প্রিয়দর্শিনীর খোঁজে পর্ব-০৬

0
337

#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ৬ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

আজ তাহনার প্রথম পরিক্ষা। ফজরের আজানের সাথে সাথে উঠে প্রথমে নামাজ পড়ে নিল সে। তারপর কিছুক্ষণ পরিক্ষার পড়া সেড়ে নিল।

রাইশা শুয়ে শুয়ে ফেসবুকিং করছে। তাহনা যখন উঠলো তখন রাইশাকেও নামাজ পড়তে ডেকে দিল। আর রাইশাও তাহনার সাথে নামাজ পড়ে নিল।

সকাল আট টা বেজে গেছে। রিদ এর মা রাইশাদের রুমে আসলেন। উনি দেখলেন যে রাইশা ফোন টিপছে আর তাহনা পড়ছে। উনি রাইশা কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘রাইশা! বড় বোনের থেকে কিছু শিখতে পারো না?’

হঠাৎ মায়ের গলা পেয়ে রাইশা লাফিয়ে উঠে বসে। দরজায় তার মাকে দেখে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘মা তুমি? কি হয়েছে?’

তাহনা এতক্ষণ পড়ছিল রিদের মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে দরজার দিকে তাকায় সে। রিদের মা ভিতরে এসে বললেন।

‘তাহনা পড়ছে। তোমারও উচিৎ নয় কি যে বই ধরে একটু পড়ার? সামনে তোমারও তো পরিক্ষা নাকি?’

রাইশা চুপ করে আছে। এদিকে তাহনা পড়া শেষ করে বলে,

‘আন্টি ওকে এতো বকছেন কেন?’

রাইশার মা বলে,

‘কিছু শেখা উচিৎ ওর। দুজনে খেতে আসো। সবাই তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’

রিদের মা চলে গেল এ কথা বলেই চলে গেল ওখান থেকে। তাহনা আর রাইশাও নিচে নাস্তা করতে গেল।
তাহনা নিচে গিয়ে দেখলো রিদ ছাড়া সবাই আছে। কিন্তু রিদ কোথায় গেল?

তাহনা নাস্তা করে রাইশার রুমে চলে এলো। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নিল। পরিক্ষার সব কাগজ রেড়ি করে নিজেও রেড়ি হতে লাগলো। তাহনা আজ একটা কালো বোরকা পড়েছে। মাথায় বেঁধেছে কালো হিজাব।
তাহনা বোরকা হিজাব পড়েই সব জায়গায় যায়। কোথাও থাকলেও মাথায় সবসময় ঘোমটা দিয়ে রাখে। রিদের বাড়িতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

তাহনা রেড়ি হয়ে নিচে নেমে আসে। নিচে এসে চমকে যায় তাহনা। তার বাবা এসেছে। বাবা কে দেখেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সে। জিজ্ঞেস করে,

‘তুমি কখন এলে?’

তাহনার বাবা বলে,

‘এইতো এখন। তোকে পরিক্ষার হলে দিয়ে আসব বলে।’

রিদের বাবাও রেড়ি হয়ে নিচে নামলেন। উনি রিদ কে কোথাও না দেখতে পেয়ে স্ত্রী কে জিজ্ঞেস করলেন,

‘রিদ কোথায়? নাস্তা করার সময়ও তো ওকে দেখলাম না।’

রিদের মা মলিন হাসি টেনে বললেন,

‘তোমার ছেলের নাকি কি কাজ আছে তাই চলে গেছে সকাল সকাল৷ নাস্তাও করেনি। কত করে বললাম।’

রিদের বাবা চিন্তিত স্বরে বললেন,

‘খালি পেটে চলে গেল? তাছাড়া আমিতো ভেবেছিলাম ও তাহনা কে দিয়ে আসবে।’

তখনই তাহনার বাবা এগিয়ে এসে বলে,

‘আরে থাক না স্যার। শুধু শুধু রিদ বাবাকে কষ্ট দেওয়ার কি আছে। তাছাড়া আমিতো এসেছি ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’

‘চলো। আজ আমরা দুজন তাহনা মাকে দিয়ে আসি।’

রিদের বাবার কথা শুনে বেশ তাহনার বাবা খুশি হয়। তাহনা সবাইকে সালাম করে ওরা বেড়িয়ে পড়ে।

গাড়িতে বসে থেকে তাহনা শুধু রিদের কথাই ভাবছে। সেদিনের পর থেকেই তো রিদ তার সাথে কথা বলেনি আর। দু একবার চোখাচোখি হলেও কথা হয়নি। কিন্তু আজ ওকে না দেখতে পেয়ে তাহনার কেমন যেন লাগছে।

তাহনা কে হলে পৌঁছে দিয়ে তাহনার বাবা আর রিদের বাবা অফিসে চলে গেল।

__

প্রায় দুই ঘন্টা পর রিদ বাসায় আসে। সোজা নিজের রুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। দশ মিনিট পর ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নিচে আসে রিদ। তারপর তাড়াহুড়ো করে তার মাকে বলে,

‘মা, খিদে পেয়েছে খাবার দাও।’

রিদের মা খাবার হাতে ডাইনিং এ এসে রিদ কে বলল,

‘কি ব্যাপার? তুই সকালে না খেয়ে চলে গেলি কেন? ভেবেছিলাম তুই তাহনা কে পৌঁছে দিবি। তুই না থাকাতে তোর বাবা আর তাহনার বাবা ওকে হলে দিয়ে এসেছে।’

মায়ের কথায় রিদের হঠাৎ মনে তাহনার কথা। ইশ! ও কিভাবে ভুলে গেল। আজ তো তাহনার প্রথম পরিক্ষা ছিল। ওকে একটা উইশও তো করলো না রিদ। ওকে হলে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে তো ও-ই ছিল। ইশ! মাথা থেকেই বের হয়ে গিয়েছিল।

রিদ এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না। দ্রুত বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল। পিছন থেকে তার মা অবাক হয়ে বলল,

‘আরে, খাবার খেয়ে যা। ছেলেটা এমন কেন আল্লাহ। সারাটাদিন আজ খালি পেটে।’

__
গাড়ির পাশে হেলান দিয়ে কলেজের গেইটে দাঁড়িয়ে আছে রিদ। তাহনা কলেজ থেকে বের হলে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে সে। কিন্তু সবাই বের হচ্ছে তাহনা এখনো এলো না। রিদ এবার কলেজের ভিতরে ঢুকে। সে এদিক ওদিক চতুর দিক তাহনা কে খুঁজেই যাচ্ছে। কিন্তু এতো ছেলে মেয়ের মাঝে তাহনা কে সে দেখতে পাচ্ছে না। রিদ হাতের ঘড়ির দিকে তাকায়। সময় তো শেষ হলো। কিন্তু তাহনা কই? রিদ মাস্ক পড়ে এসেছে। এটা সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ। করোনার কারণে এখন পরিক্ষার সময়ও কমিয়ে দিয়েছে।

রিদ ঘুরে ঘুরে তাহনা কে দেখতে পেল না। পিছন থেকে একজন তাহনা বলে ডাক দিল। রিদ পিছনে ফিরে দুজন মেয়েকে দেখলো। হিজাব দিয়ে তাদের মুখ বাঁধা। এদের মধ্যে তাহনা কে সেটাই বুঝতে পারল না রিদ। রিদ তাদের সামনে গেল। হঠাৎ রিদ কে দেখে মেয়ে দুটো চমকে যায়। ওখানে একটা তাহনা, আর একজন ওর বান্ধবী। তাহনাও রিদের মাস্কের কারণে তাকে চিনতে পারে না। রিদ দুজনের চোখের দিকে তাকায়। চোখ দেখে সে তাহনা কে চিনতে সক্ষম হয়।
তাহনা জিজ্ঞেস করে,

‘আপনি কে?’

রিদ কিছু বলার আগেই তাহনার গায়ের উপর হেলিয়ে পড়ে। দুজনেই হকচকিয়ে উঠে। রিদকে ধরাধরি করে তারা একজায়গায় বসায়। কয়েকবার ডাকে, কিন্তু সাড়া নেই। তাহনা যখন অচেনা লোকটির মুখ থেকে তার মাস্কটি খুলে, রিদকে দেখে সে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সে দ্রুত তার বান্ধবীর হাতে থাকা পানির বোতলটা নিয়ে হাত দিয়ে রিদের চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয়। রিদের হেলদোল নেই। তাহনা ঘাবড়ে যায়। উত্তেজনার বসে বোতলে থাকা পুরো পানিই রিদের মুখে ঢেলে দেয়। যার দরুন কিছু পানি রিদের নাকের ভিতর ঢুকে যায়। রিদ কাশতে শুরু করে এবং চোখ খুলে। তাহনা চোখ বন্ধ করে একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়ে।
.
রিদ উঠে বসে। তাহনা জিজ্ঞেস করে,

‘আপনি ঠিকাছেন?’

রিদ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।

.
মিনিট দশের মধ্যেই তারা পৌঁছে যায় রিদের বাড়িতে। বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই রিদের মা মিসেস ফাবিহা শেখ তাদের ফ্রেশ হয়ে আসতে বলেন। রিদ তাহনা আর রাইশা একসাথে খাচ্ছে। খেতে খেতে রিদ জিজ্ঞেস করল তাহনা কে।

‘প্রথম পরিক্ষা কেমন দিয়েছো?’

তাহনা খাওয়া থামিয়ে উত্তর দেয়।

‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো হয়েছে।’

রিদ আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। চুপচাপ খেয়ে উপরে চলে যায় তার ঘরে। একসাথে রাইশা আর তাহনাও চলে যায় তাদের ঘরে।

তাহনা আজ ঘাবড়ে গিয়েছিল রিদের পড়ে যাওয়া দেখে। তাহনা সুন্দর করে মাথায় ঘোমটা টেনে রিদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে যাবে কি যাবে না এই নিয়ে চিন্তায় আছে সে। শেষমেশ তাহনা সাহস নিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে বলে,

‘আসব?’

ভেতর থেকে জবাব আসে।

‘কে?’

তাহনা ভয়ে ভয়ে বলে,

‘আমি, তাহনা।’

রিদ বলে,

‘দরজা খোলা আছে, আসো।’

তাহনা ভেতরে ঢুকে। সে দেখে যে রিদ বিছানায় শুয়ে আছে কপালে হাত দিয়ে। তাহনা বলে।

‘বলছি যে, দূর্বলার জন্য তখন বোধয় ওভাবে পড়ে গিয়েছেন। আমি ঔষধ নিয়ে এসেছি। এটা খাবেন!’

রিদ যে পাত্তা দিল না তাহনার কথায়। তাহনা মন খারাপ নিয়ে চলে যেতে নিল। দরজার সামনে আসতেই পিছন থেকে রিদ বলে উঠে,

‘আমার জন্য এক কাপ কফি করে নিয়ে আসতে পারবে?’

রিদের কথা শুনে তাহনা থেমে গেলেও পিছন ফিরে তাকায়নি। সে সোজা রান্নাঘরে চলে যায়। রিদের মা ছিলনা তখন রান্নাঘরে। চট জলদি এক কাপ কফি বানিয়ে সে রিদের ঘরে আসে।

রিদের ঘরে এসে রিদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। রিদ চোখ বন্ধ করে আগের মতোই আছে। তাহনা রিদকে উদ্দেশ্য করে বলে।

‘শুনছেন? আপনার কফি।’

রিদ নড়ে চড়ে উঠে। বিছানা থেকে উঠে বসে তাহনার হাত থেকে কফির মগটা নেয়। আর বলে।

‘ঔষুদের থেকেও এটা আমার বেশি প্রিয়। ঔষধ কে আমি ঘৃণা করি।’

তাহনা যে তাজ্জব বনে গেল। ঔষধ কে ঘৃণা করে এমন লোকও আছে নাকি পৃথিবীতে?

‘তোমার নেক্সট এক্সাম কবে তাহনা?’

রিদের প্রশ্নে তাহনার ঘোর কাটে। সে উত্তর দেয়।

‘চারদিন পর।’

রিদ কফিতে এক চুমুক দিয়ে বলে।

‘রাইশা বলছে কাল সিআরবিতে ঘুরতে যাবে। তুমি যাবে?’

‘না ভাইয়া। এখন ঘোরার সময় কই।’

‘আমি কিন্তু কয়েকদিন ফ্রী আছি। পরে একদম ব্যস্ত হয়ে পড়ব। তখন চাইলেও তোমাদের নিয়ে ঘুরতে যেতে পারব না।’

তাহনা বলে।

‘পরিক্ষার পরে তো চলেই যাবো।’

‘এত কথা জানি না। রেডি থেকো। আমরা তোমাকে নিয়ে যাবো। আর কফির জন্য থ্যাংকস।’

তাহনা আর কিছু না বলে ও ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। রিদ কফিতে চুমুক দিয়ে বলে।

‘মেয়েটার বানানো কফি তো একদম আমার মনের মতো। আহ্। কতদিন পর এমন স্বাদ পেলাম।’

কফি খাওয়ায় মনোযোগ দিল রিদ।

চলবে….