#প্রিয়মুখ
#ফারিহা_জান্নাত
#পর্ব০১
আজ ঝুমকার আংটি বদল হবে। বাড়িতে অনেক আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু এত আনন্দের মাঝেও কারও একজনের মন বিষন্নতায় ভরে আছে।পুকুর ঘাটে নিরালায় বসে ভাবছে আগের দিনগুলোর কথা যখন ঝুমুর ছোট ছিল (ঝুমুর হলো ঝুমকার চাচাতো বোন)।কত ভালোবাসায় জড়ানো ছিলো পরিবার। সবাই ঝুমুরকে অনেক আদর করতো কারণ ঝুমুরের বাবা তখন বেঁচে ছিলেন।অনেক বড় ব্যবসা ছিলো।ঝুমুরের বাবারা ছিলেন তিন ভাই। কত হাসি আনন্দে কাটতে দিনগুলো। ঝুমুরের বাবার বন্ধু মিজানুর রহমান উনার ছেলে হাসিবের সাথে ঝুমুরের বিয়ে ঠিক করেন দুই বন্ধু মিলে।হাসিব তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে আর ঝুমুর মাত্র ক্লাস ফোর। দুই পরিবার খুব খুশি ছিলেন বন্ধুত্বের সম্পর্ক আত্বীয়ের সম্পর্কে পরিনত হবে।কিন্তু একটা রোড এক্সিডেন্ট সব আনন্দ মাটি করে দেয়। ঝুমুরের বাবা মারা যান।হাসিবের বাবা শহরে চলে আসেন। ঝুমুরের লেখাপড়ার প্রতি প্রচুর আগ্রহ থাকার কারণে ঝুমুরের মা অনেক কষ্টে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন।ঝুমুরের বাবার সব সম্পত্তি ঝুমুরের দুই চাচা মিলে আত্মসাৎ করে আজ তারা সমাজের নামকরা নামি-দামি ব্যক্তি।ঝুমুরের চাচারা খুব বেশি একটা পছন্দ করেন না ঝুমুর আর ঝুমুরের মাকে।লোক লজ্জার ভয়ে বাড়ি ছাড়া করেন নি। ঝুমুর এখন অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিবে।সেই ছোটবেলায় ঠিক করা ঝুমুরের হবু বরের সাথেই আজ নিজের ছোট বোনের আংটি বদল হবে আর কিছুদিন পর বিয়ে।জীবন বড়ই আজব বড়ই অদ্ভুত।
কষ্টের দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের কোণায় জল এসে জমা হচ্ছে খেয়ালই করলো না।হঠাৎ কারও ঝুমুর বলে ডাক শুনে ধ্যান ভাঙ্গলো।তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে পিছনে তাকিয়ে দেখে ছোট চাচী।
…..ঝুমুর ছেলে পক্ষ এসে পড়লো বলে তুই তাড়াতাড়ি আয় তো।দেখ সব কিছু ঠিক আছে কিনা।
ঝুমুরকে মায়ের পর ছোট চাচী বেশি আদর করে। ঝুমুর কাছে আসতেই ছোট চাচী ঝুমুরকে দেখে বললো…
….কিরে ঝুমুর কাঁদছিস কেন?তোর হবু বর তোর ছোট বোনকে বিয়ে করছে খুশীতে কাঁদছিস নাকি দুঃখে কাঁদছিস?
ঝুমুর হঠাৎ ছোট চাচীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।
…..ছোট চাচী যখন কিছু বুঝতাম না তখন থেকে জানতাম হাসিবের সাথে আমার বিয়ে হবে যখন বুঝতে শিখেছি তখন হাসিবের জন্য নিজেকে তৈরি করলাম।কখনো হাসিবকে দেখিনি কিন্তু ওর জন্য সব ভলোবাসা জমা করে রেখেছিলাম আজ সব শেষ হয়ে গেলো।
……ঝুমুর একদম কান্না করবি না কোনো বেঈমানের জন্য কান্না করা তোকে মানায় না।
তোর বড় চাচী তো হাসিবদের সম্পত্তি দেখে লোভ আর সামলাতে পারছে না।
…..থাক ছোট চাচী দোষ কারও না দোষ আমার ভাগ্যের আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতো তাহলে এই দিন আর দেখতে হতো না আমাদেরকে।
কান্না থামিয়ে ঝুমুর বললো…
….চলো চাচী আমাদেরকে না দেখলে বড় চাচী আবার তুলকালাম করে ফেলবে।
….তাই চল।
ঘরে আসতেই বড় চাচী ঝুমুরকে বলে উঠলো…
….তুই তো ভালো আলপনা করতে পারিস সামনের দরজায় তাড়াতাড়ি আলপনা দিয়ে আয়।আবার দেখিস সময় সেখানে কাটিয়ে আসবি না ঘরে আরও কাজ আছে। ঝুমকাকে সাজিয়ে দিতে হবে। আবার ভুলে যাস না জেনো।
মনের মধ্যে হাজার কষ্ট চেপে রেখে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে আলপনা আঁকতে চলে গেলো।
চলবে….
#প্রিয়মুখ
#ফারিহা_জান্নাত
#পর্ব০২
ঝুমুর আলপনা এঁকে রান্না ঘরে এসে দেখে ঝুমুরের মা আর নাজমা খালা পিঠা বানাচ্ছে।
……কি রে আলপনা আঁকা শেষ হলো?
…..হুমমম মা মাত্র শেষ করে আসলাম।মা ঝুমকা কোথায় বড় চাচী বললো ঝুমকাকে সাজিয়ে দিতে হবে।
…..আছে কোথায় দেখ।
ঝুমুর রান্না ঘর থেকে বের হচ্ছে এমন সময় বড় চাচী এসে বললো…
…..ঝুমুর ঝুমকা ওর রুমে আছে শাড়ি আর সাজগোজ সব খাটের উপর রাখা আছে তুই গিয়ে সুন্দর করে মেয়েটাকে সাজিয়ে দিয়ে আয়।
…..যাচ্ছি বড় চাচী।
….আর শুন তুই কিন্তু ওদের সামনে যাবি না। তোকে যেন ওরা ওখানে না দেখে।আমি চাই না তোর কারণে আমার মেয়ের কোনো সমস্যা হোক।
ঝুমুর কথা না বাড়িয়ে মাথা নিচু করে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে যায়।বুঝায় যাচ্ছে কথাগুলো ঝুমুরের বিষের মতো লাগলো।
ঝুমুরের মা সব শুনতে পেয়েও কিছুই বললো না শুধু শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ছোট চাচী সব শুনতে পেয়ে সাথে সাথে উত্তর দিলো…
…মেঝো ভাবী তোমার সমস্যা কি বলবে? সব সময় তুমি ঝুমুরের সাথে এভাবে ব্যবহার করো কেন?কি করেছে মেয়েটা তোমার?
….আমি আবার কি করলাম সাজেদা?(ঝুমুরের ছোট চাচীর নাম)
….না মেঝো ভাবী তুমি কিছু করোনি সব আমি করেছি।ঝুমুরকে সব সময় খোঁচা না দিয়ে কথা বললে তোমার পেটের ভাত হজম হয় না তাই না।
….দেখ সাজেদা ঝগড়া করবি না আমার সাথে। আমি ওকে এমন কি বললাম বল।সবার সামনে আসতে নিষেধ কেন করেছি তা তুই খুব ভালো করেই জানিস।
…..হুমমম মেঝো ভাবী জানি তো ঝুমুর দেখতে যেমন সুন্দর গুণের দিক থেকেও তেমন।ঝুমকার চাইতেও উত্তম এটাই ঝুমুরের দোষ।
ঝুমুরের মা দুজনকে থামানোর চেষ্টা করছে…
…..রোখসানা(ঝুমুরের বড় চাচীর নাম) চুপ কর বাড়ি ভর্তি মেহমান কি হচ্ছে এসব?
….আমাকে বলছো কেন ভাবী?সাজেদাকে চুপ থাকতে বলো ঝগড়া তো শুরু সাজেদা করেছে। চোখে দেখো না তুমি?
…..সাজেদা বোন চুপ কর তুই অশান্তি করিস না একটু পর সবাই চলে আসবে কে কি ভাববে বল তো।
রোখসানা রাগে গজগজ করতে করতে বের হয়ে গেলো রান্না ঘর থেকে।
…..বড় ভাবী মেঝো ভাবী ঝুমুরের সম্পর্কে এত কথা বলে আর তুমি চুপ করে কি করে থাকো?কবে মাথা উঁচু করে কথা বলবে ভাবী?আর কত অপমান সহ্য করবে তোমরা?
কথাগুলো শেষ করে সাজেদা চলে গেলো।ঝুমুরের মা বলতে লাগলো…..
সাজেদা কথা আমিও বলতে পারি প্রতিবাদ আমিও করতে পারি কিন্তু পরিনাম যে কি হবে সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি।কথা গুলো মনে মনে বললো।
…..ঝুমুর নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কান্না করতে কিন্তু পারছে না।শুধু নিজের সাথে কিছু কথা বলতে লাগলো…আমার সাথে কেন এমন হচ্ছে?শুনেছিলাম মানুষ জন্মের পর পাপ করে আমি তো মনে হয় জন্মের আগেই পাপ করেছি।কেন আমার প্রিয় জিনিস আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায়?আল্লাহ তুমি বলে দাও আর কত দিন এসব সহ্য করবো?আর যে পারছি না আমি।
একটু পর দরজার ধাক্কানোর শব্দে হুঁশ ফিরে আসে ঝুমুরের। তাড়াতাড়ি বাতরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিলো।দরজার সামনে গিয়ে কিছু বলার আগেই ছোট চাচীর গলা শুনতে ফেলো।
….ঝুমুর দরজা খোল মহারানীকে সাজাতে হবে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আয়।
ঝুমুর দরজা খুলে ছোট চাচীর দিকে হাসি দিয়ে বলে…
…..কি গো চাচী কার উপর এত রাগ দেখাচ্ছো হুমমম
…..দাঁত কেলিয়ে হাসলেই চোখের পানি আড়াল করা যায় না ঝুমুর।এত কিছুর পর হাসতে ইচ্ছে করে কিভাবে তোর?
……চাচী শুনো আমার এখন ইচ্ছে করছে তোমার হাতের গরম গরম এক কাপ চা খেতে(চাচীকে জড়িয়ে ধরে আছে ঝুমুর)
তোমার হাতের চা খেয়ে ঝুমকাকে সাজাতে যাবো।
…..তুই কি রে ঝুমুর এত কিছুর পরও তোর রাগ হচ্ছে না?তোর চা খেতে ইচ্ছে করছে?
….হুমমমম চাচী শুধু তোমার হাতের চা।যত তাড়াতাড়ি নিয়ে আসবে তত তাড়াতাড়ি ঝুমকাকে সাজাতে যাবো।আর তুমি তো জানোই যদি দেরি হয় তাহলে কিন্তু আমাকেই বড় চাচীর কাছে বকা শুনতে হবে।
ছোট চাচী ঝুমুরের কান ধরে বলে….
…..বেশি পাকামি শিখেছিস তাই না।
…..চাচী ছাড়ো লাগছে তো।
….তুই বস আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।ফাজিল মেয়ে।
ঝুমুরের একটুও চা খেতে ইচ্ছে করছে না শুধু ছোট চাচীর মন ভালো করার জন্যই চায়ের কথা বললো।
ঘরে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবছে…..
কত বিশাল আকাশ অথচ তার কোনো ঠিকানা নেই। আর ছোট্ট একটা পাখির তারও একটা ঠিকানা আছে উড়তে উড়তে যত দূরেই যাক দিন শেষে তার ঠিকানায় ঠিকই পৌঁছে যায়।
একটুপর ছোট চাচী চা আর সাথে কিছু পিঠা নিয়ে আসলো।
….চাচী তুমি আবার পিঠা আনতে গেলে কেন এসব খেতে দেরি হয়ে যাবে তো।
…..কিছুই হবে না।তুই খেয়ে নে।
ঝুমুর জানে পিঠা না খেলে চাচী রাগ করবে তাই পিঠা একটা হাতে নিয়ে খেতে লাগলো।চাচী ফাইজা আর ফাহিম কোথায় সকাল থেকে দেখছি না।(ফাইজা আর ফাহিম ছোট চাচীর ছেলে মেয়ে)
….আছে তোর চাচার সাথে।
….চাচী এবার যাই ঝুমকাকে সাজিয়ে দিয়ে আসি।দেখবে ওকে পরীর মতো লাগবে।
ঝুমুর কথা গুলো বলে ঝুমকার রুমে চলে গেলো।
…..পরী না পেত্নীর মতো লাগবে।যতই সাজানো হোক না কেন পেত্নী কি আর পরী হবে। মনে মনে কথাগুলো বলে রাগ কমানোর চেষ্টা করলো ছোট চাচী।
ঝুমকার রুমের কাছে গিয়ে দরজায় নক করে ঝুমুর বললো…
…..ঝুমকা ভিতরে আসবো?
…..আপু তুমি এত দেরি করলে কেন?ওরা যদি এখন এসে যায় কি হবে বলতো?তাড়াতাড়ি রেডি করে দাও।
….আজকে ঝুমকা রানীকে এত সুন্দর করে সাজাবো দেখবি একদম পরীর মতো লাগবে। আয় বস।
(একটা টুল এনে বসতে বললো)
প্রায়ই আধাঘন্টার মতোই লাগলো সাজাতে তারপর শাড়িটাও পরিয়ে দিলো।
….ঝুমকা এবার আয়নায় দেখতো কেমন লাগছে তোকে।
…..খুবই সুন্দর হয়েছে আসলে আমাকে সাজলে অনেক সুন্দর লাগে তাই নারে আপু?(ঝুমকা আয়নার সামনে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে)
….হুমমম অনেক সুন্দর লাগে।আচ্ছা ঝুমকা আমি আমার রুমে যাচ্ছি। মেহমানদের আসার সময় হলো বলে।
…..ঠিক আছে আপু।
ঝুমুর নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। অনুষ্ঠানে তো আর যেতে পারবে না তাই দূর থেকে একবার হাসিবকে দেখার ইচ্ছে তো আর লুকাতে পারবে না।ভালোবাসার মানুষকে দেখার লোভ কি আর সামলানো যায়।
ঝুমুর এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যাতে করে বাহির থেকে ঝুমুরকে দেখা না যায়।
কিছুক্ষণ পরই একটা কালো রংয়ের গাড়ি গেটের ভিতর প্রবেশ করলো।একে একে সবাই বের হচ্ছে। হাসিবের বাবা মা আর বোন ঈশিকা।
একটুপর হাসিবও বের হলো। কালো রংয়ের ব্লেজার পরা, হাতে একটা ঘড়ি, চোখে কালো রংয়ের সানগ্লাস পরা।দুর থেকে স্পষ্ট বুঝা না গেলেও এটা বুঝা যাচ্ছে হাসিব বেশ স্মার্ট একটা ছেলে।
ঝুমুর সেখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে বিছানায় হাত পা গুটিয়ে মন মরা হয়ে শুয়ে আছে।
চলবে…..