আর যেন কি বললে! তোমার পড়াশোনা শেষ? ইন্টার পাশ করা মেয়ের পড়াশোনা শেষ হলো কীভাবে আমাকে বলো তো!

– আরে আপনি দেখি হাট ঘাট বেঁধেই মাঠে নেমেছেন। আমার সম্পর্কে সব জানেন। কিন্তু আপনি তো ভুল বললেন। আমার পড়াশোনা সত্যিই শেষ। আমি এখন অনেক বড়ো। কিন্তু আপনি এখনও আমাকে বললেন না যে কেন আমাকে বিয়ে করেছেন।

– তোমার মত তিন ইঞ্চি বাট্টুকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।

– কিহ, আমি বাট্টু! তাহলে আপনি জিফরু।
– জিফরু মানে কি!
– জিরাফ।
রাদ এবার দু হাতে নিজের মাথা চেপে ধরলেন। কয়েকসেকেন্ড পর আমার উদ্দেশ্যে বললেন।
– আজ তোমার সব বদমাইশি বের করছি দাঁড়াও।
রাদের কথা শুনে আমাকে আর পায় কে। দরজা বন্ধ থাকায় এই লম্বাটে ঘরের মধ্যেই এক্কা দোক্কা খেলা শুরু করে দিয়েছি। রাদ আমার পিছনে আর আমি রাদের সামনে সারা ঘরে দৌঁড়াচ্ছি। রাদের হাতে নাগালে আমাকে না পেয়ে রাদ চিল্লিয়ে বলতে শুরু করল।

– খোদার কছম তুবা, তুমি যদি না থামো তো তোমাকে তিনদিন বিনা খাবার, পানিতে এই ঘরে বন্দি করে রাখবো।

রাদের কথার পর পর’ই হঠাৎ লোডশেডিং হয়। দিনের আলোতে যতই আমি চঞ্চল রাতের আঁধারে ততই আমি ভীতু। সাদা বিলাই বলে এক চিৎকারের পিছনে রাদের দিকে দৌঁড় দেই। শক্ত করে রাদকে জরিয়ে ধরে বিড়বিড় করতে থাকি।

– আমি আঁধার অনেক ভয় পাই সাদা বিলাই। ঐ কালো মানুষেরা চলে আসবে। আমি আম্মুর কাছে যাবো সাদা বিলাই। আম্মুও ভয় পাচ্ছে এই আঁধারে। সাদা,,,,,,

এরপর আর কিছু মনে নেই।

এদিকে তুবার জরিয়ে ধরাতে রাদ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। জীবনের এই প্রথম কোন মেয়ের এত নিকটে আসা তাও আবার যাকে রাদ তিন কবুল পড়ে বিয়ে করেছে। রাদের আসল উদ্দেশ্য তো এটা না। রাদ তো অন্য কিছু করতে চায়। কারেন্ট চলে আসায় রাদ তুবাকে কোলে তুলে খাটে শুইয়ে দেয়। নিজের মুখ থেকে মাক্স খুলে লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করে। তুবার দিকে তাকিয়ে খেয়াল করে, তুবার চোখের পানি এখনও জমে আছে চোখের কোনায়। রাদ আলতো হাতে পানিটুকু মুছে বলতে শুরু করে,

– তোমার আজকের রুপ দেখে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না যে তুমি এমন জঘন্য কাজ করতে পারো। তোমাকে যত শাস্তি দিবো কম হয়ে যাবে। প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা তোমার মত মেয়ে বুঝবে কি করে! আমার আপনজনের হৃদয় যেভাবে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখেছি ঠিক একইভাবে তোমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করব। আমার প্রিয়জনের চোখের জলের প্রতিশোধ আমি নিয়েই ছাড়ব।

রাদ আর এক মুহূর্তও দাড়াল না। দরজা খুলে হনহনিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এদিকে তুবা একা গরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে যাকে দেখার মত কেউ নেই।

—————

সাত মাসের পেট নিয়ে ফারিফতা এগিয়ে যাচ্ছে তুবার বাসার উদ্দেশ্যে। তুবার একমাত্র বেস্টফ্রেন্ড ফারিফতা। আজ তিনদিন তুবা গায়েব। তুবার মা তুবার কথা চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
এক বছর আগে ফারিফতার বিয়ে হয় আবিরের সাথে। ফারিফতার বাবা আবিরকে অপছন্দ করতো কিন্তু শেষে ফারিফতার কথা ভেবে রাজি হয়ে যায় আর এসবকিছু সম্ভব হয়েছে তুবার জন্য। ফারিফতার জীবনের যত ঝড়-তুফান এসেছে সবকিছুর মোকাবিলা করেছে তুবা। তুবা ফারিফতার জান আর ফারিফতা তুবার। তুবার বাসায় প্রবেশ করতেই তুবার মা রেহেনার ক্রন্দন শুনতে পায় ফারিফতা। ‘বড়ো আম্মু’ বলে সম্বোধন করতেই তুবার মা আরো জোরে কান্না করে আহাজারি করতে থাকে।

– ফারিফতা, আমার মেয়েকে এনে দে মা! আমার মেয়ে একা কোথায় কি করছে কে জানে। তুই তো জানিস আমার মেয়ে কেমন। অচেনা মানুষদের সাথে এমন ব্যবহার করে যেন সে শত বছরের চেনা। ফারিফতা, আমার মেয়ের যে পদে পদে বিপদ! কোথায় খুঁজবো আমার মেয়েকে। আমার তুবাকে এনে দে মা! সবকিছু হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি একমাত্র তুবাকে আঁকড়ে ধরে। এই মেয়ের কিছু হলে আমি মরে যাবো।

তুবার মায়ের আহাজারি শুনে ফারিফতার নেত্র বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। একজন মায়ের বুক থেকে সন্তান হারানোর বেদনা অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারে না।
তুবার মা হাই প্রেশারের রোগী। অতিরিক্ত চিন্তার ফলে মাথা ঘোরাচ্ছে। ফারিফতার একার পক্ষে তুবার মাকে নাড়াচাড়া করা সম্ভব না তাই ফারিফতার স্বামী আবিরকে একজন ডাক্তার নিয়ে আসতে বলে।
ফারিফতা এক ধ্যানে তুবার মায়ের পানে তাকিয়ে আছে। তুবার পরিবার সম্পর্কে সমস্তকিছু একমাত্র ফারিফতার জানা যা ফারিফতা কখনও কাউকে বলেনি এমনকি আবিরকেও না। তুবার অতীত যে খুবই ঘৃণিত যা ফারিফতার অজানা না।

————-

প্রেমে পরেছ কখনও!
প্রেমিক পুরুষের অপেক্ষায় কেটেছে কি প্রহর?
নিশ্বাস ত্যাগ করেছ কি তাঁর কথা স্বরণ না করে!
আমি অপেক্ষা করছি, হাজারবার অপেক্ষা করতে রাজি আছি।
করব’ই বা না কেন; সে তো আমার শুধু আমার’ই।
– আফসানা মিমি

বিছানায় অর্ধ শায়িত অবস্থায় কাগজে একের পর এক ছন্দ, কবিতা লিখেই যাচ্ছি। আজ তিনদিন তিনরাত এই বন্দি দশায় আছি আমি। সেই প্রথমদিন আমার সাথে রাদ দেখা করে গিয়েছিল এরপর আর আসেনি। তিনদিন আগে যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসে তখন সকাল দশটা বাজে, আমি রুমে একা ছিলাম। হাজারবার সিসি ক্যামেরার সামনে রাদ রাদ বলে চিৎকার করেছি কিন্তু রাদের কোন হদিস পাইনি। এক পর্যায়ে যখন ক্লান্ত হয়ে যাই তখন বিছানায় ফিরে আসি। ক্ষুধার জ্বালায় ফ্রিজ খুলে দেখি সেখানে শুধু শুকনো খাবার আর ফল রাখা আছে; যা আমার অপছন্দনীয়। অগত্যা না খেয়ে ছিলাম সারাদিন। কিন্তু এভাবে না খেয়ে আর কতক্ষণ, ওবুও উপায় নেই। পানি পান করে এই তিনদিন ছিলাম যার কারনে আমার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই।

রাদ আমার কাছে না আসার কারন বুঝতে পারছি না। আমার যতটুকু মনে হচ্ছে রাদ আমাকে আগে থেকেই চিনে যার কারনে আমাকে এভাবে জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে করেছে কিন্তু আমি কি করলাম? কথা বলবো না এবার আসলে। রাদের অপেক্ষা করতে করতে একটা গান গাইতে ইচ্ছে করছে,

– জামাই কেন এলো না,
কিছু ভালো লাগে না।
এবার আসুক,
উদ্ভট আরো নাম রাখিবো।

চলবে……..