প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই পর্ব-৩৫ এবং শেষ পর্ব

0
657

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৩৫ (সমাপ্তি পর্ব)

সন্ধ্যের মাঝামাঝি সময়। দিন ছোট হওয়াতে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে চারপাশে। আবহাওয়ার মর্জি বোঝা দায়। আজকাল আবহাওয়া বদলে যাওয়ার কারণে অনেক পরিবর্তনই প্রকৃতিতে লক্ষ্য করা যায়। এই রাস্তাটা একেবারেই নির্জন। মা বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাবা ফোন করে বলেছে বাড়ি ফিরতে। চিনিশপুরে নিজের বান্ধবীর বাসায় এসেছিলো নাদিয়া। মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে মনটা মানেনি তার। বান্ধবীর বড় ভাই সজীবের সাথেই বেরিয়ে পড়ে সে। সজীব তাকে বাড়ি দিয়ে আসবে। দুপাশে ধানক্ষেত মাঝে পাকা রাস্তা। দূরে রেললাইন। ট্রেন যাচ্ছে। ধানক্ষেতের পাশে আবার কলা ক্ষেতেরও দেখা মিলে। সজীবের মোটরসাইকেলের পিছনে বসে আছে নাদিয়া। সজীব রাজনীতি করে। পাড়ার বিরোধী দলের ছেলেপেলেদের সাথে সাপেনেউলে সম্পর্ক। দূর থেকেই আবছায়ায় কয়েকজন ছেলেদের দেখতে পাচ্ছে নাদিয়া। টিনের একটা ঘরের মতন। সামনে বাঁশ দিয়ে বসার জায়গা তৈরি করেছে। উচ্চ শব্দে গান বাজাচ্ছে। মোটরসাইকেল দেখেই তারা বোধহয় বুঝে গিয়েছিল। সজীবের গাড়ি আটকালো তারা। সজীবের সাথে বাক-বিতন্ডা শুরু হলো তাদের। ভয়ে শঙ্কায় চুপ করে মোটরসাইকেলে বসেছিলো নাদিয়া। এক পর্যায়ে মা রা মা রি শুরু হলো। সজীবকে মে রে তারা র ক্তা ক্ত করে দিয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে মোটরসাইকেল থেকে নেমে দৌড় দিতে চাইলো নাদিয়া। তা আর সম্ভব হয়নি। তাকে টেনে হিঁচড়ে কলা ক্ষেতে নিয়ে গেলো হায়নার দল। খামছে ছিঁড়ে ফেললো শরীরের বস্ত্র। কতশত চিৎকার করেছে নাদিয়া। তারা থামেনি। এক সময় নাদিয়া শান্ত হয়ে পড়ে। তীব্র যন্ত্রণায় নিস্তেজ হয়ে যায় তার শরীর। কালো কুচকুচে আকাশটার পানে তাকিয়ে নাদিয়া অনুভব করে সে ভুল করেছে। শাহবাজের সাথে সে ভুল করেছে। সেই ভুলের মাশুল হয়তো আজ তাকে দিতে হচ্ছে। গলায় ছু’রি চালিয়ে হ’ত্যা চেষ্টা করা হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে আছে নাদিয়া। তবে এই জীবন বড়ই য ন্ত্র ণার জীবন। নাদিয়া মুক্তি খুঁজে বেড়ায়। দম বন্ধ হয়ে আসে তার। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বুকে চাপ লাগে। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করেনা। কয়েকজন পুরুষের হা য় নার মতো থাবায় আজ নাদিয়া নিষ্প্রাণ। আজ নাদিয়ার জীবন শেষ। সামান্য সুস্থ হওয়ার পর বাবা-মাকে সত্যিটা জানিয়েছে নাদিয়া। নাজমা মেয়ের এ দশায় এমনিতেই আধপাগল হয়ে গিয়েছেন। আবার এসব কথা মেয়ের মুখে শুনে তিনি হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন। সেই সঙ্গে অনুতপ্ত। তবে শাহবাজ, প্রিয়াঞ্জনার ঠিকানা তিনি জানেন না। জানলে হয়তো গিয়ে ক্ষমা চাইতেন।

সমস্ত জায়গা-জমি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে প্রীতম। জোহরার সাথে তার সম্পর্ক খুবই খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মা ছেলের দুদিন পরপরই ভয়াবহ ঝ গ ড়া হচ্ছে। প্রীতম এতটাই হিং স্র হয়ে যাচ্ছে দিনদিন যে মাকে আ ঘা ত করতেও সে দুবার ভাবছেনা। জোহরা বেগম নিজের জীবন নিয়ে আফসোস করেন। তার জীবনটাই ছিলো ভুলে ভরা। সারাজীবন নিজের জেদ কে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। আর আজ শেষ বয়সে তিনি অনুতপ্ত। ভিষণ অনুতপ্ত। শাহবাজ তার সাথে কথা বলেনা। প্রিয়াঞ্জনা অবশ্য ফোন দেয়৷ টাকা পয়সাও দেয়। খোঁজ খবর নেয়। তবে আগের মতো অতিরঞ্জিত মা প্রীতি তার নেই। হয়তো প্রাপ্তির মৃ’ত্যু এর পিছনের কারণ। প্রীতম চাকরি হারিয়েছে। এখন বাজারের দোকানে বসে। বিশাল দোকান। মজনু নামের এক কর্মচারীও তাকে সাহায্য করে। সে কিছুক্ষণ আগে জোহরা বেগমকে ফোন করে জানিয়েছে প্রীতমের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাকে পুলিশ দোকান থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছে। জোহরা বেগমকে তেমন বিচলিত দেখালো না। কেবল স্বর্ণাকে নির্লিপ্ত কন্ঠে জানিয়েছেন। স্বর্ণা তেমন কোনো জবাব দিলো না। নিজের মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। প্রীতমের প্রতি তার বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। জোহরা বারান্দায় দাঁড়ালেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রীতমকে কোনো প্রকার সাহায্য করবেন না। দূরে শ্যাওলাঘন এক পুকুর দেখা যায়। হঠাৎ করে একটা দমকা হাওয়ায় কেঁপে উঠলেন জোহরা। খেয়াল করলেন পুকুর থেকে প্রাপ্তি উঠে শূন্যে ভাসছে। তার দিকে এগিয়ে আসছে। মুখে ডাকছে, “মা, মা, মা”
মুখে হাসি।
চোখ মেললেন জোহরা। মাগরিবের আজান দিচ্ছে। বারান্দার ফ্লোরে কখন শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন টের পাননি। একটা বিষয় খেয়াল করলেন তিনি প্রাপ্তি এবং প্রবীরকে মাঝে মাঝেই দেখতে পাচ্ছেন। এটা অবশ্যই তার মনের ভুল। দিনদিন তার নিজেকে কেমন যেন পাগল পাগল মনে হয়। খেতে গেলে, ঘুমাতে গেলে তিনি অশরীরী কেউ পাশে আছে অনুভব করেন। তার ভয় হয় এখন। তিনি চিৎকার করে উঠেন। স্বর্ণার মতে তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। জোহরা ভয় পান। চুল ছেড়ে রাখেন। শরীরের ঠিক মতো খেয়ালও রাখেন না৷ তিনি হলফ করে বলতে পারেন তিনি পাগল হননি। তিনি বাস্তবেই প্রাপ্তি, প্রবীরকে দেখতে পান। তাকে ডাকে, তাকে অভিশাপ দেয়, তাকে নিয়ে যেতে চায়। আজকাল স্বর্ণা বাধ্য হয়েই জোহরাকে ঘরে আটকে দিচ্ছে। তিনি কিছুসময় পাগলামি করেন। আবার ঠিক হয়ে যান!

একটি অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছে। শাহবাজ ব্যবসায়িক কাজে কলকাতা গিয়েছিলো। সিটি সেন্টার টু এর সামনে হঠাৎই একজন বৃদ্ধ মুখ ঢাকা অবস্থায় তার সামনে এসে দাঁড়ান। বৃদ্ধ হয়তো খেয়াল করেননি। ভি ক্ষা চেয়ে বসেন,
“বাবু, সকাল থেকে কিছু খাইনি। কিছু টাকা দিন। ভগবান আপনার মঙ্গল করবেন।”

গলার স্বর পরিচিত লাগলো শাহবাজের। সে ভালো করে চাইলো বৃদ্ধের পানে। ময়লা একখানা ধূতি আর বহুদিনের পুরাতন একটি শার্ট পরনে। শাহবাজ অবাক কন্ঠে বলে উঠে,
“জামাল চাচা?”

বৃদ্ধ আর একমুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়ান নি। উল্টোপথে হাঁটা দিলেন। একপ্রকার দৌড়ই বলা চলে। শাহবাজ পিছু নিলো। একসময় ধরে ফেললো। বৃদ্ধও ক্ষান্ত হলেন। হাঁপানি উঠে গেছে তার। কথাও বলতে পারছেন না। চলতেও পারছেন না। শাহবাজ একটি পানির বোতল কিনলো পাশের দোকান থেকে। বৃদ্ধের হাতে দিলো। পানি পান করে জামাল হু হু করে কান্না করে দিলেন। শাহবাজের মায়া হয়নি। হয়েছে করুণা। সে সাথে তার কিছু প্রশ্নের জবাব চাই। সে বললো,
“আসেন চায়ের দোকানটায় বসি। কাঁদবেন না। আমি আপনাকে কিছু করবো না।”
চায়ের দোকানে বসলো তারা। বৃদ্ধকে চা, রুটি দেওয়া হলো। তিনি অভুক্তের মতো খেলেন। শাহবাজ বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলো। কোটি কোটি টাকা বিশ্বাসঘা ত কতা করে নিয়ে এসেও আজ এমন ভিক্ষুকের জীবন কাটাচ্ছে! হিসেব মিলছে না তার। জামালের খাওয়া শেষ। সোজা প্রশ্ন করে শাহবাজ,
“কেন এমন করলেন? আমি তো আপনাদের বিশ্বাস করেছিলাম?”
জামাল নরম কন্ঠে বললেন,
“ক্ষমা করে দিও শাহ্। আমরা পাপ করেছি। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত এখন করছি। আমার ছেলে হয়ে ফারুক এমন কাজ করবে আমি ভাবতেও পারিনি। সে আমাদের কলকাতায় ফেলে সব টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। ভিসা জটিলতায় দেশেও ফেরত যেতে পারছিনা। ফারুকের কাছে ছিলো সব কাগজপত্র। এখন দেশে ফিরতে অনেক টাকা লাগবে। যা আমাদের নেই। মানবেতর জীবনযাপন করছি।”
“কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ ভালো থাকতে পারেনা।”
তাচ্ছিল্যের সাথে বললো শাহবাজ। জামাল আবার কেঁদে দিলেন। শাহবাজ কোনো সান্ত্বনা দিলো না। মুখে বললো,
“আপনি তো শিক্ষিত মানুষ। ভি ক্ষা না করে অন্য কাজও তো করতে পারেন?”
জামাল জবাব দিলেন না। শাহবাজের ডান হাত আঁকড়ে ধরে অনুরোধের সুরে বললেন,
“তুমিই আমাদের সাহায্য করতে পারো শাহ্। আমাদের দেশে ফিরার একটা ব্যবস্থা করে দাও।”

হাত ছাড়িয়ে নিলো শাহবাজ। এত বিপদের মুখে তারা শাহবাজকে ফেলে দিয়ে এসেছে। কতটা মানবেতর জীবন সে পাড় করেছে তারা জানে! বিশ্বাস ঘা ত কদের পুনরায় বিশ্বাস করতে নেই। শাহবাজ বলে,
“আমি পারবোনা চাচা। ভালো থাকবেন।”

বলেই শাহবাজ চলে আসে। সেদিন রাতে ফ্লাইট ছিলো। তারপর সোজা বাংলাদেশ। কি অদ্ভুত মানুষের জীবন! কি নি ষ্ঠুর সৃষ্টিকর্তার বিচার!

শরীফ জামান সাহেব, শাহবাজ, আলো, প্রিয়াঞ্জনা, রিমন, সুফিয়া তাদের ছেলে সবাই মিলে ছুটি কাটাতে কক্সবাজার এসেছে। এমনিতে শাহবাজ আর রিমন এত ব্যস্ত থাকে! শ্বাস ফেলবার সময়ও তাদের নেই। তাই এই ঘুরতে আসা। জীবনে এমন দু একটা ট্রিপ অনেক দরকার।
হোটেল অভিসারে উঠেছে তারা। কি যে সুন্দর চারপাশ! আলোকে প্রিয়াঞ্জনা একটা গোলাপি ফ্রক পরিয়েছে, চোখে মোটা করে কাজল দিয়ে দিয়েছে। ইস্! কি যে মিষ্টি দেখতে! শাহবাজ ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয় মেয়ের কপালে। চোখ আর্দ্র হয়ে আসে। বারান্দায় মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। দূরে উত্তাল সমুদ্র। সূর্য ডোবার মুহূর্তে অভাবনীয় লাগছে দেখতে। লালচে আকাশ। সূর্যটা সমুদ্র ছুঁই ছুঁই। পানিতে সোনালি আলোর ঝলকানি। শব্দ ভেসে আসছে কানে। স্রোতের শব্দ। শাহবাজ মেয়েকে আঙুল উঁচিয়ে দেখায়,
“মা, ঐ দেখো সমুদ্র। যাবা তুমি, মা?”

আলো কি বুঝলো কে জানে! বাবার আঙুল যেদিকে সেদিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। প্রিয়াঞ্জনা পাশে এসে দাঁড়ায়। কালো থ্রি-পিস পরনে তার। চুল ছেড়ে রেখেছে। একটু স্বাস্থ্য হওয়ায় কি যে মায়াবী লাগে তাকে! মুখে মাতৃত্বের ছাপ। মেয়েকে কোলে নিয়েই প্রিয়াঞ্জনার গালে চুমু দেয় শাহবাজ। প্রিয়াঞ্জনা চোখ রাঙায়। ঠোঁটে হাসি চেপে রেখে বলে,
“মেয়ের সামনে কি করছেন, শাহ্!”
“মেয়ের মাকে আদর করছি।”
“শাহ্, আপনি না….
” কি আমি?”

প্রিয়াঞ্জনা একপাশে শাহ্কে জড়িয়ে ধরে বলে,
“জানিনা”
“এখন মেয়ের সামনে আদর কে করছে!”
“শাহ্!”

লজ্জা পায় প্রিয়াঞ্জনা। আলো কিছুই বুঝেনা৷ ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে কেবল।

আকাশে চাঁদ নেই। তবে অজস্র তারার মেলা। সমুদ্রের পাড়ে বসে আছে শাহবাজ আর প্রিয়াঞ্জনা। আলো ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন জামান সাহেব বললেন তিনি আলোর খেয়াল রাখবেন। ওরা যেন ঘুরে আসে। তাই নিশ্চিন্তে বেরিয়েছে দুজন। শরীফ জামান সাহেব যে আলোকে অনেক বেশি ভালোবাসেন তা তাদের জানা।

শাহবাজের কাঁধে প্রিয়াঞ্জনার মাথা রাখা। সমুদ্রের পাড়ে উত্তাল বাতাস বইছে। ঢেউয়ের শব্দ কানে আসছে। এককাপ চা শাহবাজের হাতে। এককাপ চায়েই তাদের ভালোবাসার মহাকাব্য আদান-প্রদান হয়। শাহ্ শান্ত কন্ঠে বলে,
“আমি তীর খুঁজে পেয়েছি, প্রিয়াঞ্জনা। আমার প্রতিটি ডুবন্ত মুহূর্তে তুমি পাশে ছিলে। এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না৷”
“আপনি আমার অর্ধাঙ্গ, শাহ্। আমার সব। আমার দুনিয়া। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনি আমার অস্তিত্বে মিশে গিয়েছেন। আমি ঋণী আপনার প্রতি।”
“তাহলে দুইজনের টা কা টা কাটি!”

হেসে উঠে শাহ্। প্রিয়াঞ্জনা একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায় তার। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায় একটি সুর। চিরচেনা সুর।

প্রিয়াঞ্জনা, এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
ডাইনে ও বাঁয়ে আমি তোমাকে চাই
দেখা না দেখায় আমি তোমাকে চাই
না-বলা কথায় আমি তোমাকে চাই…..

(সমাপ্ত)