প্রীতিলতা আসবে বলে ৪ পর্ব-০৫

0
1168

প্রীতিলতা আসবে বলে
লেখিকা:আফরিন ইসলাম
সিজন :৪
পার্ট :৫

পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও খুনীকে বের করতে পারে নি ৷ এদিকে মেন্টাল হাসপাতালে মাসের পর মাস প্রীতির জীবন কাটতে লাগলো ৷ আর দিন দিন সে চুপ হয়ে গেল ৷তবে রাত হলে সে কাদঁতো আর কথা বলতো ৷নিজের পাশে তাকিয়ে নিজেই কাদঁতো ৷একটা সময় চিৎকার করতো খুব ৷প্রীতিকে তখন কেউ দমাতে পারতো না ৷ যাকে সামনে পেতো তাকে আঘাত করতো ৷যার কারনে একটা সময় তাকে লোহার শিকল দিয়ে আটকে রাখার ব্যবস্থা করা হয় ৷তবুও সে রাত হলেই একা একা কাদঁতো ৷কিছুক্ষন পর কাউকে চিৎকার করে বলতো আমায় ছেড়ে যেও না ৷আমাকে নিয়ে যাও সাথে করে ৷এখন আর কেউ আমাকে ভালোবাসে না তোমাদের মতো ৷এভাবেই দিন যাচ্ছিলো ৷একটা সময় প্রীতিলতা চিৎকার করে কাদাঁও বন্ধ করে দিল ৷কিন্তু একা একা বিরবির করে কথা বলা বন্ধ হলো না ৷

কখন দিন হতো আর কখন রাত হতো সেই হিসেব প্রীতি জানতো না ৷সে শুধু আবছা আলোর একটা ঘরে শিকলে বন্দি হয়ে জীবন কাটাতে লাগলো ৷

প্রীতিলতা মেন্টালে হাসপাতাল আজ এক বছরের বেশি ৷এসিপি শরীফ প্রীতিকে দেখতে গেলেন মেন্টাল হাসপাতালে ৷বরাবরের মতো প্রীতি তাদের সাথে কথা বলতো না ৷কিন্তু এসিপি শরীফের ছোট ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকতো খুব করে ৷যখন তাকিয়ে থাকতো ৷তখন একটা পলক ফেলতো না ৷

দীর্ঘ পাচঁ মাস পর প্রীতির পা থেকে শিকল খুলে দেওয়া হয় ৷ প্রীতিকে গোসল করিয়ে ভালো একটা জামাও পড়িয়ে দেওয়া হয় ৷মাথার চুল গুলো একদম নষ্ট হয়ে গেছে ৷চুল গুলো জটলা পাকিয়ে গেছে ৷শরীরের ফর্সা চামড়া ময়লায় ঢাকা পরে গেছে ৷এসিপি শরীফের স্ত্রী জাহানারা বেগম খুব যত্নে প্রীতিকে তৈরি করলো ৷তারপর প্রীতির গালে হাত দিয়ে বলল

এখানে থাকতে খুব কষ্ট হয় তোর তাই না ৷তোকে আর এখানে রাখবো না ৷আজ থেকে আমাদের সাথে থাকবি তুই কেমন ৷জাহানারা বেগম প্রীতির কপালে চুমু খেলেন ৷

প্রীতিকে হাসপাতাল থেকে ইচ্ছা করেই শরীফ নিয়ে এসেছে ৷তার কেন যেন মনে হচ্ছে মেয়েটাকে মেন্টাল হাসপাতালে রেখে তিনি ভুল করেছেন ৷ মেয়েটার অবস্থা ভালো না হয়ে আরো খারাপ হয়েছে ৷এখন থেকে তার এক ছেলে আর এক মেয়ে ৷ আল্লাহর আমানত তিনি অবহেলায় নষ্ট করতে চান না ৷যার জন্মের সন্তানই হোক ৷কিন্তু কারো না কারো অনেক আদরের সন্তান ৷তাই কারো সন্তানকে তিনি অবজ্ঞা করতে চান না ৷

এসিপি শরীফের কাছে প্রীতি আছে আজ তিন বছর পেরিয়ে গেছে ৷প্রীতিকে স্কুলে ভর্তি করেছে শরীফ ৷প্রীতিকে বাসায় শিক্ষক দিয়েও শরীফ পড়ান ৷মেয়েটার মাথার ব্রেন অনেক ভালো ৷কিন্তু না কখনো কথা বলে ৷আর না হাসে কখনো ৷ কিছু দরকার হলেও শরীফকে বলে না ৷মোট কথায় একটা রোবট ৷ কিছু দিন আগে ক্যারাটে স্কুলে সে ভর্তি হয়েছে ৷শরীফের কাছে হঠাৎ এই অদ্ভুত বায়না করে বসে সে ৷শরীফ আর না করে নি মেয়েকে ৷ শরীফ ইদানিং প্রীতিকে দেখে কিছুটা অবাক হয় ৷কেননা প্রীতি পত্রিকা পেলেই সেখানে থাকা অপরাধমূলক ঘটনা গুলো পড়ে ৷ আর সারা দিনেও নিজের ঘরের দরজা খোলে না ৷ তবে প্রীতির শরীর থেকে আজকাল সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যায় ৷শরীফ নিজের ভুল ভেবে উড়িয়ে দেয় ভাবনা গুলো ৷

এভাবেই দিন যেতে লাগলো ৷ মাস পেরিয়ে বছর যেতে লাগলো ৷ ছোট প্রীতিলতা স্কুল শেষ করে কলেজে পৌছে গেল ৷এত বছরে প্রীতি যেন শুধুই গম্ভীর স্বভাবের হয়ে উঠছিল ৷শরীফ প্রীতিকে যতই দেখতেন ততই অবাক হতেন ৷কেউ বলবে না এই মেয়েটার মাথায় সমস্যা আছে ৷কেউ দেখলে বলবে না মেয়েটার মাথার নার্ভ গুলো খুব খারাপ ভাবে ক্ষতি হয়েছে ৷কিন্তু যেই দিন প্রীতিকে শরীফ,বাসায় নিয়ে আসে ঐ দিন ডাক্তার তাকে সাবধান করে ছিল ৷প্রীতিকে হাসি খুশি রাখতে বলে ছিল ৷ কেননা প্রীতির মাথার ক্ষত আর লক্ষন গুলো বড্ড খারাপ দিক নির্দেশ করছিল ৷কেননা প্রীতি যত নিশ্চুপ প্রানহীন হবে ততই তার অন্যকে আঘাত করার প্রবনতা দেখা দেবে ৷যা ভয়ংকর রূপ ধারন করতে পারে ৷ সে সাইলেন্ট সাইকো হয়ে যেতে পারে ৷ কিন্তু শরীফ আর জাহানার হাজার চেষ্টা করেও কখনো প্রীতিকে হাসাতে পারে নি ৷হাসি তো দূর তার সাথে ঠিক মতো কথাই বলতে পারে নি ৷কখনো কথা বলতো না সে ৷খাওয়ার কাজ খেয়ে নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে দিত ৷ নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে যে কি করতো প্রীতি তা শরীফকে বড্ড ভাবাতো ৷খুব মন দিয়ে সে কিছু একটা করতো ৷মাঝে মাঝে আড়াল থেকে শরীফ দেখতো ৷মাঝে মাঝে প্রীতির মুখে সে ভয়ংকর এক হাসি দেখতে পেত ৷যা স্বাভাবিক নয় ৷এত কিছুর মাঝেও প্রীতি ক্যারাটে আর কুস্তিতে অনেক ভালো ছিল ৷যার জন্য শরীফ,প্রীতিকে অনেক ভালোবাসতেন ৷

দেখতে দেখতে প্রীতি কলেজ শেষ করে ভার্সিটিতে উঠে গেল ৷প্রীতি এখন বেশ বড় হয়ে গেছে ৷সিআইডি অফিসের সবাই প্রীতিকে চেনে ৷সবাই বেশ আদর করে তাকে ৷ একদিন নিজে ইচ্ছে করেই শরীফের পাশে বসলো প্রীতি ৷ তারপর ধীর গলায় বলল

আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল ৷

শরীফ বেশ আনন্দ ভরা গলায় বলল

বলনা মা কি বলতে চাস ৷

আমাকে কি কোনো ভাবে সিআইডিতে নেওয়া যায় ৷না মানে আপনাদের সাথে টুকটাক কাজ করতাম ৷

কেন মা হঠাৎ এ কথা ৷তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে ৷

আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না ৷এবার আপনি বলুন সিআইডি তে ছোট একটা পোস্ট আমায় দিতে পারবেন কি না ৷

পারবো দিতে ৷কিন্তু তুমি তো ছোট ৷

আমি একদম ছোট নই ৷আমার একটা চাকরি চাই ৷আমি ট্রেনিং দিতেও প্রস্তুত ৷

ওকে ৷দেখি কি করা যায় ৷শরীফ চলে গেল নিজের ঘরে ৷

বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেছে ৷শরীফ প্রীতিকে কোনো চাকরি দেয় নি ৷তবে সে বিভিন্ন কেসের জন্য কাজ করতে পারবে ৷ যদি তার কাজ ভালো হয় ৷তবেই সে সিআইডি হতে পারবে ৷এভাবেই দিন যাচ্ছিলো ৷প্রীতি বেশ ভালোই কাজ করছিল ৷প্রীতি একদিন কাজ করছিল ৷হঠাৎ বাইরে থেকে আসা চিৎকারে তার ধ্যান ভাঙ্গলো ৷একটু বাইরে তাকিয়ে দেখলো একজন বুড়ো মহিলা আর পুরুষ কাদঁছে আর বিচার চাইছে ৷ গেটে জোড়ে জোড়ৈ ধাক্কা দিচ্ছে আর কাদঁছে ৷কয়েকজন পুলিশ এসে তাদের নিয়ে যেতে লাগলো ৷প্রীতির পাথর হৃদয়ে কেন যেন মনে হলো ওদের কাছে যাওয়া উচিত প্রীতি দৌড়ে গেল ঐ দিকে ৷বুড়ো লোক দুটো চিৎকার করে কাদঁছে ৷ প্রীতি দৌড়ে ওদের কাছে যেয়ে পুলিশদের বলল

ওদের এভাবে কেন নিয়ে এসেছেন ৷

এরা কিভাবে অফিসের সামনে হট্টগোল করছে দেখেছো ৷বারবার বলছি কেস না করলে ৷আমরা কিছু করতে পারবো না ৷কিন্তু এরা তো কথাই শুনছে না ৷বলছে কেস করার টাকা নেই ৷

প্রীতি অন্য পুলিশদের দিকে তাকিয়ে বলল

ঠিক আছে আপনারা যান ৷আমি ওনাদের পাঠিয়ে দিচ্ছি ৷পুলিশ গুলো চলে গেল রেগে ৷

প্রীতি বুড়ো মানুষ দুটোর সামনে দাড়িয়ে বলল

কি হলো কাদঁছেন যে ৷আগে বলুন কিসের বিচার চান ৷কি হয়েছে আপনাদের ৷

বুড়ো মহিলাটা আচঁলে মুখ গুজে কাদঁতে কাদঁতে বলল

ওরা আমার সোনার চান নাতিডারে মাইরা ফালাইছে গো মা ৷আমার নাতিডারে গতকাইল তিনদিন পর পাইছি ৷পাশের এলাকার বালুর ভিতরে ঢুকাইয়া রাখছিল মাইরা ৷গতকাইল সকালে কুকুরে খুইড়া বাইর করছে ৷আমার নাতিডারে তিন দিন পাগলের লাহান খুজছি মা ৷কিন্তু পাই নাই ৷গত দুই দিন আগে আমার নাতিডার বিদেশ যাওয়ার কথা আছিলো ৷তার আগের দিন বিকালে খেলার কতা কইয়া ঘর থেইকা নিয়া গেল ৷ ওরা ঠিক আইলো ৷কিন্তু আমার নাতি আর আইলো না ৷ইতালি যাওয়া কথা আছিলো ৷আমারে কইছিল নানি তোমারে রানীর মতো রাখমু ৷কিন্তু আমার নাতি তো জানে না ৷ওরে ছাড়া আমার আর কিছু লাগবো না ৷আমার নাতির মুখটা ইট দিয়া থেতলাইয়া দিছে মা গো ৷আমার নাতির নাক ,মুখ থেতলাইয়া দিছে ওরা চাইর জনে মিল্লা ৷পুলিশে কেস নেয় না মা ৷ওগো মতো বড় লোকের লগে আমরা কেমনে পারমু ৷ আমাগো তো নুন আন্তে পান্তা ফুরায় মা ৷ আমার নাতির ভালো ওরা দেখতে পারলো না ৷মাইরা দিল আমার সোনার টুকরারে ৷ দুই বছর আগে এক্সিডেন্টে পোলা আর বউ মরার পর ওরে লইয়াই তো আছিলাম ৷ওরেও কাইরা নির ৷আমার নাতি রাইত দিন এক কইরা পড়ছে বিদেশ যাইবো ৷বিদেশ তো গেল না ৷আমার নাতি মইরাই গেল ৷

চলবে…..