প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব-২১+২২

0
237

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(২১)

রিয়াদ অন্ধকারে কোথাও মিলিয়ে গেল,আশেপাশে রিয়াদকে হন্তদন্ত হয়ে খোঁজতে লাগল সে অজ্ঞাত ব্যক্তি,রিয়াদ তাকে আড়াল থেকে দেখছে,শরীর থেকে র*ক্ত ঝড়ার বেগ প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে, সাথে দূর্বল হয়ে পরছে রিয়াদ,তাকে যে করেই হোক প্রমত্ত অঙ্গনার হাত থেকে নিজের প্রাণ রক্ষা করতেই হবে,তবে বেরুতেও ভয় করছে রিয়াদের,মৃ*ত্যু যে তার পিছনেই,তার গতির বেগ স্বাভাবিকের তুলনায় বহুগুণ,যেন দক্ষ কোনো দৌঁড় প্রতিযোগী,শরীরের জোরও কম না,তার সাথে পেরে ওঠার শক্তি ও সাহস ঝুটিয়ে ওঠতে পারছে না রিয়াদ,তবুও মন শক্ত করে অজ্ঞাত সে ব্যক্তির অগোচরে বের হলো,কিন্তু পারল না তার চোখ ফাঁকি দিতে,সাথে সাথে ধাওয়া শুরু করল তাকে সে,প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে ছুটতে মেইনরোডের বেশ পাশে চলে এলো রিয়াদ,মনে জেগে উঠল বেঁচে যাওয়ার বড় এক আশা।তবুও ভয় দূর হলো না মন থেকে,পিছনের জন যে মোটেও দূর্বল বা মাত দিয়ে যাওয়ার কোনো পাত্র নয়,তাই মেইন রোডের বেশ পাশে এসে গেলে প্রাণপণে ছুটতে লাগল, কিন্তু আবারও পিছন থেকে ভারি কিছুর আঘাতে মুখ থুবড়ে পরল রিয়াদ,শরীর পুরো অবশ হয়ে আসছে তার,হাত পা কাঁপছে,কাজ করা যেন বন্ধই করে দিয়েছে,তাও হুমড়ি দিয়ে নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল, এবার সেই অজ্ঞাত ঘাতক তাকে টেনে পাক ফিরিয়ে নিল,ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে অস্পষ্ট বাক্যে বলল রিয়াদ।

″প্লিজ আমাকে মেরো না,ছেড়ে দাও প্লিজ। ″

″ভয় পাস নে এখনই ছেড়ে দিব।″

কথাটা বলে রিয়াদকে টেনে দাঁড় করাল,রিয়াদ ভালো করে কিছু বোঝে ওঠার আগেই তাকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রবল এক ধাক্কা দিলো যাতে রিয়াদ রাস্তায় গিয়ে আঁছড়ে পরার আগেই একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে গেল,পলকেই রিয়াদের শরীর বেশ দূরে গিয়ে ছিটকে পরল,গাড়িটা একটা ব্যক্তিগত কার ছিল,হয়ত চালক ভালো মানুষ ছিল তাই গাড়ি থামিয়ে এগিয়ে গেল রিয়াদের কাছে,প্রমত্ত অঙ্গনা নামক সেই অজ্ঞাত ঘাতক আর পা বাড়াল না সেদিকে,বরং গাছগাছালির আড়াল হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

আদ্রিশ ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছে বুকে পাথর রেখে,হঠাৎ কক্ষে প্রবেশ করল রিদিকা।

″কি এখন তোমার আসার টাইম হলো?″

″আরে কি করব বলো? আমার ওই বান্ধবী তো আসতেই দিচ্ছিল না,বলে না কি আজকে থেকে যেতে,কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া বেশিক্ষণ দূরে থাকতে পারি না বলে এসেছি ওকে।ওর স্বামী নিজে এসে আমাকে বাড়ির সামনে দিয়ে গেলেন।″

″হুম ভালো করেছ।আমি নিজে থেকেই তোমায় কোথাও দূরে থাকতে দিব না কখনও,তুমি শুধু আমার কাছেই থাকবে।″

″হুম বুঝেছি,তা হাতে ওটা কি?″

″আমার আর আঁখির ডিভোর্স পেপার,সাইন করে দিয়েছি।″

″তুমি অবশেষে আঁখিকে ডিভোর্স দিয়ে দিলে?এমনটা কেনো করলে তুমি?আমি কখনও তা চাই নি।আমার জন্যই আজ তোমরা আলাদা হয়ে গেলে।″

″আরে তুমি শুধু শুধু প্যারা নিচ্ছো,আঁখি আমার কাছেই ফিরবে দেখে নিও,যখন দেখবে আমি সাইন করে দিয়েছি ডিভোর্স পেপারে, যখন বুঝতে পারবে আমাকে ও সত্যিই হারিয়ে ফেলছে,আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে তখন সব ফেলে আবারও আমার কাছে ফিরে আসবে।″

″আর তুমি ওকে মেনে নিবে!″

″অবশ্যই।″

″তোমাকে ও এতো অপমান করল তারপরও!″

″হুম,ও আমার সাথে যা তা করতে পারে কারণ আমি ওকে ভালোবাসি।আমি সেই অধিকার ওকে দিয়েছি।তুমি ফ্রেস হয়ে নাও আমি আসছি।″

অতঃপর আদ্রিশ কক্ষ ত্যাগ করল,রিদিকা বেশ খানিকক্ষণ তার যাওয়ার পাণেই তাকিয়ে রইল।

রাত ১ টা,রিয়াদের এক্সিডেন্ট যে গাড়ির সাথে হয়েছে সে গাড়ির মালিক তারই দূরসম্পর্কের আত্নীয় হন,তার এ অবস্থা দেখে লোকটি তাকে তাড়াতাড়ি করে পাশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে।ইমারজেন্সিতে নিতে হবে রিয়াদকে,শরীরের বিভিন্ন অংশ তার থেঁতলে গেছে, এদিকে বর্তমানে হাসপাতালে কোনো ডাক্তার নেই,পেরেশানিতে পরল নার্সেরা।নার্স ইরা ফোন করল ডা.আশরাফ খানকে।

″স্যার ইমারজেন্সি রোগী এসেছে,অনেক র*ক্ত*পা*ত হচ্ছে তার,আধ ঘন্টার মাথায় চিকিৎসা শুরু না করা গেলে নিশ্চিত মা*রা যাবে কিন্তু বর্তমানে কোনো ডাক্তার এখানে নেই।″

″তোমরা যেভাবে পারো রোগীর টেক কেয়ার করো,র*ক্ত বন্ধ রাখার চেষ্টা করো আর হাসপাতালের সবথেকে কাছে যে ডাক্তার থাকেন উনাকে কল করে ইমারজেন্সি আসতে বলো।″

″ওকে স্যার।″

হাসপাতালের সব থেকে কাছে একমাত্র আঁখির বাড়ি পরে,সেখান থেকে তার বাড়ির দূরত্ব মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা তাই নার্স তাকেই ফোন করল।ইমারজেন্সির ডাক কখনও অবহেলা করে না আঁখি।যতো তাড়াতাড়ি করে পেরেছে চলে এসেছে।প্রায় ২ ঘন্টা অপারেশনের পর আঁখি রিয়াদকে বাঁচাতে সক্ষম হলো,যদিও আঁখির তাকে মোটেও পছন্দ না কিন্তু আঁখি নিজের দায়িত্ব পালনে কখনও পিছপা হয় না।এতসময়ে সেখানে রিয়াদের পুরো পরিবারই চলে এসেছে,কান্নায় ভেঙে পরেছে সকলেই।রিয়াদ বেঁচে গেলেও আশংকা মুক্ত নয়,তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে,জ্ঞান ফিরলে ভালো খারাপ কিছু বুঝা যাবে।

কাজ শেষ করেই আঁখি আবারও চলে যায় তার শান্তির নীড়ে।

রাত ৪ টা,ব্যস্ত শহর ঘুমের দেশে তলিয়ে আছে,চারিদিক নিরবতার দখলে,জনশূন্য সবদিক,প্রমত্ত সে অঙ্গনার প্রিয় একটা পরিবেশ যে আশপাশে ভালোই জমে উঠেছে,এই ঘন অন্ধকার জনশূন্য নিরব পরিবেশেই তো পাপীদের মৃ*ত্যু আর্তনাদ শুনতে মজা পায় সে,নিজের কাজ অপূর্ণ রাখার অভ্যেস যে তার কখনোই নেই,তাই চলে আসলো অপূর্ণ কাজে পূর্ণতা দান করতে,হাসপাতালে এসে সোজা আইসিইউ রুমে ঢুকে পরল ,এগিয়ে গেলো রিয়াদের ধারে,অতঃপর খুবই ধীর গতিতেই তার শরীরে দেওয়া সকল সে*লা*ই ও ব্যান্ডেজ আস্তে আস্তে খুলতে লাগল, তার যেন এসব মজাই লাগছে,অতঃপর রিয়াদকে সেই আগের হালে ফিরিয়ে দিয়ে সে তার পথ ধরল।

আদ্রিশ সকাল হতে না হতেই ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়েছে আঁখির কাছে,প্রফুল্ল মনে নাস্তা সেরে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে যাবার জন্য প্রস্তুত হবে তখনই হাতে আসল পেপারটা,আদ্রিশের সাইন দেখে ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠল আরেকদফা তার মন,চোখে শোকের জল থাকলেও মুখে ফুটল তাচ্ছিল্যের হাসি।

অবশেষে তার ভালোবাসার পরাজয় ঘটল আদ্রিশের মিথ্যে ভালোবাসার ধাক্কা সামলাতে না পেরে।তাচ্ছিল্যের হাসিটা প্রখর করে বলল আঁখি।

বাহ রে ভালোবাসা,যে কাল অব্দি মৃত্যুর আগ অব্দি ছাড়বে না বলেছিল সেই আজ নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিল।মানুষ এতো নাটক জানে আদ্রিশকে না দেখলে জানতামই না।আল্লাহ তায়ালা আপনার কাছে হাজার শুকরিয়া আমাকে আদ্রিশের মিথ্যে ভালোবাসার জাল থেকে বাঁচানোর জন্য।অবশেষে আত্মসম্মানের সংগ্রামে জয়ী হলাম আমি,শুকরিয়া রাব্বুল আল-আমীন।

আদ্রিশ নাস্তা করছিল তখনই তার ফোনে কল আসে।কলটা রিসিভ করার পর ওপর পাশের বলা কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল আদ্রিশ,আর কিছু কাউকে না বলেই ছুটে বেরুলো বাইরের দিকে।রিদিকা শুধু লক্ষ্য করল আদ্রিশের কার্যকলাপ।

আইসিইউ রুমের বেড জুরে র*ক্তে*র ছড়াছড়ি,রিয়াদের লা*শে*র দিকে যে কারো তাকাতেই ভয় করছে,এতো ভয়াবহ অবস্থা সহ্য করার ক্ষমতা যে সবার থাকে না।রিয়াদের লা*শে*র পাশেও প্রমত্ত অঙ্গনা নামটা লিখা,তাজ্জবের ব্যাপার হলো নামের পাশে এবার বাক্যও লিখা আছে।

ভালোবাসার মর্ম যে প্রতারণা দিয়ে দেয় তার হাল এমনই হওয়া উচিৎ।
প্রমত্ত অঙ্গনা।

ইন্সপেক্টর জিসান নির্বাক হয়ে রইল,পা*ব এর একটা বন্ধ রুমে ইশানারও গলা কা*টা লা*শ পাওয়া গেছে যার পাশে লিখা।

লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
প্রমত্ত অঙ্গনা।

কি করবে জিসান ভেবেই পাচ্ছে না,এই প্রমত্ত অঙ্গনা যে তার রাতের ঘুম ও দিনের শান্তি হারাম করে দিয়েছে।তবে ছাড়বে না এই অজ্ঞাত খু*নি*কে পণ করে নিয়েছে সে।সে যেভাবেই হোক না কেনো তাকে তো জিসান ধরবেই।

হাসপাতালের সিসিটিভি ফোঁটেজ চেক করল জিসান,সেখানে শুধু হুডিওয়ালা,মাস্ক পরিহিত একজনকে দেখা গেছে,যার হাতে মোজা পায়ে সু।উপর থেকে নিচ অব্দি কালোতে ভরপুর,চেহারা দেখা বা শরীরের কোনো গড়ন কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না এমতাবস্থায় এই ফুটেজ দিয়েই বা কি হবে।গম্ভীর চিন্তায় পরে গেল জিসান।

হাসপাতালে পরেছে কান্নার রুল,পুলিশের দাবিতে রিয়াদের লাশ তাড়াতাড়িই পোস্টমর্টেমে নেওয়া হয়ে গেল।লা*শ কা*টা ঘরের বাইরের দিকে বসে কেঁদে যাচ্ছে রিয়াদের আত্মীয় স্বজন।একপাশে বসে কেঁদে যাচ্ছে তার স্ত্রী তার দুই সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে।রিয়াদ তাকে সত্য অর্থে ভালো না বাসলে কি হলো সে তো ভালোবেসেছিল,তার ভালোবাসায় তো কোনো খুঁত ছিল না।আঁখি দাঁড়িয়ে প্রখড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে মাসুমার উপর,তখন আদৃত চলে আসল সেখানে আঁখির খোঁজে। আঁখির উদ্দেশ্যে বলল।

আঁখি,আধ ঘন্টার মধ্যে একটা ডিফিকাল্ট সার্জারি আছে,আমাদের দু’জনকে থাকতে হবে।

আদৃত লক্ষ্য করল আঁখি যেন তার কথায় কান দিল না,বরং তার পুরো মনোযোগ মাসুমার দিকে।আদৃত এবার আঁখির কাঁধে হাত রেখে বলল।

″এমন কি দেখছ আঁখি?″

″দেখছি কারো ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে গেলে কতোটা কষ্ট হতে পারে,তার গভীরত্বে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি,ভালোবাসার মানুষটা যেরকমই হোক না কেনো তাকে মন থেকে কখনও ঘৃণা করা যায় না,দেখো না ও কিভাবে কান্না করছে এক বিশ্বাসঘাতকের জন্য,যে তাকে রেখে অন্য নারীতে আ*স*ক্ত হয়েছিল আজ তার মৃ*ত্যু*তেই সেই অভাগীর চোখের জল ঝড়ছে।″

″রিয়াদ অন্য নারীতে আ*স*ক্ত ছিল মানে?আর এসব তুমি কি করে জানলে?

এবার আঁখি আদৃতের দিকে তাকিয়ে অনেকটা হেসে বলল।

সেটা না হয় আপনাকে নাই বললাম।সবকিছু শোনতে কেনো মন চায় আপনার?মনে এতো কৌতুহল থাকা ভালো না ডা.সাহেব।চলুন সার্জারির আগে রোগীর অবস্থাও তো জানতে হবে।

আঁখি আগে হাঁটা ধরলে পিছনে এলো আদৃত ঠিক তখন আঁখির সামনে পরল আদ্রিশ,আঁখির পিছনে আদৃতকে দেখে মুহুর্তেই তার র*ক্ত জ্ব*লে উঠল।

চলবে……

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(২২)

আদ্রিশকে দেখেও না দেখার ভান করে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল আঁখি যাতে তার মনের পীড়া বেড়ে দ্বিগুণ হলো।আদৃত আদ্রিশের উপর তাচ্ছিল্য ভরা এক দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নিজেও পাশ কেটে চলে যেতে নিলে আদ্রিশ তাকে পিছু ডাক দিলো।

দাঁড়ান ডা.আদৃত।
আদ্রিশের ডাকে আদৃত থমকে দাঁড়াল, এবার আদ্রিশ ধমকানো স্বরে বলল।

″আঁখির কাছ থেকে দূরে থাকবেন আশা করি।″

″কেনো?″

″কারণ আঁখি শুধুই আমার। ″

″তোমার ছিল কিন্তু তুমি তার মর্ম দিয়ে ওঠতে পারো নি।তাই ও কারো হোক বা না হোক তোমার তো একদমই না।″

″ভুলে যাবেন না আঁখি তখনও আমার ছিলো।″

″মনে তো তোমার রাখা উচিৎ যে আঁখি তখন তোমার ছিলো না,ওকে আমি ভিক্ষে স্বরুপ দিয়েছি তোমায়।″

কথাটা কানে যেতেই ক্ষি*প্ত হয়ে আদ্রিশ আদৃতের কলার চেঁপে ধরল,দাঁত কটমট করে বলল।

″আঁখি শুধুই আমার কথাটা ভুলে যাবেন না ডা.আদৃত, নইলে আমি আমার সীমালঙ্গন করতে বাধ্য হবো,আঁখির দিকে তোলা চোখ আমি উপরে ফেলতেও দ্বিধা করব না।″

আদৃত এবার বেশ জো*র ধাক্কা দিয়ে আদ্রিশকে সরিয়ে দিলো নিজের কাছ থেকে,আদ্রিশ অনেকটা পিছিয়ে গেল এতে,আদৃত এবার ঝাঁঝালো গলায় বলল।

সেদিনের মা*র মনে থাকলে তুমি আজ এই স্পর্ধা করতে না আদ্রিশ,আমার কলার ধরার মতো ভুলের মাশুল টা এখনি সুধে আসলে নিয়ে নিতে সক্ষম আমি তুমি তা ভালো করেই জানো,কিন্তু হাসপাতালে আমি সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না,তাছাড়া আমার আঁখির এভাবে এসব ভালো নাও লাগতে পারে,আর আমি ওকে কোনোরকম পীড়া দান করার কথা ভাবতেও পারি না,আর যেখানে রইল কথা আঁখিকে নিয়ে,আঁখি আমার ছিল,আমার আছে আর আমারই থাকবে।মধ্যেখানে তুমি তো ছিলে শুধু ওর মনের ভুল,আঁখির জীবনের তিক্ততম অধ্যায় যা শেষ হয়ে গেছে,এখন আঁখির ভবিষ্যত জুরে শুধু আমারই অবস্থান হবে,ওকে আমি নিজের করে নিব,আগলে নিব নিজের ভালোবাসার পবিত্র বন্ধনে, পারলে ঠেকিয়ে নিও।

কথাগুলো বলে আদৃত কলার ঠিক করতে করতে চলে গেলো,আদ্রিশ অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল তার যাওয়ার দিকে।

সার্জারির উদ্দেশ্যে যাবে আঁখি আদৃত তখনি জিসান তাদের পথ আটকালো।

″দাঁড়ান ডা.আঁখি।″

″জি, বলুন ইন্সপেক্টর জিসান?″

″আমরা আপনার বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেছি কাল রাত ৪ টের সময় কিন্তু আপনাকে পাওয়া যায় নি,আপনি কোথায় ছিলেন তখন?″

″এক্সকিউজ মি, ইন্সপেক্টর।আপনি একজন পুলিশ অফিসার,সব রকম যৌক্তিক জ্ঞান আপনার থাকা প্রয়োজন,এমন কোনো লোক নেই হয়ত যারা বেড রুমে সিসিটিভি ক্যামরা লাগায়,এট লাস্ট আমি এমন কাজ করার কথা কখনও ভাবতেও পারি না।আপনি সিসিটিভি ফুটেজ ভালো করে দেখেছেন নিশ্চয়ই?আমি কাল রাত প্রায় সাড়ে তিনটের দিকে আমার বেডরুমে প্রবেশ করেছিলাম সেখানে পরিষ্কারভাবেই আপনি তা দেখেছেন আশা করছি,আর তারপর আমি বেডরুম থেকে হয়ত সকাল ৭ টার দিকে বেড়িয়েছি ,এর আগে কক্ষ থেকে বেড়ুনোর কোনো ফুটেজ আপনি দেখেছেন বলে আমার মনে হয় না।দেখুন আমি এক কথা বার বার বলতে মজা পাই না,তাও আপনাকে বলছি প্রমাণ ছাড়া আঁখিকে হেনস্তা করতে আসবেন না, নইলে পরিণাম ভালো হবে না।

″আমাকে থ্রেট দিচ্ছেন!″

″আমি সোজা কথা বলেছি, আপনি থ্রেট মনে করলে করতে পারেন,আঁখির কোনো আসে যায় না।″

কথাটা জানিয়ে আঁখি চলে গেলো ওটি রুমের দিকে,আদৃত একপলক জিসানের দিকে তাকিয়ে আবার হাঁটা ধরল।″

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিদিকা,বেশ সাজগোছ করছে,আদ্রিশের মন ভালো থাকবে না আজ সে জানে।প্রাণ প্রিয় বন্দু তার আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে মন মানসিকতা ভালো থাকার তো কোনো কথা না,তাই আজ সে আদ্রিশের পছন্দের খাবার রান্না করেছে নিজ হাতে,তার দেওয়া শাড়ী পরে হালকা সাজগোজ করে নিয়েছে,এবার চুল আচড়ানোর পালা,চুল আচড়াচ্ছিল হঠাৎ একগুচ্ছ চুল এমনিতেই তার হাতে চলে আসলো,স্বাভাবিক ভাবে একসাথে এতো চুল আসার কথা নয়,রিদিকার চুল এমনিতে অনেক কম পরে কিন্তু আজকে হঠাৎ এমনটা হওয়া মনে পেরেশানির যোগান দিয়ে গেল তার।

সার্জারি শেষ করে এসে আঁখি তার কেবিনে বসে আছে,আদৃত সেই রোগীর কিছু রিপোর্ট নিয়ে এলো আঁখির সাথে আলোচনা করতে।এদিকে আঁখি ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে চোখের জল ফেলছিল,তিন বছরে গড়া সম্পর্ক,যতই তিক্তটা থাকুক না কেনো তার ভেঙে যাওয়া মেনে নেওয়ার সক্ষমতা যে কেউই সহজে আয়ত্ত্ব করে ওঠতে পারে না।আঁখির অবস্থাও যে সেই একই রকম,আদ্রিশের বা বাকি সবার সামনে নিজেকে দূর্বল পরতে না দিলেও নিজের কাছে নিজের দূর্বলতা কি দিয়ে ঢাকবে আঁখি?কেমনে দিবে মনে শান্তনা?তখন আঁখির কেবিনের দরজা একটু খোলা অবস্থায় থাকলে আদৃত তাকে কান্নারত অবস্থায় বাহির থেকেই দেখতে পায় অনেকখানি,যাতে বুকের ভিতরখানা তার মুহুর্তেই ব্যথাময় হয়ে গেলো,বুকের পীড়া দমিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে দরজায় নক করল।যাতে আঁখি হকচকিয়ে ওঠে ডিভোর্স পেপারটা সরিয়ে চোখ মুছে নিল,মুখে মিথ্যে হাসি কোনোরুপ টাঙিয়ে আদৃতকে ভিতরে আসতে বলল।

″আসলে মিসেস রেহানার রিপোর্টগুলো নিয়ে এসেছিলাম,তোমার সাথে এ নিয়ে কিছু কথা ছিল।″

″আরে আপনি কেনো এলেন,আমাকে ডাকিয়ে নিলে পারতেন!″

″তোমার যাওয়া আর আমার আসা একই ই তো।″

″আচ্ছা বসুন,দেখি রিপোর্টগুলো।″

আদৃত বসে গেলে আঁখি তার কাছ থেকে রিপোর্টগুলো নিয়ে দেখতে লাগল,আদৃত বেশ সময় তার পানে অপলকে তাকিয়ে এবার বলে ওঠল।

চাইলেও আমার সাথে সব তিক্ততা ভাগ করে নিতে পারো আঁখি,তুমিই তো বলতে তিক্ততা মনে লুকিয়ে না রেখে ভাগ করে নেওয়া উচিৎ মনের ভালোর জন্যই।

আদৃতের কথায় বেশ অবাকত্ব নিয়ে আঁখি বলল।

″আপনি কি বলতে চাইছেন পরিষ্কার করে বলবেন?″

″আমি পরিষ্কার করেই বলছি আঁখি তুমি বোঝেও না বোঝার ভান করলে তো কথা চাঁপা পরেই থাকবে।আড়ালে চোখের জল ফেলে সবকিছুর সমাধান পাওয়া যায় না আঁখি।ব্যথা লুকোলেই লুকোয় না।″

″আপন কেউ রয়ে গেলে তো শোক ভাগ করে বলে বেড়াবো।″

″কেনো?আমি কি এতই পর হয়ে গেলাম?″

″আপন কখন ছিলেন? কোনোদিনও না?তখনও পর ছিলেন আর এখনও তাই।সবাই সবকিছু, সব অনুভুতি বুঝে ওঠতে সক্ষম হয় না ডা.আদৃত।″

″হয়তবা সক্ষম ব্যক্তিকেই অক্ষম ভাবছ তুমি।″

″অক্ষম তো আমি নিজেই হলাম মানুষ চিনতে আর কতো ভুল পথে পা বাড়ানোর সাহস পাব?আমার সে ক্ষমতা যে আর নেই।″

″হ্যাঁ ভুল তো সবসময় আমিই ছিলাম,দেখো না তুমি ঠিকই জীবনে কতটা এগিয়ে গেলে আর আমি সেই শুরুতেই পরে রইলাম।চাইলেই কি কাউকে কারো জায়গা দিয়ে দেওয়া যায় জীবনে আঁখি?″

″জীবনে এগিয়ে যাওয়া টা অস্বাভাবিক কিছু না,চাইলেই জীবনকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া যায় কিন্তু সে প্রথম ব্যক্তির স্থান কাউকেই দেওয়া সম্ভবপর হয়ে ওঠে না ডা.আদৃত, হয়ত আপনি কখনোই সে ব্যাথার পরিমাণটা অনুভব করে ওঠতে পারবেন না।″

কথাটা আঁখি আদৃতকে ধিক্কার দিয়ে বলেছে বুঝতে পারল আদৃত,তবে আঁখি কেনো তাকে ধিক্কার দিবে এমনভাবে,আদৃত তো আঁখির জন্যই তাকে ছেড়ে গেল,কারণ আঁখি তো শুদুই আদ্রিশকে ভালোবাসত!″

আঁখি আবার বলল।

″রিপোর্টগুলো ঠিক আছে দেখছি,আপনি রোগীর ওষুধগুলো লিখে দিন আমি আজকেও ছুটি নিয়েছি, কারণ রাতে এমারজেন্সি দেখতে গিয়ে ঘুমোতে পারি নি,শরীরটা খারাপ লাগছে।চলি…″

″আমি পৌঁছে দেই।″

″লাগবে না,এমনিতেই একা নিজেকে সামলে নিতে পেরে গেছি আর কাউকে প্রয়োজন নেই।″

আদৃত তখন আঁখির চোখে ছলছল করে ওঠা জল স্পষ্ট দেখতে পেলো যা হয়ত সে গড়িয়ে পরতে না দেওয়ার সম্পূর্ণ চেষ্টা করে গেছে।

চলে গেলো আঁখি আদৃত পাথরের ন্যায় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

জিসান প্রমত্ত অঙ্গনা সম্পর্কে বেশ সন্ধান সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে।

এস আই সুমন উৎসুক স্বরে জিজ্ঞেস করল।

″স্যার আপনার মনে হয় না এই প্রমত্ত অঙ্গনা কোনো ছেলে?
হয়তোবা পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্য নিজেকে নারী বলে দাবি করছে।″

″না, এই প্রমত্ত অঙ্গনা একজন নারীই,আর এরা একজন না দু’জন।একজন আসল আরেকজন নকল,আসল প্রমত্ত অঙ্গনার আবির্ভাব ১৩ বছর আগ থেকে হয়েছে আর নকল জনের ৪ বছর আগে।প্রমত্ত অঙ্গনা সম্পর্কে আমরা যে বিস্তারিত খবর গুলো পেয়েছি তা মোতাবেক সে আজ অব্দি যতটা খুন করেছে তাদের সবাই হয়ত পর*কীয়া কারী ছিল,নয়ত ধ*র্ষ*ক,নয়ত এমন নারীরা যারা অন্যের স্বামীকে নিজের করে পেতে চেয়েছে।আর সে সকল লা*শে*র পাশে তাদের মৃ*ত্যু*র কারণও লিখে দিয়ে গেছে,সে খুনগুলো খুব বিচক্ষণতার সাথে করে থাকে,প্রথমে শিকারকে মাথায় আঘাত করে তাকে দূর্বল করে তারপর তার উপর ছু*রি দিয়ে প্রহার করে।″

″আপনি এতো নিশ্চিত হয়ে কিভাবে বলতে পারেন প্রমত্ত অঙ্গনা দু’জন। ″

″কারণ প্রমত্ত অঙ্গনা আজ অব্দি যতটা খুন করেছে সবাই এক ধরনের অপরাধী ছিলো,সমাজের পতনের সাথে জড়িত কিছু ব্যক্তিত্ব,যাদের লা*শে*র পাশে তার নামের সাথে তাদের খু*নে*র কারণও লিখা ছিল,কিন্তু গত চার বছর আগের দুইটা খু*ন এদিকে এখন কলি আর লিজানের খুনগুলো প্রমত্ত অঙ্গনা করে নি,বরং নকল প্রমত্ত অঙ্গনা করেছে কারণ তাদের লা*শে*র পাশে নাম ব্যতীত কিছু লিখা ছিল না,যেখানে প্রমত্ত অঙ্গনা কখনও খু*নে*র কারণ লিখতে ভুল করে না।রিয়াদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী তার এক্সিডেন্টের আগে তার শরীরে ছু*রি*ঘা*ত করা হয়েছিল,আর রিয়াদ আর ইশানার খু*ন আসল প্রমত্ত অঙ্গনাই করেছে।কারণ তাদের লাশের পাশে খু*নে*র কারণ দেওয়া ছিল।
১৩ বছর আগ থেকে যখন প্রমত্ত অঙ্গনা খু*ন*গু*লো করা শুরু করেছিল তখন পুলিশের তদন্ত অনুযায়ী তার খু*ন করার ধরণ খবরের কাগজ,টিভি বা গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল,হয়তবা সেসব খবর থেকে তার খু*ন করার ধরণ আয়ত্ব করে কেউ ব্যক্তিগত শত্রুতা মিটিয়ে নিয়ে খু*ন করে প্রমত্ত অঙ্গনার নাম ব্যবহার করে বেঁচে যাওয়ার চেষ্টা করছে।এই নকল জন মাত্র ৪ টে খু*ন করেছে,কিন্তু প্রমত্ত অঙ্গনা পুরো ত্রিশটের উপর।″

″ত্রিশটের উপর! কী বলছেন স্যার?″

″হ্যাঁ সুমন,এই মাত্র আমি খোঁজ পেলাম যে গত ১৩ বছর আগ থেকে প্রমত্ত অঙ্গনা খুন করে আসছে,ইন্সপেক্টর ইশতিয়াক ছয় বছর খোঁজ করার পরও না ওকে পেতে সক্ষম হয়েছেন আর না তো ওকে দমাতে।এরপর এই পুলিশ স্টেশনে আমার আগমণ ঘটে,গত ছয় বছরে এই শহরে প্রমত্ত অঙ্গনা ধারা দু’টি খু*ন হলেও,বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে আরও ১৭ টির মতো খু*ন এখন অব্দি গণনা করা গেছে যদের খু*ন প্রমত্ত অঙ্গনা করেছে,খোঁজ নিলে হয়ত এর থেকেও বেশি খোঁজে পাওয়া যাবে,একে নিয়ে সকল পুলিশ কর্মকর্তারা নিরাশতায় ভোগছেন,কিন্তু প্রমত্ত অঙ্গনা সব থেকে বেশি খুন আমাদের ঢাকাতেই করেছে,তাই আমার যতদূর মনে হয় ওর বাসস্থান ঢাকাতেই। ওকে খোঁজে বের করার চাপটা আমার উপরই পরেছে এখন,আর আমি ওকে খোঁজে বের করবই,আমরা এই প্রমত্ত অঙ্গনাকে যতটা হালকাতে নিচ্ছি ততটা সোজা না ওকে খোঁজে বের করা,ও এক শান্ত মস্তিষ্কের সাইকো কি*লা*র,সব ধরনের যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পন্ন,বুদ্ধিমত্তাও প্রচুর তার।তাই ওকে খোঁজে বের করতে হলে আমাদের সেই নকল প্রমত্ত অঙ্গনা অব্দি আগে পৌঁছাতে হবে,হয়তবা ওকে ধরতে পারলে আসল জন অব্দি পৌঁছা যেতে পারে।″

চলবে…