প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই পর্ব-০৯

0
279

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-০৯
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

ঘরে লোকজন জড়ো হচ্ছে। আজকে নিশ্চিত কোনো অঘটন ঘটবে। প্রীতি হতভম্ব হয়ে ঘরে বসে আছে। তার মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সুমনার মোবাইলও কেড়ে নিয়ে তাকে ঘরে আটকে রেখেছে প্রীতম। শাহবাজকে কল দেওয়া হয়েছিলো প্রীতমের নতুন সিম দিয়ে। যদি প্রিয়াঞ্জনার বাড়ির নাম্বার দেখে ফোন না ধরে তাই। প্রাপ্তি পড়ার টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসে আচার খাচ্ছে। প্রীতির গা জ্বলে যাচ্ছে। আজকে এই অসভ্য মেয়েটার জন্যই সুমনা মা র খেয়েছে। খাটে হেলান দিয়ে বসে তীক্ষ্ণ চোখে প্রাপ্তির পানে তাকিয়ে আছে প্রীতি। এই মেয়েকে কিছুক্ষণ বেত্রাঘাত করতে পারলে তার রাগ কমতো।
“খুশি হয়েছিস না? আপার সংসার ভেঙে যাবে। তোর তো মজাই লাগছে? আপার সাথে কিসের এত শত্রুতা তোর? ফাজিল মেয়ে!”

রাগ দমন করতে না পেরে চিৎকার করে উঠে প্রীতি।
“আস্তে কথা বল। বাইরে মানুষজন আছে। নাকি গলা শুনিয়ে মানুষকে আকর্ষণ করতে চাচ্ছিস?”
“থাপড়ে আমি তোর দাঁত ফেলে দিবো। অসভ্য।”
“বাবা-মা যা করতে চাইছে করতে দে। তারা আপার ভালো চায় প্রীতি।”

প্রাপ্তি কথাগুলো বললো ঠান্ডা গলায়। তরতর করে রাগ বাড়ছে প্রীতির। ছোট বালিশটা ও ছুঁড়ে মারলো প্রাপ্তির দিকে। প্রাপ্তি আবার আচার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। সে তার মায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত। মা যেটাতে হ্যাঁ বলবে তার কাছে সেটাই একমাত্র সঠিক কথা। ভালো, মন্দ বিবেচনা করার ইচ্ছে কিংবা চেষ্টা তার নেই। প্রীতি মাথা চেপে বসে রইলো। তখনই চিৎকার, চেঁচামেচি শোনা গেলো বাইরে।

শাহবাজ দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়াঞ্জনাদের ড্রয়িং রুমে। তার হাতে প্রিয়াঞ্জনার হাত। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে রাখাই ছিলো। ঘরের ভিতরে অনেক মানুষজন বসে আছেন। জোহরা বেগমকে সোফায় বসে থাকতে দেখে দুজনেই বেশ অবাক হয়েছে। প্রিয়াঞ্জনা সারা রাস্তা কান্না করেছে। যার ফলে তার চোখমুখ ভিষণ রকমের লালবর্ণ । শাহবাজের চেহারাও মলিন। জোহরা এক লাফে বসা থেকে উঠে এসে প্রিয়াঞ্জনার হাত শাহবাজের হাত দেখে ছাড়িয়ে নিলেন। তিনি যে অত্যধিক রেগে রয়েছেন তা স্পষ্ট তার মুখাবয়বে। মুখে তিনি একটি কথাও বলছেন না। শাহবাজ বিস্মিত, হতভম্ব। তাদেরকে তাহলে মিথ্যা বলে আনা হয়েছে। জোহরা প্রিয়াঞ্জনার হাত মুচড়ে ধরে আছেন। শাহবাজ অর্ধাঙ্গীর চোখেমুখে ব্যথা দেখতে পাচ্ছে। সে প্রতিবাদ করতে নিলেই প্রীতম আর তার বন্ধু সজিব শাহবাজকে থামায়।
“অনেক হইছে আপনার নাটক। আমার বোনের ভালোটা আমাকে বুঝতে দেন।”
“ও আমার স্ত্রী। তোমার চাইতে অধিকার আমার কয়েকগুণ বেশি।”

জোহরা চিৎকার করে উঠলেন।
“চুপ করো, কাপুরুষ কোথাকার। আমার মেয়েরে সুখে রাখার মুরদ তোমার নাই।”
“মা!”

প্রিয়াঞ্জনা প্রতিবাদ করতে নিলে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দেন জোহরা।
“আমার স্ত্রীর গাঁয়ে আপনি এভাবে বারবার হাত তুলতে পারেন না মা। আমি সমস্যায় পড়ে আমার স্ত্রীকে এখানে রেখেছি। এরমানে এই নয় আপনারা যা নয় তাই করবেন।”
“তোমার তো পুরুষত্বেই সমস্যা। তুমি আবার বড় বড় কথা বলছো!”

প্রবীর ধমকালেন জোহরাকে।
“থামো, জোহরা। লোকজন আছে।”
“থাকুক, সবাই শুনুক। মেয়ের বিয়ে দিছি চার বছর। এখনো বাচ্চা-কাচ্চা আসে নাই ঘরে। আমার মেয়ের সব পরীক্ষা আমি করাইছিলাম। ওর কোনো সমস্যা নাই। তাহলে বাচ্চা হয়না কেন! প্রিয়া একটা বাচ্চার জন্য কাঁদে কেন? এর থেকেই বুঝা যায় এই ছেলের মাঝেই কোনো সমস্যা আছে!”

লজ্জা আর রাগে শাহবাজ কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। প্রিয়াঞ্জনা ছলছল নয়নে তার পানে চেয়ে আছে। যেন মায়ের বলা কথার জন্য সে ক্ষমা চাচ্ছে। পুরুষ মানুষের কোন কথাটা সবচেয়ে বেশি আঘাত লাগে তা বোধহয় ভালো করেই জানেন জোহরা। আর তাই ভরা মজলিসে সবার সামনে শাহবাজের পুরুষত্ব নিয়ে কথা বললেন তিনি। সারা ঘরময় নিরবতা। শাহবাজ মুখ খুললো কিছুক্ষণ পর।
“অনেক বলে ফেললেন। আপনাকে আমি মায়ের স্থানে বসিয়ে ছিলাম। তবে আমার বোধহয় মা ভাগ্য খারাপ। প্রিয়াঞ্জনা চলো। এখানে আর এক মুহূর্তও নয়।”
“খবরদার। আমার মেয়ে কোথাও যাবেনা।”

প্রিয়াঞ্জনা নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। গলা দিয়ে কোনো শব্দ তার বের হচ্ছেনা। জোহরা শক্ত করে প্রিয়াঞ্জনার হাত ধরে আছেন। আজ যেন কোনো দানবীয় শক্তিতে ভর করেছে তাকে।
“আমার স্ত্রীকে ছাড়েন। আমি ওকে নিয়ে চলে যাবো।”

“সেটাতো হবেনা ভাই।”

প্রীতম আর সজিব এসে শাহবাজের সামনে দাঁড়ায়। শাহবাজের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। চিৎকার করে উঠে সে। সাথে সাথে একটা ঘুষি পড়ে তার গালে। প্রীতম দিয়েছে। শাহবাজও পাল্টা ঘুষি দেয়। শাহবাজের বলিষ্ঠ দেহের সাথে পেরে উঠেনা প্রীতম। সজিব লাথি লাগায় শাহবাজের পেটে। ঘরের একটা মানুষও এগিয়ে যায়নি। প্রিয়াঞ্জনা চিৎকার করে বলছে,
“ভাইয়া, ওকে মে রো না। তোমার পায়ে পড়ি। যা বলবে সব করবো।”

জোহরা টেনে হিঁচড়ে প্রিয়াঞ্জনাকে শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে। এই মেয়ের কি বুঝ নাই। দেউলিয়া একটা ছেলে। এতিম আবার বাড়িঘর কিছু নাই। একটা বাচ্চাও দেওয়ার মুরদ নাই। সেই ছেলের ঘর করে লাভ আছে! বাবা-মা কি সন্তানের খারাপ চায়? অভাব ঘরে আসলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়। ভালোবাসা বলতে কি কিছু আছে! টাকা হলো সব। ফাহিম ছেলেটা কত ভালো। আমেরিকা থাকে। সেই প্রথম থেকেই প্রিয়াঞ্জনাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। প্রিয়াঞ্জনার বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো শুনে সে আর বিয়েই করেনি। আজ সবকিছু মেনে নিয়ে সে বিয়ে করতে চাচ্ছে। এতে তো প্রিয়াঞ্জনাই সুখে থাকবে।
আদোও কি তাই? জোহরার কিঞ্চিৎ জেদও কি এর পিছনে নেই?

শাহবাজ চৌধুরীর আগের মতো তেজ নেই। শরীর মন সবেতে নিষ্প্রাণ ভাব। দুজন লোকের সাথে একলা সে পেরে উঠেনি। হঠাৎ মাথায় আঘাত লাগলো। তারপর সব অন্ধকার।
______________

শাহবাজ যখন চোখ মেলে তখন প্রায় সন্ধ্যা। হাসপাতালের বেডে নিজেকে আবিষ্কার করে সে।পুরুষ ওয়ার্ড। আশেপাশের বেডে আরো অনেক রুগী। মাথায় ব্যান্ডিজ করা তার। কাউকে কিছু না বলেই ও বেরিয়ে পড়ে।

কি করবে কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। পুলিশের কাছে যাবে কি! স্টেশনে বসে বসে ভাবছে শাহবাজ। পরক্ষনেই মনে পড়লো প্রীতমের বন্ধু থানার ওসি। পুলিশ দ্বারা কিছুই করতে পারবেনা সে। তাহলে এখন করণীয়! সব ভাবতে হবে ঠান্ডা মাথায়। কিছুদিন পর জমির দলিল। টাকা নিয়ে কোথাও চলে গেলে কেমন হয়? প্রিয়াঞ্জনাকে সাথে নিয়ে! সে চিন্তাও মাথা থেকে বাদ দেয় শাহবাজ। যেসকল লোকেরা টাকা পাবে তাদের নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর টাকা না দিলে মাটি খুঁড়ে বের করবে তাকে। প্রিয়াঞ্জনার বাড়িতে আবার যাওয়াটা হবে বোকামি। শাহবাজ পরিকল্পনা সাজায়। আপাতত সে বন্ধুর বাড়িতে ফিরে যাবে। প্রিয়াঞ্জনাকে ফোন করে বলবে শান্ত থাকতে। যদিও কথা আদোও বলা যাবে কিনা সন্দেহ। সুমনা অথবা প্রীতি এদের সাথে কথা বললেও চলবে। তারপর আড়াই কোটির ঝামেলা ভাঙবে। কিছু টাকা রেখে দিবে। বাকিদের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিবে। প্রিয়াঞ্জনাকে বলবে বাসা থেকে পালাতে। তারপর নরসিংদীর কোনো গ্রামাঞ্চলের দিকে একটা বাসা ভাড়া নিবে। আশেপাশে স্কুলে শিক্ষকতা করবে। শহর থেকে গ্রাম বেশি নিরাপদ। মানুষজন বিপদে এগিয়ে আসবে। বাকি টাকার ব্যবস্থা! মাথা চিনচিন করে উঠে। সজলের ধাক্কায় টেবিলের কোনা থেকে মাথায় আঘাত পায় শাহবাজ। বাস্তবতা কত নির্মম! আকাশ পানে তাকায় শাহবাজ। কালো অন্ধকার আকাশ। একেবারে নিকষ কালো। ভুতুড়ে কালো। হালকা বাতাস বইছে। গাছের পাতা নড়ছে। শন শন করে। তাচ্ছিল্যের হাসিটাও শাহবাজের আজকাল আসেনা। সৃষ্টিকর্তা কখনো মানুষকে চারদিক থেকে দেন। আবার কখনো কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। সে সময় চতুর্দিক হতে বিপদ আসে। মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। শাহবাজ ভেঙে পড়েনি। ধৈর্য্য ধরছে। পরিকল্পনা করছে। আজকের ঘটনাটাও ভুলবার চেষ্টা করছে। সময় হয়তো একদিন তারও আসবে। এখন কেবল মাথা ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন। ভুল কিছু করলে দিনশেষে নিজেকেই পস্তাতে হবে।

এতক্ষণ শান্ত ছিলো স্টেশন। মাত্র একটা ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে থামলো। নিস্তব্ধ স্টেশন প্রাণ ফিরে পেলো। মুহূর্তেই হরেকরকম মানুষে ভরে গেলো চারপাশ। গিজগিজ করছে মানুষে।
“আপনি কি শাহবাজ চৌধুরী?”

একজনের প্রশ্নে মাথা তুলে উপরে চায় শাহবাজ।

(চলবে)….