প্রীতিলতা আসবে বলে
লেখিকা :আফরিন ইসলাম
সিজন :৩
পার্ট :৩
প্রীতি ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে ৷তার সামনে বাড়ির মালিক বসে আছে ৷কফির কাপে চুমুক দিয়ে প্রীতি বলল
আপনার বাড়ীটা আমি কিনতে চাই কাকু ৷এই বাড়ীটা আমার দরকার ৷
কিন্তু মা আমি তো বাড়ীটা বিক্রি করতে চাই না ৷সম্পত্তি বলতে তো এই বাড়ীটাই আছে আমার ৷তুমি তো জানো আমার একটা ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই ৷ভবিষ্যতে ছেলেটা এখানে থাকবে ৷
প্রীতি তার সামনে বসা মধ্য বয়স্ক লোকটা হাত ধরে বলল
কাকু আপনি তো জানেন আপনার এই বাড়ীতে এখন শুধু আমি থাকি না ৷আমার সাথে আরো বিশটা অসহায় মেয়ে থাকে ৷এই বাড়ীটার বিনিময়ে আমি আপনাকে দশ কোটি টাকা দিচ্ছি ৷আর শুনেছি আপনার ছেলেটা বেকার ৷তার চাকরির ব্যবস্থাও আমি করে দেব ৷আপনি না করবেন না কাকু ৷এই মেয়ে গুলোর কথা একটু ভাবুন ৷আমি চাইলে অন্য কোথাও বাড়ী কিনতে পারতাম ৷কিন্তু আপনি আমার পরিচিত ব্যক্তি ৷আমি আপনাকে দ্বিগুন টাকা দিলাম ৷আপনার যখন ইচ্ছা এখানে আসবেন ৷কিন্তু প্লিজ না করবেন না ৷
মধ্যবয়সি লোকটা প্রীতির অনুরোধ ফেলতে পারলো না ৷প্রীতিকে বাড়ীটা লিখে দিতে রাজী হলো ৷
বাড়ীওয়ালাকে বিদায় দিয়ে প্রীতি রেডি হয়ে বাইক নিয়ে বেড়িয়ে গেল ৷ তার এখন অনেক কাজ বাকি ৷ সবাইকে বলে গেছে দুপুরে আসবে না ৷
একটা প্রাইভেট হাসপাতালের সামনে প্রীতি নিজের বাইকটা থামালো ৷কিছু দিন আগে ডাক্তারের কাছে সে এসেছিল ৷ডাক্তার কিছু টেস্ট করাতেও বলে ছিল তাকে ৷টেস্ট গুলো করালেও সময়ের অভাবে হাসপাতালে আসতে পারে নি সে ৷তাই আজ চলে এসেছে ৷
ডা:গোবিন্দ দত্তের সামনে প্রীতি বসে আছে ৷ডা: প্রীতির রিপোর্ট গুলো দেখে বললেন ৷
মিস প্রীতি আপনার মাথার অবস্থা ভালো না ৷যত দ্রুত পারবেন অপারেশনটা করুন ৷যদিও অপারেশনটা অনেক ব্যয় বহুল ৷তবুও বলবো অপারেশনটা করলে হয়তো আপনি বেচেঁ যেতে পারেন ৷কারন আপনার ব্রেইনের সমস্যা গুলো বিরাট আকার ধারন করছে ৷আপনার জীবনের ঝুকি বেড়ে যাচ্ছে ৷মাথায় কোনো ভাবে আঘাত পেলে তা আপনার জন্য ভালো হবে না ৷তাই যা করার দ্রুত করুন ৷আর আপনাকে ঔষুধ দিলাম ৷এগুলো নিয়ম মেনে খাবেন ৷আর মাথা ব্যথা করলে নিজেকে শান্ত রাখবেন ৷
প্রীতি রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে গেল ৷বাইক নিয়ে আবারো বেড়িয়ে গেল নিজের গন্তব্যে ৷প্রায় ত্রিশ মিনিট পর প্রীতি বাইক থামলো একটা প্রতিবন্ধী আশ্রমের সামনে ৷এই নিয়ে দুইবার সে এখানে এসেছে ৷প্রীতি নিজেই দারোয়ানকে সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলো ৷ভেতরে যেয়ে দেখলো ছেলে মেয়ে গুলো খেলছে ৷আশ্রমে থাকা ছেলে মেয়ে গুলোকে প্রীতির কাছে এক একটা জান্নাতী ফুলের মতো লাগে ৷যাদের ভিতরে কোনো পাপ নেই ৷কিন্তু নানা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আজ তারা সমাজের বুকে প্রতিবন্ধী ৷যাদের অনেকের পরিবার আছে ৷আবার অনেকের পরিবার থেকেও নেই ৷
প্রীতি সোজা আশ্রমের ফাদারের কাছে চলে গেল ৷উনি একজন খ্রিষ্টান ৷ফাদারের সামনে চেয়ার টেনে প্রীতি বসলো ৷ফাদার প্রীতিকে দেখেই চিনলো ৷কারন এর আগে যখন প্রীতি এখানে এসেছিল ৷তখন সে বলে ছিল যে সব ছেলেমেয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে ৷ফাদার মুচকি হেসে প্রীতিকে বললেন
তা কি খবর মাই চাইল্ড ৷
জ্বী ভালো ৷আপনার সাথে একটু বিশেষ দরকার ছিল ৷
জ্বী বলো ৷
গতবার যখন এসে ছিলাম ৷তখন আপনি বলেছিলেন এখানে প্রায় একশ শিশু আছে ৷যাদের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা লাগবে ৷আমি তাদের চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করতে চাই ৷তাদের চিকিৎসা করতে যত টাকা লাগবে আমি দেব ৷আপনি শুধু খরচের পরিমান আমাকে জানাবেন ৷
ফাদার নিজের চোখের চশমা খুললেন ৷তারপর বললেন
আজ পর্যন্ত অনেকেই সাহায্যের কথা বলেছে ৷কিন্তু পরবর্তীতে আর এগিয়ে আসে নি ৷
আমাকে এইবার বিশ্বাস করতে পারেন ৷ আমি তাদের মতো এখানে কয়েকটা ভিডিও করতে আসি নি ৷আমার কয়েকটা লাইকের কোনো দরকার নেই ৷ আমি কাল টাকা নিয়ে আসবো ৷আপনি আজ রাতে টাকার পরিমান আমাকে জানাবেন ৷ আমি সব ব্যবস্থা করবো ৷
ফাদার নিজের চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন
ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক মা ৷আমি জানি না তুমি কে ৷কিন্তু ঈশ্বর তোমায় হাজার বছর বাচিঁয়ে রাখুক ৷তুমি যদি একটু আশ্রমটা ঘুড়ে দেখতে তাহলে খুব ভালো লাগবে আমার ৷প্রীতি ফাদারের কথায় সায় দিল ৷
ফাদারের সাথে ঘুড়ে ঘুড়ে আশ্রমটা দেখছে প্রীতি ৷একটু পর ফাদার সব বাচ্চাদের ডাকলো ৷বাচ্চারা দৌড়ে এলো ফাদারের কাছে ৷ফাদার প্রীতির দিকে তাকিয়ে বাচ্চাদের বলল
ওর নাম প্রীতি বাচ্চারা ৷ তোমাদের চিকিৎসার সব টাকা ও দেবে ৷তোমরা আবার সুস্থ হয়ে যাবে ৷
একটা বাচ্চা লাঠিতে ভর দিয়ে হেটেঁ প্রীতির কাছে এলো ৷তারপর মাথা নিচু করে বলল
আপু আমি না হাটতে পারি না ৷আমার খুব হাটতে ইচ্ছে করে ৷সবার মতো দৌড়ে খেলতে ইচ্ছে করে ৷তুমি আমার চিকিৎসা করাবে ৷জানো আমার মা বাবা কেউ নেই ৷গত বছর গাড়ী দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৷আর আমার পা অবশ হয়ে গেছে তারপর ৷আমি হাটতে চাই আপু ৷
প্রীতি হাটু গেরে বসে পড়লো মাটিতে ৷অন্য একটা মেয়ে এসে বলল আপু আমি এক চোখে দেখতে পাই না ৷এই দেখ আমার বাম চোখটা সাদা হয়ে গেছে ৷ডাক্তার বলেছে চিকিৎসা করাতে হবে ৷কিন্তু তাতে অনেক টাকা লাগবে ৷আমি দেখতে চাই আপু ৷ সবার মতো দুই চোখ দিয়ে দেখতে চাই ৷
অন্য আরেকটা বাচ্চা এসে বলল আমার কিডনী নষ্ট হয়ে গেছে ৷আমার একটা কিডনী ভালো আছে ৷যদি চিকিৎসা হয় তাহলে আমিও ভালো হয়ে যাবো ৷
তারপর আরো একটা বাচ্চা মেয়ে প্রীতির কাছে এলো ৷যার মুখটা পোড়া ৷খুব বিশ্রী ভাবে তার শরীর পোড়া ৷প্রীতির হাত পা কাপঁতে লাগলো বাচ্চা মেয়েটার অবস্থা দেখে ৷মেয়েটা প্রীতির হাত ধরে বলল
আপু আমার অপারেশন করাবে তুমি ৷জানো সবাই আমাকে দেখে ভয় পায় ৷কেউ কাছে আসে না ৷ আমি তো ইচ্ছে করে এমন হই নি ৷আমাদের বস্তিতে আগূনে লেগে গিয়েছিল ৷আগুন আমার শরীরে লেগে যায় ৷আমার মা মরে গেছে ৷বাবা আমার কাছে আসে না ৷আমাকে দেখলে নাকি তার ভয় লাগে ৷ তাই এখানে রেখে গেছে ৷আমাকে আবার সুন্দর করে দেবে আপু ৷তাহলে বাবা আমাকে আবার ভালোবাসবে ৷বাচ্চা মেয়েটার কথায় প্রীতি এবার শব্দ করেই কেদেঁ দিল ৷প্রীতির পাথরের মতো শক্ত হৃদয় কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ৷প্রীতি আগুনে পুড়ে যাওয়া মেয়েটার কপালে চুমু দিয়ে বলল
আমি তোমাদের চিকিৎসা করাবো ৷কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে ৷সুস্থ হবার পর তোমরা সবাই মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া করবে ৷মানুষের মতো মানুষ হবে ৷আর এই বুড়ো ফাদারকে অনেক ভালোবাসবে ৷কি রাজী তো সবাই ৷
সবাই এসে প্রীতিকে জরিয়ে ধরলো ৷তারা সবাই একসাথে বললো তারা রাজী ৷বাচ্চা গুলো কাদঁছে ৷তাদের সাথে প্রীতিও কাদঁছে ৷ফাদার দূরে দাড়িয়ে নিজের চোখের পানি বারবার মুছে যাচ্ছে ৷
প্রীতি সন্ধ্যার দিকে আশ্রম থেকে বের হলো ৷
রাত আটটা বাজে ৷একটা ফাকা রাস্তায় প্রীতি বাইক থামিয়ে দাড়ালো ৷আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে প্রীতি ৷তার চোখে টলমল পানি ৷ আকাশের দিকে প্রীতি তাকিয়ে বলল
বাবা তুমি কি আমার কথা শুনতে পাও ৷তোমাদের কাছে আসার দিন ঘনিয়ে আসছে আমার ৷কি ভেবে ছিলে তুমি হ্যাকিং করা ঐ টাকা আমি নিজের স্বার্থে লাগাবো ৷ভুল ভেবেছো তুমি বাবা ৷আমার জীবনে এখন আর কোনো পিছুটান নেই ৷কিন্তু ঐ বাচ্চা গুলোকে এখনো অনেক দিন বাচঁতে হবে ৷তাদের বেচেঁ থাকতে হবে নিজেদের জন্য ৷এইবার আর স্বার্থপর হতে পারলাম না ৷পারলে ক্ষমা করে দিও , তোমার এই স্বার্থপর মেয়েকে ৷নিজের হাতে থাকা মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট গুলো প্রীতি ছিড়ে ফেলে দিল ৷চোখের পানি মুছে আবারো রওনা দিল নিজের বাড়ীর দিকে ৷
প্রীতি বাড়ীতে ফিরলো রাত দশটায় ৷প্রীতি দেখলো মেয়ে গুলো বসে আছে ৷প্রীতি তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
আপনাদের সাথে আমার একটু কথা আছে ৷একটু সময় হবে ৷সবাই সায় দিল প্রীতির কথায় ৷প্রীতি তাদের পাশে বসে বলল
আমি চাই আপনারা নিজেদের পায়ে দাড়ান ৷এই বাড়ীটা আমি আপনাদের জন্য কিনেছি ৷আমি চাই না আপনারা কারোর দয়া বেচেঁ থাকেন ৷বাড়ীতে বেশ কয়েকটা ঘর আছে ৷আপনারা এখানে হাতের কাজ করবেন ৷কাল থেকে আপনাদের প্রশিক্ষনের জন্য পাঠানো হবে ৷ এখন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন ৷
প্রীতি উঠে দাড়ালো ৷তারপর আবারো বলল আজ আর আমি খাবো না ৷ শরীরটা ভালো লাগছে না আমার ৷প্রীতি সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গেলেই পেছন থেকে একটা আওয়াজ এলো ৷
আমাদের জন্য কেন এত কিছু করছেন ৷
প্রীতি পেছনে তাকিয়ে বলল এটা আপনাদের হক ৷আর কিছু জানতে চাইবেন না কেউ ৷আমি বলতে পারবো না ৷
চলবে…