প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই পর্ব-০১

0
565

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-০১

“তোমাকে কি বাপের বাড়ি পড়ে থাকার জন্য বিয়ে দিয়েছি? তোমার স্বামীটাই বা কেমন ছ্যাঁচড়া, প্রতিদিন রাত দুপুরে ভাত খেতে চলে আসে!”

মায়ের কথায় বুকটা খচ করে উঠে প্রিয়াঞ্জনার। দুপুরের ভাত খাওয়া আর হয়ে উঠেনা। ভাত সহকারে পানি ঢেলে উঠতে নিলে ভাতের প্লেটটা ঠাস করে মাটিতে ফেলে দিলেন জোহরা বেগম। সেই সাথে একটা চড় পড়লো প্রিয়াঞ্জনার গালে। প্রিয়াঞ্জনা গালে হাত দিয়ে থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। জোহরা বেগম ভয়ানক চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন।
“ভাতে পানি ঢাললি কেন কু’ত্তার বাচ্চা? তোর সাহস হয় কি করে? টাকা কি গাছ থেকে পড়ে? তোর জামাই দেয় চালের টাকা?”

তিনি আরেকবার প্রিয়াঞ্জনাকে প্রহার করতে উদ্ধত হলেন। প্রিয়াঞ্জনা ঠাটা পড়া মানুষের ন্যায় কেবল নির্নিমেষ চেয়ে আছে। কে বলবে এই মা তাকে নিজের হাতে তুলে খাইয়ে দিতো? প্রিয়াঞ্জনার বড় ভাইয়ের বউ এসে জোহরা বেগমকে আঁকড়ে ধরলেন। জোহরা তখনও হাত পা ছুড়াছুঁড়ি করছিলেন। হাতের কাছে কিছু খুঁজছিলেন। আজ তিনি এই মেয়েকে শেষ করে ক্ষান্ত হবেন।
“প্রিয়া, তুমি ঘরে যাও। ঘরে যাও।”

প্রিয়াঞ্জনাকে সতর্ক করলেন সুমনা ভাবী। জোহরা বেগম ভয়ানক রেগে রয়েছেন। প্রিয়াঞ্জনা মাথা নিচু করে ঘরে চলে আসে। আজ শ্রাবণ মাসের পহেলা দিন। বাইরে ঘন বরষার আনাগোনা। ধূসর হয়ে আছে আকাশ। প্রিয়াঞ্জনাদের তিনতলার ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে বাইরে তাকালে বেশ বড় পাকা রাস্তা। রাস্তার দুপাশে সারি সারি নারকেল গাছ। দক্ষিণদিকে এক শ্যাওলাঘন বাঁধানো পুকুর। প্রিয়াঞ্জনা উদাস নয়নে চেয়ে থাকে শ্যাওলাঘন পুকুরটার পানে। মৃদু বাতাসে তার চুল উড়ে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। এমন সময় প্রিয়াঞ্জনার নজর কাড়ে টাকনু পর্যন্ত ভাজ করে রাখা প্যান্ট, টিপ টিপ বরষার জলে ভেজা নীলচে রঙের লেপ্টানো শার্ট পরে বাড়ির দিকে হেঁটে আসছে তার পুরুষ। চেহারাটা ভিষণ মলিন। শ্যামল বর্ণের ফ্যাকাশে মুখমন্ডল। ঘন চুলগুলো এলোমেলো।
প্রিয়াঞ্জনা বিড়বিড় করে,
‘শাহ্, তুমি আজ এসো না। তোমার অপমান যে আমি সইতে পারবোনা।’

ততক্ষণে তার পুরুষ চলে এসেছে গেটের কাছটায়। মন কি আর মানে? প্রিয়াঞ্জনা দৌড়ে ছুটে যায় নিচে। দৌড়ে নিচে নামার ফলে শ্বাস উঠানামা করছে তার। গেটে কোনো দাড়োয়ান নেই। প্রিয়াঞ্জনা গেট খুলে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তার পুরুষকে। শাহবাজ মলিন হাসে। ভেজা ঠোঁটে একখানা চুমু খায় প্রিয়াঞ্জনার কপালে।
“ছাড়ো, প্রিয়াঞ্জনা। ভিজে যাবে।”
“ভিজতে দিন।”

কল্পনায় তুমি বলে ডাকলেও বাস্তবে আপনি বলেই নিজের পুরুষকে সম্বোধন করে প্রিয়াঞ্জনা। শাহবাজ চোখ বুজে। উপলব্ধি করে বুকের ফাঁকা স্থানটায় কমল ফুটছে। হাহাকার করা হৃদয়টা হাসছে আপনমনে। ভালোবাসার মানুষকে জড়িয়ে ধরলে বুঝি এত শান্তি? এত সুখ? টিপটপ বর্ষা এখন দাপটে রূপ নিচ্ছে। তবে তারা যে ভিন্ন জগতে!
রিকশার হর্নের শব্দে ধ্যান ভাঙে। হুঁশ ফিরে তাদের। তড়িঘড়ি করে ভিতরে প্রবেশ করে দুজনে। প্রিয়াঞ্জনার বাম হাতে শাহবাজের ডানহাত। বাইরে শুরু হয়েছে প্রবল বরষা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময় নিরবতা ভাঙে প্রিয়াঞ্জনা।
“শাহ্, ওরা কি বলেছে? কেস করবে?”
“তাই মনে হচ্ছে। কোটি কোটি টাকার ব্যাপার প্রিয়াঞ্জনা। এমনি তো আর ছেড়ে দিবেনা।”
“আপনার দোষ কোথায় শাহ্? ওরা কেন আপনাকে ফাঁসাচ্ছে?”
“আমার সরলতা। আমার অন্ধবিশ্বাসের ফল আমি পাচ্ছি।” অসহায় কন্ঠ শাহবাজের।
একতলা শেষ হলে একটা খালি জায়গা পড়ে। পাশের দেয়ালে ছোট একটি জানালা। জায়গাটা ভিজে আছে। বৃষ্টির পানি জানালা দিয়ে ছিটকে পড়ে স্থানটা ভিজে আছে। সেখানে থামে শাহবাজ। থামায় নিজের অর্ধাঙ্গীকেও।
“কি হলো শাহ্?”

প্রিয়াঞ্জনার চোখে চোখ রাখে শাহবাজ। অতিরিক্ত ফর্সা এই মেয়েটার গাল দুটো লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ঠান্ডা লাগবে নিশ্চিত। ডাগর ডাগর চোখ দুটো স্থির শাহবাজের চোখে। কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে শাহবাজ নিজের ভারী পুরুষালি কন্ঠে বলে,
“আমাকে তুমি বিশ্বাস করো তো প্রিয়াঞ্জনা?”
“নিজের চাইতেও বেশি। আল্লাহর পর আমি আপনাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি শাহ্।”

চোখের পাতা স্থির। দু সেকেন্ডও না ভেবে উত্তর দেয় প্রিয়াঞ্জনা। তার সুরে কোনো জড়তা নেই। নেই কোনো মিথ্যে আশ্বাস। শাহবাজ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সারা দুনিয়া তার বিরুদ্ধে। কেন এই মানুষটা তাকে এত বিশ্বাস করে?
“আমি বৈঠা বিহীন নাইয়া প্রিয়াঞ্জনা। মাঝ নদীতে আমার নাও ভাসছে। আমার না আছে একূল আর না আছে ঐ কূল। আমি জানিনা আমার গন্তব্য কোথায়। ভাসছি কেবল ভাসছিই।”
“আমি আপনার সঙ্গী শাহ্। আপনি যেখানে যাবেন সেখানেই আমার গন্তব্য।”
“যদি ডুবে যাই?”
“আমিও ডুবে যাবো।”
“আমি ভবঘুরের ন্যায় ঘুরছি প্রিয়াঞ্জনা। পাওনাদারেরা রাম দা নিয়ে খুঁজে বেড়ায় আমাকে। বাবুর হাঁটে আমি যেতে পারবোনা। তুমি বুঝতে পারছো প্রিয়াঞ্জনা? আমার শহর শেখের চড়। আমার বাবুর হাঁটে তিলে তিলে গড়া দোকান। আমার ফ্যাক্টরি আজ সব শেষ।”

গলা ভিজে উঠে শাহবাজের। প্রিয়াঞ্জনার ভিষণ খারাপ লাগে। শক্ত পোক্ত মানুষটা আজ কি অসহায়! যে মানুষটা কত শত মানুষকে সাহায্য করতো আজ তার পক্ষে কেউ নেই। সে একা। প্রিয়াঞ্জনা আবার আঁকড়ে ধরে শাহবাজকে। শান্ত কন্ঠে বলে,
“সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন। আল্লাহ পরীক্ষা নিচ্ছেন শাহ্।”

হয়তো! হয়তো আবার তাদের দুনিয়াটা রঙিন হয়ে উঠবে। তিনতলা বাড়িটা প্রিয়াঞ্জনার বাবার বাড়ি। নিচে দু’তালা ভাড়া দেওয়া। তিনতালায় তারা থাকে। প্রিয়াঞ্জনার বাবা-মা। বড় ভাই প্রীতম, ভাবি সুমনা। ছোট জমজ দুই বোন প্রাপ্তি, প্রীতি। শাহবাজকে নিজের ঘরে নিয়ে আসে প্রিয়াঞ্জনা। বাবা প্রবীর আহমেদ এককালে বিদেশ থাকতেন। জীবনের বেশ কয়েকটি বছর তিনি বিদেশেই ছিলেন। মায়ের কাছেই বড় হয়ে উঠেছে প্রীতম আর প্রিয়াঞ্জনা। বাবার আদর পেয়েছে তবে কম। প্রাপ্তি, প্রীতি আবার বাবার আদর পেয়েছে এখনও পাচ্ছে। জোহরা বহু কষ্টে এই তিনতলা বাড়ি দাঁড় করিয়েছেন। স্বামী তো সেই টাকা দিয়েই কার্য শেষ। ইট সিমেন্ট, বালু সবকিছুই এসেছে জোহরা বেগমের দ্বারা। তারপর প্রবীর আহমেদ একদিন হার্ট অ্যাটাক করলেন বিদেশে। নিজের একটি দোকান ছিলো সেখানে। বউ বললো, “অনেক তো হয়েছে। এবার দেশে চলে এসো।”

সব বিক্রি করে দেশে চলে এলেন প্রবীর। স্থানীয় বাজারে বড় বড় দুটো মুদি দোকান দিলেন। বেশ চলছিলো তাদের জীবন। তবে অতি যত্নে গড়ে তোলা ছেলে-মেয়ে যে তাদের কষ্ট দিলো! জোহরা বেগম বেশ শাসনের মাঝেই ছেলে-মেয়েকে বড় করে তুলেছিলেন। স্বপ্নও ছিলো অনেক। সেই স্বপ্নগুলো অবশ্য এখন মাটিচাপা দিয়েছেন তিনি। একবার যে আশা ভেঙে যায় দ্বিতীয়বার সে আশায় বুক বাঁধতে চায় না কেউই। কষ্টটা যে দ্বিতীয় বার সহ্য করা যায় না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁই ছুঁই। গত তিনদিন যাবত শাহবাজ এ সময়টায় আসছে। প্রিয়াঞ্জনা বুঝতে পারে ক্ষুধার কারণেই ছুটে আসে তার শাহ্। মানুষটা একদম ক্ষুধা সহ্য করতে পারেনা। ভবঘুরে হয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকছে। হাতে হয়তো তেমন টাকাও নেই। প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ব্যাক্তিটাও একমুঠো ভাতের আশায় ছুটে আসে। কষ্টে বুক ফেটে যায় প্রিয়াঞ্জনার। পাঁচ তারকা রেস্টুরেন্টে খাওয়া মানুষটার আজ এ কি হাল!
“ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি খাবার বাড়ছি।”

শাহবাজের বলতে ইচ্ছে করে, ‘না। থাক, প্রিয়াঞ্জনা। আমি তোমার সাথে গল্প করেই চলে যাবো।’ তবে প্রচন্ড ক্ষুধার তাড়নায় তা বলতে পারেনা। ছুটে যায় ওয়াশরুমে। কাজের খালা আসেন নি। আজ দুপুরে গরুর গোশত ভুনা, পাট শাক দিয়ে ডাল, রুই মাছ রান্না হয়েছে। প্রিয়াঞ্জনার ভালো লাগছে। আজ তার শাহ্ কে ভালো খাওয়াতে পারবে। যদিও কিছুক্ষণ আগের ঘটনার কারণে তার মাঝে খানিক ভীতি ছিলো। মা যদি খারাপ ব্যবহার করেন! জোহরা ঘরে ঘুমাচ্ছেন। প্রবীর দোকানে। প্রাপ্তি, প্রীতি স্কুলে আর প্রীতম কলেজে। সে কলেজে শিক্ষকতা করে। ডাইনিং টেবিলে কোনো খাবার নেই। রান্না ঘরে ছুটে যায় প্রিয়াঞ্জনা। কোনো পাতিলে খাবার নেই। উদভ্রান্ত হয়ে যায় সে। ডিপ ফ্রিজসহ দুই ফ্রিজে তালা দেওয়া। রান্নাঘরের শেলফগুলোতেও তালা দেওয়া। নিশ্চয়ই মা করেছেন এটি। প্রিয়াঞ্জনা তড়িঘড়ি করে ছুটে যায় সুমনা ভাবীর ঘরে। সুমনা শুয়ে ছিলো। প্রিয়াঞ্জনা সুমনার পা আঁকড়ে ধরে ভেজা গলায় বলে,
“মায়ের কাছ থেকে চাবি এনে দাও ভাবী। মানুষটা না খেয়ে আছেন। আমি কেমন করে তা সইবো ভাবী? একটু দয়া করো।”

সুমনা চেয়ে থাকে অসহায় এক অর্ধাঙ্গীর দিকে। যে নিজের স্বামীর জন্য অপর মানুষের পা আঁকড়ে ধরতেও দ্বিধা করছেনা।
আদোও কি এতটাই ভালোবাসা প্রিয়াঞ্জনার আজীবন থাকবে তার শাহ্ এর জন্য? নাকি ভাঙনের সুর বাজবে?

(চলবে)…