প্রিয় বেলা পর্ব-৩২+৩৩

0
465

প্রিয় বেলা
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
৩২.+৩৩

শরীরের ওপর চাদরের অস্তিত্ব টের পেতেই নড়েচড়ে উঠলো বেলা। জড়োসড়ো হয়ে বুকের মধ্যিখানে একেবারে মিশে যেতে চাইলো যেন। আদ্র একহাতে আগলে ধরলো তাকে। খুব সাবধানে, ভীষণ যত্নের সাথে। অন্যহাতে কপালের অবিন্যস্ত চুলগুলো গুছিয়ে পেছনে ঠেলে দিলো। পলক না ফেলে একমনে দেখতে লাগলো ঘুমন্ত বেলাকে। একটু আগেও তার জন্য কিরকম কাঁদছিল মেয়েটা! তাকে কাছে পেয়ে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল। ছাড়ছিল না। ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল বারংবার। বিরতীহীন কান্নায় ভিঁজিয়ে দিয়েছিল পরনের শার্টটি। আদ্র তার গালে হাত বুলালো আলতো করে। ক্রন্দনরত মুখশ্রীর নিস্তব্ধতায় লাল হয়ে যাওয়া নাক, গাল, কান, খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো। নজর গিয়ে ঠেকলো ফুলিয়ে রাখা ওষ্ঠের খুব গভীরে। আদ্র থমকালো। দৃষ্টি সরাতে অক্ষম হলো। ঘোর লেগে গেল যেন। গাল থেকে হাত নামিয়ে তা ছোঁয়ার পূর্বেই হঠাৎ তীব্র বজ্রপাতের শব্দে হুঁশ ফিরলো তার। আদুরে ওষ্ঠজোড়া আর ছোঁয়া হলো না। বেলাকে জ্বালানোর মোক্ষম সুযোগটা নিমিষেই হাত ছাড়া হয়ে গেল। নিজেকে বহু কষ্টে সংযত করলো আদ্র। তপ্ত নিশ্বাস ফেললো অনেকটা রয়েসয়ে। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক দিন পর। বিস্তর নভস্থলে কালো ঘন মেঘেদের দেখা নেই। তবুও দন্দের রেশ ধরে ঠিকই চেঁচামেচি করছে তারা। এক, দু সেকেন্ডের মাঝেই পুরো ঘরে কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব চলে এসেছে। বেলার শরীর মৃদু কাঁপছে। উষ্ণতার খোঁজে নিরবে অভিযোগ জারি করছে সে। আদ্র উঠে বসলো। বেলার গলা অব্দি কম্বল টেনে নিজেও শুয়ে পরলো আবার। পুরুষালি শক্ত দেহের সঙ্গে বেলার ছোট্ট, নরম দেহখানি প্রগাঢ় ভাবে জড়িয়ে নিলো।
বেশকিছুক্ষণ পর তন্দ্রা কাটলো বেলার। তবে তক্ষুণি চোখ মেললো না সে। মাথার টনটন যন্ত্রণায় দূর্বল লাগলো নিজেকে। কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো। আদ্র কোমল স্বরে ডাকলো তখন,
—“বেলা? উঠবে না?”

বেলা নিরুত্তর। নখের ধারালো আঘাতে হঠাৎ-ই খামচে ধরলো আদ্রর বুকের একটুখানি অংশ। শার্ট ভেদ করে উন্মুক্ত ত্বক ক্ষতবিক্ষত হলো। আদ্র কোনোরুপ শব্দ করলো না। নড়লোও না। সহ্য করে নিলো চিনচিনে সূক্ষ্ণ ব্যথা। মৃদু স্বরে প্রচন্ড কাতরতা নিয়ে বেলা জিজ্ঞেস করলো,
—“নেতা সাহেব, আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না তো কখনো?”

যেন বুকে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ তান্ডব করছিলো। হুট করেই প্রবল ঝড়ে তান্ডবটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হলো। এলোমেলো হলো সব। ছুটাছুটি করলো। অস্থির হলো ভেতরটা। মনে মনে হাজারবার বললো,
—“কক্ষনো না। কক্ষনো না।”
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেঁজালো আদ্র। নিষ্প্রভ স্বরে অকপটে বললো,
—“তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার কোনো কালেই আসবে না বেলা। আমি ফিঁকে পরে যাবো।”

বেলা শুনলো। তবুও শান্ত হলো না তার নিষ্ঠুর মন। স্বান্তনা অব্দি পৌঁছালো না গহীন ডাকঘরে। আবারও ডুকরে উঠলো হালকা শব্দে। তৎক্ষণাৎ কড়া নজরে তাকালো আদ্র, “কাঁদতে মানা করেছিলাম বেলা। তবুও কাঁদছো না? আমার কথা কি তুমি শুনবে না বলে পণ করেছ? এত জ্বালাচ্ছো কেন?”

বেলা থামলো না। আওয়াজ ক্ষীণ বাড়ালো। আদ্রর সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে খুব জোড় লাগিয়ে বলতে লাগলো,
—“আমার ভিষণ ভয় হয় আদ্র। ইদানিং সেই ভয়টা আরও বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনাকে কোথাও যেতে দিতে ইচ্ছে করে না। নিজের কাছে রাখতে ইচ্ছে করে। সবসময় অজানা আতঙ্কে বুক কাঁপে। যদি আপনার কিছু হয়? এমন কঠিন পেশায় জড়ালেন কেন আদ্র? সহজ কোনো পেশা ছিল না? আমাকে এভাবে কাঁদান কেন? আমি সহ্য করতে পারি না।”

নিশ্বাস ফুরিয়ে এলো। কথা থামলো। জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিলো সে। আবারও কিছু বলতে নিলেই নিজের সঙ্গে শক্তভাবে চেপে ধরলো আদ্র। কপালে অধর ছোঁয়ালো দীর্ঘক্ষণ, বহুক্ষণ, খুবক্ষণ। গাঢ় স্পর্শে মাতোয়ারা হলো পবন, দৃঢ় হলো অনুভূতি।
জোড়ালো কণ্ঠে আদ্র আশ্বাস দিলো,
—“আমার কিচ্ছু হবে না বেলা। আমি সবসময় তোমার সঙ্গেই থাকবো।”
অভিমানি প্রিয়তমা নিমিষেই বিশ্বাস করে নিলো যেন। পলক ঝাপটাতেই অশ্রুসিক্ত নেত্র বেয়ে একবিন্দু মুক্তদানা গড়ালো। মোলায়েম স্পর্শে পানিটুকু মুছে দিলো আদ্র। প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—“ও বাড়ি যাবে না? বিকাল হয়ে আসছে। পরে কিন্তু আমি আর যেতে দেবো না।”
বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে থাকা বেলার ছোট্ট উত্তর, “যাবো না।”
—“আচ্ছা। আমি কিন্তু আর পাঠাচ্ছি না। আমার কাছেই রাখবো। যেতে দিবো না। তুমি কাঁদলেও না।”

বৃষ্টি প্রবলই বাড়ছে। আওয়াজ হচ্ছে, ঝরঝর! ঝরঝর! স্পষ্ট শুনতে পারছে বেলা। এই বৃষ্টির মাঝে আদ্র কখনোই তাকে ও বাড়ি যেতে দিতো না। সে জানে। ধীরস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “ক’টা বাজে?”
বেলার কারণে কাপড় পাল্টাতে পারেনি আদ্র। ঘড়িও খোলা হয়নি। হাত উঁচিয়ে সময়টা দেখলো সে। উত্তর দিলো, “৩টা।”

দুপুর তিনটা! অনেক বাজছে। এতক্ষণ শুয়ে থাকা ঠিক হবে না। আদ্র এখনো না খেয়ে আছে। পরনের শার্ট অব্দি পালটায় নি। বেলা আর শুয়ে থাকতে চাইলো না। নিশ্চয়ই লোকটা খুব ক্ষুধার্ত। মুখ ফুটে বলছে না হয়তো। পিটিপিট করে তাকালো সে। একদফা সময় নিয়ে সুদর্শন পুরুষটিকে দেখলো। উঠে যেতে নিলেই আবারও চেপে ধরলো আদ্র। বেলা চমকালো। ভড়কালো কণ্ঠে বললো,
—“কি করছেন? উঠতে দিন।”
—“আরও কিছুক্ষণ থাকো। এখন উঠতে হবে না।”
—“কিন্তু আপনি তো এখনো খাননি। সবার বোধহয় এতক্ষণে খাওয়াও শেষ! খাবার গরম করতে হবে। গোছাতে হবে। কত কাজ!”

একরোখা আদ্র একদমই পাত্তা দিলো না সেকথায়। বেলা আবারও দিরুক্তি করতে চাইলেই সে তার শক্ত, ভারি হাত-পাগুলো বেলার একটুখানি শরীরের ওপর উঠিয়ে দিলো। কেমন দমবন্ধ হয়ে আসলো। ছটপট করলো বেলা। পরক্ষণেই আবার শান্ত হয়ে গেল। ধাতস্ত হলো এহেন অপরিচিত কান্ডে। আদ্র ততক্ষণে তার গলার মাঝে মুখ গুঁজে দিব্যি আছে।
বেলা ডাকলো, “শুনুন।”
অস্ফুট স্বরে উত্তর দিলো আদ্র, “হু।”
—“আপনি সবসময় নিজের আশেপাশে গার্ড রাখবেন। সাবধানে থাকবেন। খারাপ লোকদের সঙ্গে একদমই মিশবেন না।”
যেন ছোট্ট একটা বাচ্চাকে নিয়ম শিখাচ্ছে বেলা। আদ্রর হাসি পেল। নিঃশব্দে হাসলোও। টের পেল না বেলা।
—“আচ্ছা।”
—“টিভিতে আপনার কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো আপনি—”

কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলো না সে। আদ্রর ফোন বাজছে। স্ক্রীনে আকিবের নাম জ্বলজ্বল করছে। বেলা বেশি ভাবলো না। রিসিভ করে আদ্রর কানে রাখলো। খুব অল্প করে, আবছাভাবে আকিবকে কি যেন বলতে শুনলো সে। বুঝতে পারলো না। অথচ কথাটা শোনা মাত্র আদ্র উঠে বসেছে। বেলা একটু অবাকই হলো। তাকালো আদ্রর মুখশ্রীপানে। গম্ভীর চিত্তে সে তখন ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে বলছিল, “পাশের এলাকার মেন্টাল হস্পিটালটা চেনো না? নতুন হয়েছে যেটা? ইমার্জেন্সি একটা কেবিন বুক করো। বাকিটা আমি দেখছি।”

বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়েছে আদ্র। বেলা তখনো অভিনব চোখে তাকিয়ে ছিল। প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছে না। আদ্র অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে বললো,
—“আলমারি থেকে শার্ট বের করো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
—“কোনটা বের করবো?”

জিজ্ঞেস করলো বেলা। আদ্র একপলক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, “তোমার যেটা পছন্দ।”

___________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

প্রিয় বেলা

৩৩.
আদ্রর বেহিসাব জয়ে অপমান, ক্রোধ আর আক্রশে ফেঁটে যাচ্ছে ইখতিয়ার। একদন্ড শান্তি মিলছে না অন্তরে। দূষিত ইগো জ্বালিয়ে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে ভেতরটা। মস্তিষ্ক ফাঁকা। প্রচন্ড রাগে থরথর করে কাঁপছে শরীর। আজ তিনদিন হতে চলেছে সে কারাগারে বন্দী। কালকে সকালে তার ব্যক্তিগত উকিল আসার কথা ছিল। আসেনি। আজকেও আসছে না। যোগাযোগের সব মাধ্যমও বন্ধ করে দিয়েছে আদ্র। ধমকাধমকি, গালিগালাজ কিংবা ক্ষমতার দাপট দেখিয়েও পার পাওয়া যাচ্ছে না। ময়লা গেঞ্জিটা দু’হাতে ঝেড়ে মেঝেতে সশব্দে বসলো সে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে, পা দু’টো দুদিকে ছড়িয়ে। কানে কনিষ্ঠ আঙুল ঢুকিয়ে গুতালো কিছুক্ষণ। মুখ বাঁকালো। কি যেন ভাবলো মনে মনে। বিড়বিড় করে আদ্রকে বিশ্রী ভাবে গালমন্দ করলো। পরক্ষণেই অশ্রাব্য ভাষায় কন্সটেবলের উদ্দেশ্যে খশখশে কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো,
—“ম***** কতগুলো! একটু কল করতে দিলে কি তোর জাত যাইতো রে? শালা ****। ছাড়া পাইতে দেয় একবার। তোদের শরীরের হাড্ডিগুলা যদি আমি গুঁড়াগুঁড়া না করি!”

কন্সটেবল আসরাফ বিরক্ত হলো খুব। প্রতিদিন এক জ্বালা সহ্য করা যাচ্ছে না। ভেতরটা বিষিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে আটকাতে পারলো না সে। ইখতিয়ারের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। কড়া কণ্ঠে সাবধান করলো,
—“ছাড়া তো তুই এমনেও পাবি না। সেই আশা বাদ দে। এভাবেই পঁচে মরবি। সামনে দেখ তোর সাথে কি কি হয়। তারপর দেখমু তুই আমার কি ব*** করতে পারিস।”

ইখতিয়ার দ্বিগুণ রেগে গেল। বয়সের অল্প ছাপ যেন নিমিষেই পরে গেল নেত্রপল্লবের একদম কোণ ঘেঁষে। খেঁকিয়ে উঠলো,
—“বেশি জবান চলতাছে না? জিহ্বা কাইট্টা ফেলবো। চোখ নামায়া কথা বলবি আমার সাথে। চাকর তোরা। পায়ের তলানিতে ঘর কইরা থাকোস। ওই হিসাবেই নত হইয়া চলবি। দ্বিতীয়বার যেন এই সাহস আর না দেখি।”
আসরাফ উত্তর দিলো না এবার। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে কটমটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। চোখে ভয়ংকর ভস্ম করে দেওয়ার উদ্যোম ইচ্ছে। শুধু ক্ষমতাটাই নেই তার।
মাথার ওপর ছোট্ট জানালাটির দিকে নজর পরলো ইখতিয়ারের। অনেক ছোট হওয়ায় ফাঁকফোকর দিয়ে একটু একটু করে আলো আসছে। সেই আলো পরখ করলো সে। ভেবে নিলো, এখন দুপুর নেমে এসেছে ভূ-স্থলে। পেটে মোচড় দিলো ক্ষুধায়। প্রতিবারের মতো এবারও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো,
—“ওই ****। কইটা বাজে? খাবার কই আমার? এখনো আনোস নাই কেন? যা, নিয়া আয়। যাস না কেন?”
কন্সটেবল আসরাফ এবারও জবাব দিলো না। শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো মাত্র। তাকালোও না। ইখতিয়ার আবারও চেঁচামেচি শুরু করলে অন্য একজন কন্সটেবল এগিয়ে এলেন সেখানে। বেজায় বিরক্ত হয়ে বললেন,
—“এহনো খানা দেওনের সময় অয় নাই। তোমারেও দেওয়া যাইবো না। স্যারের নিষেধ আছে। চুপ কইরা বইয়া থাহো। সময় হইলে দিয়া যাইবো।”
ইখতিয়ারের তেজি উত্তর, “আমি এখন খাবো। আমার জন্য এখন নিয়ে আয়।”
—“বলছি না এহন দেওয়া যাইবো না? বেশি উড়লে খানাই বন্ধ কইরা দিমু।”
—“আমাকে থ্রেড দিচ্ছিস? এর পরিমাণ কি হবে জানোস?”

প্রবল ধমকের সুরে বলে উঠলো ইখতিয়ার। কন্সটেবল ভয় পেল না। মুচকি হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি। নির্ভয় কণ্ঠে বললো,
—“আমার পরিমাণ কি হইবো আমার জানা আছে। তোমার কি হইবো সেইটাও জানি। ইকটু পরে বাঁচবা নাকি মরবা তারও ঠিক নাই। চুপচাপ বইয়া থাহো। পারলে ক্ষমা চাও আল্লাহর কাছে। পরকালে ক্ষমা পাইলেও পাইতে পারো।”

ইখতিয়ার মনে মনে খুব ভাবলো। সবাই একই কথা বলছে কেন? একটু পর কি হবে তার? আদ্র কোনো নতুন ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছে না তো? ঘটাতেও পারে। তার দ্বারা বিশ্বাস নেই। ভেতরটা আরও উদগ্রীব হলো ইখতিয়ারের। অস্থির হলো। একবার ভাবলো, আসরাফকে জিজ্ঞেস করবে। পরপরই অহংকারের প্রচুরতায় টু শব্দটিও করতে পারলো না। কণ্ঠনালি থেমে রইলো। উকিল এইতো এসে যাবে। তারপরই ছাড়া পাবে সে।— এতটুকু বার বার আঁওড়িয়ে নিজেকে নিজেই শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেল ইখতিয়ার।

সময় গড়িয়ে দুপুর থেকে বিকাল হলো। ধোঁয়াধুঁয়ি ছাড়া নোংরা হাতে ভাত খাওয়া শেষ করে মাত্রই আরাম করে বসেছে ইখতিয়ার। সাচ্ছন্দ্যে ঢেকুর তুলছে সেকেন্ড গড়াতে না গড়াতেই। এসময় হঠাৎ জেলখানার রডের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলো কন্সটেবল আসরাফ। ভীষণ অনিচ্ছা নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
—“আপনার জামিন হয়ে গেছে। ভেতরে ওসি সাহেব আর আপনার উকিল বসে আছেন। আসুন।”

ইখতিয়ার চোখ তুলে তাকালো। ক্রুর হাসলো। হাসতে হাসতে উপহাস করে উঠলো, “আপনি? এত সম্মান? জামিন পেতে না পেতেই নিজের অবস্থান বুঝে ফেলেছিস তাই না? কিন্তু লাভ নেই। আজ রাতে আর বাসায় ফেরা হচ্ছে না তোর।”
আসরাফ ভাবান্তরহীন। কোনোরুপ প্রভাব পরলো না তার মাঝে। অস্পষ্ট হাসলো। ওসির কেবিনের বদলে কারাগারের কোনো এক নিচের ঘরে নিয়ে গেল। ইখতিয়ার উৎফুল্ল মনে আশপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। অবিশুদ্ধ মস্তিষ্কে চলছিল আদ্রকে জব্দ করার ফন্দি, নিষ্ঠুর পরিকল্পনা।
আচমকা কিছু কন্সটেবল ঘিরে ধরলো তাকে। টেনেটুনে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। কৌশলে চেয়ারের শক্ত কাঠের সঙ্গে হাত, পা দঁড়ি দিয়ে বেঁধে দিলো। সহসা প্রচন্ড ভয়ে রক্ত শূণ্য হলো ইখতিয়ারের চোখ,মুখ। চুপসে গেল সে। তবুও দমলো না যেন। সর্বোচ্চ কণ্ঠে চেঁচালো, “এই ****। এভাবে বাঁধছিস কেন আমাকে? খুল, সব খুল এখনি। নাইলে কিন্তু সবাইরে মাটিতে পুতে ফেলবো। ছাড়!”

ইখতিয়ারের ছটফট, আকুলতা সব মিলিয়ে মুহুর্তটাকে প্রচন্ড উপভোগ করলো আসরাফ। দাঁত বের করে হাসতে লাগলো। আদ্র, ওসি আর আকিব এলো এর একটু পরই। ইখতিয়ার তখনো ছেড়ে দেবার জন্য চেঁচাচ্ছিল। আদ্রকে দেখে থমকালো ক্ষীণ। পরক্ষণেই এরচেয়েও অধিক আক্রোশ নিয়ে বললো,
—“এগুলা সব তোর কাজ না? ভালো করিস নাই তুই। একদম ভালো করিস নাই। এখন আমি তোদের কি করবো সেটা তুই কল্পনাও করতে পারবি না। তোর পরিবারের একেকটারে তোর বাপের মতো যন্ত্রণা দিয়ে মারবো। রক্ষিতা বানাবো তোর প্রেমিকারে। ****বাচ্চা সময় থাকতে ছাড় আমারে। নাইলে কিন্তু—”

ইখতিয়ারের কথা শেষ হলো না। মুখশ্রী শক্ত করে ভয়াবহ কণ্ঠে আদেশ দিয়ে উঠলো আদ্র,
—“মেশিন বের করো।”

তাড়া জাগলো সবার মাঝে। রুমের এককোণ থেকে মাঝারি আকারের মেশিনটা আলগে ইখতিয়ারের কাছাকাছি রাখলো। গেঞ্জি ছিঁড়ে ফেললো। উন্মুক্ত বুক, হাত আর কপালে তাড় জাতীয় কি যেন লাগিয়ে দিলো। ইখতিয়ারের চোখ বড় বড়। ইতিমধ্যে যা বোঝার বুঝে ফেলেছে সে। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে কাঠ। জোড় গলায় তোতলে উঠলো,
—“তুই কিন্তু ভালো করছিস না আদ্র। ওদের বল আমার কাছে থেকে সরতে। বল!”

কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই মাত্রারিক্ত বৈদ্যুতিক শক কপালে, হাতে, বুকে প্রচন্ড ভাবে ঝটকা দিতেই শরীর ঝাঁকিয়ে উঠলো তার। চোখ মুদলো, খিঁচে এলো বাজেভাবে। চার’পাঁচ সেকেন্ড এ যন্ত্রণাময় মুহুর্তটি চললো। পরপরই হাঁফ ছাড়লো ইখতিয়ার। সামান্য ব্যবধানে ঘেমে গেল শরীর। মাথা টনটন করে উঠলো অসহনীয় কষ্টে। সহ্য করতে পারছে না। দেহের সঞ্চার কমছে। দূর্বল হয়ে আসছে ক্রমশই। আরও একবার বৈদ্যুতিক শক দিতে চাইলেই দূর্বল গলায় চিৎকার করে উঠলো ইখতিয়ার,
—“আমাকে ছেড়ে দেয় আদ্র। আমি আমার সব দোষ মেনে নিবো। তোকে কিচ্ছু করবো না। ছেড়ে দেয় আমাকে, ছেড়ে দেয়।”
কণ্ঠ থামলো। নতুন উদ্যোমে শরীরের শিরা-উপশিরায় বিদ্যুৎ খেলে যেতেই শক্ত হয়ে খিঁচে রইলো ইখতিয়ার।

আদ্রর চোখে,মুখে একরাশ আনন্দের দাম্ভিকতা। ঠোঁটে লেগে আছে ভয়ংকর ক্রুর হাসি। জ্বলজ্বল করছে কালো নেত্রজোড়া। রক্তিম হয়ে আছে সাদা অংশ। ইখতিয়ারের শোচনীয়তা দেখে বিদ্রুপ করে উঠলো সে,
—“আমার বাবাও একদিন বাঁচার জন্য অনুরোধ করেছিল ইখতিয়ার। তোরা শুনিস নি। মেরে ফেলেছিস। কিন্তু আমি তোকে মারবো না। পার্থক্যটা এখানেই।”

তৃপ্ত নিশ্বাস ফেলে আকিবকে আবার বললো, “তোমার ভাবীকে কল করো আকিব। বলো, তার নেতা আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে।”

ঝলমলে আকাশ। রোদ্দুরে ভীষণ আদুরে আদুরে ভাব। পাখিরা ডাকছে। কিচিরমিচির। ক্ষুধার্ত বেলা আদ্রর অপেক্ষায় ঘুমিয়েই গিয়েছিল প্রায়। গালে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেতেই তন্দ্রা কাটলো। পিটপিট করে তাকালো। ঝাপসা চোখ স্পষ্ট হলো ধীরে ধীরে। প্রেমিক পুরুষের মুখশ্রী ভেসে উঠলো একদম সামনে। অধরে ঈষৎ হাসি তার। চোখের তীক্ষ্ণ, দৃঢ় চাহনি যেন গাঢ় ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে। লাজুকরাঙা গালে আলতো হাসলো বেলাও। মন চাইলো, আদ্রর সদ্য ভেঁজা ঝাঁকড়া চুলগুলো খুব করে ছুঁয়ে দিতে। ধারালো দাঁড়ির ভাঁজে হাত বুলাতে। নিজেকে সংযত করলো সে। ঘুমকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“কখন এসেছেন?”

আদ্র হাসোজ্জল মুখেই উত্তর দিলো, “আধঘণ্টা হয়েছে।”
—“কিছু খেয়েছেন?”

আদ্র মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ, না। তৎক্ষণাৎ উঠে বসলো বেলা। এলোমেলো শাড়ির আঁচল সামলালো। হাত উঁচিয়ে চুল খোঁপা করলো। এরপর ব্যস্ত হয়ে বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো,
—“আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। একটু বসুন। আমি খাবার আনছি।”

কিন্তু তা আর করা হলো না। বাঁধা দিয়ে হাত টেনে ধরেছে আদ্র। বুকের সঙ্গে প্রগাঢ় ভাবে মিশিয়ে নিয়ে বললো,
—“আমি নিয়ে এসেছে। ওই যে, টেবিলে প্লেট রাখা। আসো, খাইয়ে দিচ্ছি।”

বলতে বলতে টি-টেবিল থেকে প্লেটটা নিলো আদ্র। অনভ্যস্ত হাতে একলোকমা ভাত বেলার ঠোঁটের কাছে ধরলো। বেলা পলক ঝাপটালো বিমূঢ়তা নিয়ে। ভাতটুকু কোনোমতে মুখে নিতেই বিশ্রী তিক্ত স্বাদ টের পেল সে। তবুও নজর বিন্দু মাত্র সরালো না। অবাক নয়নে চেয়েই রইলো। আদ্র ভ্রু কুঁচকে ফেলেছে। আরেক লোকমা ভাত এগিয়ে সে গম্ভীর গলায় বললো,
—“এভাবে তাকিয়ে থাকবে না বেলা। তুমি বিরক্ত করছো আমায়।”
বেলার কি যেন হলো। সে তবুও চেয়ে রইলো। লজ্জা ভীড় জমালো না। প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আপনি খাচ্ছেন না কেন?”
তার আগের মতোই উত্তর, “খাচ্ছি।”

খাওয়ানো শেষ। হাত ধুঁয়ে বেলাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পরলো আদ্র। এক কম্বলের নিচে। একে অন্যের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে। বেলা তখনোও আদ্রর পানে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। আদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কোমড় জড়িয়ে রাখা হাতটা শক্ত করে লহু স্বরে বললো,
—“ঘুমাও বেলা। এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না।”

বেলা ঠোঁট কামড়ালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে দৃষ্টি সরালো। খুব আস্তে করে বলবো,
—“আমার ঘুম আসছে না তো।”
আদ্র ভ্রু কুঁচকালো, “কেন?”
—“একটু আগেই তো ঘুমিয়েছি।”
—“তবুও ঘুমানোর চেষ্টা করো। আমার ঘুম আসছে।”

বেলা হাঁসফাঁস করছে। ঘুম আসছে না কিছুতেই। চোখ তুলে বারবার দেখছে সুদর্শন লোকটাকে। আনমনে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এত সুন্দর কেন আদ্র?”

আদ্র চমকালো। বন্ধ চোখ তক্ষুণি মেললো। কিছু বলার পূর্বেই অনুভব করলো, বেলার শরীরের তাপমাত্রা আস্তে আস্তে অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। উষ্ণতা বাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তার অল্প খাওয়ার রহস্যটাও পরিষ্কার হয়ে এলো আদ্রর কাছে। ধমকের সুরে সে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করলো,
—“বেলা? তোমার জ্বর এসেছে? বলোনি কেন?”

বেলার হঠাৎ কেন যেন খুব কান্না পেল। তীব্র কান্না। অভিমান হলো সামনের পুরুষটির ওপর। আদ্রর শুকনো শার্ট চোখের লবণাক্ত পানিতে ভিঁজিয়ে দিতে উঠে পরে লাগলো সে। আদ্র হেসে ফেললো। নিশব্দে, মাথা ঝুঁকিয়ে। কপালে অধরের ছোঁয়া স্থির রেখে বললো,
—“আমি আদ্র ইয়ানিদ কথা দিচ্ছি বেলা। তোমাকে আজীবন সুখের কান্না কাঁদিয়েই যাবো।”

_________________

চলবে~