প্রিয়মুখ পর্ব-১৪+১৫

0
433

#প্রিয়মুখ
#ফারিহা_জান্নাত
#পর্ব১৪

ঝুমুর বাড়িতে এসেই পুকুরপাড়ে চলে গিয়ে পানিতে পা ডুবিয়ে পানির দিকে তাকিয়ে একমনে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছে আর ভাবছে…

রিপোর্টে কি আসবে আমি জানি না কিন্তু আমার এত অস্থির লাগছে কেন?আমার যদি সত্যি খারাপ কিছু হয়ে থাকে মায়ের কি হবে, মাকে কে দেখবে? হাসিব আমার উত্তরের অপেক্ষায় আছে কি বলবো আমি হাসিবকে?আমার ভাগ্যে কি আছে জানি না।

এদিকে হাসিব ঝুমুরকে সকাল থেকে খুঁজতে ছিলো। পুকুরপাড়ে এসে দেখে ঝুমুর পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে।

…ঝুমুর

ঝুমুর এতটাই আনমনা হয়ে ছিলো যে হাসিবের কথা শুনতে না পেয়ে আগের মতোই বসে আছে

হাসিব আবারও ডাক দিলো…

…ঝুমুর কি হয়েছে তোমার?

ঝুমুর হঠাৎ হাসিবের গলার আওয়াজ শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখে হাসিব দাঁড়িয়ে আছে।

….আপনি এখানে কি করেন?

….তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম(মুখে দুষ্ট একটা হাসি দিয়ে)
…তাহলে এবার বলেন কেন খুঁজছিলেন?

….তোমাকে না দেখলে যে আমার ভালো লাগে না এজন্য (ঝুমুরের পাশে বসে)

ঝুমুর কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।

…ঝুমুর আমি কি তোমার মন খারাপ করে দিলাম?

ঝুমুর হাসিবের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে…

….কি করে বলি তোমাকে তুমি পাশে থাকলে আমার কতটা ভালো লাগে। সব ভালো লাগার মাঝে যে তোমাকেই খুঁজে পাই।

হাসিবের থেকে চোখ নামিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলে…

…না মন খারাপ হয়নি আমার।

…সত্যি বলছো? আচ্ছা তাহলে কি তুমি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছো ঝুমুর

….ভালো তো সেই কবে বেসেছি কিন্তু সময়গুলো যে বড্ড অসময় হয়ে যাচ্ছে হয়তো সেই কারণে কখনো বলা হবে না তোমাকে আমি ভালোবাসি কথাগুলো নিজের মনের সাথেই বলে গেলো।

ঝুমুরকে চুপ থাকতে দেখে হাসিব হেসে দিয়ে বলে..

….আমি জানি একদিন তুমি আমাকে ঠিকই বলবে আর আমি তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।

দুজনের কথার মাঝে হঠাৎ ঝুমকা চলে আসলো।ঝুমকা আসাতে হাসিব বিরুক্তবোধ করতে লাগলো।দুজনকে এক সাথে কথা বলতে দেখে ঝুমকারও ভীষণ রাগ হতে লাগলো কিন্তু মুখে কিছু না বলে দুজনকেই উদ্দেশ্য করে বলে…

…আমি আসাতে কি তোমরা বিরুক্ত হয়েছো?

….একদম না ঝুমকা তুই আসাতে বিরুক্ত হবো কেন?

….না এমনিতেই বললাম। তুমি বিরুক্ত না হলেও মনে হয় আরেকজন হয়েছে।

হাসিব ঝুমকার কথা শুনে চলে যেতে লাগলো..

….ঝুমকা তোমরা দুই বোন গল্প করো আমি যাই

ঝুমুর ঝুমকার মনের অবস্থা বুঝতে পারে। ঝুমুর জানে এসব কথা বড় চাচীকে গিয়ে ঠিকই বলবে।তাই ঝুমুর নিজের থেকেই সরে যেতে চাইলো…

….তোর হবু বর কিছু দিন পরই তো তোদের বিয়ে হচ্ছে তাই রাগ অভিমান সব মিটিয়ে নেয় আমি বরং যাই।তোরা থাক।
কথাটা শেষ করে ঝুমুর ওখান থেকে চলে আসলো।

হাসিব কিছুই বুঝতে পারলো না ঝুমুরের এভাবে হঠাৎ চলে যাওয়ার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে। শুধু হা করে ঝুমুরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো।

ঝুমুর নিজের রুমে এসে শুয়ে শুয়ে অনেক কিছু ভাবনার মাঝে অনেক প্রশ্নের জোট বাঁধতে শুরু করেছে। কালকে রিপোর্টে কি আসবে এই নিয়ে ভেবেই চলছে।

চলবে…

#প্রিয়মুখ
#ফারিহা_জান্নাত
#পর্ব১৫

ঝুমকা হাসিবের পাশে বসে হাসিবকে উদ্দেশ্য করে বলে..

….আমি তো ভেবেছিলাম আপনি কথা কম বলেন কিন্তু আপুর সাথে তো দেখলাম বেশ ভালোই কথা বলছেন ব্যাপারটা কি বলেন তো(খুব রেগে গিয়ে)

…এত তাড়াতাড়ি জানার কি আছে, সময় হলে সব কিছু নিশ্চয়ই জানতে পারবে(বিরুক্ত হয়ে)

….আমাকে এখুনি বলতে হবে

….দেখো ঝুমকা এখানে রাগ করার মতো কিছু হয় নি।শুধু শুধু সিনক্রিয়েট করবে না

…. আমি এখুনি জানতে চাই আমি আপনার হবু বউ তাই সব কিছু জানার অধিকার আমার আছে(হাসিবের দিকে তাকিয়ে বলে)

….ঝুমকা প্লিজ ঝগড়া করো না। ভালো লাগছে না আমার(নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করেই যাচ্ছে হাসিব)

….আমি ঝগড়া করছি আপনার সাথে? আর আপু বুঝি আপনাকে সোহাগ করছিলো

কথাটা বলার সাথে সাথে হাসিব ঝুমকার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলে….

….ঝুমুরের সম্পর্কে যদি একটা বাজে কথা বলো তাহলে আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবে না।(হাসিবের রাগ চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো)

কথাটা শেষ করেই হাসিব চলে গেলো

ঝুমকা ভাবতেও পারে নি হাসিব এমন কিছু একটা করবে তাই গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে হাসিবের দিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পর কাঁদতে কাঁদতে ঝুমকা ওর মায়ের কাছে গিয়ে ঝুমুর আর হাসিবের কথা বলে ওখানে ছোট চাচীও উপস্থিত ছিলো …

…মা আমি হাসিবকে বিয়ে করতে পারবো না। ওই ছেলের সাহস হয় কি করে আমার গায়ে হাত তোলার?

ছোট চাচী মনে মনে অনেক খুশি হলো

….এত দিন পর হাসিবের বুদ্ধি হলো তাহলে।একটা চড় না দিয়ে আরও কয়েকটা চড় দেয়া দরকার ছিলো কিন্তু ঝুমুরকে তো বড় ভাবী আস্ত রাখবে না মেয়েটাকে তো বাঁচাতে হবে বিড়বিড় করে বললো কথাগুলো

….কি রে সাজদা বিড়বিড় করে কি বলছিস স্পষ্ট করে বল(রেগে গিয়ে ঝুমকার মা)

….বলছিলাম কি ভাবী ঝুমকাকে বুঝাও হাসিবের মতো এত বড়লোকের ছেলে এত হ্যান্ডসাম ছেলে কোথায় পাবো আমরা বলো। ঝুমকার মতো এত রাগী মেয়েকে কখনো আমরা এত বড়লোকের ঘরে বিয়ে দিতে পারবো না।তাই ধৈর্য ধরতে বলো শুধু বিয়েটা হতে দাও তারপর হাসিবকে বিড়াল বানিয়ে রাখতে পারবে আমাদের ঝুমকার এই যোগ্যতা অবশ্যই আছে। ঝুমকাকে ছোট করে বলছি না ভাবী যা সত্যি তাই বলছি পরে কিন্তু পস্তাতে হবে।

….ঝুমুর আপুর সাথে হেসে হেসে কথা বলে আর আমাকে সব সময় এড়িয়ে চলে(কান্না জড়িত কন্ঠে)

….ঝুমুরের সাথে হেসে হেসে কথা বলুক আর না হয় নেচে নেচে কথা বলুক তোর কি সমস্যা বুঝলাম না।বিয়ে তো তোর সাথেই হবে তাহলে ওদেরকে নিয়ে এত ভাবছিস কেন? বিয়ের কেনাকাটা শেষ।মাত্র কয়েকদিন বাকি আছে বিয়ে হবার এর মধ্যে তুই কোনো ঝামেলা করিস না ঝুমকা।আর সব সময় হাসিবের পিছনে না পড়ে থেকে ওর বাবা মা বোনের দিকে খেয়াল কর।ওরা ঠিক থাকলে হাসিব এমনিতেই ঠিক থাকবে। ভাবী তুমি ঝুমকাকে বুঝাও তো এত বোকামি করলে পরে হাসিব হাতছাড়া হয়ে যাবে।

ঝুমকার মা ভেবে দেখলো ঝুমকার চাচীর কথায় ঠিক কয়েকদিন পর বিয়ে এখন ঝামেলা না করায় ভালো হবে…

….ঝুমকা তুই আর কোনো ঝামেলা না করে এই কয়েকটা দিন চুপ করে থাক

….কিন্তু মা

ঝুমকার মা ঝুমকাকে থামিয়ে দিয়ে বলে..

…আর কোনো কিন্তু নেই সময়ের জন্য অপেক্ষা কর।সব ভুলে যা। হাসিবকে নিয়ে পড়ে থাকিস না ওর মা বোনের দিকেও একটু খেয়াল রাখ।সব সময় জিদ না করে বুদ্ধি দিয়ে চলার চেষ্টা করবি।তোর চাচী তো ঠিকই বলেছে।

এখন যা আমার কাজ আছে।

ছোট চাচী মনে মনে খুশি হয়ে বললো…

এবারের মতো বাঁচাতে পারলাম মেয়েটাকে।উফফ এত প্যাঁচ জানে ঝুমকা।হাসিব ঝুমকাকে বিয়ে করা মানে সারাজীবন বউয়ের গোলামী করে যাওয়া।

ঝুমকা নিজের রুমে চলে গেলো আর ভাবতে থাকে চাচী আর মায়ের কথাগুলো নিয়ে
নিজে নিজে বলে…

…. মা আর চাচী যা বলেছে ঠিক কথায় বলেছে সব সময় রাগ না দেখানোই ভালো। ধুর বোকামি করে ফেললাম। বিয়ে তো আমার হাসিবের সাথেই হবে। (এক গাল শয়তানি হেসে দিয়ে বলে)

ওদিকে ঝুমুর ঘরে বসে বসে শুধু রিপোর্ট নিয়েই ভাবছে কাল কি হবে, রিপোর্টে কি থাকবে ভালো কিছু থাকবে নাকি খারাপ কিছু। যদি ভালো কিছু হয় তাহলে তো সব কিছু ঠিক থাকবে আমি সব কিছু নতুন করে আবারও শুরু করতে পারবো হয়তো আমার স্বপ্নগুলো নিজ হাতে সাজাতে পারবো। আর যদি খারাপ কিছু হয় আমার যে সব শেষ হয়ে যাবে….

নাহ আর ভাবতে পারছে না ঝুমুর, টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো।

দিন গিয়ে রাত হলো ঝুমুর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর আকাশের তারা দেখছে,তারাগুলো কেমন জানি এলোমেলো হয়ে আছে, চাঁদের আলো কেমন জানি মলিন দেখাচ্ছে।কেন এমন হচ্ছে? আজকে কেন এমন লাগছে? প্রকৃতির এমন রুপ আগে তো কখনো দেখি নি।ঝুমুরের বুকের মধ্যে এক অন্য রকম ভয় কাজ করছে।জানালা থেকে সরে বিছানায় গিয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না।

হাসিব বারান্দায় গিয়ে ঝুমুরকে নিয়ে ভাবছে। আর বলছে….

….ঝুমুর প্লিজ আমার জীবনে তাড়াতাড়ি ফিরে আসো।তুমি ছাড়া সব কিছুই যে অপূর্ণতা লাগছে। শুধু একবার বলো আমাকে তুমি ভালোবাসো।তোমার ভালবাসায় যে আমার ভরসা।

শেষ রাতের দিকে ঝুমুরের চোখে ঘুম আসে।

ভোরের আলো ফুটতেই ঝুমুরের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়।সকালের নাস্তা না খেয়ে কাউকে কিছু না বলে বের হয়ে পড়ে। খালি রিকসা একটা দেখে মামা যাবেন বলে রিকসার উপর উঠে বসে পড়লো উদ্দেশ্য ডাঃ ফায়াজের চেম্বার।

মনের ভিতর হাজার ভয় জমা হতে লাগলো।সাহস যেন হারিয়ে ফেলছে। দুঃশ্চিতা গুলো ভর করতে লাগলো।অবশেষে ডাঃ ফায়াজের চেম্বারের কাছে এসে রিকসা থামলো।আজকে কেন জানি ফায়াজের চেম্বারে ডুকতেই বুকটা কেঁপে উঠলো ঝুমুরের। আজ চেম্বারে ঝুমুর ছাড়া কেউ নেই। আসলে আজ ঝুমুর অনেক তাড়াতাড়ি আসলো। ডাঃ ফায়াজও আসলো একটু আগে। ঝুমুর ফায়াজের রুমে ডুকতেই…..

…আরে ঝুমুর যে বস এখানে,এত সকাল সকাল। রাতে ঘুম হয়নি বুঝি (চেয়ার একটা টেনে ফায়াজের কাছে বসালো)

….ভাইয়া আমার রিপোর্ট (কাঁপা কাঁপা কন্ঠে)

ডাঃ ফায়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে…..

….ঝুমুর তোকে রিপোর্ট দেখানো আমার উচিত হবে না।আমি ডাক্তারের আগে তোর ভাই।

….ভাইয়া তুমি একজন ডাক্তার আর একজন ভাই। আমার ভাগ্যে যা আছে তাই তো হবে। তুমি ডাক্তার না একজন ভাই হিসেবে বোনকে তো সব বলতে পারো।

….আমি তোর ভাই বলেই তো তোকে কিছু বলতে পারছি না।অন্য কোনো রোগী হলে হয়তো বলতে পারতাম তার রোগের কথা কিন্তু নিজের আপনজনদের কি করে বলবো আমি।

….ভাইয়া আমার কি খারাপ কিছু হয়েছে?

….ঝুমুর তুই তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নেয়।যা যা করতে হয় সব আমি করবো কিন্তু তুই দেরি করিস না।ভয় পাবি না, আমি তো আছি তোর কিছুই হবে না।

ঝুমুর কিছুটা হলেও বুঝতে পারলো চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে থামানোর বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। পৃথিবী যেন উল্টে গেলো মুহুর্তের মধ্যে।

….ভাইয়া প্লিজ কথাগুলো তুমি কাউকে বলো না, কেউ যেন কিছু জানতে না পারে। আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠান শেষ হোক তারপর না হয় আমি হাসপাতালে ভর্তি হবো।

….ঝুমুর তুই বুঝতে পারছিস না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুই…

ঝুমুর ফায়াজকে থামিয়ে দিয়ে বলে…

….ভাইয়া তুমি বুঝতে পারছো না আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। তুমি না বললেও আমি বুঝতে পারছি আমি হয়তো আর বেশিদিন বাঁচবো না হয়তো আমার খারাপ কিছু হয়েছে কিন্তু আমি এখন হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবো না ভাইয়া।

কথাগুলো বলে ঝুমুর রিপোর্ট গুলো টেবিলের উপর রেখে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে গেলো….

চলবে….