প্রাণেশ্বর পর্ব-১৩+১৪

0
144

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৩।

‘বিবিজান, এক গ্লাস শরবত করে নিয়া আসো তো।’

তনুকা কাপড় ভাঁজে ব্যস্ত ছিল, মেহতাবের গলার স্বর পেয়ে সেদিকেই তাকায়। অস্থির দেখায় তাকে। কাপড় রেখে তাই সে এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,

‘কিছু হয়েছে?’

‘না। গরমে অস্থির লাগছে। শরবত নিয়ে এসো।’

তনুকা কথা বাড়াল না। শরবত আনতে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, লতা কাজ করছে। তনুকার উপস্থিতি খেয়াল করেই লতা প্রশ্ন করল,

‘কিছু লাগব, বউমনি?’

‘না না, একটু শরবত বানাতে এসেছি।’

‘আমি বানাই দিমু?’

‘না, আমি পারব।’

শরবত বানাচ্ছে তনুকা। লতা দুপুরের রান্নার সব আয়োজন করছে। সেই সময় রান্নাঘরের চৌকাঠে এসে দন্ডায়মান হন রাহীলা। পান খাওয়া রক্তিম ঠোঁট নাড়িয়ে রষিয়ে রষিয়ে বলেন,

‘খালি স্বামীর সেবা যত্ন করলেই চলবে, একটু তো শাশুড়িদের প্রতিও খেয়াল রাখতে হয়।’

তনুকা ফিরে চাইল। রাহীলার উপস্থিতি ঠিক পছন্দ হলো না তার। তাও অগত্যাই হাসল। বলল,

‘বলুন, কী সেবা করতে হবে?’

‘শরবত বানাচ্ছো না কি?’

‘জি, মেহতাব চেয়েছেন।’

‘এক গ্লাস শরবত বানিয়ে আমার রুমেও পাঠিয়ে দিও। তোমার কাকার মেজাজও ঠিক নেই। আর শোনো, স্বামীকে একটু বুঝিও, বড়োদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেই জ্ঞানও তো তার নেই।’

মুখ বাঁকিয়ে জায়গা ছাড়লেন তিনি। তনুকা বুঝল না কিছু। কাকী ক্ষেপলেন কেন? আর মেহতাব’ই বা কী করেছে? সে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে লতার দিকে চাইল। দেখল, লতাও তার দিকে একই দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তনুকার ভ্রু কুঁচকাল। লতাকে বলল,

‘আমি শরবত বানিয়ে দিচ্ছি, আপনি একটু কষ্ট করে কাকীর রুমে দিয়ে আসবেন।’

লতা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

‘ঠিক আছে।’

শরবত নিয়ে তনুকা নিজ কক্ষে ফিরে এল। বিছানায় মেহতাবকে দেখল, উদম গায়ে শুয়ে আছে। একপলক তাকে দেখেই দৃষ্টি নিমজ্জিত করে বলল,

‘আপনার শরবত।’

চিন্তায় ভগ্ন ঘটিয়ে মেহতাব বলল,

‘রাখো।’

তনুকা সাইড টেবিলে রাখল। বলল,

‘ছোট কাকার সাথে কি আপনার কিছু হয়েছে?’

মেহতাব উঠে বসল। শরবতের গ্লাস হাতে নিতে নিতে বলল,

‘কেন, তোমায় কেউ কিছু বলেছে না কি?’

‘কাকী বললেন।’

‘কী বললেন?’

তনুকা রয়েসয়ে বলল,

‘আপনার নাকি বড়োদের সাথে কথা বলার জ্ঞান নেই।’

শরবতের গ্লাসে চুমুক দিল মেহতাব। ঠান্ডা ঠান্ডা শরবতে অন্তর জুড়াল তার। তনুকার দিকে চেয়ে বলল,

‘এদিকে এসে বসো।’

তনুকা বসল। দূরত্ব রাখল মাঝে কিছু। চোখ তার মাটিতেই নিমজ্জিত। মেহতাব পরপর দুবার শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল,

‘খালি গায়ে আমি আর লজ্জা পাচ্ছো তুমি? ব্যাপারটা কেমন হলো?’

তনুকা ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কে বলল আমি লজ্জা পাচ্ছি?’

‘তবে তাকাচ্ছো না কেন?’

‘এমনি?’

‘আমাকে উদম গায়ে দেখে কি অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে?’

তনুকা ভড়কাল ভীষণ। চটে গিয়ে বলল,

‘পাগল হয়েছেন? কী বলছেন?’

তনুকার বিভ্রান্তিকর অবস্থা দেখে সশব্দে হাসল মেহতাব। বলল,

‘থাক, আর কিছু বলতে হবে না। আমি সব বুঝি।’

‘কিছুই বুঝেন না আপনি। এখন এসব বাদ দিয়ে কাকার সাথে কী হয়েছে সেটা বলুন।’

‘ঐসব আমাদের ব্যক্তিগত ঝামেলা, তুমি বুঝবে না।’

এহেন জবাবে তনুকার মনঃক্ষুন্ন হলো যেন। সে কি তবে মেহতাবের ব্যক্তিগত কেউ না? তার কাছে কি সব বলা যায় না? তনুকা উঠে দাঁড়াল। মেহতাব কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

‘কোথায় যাচ্ছো?’

জবাব না দিয়েই তনুকা পা বাড়াতে চাইল। সঙ্গে সঙ্গেই তার হাত চেপে ধরল মেহতাব। হেয়ালির সুরে বলল,

‘এইটুকুতেই এত অভিমান?’

ফিরে চাইল তনুকা। বলল,

‘আমি মোটেও অভিমান করিনি।’

মেহতাব হাতে টান দিয়ে বসাল তাকে। বলল,

‘সময় হলে সব বলব তোমায়, আপাতত তোমায় কোনো দুশ্চিন্তা দিতে চাই না।’

পুরোটা কথা বলার সময় তনুকার পূর্ণ দৃষ্টি মেহতাবের উন্মুক্ত বক্ষেই ছিল। কিছু একটাতে নজর আটকেছে তার। তাই প্রশ্ন করল,

‘বুকের ঐ কাটা দাগটা কীসের?’

মেহতাব একপলক চাইল সেই কাটা দাগের দিকে। যেটা তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে ঠিক বুকের বামদিকে। সে মৃদু হাসল। বলল,

‘ভালো মানুষের শত্রুর অভাব নেই। হয়তো শত্রুতা মেটাতেই কেউ একজন আঘাত করেছিল।’

তনুকা বিস্মিত হলো। জিজ্ঞেস করল,

‘কে সে? আপনি চেনেন না?’

ফিচেল হাসল মেহতাব। বলল,

‘চিনি তো।’

‘তাকে কোনো শাস্তি দেননি।’

‘সময় হলে অবশ্যই দিব। এখনো সময় হয়নি।’

‘কে সে?’

‘তুমি জেনে কী করবে?’

এমন প্রশ্নে বিরক্ত হলো তনুকা। তার স্বামীর শত্রুকে সে চিনবে না? তার তো চেনা উচিত, জানা উচিত সেই শত্রু সম্পর্কে। তাই বলল,

‘আপনার শত্রু তো আমারও শত্রু। আমার তো জানা উচিত তাই না?’

মেহতাব গম্ভীর সুরে বলল,

‘সময় এলে বলব।’

ভ্রু কুঁচকাল তনুকা। বিরক্তির মাত্রাও তড়ান্নিত হলো। কথা বাড়াতে আর ইচ্ছে হলো না। তাই উঠে চলে গেল গোসলখানায়, গোসল করতে।

মেহতাব শরবত শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। সহসাই হাত রাখল বুকের সেই কাটা দাগে। চোয়াল দৃঢ় হলো সঙ্গে সঙ্গেই। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘আমার বুকের প্রতিটা রক্তের ফোটার দাম তোমাকে দিতেই হবে মতিব মজুমদার। তোমার গায়ের চামড়া বেঁচে আমি সেই দাম মেটাব।’

_______

গোসল সেরে এসে দেখল, মেহতাব কক্ষে নেই। তনুকা শ্বাস ফেলল। মাথার ভেতর প্রশ্নের জট আরো গভীর হলো যেন। মেহতাবের চরিত্র বেজায় রহস্যময়। লোকটাকে ঠিকঠাক ধরা যাচ্ছে না। তাকে ধরতে হলে তীক্ষ্ণ মেধা প্রয়োজন। এত চিন্তাই যতটুকু মেধা ছিল তাও ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে যে। অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

আজ গোসল সেরে তনুকা কামিজ পরেছে। মাথায় ওড়না টেনে গিয়েছে ছাদে। ভেজা কাপড় এখানেই মেলবে। মাথার ওপর তখন কড়া রোদ। বাতাসের কোনো নাম গন্ধও নেই। ছাদ থেকে মহলের পেছন দিকের রাস্তা স্পষ্ট। ঘাট বাঁধানো পুকুরের পাশ ঘেষে গিয়েছে রাস্তাটা। পিচ ঢালা সরু রাস্তা। সেই রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে কথা বলছেন দুজন মানুষ। দূর থেকে তাদের মুখ অস্পষ্ট। তনুকার দৃষ্টি সেদিকেই। তার মধ্যে একজনকে তার পরিচিত মনে হলো। চোখের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ করল তাই। চিনতে সময়ও নিল না খুব। লোকটা ছোট কাকা, মতিব মজুমদার। তবে পাশের জন পরিচিত নয়। তাকিয়ে রইল তনুকা। হঠাৎ দেখল, ঐ দুজনও যেন তাকেই দেখছে। আকস্মিক এমন দৃষ্টিতে খাটিকটা বিব্রত বোধ করল সে। দ্রুত ছাদ থেকে নিচে নেমে গেল। দ্রুত নামতে গিয়েই ধাক্কা গেল কারোর সাথে। খানিকটা ভীত হয়ে চাইল তনুকা। রেনুকে দেখে ভয় কমল। হেসে বলল,

‘স্কুল ছুটি?’

‘হ্যাঁ, বউমনি। কিন্তু তুমি এমন ছুটে আসছো কোথ থেকে?’

‘না মানে, একটু ছাদে গিয়েছিলাম।’

‘এই সময়, এত রোদে ছাদে কেন?’

‘কাপড় মেলতে।’

রেনু এতক্ষণে খেয়াল করে দেখল, তনুকার এক হাতে একটা বালতি। সে বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বলল,

‘জমিদার বউ কাপড় ধৌয়? তাহলে বাড়িতে আর এত কাজের লোক রেখে কী লাভ? ভাইজান আর আম্মা শুনলে খুব রাগ করবেন কিন্তু। এসব কাজ বাড়ির কাজের লোকেরাই করে, ওদের দিয়েই করাবে।’

‘নিজের পরনের দুটো কাপড় আবার কাজের লোকদের দিয়ে ধুয়াতে হয় না কি? এইটুকু কাজ তো নিজেই করা যায়।’

‘কিন্তু, এই বাড়ির মেয়ে বউরা এইটুকু কাজও করে না। তাই তোমারও উচিত নয়, বুঝলে?’

তনুকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ঠিক আছে। তুমি গিয়ে এখন ফ্রেশ হয়ে নাও।’

_____________

‘আমাগো জমিদার ভাবিজান দেখি খুব মারাত্মক, কাকা।’

মতিব মজুমদার কপাল কুঁচকে বললেন,

‘ভাইয়ের মতো জান দেওয়ার ইচ্ছে আছে না কি?’

হাসল করিমুল্লাহ। বলল,

‘আমার ভাই তো বেকুব আছিল। বাঘের সামনে বাঘিনীর রূপের প্রশংসা করলে বাঘ তো ক্ষেপবই। আমি কি আর তার মতো বেকুব? আমি চালাক, কার সামনে কী কইতে হয় তা আমি জানি।’

মতিব মজুমদার বিরক্ত গলায় বললেন,

‘হয়েছে থাম। কাজ যা দিয়েছি সেটা মন দিয়ে করো আগে।’

‘কাজে সফল হইলে কী দিবেন?’

‘যা চাইবে তাই।’

করিমুল্লাহ দাঁত বের করে বিশ্রী হাসল। বলল,

‘জমিদার ভাবিজানরে এক রাইতের জন্য দিয়েন খালি।’

মতিব মজুমদার সতর্ক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চাইলেন। তারপর দাঁত খিঁচে বললেন,

‘আস্তে বল, শা’লা; নিজে তো মরবি মরবি, সাথে আমাকেও মারবি দেখছি।’

চলবে….

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৪।

মধ্যাহ্নভোজ করতে বসেছে সবাই। সকলের দৃষ্টি তাই খাবারের প্লেটে। তনুকা ধীরে ধীরে খাচ্ছে। তার উল্টো দিকের এক চেয়ারে মতিব মজুমদার বসা। তিনিও খাচ্ছেন। বরাবরের মতোই বড়ো চেয়ারে বসেছে মেহতাব। খাবার খাওয়ার মাঝেই একবার মতিব মজুমদারের দিকে চেয়েছে সে। তখনই মনে হয়েছে, মতিব মজুমদারের গুপ্ত দৃষ্টি তনুকার উপর। সে রা করল না কোনো। খাবার খেয়ে নিল নিঃশব্দে। তনুকা খুব বেশি খেল না। অল্প খাবার খেয়েই জিজ্ঞেস করল,

‘মা, বাবাকে খাবার দিয়ে আসব?’

আম্বিরা বেগম চাইলেন তার দিকে। বললেন,

‘লতা রান্নাঘরে খাবার রেখে দিয়েছে, দিয়ে এসো।’

তনুকা উঠে চলে গেল। মেহতাব মুখের খাবারটা হজম করে গম্ভীর সুরে বলল,

‘আজ রাত থেকে ছোট কাকা নিজ কক্ষে খাবেন, এটা আমার আদেশ।’

মেহতাবের কথা শুনে খাবারের ছন্দ পতন হলো সকলের। সবাই ড্যাবড্যাব করে চাইল। আম্বিরা বেগম কপাল কুঁচকে চেয়ে বললেন,

‘কী হয়েছে, মেহতাব? হঠাৎ এই আদেশ?’

‘আম্মা, আপাতত আমি কোনো কৈফিয়ত দিতে চাইছি না। যা বলেছি তাই যেন হয়। ছোট কাকাকে যেন আর খাবার ঘরে টেবিলে বসে খেতে না দেখি।’

মতিব মজুমদারের চোয়াল শক্ত হয়ে এলেও মুখে শব্দ করলেন না। তবে গর্জে উঠলেন তাঁর স্ত্রী, রাহীলা। বাজখাঁই স্বরে বলে উঠলেন,

‘কী শুরু করেছ তুমি? আর কত অত্যাচার করবে আমাদের উপর? ভাইজান অসুস্থ হবার পর থেকেই শুরু করেছ, কেন করছো এমন? কী করেছি আমরা?’

তিনি রাগে এমন ভাবে ফোঁস ফোঁস করছেন যেন, সাপ হলে এক্ষুনি মেহতাবকে ছোবল দিয়ে বসতেন। মেহতাবের মাঝে কোনো ভাবান্তর আসে না। সে বরাবরের মতোই নির্লিপ্ত। খেয়ে যাচ্ছে চুপচাপ। রাহীলা আরো জ্বলে উঠলেন তাতে। কর্কশ সুরে বললেন,

‘এমন করলে আমরা এই মহল ছাড়তে বাধ্য হব কিন্তু।’

‘আহ রাহীলা, কী শুরু করলে?’

মতিব মজুমদার ধমকে ওঠলেন। তাঁর স্ত্রী মূর্খ বড্ড। এই মহলকে হাত করার এত ফন্দি আঁটছেন তিনি, অথচ এই বোকা মহিলা কথায় কথায় মহল ছাড়ার হুমকি দেয়। মনে হয় যেন, তাঁর হুমকিতে সকলে ভয়ে কুপোকাত হয়ে যাচ্ছে।

মেহতাব উল্টো মৃদু হেসে বলল,

‘আপনাদের বিদায়ের জন্য আমরা সবসময় প্রস্তুত।’

অপমানে শরীরের রক্ত গরম হয়ে উঠল ততক্ষণাৎ। রাহীলা দাঁতে দাঁত চেপে চাইলেন মতিব মজুমদারের দিকে। মতিব মজুমদার ইশারায় শান্ত হতে বললেন তাঁকে। রাহীলাও উপায়ান্তর না পেয়ে অগত্যাই নিজেকে কোনোরকমে গুটালেন। মতিব মজুমদার হেসে বললেন,

‘কাকার উপর এত রাগ কেন জানতে পারি?’

‘যে জেনেও না জানার ভান করে, তাকে আর নতুন করে কী জানাব বলুনতো?’

মেহতাব উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার আগে আরেকবার বলল,

‘আমার আদেশের যেন কোনোপ্রকার হেরফের না হয়।’

মেহতাব চলে যেতেই আম্বিরা বেগম প্রশ্ন করলেন,

‘মতিব ভাই, কী হয়েছে বলবেন আমায়?’

মতিব মজুমদারও দাঁড়িয়ে পড়লেন। রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,

‘সেটা আপনার ছেলের কাছ থেকে জেনে নিবেন, ভাবিজান।’

চলে গেলেন তিনিও। রাহীলা খাওয়া রেখে এবার মরা কান্না জুড়ে বসল। তাতে প্রচন্ড বিরক্ত হলো, উপস্থিত বাকি সব মানুষ। তাঁরা যে মানুষ হিসেবে খুব একটা সুবিধার না সেটা আম্বিরা বেগম প্রথম থেকেই জানেন। আর যায় হোক, লোভ তাঁদের শিরায় শিরায় মিশে গিয়েছে। আর সেই নিয়েই হয়তো চাচা ভাতিজার মাঝে এত দ্বন্দ্ব, তাই ব্যাপারটাও কারোর আন্দাজের বাইরে নয়।

__________

‘বাবা, খাচ্ছেন না কেন? এমন করলে সুস্থ হবেন কী করে?’

কোনোরকমে দুই চামচ নরম ভাত শ্বশুরকে খাওয়াতে পেরেছে তনুকা। কিন্তু তার পর থেকেই মানুষটা আর খাচ্ছে না। ঠোঁট চেপে ঝিম মেরে শুয়ে আছে। তনুকা চেয়েও হা করাতে পারছে না। সে হতাশ গলায় বলল,

‘আপনার কি খাবার পছন্দ হয়নি? অন্য কিছু বানিয়ে আনব?’

লোকটি তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। তনুকার নিকট এই দৃষ্টির অর্থ বোধগম্য নয়, তাই বুঝতে পারছে না কী করবে। সে খাবারটা নাকের কাছে নিয়ে একবার শুঁকল। ততক্ষণাৎ একটা তীব্র ঘ্রাণ গিয়ে ঠেকল নাকে। কীসের ঘ্রাণ আচমকা ধরতে পারল না। লাউয়ের ঝোল দিয়ে নরম ভাত। এই ঘ্রাণ কোনো তরকারির না। কেমন একটা যেন ঔষধ ঔষধ গন্ধ। তনুকা অল্প একটু খাবার মুখে নিল। খাবারটা গলাধঃকরন করতেই ভীষণ বিদঘুটে ঠেকল তার। এত বিশ্রী স্বাদ কেন এই খাবারের? সে চাইল তার শ্বশুরের মুখ পানে। মনে হলো যেন, ঐ ঘোলাটে চোখ যুগল কিছু বলছে তাকে। তনুকা চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল,

‘আমি আবার খাবার বানিয়ে নিয়ে আসছি, বাবা। একটু অপেক্ষা করুন।’

তনুকা দ্রুত বেরিয়ে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে আবার ভাত বসাল। তরকারি পাতিল থেকে খেয়ে দেখল, সেখানে ঐ গন্ধটা আর করছে না। নরম ভাতের সাথে লাউয়ের ঝোল ভালোমতো মেখে আবার ছুটল শ্বশুরের রুমে। তবে এখন যেতেই দরজার দুই সেবক প্রহরী পথ আটকাল তার। তনুকা ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কী ব্যাপার, পথ আটকাচ্ছেন কেন?’

‘সাড়ে তিনটার ভেতরে জমিদার সাহেবকে খাবার দিতে হয়, এরপরে আর কাউকে অনুমতি দেওয়া হয় না।’

তনুকা ক্ষিপ্ত হলো ভীষণ। তেতে উঠে বলল,

‘এই অদ্ভুত নিয়ম কার?’

‘বড়ো মাতা’র।’

‘বড়ো মাতা কে?’

‘মেহতাব বাবুর আম্মাজান।’

তনুকা অবাক হলো। এটা কেমন অদ্ভুত নিয়ম। সাড়ে তিনটার পর খাবার কেন দেওয়া যাবে না? তনুকা বলল,

‘সমস্যা নেই। মা কিছু বলবেন না। দরজা ছেড়ে দাঁড়ান।’

প্রহরী দুজন মাথা নুইয়ে বলল,

‘ক্ষমা করবেন।’

‘আশ্চর্য, বাবা কি এখন না খেয়ে থাকবেন? সরে দাঁড়ান, বললাম তো।’

‘মাতার হুকুম অমান্য করতে পারব না।’

‘মা নিশ্চয়ই চাইবেন না, উনার অসুস্থ স্বামী না খেয়ে থাকুক? অযথা কথা না বাড়িয়ে যা বলছি তাই করুন। সরুন।’

ছেলে দুজন সরল না। তনুকা আকস্মিক ক্ষিপ্ত হলো অনেক। রাগে আওয়াজ করে বলল,

‘আমার হুকুম অমান্য করার সাহস হয় কী করে আপনাদের? সরে দাঁড়াতে বলছি, নয়তো মেহতাবকে বলে আমি আপনাদের কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করব।’

এবার হয়তো ভয় পেল দুজন। ঢোক গিলে একে অন্যকে দেখল তারা। কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই সেখানে এসে উপস্থিত হয় মেহতাব। তাকে দেখা মাত্রই ছেলে দুজন দুদিকে সরে দাঁড়ায়। মেহতাব এসে প্রশ্ন ছুড়ে,

‘কী হচ্ছে এখানে?’

মেহতাবের গলা পেয়ে ফিরে তাকায় তনুকা। রাগের মাত্রা কিছুটা প্রশমিত করে বলে,

‘উনারা আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না।’

মেহতাব ছেলে দুটোর দিকে তাকাতেই তারা তরতর করে কেঁপে উঠল যেন। একজন কম্পিত সুরেই বলল,

‘এটা মাতা’র আদেশ ছিল।’

‘এই আদেশ আমার বিবিজানের জন্য কার্যকর নয়। আর যেন ভুলে এমন কিছু করতে না দেখি।’

ছেলেগুলো ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। মাথা নাড়াল দুই দিক ঝাঁকিয়ে। মেহতাব বলল,

‘এবার ভেতরে যাও, বিবিজান।’

তনুকা ভেতরে প্রবেশ করল। পেছন পেছন এল মেহতাবও। মোহন লাল মজুমদার তার দিকেই চেয়ে আছেন যেন, এতক্ষণ তার’ই অপেক্ষায় ছিলেন। তনুকা এবার খাবার তুলতেই সহসাই খেয়ে নিলেন তিনি। তাতে আরেকদফা অবাক হলো তনুকা। তবে কিছু বলল না। শ্বশুরকে ভালো মতো খাইয়ে দাইয়ে চলে এল নিজের কক্ষে। এসেই মেহতাবকে বলল,

‘ঐ ছেলে দুটোকে আমার সুবিধার মনে হচ্ছে না, ওদের কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিন।’

‘তাহলে আব্বাকে কে দেখবে?’

‘আমি দেখব।’

মেহতাব বিছানায় বসতে বসতে বলল,

‘আব্বা বিছানায় প্রসাব পায়খানা করেন, সেসব কি তুমি পরিষ্কার করতে পারবে?’

তনুকা থামল। ভাবল, স্বামীর এই কাজগুলো করা কি স্ত্রীর দায়িত্ব না? তবে মা কেন করছেন না? যদি নিজের খারাপ সময়ে প্রিয় মানুষকে কাছেই না পেলেন তবে, এই নাম মাত্র প্রিয় মানুষের আর কীসের প্রয়োজন? তনুকা ভেবে বলল,

‘ঐ ছেলেগুলোকে ছাড়িয়ে দিন, আমি নিজে অন্য দুজন সেবক খুঁজে নিয়ে আসব।’

‘ঠিক আছে, ছাড়িয়ে দেব।’

তনুকা বসল। রয়ে সয়ে বলল,

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

‘করো।’

‘বাবার খাবারে ঔষধের গন্ধ করছিল কেন?’

মেহতাব বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। পা লম্বা করে রাখল তনুকার কোলের উপর। তাতে কপালে ঈষৎ ভাঁজ পড়ল তনুকার। তার অমন ভাঁজ করা কপাল দেখলে মেহতাবের কেমন যেন সুখ সুখ লাগে। সে বলল,

‘ডাক্তার একটা ঔষধ খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে বলেছিলেন, হয়তো সেই ঔষধের গন্ধ’ই পাচ্ছিলে।’

তনুকা বিস্মিত হলো খানিক। বলল,

‘আমি তো সেই খাবার খাওয়াইনি। নতুন বানিয়ে নিয়েছি।’

‘কেন?’

‘মনে হচ্ছিল, নষ্ট খাবার। তাই…’

‘থাক, পরের বার খেয়াল রাখলেই হবে।’

‘আচ্ছা, আমাকে একবার বাবার ঔষধগুলোও দেখিয়ে দিয়েন, তখন আর ভুল হবে না।’

‘ঠিক আছে। এখন এদিকে এসো, তোমাকে একটা প্রেমের গল্প শোনাই।’

‘প্রেমের গল্প?’

তনুকা অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল। মেহতাব বলল,

‘হ্যাঁ, আমার আম্মা আর আব্বার প্রেমের গল্প। তুমি জানো, আমার আব্বা কিন্তু হিন্দু তবে আম্মা মুসলিম….’

চলবে….