প্রিয় তুই পর্ব-২৯+৩০

0
208

#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_২৯

এখন সকাল আটটা বেজে চার মিনিট। ব্যস্তমুখর এ জীবনে সবাই যে যার কর্মে ব্যস্ত। তিতাসের বাবা নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়েছেন। গতরাতে উনি অনেক বড় ডিল সাইন করেছেন।
এবার আশা করা যাচ্ছে ভালো কিছু’ই ঘটবে। সব বাঁধা বিঘ্ন
পেরিয়ে নতুনভাবে সবটা শুরু করতে পারবেন। এতদিন উনি জানতেন, বাবারা ছেলেদেরকে অনুপ্রেরণা জোগান। ছেলের কাঁধে হাত রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেন।একবার
ব্যর্থ হলে পুনরায় উঠে দাঁড়াতে সহায়তা করেন। কিন্তু তিতাস সেটা উল্টো করে দেখিয়ে। উনি সত্যি সত্যি মনোবল হারিয়ে ফেলেছিলেন, এসব ঝামেলায় সবকিছুকে হেলাও করতেন। কিন্তু তিতাসের একটা মেসেজ উনাকে নতুন উদ্যোগে চেষ্টা করার ইচ্ছে জাগিয়েছে। উনি বুঝেছেন উনার ছোট ছেলেটা উনার পাশে আছে, শক্তি রুপে। এতে যেমন নিজের কাজের প্রতি উনি মনোবল ফিরে পেয়েছেন, তেমনি মনের জোরও।
উনি চলে যাওয়ার পরে ভোর আর রোজা মিলে ফলের জুস
বানিয়ে গ্লাসে রাখল। দু’জন গল্প করতে করতে সিদ্ধ ডিমের
খোসা ছাড়াল। তিতাসের আম্মু রান্নাঘরে পরোটা ভাজছেন।
রোজা আর ভোর খাবার টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। এবার তিতাস আসলেই তারা খেতে বসবে। ইতিমধ্যেই ভোর গিয়ে তিতাসকে দুইবার ডেকেও এসেছে। কিন্তু তিতাস গুরুত্বপূর্ণ চ্যাপ্টার গুলোতে নজর বুলাচ্ছে, বিরবির করে পড়ছে। হাতে কলম তুলে নিয়ে খাতায় অগোছালোভাবে কীসব লিখছেও।
বেশ কিছুক্ষণ পর ঘড়িতে সময় দেখে একেবারেই রেডি হয়ে নিলো। এবার নিচে গিয়ে নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়বে। এসব ভেবে সে শরীরে পারফিউম স্প্রে করে চুলগুলো ব্রাশ করল।
নিজেকে পরিপাটি দেখে ঘুরতেই দেখে ভোর দাঁড়িয়ে আছে।
তিতাসের মা তাকে পুনরায় পাঠিয়েছেন। তিতাস ওকে দেখে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কপালের মাঝখানে চুমু এঁকে মৃদু হাসল।
তারপর ভোরের নাক টেনে বলল,

-”’বেস্ট অফ লাক’ সিনিয়র বউ। শুভ হোক আপনার জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত।'”

-”একথা তো আপনাকে বলা উচিত ডাক্তার সাহেব।”

-”তো বলুন নিষেধ করেছে কে?”

ভোর জবাব না দিয়ে তিতাসের শার্টের কলার ঠিকঠাক করে পকেটে এক হাজার টাকা গুঁজে বলল,

-”সাবধানে যাবি, সাবধানে ফিরবি, অপেক্ষায় থাকব আমি।”

তিতাস তৃপ্তির হাসির হেসে সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল। আজ সে ভীষণ খুশি। অনেকদিন পর নিজেকে কেমন হালকা মনে হচ্ছে। শরীর জুড়ে অন্যরকম অনুভূতির আভাস পাচ্ছে। সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে। চারপাশের সবকিছু রঙিন লাগছে। নব্য রুপে জীবনটাকে রংধনুর মতো রাঙাতে বড্ড ইচ্ছে জাগছে।
এসব ভেবে তিতাসের ওষ্ঠের কোণে হাসি ফুটল। সেই সঙ্গে দেখা গেল তার চোখে তৃপ্তির চাহনি। ভোর এবার তিতাসকে তাড়া দিয়ে নাস্তা করতে যেতে বলল। অতঃপর দু’জনে কথা বলতে বলতে রুম থেকে বেরিয়েছে, তখন ভোর থেমে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,

-”সত্যিই কি তোর ছাব্বিশটা গফ ছিলো?”

-”হুম, মিথ্যে বলতে যাবো কেন?”

-”এতগুলোকে সামলাতে পারতি?”

-”আমি সামলাতে যাবো কেন, আজিব।”

-”তো তোর গফদের অন্য কেউ সামলে দিতো?”

-”ওরে হিংসুটে বউ রে আপনি যা ভাবছেন তা নয়।”

-” তাহলে? ”

-”গফ মানে কি শুধু প্রেমিকাকেই বোঝায়?”

-”তা নয় তো কি?”

-”আমি সেই গফের কথা বলি নি। গফ মানে গার্ল ফ্রেন্ডকে বুঝিয়েছে। যাদেরকে খাঁটি বাংলায় বলে বান্ধবী, সহপাঠী। আপনারা মেয়েরা আসলেই একটু বেশিই বুঝেন। বারংবার প্রমাণ দেন, আপনাদের বুদ্ধি হাঁটুর নিচে। নিজে থেকে কিছু বোঝার চেষ্টা তো করবেনই না।আবার কেউ সঠিক বোঝাতে চায়লে তা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উল্টো বুঝে বসে থাকেন।আপনিই
ভাবুন,সত্যি সত্যিই ছাব্বিশটা প্রেমিকা থাকলে ডাক্তারী পড়া হতো আমার? মেডিকেলের বই কী আসলেই এতটা সোজা?
তাছাড়া এসব করে বেড়ালে বাবা আমাকে আস্ত রাখত?গফ মানে আমি বান্ধবীকে বুঝি। তাই কেউ জিজ্ঞাসা করলে গফ বলে তাদের পরিচয় করায়। আমরা গফ’রা একথা জানেও।
এছাড়া চিপায় গিয়ে হাতাহাতি করার সম্পর্ক এদের কারোর সঙ্গে গড়া হয় নি আমার। যদি এমন করতাম ভাইয়া চাপকে সোজা করে দিতো।কারণ ভাইয়া এসব করত না আমাকেও
নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। তবে মজা করে দু’একজনকে ডেয়ার টেয়ার নিয়ে ফুল দিয়েছি, চিঠি দিয়েছি। এসব কথা
আমার বাবা-মাও জানে। উনাদের রাগাতে ইচ্ছে করে এমন করতাম। এসব ছাড়া আমি খুব ভদ্র ছেলে। এমনকি আমার
বউটাকে পোড়া ঠোঁটে চুমু খাবো না ভেবে রেগুলার সিগারেট খাই না। তবে টেষ্ট মনে রাখতে মাঝেমধ্যেই দু’চার টান দিয়ে ফেলি। আর হ্যাঁ, গতরাতে যেসব কথা বলেছেন ভুলেও আর উচ্চারণ করবেন না। শুধু একটা কথা স্মরণে রাখবেন, এই তিতাস আপনাকে কখনো মিথ্যা বলবে না, কখনো না। তাই কিছু জানার অথবা বলার থাকলে সোজা-সাপ্টা বলবেন।”

-”হুম।”

-”এক কাজ করুন আপনিও চটজলদি রেডি হয়ে আসুন। দু’জন এক সঙ্গে বের হই।”

ভোর তিতাসের দিকে একবার তাকিয়ে হেসে দ্রুত রেডি হতে গেল। তারপর দু’জনে নাস্তা সেরে একসঙ্গেই বেরিয়ে পড়ল। আজ থেকে ভোরও হসপিটালে যাবে, রোগী দেখবে। তিতাস নিজেই একথা গতপরশু জানিয়েছে। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের কারণ ভোরের অজানা। এ ছেলেটার কখন কী মনে হয় তার বোধগম্য হয় না। তবে রবিনের পরিবর্তে তার জন্য সহকারী হিসেবে রেখেছে মিজানকে।সে তিতাসের খুব কাছের বিশ্বস্ত একজন। রবিনের কথা জিজ্ঞাসা করাতে বলেছে, সে নাকি কিছুদিন বাবার সঙ্গে থাকবে। অফিসে খুব চাপ তাই বাবাকে সাহায্য করবে। তাই এই ব্যাপারে ভোরও আর কিছু বলে নি। কারণ ওর বাবার পরে বর্তমানে তিতাসই তার জন্য নিরাপদ কেউ। আর যায় হোক তিতাসের দ্বারা তার কোনো ক্ষতি হবে না, একথা সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। আর ওর জুনিয়র বর একজন দায়িত্বশীল পুরুষ। সে জানে পরিবারটাকে কীভাবে
আগলে রাখতে হয়।
এসব ভেবে ভোর ওর রোগী দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।রোগীর চাপ বেশি থাকায় সময়ও অতিবাহিত হতে থাকল। ভোরের
হসপিটালে আসার কথা জানতে আয়মানেরও সময় লাগল নি। একথা শুনেই সে তাৎক্ষণিক ছুটে এসেছে।রোগীর চাপ রেখে ভোর এখন তার সঙ্গে খেজুরে আলাপ জুড়ে দিবে না নিশ্চিত। এজন্য একগুচ্ছ গোলাপ হাতে এসি গাড়িতে বসে ভোরের অপেক্ষায় সে। সেই সঙ্গে নানান পরিকল্পনা করে সে
কিছু ভাবছে আর কুটিল হাসছে। এই ভোর মেয়েটা সত্যিই বড্ড বোকা। সে আপনজনদের খুব বেশি ভরসা করে, ফলে ঠকেও বেশি। এই যেমন, ওর বাবার থেকে কিছু ইঙ্গিত পেয়ে
তিতাসদের বাসায় এসেছিল। এবং পিয়াসের মৃ/ত্যু/র জন্য তিতাসকে সর্বপ্রথম সন্দেহ করেছিল। তবে তিতাস যে ধূর্ত, ভোরের পরিকল্পনা বুঝে ফেলেছিল। পরে ভোরের অজান্তেই বাসার সকলকে যেভাবেই হোক বিয়ের জন্য রাজি করাতে বলে। তখন উছিলা হিসেবে সারাও নোংরা কথা বলে সুযোগ করে দেয় তিতাসের মাকে। আর ভোর তিতাসের মায়ের এত
ইমোশনাল কথা শুনে আবেগী হয়ে নিজে তিতাসকে বিয়ের কথা বলে। আর তিতাসও তখন লুফে নেয় ভোরের প্রস্তাব।
আর এখানে সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় ভোরের বাবা। উনাকে প্রায় দেখা যেতো, তিতাসের সঙ্গে আলোচনায় বসতে। হোক সেটা, কোনো রেস্টুরেন্ট অথবা নিরিবিলি কোনো স্থান। উনি
কীভাবে যেন তার উদ্দেশ্যে ধরে ফেলেছিলেন। এজন্য উনি নিজেই তিতাসকে তাড়া দিতেন ভোরকে বিয়ে করার জন্য।
পরিশেষে মেয়ের বিয়ে দিয়ে যাওয়ার পথে সে নিজেই গাড়ি
এক্সিডেন্ট করিয়েছিল। ইচ্ছে ছিল পিচ ঢালা রাস্তায় উনাকে পি/ষে ফেলতে। কিন্তু তা আর সম্ভব হয় নি। কিন্তু পরে যখন ভোরের বাবার বাঁচার সম্ভবণা দেখা দিলো, তখন সে নার্সকে টাকা খাইয়ে উনার অক্সিজেন মাক্সটা খুলে মৃ/ত্যু/র দুয়ারে পাঠিয়ে দিলো। আর ভোরের মা ধকল সামলাতে না পেরেই অক্কা পেয়েছে। আর উনার মৃ/ত্যুে/র পর সে মিশানকে এটা বুঝিয়েছে, ভোরের জন্যই এমন হয়েছে। কী দরকার ওখানে গিয়ে তিতাসকে বিয়ে করার, সে বিয়ের কথা না বললে ওর বাবা-মা নিশ্চয়ই ওখানে যেতেন না। আর এমন মর্মান্তিক কিছু ঘটতোও না। একথা শুনেই সে রেগে ভোরকে শেষবার তাকে মাকে দেখতেও দিয়েছিল না। এমনকি তিতাসকেও ওর মৃত ভাইয়ের কসম দিয়ে আঁটকে দিয়েছিল। হাস্যকর হলো, ভোর এবং তিতাসের বাসার সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে সে অবগত। তিতাসের চাচীর কাহিনীতেও সে ভীষণ মজা পায়,
ওই মহিলা আসলেই ধূরন্ধর। আহারে গো বেচারা তিতাস।
বোনটা মান সন্মানের ছিঁটেফোঁটা তো রাখেই নি। এখন চাচী
নিজের রুপ দেখাচ্ছে। শাহিনা যেহেতু তিতাসকে প্যারাতে রেখেছেই তাই এই কয়েকদিন সে বিশ্রামেই ছিল। বসে বসে তিতাসের বেগতিক অবস্থা দেখছিল, মজা নিচ্ছিল। বেচারা তিতাস আসলেই একটা চিজ বটে নয়তো এতদিনে সবছেড়ে ছুঁড়ে পালিয়ে যেতো। তিতাস উচ্ছন্নে যাক, ভোরকে পেলেই হবে তার। আর ভোর যেহেতু বাইরে বেরিয়ে এসেছে এবার খপ করে ধরে উড়াল দিবে দেশের বাইরে। তবে আজই এটা করা যাবে না, পাখি কেবল বের হয়েছে, একটু ডানা ঝাঁপটে উড়ুক। তারপর নাহয়..!!

রোগী দেখে ভোর তিতাসের অপেক্ষা বসে আছে। এতক্ষণে তিতাসের চলে আসার কথা। ওর কথা ভুলে আবার কোথাও চলে গেছে নাকি কে জানে। সে তো আবার চঞ্চল পুরুষ।এক স্থানে মন বসে না তার।এসব ভেবে ভোর আর কিছুক্ষণ বসে কল দিলো তিতাসের নাম্বারে।তিতাস ওর কল কেটে মেসেজ করেছে, ‘বাইরে আসুন।’
ভোর হ্যান্ড নিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়াল। মিনিট দুয়েক পরেই তিতাসকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। সে মুখভর্তি হাসি নিয়ে ভোরের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে। তার বাম হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। ফুল দেখে ভোরের ঠোঁটে হাসি ফুটল। রজনীগন্ধার সুভাষ তার ভীষণ প্রিয়। তাও যদি হয় জুনিয়র বরের থেকে তাহলে তো কথায় নেই। ভোরের তিতাসের দিক তাকিয়ে কেন জানি আজ মনে মনে বলেই ফেলল,
-”এই পাগল প্রেমিকটা শুধু আমার, একান্তই আমার।”

একথা বলতেই তার মুখশ্রী লাজুক রাঙা হয়ে উঠল। তখনই তিতাসের পাশ দিয়ে ছুটে গেল চলন্ত একটা বাইক। তিতাস ততক্ষণে গলায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সে গলা থেকে ওর হাত নামাতেই দেখে র/ক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে গলা বেয়ে। ভোরের জন্য আনা শুভ্র রজনীগন্ধার উপরে লাল র/ক্তে/র ফোঁটা।
তিতাস হাত থেকে তার হতবাক দৃষ্টি সরিয়ে ভোরের দিকে তাকাতেই দেখে ভোর জ্ঞান হারিয়ে রাস্তার লুটে পড়েছে।

To be continue…………!!

#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_৩০

ভোরের জন্য আনা শুভ্র রজনীগন্ধার উপরে লাল র/ক্তে/র ফোঁটা। তিতাস হাত থেকে তার হতবাক দৃষ্টি সরিয়ে ভোরের দিকে তাকাতেই দেখে ভোর জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে
পড়েছে।

তখনই ভোর হঠাৎ শরীরে স্বজোরে ঝাকুঁনি টের পেলো। সে টেবিল থেকে মাথা তুলে হতবাক হয়ে সামনে তাকিয়ে রইল।
তার পুরো শরীর ঘামে ভেজা। চোখ দু’টো অশ্রুতে টইটম্বুর।
তখনো ভোরের শরীর থরথর করে কাঁপছে। ভোর এবার চট করে উঠে সামনে দন্ডায়মান তিতাসের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ঝরঝর করে কেঁদেও ফেললো। তিতাস হতভম্ব হয়ে ভোরকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কী হয়েছে,জানতে চায়লেও ভোর উত্তর দিচ্ছে না,পাগলের ন্যায় তিতাসের শার্ট খামচে ধরে কাঁপছে। তিতাস ভোরকে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো তার বক্ষমাঝারে। এতটাই শক্ত করে যেনো বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নিবে। এভাবে কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর ভোর স্বাভাবিক হতে শুরু করল। তিতাস তখন ভোরকে পানি এগিয়ে দিয়ে হেসে বলল,

-”গত রাতের আদরের রেশ এখনো কাটে নি বুঝি? হুম হুম আরো আদর চায় বললেই হয়, এত কান্নাকাটির কী আছে?”

ভোর জবাব না দিয়ে পানি খেয়ে ওর চেম্বারে চোখ বুলিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো। ওহ, তাহলে স্বপ্ন ছিলো। মনে হচ্ছিল বাস্তবেই ঘটেছে। পুনরায় তার চোখের সামনে ভেসে উঠল স্বপ্নের দৃশ্য। মনের ভেতরে ভয় ঢুকে গেছে। সে এটাও আজ বুঝে গেছে তিতাস ওর কতটাজুড়ে আছে। ভোর অশ্রু ভেজা নেত্রে তিতাসের হাসিমাখা মুখখানার দিকেই তাকিয়ে রইল। হারানোর লিস্টে সে তিতাসের নামটা যুক্ত করতে চায় না, কখনোই না। অনাকাঙ্ক্ষিত এই ভয়ংকর স্বপ্ন তাকে তার মনের খোঁজ পাইয়ে দিয়েছে। সে বুঝে গেছে, এই জুনিয়রের মোহে বাজেভাবে আঁটকে গেছে, খুব ভালোবেসে ফেলেছে।
প্রাণবন্ত ও চঞ্চল ছেলেটা ওর মনে ধীরে ধীরে জায়গা দখল করে নিয়েছে। একথা মানতে ওর লজ্জাও নেই, দ্বিধাও নেই।
তখন ভোরকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিতাস নিজের চুলে আঙুল চালিয়ে বলল,

-”আমাকে কী আজ একটু বেশি হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে?”
-”আসতে দেরি হলো কেন?”
-”জ্যামে পড়েছিলাম।”
-”পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”
-”ভালোই।”
-”বাসায় চল।”
-“চলুন।”

এমন টুকটাক কথা বলতে বলতে দু’জনে বেরিয়ে আসলো।
তারপর গাড়ি নিয়ে চলল বাসার পথে। ভোর বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে। তার মনে চলছে নানান ভাবনা। তখন তিতাস ভোরের আঙুলের ভাঁজে আঙুল গুঁজে নিয়ে হাসল। তখন তিতাস ভোরের চেম্বারে প্রবেশ করে দেখে ভোর ডেস্কে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। ঘুরের ঘোরেই ওর চোখ থেকে অঝরে গড়িয়ে যাচ্ছে অশ্রুবিন্দু। মুখে আওড়ে যাচ্ছে তার নাম। সে বুঝেছিল ভোর খারাপ স্বপ্ন দেখে ভয় পাচ্ছে। এজন্য হয়তো
তাকে বার বার তিতাস তিতাস করে ডাকছে। তাৎক্ষণিক সে ভোরের শরীরে হাত রেখে ডাকে তবুও ভোরের সজাগ হয় না। পরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকতেই ওর ঘুম ভেঙে যায়।
আর ওকে স্ব-শরীরে অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে
কেঁদে ফেলে।না জানি কী স্বপ্ন দেখেছে কে জানে। তবে ইচ্ছে করেই জিজ্ঞাসা করল না। খারাপ কিছু যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে ততই মঙ্গল। তবে এখনো ভোরের মন খারাপ দেখে সে
বলল,

-” ডেস্কে ঘুমাচ্ছিলেন কেন?”

-” তোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পাই নি।”

-”আইসক্রিম খাবেন, নিয়ে আসি?”

-” তিতাস শোন!”

-”হুম।”

-“চল আমরা অন্য কোথাও চলে যায়। যেখানে হারানোর ভয় থাকবে না, কষ্ট থাকবে না, বিচ্ছেদ নামক শব্দও থাকবে না। আপনজনকে বেইমানি স্বচক্ষে দেখতে পাবো না। দিন শেষে এত অস্থিরতায় ভুগতে হবে না। চল আমরা এমন কোথাও চলে যায়। রোজকার এতসব ঝামেলা আমার আর ভালো লাগছে না। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি দিনকে দিন।আচ্ছা, আমার চাওয়াটা কি খুব বেশি, তুইই বল?”

-”সময় সব ঠিক করে দিবে।”

-”কবে দিবে বল আমায়?”

-”এত উতলা হলে চলবে? আমি আছি তো।”

-”আমিও সবার মতো স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকতে চাই।
স্বাভাবিক একটা জীবন চাই। অথচ দেখ, আমার জীবনেই অশান্তির শেষ নেই। আচ্ছা, তুই একদিন বলেছিলি আমার বাবা নাকি পিয়াসের মৃ/ত্যু/র কথা জানতেন, কীভাবে বলিস নি আমায়?”

-”বিয়ের দিন আমাদের বাসায় আসার পর ভাইয়া আপনাকে রেখে উপরে চলে গিয়েছিল। রুমে প্রবেশের আগে আপনার
বাবা ভাইয়াকে কল করেছিলেন। একমাত্র মেয়ে আপনি, এ জন্য উনি আপনার চিন্তাও করতেন বেশি। ভাইয়া কথা বলা অবস্থায় রুমে ঢুকে নাহিদকে ক্যামেরা লাগাতে দেখে। রাগে ভাইয়া কল কাটতে ভুলে যায়, আর আপনার বাবা সব শুনে
ফেলে। পরে আমাদের বাসার সকলকে আপনার বাবা একে একে কল করেছিলেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে কাউকেই না পেয়ে এখানে আসার জন্য বেরিয়ে পড়েন। ততক্ষণে যা হবার হয়ে গিয়েছিল।”

-”সুখ আর আমার জীবনে আসবে না হয়তো।”

-”আসবে, সুখকে নিয়ে আসুন তারপর রাজ্যকে এনে আমরা
সুখরাজ্যে অনেক সুখে থাকব, অনেক।”

-”আমার জন্য কখনো ভুলেও রজনীগন্ধা ফুল আনবি না।
এটা তোর কাছে আমার অনুরোধ।”

-”কেন?”

-”কারণ লাল শাড়ি আর রজনীগন্ধা ফুল আমার অপছন্দ তাই।”

একথা বলে ভোর সিটে হেলান দিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো। অতঃপর ওরা বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসল। রোজা আর তিতাসের বাবা খেয়ে নিশিন্তে ভাতঘুম দিচ্ছেন। ভোর আর তিতাসকে খেয়ে নিতে বলে তিতাসের মাও রুমে চলে গেলেন। তখন তিতাস উঠে ড্রয়িংরুমে বসে টিভি অন করে একের পর পর চ্যানেল পাল্টাতে থাকল। তখন ভোর বিরক্ত হয়ে বলল,

-” খাবি না?”

-”সিনিয়র মেয়েকে বিয়ে করেছি নিজে হাতে খাওয়ার জন্য নাকি? ”

-”জুনিয়র ছেলেকে বিয়ে করেছি সাজিয়ে রাখার জন্য নাকি? তাড়াতাড়ি খাবার নিয়ে রুমে আয়, খাইয়ে দিবি আমায়।”

একথা বলে ভোর মিটিমিটি হেসে প্রস্থান করল। এই জুনিয়র বরকে দিয়েই তার সকল শখ আহ্লাদ পূরণ করবে সে। বয়স আর দ্বিধাদ্বন্দ উচ্ছনে যাক। সংকোচসহ পাহাড়সম অস্বস্তি মিইয়ে যাক, চিরতরে দূর হয়ে যাক। তিতাসকে নিয়েই সুখ খুঁজবে সে, অনাবিল সুখ। তাছাড়া ছোট ভেবে অনেক ছাড় দিয়েছে এবার নাহয় ছেলেটা বুঝুক বউয়ের জ্বালাতন কি।
এসব ভেবে ভোর একবার পিছু করে রুমে চলে গেল। আর
তিতাস হতবাক হয়ে ভোরকে চলে যেতে দেখে বলল, ‘একেই বুঝি বলে চোরের উপর বাটপারি।’

_______________________________

আয়মান হসপিটাল থেকে বাসায় না ফিরে সোজা মিশানের অফিসে এসেছে। মিশান হাতের কাজ শেষ করে মুখোমুখি বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। দু’জনের মধ্যে চলছে গোপন
আলোচনা। আর তাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ভোর এবং তিতাস। তাদের নিয়ে এদের মাঝে চলছে নানান পরিকল্পনা।
আয়মান তখন এক নার্সকে পাঠিয়ে ভোরকে জানিয়েছিল, সে এসেছে ভোর যেন বাইরে আসে।” কিন্তু ভোর ওর উত্তরে জানিয়েছিল, ‘দেখা করবে না সে যেন চলে যায়।” এরপরেও
সে অনেকক্ষণ ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিল। রোগী দেখা শেষ করেও ভোর ওর সঙ্গে দেখাও করে নি বাইরেও বের হয় নি। নার্স তাকে এটাও জানিয়েছে ভোর নাকি তিতাসের জন্য অপেক্ষা করছে। তিতাস আসলে একসাথে বাসায় ফিরবে।
একথা শুনে রাগে ওর শরীর এখনো কাঁপছে। এ মেয়ে আজ কাল বড্ড বেশিই তেজ দেখাচ্ছে। লাজ-হীন বে/য়া/রা মেয়ে বয়সে ছোট ছেলেকে বিয়ে করে ভালোবাসা দেখাচ্ছে। দরদ উতলে পড়ছে ক্ষণে ক্ষণে।এখন কী না ওকে তেজ দেখাচ্ছে! যদিও ওর অজানা নয়, ভোরের তেজের উৎস স্বয়ং তিতাস।
তিতাসই তাকে দিনকে-দিন চতুর করে তুলছে। নয়তো তাকে থ্রেট দেওয়ার মেয়ে ভোর কখনোই ছিল না। যেই মেয়ে মিষ্টি না হেসে কথায় বলত না, সেই মেয়েটা চোখ রাঙিয়ে আঙুল তুলে ওকে শাসিয়ে যাচ্ছে। তিতাসকে সে ফলো করে একথা কোনোভাবে ভোর জেনেছে। এমনকি সে তিতাসের বাইকের ব্রেক ফেল করিয়েছিল ভোরের কানে একথাও পৌঁছে গেছে।
মেয়েটাকে যতটা বোকা ভেবেছিল সে আসলেই বোকা নয়।
বরং প্রচন্ড ধূর্ত সে।এমন আরো কিছু তথ্য জেনে ভোর ওকে
কল করে সরাসরি বলেছে,

-”তিতাসের ক্ষতি করার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। এই আমিটাকে আর খারাপ হতে বাধ্য করো না, পরে সামলাতে পারবে না।”

-”বাপ্রে এত প্রেম, হা হা হা?”

-”আর একটাবার তিতাসের ক্ষতি করার চেষ্টা করেই দেখো। তারপর কী হয় কাজেই করে দেখাব।”

-”আসল রুপে আসলে তবে? ”

-”জুনিয়র বরের সেফটির জন্য মাঠে নামতেই হলো। তোমার বোঝাপড়া আমার সঙ্গে। তাই ভুলেও আমার শশুড়বাড়ির
কারো ক্ষতি করার চেষ্টা দ্বিতীয়বার করো না।”

-”আমি নাহয় করলাম না, তবে তোমার ভাইয়েরা?”

-”তাদেরও নাহয় আমিই দেখে নিবো।”

ভোরের মুখে এহেন কথা শুনে সে অবাক হলেও তখন হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। মেয়ে মানুষ কী আর করবে? কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে ভোর তিতাসের চোখ এড়িয়ে ওর বাসায় এসেছিল। আর এসে এমনকিছু ঘটনা ঘটিয়ে যেটার জন্য সে মোটেও প্রস্তুুত ছিল না। এর পরিশোধ সে নিবে, অবশ্যই নিবে।আরএদের কে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর সময় ঘনিয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে অপেক্ষা করছে চরম এক দূগর্তি। নয়তো ডানা ঝাপটানো থামাবে না এরা। পরিকল্পনামাফিক ওর এই
কাজে ওকে সাহায্য করবে মিশান। এতক্ষণ যাবৎ ভুলভাল অনেক কিছুই বুঝিয়েছে সে মিশানকে। মিশানও রাজি।

To be continue…………!!