প্রিয়তমা প্রজাপতি পর্ব-০২

0
213

#প্রিয়তমা_প্রজাপতি🩷 [পর্ব-০২]
~আফিয়া আফরিন

অনিন্দিতা পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে এসে বিছানায় গায়ে এলিয়ে দিল। আপাতত, কয়েকদিন শান্তি। আজ পরীক্ষা শেষ, দুই মাস পর আবার টেস্ট পরীক্ষা। যদিও, পড়াশোনার ওপরেই থাকতে হবে তবুও; আপাতত পরীক্ষা শেষ ভেবেই মাথা ঠান্ডা। অনিন্দিতা শোয়া থেকে উঠে সোজা রান্নাঘরে গেল। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি আর লেবু বের করে, শরবত বানালো। খেতেই খেতেই মনে পড়লো গতকাল মিফানের জন্য বানানো শরবতে ইচ্ছে করেই লবণ চিনি কম দিয়েছিল, মাঝে মাঝে ছেলেটাকে ক্ষ্যাপাতে সেই লাগে।
ছোট থাকতে সর্বক্ষণ পিছে পিছে ঘুরতো আর বলতো, ‘তোমাকেই আমি বিয়ে করবো, তোমায় ছাড়া আর কাউকেই কখনো বিয়ে করব না। তুমি মানে তুমি-ই, আমার প্রজাপতি!’
আগের কথাগুলো মনে পড়তেই হাসতে হাসতে দম খিচড়ে আসে অনিন্দিতার। কি সুন্দর ছিল ছোটবেলা! পড়াশোনার চাপ ছিল না, শুধু সারাদিন হেসে খেলে বেড়ানো।
মিফান কে কতবার পুকুরের পানিতে নাকানি চুবানি খাইয়েছে তার কোন বিবরণ তালিকা নেই। মিফান অনিন্দিতার এইরকম কাজ কারবার টু শব্দ করলেই সে বলেছে, ‘খবরদার বাসায় গিয়ে কাউকে বলে দিবি না। তাহলে, তোর প্যান্ট খুলে সারা রাস্তায় ঘুরাবো আর তোর ঐখানে কাঁকড়া ছেড়ে দেব। আমি তোর বড়, এটা মনে রাখিস।’

মিফান আর ভয়ে কাউকে কিছু বলত না। অনিন্দিতা কে সে বরাবরই ভয় পেয়ে এসেছে। শুধুমাত্র সাহস করে, বিয়ের কথাটা বলে। সেটাও অনিন্দিতা হেসে খেলে উড়িয়ে দেয়।
অনিন্দিতা বরাবরই একটু উগ্র আর বেপরোয়া স্বভাবের। পাশাপাশি সে প্রচন্ড জেদি, নিজের জিনিসটা যেকোনো ভাবে আদায় করে ছাড়বেই। মাঝে মাঝে অনিন্দিতা এমন সব জিনিসের জন্য পাগলামি করে বসে, মিফানের বলেই দিতে ইচ্ছা করে যে, ‘আমি তোমার ওই পাগলামির বিষয়বস্তুটা আমি হলাম না কেন? আমি হলেই তো, তুমি আমাকে পাওয়ার জন্য এত জেদ করতে। আমাকে পাওয়ার জন্য ছোট বাচ্চাদের মত বায়না ধরে হাত পা ছড়াছড়ি করতে।’
কিন্তু আফসোস! এসব আর তাকে বলা হয়ে ওঠে না। মনের কথা মনের গোপন কুঠুরিতেই থেকে যায়। কবে যে অনিন্দিতা কে ভালোবাসার কথাটা বলবে? কিভাবে বলবে বা কোথা থেকে শুরু করবে, তার কূলকিনারা খুঁজে পায় না মিফান। এক জনমে কি অনিন্দিতা বুঝবে তাকে? বড্ড ভালোবেসে নাম দিয়েছে প্রজাপতি, হ্যাঁ প্রজাপতি-ই তো! খুব ভালোবেসে আলতো করে আগলে রাখতে হবে তো তাকে।
.
.
এরই মধ্যে মিফান একদিন ভেবে নিল, দিন তো অনেক গেল এইবার অনিন্দিতা কে মনের কথাটা বলে দেওয়া উচিত। আর কতো, আর কতো অপেক্ষার প্রহর গুনলে প্রতীক্ষার ফল পাওয়া যাবে?
ইদানিং অনিন্দিতার আশেপাশে তার কয়েকজন ব্যাচমেট/ক্লাসমেটের ঘোরাঘুরি লক্ষ্য করছে মিফান।
তার আগে কেউ ছোঁ মেরে অনিন্দিতাকে নিয়ে যাবে, মিফান বেঁচে থাকাকালীন সে এটা কখনোই হতে দিতে পারে না।
রুক্ষ মস্তিষ্কে একটা আবোল তাবোল মেসেজ পাঠালো অনিন্দিতার ফোনে।
‘শোনো, ছোটোবেলায় তোমার সাথে অনেক ফাজলামি করতাম। কথায় কথায় তোমায় বলতাম, আমি বড় হলে তোমাকেই বিয়ে করব। তোমার মনে হতেই পারে আমি ছোট থাকতে এই কথাটা ফাজলামি করে বলেছি; কিন্তু তা না। আমি এই কথাটা একদম মনের গহীন থেকে বলেছি, সত্যিই আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই! মিফানের মনের অন্তঃকুঠিরে তোমার জন্য ধিকে ধিকে যে ঝড় বয়ে চলছে, তার অবসান একমাত্র তুমিই প্রজাপতি!’

সাত পাঁচ না ভেবে মেসেজটা পাঠাল মিফান। মিনিট দশেক ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। ওই দশটা মিনিট সে পলকহীন স্ক্রিনে তাকিয়েই রইল। চোখ ব্যথা হয়ে গেল, চোখ জ্বলে গেল কিন্তু ওই পাশ থেকে অনিন্দিতার কোন উত্তর এলো না। আসবে কি? অনিন্দিতা কিভাবে রিয়েক্ট করবে? মেসেজটা কি ডিলিট করে দেওয়া উচিত? নাহ, থাক। পরে তা হওয়ার হবে। ভীতু প্রেমিক হওয়া যাবে না, মার্ক এন্টনির মতো সাহসী প্রেমিক হতে হবে। প্রেমিক হতে হলে রোমিও না হয় মজনুর মত হতে হবে।
সেই দিন পুরোটা পার হয়ে গেল, কিন্তু অনিন্দিতার কোন রিপ্লাই এলো না। মিফান বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুটো চকলেট কিনে অনিন্দিতার বাড়ির দিকে রওনা দিল। সবাই জানবে সে চকলেট দুটো অবশ্য আনিসা আর আনিকার জন্য নিয়ে এসেছে, আর তার মন জানবে সে আড়ালে আবডালে, গোপনে সঙ্গোপনে তার প্রজাপতির দৃষ্টিতে নিবদ্ধ হতে এসেছে।

অনিন্দিতাদের ফ্ল্যাটের দরজায় কড়া নাড়তেই, অনিন্দিতা দরজা খুলে দিল। মিফানকে দেখে মুহূর্তেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। মিফান কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনিন্দিতা, ওর শার্টের কলার ধরে ভেতরে নিয়ে এলো। বলল, ‘এইতো পাইছি তোরে? কাল কি মেসেজ দিয়েছিলিস আমার ফোনে? বিয়ে করবি আমারে? আমার হাঁটুর বয়সী ছেলে হয়ে তুই আমাকে বিয়ে করতে চাস, এই লজ্জা করে না তোর?’

মিফান শার্ট ছাড়িয়ে নিল। বলল, ‘তুমি মেসেজ দেখেও রিপ্লাই দাও নাই কেন?’

‘ফোনে ব্যালেন্স ছিল না তাই রিপ্লাই দিতে পারি নাই। সবচেয়ে বড় কথা কি জানিস, তোর ওই মেসেজ দেখা মাত্র আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেছে। সামনে পাইলে তোকে সেখানেই আস্ত খেয়ে ফেলতাম। সাহস কতো! এখন বল, আমার সাথে মশকরা করার মত এত ডেঞ্জারাস ডেয়ার তোকে কে দেয়?’

মিফান কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, ‘ডেয়ার কেন হতে যাবে? আমি তো সত্যি সত্যি তোমাকে ভালোবাসার কথা বলেছি থুক্কু বিয়ের কথা!’

‘মিফান, অনেকদিন হলো তুই আমার কাছে চড় থাপ্পর কিছু খাস না। এই বয়সে একটা থাপ্পড় খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে? তুই করবি আমারে বিয়ে? হাঁটুর বয়সী ছেলে!’

‘কথায় কথায় হাঁটুর বয়সী ছেলে বলে একদম লেগপুল করবা না। কোন অ্যাঙ্গেল থেকে আমাকে তোমার ছোট দেখা যায়? বয়স অত কে বুঝে বল? মাত্র, মাত্র ৮ মাসের ছোট আমি তোমার থেকে।’

অনিন্দিতা ভুরু কুঞ্চিত করে বলল, ‘তার মানে তুই আমার ব্যাপারে সিরিয়াস?’

ঝলমলিয়ে তাকালো মিফান। ‘হ্যাঁ। অবশ্যই সিরিয়াস!’

অনিন্দিতা বিস্মিত ভাব চেপে বলল, ‘আমি সত্যি আশ্চর্য হয়ে গেছি তোর কথা শুনে। এসব কোন কথা হলো? হুট করে কোথা থেকে এসে বলছিস, বিয়ে করতে চাস। এই আমার যদি বয়ফ্রেন্ড থাকে?’

‘নাই। তোমার ব্যাপারে তোমার ক্যাম্পাসে আমি সব খোঁজ খবরই রাখি। ইভেন, আমাকে রাখতে হয় আর আমি তোমার খোঁজ খবর রাখতে বাধ্য।’

আরেক দফা আশ্চর্য হলো অনিন্দিতা। বলল, ‘এখন বাড়িতে এসেছিস কোন রাজকার্য উদ্ধার করতে? করে তাড়াতাড়ি আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হবি।’

‘তোমার উত্তরটা জানালে না?’

‘আর কোন কথা না। থাপ্পড় মেরে যে তোর গালে দাগ বসিয়ে দেই নাই, এটা তোর সাত জনমের ভাগ্য। এই ভাগ্য আর টেনে টেনে লম্বা করতে যাস না, খুব খারাপ হবে বলে দিলাম।’

মিফান পকেট থেকে চকলেট দুটো বের করে অনিন্দিতার হাতে ধরিয়ে দিল।
তারপর বলল, ‘সব যখন সজ্ঞানে স্বীকার করে নিয়েছি তখন আমার আর কোন ভয় নেই। তোমাকে কি আমি আজকাল বা দুইদিন আগে থেকে ভালবাসি? উহু, যেদিন তুমি চোখের সামনে প্রজাপতির মতো উড়ে বেরিয়েছে; সেদিন তোমায় ভালোবেসেছি আর সেদিনই বুঝেছি তোমায় খুব ভালবেসে যত্ন করে আগলে রাখতে হবে।’

‘আশ্চর্য। আমার ভূত মাথা থেকে নামিয়ে ফেল।’

‘তোমার ভূত আমার মাথায় চড়ে নাই, তোমার নেশা চড়েছে আমার মাথায়। আর মৃত্যু ছাড়া এই নেশা কাটানো অসম্ভব।’

অনিন্দিতা নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, ‘তো মরে যা তুই। বেঁচে আছিস কি জন্য এখনো? যা, মর।’

‘আচ্ছা।’ নির্লিপ্ত ভাবে এই কথাটাও বলল মিফান। তারপর পা বাড়াল বাহিরের দিকে। সে জানতো, তার মনের কথাটা অনিন্দিতাকে জানানো মানেই অনিন্দিতার সাথে ছোটখাটো একটা যুদ্ধ লেগে যাওয়া। কিন্তু সে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত, সৈন্যরা যেরকম তাদের অস্ত্র/তড়োয়ার নিয়ে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকে; মিফান ও সেই ভাবে প্রস্তুত। তবে মিফানের হাতিয়ার কোন অস্ত্র বা তলোয়ার নয়, তার হাতিয়ার ভালোবাসা। এই ভালোবাসা দিয়ে যুদ্ধ জয় করবে সে, নিজের প্রতি এটা তার দৃঢ় বিশ্বাস!
.
.
পরদিন সকালে ক্যাম্পাসে দেখা হলো অনিন্দিতার সাথে। যদিও মিফান আর অনিন্দিতার ক্যাম্পাস আলাদা; তবুও মিফান অনিন্দিতার সাথে দেখা করার জন্যই মেইন গেটে দাঁড়িয়েছিল।
মিফানকে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনিন্দিতা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে কি সিকিউরিটি গার্ডের জব নিয়েছিস?’

মিফান বরাবরের মতো হাসলো। কপালে থাকা অদৃশ্য ঘাম হাতে মুছে বলল, ‘আপাতত তোমার সিকিউরিটি গার্ডের জব নিয়েছি। তোমাকে বিয়ে করে তোমার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে না? এখনো আমার পড়াশোনা কমপ্লিট হলো না, ইঞ্জিনিয়ারিং টা কমপ্লিট করি। তারপর না হয় তোমার হবু বর সিকিউরিটি গার্ড থেকে এক লাফে ইঞ্জিনিয়ারিং এর সার্টিফিকেট পেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাবে।’

‘ইঞ্জিনিয়ার? হুহ! মিস্ত্রিগিরি করে আবার নিজেকে ইঞ্জিনিয়ার বলে দাবি করা হচ্ছে?’

মিফান মুখে শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘আমার এত দিনের সার্টিফিকেট ডিগ্রি, এসব থাকা সত্ত্বেও মিস্ত্রি বলছো? আচ্ছা, তোমার কোন কথাতেই তো আমি মাইন্ড করি না। এখন ও না হয় করব না। তুমি আমাকে মিস্ত্রি বলে খুশি থাকলে, আমি সত্যিকারের মিস্ত্রি হয়ে যেতেও রাজি।

‘ভালো কথা, তোর না মরে যাওয়ার কথা ছিল? এখনো বেঁচে আছিস কিভাবে তুই?’

‘মরে যাবো? কেন মরে যাবো বল তো? মরে গেলে কি আমি দশটা টাকা পাবো, কিন্তু বেঁচে থাকলে তো তোমাকে পাবো! আমি এতটাও বোকা নয় যে, এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করব। আর সবচেয়ে বড় কথা, তোমাকে ভালোবাসার জন্য হলেও জনম জনম বেঁচে থাকব! দরকার হলে পরের জন্মে তোমার রাগ জেদ হয়ে জন্মাবো, যাতে করে আজীবন তোমার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে থেকে যেতে পারি।’

‘আজকাল খুব কথা বলছিস দেখা যায়? ছোট কাকিমাকে বলতে হবে নাকি তোর এই কান্ড কারখানা? ছোটবেলার মতো তো এখন আর বলতে পারব না, প্যান্ট খুলে সারা রাস্তা হাঁটতে হবে তোকে। তাই ছোট কাকিমাকে বলার উপায়টাই বেছে নিলাম। আসছি, আল্লাহ হাফেজ।’

অনিন্দিতা উল্টো দিক ফিরে ঘাড়ে থাকা চুল গুলো মিফানের দিকে উড়িয়ে ক্লাসে চলে গেল। মিফান বুকের বা পাশে হাত রেখে বলল, ‘হায়েএএএএএএ!’
.
.
.
চলবে…..!