প্রীতিলতা আসবে বলে
লেখিকা :আফরিন ইসলাম
সিজন :৪
পার্ট :৭
প্রীতিকে টেনে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে ৷পুলিশের গাড়ীতে ওকে বসানো হলো ৷আবেশ কারাগারের সামনে বসে কাদঁছে ৷যাদের আপন ভেবে ছিল ৷তারাই তার পরিবারটা শেষ করেছে ৷নিরুপমা স্বামীর কাধেঁ হাত রাখতেই স্ত্রীকে জরিয়ে ধরে চিৎকার করে কাদঁতে লাগলো আবেশ ৷কাদঁতে কাদঁতে বলল
নিরু ওরা কেন সবাইকে বিনা অপরাধে মারলো ৷একটা পরিবারকে শেষ করে দিল ৷আমি হয়ে গেলাম এতিম ৷আর আমার ছোট বোনটা খুনী হয়ে গেল ৷ওরা দিনের পর দিন আমাদের মিথ্যা বলে গেল ৷আমি পারছি না আর ৷একটা মানুষ কত হারাতে পারে তুমি বলে দাও ৷
অন্যদিকে দিহনের মা ডায়না পাথরের মতো বসে আছে ৷যাকে নিজের স্বামী ভেবে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিল ৷সে আসলে তার স্বামী না ৷যার কথায় আবেশকে শেষ করতে চেয়ে ছিল ৷সে আসলে তার স্বামীর হত্যাকারী ৷
কারাগারের চার দেওয়ালে প্রীতিলতা বন্দি ৷ তার শাস্তির রায় এখনো হয় নি ৷পরশু বিচারক বিচার করবেন ৷ ময়লা মেঝেতে কিছু একটা আকঁছে সে ৷হঠাৎ কারাগারের তালা খোলার শব্দে সেই দিকে তাকালো প্রীতি ৷শান্ত দাড়িয়ে আছে ৷প্রীতি শান্তর দিকে এক পলক তাকিয়ে আবারো নিজের কাজে মন দিল ৷
আপনি নিজের ব্যাপারে আমাদের কেন বললেন না ম্যাডাম ৷আমরা নিজেদের সবটা দিয়ে কি ক্রিমিনালদের ধরতাম না ৷শান্ত বলল ৷
প্রীতিলতা শান্তের দিকে তাকিয়ে হাসলো ৷তারপর বলল
আমি খুনী এটা জানার পরে তুমিই শুধু আমাকে এতটা সম্মান দিয়েছো ৷কখনো সুযোগ হলে এর ঋন শোধ করবো ৷
শান্ত প্রীতির সামনে বসে বলল কেন এমন করলেন ম্যাডাম ৷আপনার ফাসিঁ যে আমরা দেখতে পারবো না ৷ আমরা যে আপনাকে অনেক ভালোবাসি ৷আপনি বরং পালিয়ে যান ম্যাডাম ৷আমি সব ব্যবস্থা করবো ৷কেউ কিছু জানবে না ৷আমি চাই আপনি বেচেঁ থাকুন ৷
প্রীতি শান্তর চোখের পানি মুছে দিল ৷তারপর বলল
শান্ত আপনি আমাকে কেন পালাতে বলছেন ৷আমি আমার এই হাতে কত মানুষের প্রান নিয়েছি জানেন ৷আমার জন্য কত মানুষ নিজেদের প্রিয়জনদের হারিয়েছে ৷দিন শেষে আমিও খুনী ৷দিন শেষে আমিও অপরাধী ৷জানেন শান্ত জীবনের রাস্তায় দৌড়াতে দৌড়াতে এখন আমি ক্লান্ত ৷আর দৌড়াতে পারছি না ৷ এখন আমার থামা উচিত ৷
আপনি কি সত্যি কাউকে কখনো ভালোবেসেছেন ম্যাডাম ৷আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না আপনার মৃত্যুতে কেউ খুশি না ৷কেউ ভালো থাকবে না ৷ আপনি আমাদের ভালো না বাসলেও ৷আমরা অনেক ভালোবাসি আপনাকে ৷
আমার বেচেঁ থাকাতেও কেউ ভালো থাকবে না শান্ত ৷ আমার এই জীবনটা অভিশপ্ত ৷আমার মতো অভাগীরা যেই দিকে যায় ৷সেই দিকেই দুঃখ ধেয়ে আসে ৷তা না হলে আমার মা বাবা কেন মরবে ৷আমি যদি অভাগী না হতাম তাহলে আমার ব্রেন ড্যামেজ হতো না ৷কেন একের পর এক রোগ আমার শরীরে বাসা বাধঁবে ৷ কেন আমি খুনী হয়ে যাবো ৷কেন ভালোবাসার মানুষটাকে চোখের সামনে অন্য কারো হতে দেখবো ৷শান্ত মানুষ অর্থের দিক থেকে গরিব হয় ৷কিন্তু ভালোবাসার দিক থেকে গরিব হতে নেই ৷তুমি মখন কাউকে ভালোবাসবে ৷তখন তাকে রানীর মতো ভালোবাসবে ৷তার জীবনে পার্থিব জিনিসের অভাব থাকলেও ৷যেন ভালোবাসার অভাব না থাকে ৷ ভালোবাসা কখনো অপ্রকাশিত রাখতে নেই ৷তাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখতে হয় ৷ যে ক্ষমতা আমার নেই ৷ ভালোবাসা যায় কিন্তু তা প্রকাশ করতে এক বুক সাহস লাগে ৷যা আমার কখনো ছিল না ৷জানো আমি এসিপি শরীফ আর তার স্ত্রী জাহানার বেগমকে ভালোবাসি ৷খুব ভালোবাসি আমি ৷কিন্তু কখনো তাদের জরিয়ে ধরে মা বাবা ডাকতে পারি নি ৷বিশ্বাস করো অনেক বার চেয়েছি ৷কিন্তু হয় নি কেন যেন ৷ কেন যেন মনে হতো এরাও যদি চলে যায় ৷আমি সহ্য করতে পারবো না ৷তাই তো তাদের ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকতে শুরু করে ছিলাম ৷ভেবে ছিলাম দূরে থাকলে মায়া কমে যাবে ৷কিন্তু তা আর হয় নি ৷নিজের ভাইকে জরিয়ে ধরে কখনো বলা হয় নি ৷আমি বেচেঁ আছি ৷কখনো বলা হয় নি হাজারো না বলা কথা ৷ভাইয়ের হাত ধরে অপরাধীদের দেখিয়ে বলতে পারি নি ৷ভাইয়া এরা আমায় খুব কষ্ট দিয়েছে ৷নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবেসে ছিলাম ৷বিশ্বাস করো আমি গরিবের মতো ভালোবাসি নি ৷আমি তাকে রাজার মতো ভালোবাসি ৷খুব ভালোবাসি তাকে ৷তাইতো নিজের অসুখ ভালো করতে মরিয়া হয়ে উঠে ছিলাম ৷কিন্তু তা আর হলো কোথায় ৷একটা সময় আমি বুঝে গিয়েছি সে আমার জন্য নয় ৷যখন বুঝেছি তখন সরে এসেছি ৷আরে আমি তো এক আকাশ সুখ তাকে দিতে চেয়েছি ৷আমার মানুষটা ভালো আছে ৷আমার মানুষটা সুখে আছে ৷এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে ৷আমার সাথে রেখে তার সুখকে দুঃখে পরিনত করতে পারবো না ৷থাকুক না সে অন্য কারো রাজা হয়ে ৷ ক্ষতি কি তাতে ৷ প্রীতিলতা হাসতে হাসতে চোখের পানি মুছে নিল ৷তারপর আবারো বলল
সম্পর্কের বিচ্ছেদ হয় ৷ভালোবাসায় দুরত্ব তৈরি হয় ৷কিন্তু স্মৃতির পাতায় ওপারের মানুষটা অবিনশ্বর ৷যাকে কখনো মুছে ফেলা যায় না ৷যাকে চাইলেই ছুরে ফেলা যায় না ৷
তার মানে আপনি পালাবেন না তাইতো শান্ত বলল৷
হুমমম ৷
শান্ত আর একটা কথাও বলল না ৷ চোখের পানি মুছতে মুছতে বের হয়ে চলে গেল ৷প্রীতি ঐ দিকে তাকিয়ে আবারো হাসলো ৷
গত চব্বিশ ঘন্টায় আবারো নারী শিশু অপহরন হয়েছে পঞ্চাশের মতো ৷ জবা ও কিডন্যাপ হয়েছে ৷গতকাল ঔষুধ কিনতে বাইরে এসে ছিল ৷কিন্তু মাঝ রাস্তায় একটা মমাইক্রো এসে তাকে নিয়ে যায় ৷ অপহরনকারীদের পিতা মাতা পুলিশের কাছে এসে সাহায্য চাইছে ৷কিন্তু পুলিশ এই কেসের কোনো সন্ধান পাচ্ছে না ৷প্রীতিলতা আর নারীপাচারের কেসটা এখন আলোচনার তুঙ্গে ৷শান্ত পাগলের মতো জবাকে খুজছে ৷এই তো কিছু দিন আগেই জবার সাথে সব ঠিক হয়ে ছিল ৷মেয়েটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে উঠে ছিল ৷মেয়েটার সাথে যদি আবারো খারাপ কিছূ হয় ৷তাহলে নিজেকে মাফ করতে পারবে না সে ৷
প্রীতিলতাকে আজ আবারো কোর্টে হাজির করা হয়েছে ৷বাইরে শত শত মানুষের ঢল ৷সবাই প্রীতিলতার মুক্তি চায় ৷প্রীতিকে নিয়ে আসতে এক প্রকার পুলিশের যুদ্ধ করতে হয়েছে ৷
বিচারকের সামনে দাড়িয়ে আছে প্রীতি ৷বিচারক প্রীতিকে বলল
তোমাকে বেশি প্রশ্ন করবো না ৷তোমার প্রথম প্রশ্ন পতিতালয়ের সর্দারনীকে কেন মারলে ৷ আর কিভাবে মারলে ৷
প্রীতি বিচারকের দিকে তাকিয়ে বলল সে শত শত মেয়ের জীবন নিজ হাতে নষ্ট করেছে তাই মেরেছি ৷এখন ভাবতে পারেন ৷ তাকে কেন কারাগারে এনে মারলাম ৷ তাকে কারাগারে না নিয়ে আসলে , সে আমার কোনো কাজে আসতো না ৷তার সাথে মিহান চৌধুরীর যোগাযোগ ছিল ৷সর্দারনীকে মারার কিছু দিন আগেও কিছু মেয়েকে কিডন্যাপ করা হয় ৷তার খোজঁ নিয়ে জানতে পারি তাদের খুব তাড়াতাড়ি চড়া দামে বিক্রি করা হবে ৷কিন্তু তারা কোথায় আছে , সেই খোজঁ কোথাও পাচ্ছিলাম না ৷তাই প্লান মোতাবেক ঐ পতিতালয়ে আমি আক্রমন করি ৷সর্দারনীকে কারাগারে নিয়ে আসি ৷তারপর আমি অন্য প্লান করি ৷তাকে আমি পালাতে সাহায্য করবো ৷এমন প্রতিশ্রুতি তাকে আমি দেই ৷কিন্তু তার বিনিময়ে শর্ত দেই একটা ৷আমি তার ফোন থেকে মিহান চৌধুরীকে কল করতে বলি ৷আর মেয়ে গুলো কোথায় আছে ৷সেই সন্ধান জিজ্ঞাসা করতে বলি ৷মিহান তখনো জানতো না সর্দারনীর সাথে কি হতে চলেছে ৷ওরা ভেবে ছিল প্রতিবারের মতো এবারও ঘুষ দিয়ে বেচেঁ যাবে ৷ মিহান ভেবে ছিল সর্দারনীর কাছে ফোন আছে ৷পুলিশ হয়তো টাকার জন্য এমন করেছে ৷ তাই সে পুলিশকে টাকা দিতে চায় ৷অন্য দিকে সর্দারানী আমাকে সেই টাকার ভাগ দিতে চায় ৷বিনিময়ে তাকে পালাতে সাহায্য করতে হবে ৷মিহান মেয়েদের ঠিকানা সর্দারনীকে বলে দেয় ৷ আমি ঠিকানা জেনে গেলাম ৷তারপর শর্ত অনুযায়ী আমি সর্দারনীর পালানোর রাস্তা বলে দেই ৷কিন্তু সে জানতো না ঐ পথে সিসি ক্যামেরা আছে ৷তারপর পুলিশ বাধ্য হয়ে ওকে গুলি করে দেয় ৷
হ্যাকিং করা কোটি কোটি টাকা কোথায় বিচারক বলল ৷
ঐ গুলো আমার কাছে নেই ৷আর টাকার হিসেব আমার কাছে নেই ৷যাদের হক তাদের দুই হাত ভরে দিয়ে দিয়েছি ৷আর যাদের দিয়েছি তারা এখন বাইরে দাড়িয়ে আছে ৷ চাইলে খোজঁ নিতে পারেন ৷
তোমার পরবর্তী শিকার কে ছিল ৷ তার নাম বলো ৷
আমাকে এখন মেরে ফেললেও তার নাম আমি বলবো না ৷তাকে একমাত্র আমি শিকার করবো ৷ আর হ্যা আমাকে পুলিশের হাতে দেওয়া থেকে শুরু করে ৷এই যে অপহরন গুলো হচ্ছে ৷সব তার কাজ ৷
নারীপাচার করা গ্যাং এর তথ্য গুলো আমাদের দাও ৷
কেন স্যার ৷আমি কেন তথ্য দেব ৷ কোনো তথ্য আমি দেব না ৷
তথ্য গুলো দিলে অনেক গুলো মেয়ে তার পরিবারের কাছে যেতে পারবে ৷ পুলিশকে সাহায্য করো ৷এই কেসের মূল মাস্টার মাইন্ডের নাম বলো ৷
আপনি তাদের কথা চিন্তা করছেন হ্যা ৷ আচ্ছা আমি যদি বলি আমাকে দুই দিনের জন্য মুক্ত করতে ৷আপনি কি তা করবেন ৷করবেন না স্যার ৷তাহলে আমি কেন তথ্য দেব ৷মরলে সবাই এক সাথেই না হয় মরি ৷আমি এত বড় মনের অধিকারী নই ৷আমি যখন আমার প্রতিশোধ পূরন করতে পারি নি ৷তখন কেউ তাদের সন্তানদের পাবে না ব্যস ৷
ওকে ৷সাহায্য করতে হবে না ৷বাইরে সবাই তোমার মুক্তি চাইছে ৷তুমিও কি তাই চাও বিচারক বলল ৷
প্রীতি মুচকি হেসে বলল এক অপরাধীর চাওয়া আর না চাওয়ায় কিছু আসে যায় না স্যার ৷আমি অপরাধী এটাই বড় কথা ৷দেশের আইন অনুযায়ী আমার যা সাজা প্রাপ্য আমাকে তাই দিন ৷আমার অতীত দেখে যেন বিচার না হয় স্যার ৷
তুমি কাউকে কিছু বলতে চাও ৷বা তোমার কোনো ইচ্ছে আছে ৷
না স্যার আমার কাউকে কিছু বলার নেই ৷সবাই ভালো থাকুক ৷ এটাই চাই শুধু ৷
বিচারক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন ৷তারপর একটা কাগজে কিছু একটা লিখে বললেন
খুন ,অপহরন ,লাশ গুম ,অন্যের টাকা আত্মসাৎ ,আইন ভঙ্গ সহ নানাবিধ অপরাধের কারনে ৷মিস প্রীতিলতা চৌধুরীকে মহামান্য আদালত ফাসিঁতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডের ঘোষনা দিচ্ছে ৷দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার পর তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হবে ৷
মৃত্যুদন্ডের কথা শুনে প্রীতিলতার চোখ থেকে একফোটাঁ পানি গড়িয়ে পড়লো ৷কিন্তু সবার আড়ালেই সে তা মুছে নিল ৷কেননা এটা হওয়ারই ছিল ৷
চলবে…..