প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা পর্ব-১০

0
629

#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
|দশম পর্ব | বোনাস পর্ব

মধ্যাহ্নের সময় মনে হয় সূর্য্যিমামা মাথার এক হাত উপরে চলে এসেছে। রোদে পুড়ে শরীরের বিন্দু বিন্দু ঘাম জমালে হয়তো বালতির পর বালতি জমানো যাবে।
বাগানের পরিবেশ খুব গরম। ছায়াদার ছাউনির নিচে বসে আছে নাদিফ। দারোয়ানকে দিয়ে কোকাকোলা আনিয়েছে মাত্র। যা গরম পড়েছে! তৃষ্ণায় মরি মরি অবস্থা।
তীব্র গরমে কাঠফাটা রোদে এক পা উঠিয়ে কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ফয়সাল। আর সেই পায়ের উপর ক্যাকটাস গাছের ছোট্ট টব। শুকনো শরীর থেকে দশ বালতি পানি চলে গিয়েছে আপাতত। ললাটের বিন্দু ঘাম ঝড়ে পড়ছে নাক মুখ বেয়ে।

” তা কি যেন বলছিলে ছোট ভাই?”

ঢকঢক করে কোকাকোলা পান করছে নাদিফ ফয়সালের সামনে বসে। বেচারা ফয়সালের অবস্থা করুন। বলে না যে,” মুখের সামনে থেকে যখন কোন খাবার ক্ষুধার্ত প্রাণীদের থেকে কেড়ে নেয়া হয় তখন সেই প্রাণী হিংস্ররুপ ধারণ করে” ব্যাপারটা তেমন। ফয়সালের তৃষ্ণায় ইচ্ছে করছে আস্তো পুকুরের পানি পান করে ফেলতে। কিন্তু এখানে ফয়সালের ক্ষেত্রে একটু ভিন্নতা আছে। ফয়সালের সম্মুখে যে এখন দাঁড়িয়ে পিপাসা মেটাচ্ছে তাঁকেই এখন প্রকৃত হিংস্র প্রাণী মনে হচ্ছে। কোকাকোলার বোতল পুরোটা খালি করে অদূরে গাছের গোড়ায় নিক্ষেপ করলো নাদিফ। মাথার কেশবে হাত বুলিয়ে আবার বলল,

” মুখে কি লাগাম লাগিয়ে রেখেছো? ঘরে বসে তো অনেক কথা ই বললে। তা এখন কি হলো! রংধনুর কয়টা রং দেখতে পেলে এখন পর্যন্ত?

ফয়সালের মুখ চুপসে গেলো। প্রেম নীড়ের প্রধান ফটকে নজর ফয়সালের। দারোয়ান বসা গেটের সামনে। গেট পুরোটা উন্মুক্ত। রাস্তার পথচারীরা ফয়সালের মত বড়ো ছেলেকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মজা নিচ্ছে।

” আমাকে ছেড়ে দিন স্যার। আমি আর জীবনেও আপনার বাড়িতে বিনা অনুমতিতে আসবো না।”

নাদিফ আবারও চেয়ারে আসন পেতে বসলো। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বলল,

” তোমার অপরাধ টা কি জানো?”

ফয়সালের সাথে সাথে না উওর।

” রুপকে অসম্মান করা। দ্বিতীয় কারণটা কি জানো?”
ফয়সালের এবারও না উওর।

” রুপকে নিজের প্রেমিকা বলা।”

ফয়সালের চোখ এবার কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম। পুরো কথা না বলতেই লোকটা জেনে গেলো! ফয়সাল করুণ চোখে নাদিফের পানে তাকায়। এতে নাদিফের মুখের কাঠিন্যতা বিন্দু পরিমানেরও কমে নি।

” অপরুপ আমার। শুধুই আমার। অপরুপের দিকে যে ফিরে তাকাবে তাঁর অবস্থা খুবই ভয়ানক হবে। ভাবতে পারবে না আমি আমার জিনিসের জন্য কতটুকু করতে পারি। আজ থেকে তুমি অপরুপের প্রধার দেহরক্ষী। অপরুপের গায়ে যদি এক ফোঁটা আঘাত লাগে আর আমি শুনতে পাই, তাহলে সর্বপ্রথম আমি তোমাকে ধরবো। মনে থাকবে?”

” মনে থাকবে স্যার। আর জীবনেও ম্যাডামের দিকে চোগ তুলেই তাকাবো না। ম্যাডামকে মায়ের চোখে দেখবো। এবারের মত আমাকে ক্ষমা করে দিন।”

নাদিফ এবার হাসলো। আগের ন্যায় ফয়সালের কাঁধে হাত রেখে প্রেম নীড় ভবনে প্রবেশ করলো।

” কোথায় গিয়েছিলি তোরা? মেহমান এসেছে, চা নাস্তা নিয়ে এসে দেখি কেউ নেই। রুপের রুমে নাস্তা পাঠিয়ে দিয়েছি। তা বাবা তুমি কি উপরে যাবে? নাকি এখানে নাস্তা নিয়ে আসবো?”

আয়েশা আজাদ সোফায় বসে থাকা শান্ত, ভদ্র বাচ্চা ফয়সালকে কথাগুলো বলছিলেন। আয়েশা আজাদের কথা শুনে ফয়সাল দ্রুতগতিতে মাথা নাড়ানো শুরু করল, যার অর্থ ‘না’ সে উপরে যাবে না। অগত্যা আয়েশা আজাদ রান্নাঘরের দিকে চলে যান নাস্তা দিবে বলে।

খাবারের টেবিলের উপর ফলের ঝুড়িতে রাখা ফলসমূহের মধ্য থেকে একটা আপেল নিয়ে তাতে কামড় বসিয়ে ফয়সালের অপর পাশে বসলো নাদিফ। আপেলে একের পর এক কামড় বসাচ্ছে আর ফয়সালের দিকে তাকাচ্ছে। ফয়সাল নাদিফের তাকানো তে শুকনো ঢুক গিলে। ফয়সালের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ফয়সাল ইচ্ছে করছে এখন প্রেম নীড় থেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু তা করতে পারছেনা না। নাদিফের অনুমতি না পেলে কিছুই করতে পারবে না।

” রংধনুর কয়টি রং দেখতে পেলে?”

“অনেকগুলো স্যার! আর জীবনেও দেখতে চাই। উচিত শিক্ষা হয়েছে আমার। আমি কি এখন ঘরের বাহিরে যেতে পারি?”

” হ্যাঁ যেতে পারো। কিন্তু একা না। এসেছো দু’জন যাবেও দু’জন। অপেক্ষা করো তোমার বন্ধুর জন্য। আরেকটা কথা, অপরুপকে যদি আজকের বিষয় কিছু বলেছ তো,,,,,,

” জীবনে বলবো না। আমি তো কোনদিন কথা’ই বলবো না। একদম চুপ করে থাকবো। কোন মেয়ের দিকে কোনদিনও তাকাবো না। আর অপরুপ থুক্কু রুপ ম্যাডামের দিকে তো কোনদিনও না। আমাকে এবারের মত ছেড়ে দিন ভাই! নাহলে আমি এখনই এক নম্বর করে দিব ভয়ে।”

নাদিফ হাসছে মন খুলে হাসছে। ফয়সাল যেমন বয়সের দিক দিয়ে ছোট তেমন আচার-আচরণের দিকেও ছোট। ফয়সালের চোখে কিছুটা ভালোলাগা কাজ করেছিল রূপের জন্য যা আজকের পর থেকে থাকবে না বলে মনে করে নাদিফ।

সিঁড়ি বেয়ে ফাল্গুনী,রুপ টুকটাক কথা বলতে বলতে নেমে আসছে। রুপের দৃষ্টি হাস্যজ্বল নাদিফের দিকে। রুপ মনে মনে ভাবছে,” লোকটা হাসতেও জানে! বাহ লোকটার হাসিটা তো খুব সুন্দর! রুপের এই প্রথম লোকটার হাস্যজ্বল চেহারা দেখা।”

ফয়সালের কাছাকাছি রুপ ফাল্গুনী চলে আসে। ফয়সাল রুপের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না। অন্য সময় হলে দেখা যেতো ফয়সাল বেহায়ার মতো রুপের দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু আজ আর তাকালো না। ফয়সাল নাদিফের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ফাল্গুনীর হাত ধরে এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে প্রেম নীড় থেকে বের হয়ে যায়।

” শুনো মেয়ে! বন্ধুকে বাসায় নিয়ে এক বালতি লেবুর শরবত পান করতে দিও। বেচারা আজ রংধনুর হাজারো রং দেখে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে।”

ফাল্গুনী হা করে নাদিফের কথা শুনলো কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ পেলো না ফয়সালের জন্য।

এদিকে রুপ ফয়সালের কান্ড দেখে হতবাক বৃষ্টিতে প্রেম নীড়ের সদর দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।
রুট নিজের ঘরে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিলে নাদিফ বলে উঠে,

” ছোট বাচ্চাদের পড়াতে যাও নাকি নিজের রুপ দেখাতে যাও শুনি? আজকাল যেখানে-সেখানে দেখি ছোট বাচ্চারা ম্যাডামের প্রেমে পড়ছে। বুঝলাম না ছোট ছোট বাচ্চাদের এতে দোষ দিবো! নাকি ম্যাডামদের!”

রুপ রেগে কটমট চোখে নাদিফের পানে তাকালো। রুপের এখন ইচ্ছে করছে ইচ্ছামত রাগী লোকটাকে বকে দিতে। লোকটা আসলেই খুব খারাপ। এই লোকের প্রতি সহানুভূতিশীল দেখানো ঠিক হবেনা রুপের। রুপ কিছু না বলে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিলি নাদিফ আবার বলে উঠে,

” খবরদার কোন ছেলের সাথে কথা বলবে না। আমি যদি দেখি কোন ছেলের সাথে কথা বলছো তো সেখানেই জিন্দা কবর দিয়ে দিবো।”

রুপ অবাক,বিমূঢ়। রাগী লোকটা মাত্র কি বলল ভেবেই মাথা ভনভন করে ঘুরছে। জিন্দা কবর দিবে মানে? আমি কি তার প্রপার্টি নাকি! যে আমার উপর অধিকার দেখাচ্ছে? রুপ আর সামনে আগালো না। পিছনে ফিরে নাদিফের উদ্দেশ্যে বলল,

” আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করবো। আপনার কি? আপনি না বলেছেন আমার সামনে আসবেন না?”

নাদিফ এতক্ষণ সোফায় এক প্রকার শুয়ে রুপের সাথে কথা বলছিলো। রুপের কথা শেষ হতেই দ্রুতগতিতে শোয়া থেকে উঠে রুপের একদম কাছে চলে আসে। রুপ আকস্মিক নাদিফের কান্ডে ভয় পেয়ে যায়। নাদিফের কাছ থেকে দুই কদম দূরে চলে যায়। কিন্তু নাদিফ এতে সন্তুষ্ট হলো না রুপের দিকে আরো দুই কদম কাছে চলে এসে দাঁড়ায়। রুপের একদম কাছাকাছি এসে কিছুটা ঝুকে বলে,

” আমি গতকাল কি বলেছিলাম মনে নেই! বলেছিলাম আমি তোমার কাছে আসবো না
কিন্তু তুমি যদি আমার কাছে আসো তাহলে প্রেমের জে’লে বন্দি করে রাখবো। এখন তুমি নিয়ম ভঙ্গ করেছো সাজা তো তোমায় পেতেই হবে, তাই না! আজ দুপুরে আমার কাছে এসে নিয়ম ভঙ্গ করে ফেলেছো অপরুপ! শাস্তিস্বরূপ সারা জীবন এই লোকটার চোখের সামনে তোমার থাকতে হবে। আর অধিকারের কথা বলছো! খুব শীঘ্রই বুঝতে পারবে অধিকারবোধ কি।”

নাদিফ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। গুনগুন গান গেয়ে উপরে চলে গেলো। এদিকে রুপ নাদিফের কথা হজম করতে চেষ্টা করছে। রুপ কাঁদো কাঁদো মুখে বিড়বিড় করে বলল,

” এই কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম আমি! না খেতে পারি, না ঘুমাতে পারি। সবকিছুতেই তাঁর আমদানি রপ্তানি। সত্যিই কি আদৌও বেঁচে আছি! তা নিয়ে সংশয়ে আমি।”

চলবে……..