#প্রিয়মুখ
#ফারিহা_জান্নাত
#পর্ব_শেষ
ঝুমুর বাড়িতে এসে নিজের রুমে ডুকে দরজা বন্ধ করে হাঁটু গেঁয়ে বসে অঝোরে কান্না করতে করতে বলতে লাগলো….
…আমার জীবনটা কেন এমন হলো? যখনি বাঁচার আলো খুঁজে পাই তখনি আলো নিভে যায়।আমার জীবনের সাথে বার বার কেন ধোঁকা হচ্ছে। এবার ভালোই হবে সব কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে যাবো। কিন্তু আমাকে তো সবার কাছ থেকে সব কিছু লুকিয়ে রাখতে হবে। আমাকে যেভাবেই হোক স্বাভাবিক থাকতেই হবে। আমাকে আগের মতো ঠিক থাকতে হবে। সব কিছু মানিয়ে ভালো থাকতে হবে।আল্লাহ সাহায্য করে আমাকে।
একটুপর ঝুমুর ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরের দিকে গেলো।
ঝুমুরের মা ঝুমুরকে দেখে বলে…
….কি রে ঝুমুর তুই সকালে কোথায় গিয়েছিলি কিছু না খেয়ে?
….বেশিদূর যাই নি কাছাকাছি ছিলাম।এখন ক্ষিধে লেগেছে খেতে দাও
….বস দিচ্ছি
ঝুমুরের ইচ্ছে না থাকার সত্ত্বেও নাস্তা করতে বসলো।কিছুটা নাস্তা করে ঝুমুর ছাদে চলে গেলো আলপনা আঁকার জন্য।কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা দরকার। ছাদে আলপনা আঁকছে কিন্তু কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কাউকে কিছু বলতে পারছে না।মনে মনে ভাবছে…
যদি কাউকে নিজের মনের কথা বলতে পারতাম তবে নিজেকে অনেক হালকা মনে হতো।
ওদিকে ডাঃ ফায়াজ ঝুমুরের এরকম ছেলেমানুষীকতা কিছুতেই মানতে পারছে না।ডাঃ ফায়াজ সিদ্ধান্ত নেয় ঝুমুরের পরিবারের সাথে কথা বলবে। বেশি দেরি করা যাবে না যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঝুমুরের চিকিৎসা করানো দরকার। তাই চেম্বার থেকে বের হয়ে ঝুমুরের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
কিছু সময় পর ঝুমুরের বাড়িতে ডাঃ ফায়াজ আসে। কলিং বেলের শব্দ শুনে ঝুমকা এসে দরজা খুলে ফায়াজকে দেখে সালাম দিয়ে বলে…
…ভাইয়া তুমি!! ভিতরে আসো।
….ঝুমকা কেমন আছো?
….ভালো আছি।
…বড় আন্টিকে একটু ডেকে দিবে?
ঠিক আছে বলে ঝুমকা চলে যায়
একটুপর ঝুমকার মা আর ছোট চাচী আসলো ফায়াজকে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেলো।ফায়াজ সাধারণত প্রয়োজন ছাড়া আসে না।
….ফায়াজ কেমন আছো? হঠাৎ কি মনে করে আমাদের বাড়ির কথা মনে পড়লো এত দিন পর(হেসে হেসে কথা গুলো বললো ঝুমুরের মা)
ঝুমুরের চাচী বলে..
….আমাদের ফায়াজ তো আবার রোগীর সেবা করা ছাড়া কিছু বুঝে না।
….আন্টি আপনাদের সাথে কিছু জরুরি কথা বলার ছিলো। আপনাদেরকে কথা গুলো জানানো দরকার আমি মনে করি।
….কি হয়েছে ফায়াজ তোমাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে
….বড় আন্টি আসলে হয়েছে কি…
কথার মাঝে হাসিব চলে আসলো। হাসিবকে দেখে ফায়াজ চুপ হয়ে গেলো।
ঝুমুরের চাচী বলে…
….ফায়াজ, এই হলো আমাদের বাড়ির ভবিষ্যৎ জামাই হাসিব।সমস্যা নেই ওর সামনেই বলতে পারো।
ফায়াজ বলতে লাগলো…
….আন্টি ঝুমুরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হসপিটালে ভর্তি করাতে হবে তা না হলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
ঝুমুরের মা কথা গুলো শুনে গলা শুকিয়ে যায়।কথা বের হচ্ছে না। হাসিব চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে নিজের শক্তি মনে হচ্ছে হারিয়ে ফেলছে। হাসিব জানতে চাইলো ঝুমুরের কি হয়েছে…..
ফায়াজ সব কিছু বলতে লাগলো।
ঝুমুরের মা কাঁদতে কাঁদতে বলে…
….আমার মেয়েটার সাথে এত কিছু হয়ে গিয়েছে আর মেয়েটা কাউকে কিছু বলে নি।এত কিছু সব নিজে নিজে সহ্য করে যাচ্ছে।
ঝুমুরের মায়ের কান্নার আওয়াজ শুনে ঝুমকার মা সেখানে চলে আসে। ফায়াজের কাছে হাসিব জানতে চায় ঝুমুরের কি হয়েছে।ফায়াজ ঝুমুরের রিপোর্ট গুলো হাসিবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে…
….ঝুমুরের ব্রেইন টিউমার ধরা পড়েছে চিকিৎসা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুরু করানো উচিত তা না হলে সমস্যা আরও বেড়ে যাবে তখন কারও কিছু করার থাকবে না।
হাসিব কথা গুলো শুনে বলে….
….আমার ঝুমুরের কিছু হবে না। ওকে আমি সিঙ্গাপুর নিয়ে যাবো উন্নত চিকিৎসা করাবো। ঝুমুরের কিছু হতে দিবো না।
ঝুমকার মা অবাক হয়ে হাসিবের দিকে তাকিয়ে আছে
.ঝুমুরের মা আর চাচী কান্না করেই যাচ্ছে। ফায়াজ শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে।
….আন্টি কান্না করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে ঝুমুরের কিছুই হবে না। চিকিৎসা নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
হাসিব ঝুমুরের মায়ের কাছে এসে বলে…
…আন্টি ঝুমুরের কিছু হবে না আমি আছি তো।
কথাটা বলে ডাঃ ফায়াজকে বলে…
…ভাইয়া ঝুমুর কি জানে ওর কি হয়েছে
…ঝুমুর জানে ও হয়তো বাঁচবে না এমন কোনো রোগ হয়েছে তার কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হতে রাজি হচ্ছে না বাড়ির অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে কিছুই করবে না।
…ভাইয়া আপনি সব ব্যবস্থা করেন ঝুমুরকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাবো আমি।যা কিছু করা দরকার সব করবো।কথাটা বলে হাসিব চলে গেলো
ফায়াজ সবাইকে বলে দিলো ঝুমুরের সামনে এসব নিয়ে কেউ যেন কান্নাকাটি না করে। সবাই যেন স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে।
বাড়িটা কিছুক্ষনের মধ্যে নিস্তব্ধ হয়ে হয়ে গেলো।হাসিব ওর মায়ের কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।ছেলের এই অবস্থা দেখে মা খুব বিচলিত হয়ে পড়ে …
….হাসিব কি হয়েছে তোর এমন করছিস কেন?
….মা ঝুমুর
…কি হয়েছে ঝুমুরের?
…মা ঝুমুরের ব্রেইন টিউমার ধরা পড়েছে। ওর কিছু হলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না।আমি ওকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যেতে চাচ্ছি।ওকে বাঁচাতে হবে।
….আমার দোয়া সব সময় তোর সাথে থাকবে।তুই কখনো ভুল করবি না সেটা আমি জানি। ঝুমুরের জন্য যা কিছু করতে হয় সব করবি।চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।
এদিকে ঝুমুর ছাদে বসে আলপনা আঁকা শেষ করে নিজের রুমে চলে আসলো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। চুপচাপ শুয়ে থাকলো আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুম এসে গেলো
দুপুরে ঝুমুরের দুই চাচা বাড়িতে আসলে ওদেরকে বিষয় টা জানিয়ে দেয় ঝুমকার মা। ঝুমকার মায়ের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ঝুমকার বিয়ে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই।
দুই চাচাই চিন্তা করছে এখন কি হবে যতই হোক ঝুমুর এই বাড়ির মেয়ে। ঝুমুরের এমন কিছু হোক এটা কেউ চায় নি।দুই চাচা মিলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এখন কি করা যায়।
ঝুমুরের রুমে ওর মা এসে দেখে ঝুমুর ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ঝুমুরের মায়ের চোখের পানি টপটপ করে পড়তে লাগলো।আমার মেয়েটার কেন এমন হলো। আমার মেয়েটা ছাড়া যে আমার আর কেউ নেই। আল্লাহ আমার মেয়েটাকে ভালো করে দাও।
চোখের পানি মুছে ঝুমুরকে খাওয়ার জন্য ডাক দিলো। ঝুমুর ঘুম থেকে উঠে বসে যায়। মাকে দেখে চিন্তিত হয়ে বলে…
….মা কি হয়েছে তোমার চোখ এমন ফুলে আছে কেন?কিছু হয়েছে?
….না কিছু হয়নি। এতক্ষণ কেউ ঘুমায় কয়টা বাজে দেখ।ফ্রেশ হয়ে নেয় খেতে হবে তো নাকি
…আচ্ছা
হাসিবের বাবা আসলে হাসিব বাবাকে সব খুলে বলে আর বলে দেয় ঝুমকাকে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব না।হাসিবের বাবা প্রথমে অনেক রাগারাগি করলেও এক পর্যায়ে ছেলের জিদের কাছে হার মেনে নিলো।
ঝুমুর বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের দিকে গিয়ে দেখলো হাসিব সেখানে বসে আছে
ঝুমুরকে দেখে হাসিব বলে…
….কখন থেকে অপেক্ষা করছি এতক্ষণ লাগলো আসতে
ঝুমুর কিছুটা দুষ্টমী করে বলে…
…আমি যদি জানতাম আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন তাহলে অনেক আগেই চলে আসতাম
হাসিব ঝুমুরের কাছে এসে ঝুমুরের হাত ধরে বলে…
…ঝুমুর কাল থেকে তোমার আর আমার নতুন করে পথ চলা শুরু। শুধু আমাকে বিশ্বাস করো। আমি সব সময় তোমার পাশে থাকতে চাই দূরে সরে দিও না প্লিজ
ঝুমুর অবাক হয়ে হাসিবের কথা গুলো শুনছে কি বলছে হাসিব এসব।
….মানে কি? আমি ঠিক বুঝলাম না
…ঝুমুর তুমি আমার সাথে সিঙ্গাপুর যাচ্ছো আর কাল থেকে আমাদেরকে সেই প্রস্তুতি নিতে হবে।বেশি দেরি করা যাবে না।
ঝুমুর বেশ অবাক হয়ে হাসিবের দিকে তাকিয়ে আছে। হাসিব ঝুমুরকে সব কিছু খুলে বলে।
ঝুমুর বলে…
…ফায়াজ ভাইয়া আসছিলো,এত কিছু হয়ে গেলো আর আমি কিছুই জানতে পারলাম না।
….তুমি সত্যি বোকা একটা মেয়ে। নিজের কথা চিন্তা না করে তুমি ঝুমকার বিয়ে নিয়ে চিন্তা করেছো।অথচ একবারও জানতে ইচ্ছে হয়নি আমি সত্যি কি ঝুমকাকে বিয়ে করতে চাই।আমি তোমাকে ভালোবাসি,সারাদিন তোমার পিছনে পড়ে থাকি, সব সময় তোমাকে নিয়ে ভাবি কেন একটুও জানতে ইচ্ছে করে নি? কিভাবে পারলে এত বড় সিদ্ধান্ত নিজে নিজে নিতে?অনেক ছেলেমানুষী দেখিয়েছো এখন থেকে আমি যা করতে বলবো ঠিক সেটাই করবে।কাল থেকে আমাদের যাত্রা শুরু।
….কিন্তু ঝুমকা
….কাউকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, সবাই সব কিছু জানে।এখন থেকে তুমি শুধু আমাকে নিয়ে ভাববে
ঝুমুরের কাছে সব কিছু যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। নতুন করে পথ চলা প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে এগিয়ে চললো ঝুমুরের নতুন জীবন।
ঝুমুরের চিকিৎসা চলছে এখন অনেকটাই সুস্থ আছে আর সব সময় হাসিব ওর সাথেই আছে এক মুহুর্তের জন্যও ঝুমুরকে ছেড়ে হাসিব কোথাও যায় না।ভালোবাসার সমাপ্তি এভাবেই ঘটলো।
সমাপ্ত।