প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব-২৭+২৮

0
200

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(২৭)

অনেক করেও আঁখি আজ মির্জা হাউজ থেকে বেরুতে পারল না,শায়েলা মির্জা তাকে যেতে দিবেন না উনার এক কথাই,এখানেই কয়েকদিন থাকতে হবে,উনার বায়নার কাছে জিম্মি হলো আঁখি,কয়েকদিন থাকার মানসিকতা না থাকলেও আজ রাতটা থেকে যাওয়ার মন মানিয়ে নিল।

″যাক অবশেষে আঁখি ফিরে আসলোই,এখন ওই আপদ আদ্রিশও নেই,সুখে থাকতে ভুঁতে কিল দিয়েছিল ওকে, বুঝে নিতো এখনও কি হারাইছে,যাক যা হয় ভালোর জন্যই হয়,আদ্রিশ আঁখিকে না ছাড়লে আমার আদৃতের জীবনে আবার আঁখি কেমনে ফিরত।″

″তোমার মাথা ঠিক আছে শায়েলা,আমাদের ছেলের এখনও বিয়ে হয় নি,ওর জীবনে এখনও কোনো দাঁগ লাগে নি,হ্যাঁ কথাটা ছয় বছর আগে হলে ঠিক ছিল কারণ তখন আঁখিও অবিবাহিত ছিল,তার জীবনে কোনো কলঙ্ক ছিল না,কিন্তু এখন আঁখি ডিভোর্সি,তাও মেনে নেওয়া যেত কিন্তু আদ্রিশ ওকে ছেড়েছে ও মা হতে পারবে না বলে,কথাটা তুমি জানো?এতো কিছুর পরেও তুমি বলবে আঁখিকে ঘরের বউ বানাতে!″

″তুমি কথাটা কেমনে বলতে পারলে আরিয়ান?আঁখিকে তুমি–আমি সবসময় ইশিকার মতো করেই দেখেছি,সেই প্রথম থেকেই আমি আঁখিকে আমার আদৃতের বউ করে ঘরে নিয়ে আসার সপ্ন দেখে এসেছি,কি হয়েছে ও ডিভোর্সি তো?কি হয়েছে ও মা হতে পারবে না তো?ছিঃআরিয়ান এতো শিক্ষিত হয়েও তুমি এমন মানসিকতা রাখো!আজকাল অনেক ব্যবস্থা থাকে নিজের সন্তান পাওয়ার,টাকা থাকলে এমন অনেক পাওয়া যায়,তাছাড়া আঁখি আদৃত দু’জনই ডাক্তার, আচ্ছা একটা কথা বলো তুমি আমায় আল্লাহ না চান যদি এমন সব কিছু আমাদের ইশিকার সাথে হতো তখনও কি তুমি এমনটা বলতে ওকে নিয়ে?″

″দেখো শায়েলা তুমি আমায় ভুল ভাবছ,আঁখিকে আমিও যথেষ্ট ভালোবাসি,ও আমার কাছে ইশিকার মতোই,কিন্তু এর মানে এটা নয় যে অনুভুতিতে ভেসে যুক্তিগত দিক ভুলে যাব।″

″তুমি থাকো তোমার যুক্তি নিয়ে,এ ঘরে বউ হয়ে তো আঁখিই আসবে।″

কথাটা বলে কক্ষ থেকে বেড়িয়ে গেলেন শায়েলা মির্জা,আরিয়ান মির্জা মনে মনে কি যেন ভাবতে লাগলেন।

আদৃতদের বিশাল বাড়ির একটা গেস্ট রুম আঁখির জন্য রেডি করা হয়েছে।কক্ষ টা বেশ ভালোই লাগল আঁখির,সাথে করে এক্সট্রা কাপড় তো আনে নি তাই ইশিকা নিজের একটা নতুন থ্রিপিস পরতে দিলো তাকে,ইশানার সদ্য বাচ্চা হয়েছে শরীর আগে থেকে একটু বেড়েছে তাই আঁখির গায়ে কাপড়টা অনেকটা ঢিলে পরেছে কিন্তু খারাপ লাগছে না তাকে,তাছাড়া আঁখি ঢিলে কাপড়ে বেশ সাচ্ছন্দ্য বোধ করে।বাইরে বৃষ্টি নেমেছে প্রচুর,আবহাওয়া বেশ শীতল,কেমন জানি মনে ভালোবাসা ভালোলাগার এক আচমকা অনুভুতির সৃষ্টি করে উক্ত এই আবহাওয়া,ভেসে আসা মৃদু হাওয়া শরীরে যেমন শীতলতার অনুভুতি দেয় তেমনই মনে এনে দেয় এক আলাদা তৃপ্তি, আজ হঠাৎ করেই আবার মনে পরছে বিশ্বাসঘাতক সেই প্রেমিক পুরুষের কথা,না জানি এমন কতো সুন্দর ক্ষণ কাটিয়েছে আঁখি তার সনে,চাইলেই কি ভালোবাসার সে মুহুর্তগুলো নিমিষেই ভোলা যায়!বারান্দার বেশ পাশ ঘেষে দাঁড়ানোতে বৃষ্টি এসে আছড়ে পরছে আঁখির গায়ে,তবুও পিছু হটছে না সে,ইচ্ছে করেই যেন বৃষ্টিকে উসকানি দিয়ে যাচ্ছে আঁখি তাকে ভিজিয়ে তোলার জন্য।

″এই যে বাচ্চামো এখনও গেলো না?ভিজছ কেনো এতো রাতে?″

″আমার ইচ্ছে করছে তাই,আপনি কেন এসেছেন এতো রাতে এখানে?জ্বর শরীরেও বাহাদুরি যায় না তাই না?″

″আমি বাহাদুরি করলাম কোথায়?″

″দূর্বল শরীর নিয়ে মাঝরাতে ঘরে ঘুরে বেড়ানো বাহাদুরি নয়ত কি?″

″হয়েছে, বাহাদুরি করব আমি,তোমার সাথে এমনটা না করলে হবে না।চুপচাপ এসো ওখান থেকে,আবহাওয়া ভালো না জ্বর আসবে। ″

″আসলে আসুক,ভিজব আমি,যান আপনি গিয়ে ঘুমোন,তাছাড়া আপনার মতো ঠুসঠাস করে জ্বর আমার আসে না।″

″তবে আসবে না তুমি?″

″না।″

″এতো জেদি কেনো তুমি বলোতো?″

″জেদ আমার র*ক্তে মেশা তাই।″

″আসবে না?″

″না।″

″ওকে আমি আসছি।″

এবার আদৃত গিয়ে আঁখিকে টেনে নিয়ে এলো কক্ষের ভিতর তারপর বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিল।

″এটা কি করলেন আপনি?″

″দরজা লাগিয়েছি দেখো নি?″

″আপনার ঘরে এসেছি বলে ক্ষমতা খাটাচ্ছেন?″

″ওটাই মনে করো।″

″আপনি কখনও বদলাবেন না,নিরামিষ তো নিরামিষই থাকে।কই এমন আবহাওয়ায় লোক একসাথে বসে বৃষ্টি উপভোগ করার ফাঁকে গল্পগুজব করে আর ইনি দরজা লাগিয়ে ঘুমোয়।″

″হ্যাঁ আমি নিরামিষ, তবে নিরামিষ হলেও তোমার সাথে থেকে কিছু জিনিস তো আয়ত্ত আমিও করেছি,হয়ত তোমার থেকেও বেশি কিছু জানি।″

″যেমন?″

″আমি আবার মুখে বলতে মজা পাই না,করে দেখাই।″

″আচ্ছা,তবে তাই।″

″হম,চলো।″

″কোথায়?″

″গেলে বুঝবে।আমার পিছন আসো।″

আঁখি আদৃতের পিছন গেল, ঘরের ভিতরের পিছন দিকটায় বড় একটা খোলা জায়গা,যাতে বেশ বড় একটা জানালা দরজার ন্যায়,বারান্দার মতো বাইরের দিক তার,তবে ভিতরের দিকে কাঁচের দরজা সামনে পর্দা লাগানো,সেখানে বসার জন্য অনেক বড় করে জায়গা বানানো যেখানটায় বসে বাগানের দিকটা সম্পূর্ণ চোখ ভরে দেখা যায়,জায়গাটা আঁখির বরাবরেরই প্রিয় ছিল,যখনই আসত এখানেই বসে থাকত সারাদিন,আদৃতের সাথে আড্ডার আবদার করত এখানটায়,এবার ছোটে এসেই জানালার পাশ লেগে বসল আঁখি,আদৃতও তার পাশে এসে বসল।

″দেখলে এখন বৃষ্টিও উপভোগ করতে পারবে আর ভিজবেও না।″

″হুম,তবে এতে আপনার কোনো ক্রেডিট নেই,জায়গাটা আগে থেকে বানানো।″

″আইডিয়া তো আমি দিলাম।″

″হুম তা মানা যায়,কারণ আপনার ওই নিরামিষ মাইন্ডে এতো সুন্দর আইডিয়া আগে কখনও আসত না,আগে তো একটু সময় আমার সাথে বসে কথা বলার জন্য বললে মনে হতো আপনার কাছ থেকে আপনার প্রাণ চাওয়া হয়ে গেছে,যাক এখন তো নিজে থেকে এক আধটু কথা বলার সুযোগ বানিয়ে নেন।″

″ভুল তো মানুষ সারাজীবন করে যায় না,এক সময় তা শোধরায়ই।″

″যাক অবশেষে যখন ভুল ধরতে পেরেছেন তবে তার সাজাটাও নইলে দেই।″

″কি সাজা দিবে?″

″বেশি কিছু না,ঘুমে ডলুডলু হয়ে পরার আগ অব্দি আমার সাথে এখানে বসে গল্প করতে হবে,যদি আপনার অসুস্থ শরীর মানে তবে।″

″আরে না,জ্বর একটু সকালে ছিল,এখন একদম নেই,ভালোই লাগবে তোমার সাথে আড্ডা দিতে।″

″যাক নিরামিষতা কাটল তবে।″

″তা আড্ডাতে কি আমাকে রাখা যাবে?″

রিংকির সেখানে হঠাৎ আগমণে অল্পতে হাসিমুখটা মলিন হলো আদৃতের,আঁখির সাথে অনেক দিন পর এমন একা সময় পার করার সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া হয়ে গেল তার।আঁখি হেসে জবাব দিলো।

″আরে কেন নয়?এসো রিংকি।দুই থেকে তো তিন ভালোই।″

রিংকি এসে আদৃতের বেশ পাশ হয়ে বসল,আঁখির কেমন জানি ভালো লাগল না বিষয়টা তবুও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল,তবে আদৃত অনেকটা সরে গেল সাথে সাথে।

″তা আঁখি,তোমার কথা অনেক শুনেছি আদৃতের কাছে,তাছাড়া এখন ইশিকার কাছ থেকেও শুনে এলাম,ভালোই নাম করে ফেলেছ তুমি কম দিনে।″

″ধন্যবাদ।তা তোমার আর ডা.আদৃতের পরিচয় কেমনে?″

″আমেরিকাতে দু’জন একই হাসপাতালে ছিলাম,একসাথেই কাজ করতাম দু’জন,ওখানে তো আমাদের বেশ নাম ছিল,শুধু ডাক্তারি যোগ্যতার জন্য না,একসাথে আমরা এতো থাকতাম যে অনেকেই আমাদের গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড মনে করত,আসলে আদৃত চাইলে হয়ত এতদিনে বিয়েও করে নিতাম আমরা।হা হা হা″

″অহ।″
রিংকির কথায় কেন জানি অনেকটা খারাপ লাগল আঁখির,কেমন যেন ঠিক তেমনটাই অনুভব হলো যেমনটা ঠিক ছয় বছর আগে আদৃতের পাশে কোনো মেয়েকে দেখলে হতো,পার্থক্য শুধু এটাই তখন আঁখি এতে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া করত,সবার সামনেই আদৃতের উপর অধিকার ফেলাত,তাকে নিজের বলে দাবী করত বর্তমানে যার এক অংশও করার মানসিকতা আঁখির নেই,তাই পানসে মুখে অল্প জবাবটা দিলো,এদিকে আদৃতের মনে ভয় জন্মাল।

″এ রিংকি বাড়িয়ে কেন বলছে এসব?আঁখি না আবার আমায় ভুল বুঝে যায়।″

″আরে তেমন কিছু না আঁখি,ওর তো বাড়িয়ে বলার স্বভাব সবসময়ের,ও শুধুই আমার ভালো বন্ধু এর থেকে বেশি কিছু না। ″

″হয়েছে আর ঢাকতে হবে না,তোমার কি মনে হয় আঁখি, এতো হ*ট মেয়ের সাথে কেউ এতবছর ধরে জাস্ট ফ্রেন্ড সম্পর্কে থাকে?তা তুমি বলো তোমার খবর,শুনেছি বিয়ে করেছিলে ডিভোর্সও হয়ে গেছে।এখন ফিউচার প্লান কি?দ্বিতীয় বিয়ে করবে না কি?″

সবগুলো কথাই যেনো আঁখির মনে দাঁগ কেটে গেল,সোজাসাপটা জবাবে বলল আঁখি।

″এমনটা তো জরুরি নয় জীবনে একজন চলে গেছে বলে আরেকজনকে নিয়ে আসতেই হবে।জীবন একাও কাটানো যায়।″

″হুম তা যায়,কিন্তু আদৃতের মতো সুদর্শন পুরুষ সামনে থাকলে কিন্তু নিজেকে ঠিক রাখা অসম্ভব, তুমি আবার ওর দিকে নজর দিয়ে বসো না।হা হা হা।″

″এসব কি বলছ তুমি রিংকি?″

″আরে আদৃত তুমি রাগছ কেনো?আই এম জাস্ট কিডিং।তোমার কি আমার কথায় খারাপ লেগেছে আঁখি?মজাই তো করছিলাম।″

″না না খারাপ লাগবে কেন?মোটেও খারাপ লাগে নি,তা আপনারা গল্প করুন আমি চলি,ঘুম পাচ্ছে। ″

″আঁখি কথা শুনো আমার।″

আঁখি আদৃতের পিছু ডাকে কান না দিয়েই চলে যায়,
আদৃত এবার বেশ রেগে বলে।

″তুমি আমার রাগ সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানো রিংকি,তুমি আজ আমার বাড়ির মেহমান না হলে আঁখির সাথে এমন ব্যবহার করার পরিনাম কি হতে পারে দেখিয়ে দিতাম,আমার আঁখির চেহারায় মলিনতা আমার সহ্য হয় না,সামনে থেকে এমন কিছু করার আগে ভেবে নিও।″

আদৃত বেগতিক পায়ে গেল এবার আঁখির পিছন।

রিংকি পায়ের উপর পা তুলে জায়গায় বসেই মুচকি হাসল।

আঁখি কক্ষে ঢোকার আগেই আদৃত এসে তার হাত পাকড়াও করল।

″আঁখি,শুনো আমার কথা,ওই রিংকির কথায় মন খারাপ করো না,ও আসলে গায়ে পরা একটা মেয়ে,তাছাড়া কাকে কি বলতে হয় সে জ্ঞান ওর নেই।″

″ঠিক আছে ডা.আদৃত,আমি ওর কথায় মন খারাপ করি নি,আমি ঠিক আছি।রাত অনেক হয়েছে গিয়ে ঘুমিয়ে পরুন,জ্বর তো দেখি এখনও আছে,যান গিয়ে ঘুমান।″

আদৃতের কপালে হাত দিয়ে বলল আঁখি কথাটা স্বাভাবিক ভাবে, নিরাশ হলো আদৃত এতে।

″তুমি না বললে সারারাত আজকে গল্প করবে?″

″আরে কি যে বলেন,আমি তো মজা করি জানেনই,কাল হাসপাতাল আছে তাছাড়া আপনি অসুস্থ সারারাত এভাবে বিনাশ করলে হবে?যান গিয়ে ঘুমিয়ে পরুন।″

অতএব আর কথা না বাড়িয়ে কক্ষে ঢুকে দরজা লাগিয়ে নিল আঁখি,আদৃত ভালোয় বুঝতে পারল আঁখি ভালো নেই,আফসোস হলো তার একসময় যে মেয়ে অনুভূতি নামক জিনিস লুকোয় কিভাবে তা জানত না,অল্পতে কান্না করে ঘর ভাসাত আজ সে হাসির নিচে লুকিয়ে রাখে পাহাড় সমান যন্ত্রণা।

আদ্রিশ হঠাৎ তার বুকে কারো নরম হাতের ছোঁয়া পেল,চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দেখল রিদিকা,অন্যদিন যার এমন স্পর্শে শরীরে মুহুর্তেই আলাদা শিহরণ তৈরি হতো আজ তেমনটা আর হচ্ছে না আদ্রিশের,মন আজ খুব করে আবারও আঁখিকে চাইছে।যা চাইলেও সম্ভব না আজ,ব্যর্থতা আর অসক্ষমতা আদ্রিশের সব সুখ যেন নিমিষেই কেড়ে নিল,বর্তমানে চাইলেও আর কোনো সুখের দোলায় দোলতে মন মানাতে পারবে না সে,তাই রিদিকার হাত সরিয়ে একপাশ হয়ে শুয়ে পরল,রিদিকা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

″কি হয়েছে,এমন করছ কেনো?″

″কিছু না ভালো লাগছে না,ঘুমোয়।পারলে লাইটটা অফ করে দাও।″

আদ্রিশের এমন ব্যবহার অল্পতে রিদিকার মন ব্যথায় ভরে তুলল,তবে আদ্রিশকে বলল না আর কিছু,ঘরের বাতি উঠে বন্ধ করেই আদৃতের বিপরীতে শুয়ে পরল,মনের যন্ত্রনায় মত্ত হয়ে বারান্দার দরজা আজও লাগাতে ভুলে গেল।

রাত তিনটে,আশপাশ জনশূন্য, আদ্রিশের বাড়ির বাইরের রাস্তা থেকে রুমের বারান্দার দরজা খোলা দেখা গেলে হুডিওয়ালা অজ্ঞাত জন এগিয়ে গেল সেদিকটায়,বাড়ির সামনে দারোয়ান, তাই পিছনের দিকের দেয়াল টপকে বাড়িতে প্রবেশ করে গেল সে,বারান্দার দিকে রাখা সিঁড়ি বেয়ে ভিতরে ঢুকে পরল অজ্ঞাত সে জন।আস্তে পায়ে কক্ষে ঢুকে একে একে রিদিকা আদ্রিশ দু’জনেরই মুখের সামনে কিছু স্প্রে করে,দু’জন কিছু না বোঝেই ঘুমের ঘরে অজ্ঞান হয়,অজ্ঞাত জন এবার নির্দ্বিধায় কক্ষে বিচরণ করতে শুরু করে,ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা রিদিকার নতুন করে আনা পন্যগুলো একবার করে দেখে নেয়,কিন্তু ওগুলোতে কিছুই না করে এবার পকেট থেকে একটা ইনজেকশন বের করে রিদিকার হাতের মাধ্যমে তার শরীরে দিয়ে দেয়।তারপর বলে উঠে।

″প্রমত্ত অঙ্গনা সাজা তোদেরও দিবে কিন্তু অন্যদের মতো সহজ মৃত্যু তোরা পাবি না,মিস্টার এন্ড মিসেস রাহমান।প্রমত্ত অঙ্গনা অপরাধীদের ছাড় দেওয়া মোটেও পছন্দ করে না।″

অতঃপর যেভাবে সে এসেছিল সেভাবেই চলে গেল।

পরদিন সকালে…

যশোর এসেই খোঁজ করতে লেগে গিয়েছিল জিসান,ইতিমধ্যে অনেক নতুন সন্ধান পেয়ে গেল সে।চারবছর আগে যশোর জেলায় নকল প্রমত্ত অঙ্গনা দ্বারা যে দু’টি খুন হয়েছিল বলে জিসান মনে করে তাদের সম্পর্কে বড় তথ্য পেল সে।তখন কেসটা তার থানার আন্ডারে না থাকায় তেমন মাথা ঘামায় নি বলে হয়ত এসব খবর ছোটে গিয়েছিল তার কাছ থেকে।এবার ভালোয় খোঁজ নিলে জানতে পারল সে দু’টি খুন যাদের করা হয়েছিল তারা দু’জন স্বামী স্ত্রী ছিল।প্রথম যে পুরুষের খুন হয়েছিল তার আসল ঠিকানা বের করলে জানা গেল সে যশোরের এক জায়গায় ভাড়া থাকত তার স্ত্রী তাহমিনাকে নিয়ে,প্রথম প্রথম আমিরুল আশপাশ এবং কর্মস্থানের লোকের সাথে ভালো ব্যবহার করলেও ধীরে ধীরে না কি সে সবার থেকে কেমন দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করল,কারো সাথে তেমন কথাও বলত না,কখনও কোনো বন্ধু বান্ধবকে বাসায় নিয়ে নাস্তাও করাতে চাইত না কেউ নিজে থেকে যেতে চাইলেও,তার স্ত্রীকেও আশপাশের কেউ তেমন দেখে নি ঘর থেকে বের হতে,হঠাৎ একদিন আরেকটা মেয়ে এসে তাকে স্বামী বলে দাবী করে,সেদিন সে বাড়িতে না কি তুলুম ঝগড়া হয়,চারপাশের মানুষ মুহুর্তেই একত্রিত হয়,আমিরুলের প্রথম স্ত্রী নিলিমা ছিল সে যে তার দ্বিতীয় স্ত্রী তাহমিনাকে অনেক মারধর করে,তবে তাহমিনা এতে কিছুই বলল না আর না তো তার কোনো প্রতিবাদ করতে চাইল,বরং পুরো ঘটনায় স্বাভাবিক থাকল যা আশপাশের লোকের কাছে অনেক অস্বাভাবিক বলে মনে হলো,আমিরুলও নিলিমাকে সেদিন অনেক মারধর করল,এসবের এক পর্যায়ে সেখানে পুলিশ এসে তিনজনকেই আটক করে ধরে নিয়ে গেল।সুযোগ সুবিধা করে আমিরুল তাহমিনাকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসতে সক্ষম হলেও নিলিমা তার উপর কেস করে বসল।কেস চলাকালীন এক দিন হঠাৎ আমিরুলকে তার ঘরেই মৃ*ত অবস্থায় পাওয়া গেল,কিন্তু তাহমিনাকে কোথাও পাওয়া গেল না ,এর কিছুদিন পর নিলিমাকেও খু*ন করা হলো,কিন্তু তাহমিনা কে আর কোথায় গেছে কেউ বলতে পারে না।তারা সেখানকার স্থায়ী কোনো বাসিন্দা ছিল না এমনকি তাহমিনাকে তেমন কেউ দেখেও নি তাই তার বা তাদের বিষয়ে কিছু বলা সবার জন্যই দূরুহ ছিল।জিসান এবার গভীর চিন্তায় ডুব দিল।তার ভাবনামতে হোক না হোক এই তাহমিনাই এসব খুনের সাথে জড়িত যদি সে এখনও বেঁচে থাকে।এখন জিসানকে খোঁজে বের করতে হবে তাহমিনাকে।

চলবে…

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(২৮)

আঁখির মন বড্ড খারাপ আজ,চাইলেও রিংকির রাতে বলা কথাগুলো ভুলতে পারছে না সে,এমনিতে কারো বলা কোনো কথা কখনও মনে নিয়ে বসে থাকে না,হাসিখুশি থাকাই আঁখির স্বভাব,কিন্তু আজ যেন চাইলেও খুশি থাকতে পারছে না,মন টা কেমন জানি ভার হয়ে আছে,কি করবে আঁখি ডিভোর্সিদের হয়ত সবাই এমন নিচু চোখেই দেখে,মন ভালো করার জন্য ইশিকার সদ্য জন্ম নেওয়া মেয়েটাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে এসে খেলা করছিল আঁখি,এমনিতে বাচ্চাদের সে খুব পছন্দ করে,ঠিক তখন কক্ষে নক করল আদৃত।

″আসতে পারি?″

″হুম আসুন ডা.সাহেব।″

″কি করছ?″

″এইত নিশিকে নিয়ে খেলা করছি।″

″শুধু খেলা করবেই?হাসপাতালও তো যেতে হবে আর তার আগে নাস্তা করতে হবে,চলো।″

″আপনার জ্বর নেমেছে?″

″হ্যাঁ,একদম সুস্থ আমি বর্তমানে, আজকে হাসপাতালও যাব।চলো নাস্তা করবে।″

″না আমি নাস্তা করব না,খিদে নেই।″

″নেই বললে চলে?চলো চুপচাপ। ″

″খাবো না ডা.আদৃত, প্লিজ আপনি গিয়ে খেয়ে নিন।″

″তুমি না খেলে আমিও খাচ্ছি না।″

″এ কেমন জেদ?″

″তেমন জেদ যেমন তুমি করছ।″

″আপনি একটু বেশি করছেন।″

″তুমি কোথায় কম করছ?″

″কথায় কথায় ঝগড়া না বাঁধালে হয় না আপনার?″

″ঝগরাটের সাথে ঝগড়া করব না তো কি করব?″

″কি আমি ঝগড়াটে?″

″আমি তো সেটা বলি নি,তবে তুমি মেনে নিলে আমার কি করার আছে?″

″আপনি কি মনে করেন আপনি আমায় কথায় ফাঁসাতে পেরো যাবেন?″

″চেষ্টা তো করতেই পারি।″

তখনই নিশি কেঁদে উঠল চিৎকার করে।

″দেখলেন তো আপনার বাজে ফাজলামো নিশিরও পছন্দ হয় নি,দিলেন তো কাঁদিয়ে বাচ্চাটাকে।না না কাঁদে না ময়না।″

″ও কাঁদছে কারণ ওর তোমার কথা পছন্দ হয় নি।″

″আপনার মতো পঁচা নিরামিষ কথা বলি না আমি।″

″হয়েছে তোরা থাম এবার,এতো বড় হয়েও দু’জন বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করা বাদ দিলি না।আঁখি চল আদৃতকে নিয়ে নাস্তা করবি নিশিকে আমার কাছে দে।″

″না মামুনি খিদে নেই।″

″আবার কথাটা বললে নাস্তার জায়গায় থাপ্পড় খাইয়ে তোর পেট ভরাব।″

″তুমি আমায় এমনটা বলতে পারলে মামুনি?″

আহ্লাদী করে ঠোঁট উল্টে বলল আঁখি।

″যাবি এবার খেতে না দিব সত্যি একটা কানের নিচে বসিয়ে।″

″দিয়ে দাও মা,তাও যদি একটু বুজদার হয়।″

″হুহ,কি এসেছেন আমার বোজদার সাহেব।″

আঁখি আদৃতকে ভেংচি কেটে চলে গেল পাশ কাটিয়ে, আদৃতও মুচকি হেসে তার পিছু গেল,শায়েলা মির্জা দু’জনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বললেন।

আল্লাহ আমাকে তৌফিক দাও যাতে এ দু’জনকে আমি এক পবিত্র বন্ধনে বেঁধে দিতে সক্ষম হই।যে বন্ধন থাকবে জীবনভর,কখনও ছিঁড়ে যাবে না,দু’জন একে ওপরে খুঁজে পাবে নিজেদের প্রকৃত সুখ।রহম করুন রাব্বুল আল-আমিন।

আজ হঠাৎ করেই লক্ষ্য করল রিদিকা তার গায়ের চামড়া খসখসে হয়ে যাচ্ছে, একটা টান টান ভাব সারা শরীর জোরে,মনের ভয় আরও প্রখড় হলো তার।হঠাৎ হাতে অল্প ব্যথা অনুভব করলে হাতে সুচের ছিদ্র লক্ষ্য করল সে।হতবাক হলো মুহুর্তেই।

″আমি তো কোনো ইনজেকশন দেই নি তবে হাতে সুচের দাঁগ এলো কোথা থেকে!তাছাড়া ব্যথাও আছে,এদিকে চামড়াও কেমন খসখসে হয়ে আছে।না দেরি করলে হবে না দেখছি,আজ একবার সময় করে ডাক্তারে যেতে হবে,এভাবে বসে থাকলে তো আর হয় না।তবে ব্যপারটা আদ্রিশকে জানানো উচিৎ হবে না।″

আদ্রিশের কিছুই ভালো লাগছে না,জীবনটা কেমন বিষাদময় হয়ে গেছে,মন শুধু আঁখিকেই খোঁজে বেড়াচ্ছে,আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছিল তখন রিদিকা এসে তাকে বোতাম লাগাতে সাহায্য করতে শুরু করলে তাতে বাঁধা দিলো আদ্রিশ।রিদিকার প্রতি কোনো টানই যেন বর্তমানে অনুভব করছে না আর সে।

″কি হয়েছে আদ্রিশ?″

″কিছু না ভালো লাগছে না কিছু।আমি চলি।″

″কখন ফিরবে?″

″আজ কখন আসব জানি না,আসতে দেরি হবে।″

″দিনে ফিরবে না তো?″

″না,কেন?″

″না এমনিই।″
আমতা করে জবাব দিলো রিদিকা।আদ্রিশ আর সে নিয়ে এতো মাথা না ঘামিয়ে বরং চলে গেল।

″মামুনি আমি হাসপাতাল থেকে বাড়ি চলে যাব।″

″কি বললি তুই?আবার বল তো?″

″না মানে একদিন তো থেকেছি।″

″তো কোন বড় তী*র মে*রে*ছি*স?এখানে তুই মাস দেড় এক থেকে যাবি,তার মধ্য দিয়ে তোকে পার্মানেন্ট করে রাখার ব্যবস্থা করে নিব আমি।″
শেষের কথা মিনমিনিয়ে বললেন শায়েলা মির্জা।

″কি বললে মামুনি?″

″না বললাম যে তুই এখন যাবি না।″

″কিন্তু মাস দেড় এক তো বেশি হয়ে যায়।″

″তো কি হলো?বুঝেছি আমি তো তোর নিজের মা না তাই এমন করছিস, নিজের মা হলে তো এমন কখনও করতি না″

″তুমি কিন্তু আমায় ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করছ মামুনি।″

″হ্যাঁ,আমার অনুভূতি তো নাটক মনে হবে তোর কাছে,যা চলে যা আমার আর কাউকে প্রয়োজন নেই।″

″কি বলছেন মামুনি এসব?আচ্ছা ঠিক আছে দেড় দুই মাস না থাকলেও কিছুদিন থেকে যাব,এবার খুশি?″

″এই তো আমার লক্ষি মেয়ে।″

অনেক সন্ধানের পর জিসান পেল আমিরুল এর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর খোঁজ,আমিরুলকে প্রায় সময়ই তার সাথে দেখা যেত অনেকের মুখ থেকে খবরটা জানতে পারল জিসান,এবার বের করল তার বাড়ির ঠিকানা,কিন্তু তার বাড়িতে গিয়ে যা শুনল তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সে।লোকটির নাম মিশু,ঘরে তার স্ত্রী আর দু’টা সন্তান আছে,মিশু আর আমিরুল সম্পর্কে মিশুর স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে মহিলাটি জানাল।

″স্যার,আমার স্বামী মিশু হাসান একটা ছোটো কোম্পানিতে কাজ করতেন,উনার সাথে কাজ করত আমিরুলও,ওখান থেকেই দু’জনের পরিচয়,কম দিনেই দু’জনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত হয়,আমিরুল প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসত,তবে তার স্ত্রী তাহমিনাকে কখনও আনা হয় নি,দাওয়াত দিলেও সে আসতে চায় নি কখনও,উল্টো আমিরুল বলত তাহমিনার না কি আমিরুল এর অন্যদের সাথে মেলামেশা তেমন পছন্দ ছিল না,আর আমিরুল তাকে খুব ভালোবাসে,তাকে হারাতে চায় না,আমিরুলের আগের স্ত্রী ছিল,ঢাকাতে নিজস্ব বাড়ি আছে আমিরুল এর,নিলিমার দূর সম্পর্কের বোন ছিল না কি তাহমিনা,আমিরুল এর তাহমিনাকে হঠাৎ ভালো লেগে যায় কিন্তু সে চাইলেও নিলিমাকে ছাড়তে পারত না,কারণ আমিরুল এর মা বাবা নিলিমাকে খুব ভালোবাসতেন,ওকে ছাড়তে গেলে হয়ত ঘর সম্পত্তি সবকিছু ছাড়তে হতো তাকে,তাই আমিরুল কাজের কথা বলে তাহমিনাকে বিয়ে করে এসে যশোরে থাকত।এতটুকুই জানতাম আমরা তার বিষয়ে।হঠাৎ একদিন আমার স্বামী কারো হাতে খুন হন,তার লাশের পাশে প্রমত্ত অঙ্গনা নামটা পাওয়া যায়।স্থানীয় পুলিশ এ নিয়ে খোঁজ করলেও আজ অব্দি কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি।তার কিছুদিন পরে আমিরুল এর ও একইভাবে মৃত্যু ঘটে প্রমত্ত অঙ্গনা দ্বারা।

কথাগুলো শুনে জিসান জায়গায় স্থির হয়ে যেন থাকতে পারছে না,রহস্য খুলতে এসে রহস্যের মারপ্যাঁচে তলিয়ে যাচ্ছে জিসান,খু*নির সন্ধান করতে গিয়ে খুনের সংখ্যা অজস্র বেড়িয়ে আসবে আগে তো এমন ভাবনা ভাবার কথাই ছিল না।এবার আবার জিজ্ঞেস করল জিসান তাকে।

″আচ্ছ আমিরুল ঢাকায় কোথায় থাকত সেটা কি আপনি জানেন?″

″না স্যার,আমিরুল তার আর তাহমিনার ব্যপারে তেমন কিছু বলতে চাইত না,কেমন জানি রহস্যের নিচে চাঁপা রাখত সব,মিশু বলতেন আমিরুল তার ব্যপারে কিছুই বলে না,যা সব জেনেছিলেন তা না কি আমিরুল কখনও কখনও মুখ ফসকে বলে ফেলত উনাকে।″

″তাহমিনার কোনো ছবি হবে?বা তাকে কখনও দেখেছ?″

″না স্যার।″

″হুম, আসি তাহলে।″

জিসান আবার নিরাশ হয়ে ফিরে এলো,তাকে এবার আমিরুল এর আসল বাড়ির ঠিকানা পেতে হবে,ওখানে গেলে হয়ত কোনো সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।

রিদিকা বসে আছে ডাক্তারের চেম্বারে,আদ্রিশ বেড়িয়ে যেতেই রিদিকা বেড়িয়ে এসেছিল।ডাক্তার আবারও তাকে চেক আপ করলেন,সে তার হাতের ব্যপারে বলল উনাকে,এবার ডাক্তার বললেন।

″মিসেস রিদিকা রাহমান আপনার শরীরে যে ভাইরাসটা পাওয়া গেছে তা নিয়ে আমি অনেক রিসার্চ করেছি,অতঃপর এ বিষয়ে অনেক কিছুই জানতে পারলাম আমি।ভাইরাসটা মানুষের শরীরে বা অন্য কোথাও কখনও নিজে থেকে জন্ম নেওয়ার কোনো যোগ্যতা রাখে না,এটা সম্পূর্ণ মনুষ্য সৃষ্টি,এটা কোনো মাধ্যম খোঁজে কারো শরীরে পৌঁছানোর জন্য,আর শরীরে ঢুকে শরীরের কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দেয়,যাতে অল্প বসয়ে বার্ধক্যের ভাব চলে আসবে,ধীরে ধীরে শরীর অচল হয়ে পরবে।এটার অংশ অনুযায়ী,এর মোট তিন অংশ,পূর্ণাঙ্গ কাজের জন্য এর প্রথম অংশ অল্প আকারে দিতে হবে আর পরের অংশ এর থেকে বেশি আকারে,আর তার পরের অংশ এর থেকে বেশি,এই তিন ডোজই একজনকে জীবন্ত লা*শে পরিণত করতে সক্ষম।″

″এ কি বলছেন ডাক্তার!তারমানে কি আমার শরীরে দুই ডোজ দেওয়া হয়ে গেছে!″

″আপনার কথামতো আপনার শরীরে ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে আপনি তা বুঝতেই পারেন নি এর মানে তো এটাই মনে হয় আপনার শরীরে দুই ডোজ দেওয়া শেষ,তাও টেস্ট করে দেখতে হবে আবার।″

″এর থেকে বাঁচার কি কোনো রাস্তা নেই ডাক্তার?″

″দেখুন আমি ওষুধ লিখে দিতে পারব,কিন্তু কাজ করার কোনো নিশ্চয়তা নেই,যেহেতু ভাইরাস নতুন তাই এতো তাড়াতাড়ি তার পথ্য দেওয়ার সামর্থ্য বর্তমানে কোনো ডাক্তারের থাকবে না,তবে হ্যাঁ যে এটা বানিয়েছে তার কাছে এর প্রতিষেধক নিশ্চয়ই থাকবে।ভাইরাসটা যেই বানিয়েছে সে নির্ঘাত কোনো বিজ্ঞ ও দক্ষ একজন যে বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান রাখে।যেহেতু আপনার সাথে সে এমন করছে তবে তো নিশ্চিত তার আপনার সাথে ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা,আপনি তাকে সনাক্ত করুন, তারপর তার সাথে সবকিছু মিটিয়ে নিন এতেই প্রাণরক্ষা পাবেন আপনি।″

আঁখি আজ আদৃতের গাড়িতে হাসপাতাল যাচ্ছে, আদৃত আঁখির ড্রাইবারকে আঁখির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে আর বায়না ধরেছে আঁখি তাদের বাড়িতে যতদিন থাকবে আদৃতের গাড়িতেই যেখানে যাওয়ার যাবে,আজকে ড্রাইবার আনে নি আদৃত,অনেক দিন পর আঁখির সাথে একা সময় পার করার সুযোগ কি সে এমনি যেতে দিবে!বর্তমানে ড্রাইব করছে আদৃত,আঁখি চুপচাপ গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।আদৃত মনে মনে বলে চলেছে।

″আফসোস হয় আঁখি,একদিন যে আঁখি সারাদিন কথা বলে আমাকে বিরক্ত করত,গাড়িতে আমার সাথে একা ভ্রমণ করার জন্য না জানি কি কি করত,একবার আমাকে একা পেলে জীবনের সব গল্প অল্প মুহুর্তে বলে দেওয়ার প্রচেষ্ঠায় থাকত সেই আঁখি আজ এতো চুপচাপ, সবকিছুই ওই ফালতু আদ্রিশের জন্য হয়েছে,আমি কথা দিলাম আঁখি ছাড়ব না ওই আদ্রিশকে,তোমার সুখ কেঁড়ে নেয় এমন সব লোককেই আমি দূর করে রাখব তোমার থেকে।″

হঠাৎ আঁখি বলে উঠল।

″গাড়ি থামান ডা.আদৃত।″

আঁখির কথায় জায়গা দেখে গাড়ি দাঁড় করাল আদৃত।

″কি হয়েছে আঁখি?″

″শুভ্রতা আপু,বাড়ির বাজার করছে দেখি।উনি তো কখনও বাজার করতে আসে না,বাড়ির কর্মচারী গুলো বাজার করে।দাঁড়ান আমি কথা বলে আসি।″

আঁখি নেমে গেলে আদৃতও তার পিছন নেমে যায়,আঁখি গিয়েই শুভ্রতার হাত পাকড়াও করে,হঠাৎ আঁখিকে এভাবে দেখে হকচকিয়ে উঠে শুভ্রতা।

″আপু তুমি এখানে কি করছ?তুমি সবজি কিনতে এলে কেন?ঘরের কর্মচারী গুলো কই?″

″ওই আসলে আঁখি দু’জনই কাজ ছেড়ে দিয়েছে,নতুন কাজের লোক তো আর তাড়াতাড়ি করে পাওয়া যায় না,আর আদিল একটা কাজে গেছে ওই যে ব্যবসা খুলছে তোমার কথায় ওটারই কাজ,তাই আমি চলে আসলাম।″

″হুম,আমি নতুন কাজের লোকের ব্যবস্থা করে দিব,ভাইয়াকে বলো ব্যপারটা আদ্রিশকে না জানাতে।″

″না তোমাকে কষ্ট করতে হবে না আঁখি,কাজের লোক আর লাগবে না,লাগলে আদ্রিশ দেখবে,আমি বরং আসি কাজ আছে।″

শুভ্রতা চলে যেতে নিলে তার হাতে বেশ গাঢ় হয়ে ফুলে ওঠা খামচির দাঁগ দেখতে পেল।

″এ কি হয়েছে তোমার হাতে আপু?কে করল এসব?″

″আরে কিছু না,রিহান দুষ্টুমি করে করেছে এসব,চলি এবার।″

অতঃপর চুরের মতো পালিয়ে গেল শুভ্রতা,আঁখি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে,আঁচড়টা রিহানের দেওয়া বলে মোটেও মনে হলো না আঁখির,বরং মনে সৃষ্টি হলো অন্য এক সন্দেহের।

আঁখি আবারও চুপচাপ গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে দেখছে আর আদৃত ড্রাইব করছে,এবার নিরবতা ভেঙে বলল আদৃত।

″আঁখি,আমি জানি তুমি রিংকির ব্যপার নিয়ে আপসেট,আসলে ও সহ্যের বাহিরের একটা ব্যক্তিত্ব,ওর কথা আমি কখনও কানে নেই না,কিন্তু ও তোমাকে এভাবে কথা বলবে বলে ভাবি নি,তুমি মন খারাপ করো না,ওকে আমেরিকা পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি আমি।″

″আমেরিকা কেন পাঠাবেন?বিয়ে করে নিন ওকে,দেখতে তো সুন্দরী, তাছাড়াও এডাল্ট,আপনাকে পছন্দও করে তবে ক্ষতি কিসে?আর কতকাল একা থাকবেন?কারো জন্য তো জীবন আটঁকে থাকে না,ডা.সানিয়ার সাথে কি হয়েছিল আপনার তা আমি জানি না তবে আপনার জীবনকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া উচিৎ বলে আমার মনে হয়।

আদৃতকে জীবনে অন্য কারো সাথে এগিয়ে যেতে বলতে বুকে বড্ড পীড়া অনুভব করছিল আঁখি তবুও তাতে মন দিলো না,নতুন কোনো মনের অনুভুতির ডাকে সারা দিতে চায় না সে,একদিন যে আদৃতকে খুব করে চেয়েছিল তাই হয়ত আজও তাকে অন্য কারো সাথে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলতে খারাপ লাগছে।এদিকে বাকরুদ্ধ হলো আদৃত, প্রথমত বুক ফেঁটে যাচ্ছে এটা ভেবে যে আঁখি কখনও তার মুখে কোনো মেয়ের নাম শুনতে রাজি ছিল না সেই আঁখি আজকে তাকে অন্যের সাথে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছে আর দ্বিতীয়ত আঁখির ডা.সানিয়াকে নিয়ে বলা কথাটা পেরেশান করে তুলল তাকে।আঁখির এমন কথার মানে বুঝে উঠতে না পেরে এবার প্রশ্ন করে বসল সে।

″ডা.সানিয়ার সাথে আবার কি হবে আমার?ওর সাথে কিছু থাকলে তো কিছু হবে।আমি তোমার কথার মানে বুঝতে পারছি না আঁখি,পরিষ্কার করে বলো।″

চলবে…