প্রিয় অসুখ পর্ব ১৩

0
519

প্রিয় অসুখ
পর্ব ১৩
মিশু মনি
.
শ্রবণার ঘুম জড়ানো কণ্ঠ আর ধারালো নিশ্বাসের শব্দ বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো শীতুলের কানে, বুকে, সমস্ত শরীরে। শিহরিত হয়ে শীতুল বললো, ‘তুমি এমন কেন? আমার সাথেই কেন এমন করছো?’

শ্রবণা অবাক হয়ে জানতে চাইলো, ‘আমি আবার কি করলাম?’

শীতুল বললো, ‘না কিছু না। সরি তোমার ঘুম ভাঙানোর জন্য।’
– ‘হুম।’

‘হুম’ বলার পর চুপ করে রইলো শ্রবণা। শীতুল বলার মত কিছু খুঁজে পেলো না। কিন্তু খুব করে শ্রবণার কথা শুনতে ইচ্ছে করছিলো। এমন কেন হচ্ছে কে জানে। মন কেমনের অনুভূতি গুলো বোঝা বড় কঠিন। একদিকে শ্যামলতার জন্য দুশ্চিন্তা, অন্যদিকে শ্রবণার কাছে আসতে চাওয়া, দুটো মিলিয়ে একটা মানসিক যন্ত্রণা তৈরি হয়েছে। শীতুল অন্য রকম একটা ঘোরের মাঝে চলে যাচ্ছে যার দিক কিংবা ইশারা কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।

শ্রবণার আরেকটা ধারালো নিশ্বাসের শব্দে শীতুল বাস্তবতায় ফিরে এসে বললো, ‘প্লিজ শ্রবণা, প্লিজ।’
– ‘কি?’
– ‘ভালো থেকো, বাই।’

সাথে সাথেই ফোন কেটে দিলো শীতুল। শ্রবণা’র চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। নিঃশব্দে সেই জল মুছলো শ্রবণা৷ এ কান্নার কারণ, অর্থ, সমাধান কেউ জানেনা। কিন্তু তিনটারই একটাই উত্তর- শীতুল। বুকের বোবাকান্না অশ্রু হয়ে নিরবে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আর কিচ্ছু তো করার নেই।

কত রাত এভাবে কেঁদেছে নিজেও জানেনা শ্রবণা। দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে গেলো। এর মাঝে একবারও কথা হয়নি শীতুলের সাথে। কেউ কাউকে একবারও ফোন করেনি। শ্রবণার বুক ফাটলেও এ দহন কেউ দেখে নি। সারাদিন ফোন দূরে ফেলে রেখে নিজের মত সময় কাটাচ্ছিলো শ্রবণা। কয়েকদিন প্রচন্ড কষ্ট হলেও ধীরেধীরে রাতগুলোতে যন্ত্রণা কমে আসতে শুরু করেছে। গত কয়েকটা রাত একটুও ঘুমাতে পারেনি শ্রবণা। এমনকি খাওয়া দাওয়াও ঠিকমতো করতে পারেনি। একা থাকার দরুন কেউ জোর করে খাওয়ানোর মত ছিলো না।

১৫
কয়েকদিন পর আজ বাইরে বের হয়েছে শ্রবণা। বাজার করতে হবে। আপনমনে হাঁটছিলো ফুটপাত ধরে। হঠাৎ কেউ একজন শ্রবণার নাম ধরে ডাকলো। পিছন ফিরে ব্যক্তিটিকে খোঁজার চেষ্টা করলো শ্রবণা। দেখলো কাউন্টার থেকে বেরিয়ে আসছেন শীতুলের মা।

উনি কাছে এগিয়ে এসে শ্রবণাকে বললেন, ‘কেমন আছো মা?’

শ্রবণা মাথা ঝাঁকালো, ‘জ্বি আন্টি ভালো। আপনি?’
– ‘আছি। তোমার চেহারার এই অবস্থা কেন? মাত্র কয়দিনেই একেবারে কেমন চুপসে গেছো। চোখের নিচ দেবে গেছে, কালো হয়ে গেছো। মা গো কি হাল হয়েছে চেহারার।’

শ্রবণা হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘ঠিক হয়ে যাবে আন্টি।’

আন্টি শ্রবণাকে নিয়ে এসে বাস কাউন্টারের ভেতরে বসলেন। গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে খেয়াল করছিলেন শ্রবণাকে। শ্রবণার মুখ শুকিয়ে গেছে, চোখ ফোলা ফোলা। চোখের নিচটা নিচু হয়ে বসে গেছে, চুল এলোমেলো। এরকম দেখানোর কারণ বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন উনি।

শ্রবণা বললো, ‘কোথাও যাচ্ছেন আন্টি?’
– ‘হ্যাঁ মা। শীতুলের সাথে কথা হয় না তোমার?’
– ‘না। বোধহয় বারো দিন হয়ে গেছে কথা হয় নি।’
– ‘ওহ। শীতুল একটা ঝামেলায় আছে। এই পাগল ছেলেকে নিয়ে আমি কি যে করবো।’

শ্রবণা অবাক হলেও চেহারার কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না। যেন অবাক হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে ও। আন্টির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।

আন্টি বললেন, ‘শীতুল একটা মেয়েকে খুব ভালোবাসে বুঝছো। সেই মেয়েকে পাওয়ার জন্য কত কি যে করছে। অথচ মেয়েকে এখনো নিজ চোখে দেখেনি পর্যন্ত। তাও কিসের জন্য এত পাগল আমি বুঝি না।’

শ্রবণার কোনো ভাবান্তর নেই। আন্টি কি বলছেন শুনেও যেন শুনছে না। কষ্ট বাড়ানোর সুযোগ নেই, মনটা এতটাই খারাপ যে নতুন করে আর মন খারাপ হবার অবস্থা নেই। শ্রবণা সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।

আন্টি বললেন, ‘এর আগে এক মেয়ে নক করে বলেছিলো সে ওর প্রেমিকা। ওই মেয়ের সাথে দেখা করে ইচ্ছেমতো ঝাড়ি দিয়েছে। মেয়েটা নিজের এলাকার ছেলেপেলে ডেকে আচ্ছা করে মারধোর করেছে শীতুলকে। গত পরশু হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়ে আমাদের গ্রামের বাসায় বেড়াতে গেছে। শহরের নির্জনতা ওর একেবারেই পছন্দ না। আমার কাজ ছিলো তাই আমি আজকে যাচ্ছি।’

শ্রবণা নির্বিকার ভংগীতে শুধু উচ্চারণ করল, ‘ও’

শীতুলের কিছু হয়েছে এটা ওর মাঝে তেমন কোনো পরিবর্তন আনলো না। সত্যি বলতে মেয়েটা কেমন যেন পাথরের মত হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ সহজে বের হয় না, কোনো খবরই ওকে আহত করে না। নিজেই যেন প্রায় নিহত হয়ে গেছে এমন অবস্থা।

আন্টি ব্যাপারটা না বুঝলেও শ্রবণা আগের মত নেই এটুকু বুঝতে পারছেন। কিছু একটা তো হয়েছে ই। আন্টি কৌতুহলী চোখে জানতে চাইলেন, ‘কিছু মনে কোরো না মা। তোমার কি কিছু হয়েছে?’
– ‘না।’

আন্টি অনেক্ষণ শ্রবণার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এটুকু নিশ্চিত হলেন যে মেয়েটা চরম ডিপ্রেশনে আছে। কাছে এসে বললেন, ‘শ্রবণা, আমি তোমার মায়ের মত। কিংবা আমাকে নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি ভেবে বলো। আমি একটা ভালো সলুশ্যন দিতে পারবো দেখো৷ প্লিজ বলো কি হয়েছে? তুমি কি কোনো সমস্যায় আছো?’

এতক্ষণ পর অবাক হয়ে আন্টির দিকে তাকালো শ্রবণা। বুঝতে পারলো সত্যিই কোনো সমস্যায় আছে। কি যে হয়েছে নিজেও বুঝতে পারছে না। আচমকা আন্টিকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলো। তারপর হাত শিথিল করে দিয়ে বললো, ‘মা গো, আমার মা নেই। এরকম করে কেউ কখনো আমাকে বলে নি।’

আন্টি শ্রবণার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘শোনো, আমিই তোমার মা। আমাকে খুলে বলো কি হয়েছে। মাকে বলা যাবে না?’

শ্রবণা কি বলবে বুঝতে না পেরে অনেক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে আন্টির কাঁধে মাথা রেখে ওনাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো, ‘আমি অনেক একা। আমার কেউ নেই এই শহরে। ব্যাংকে অনেক টাকা পয়সা আছে, তুলি আর খরচ করি। খাই, পড়াশোনা করি আর চুপচাপ একা বসে থাকি। আমার খুব কষ্ট হয় গো মা। আমি এত একা কেন!’

শীতুলের মা শ্রবণাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আস্তে আস্তে বললেন, ‘এই পৃথিবীতে সবাই একা। খুব সেলিব্রেটি মানুষটাও দিনশেষে ফিল করে সে অনেক একা। আমরা সবাই খুব একা রে মা। পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধব থাকলে মাঝেমাঝে বুঝতে পারি না। কিন্তু প্রত্যেকেই একা। একমাত্র আপনজন হচ্ছে বাবা মা।’

শ্রবণা গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ‘সবার বাবা মা আপন হয় না গো। বাবা তো বউ নিয়ে মহাসুখে আছে, মেয়ের খোঁজ কে রাখে।’

আন্টি শ্রবণার হাত ধরে বললেন, ‘চুপ কর তো। এখন থেকে তুই আমারই মেয়ে৷ দেখি কিভাবে একা একা লাগে? মন খারাপ করিস না। চল আমার সাথে কুমিল্লা যাবি। ছেলে মেয়ে দুটোকে একসাথে সুস্থ করে তুলবো আমি।’

শ্রবণা অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই রইলো। এই মহিলাটিকে প্রথম দিনেই অনেক আপন মনে হয়েছিলো শ্রবণার। তার আদর ,স্নেহ পাওয়াটা তো শ্রবণার জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু এখন তো এই সৌভাগ্য কপালে সইবে না। কোনোভাবেই শীতুলের সামনে পড়তে চায় না শ্রবণা। শীতুল ভাববে শ্রবণা শীতুলকে পাওয়ার জন্য এতকিছু করছে, ছ্যাঁচড়া মেয়ের মত বারবার ওর কাছে ঘেষছে৷ এটা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না। শ্রবণা কি বলবে বুঝতে না পেরে স্তব্ধ হয়ে রইলো।

আন্টি বললেন, ‘ভেবেছিলাম কলাবাগান থেকে যাবো। আয়াশ বললো টিটিপাড়া থেকে সরাসরি স্টার লাইনের এসি বাসে করে চলে যেতে। তোমার বাসায় চলো, জামাকাপড় গুছিয়ে আমার সাথে যাবা।’

শ্রবণা মাথা ঝাঁকিয়ে না না বলতে লাগলো। কিন্তু আন্টি নাছোরবান্দা। এমনভাবে শ্রবণাকে ধরে রইলেন যেন ও নিজেরই মেয়ে। আন্টির আচরণে শ্রবণারও ওনাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। তবুও নিজের সর্বসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলো যেন কিছুতেই শীতুলের মুখোমুখি হতে না হয়।

আন্টি চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘মায়ের সামান্য একটা কথা যদি না শোনো, কিভাবে ভালোবাসা অর্জন করবা? কারো কাছ থেকে কিছু পেতে চাইলে তাকে দিতেও হয়, রেস্পেক্ট করতে হয়। আমাকে রেস্পেক্ট করছো না নাকি আপন ভাবতে পারছো না?’

এমন একটা কথা শোনার পর আর না করার সাধ্য নেই কারো। শ্রবণাও আর কিছু বলতে পারলো না। যিনি ওকে মেয়ের মত ভেবে নিয়েছেন তাকে এভোয়েড করলে চরম অন্যায় হয়ে যাবে। প্রয়োজনে আন্টিকে শীতুলের ব্যাপারটা খুলে বলতে হবে। তবুও এই মা যেন ভুল না বোঝেন। মা না থাকার যে কষ্ট, একজন মাকে কষ্ট দিয়ে আর সেই কষ্টটা দ্বিগুণ করতে পারবে না শ্রবণা।

আন্টি শ্রবণাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, ‘চলো।’

যাওয়ার ইচ্ছা না থাকা স্বত্তেও মা জোর করে শ্রবণাকে নিয়ে বাসে উঠলেন । বাসে ওঠার আগে জোরপূর্বক বিরিয়ানি নিজ হাতে তুলে খাওয়ালেন। আজ তিনটি বছর পর শ্রবণার মনে হচ্ছে নিজের মাকে পেয়েছে। কষ্টে, আনন্দে কান্না আসছিলো ওর। বাসে ওঠার পর মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ওনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো। মা ওর ঘুম ভাঙায় নি। মায়ের ডাকে ঘুম থেকে উঠে দেখলো কুমিল্লায় পৌঁছে গেছে। লজ্জিত মুখে বাস থেকে নামলো শ্রবণা। রাস্তায় নামতেই শীতুলের মুখোমুখি হয়ে দুজনেই অনেক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো।

চলবে..