প্রীতিলতা পর্ব-০৮

0
354

#প্রীতিলতা❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#৮ম_পর্ব🍂

সময় আর নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সে তার আপন গতিতে চলতে থাকে। প্রতিদিন নিয়ম করে সূর্য উদয় হয়ে সকালের আবির্ভাব হচ্ছে আবার সাঁঝের বেলায় সূর্য অস্তের মাধ্যমে দিনটার সমাপ্তি ঘটছে।

ঠিক একই ভাবে মাঝখানের কয়েকটা দিন কিভাবে কেটে গেল তা বুঝতেই পারলাম না। এখন পুরো সময়টা আমার ব্যস্ততার সাথেই কাটে। সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে রান্নাবান্না করা, তারপরে পুতুল সোনা কে রেডি করে স্কুলে পাঠানো। আবার ওকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়া, দুপুরে খাইয়ে দেওয়া, হোমওয়ার্ক পাশাপাশি আবার কোচিংয়ে নিয়ে যাওয়া। এক কথায় বলতে গেলে বেশ দৌড়ের উপরে আছি আমি।

আর এই মেয়ে তো আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝেনা। যদি বলি ড্রাইভার আঙ্কেলের সাথে স্কুল অথবা কোচিংয়ে যাও। ওমনি ছুটে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলবে,

— প্রীতিলতা। তুমি কিন্তু আমাকে কিপটামো করে ভালোবাসছো। এরকম কিপটামো করলে কিন্তু আমি কান্না করে দেব। আমি আজ কোথাও যাবো না তাহলে এভাবেই সারাদিন তোমার গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো। পাগলি মেয়ে তাই না…!

খাইয়ে দিতে গেলেও তার তার আমাকে লাগে, রাতে ঘুম পাড়াতে গেলেও আমাকে লাগে। ঘুমিয়ে গেলে ওকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিয়ে পা টিপে টিপে চলে আসি আমার ঘরে।

তার মধ্যে আবার আমার আরেক মহাশয় আছে তো।নিয়ম করে তিন বেলা তার পেছনে লাগতে আমার আবার ভুল হয় না। সারাদিন তো গম্ভীর মুখ করেই বসে থাকে। তার থেকে রাগী ফেসটাই আরো বেশি সুন্দর লাগে আমার কাছে। আর যখন খুব রেগে যায় তখন তেড়ে এসে বলে ,

তোমাকে তো আমি….

তখন আমিও মেকি হাসি দিয়ে বলি, ভালবাসতে ইচ্ছে করছে বুঝি। তা বাসুন না আমি কি নিষেধ করেছি নাকি।

এ পর্যন্তই বলার ক্ষমতা আছে তারপর বাবা আমি গা ঢাকা দেই। তখন সামনে থাকা সত্যিই বিপদজনক ধরতে পারলে যদি মার দেন।

কিন্তু এই কয়দিনে সম্পর্কের কেমন উন্নতি হয়েছে তা ঠিক বলতে পারব না । কিন্তু একটা উন্নতি হয়েছে উনার সম্মোধন টা পুরোপুরি ভাবে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে।

মাঝে মাঝে আবার নাম ধরেও ডাকেন।

তার ওপর আবার রাত্রে বেলায় তার হাতের বাহু জড়িয়ে ধরে ঘুমাই আমি। এটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আমি জানিনা তিনি রাত্রে টের পান কিনা। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে প্রতিদিনই আমার সকাল বেলার ঘুম ভাঙ্গে তার বুকের মাঝে। ব্যাপারটা আমার দারুন লাগে।

***********

যেমন আজকে সকালেও ঘুম থেকে উঠে তার বুকেই নিজের মাথাটা আবিষ্কার করলাম। দুই হাতে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে ছিলাম এতক্ষন। সকাল হয়েছে কিছুক্ষণ আগে ‌। জানালা থেকে পাখির কলকাকলি ভেসে আসছে ‌। শোয়া থেকে সোজা হয়ে উঠে বসে চুল গুলো হাত খোপা করে নিলাম।

তারপর ঝুঁকে সাফওয়ানের ঘুমন্ত মুখটা দেখছিলাম। এই লোকটা দিন দিন এত সুন্দর হয়ে যাচ্ছে কি করে। রান্না তো আমি করছি সে রান্না তো আমিও খাচ্ছি। কই আমি তো সুন্দর হচ্ছি না। কিন্তু একে দেখো দিনদিন যেন রূপ গজাচ্ছে। রূপচর্চা করে নাকি?

নাহ। যা দেখতেছি এবার নিজের দিকেও খেয়াল করতে হবে। না হলে এরপরে বর মশাই আর ফিরেও তাকাবে না। যেহেতু সে ঘুমিয়ে আছে মনের কথা তাই মুখ দিয়েই বললাম। তারপর কপালে চুম্বন দিয়ে। মর্নিং উইশ করতেই দেখি পাশ ফিরে কোলবালিশ জড়িয়ে নিলো। আমি আতকে উঠলাম।

এ ব্যাটা আবার টের পেয়ে গেল নাকি। ওদিকে উকি দিয়ে দেখলাম না ঘুমিয়ে আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে চলে গেলাম।

_________🌺🌺________

আজ শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তেমন তাড়া নেই আমার। তাই আলসেমি ঝেড়ে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল আমার। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে এসে দেখি রহিমা খালা কাজ করতে শুরু করে দিয়েছেন। আমাকে দেখে মুচকি হাসি হেসে বললেন,

— আজ তো শুক্রবার। এত তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে আইতে গেলা কেন? সারা সপ্তাহেই তো রান্নাবান্না আর পুতুলরে নিয়ে ব্যস্ত থাকো। একটা দিন না হয় খালার হাতের রান্না খাইলা। তোমার মত অত ভালো রান্না করতে না পারলেও আমার হাতের রান্না খাইতে পারবা তুমি।

আমি হেসে দিয়ে বললাম,

— তুমিও তো সারা সপ্তাহ কাজ করো খালা। আমি শুধু রান্নাবান্না করি আর পুতুলের পেছনে আমার সারা দিন কেটে যায় তাছাড়া বাড়ির বাকি কাজ তো তুমি করো। তোমার ও তো বিশ্রামের প্রয়োজন।

হাত বুলিয়ে বললেন,

— তুই অনেক ভালা নয়া বউ। তুমি আমার জন্য এটুকু ভাবছো এটাই আমার কাছে অনেক। তোমার অনেক ভালো হবে।

আমি শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললাম

— আচ্ছা। আজ ইলিশ পোলাও রান্না করব। বড় ভাইয়া অনেকদিন ধরে খেতে চাইছিল তার পাশাপাশি তোমার ছোট বাবা আর পুতুল সোনার ও তো খুব পছন্দ এই খাবারটা।

কিন্তু তোমাদের যে সাকলাইন বাবার শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত আছে আজকে। তোমরা যাবা না?

কিন্তু খালা সেটা তো রাত্রে ডিনারের জন্য যাব। সারাদিন তো আমরা খাওয়া দাওয়া করবো তাই না।

আচ্ছা ঠিক আছে আমি সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছি তুমি শুধু আজকে রান্না করবে আর কিছু করা লাগবে না তোমার। লক্ষী মেয়ের মত আমার পাশে খাড়ায় থাকো।

মুচকি হেসে বললাম ,

—আচ্ছা।

__________🌺____

ঘড়িতে নয়টা বাজে ,

রান্না প্রায় শেষের দিকে।

এবাড়ির সকলের ঘুম থেকে উঠে চা বা কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে। বড় ভাইয়ের জন্য কফি, রহিমা খালা দিয়ে এসেছেন।

আর আমি সাফওয়ানের জন্য উইদাউট সুগার এক মগ কফি তৈরি করে নিয়ে আসলাম। মর্নিং ওয়াক করে আসার পর উনার কফির দরকার পরে। খালা কফি দিয়ে এসে আমাকে জানালো সাফওয়ান মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে এসেছে।

তাই আমিও ছুটলাম কফির মগ নিয়ে।সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম।

সাফোয়ান পুতুলের রুমে উঁকি ঝুঁকি মারছে। ব্যাপারটা কি…! আমিও পা টিপে টিপে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার কাজে এতটাই মগ্ন ছিল যে আমি কখন যে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, সে বুঝতেই পারল না। আমিও সাইট থেকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখলাম। পুতুল রুমে নেই। ওয়াশরুমে আছে বোধ হয়। কিন্তু উনি কাকে খুঁজছেন তাহলে?

আমি কফিটা সাইডের বক্সের উপরে রেখে ওনার কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম,

— আপনি কি আমাকে খুজছেন কুমড়ো পটাশ?

উনি যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। তারপর নিজেকে ধাতুস্ত করে আমতা আমতা করে বললেন,

— ন্ না। আমি তো পুতুলকে খুজছিলাম। ওকে দরকার ছিল। তোমাকে খুঁজতে যাব কেন আমি?

— কিন্তু আপনার ভাব ভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি আমাকে খুঁজছিলেন।

— প্রশ্নই আসে না।

— অবশ্যই প্রশ্ন আসে। না হলে আপনি পুতুলের ঘরে এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছেন কেন। আর পুতুল তো রুমে নেই সেটা দেখতে পেয়েছেন তার পরেও ঝুঁকে কি দেখছেন মশাই?

— বড্ড বেশি কথা বলছো তুমি। এতো কথা বলো কি করে মুখ ব্যথা করে না তোমার?

বাহ্ দারুন কথা ঘোরাতে পারেন তো আপনি। আরে আমি বুঝি। নতুন নতুন বিয়ের পর এমন হয় বুঝেছেন। যতই অস্বীকার করুন না কেন আমি তো বুঝতে পারছি।

তিনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— তা কি বুঝতে পারলে তুমি।

আমি অধিক আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে উঠলাম,

— এই যে আপনি খুব খারাপ ভাবে ফেঁসে গেছেন।

— ফেঁসে গেছি মানে?

— হুম। খুব বাজে ভাবে ফেঁসে গেছেন তো। “আমার মায়ায়”। দেখুন না আমি কিন্তু কফি নিয়ে আপনার রুমে আসছিলাম। প্রত্যেকদিন তাই করি। আপনি সেটা খুব ভালো করেই জানেন।

কিন্তু তারপরেও আমাকে না দেখে, থাকতে না পেরে রুম থেকে বেরিয়ে এসে পুতুলের রুমে উঁকি ঝুঁকি মারছেন। আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি আমার কোন লেভেলের মায়ায় জড়িয়ে গেছেন।

কথাগুলো শুনে সাফওয়ানের রিঅ্যাকশন দেখার মত ছিল। পেটের মধ্যে হাসির ব্লাস্ট হলেও মুখে তা প্রকাশ না করে। মুখে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বললাম,

— ইশ্ আপনি যে এ রকম বউ পাগল হবেন আমি বুঝতেই পারিনি।

এ্যাই আপনি আবার আমার প্রেমে পড়ে গেলেন নাতো হুম।

এতক্ষন বকবক করলেও তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার সব হাওয়া বেরিয়ে গেল। রেগে এটোম বোম হয়ে গেছে থুরি কুমড়ো পটাশ হয়ে গেছে।

আমি মেকি হাসি দিয়ে বললাম,

— ঠিক আছে বলা লাগবে না। প্রেমে তো সবাই পড়ে, কজনে আর মুখ ফুটে বলে। থাক আপনাকেও আর বলা লাগবে না।

ব্যাস হয়ে গেল। আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছি এবার দৌড়ানোর পালা। আজ আর নিস্তার নেই। আমি ধীর পায়ে পিছাতে গেলেই উনি খপ করে ধরে ফেললেন আমার হাত। কিন্তুআমার ভাগ্য প্রসন্ন হলো। আমি উনার হাত ফসকে বেরিয়ে এসেছি।

কিছুটা দূরত্ব দাঁড়িয়ে এসে নাকের নিচে একটা আঙ্গুল ঘষে বললাম,

হুহ। আমাকে ধরা অতো সোজা নয় কুমড়া পটাশ। স্কুলে থাকতে ৪০০ মিটার দৌড়ে ফাস্ট হতাম। যতোই চেষ্টা করুন আমার নাগাল আপনি পাবেন না।

আমার কথা শুনে উনি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,

— হাহ মিকি মাউস এর মত এটুকু শরীর নিয়ে আবার আমাকে চ্যালেঞ্জ করছে। হোয়াট এ জোকস

— কিহ আমি মিকি মাউস।

— কার্টুনের মতই তো দেখতে লাগে তোমাকে।

— আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে ধরে দেখান আমাকে। কেমন পারেন।

বলে দৌড়াতে শুরু করলাম আমি। তিনি ও আমার পিছু নিয়েছেন। আবার তার পেছন থেকে পুতুলের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।

ওই প্রীতিলতা তোমরা ছোট বাচ্চাদের মত দৌড়াদৌড়ি খেলছো কেন। আমিও খেলব আমাকেও না সাথে।

দৌড়াতে দৌড়াতে ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাদে চলে আসলাম। এসেই ছোট্ট চিলেকোঠার মধ্যে লুকিয়ে পড়লাম। তার কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা দুজন ও ছাদে এসে পৌঁছালো। এদিকে ওদিকে আমাকে কিছুক্ষণ খোঁজ করে আবার নিচে নেমে গেল ওরা।

তার কিছুক্ষণ পর চিলেকোঠা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতেই পিছন থেকে কেউ আমার কোমর জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে ধরলো। হঠাৎ এমন হওয়ার কারণে আমি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। সাথে সাথে খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসলো আমার কানে। তার সাথে হাত তালির আওয়াজ।

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম পাশে পুতুল দাঁড়িয়ে আছে আর হাত তালি দিতে দিতে বলছে

— হিহিহি। প্রীতিলতা ধরা পড়ে গেছে ।ইয়েএএএএ

তারপর সাফওয়ান আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

কী ম্যাডাম। তখন তো বেশ বলছিলে আমি নাকি ফেঁসে গেছি। এখন তো তুমিই ফেঁসে গেছো আমার হাতের মুঠোর।

বলে শব্দ করে হেসে উঠলেন।এই প্রথম আমি তার প্রাণখোলা হাসির সাক্ষী হলাম।তার হাসির ঝংকারে আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল।তার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে বললাম,

— হ্যাঁ। সত্যি ফেঁসেছি তোমার নেশাক্ত মায়ায়। সে নেশা থেকে হয়তো মৃত্যু ব্যতিত মুক্তি মিলবে না আমার।

চলবে…..❣️