প্রেমদণ্ড পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
311

#প্রেমদণ্ড (১১/অন্তিম)💚

প্রবাদে আছে, ‘সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।’ সময় এবং পানির স্রোত দুই ই বয়ে চলে তার আপন গতিতে। প্রকৃতির কোন পরিবর্তনই তাদের থামাতে পারে না। তেমনি ইজহান-অনুজা দম্পতির জীবন থেকে কেঁটে গিয়েছে ছয় ছয়টি মাস। সময়ের সাথে ব‍্যস্ততা বেড়েছে ইজহানের জীবনে। সে এখন তেইশের তাগড়া যুবক। পুষ্ট শরীর। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার ব‍্যবসায়ের হালও কিছু ধরেছে। এমনিতেই সে পড়াশোনা শেষে বাবার ব‍্যবসায়ের দেখাশোনা করতো। কিন্তু দায়িত্ব যখন ক‍্যারিয়ার গড়ার আগেই ঘাড়ে এসে পড়েছে তাই বেকার বসে না থেকে বাবার কাজে সাহায্য সহযোগিতা করছে। রমিজ উদ্দিন অবশ‍্য নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু ইজহান তার সিদ্ধান্তে অনড়। সে বাবার ছেলের তার পয়সায় খেতেই পারে কিন্তু স্ত্রীসহ তো নয়। নিজের উপার্জিত অর্থে প্রেয়সীর জন্য কিছু কেনার আনন্দ দুনিয়াতে আর খুজেঁ পাওয়া যায় না। অনুজাও এগিয়ে চলেছে সময়ের তালে। সে এখন ষোড়শী কিশোরী থেকে সতেরোতে গিয়ে ঠেকেছে। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেড়িয়ে পা দিয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকে। পড়াশোনা, সংসার দুটোই সমান গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ব‍্যস্ততা তার খুব কম নয়। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভাব ভালোবাসা যেমন আকাশ ছোঁয়া। তেমনি ঝগড়াও কিছু কম হয় না। আজ আড়ি কাল ভাব। সম্পর্ক এখন আপনি থেকে তুমি তে গড়িয়েছে। কিন্তু গতরাতে হওয়া ঝগড়ার তীব্রতা খানিকটা বেশিই ছিল। ফলস্বরুপ অনুজা এখন মায়ের বাসায় অবস্থান করছে।

ইজহান সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে সারা বাসা এক চক্কর দেওয়ার পরেও কোথাও অনুজা নামক মেয়েটির ছায়া দেখতে পেল না। বুঝতে অসুবিধা হল না তার কিশোরী রেগে পিত্রালয়ে গিয়ে অবস্থান করেছে। অনুজা বাসায় নেই জেনেও চুপ রইল ইজহান। পাছে মা ঝগড়ার বিষয়ে কিছু জেনে যান! স্বামী, স্ত্রীর মধ্যকার ঝুট ঝামেলা নিজেদের মধ্যে রাখাই উত্তম মনে করে ইজহান। বাসায় ফাতিমা বেগম, জামিলার বাসায় থাকলেও ইজহানের নিজেকে একেবারেই একা নিঃসঙ্গ লাগছে। মনে হচ্ছে খুব মূল‍্যবান কিছুর অনুপস্থিত। যা না থাকলে তার ঘর, মন দুটোই শূন্য মৃত্যুপ্রায়! মাগরীবের নামাজ শেষে মন খারাপ করে রুমে বসে ছিল ইজহান। ফাতিমা বেগম চায়ের কাপ নিয়ে এলেন ছেলের রুমে। ছেলের মন খারাপে ঠোঁট এলিয়ে আসলেন তিনি। একবেলা বউ নেই ছেলের মুখ শুকিয়ে আমসত্ব হয়ে গিয়েছে। ধোয়া ওঠা গরম চায়ের কাপ ছেলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “নিয়ে এলেই হয়। শুধু শুধু মন খারাপের কোন দরকার আছে? যাকে ছাড়া আমার ছেলের একবেলা চলে না তার সাথে মিছে ঝগড়া কেন হু?”

মায়ের থেকে হাত বাড়িয়ে কাপ নিয়ে লাজুক হাসে ইজহান। যাহ মা ঠিক পেয়ে গেলেন তবে!

ফাতিমা বেগম বলেন, “সম্পর্কে মান-অভিমান থাকবে এটাও খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। সব সম্পর্কেই হয়। যেখানে ভাব ভালোবাসা বিদ‍্যমান সেখানেই ঝুট ঝামেলা। কিন্তু বাবা, সবসময় মনে রাখতে হবে রাগের বশে কখনও এমন কথা বলা যাবে না যে কথায় সঙ্গীনির মন ভাঙে। তবে অনুজা কিন্তু ভারি বুদ্ধিমান! মায়ের কাছে যাওয়ার সময় এমনভাবে গেল যেন সে খুব খুশি। ঝগড়ার ছিটে ফোঁটাও তার মধ্যে নেই। আমার কাছে অনুমতি তবে গিয়েছে। আমি বলি কি যাও। গিয়ে আমার ঘরের আলোকে নিয়ে এস।”

ইজহান শুকনো কন্ঠে বলল,
“আমি গেলেই কি সে আসবে?”

“গিয়েই দেখ। প্রিয় মানুষের মুখ দেখলে পৃথিবীর কোন মেয়ে মানুষ রাগ ধরে রাখতে পারে না। যেটা থাকে ওটা মিথ্যা। আর মুখ শুকনো করে থাকতে হবে না। যাও এখন!”

ফাতিমা বেগম ছেলেকে তাড়া দিয়ে বেড়িয়ে গেলেন। ইজহান তড়িঘড়ি করে পরনের টিশার্ট বদলে সফেদ রঙা একটা নতুন টিশার্ট গায়ে জড়ালো। এই টিশার্টটি অনুজার খুব পছন্দের। গায়ে সুগন্ধি আতর মেখে শাশুড়ির বাসার দিকে রওনা হল।
_______________________
দুবার কলিং বেল বাজাতেই আইরিন রহমান দরজা খুলে দিলেন। ইজহান শুকনো হাসল। মেয়ের জামাইকে দেখে খুব খুশিই হলেন আইরিন রহমান। ইজহানের দুহাত ভর্তি চিপস, চকলেট আর ফলমূলের প‍্যাকেট। ইজহানকে দেখে ইয়াশ এসে জড়িয়ে ধরল। অনিশাও গুটিগুটি পায়ে দুলুর সন্নিকটে এসে দাড়াল। পছন্দের খাবার প‍্যাকেট চোখে পড়তেই ভাইবোনের চোখ চকচক করে উঠল। আইরিন রহমান একমাত্র জামাই আপ‍্যায়নে ব‍্যাস্ত হয়ে পড়লেন। অনুজাকে ডাকতে নিলে ইজহান নিষেধ করল। বলল, “এত ব‍্যাস্ত হতে হবে না আন্টি। অনুজা রুমে না?”

আইরিন রহমান মাথা দুলালেন। ইজহান আর কথা না বাড়িয়ে তার অভিমানী প্রেয়সীর দিকে এগিয়ে গেল।

জানালার দিকে মুখ করে চুপটি করে বসে আছে অনুজা। ইজহান নিঃশব্দে রুমে ঢুকে প্রথমেই দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর গুটি গুটি পায়ে অভিমানীর দিকে এগুলো। অনুজা তখনও দৃষ্টি স্থির রেখে প্রকৃতি দেখায় মগ্ন। ইজহান মুখে একটি শব্দও উচ্চারণ না করলে স্ত্রীকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল। অনুজা কিছুক্ষণ জড় পদার্থের মত চুপ করে রইল। তারপর ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। ইজহানের হাতের বাধন আরেকটু শক্ত হল। ইজহান মুখ ফুটে কিচ্ছু বলল না। প্রেয়সীর অভিমান গলার সময় দিল। অনুজা ভেজা কন্ঠে নিজেই বলল, “তুমি খুব খুব খারাপ বুঝলে? এত কষ্ট কেন দাও? তুমি জানো না তোমার দেওেয়া কষ্ট সহ‍্য করার মত সহ‍্য ক্ষমতা তৈরি হয়নি আমার। এমন করলে দুচোখ যেদিকে যায় চলে যাব। আমার ছায়াটি পর্যন্ত দেখতে পারবে না।”

স্ত্রীর অভিযোগে কেঁপে ওঠে ইজহান। অনুতপ্তায় ছেয়ে যায় মুখ মণ্ডল। দুহাতে অনুজার মুখ উচিয়ে কাছাকাছি এনে ইজহান বলে ওঠে, “ভুলেও অমন কথা বলিও না বউ। তুমি জানো না হৃদয়ের ঠিক কতখানি জুড়ে তোমার বসবাস। তুমি না থাকলে আমার কি হবে একবারও ভেবে দেখছো? তুমি জানো না তোমাকে জড়িয়ে না ধরে রাতে আমার চোখে ঘুম ধরা দেয় না। একটু ঝগড়া নাহয় হয়েছেই। তাই বলে রাগ করে চলে আসতে হবে?”

প্রতিত্তোরে কপট রাগ দেখিয়ে অনুজা বলে, “একশবার আসতে হবে।”

ইজহান হাসে। অনুজার ফোলা গালদুটো আদর করে টেনে দেয়। হাতদুটো মুঠোয় পুড়ে বলে, “চল আজ ঘুরতে যায়। বহুদিন যাওয়া হয় না।”

অনুজা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ইজহান পুনরায় বলে, “কি যাবে না আমার সাথে? এখনো রেগে থাকবে?”

প্রতিত্তোরে অনুজা কিছু না বললে আলমারি খোলে। হালকা বেগুনি রঙের লং হাতার কুর্তির সাথে হিজাব পেচিয়ে নেয়। মুখে নিকাবের পরিবর্তে মাস্ক লাগিয়ে ইজহানের উদ্দেশ্যে বলে, “চলো!”

ইজহান অনুজার হাত ধরে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। এদিকে অনুজাকে তৈরি হতে দেখে আইরিন রহমান বিস্ময় নিয়ে শুধায়, “একি কোথায় যাচ্ছিস? আজ এলি। কটা দিন থাকবি। তা না! কোথায় বেড়চ্ছিস?”

অনুজা বলল, “ঘুরতে যায় আম্মু। অনেকদিন যাওয়া হয় না।”

“কিন্তু আমি ভেবেছিলাম তোরা থাকবি। নাস্তা বানিয়েছি খাবি।” আইরিন রহমানের কন্ঠে মন খারাপের ছাপ।

ইজহান চট করে সিঙ্গেল সোফার একটাতে বসে পড়ল। বলল, “কিছুক্ষণ ঘুরে এখানেই চলে আসব। সমস্যা নেই।”

আইরিন রহমান হাসিমুখে ইজহানকে একটার পর একটা নাস্তা খাইয়ে তারপর ছাড়ল। ফাল্গুনের সন্ধা রাত। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। তারারা ঝলমল করছে। অনুজা ইজহানের বাইকের পিছনে চেপে বসল। ইজহান বাইক স্টার্ট দেওয়ার আগে একবার বলল, “ঠিকমতো বসেছ তো?”

পিছন থেকে অনুজা অভয় দিতেই ইজহান বাইক স্টার্ট দিল। সায় সায় করে বাইক এগিয়ে চলছে। বাতাসের দমকায় অনুজার হিজাবের কোনা উড়ছে। অনুজা ইজহানের দিকে আরেকটু চেপে বসল। রাস্তার দুধারে কর্মব্যস্ত মানুষের ঢল। কৃত্রিম আলোয় ঝকমক করছে গোটা শহর। অনুজার হঠাৎ করেই নিজেকে খুব সুখী সুখী লাগছে। অনুজা মনে মনে ভাবে, “প্রিয় মানুষটার সান্নিধ্যে বুঝি এত সুখ?”
______________________
ইসরাত তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে মায়ের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে আজ তাকে দেখতে আসবে। তার ভাবনায় খুব একটা ভুল নেই। বেলা একটু গড়াতেই তার ছোটখালা তার ছেলেমেয়ে নিয়ে হাজির। এই শহরে ইসরাত আর ও ছোটখালারা পাশাপাশি একই শহরে বাস করে। যার জন্য দু পরিবারের মধ্যে কোন কিছু হলেই একে অন‍্যে ছুটে যায়। ইসরাতের ছোট খালা বেশ চটপটে মানুষ। সে দ্রুত কথায় যেমন পটু, তেমনি কাজেও। ইসরাত ব‍্যালকনি গিয়ে লক্ষ্য করল তার মহামান‍্য পিতা দুহাত ভর্তি বাজার নিয়ে ফিরছেন। ইসরাতে চোখে অশ্রুকণা ভর করেছে। মনের মধ্যে স্পষ্ট হাহাকারের শব্দ। এটা ঠিক তার কারো সাথে প্রেমের সম্পর্ক নেই। কিন্তু সেই সাথে এটাও তো সে অস্বীকার করতে পারে না কোনরকম মন দেওয়া নেওয়ার সম্পর্কে না জড়িয়েই আইমানকে কে সে মন দিয়ে বসে আছে। ওই গম্ভীর, শ‍্যামবর্ণের সুদর্শন মুখখানা যে তার মনে একেবারে সেটে গিয়েছে। ভুলবে কি করে সে! মানুষটার দূর থেকে করা যত্ন, হুটহাট পার্সেলের সাথে খুব যত্ন নিয়ে লেখা দু লাইনের প্রেমময় চিরকুট সেসব কি করে অস্বীকার করবে সে? কিন্তু বাবা-মাকে ই বা সে কি বলবে? অজানা আশংকায় হৃদয় কেঁ’পে ওঠে ইসরাতের। সে যে আইমান নামক পুরুষটাকে একটু বেশি ভালোবাসে সেটা বুঝতে তার একটুও সময় লাগে না। শান্তি করে মন খারাপটাও করা হল না ইসরাতের। এর মধ্যেই তার ছোট খালা প্লেট ভর্তি গরম খিচুড়ি নিয়ে এসে হাজির। ঝরঝরে অথচ নরম খিচুড়ি ইসরাতে ভিষন প্রিয়। সাথে ডিম ভাজি হলে তো কথায় নেই। ইসরাতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ভাত নলা পাকিয়ে ইসরাতকে খাইয়ে দিতে লাগলেন ছোট খালা। সাথে সমানতালে বকবক করছেন। অতিরিক্ত কথা বলার জন্য ইসরাত তার ছোট খালাকে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। কিন্তু সে যতই এড়িয়ে চলুক তার ছোট খালা ঠিক ততই চিপকে থাকেন সঙ্গ পেলেই। ইসরাতের মাঝেমাঝে মনে হয় ছোটখালা তার নিজের ছেলেমেয়ের থেকেও বেশি তাকে ভালোবাসে। যত্ন, আদরের কোন কমতি রাখেন না। মন খারাপে আজ ইসরাতের পেট এমনিতেই ফুলে ফেপে আছে। বেশি খাবার তার পেটে জায়গা হবে না। খাবার গালে থাকা অবস্থায় অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল, “আর খেতে পারব না খালামনি। পেট ভরে গিয়েছে।”

“বেশ পারবি। না খেয়ে চেহারার কি হাল করেছে মেয়ে। বলি, তোর মা কোন খেয়ালে থাকে হ‍্যাঁ? মেয়ের চোখমুখ শুকিয়ে যে কাঠ হয়ে গিয়েছে সে খেয়াল আছে তার? উঠতি বয়স, ভাত খাবি দু প্লেট। তা না দু লোকমা ভাতে তার পেট ভরে আছে। আমি কোন কথা শুনব না। পুরোটা খেতে হবে না। আজ বাড়িতে খুব ব‍্যাস্ততা। এখন ভালো মেয়ের মত সবটা খা তো।”

ইসরাতের দুটো বাক‍্যের পিঠে ছোটখালার একগাদা কথায় ইসরাত দমে গেল। চুপচাপ খাবার গিলতে লাগলো।

ছোটখালা খাইয়ে যেতেই ইসরাত হাপ ছেড়ে বাঁচল। দরজা আটকে তার প্রিয় ডায়েরি নিয়ে বসল। প্রিয় মানুষের দেওেয়া প্রথম উপহার ছিল এটা। হয়তো আজই সেই মানুষটাকে নিয়ে শেষ লেখা হবে এটা। যদি সত্যিই তার মনের ভাবনাগুলো সত্যি হয় তাহলে এ মূল‍্যবান উপহারগুলো আগুনে পুড়িয়ে ফেলা ছাড়া উপায় কোথায়? টপটপ করে চোখের কার্নিস বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ভিজে যাচ্ছে ডায়েরির সাদা পাতা। নিজের অসহায়ত্ত্বের কথা কাউকে বলতেও পারছে না। আর বলেও বা লাভ কি? গভীর ধ‍্যানে মগ্ন হয়ে ইসরাত কলমের আচরে ফুটিয়ে তুলছিল ডায়েরির সাদা পৃষ্ঠা। হঠাৎ দরজায় কড়াঘাতে লেখায় মনযোগ ক্ষুণ্ন হল। বিরক্ত হল সে। কে আসল আবার! পরপর কড়াঘাতের শব্দে ইসরাত দরজা খুলতেই চোখে পরল অনুজার হাসিহাসি মুখখানা। অনুজাকে দেখে কিছুটা হলেও শান্তি লাগল ইসরাতের। টেনে ভিতরে নিয়ে আসল অনুজাকে। গভীর আগ্রহ নিয়ে শুধালো, “সত‍্যি করে বল তো অনু? বাড়িতে কি হচ্ছে? আমার মন বলছে দেখতে আসবে আজ। কিন্তু কে আসবে, কেন আসবে আমার মাথায় ঢুকছে না। আম্মু-আব্বু হঠাৎ আমার বিয়ে নিয়ে এত পরলেন কেন? আমার কিচ্ছু ভালো লাগছেনা অনু। তুই তো সব জানিস।”

অনুজার মধ্যে কোন হেলদোল লক্ষ্য করা গেল না। সে খুশিমনে বলল, “চিন্তার কিছু নেই। মেয়ে বড় হলে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে সেটাই স্বাভাবিক। আন্টি বললেন পছন্দ হলে আজই বিয়ে পড়িয়ে দিবেন।”

ইসরাত রাগে খামচে ধরল অনুজার হাত। অনুজা ব‍্যাথায় নাকমুখ কুচকে বলল, “কি করছিস? হাত ছাড়। আমার বর আমাকে কত্ত আদর করে। সেখানে তুই ডায়নির মত আচরে দিচ্ছিস! দুষ্টু মহিলা! যা গোসল করে আয়। এগারোটা বেজে গিয়েছে। তারপর তোকে সাজাতে হবে। জুম্মার নামাজ শেষেই মেহমান এসে পড়বেন।”

একমাত্র বেস্টফ্রেন্ডও ইসরাতের মনের দুঃখ বুঝছে না। রাগে দুঃখে চোখে পানিতে থইথই করছে। অনুজা দুষ্টু হাসে। তা দেখে অনুজার পিঠে জোরে কি’ল বসিয়ে দেয় ইসরাত।

খানিকবাদেই ইসরাতের আম্মু এলেন। হাতের ট্রেতে খাবার সাজানো। গ্লাসে শরবত, আর বাটিতে নুডুলস রান্না করা। খাবারের ট্রে বিছানার ওপর রেখে বসলেন তিনি। তারপর বললেন, “অনুজা খেয়ে নিও মা। আর ইসরাত তোমাকে বলার সময় ই পেলাম না। মেহমান আসছে আশাকরি ভদ্রভাবে তাদের সামনে যাবে।” শেষের কথাগুলো একটু কঠিন করেই বললেন তিনি।

ইসরাত মায়ের কথা শুনল চুপটি করে। প্রতিত্তোরে একটি বাক‍্যবায় করল না। যাওয়ার আগে মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে গেলেন, “গোসলে যাও। আমরা মা-বাবা হিসাবে তোমার খারাপ কখনও চাইব না। উত্তম পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে পারলে তোমারই মঙ্গল। আমরা সবটা বিচার বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশাকরি তোমারও কোন দ্বিমত থাকবে না!”

ইসরাত এবারও চুপ। কি বলার থাকতে পারে! অনুজা বলল, “আন্টি আপনি যান। এত চিন্তা করবেন না। হঠাৎ করে এমন কথা শুনে ও কিছুটা শকে আছে। আশাকরি ঠিক হয়ে যাবে।”

দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গেলেন ইসরাতের আম্মু। ইসরাত জড় বস্তুর ন‍্যায় স্থির হয়ে বসে আছে। অনুজা আয়েশ করে নুডুলস খেতে ব‍্যস্ত। বান্ধবীর মন খারাপ তার যেন কিছুই যায় আসছে না।

ইসরাতকে একপ্রকার ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠালো। ইসরাত রাগে হুমকি দিল, “এর শোধ আমি নিব রে অনুজা। খুব মজা নেওয়া হচ্ছে তাই না?”

প্রতিত্তোরে অনুজা হেসে বলে, “যদি ইচ্ছে হয় নিস। আমি কিছু মনে করব না। আপাতত গোসলটা করে আমাকে উদ্ধার কর। মেয়েরা চলে আসবেন এখনই। ছেলেরা নামাজ শেষেই আসবেন। আর দেরি করিস না।”
_____________________
ইসরাত গোসল সেরে আসতেই চোখে পরল একগাদা শপিং ব‍্যাগ। অনুজা একটা একটা করে খুলে দেখাতে লাগল ইসরাতকে। কিন্তু একফোটাও মনোযোগ নেই ইসরাতের। সে তো উদাস হয়ে জানালার বাইরে সচ্ছ আকাশ দেখতে ব‍্যস্ত। বিয়ের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সব। অনুজা নিজেই সাজাবে বান্ধবীকে। বিয়ের এতদিনে সে শাড়ি পড়া শিখে গিয়েছে। ইসরাতের চরম অনিচ্ছা সত্বেও বিয়ের জন্য তৈরি হতে হল তাকে। ইসরাতের পছন্দের সবকিছু। তারপরও এসবের কিছুই তাকে ছুতে পারছে না। মন ভার হয়ে আছে। টকটকে লাল রঙের বেনারসির সাথে লম্বা দোপাট্টা। গলা, কান দুটোয় খালি। ঠোঁটে কটকটে লাল রঙের লিপস্টিক। মুখে হালকা মেকআপ। চুলগুলো হেয়ার ড্রেয়ার দিয়ে শুকিয়ে সিম্পল করে খোপা করে দেওেয়া। খোপায় আর্টিফেশিয়াল বেলি ফুলের গাজরা। সবমিলিয়ে দুধ সাদা বর্ণের ইসরাতকে চমৎকার লাগছে। সাজানো শেষে অনুজা বলল, “আয় কটা ছবি তুলে রাখি। পরে সময় হবে না। যা সুন্দর লাগছে তোকে। আমি নিশ্চিত তোকে দেখে হার্টফেল না হয়।”

অনুজার রশিকতায়ও ইসরাতে মুখভঙ্গীর পরিবর্তন হল না। সে চোখমুখ শক্ত করে বসে রইল। যেখানে বিয়েটাই হচ্ছে নিজের অমতে সে বিয়েতে গদগদ হয়ে ছবি তোলার কোন প্রশ্নই আসে না। ইসরাত রাগে মুখ অন‍্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। অনুজা জোর করে কয়েকটা ছবি তুলে তবেই ছাড়ল। এদিকে দরজার ওপাশ থেকে একটা বাচ্চা হাতের ঠকঠক শব্দ। অনুজা গিয়ে দরজা খুলে ছোট্ট আরুকে দেখতে পেল। ঠোঁটের হাসি চওড়া হল তার। আরুকে কোলে করে বিছানার একপাশে এনে বসালো। ইসরাত হতভম্ব! বিস্ময় নিয়ে শুধালো, “ও এখানে কেন? ওদেরও দাওয়াত দেওেয়া হয়েছে নাকি?”

অনুজা কিছু না বলে মিটমিটিয়ে হাসে। বোকা ইসরাত তখনও বোঝে না।

ইসরাতের ভুল ভাঙে যখন বর হিসাবে নিজের পছন্দের মানুষটাকে দেখতে পায়। আবেগে চোখে পানি চলে আসে তার। অভিমানী দৃষ্টিতে অনুজার দিকে তাকায়। অনুজা হাসে। ইসরাতের চোখে পানি মুখে হাসি। আইমানের পাশে নিয়ে বসায় ইসরাতকে। কবুল বলার সময় একটুও সময় না নিয়ে পরপর তিনবার কবুল বলে ইসরাত। পরে নিজেই লজ্জা পায়। আবেগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে। চারপাশ অবলোকন করে বুঝল অনুষ্ঠান ঘরোয়া হলেও আয়োজনের কমতি নেই। এক এক করে চেনা মুখগুলো চোখে পরল। বিপরীত পাশের সোফায় মুশফিকা বসে আছে। ইসরাত সেদিকে তাকাতেই দুষ্টু হাসে মুশফিকা। লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে ইসরাতের সুন্দর গালদুটো। চোখের নজর এড়িয়ে ইসরাতের কোমল হাত দুখানা নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে নেয় আইমান। নব বধূর সন্নিকটে গিয়ে শুধায়, “চমক কেমন লাগল কিশোরী?”

লাজুক হাসে ইসরাত। কিন্তু মুখ ফুটে বলে, “খুবই বাজে। খুব কষ্ট দিয়েছেন আমাকে।”

ইসরাতের হাতদুটো শক্ত করে ধরে আইমান বলে, “ভালো কিছু পেতে হলে এইটুকু কষ্ট তো করতেই হবে তাই না? অবশেষে তুমি একমাত্রই আমার হলে। আলহামদুলিল্লাহ্।”

ইসরাতও মৃদুস্বরে বলে, “আলহামদুলিল্লাহ!”
______[সমাপ্ত]_________

লেখায়~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি