প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা পর্ব-২৮

0
490

#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
| আটাশতম পর্ব |

সকালে তৈলাক্ত খাবার খেতে খেতে আজাদ সাহেব তিক্ত হয়ে গিয়েছেন। গতকাল রাতে এজন্য প্রিয়তমা স্ত্রীকে বলে রেখেছেন যেন ভাত রান্না হয়।
রোজকারের ন্যায় সকালে হেঁটে এসে পত্রিকা নিয়ে বসলেন সোফায়। পিনপতন নীরবতায় ঘেরা প্রেম নীড়। আজ রান্নাঘর থেকেও বউ-শাশুড়ির কোন আওয়াজ আসছে না। আজাদ সাহেব চিন্তিত হলেন। এগিয়ে গেল রান্না ঘরের দিকে। রান্নাঘরে নজর বুলিয়ে হতাশ হলেন। পুরো রান্নাঘর চকচকে করে বউ শাশুড়ি কোথায় যেন চলে গিয়েছে। রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এসে পর কয়েকবার রুপ, ফাহিমা,রাইসার নাম ধরে হাঁক ছাড়লেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য, কারোর কোন খোঁজখবর নেই।
আজাদ সাহেবের কথা শুনে দুই ছেলে তৈরি হয়ে উপর থেকে নিচে নেমে আসে। দুইজনের উদ্দেশ্য অফিস। একজন নিজের অফিসে যাবে তো অপরজন নতুন অফিসে যাবে। আজাদ সাহেব পায়চারি করছেন এদিক সেদিক। ছেলেদের নিচে নামতে দেখে প্রশ্ন করেন,

” কোথায় সবাই?”

আজাদ সাহেবের কথার প্রত্যুওর দিলো না কেউ। বরঞ্চ উল্টো নাবিল বাবার উদ্দেশ্যে বলল,

” কি হয়েছে বাবা? এভাবে চিৎকার করছো কেন? ক্ষুধা পেয়েছে? মাকে ডাকো না! আমাদের বউদের এভাবে ডাকছো কেন?”

আজাদ সাহেব ঢুক গিললেন ছেলের এমন কথা শুনে
আজাদ সাহেবের কল্পনার বাইরে ছিল তার বড়ো ছেলে এমন কথা বলবে। ছোট ছেলে বললে একটা কথা ছিল কেননা ছোট ছেলে আজাদ সাহেবের কার্বন কপি। কিন্তু বড়ো ছেলেও যে এমন ঠোঁট কাঁটা স্বভাবের তা জানা ছিল না। নিজেকে স্বাভাবিক করে আজাদ সাহেব ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,

” তোদের বউ সহ আমার বউ আর বাড়ির মেয়ে সব কোথায়? একজনেরও তো কোন সাড়া শব্দ নেই। সবাই কি একসাথে ঘুমোচ্ছে! এদিকে ক্ষুধায় আমার পেটের ভিতরে বাঘ দৌঁড়াচ্ছে তার কি খবর আছে কারোর?”

বাবার কথা শুনে নাবিল উচ্চ স্বরে হেসে বলল,

” আমাদের বউ সহ তোমার বউ এমনকি বাড়ির সকল মেয়েরা শপিং করতে গিয়েছে সাতসকালে। নিজের ঘরে এখনও প্রবেশ করোনি! গেলে বুঝতে টেবিলের উপর সুন্দর করে কালো অক্ষরের কালি দিয়ে লিখে গিয়েছে,’ আজ সারা দিন আমাদের হয়ে রান্না করতে হবে। নয়তো উপোস থাকতে হবে। আর সকালের নাস্তা বানিয়ে রেখে গিয়েছি, ভালোই ভালোই সব নাস্তা শেষ করবে।”

আজাদ সাহেব ফুস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। এ আর নতুন কিছু না। মাঝেমধ্যে আজাদ সাহেবের বউ রাগ করে বা অভিমান করে সারাদিনের জন্য শপিং করতে চলে যায়। শাশুড়ি বউ মিলে সারাদিন শপিং করে খেয়ে দেয়ে একদম রাত করে ঘরে ফিরে। কিন্তু আজ যে এমন একটা কাজ করবে তা জানা ছিল না আজাদ সাহেবের।

নাদিফ, নাবিল ইতিমধ্যে খাবার টেবিলে বসে পড়েছে। যেহেতু বাড়ির মধ্যে কোন মেয়ে উপস্থিত নেই তাই ছেলেদের নিজের খাবার নিজেই নিয়ে খেতে হবে।

খাবারের টেবিলের উপর খুব সুন্দরভাবে খাবার ঢেকে রেখে দিয়েছেন বাড়ির রমণীরা। তা দেখে আজাদ সাহেব ভীষণ সন্তুষ্ট। প্রিয়তমা স্ত্রী যে বলার আগেই সব বুঝে যায়। যেহেতু বাড়িতে মেয়েরা নেই তাই আজাদ সাহেব ইচ্ছে পোষণ করলেন আজ নিজ হাতে ছেলেদের খাইয়ে দিবেন।
নাবিল নাদিফ মাত্র প্লেট ঠিক করছিলো খাবার বাড়বে বলে। এমন সময় আজাদ সাহেব বলে উঠেন,

” আজ আমার ছেলেদেরকে নিজ হাতে খাইয়ে দিবো। ছেলেরা কি খাবে বাবার হাতে?”

নাবিল, নাদিফ দুজনে হতবাক। তাঁদের বাবা ঠিক ছোটবেলার মতো দুই ছেলেকে খাইয়ে দিবে বলছে। খুশিতে দুই ছেলে হ্যাঁ বলে উঠে।

আজাদ সাহেব খুশি হন ছেলেদের হ্যাঁ শুনে। খাবারের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে খাবারের প্লেটে প্রথমে ভাত নিয়ে নেয়। এরপর ঢেকে রাখা এক পাত্রের উপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে দেয়। ঢাকনা সরানোর সাথে সাথে আজাদ সাহেব ভাতের প্লেট টেবিলের উপর রেখে চেয়ারে বসে পড়ে। মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠে,

“আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক, লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোলিমিন!”

বাবার এমন ভয় পাওয়া দেখে দুই ছেলে দাঁড়িয়ে যায়। উঁকি দিয়ে দেখে খাবার পাত্রে কি রাখা আছে। পাত্রে রাখা খাবার দেখে দুই ভাই একে অপরের দিকে তাকায়। পরপর আরো দুই পাত্রের ঢাকনা সরিয়ে দুই জনেই উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে। কেননা আজাদ সাহেব যে পাত্রের ঢাকনা সরিয়ে নিয়েছিলো সেখানে রাখা ছিল পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা। আর তিন নাম্বার পাত্রে ছিল কচু শাক দিয়ে ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে রান্না তরকারি। যা নাদিফ, নাবিল দুজনেরই খুবই পছন্দ।
আজাদ সাহেব চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। প্রিয়তমা স্ত্রী যে সাত সকালে এমন একটা সারপ্রাইজ দিবে তা আজাদ সাহেব ভাবতে পারেনি। আজও মনে করেছিল তার স্ত্রী একদম ভালো হয়ে গিয়েছে। এখন আর কথায় কথায় ব্ল্যাকমেইল করবে না। কিন্তু না, বলে না! ‘কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না।’ তেমনি আজাদ সাহেবের প্রিয়তমা স্ত্রী কোনদিনও ভালো হবে না। কিন্তু আজ যে দুই ছেলেকে খাইয়ে দিবে আজাদ সাহেব বলেছেন! এখন তো খাইয়ে দিতেই হবে!
আজাদ সাহেব চোখ খুললেন। নিজেকে অনেক শক্ত পোক্ত করে উঠে বসলেন দুই ছেলেকে খাইয়ে দিবে বলে। কিন্তু দুই ছেলের দিকে তাকিয়ে আজাদ সাহেবের চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছে। কেননা আজাদ সাহেবের দুই ছেলে রাক্ষসের মত গবগব করে গিলে খাচ্ছে ভাত দিয়ে কচুর তরকারি।
আজাদ সাহেব এই তিন পদের তরকারি অপছন্দ করেন। আর পাট শাক শুটকি ভর্তার নাম শুনলেই বমি করে দেন। আজাদ সাহেব বসে অবাক চোখে দুই ছেলের খাওয়া দেখছেন। বাবার তাকানো দেখে নাবিল বলে উঠে,

” আরে বাবা! কচুশাক যা মজা হয়েছে না! একবার খেয়ে দেখো জীবনে আর পানি খেতে চাইবে না। যেন স্বাদ না চলে যায়।”

নাদিফ চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে বাবার উদ্দেশ্যে কিছুই বলছেন না। কেননা নাদিফ খুব ভালো করেই জানে তার বাবা এই তিনটার একটাও পছন্দ করেন না এখন কিছু বললে উল্টো দেখা যাবে না খেয়ে আছে।

” তোরা এতটা পাষণ্ড কবে থেকে হলি রে! তোদের সামনে বুড়ো বাবা বসে আছে আর তোরা কিভাবে গবগব করে খাচ্ছিস! তোদের মনে কি একটুও মায়া দয়া নেই! আমি কি খাব তা তোরা ভাবছিস একবারও?”

” কি খাবে মানে? আমরা যা খাচ্ছি তাই খাবে। এই নাও তোমার পাতে পাট শাক আর শুটকি ভর্তা উঠিয়ে দিলাম। খাও নাহলে মায়ের কাছে বিচার দিবো।”

ছলছল চোখে আজাদ সাহেব ছোট ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। এরা যে আজাদ সাহেবের সন্তান তা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে আজাদ সাহেবের কাছে। অগত্যা ভাতের লোকমার ভেতর পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা ঢুকিয়ে লোকমা করে প্লেটে সাজালেন। এক গ্লাস পানি এক হাতে নিলেন। এখন এক লোকমা মুখে দিবেন আর পানি পান পারবেন। এভাবেই পুরো খাবার শেষ করবেন।

এদিকে আজাদ সাহেবের খাওয়া দেখে নাদিফ ছোট্ট করে মেসেজ লিখে,” বাবা খেয়ে নিয়েছে।”

———–
দিবসের শেষ ভাগ। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে এসেছে সকল রমণীরা। সকলের হাতে চার-পাঁচটা করে শপিং ব্যাগ। সকলের মুখে চমৎকার হাসি। সারা দিনের ক্লান্তির পর সকলে এসে ধপাস করে পড়ল সোফার উপরে।

” আজ অনেক মজা হয়েছে ,মা। আজ সারাদিনে কোন উল্টা পাল্টা কাজ করি নাই।”

ফাহিমার ক্লান্ত মাখা কন্ঠস্বর। আয়েশা আজাদ ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলেন। সাড়া বাড়ি একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। কোথাও স্বামী বা ছেলেদের পেলেন না।

” বুড়ো টা কোথায় রে? ”

শাশুড়ি মায়ের মুখে বুড়ো ডাক শুনে ফাহিমা রুপ অবাক। ফাহিমা মুখ ফসকে বলে,

” মা কি বলছো গো! বুড়ে টা আবার কে?”

” তোর শ্বশুর গাঁধী। কোথায় সে? সকালের কাজের জন্য আবার কোন গন্ডগোল বাঁধায় নি তো?”

ফাহিমা,আয়েশা আজাদ ভাবনায় ব্যস্ত। এদিকে রুপ লাজুক হেসে নতুন কেনা ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। যেখানে ভিডিও কলে নাদিফকে দেখা যাচ্ছে। নাদিফ বর্তমানে নতুন অফিসে অবস্থান করছে। রুপের সাথে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ম্যাসেজের মাধ্যমে কথা হচ্ছে। রুপের ফোন নাদিফ বলিয়ে কিনে দিয়েছে। আর সে ফোন দিয়ে এখন অপরুপকে দেখছে।
সকলের অগোচরে রুপ নাদিফকে বলল,

” আপনার আঁখিদ্বয় খুব খারাপ, বুঝলেন! আলাদা মাদকতা আছে এই চোখে। আমি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। অথচ দেখুন! আপনি নির্লজ্জের মতো কীভাবে তাকিয়ে আছেন!”

নাদিফ হাসে রুপের কথা শুনে। নাদিফ রুপকে লজ্জা দিতে প্রত্যুত্তরে বলল,

” ভালোবাসি বলো একবার, দ্রুত!”

রুপ ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। নাদিফের মুখের দুষ্টু সাসির রেখা দেখে তেত যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” আপনি খুব খুব খুব অসভ্য ঠোঁট কাঁটা বদ স্বামী। রাখুন ফোন।”

নাদিফ হাসছে। নির্লজ্জের মতো রুপকে দেখেই যাচ্ছে। রুপ আর ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। ফোন বন্ধ করে দিবে তার আগেই নাদিফের কথা রুপের কর্ণধারে আসে,

” শুনো মেয়ে! আসছি আমি। অনেক কথা আছে আজ। অপেক্ষা করবে, গভীর রাত হলেও।”

রুপ মুচকি হেসে কল কেঁটে দিলো।

আয়েশা আজাদ ভীষণ চিন্তিত হলেন স্বামীর জন্য। আজাদ সাহেব প্রেম নীড়ের কোথাও নেই। অভিমান করে কোথায় যেন চলে গিয়েছেন। আয়েশা আজাদ এবার কান্না মাখা কন্ঠস্বরে বিলাপ করতে শুরু করলেন,

” কোথায় চলে গেলি তুমি সোয়ামি গো!
এইবারের মতো ফিরে আসো গো!
আর জীবনেও যাবো না বাহিরে গো!
ও স্বামী, চলে আসো না গো!”

কোথায় চলে গেলো আজাদ সাহেব?
আপনারা কি জানেন?

চলবে………