প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব-৩২

0
296

#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা

৩২.

হাতে দুটো ফাইল হাতে বিস্ময়ে থেমে আছে খই। খানিকটা সময় পর ওর আর প্রাপ্তর আংটিবদল। শাড়ি পরে মেঝেতে হাটু জরিয়ে বসে একধ্যানে বাইরে তাকিয়ে ছিলো ও। হুট করে মিষ্টিঘরের কেয়ারটেকারকে সাদিক সাহেবের বাসার দিকে ছুটতে দেখে সন্দেহ হলো খইয়ের। জিজ্ঞাসা করতেই সে ফাইলদুটো দেখালো ওকে। স্কুলের পুনর্নিমান কাজে দ্বিগুন টাকা চেয়ে মিষ্টিঘরে নোটিশ পাঠিয়েছে ইনিশা। সেটাও আজকের মধ্যেই। নইলে স্কুলটাকে ইনিশা নিজেদের করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে তার সবরকমের আইনি কাগজপত্রের প্রমানও পাঠিয়েছে নোটিশের সাথে। খইয়ের বিস্ময় কাটছেই না। যেখানে রাকীন নিজে এই কাজের দায়িত্ব ছিলো, সেখানেও এমন ছলচাতুরি সম্ভব বলে ধারনাতেও ছিলো না ওর। খই কেয়ারটেকারকে বললো,

-এসব কি মামা? এই নোটিশ?

-হ্যাঁ মা। আমিও তাই ভাবছি। এমন কোনো নোটিশ তো আসার কথা না। তাদের টাকা দেওয়ার তারিখও এতো দ্রুত শেষ হবার কথা না। আর টাকার এমাউন্টই বা এতো কেনো? নোটিশ পাঠানোর তারিখ যা দেওয়া আছে, সে তারিখে নোটিশ না পাঠিয়ে আজ লাস্ট ডেট দেখে নোটিশ পাঠানোর কি মানে? সবদিক দিয়ে মিষ্টিঘরকে হয়রানীর চেষ্টা। এসব কেনো করছে ইনিশা? শুধুমাত্র বেশি টাকা আদায়ের জন্য?

জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে নিলো খই। আপাতত কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর। কেয়ারটেকার বললো,

-ফাইলটা দাও খই। সাদিক সাহেব বা প্রাপ্তকে জানাতে হবে বিষয়টা। আজ রাত বারোটার মধ্যে এর একটা বিহিত না করলে কাল সকালে ইনিশা লোক পাঠাবে বলেছে।

উনি হাত বাড়িয়ে নিতে যাচ্ছিলেন ফাইলটা। খই হাত সরিয়ে নিয়ে শান্তভাবে বললো,

-কাউকে জানাতে হবে না মামা।

-জানাতে হবে না মানে? না জানালে এসব মিটবে কিভাবে?

-ইনিশার আর্কিটেক্ট জানে এসব?

-জানিনা। তবে ওনাকে দেখে যথেষ্ট ভালো মনে হয়েছিলো আমার। উনি জানলে এমনটা ঘটতে দিতেন বলে আমার মনে হয় না।

খই বুকে আঁকড়ে ধরলো ফাইলটা। আর কয়েকমুহুর্তে ওর জীবন অন্যকারো নামে হয়ে যাবে। শেষবারের মতো রাকীনকে দেখার লোভ কি করে সামলাবে ও? নিজেকে অন্যকারো নামে করে দিয়ে আর নকশাদারকে নিজের বলতে পারবে না যে। খই ধরা গলায়‌ বলে উঠলো,

-আমি ইনিশায় যাবো মামা।

বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন ভদ্রলোক। মিষ্টিঘরে আসার পর থেকে খই মিষ্টিঘর আর সাদিক সাহেবের বাসা ছাড়া অন্য কোথাও পা রাখেনি। পড়াশোনা নিয়েই থেকেছে সবসময়। হুট করে এভাবে বেরোতে চাওয়া, তাও আবার আজকে এ সময়ে, ওর কথা শুনে ভদ্রলোক কড়া গলায় বললেন,

-কি বলছো কি তুমি? ইনিশায় যাবে মানে? আজ তোমার আর প্রাপ্ত বাবার এনগেইজমেন্ট!

-আজই নোটিশের লাস্ট ডেইট।

-তাই বলে তুমি এখন ইনিশায় যাবে? কোনো প্রয়োজন নেই তোমার যাওয়ার। ফাইলটা আমাকে দাও। আমি সাদিক সাহেবকে বলে সাফোয়ান বাবাকে‌দিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলবো। আর তুমি…

ধপ করে ভদ্রলোকের পায়ের কাছে বসে পরলো খই। আঁতকে উঠলেন ভদ্রলোক। খইয়ের চোখের জল পায়ের পাতার উপর পরেছে তার। খই মাথা নিচু রেখে মাটিতে দৃষ্টিস্থির রেখে বললো,

-আমার এই একমাত্র চাওয়াকে ফিরিয়ে দেবেন না প্লিজ মামা! আর কোনোদিনও কিছু চাইবো না আপনার কাছে। কোনোদিনও না! আমাকে মিষ্টিঘরের জন্য এটুকো করার সুযোগ দিন প্লিজ! ভরসা রাখুন আমার উপর। কাজ শেষেই ফিরে আসবো আমি। প্লিজ মামা! প্লিজ!

ভদ্রলোক নির্বাক। এভাবেও কেউ আকুতি করতে পারে, জানা ছিলো না তার। তবুও অনেকবার অনেকভাবে মানা করেছে সে খইকে। তাতে খইয়ের কান্না বেড়েছে শুধু। উপায় না দেখে উনি রাজি হলেন খইয়ের কথায়। উঠে দাড়িয়ে হাতের পিঠে চোখমুখ মুছলো খই। ঠোটে হাসি ফুটিয়ে, আসছি বলে, লোকচক্ষু এড়িয়ে বেরিয়ে আসলো মিষ্টিঘর থেকে। ওর যাওয়ার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন কেয়ারটেকার। খইয়ের আকুতি কি শুধুই মিষ্টিঘরের জন্য ছিলো? নাকি বড়সর কোনো ভুল করে বসলেন তিনি?

ইনিশা’য় কেবিনে বসে নিজের ইচ্ছেমতো এই প্রথমবার ম’দ খেয়ে শান্তি পাচ্ছিলো নিজাম। রাকীন, রাজীব মাহমুদ দুজনেই আজকে বিয়েতে ব্যস্ত। ওকে আটকানোর কেউই নেই আজ। এই এতোবড় বিল্ডার্স কোম্পানির এতো ভালো পজিশনে থেকেও মনে শান্তি নেই ওর। নেশা করতে অভ্যস্ত বলে রাজীব মাহমুদ সবসময়ই কাজের‌ চাপে রাখেন ওকে। আর এটাই ওর পছন্দ না। টাকা পয়সা‌ দিয়ে যদি জীবনে শখ আহ্লাদই পুরন না করতে পারে, কি হবে সে টাকা দিয়ে? অনাথ হওয়ার পর থেকেই কাকার শাষনে বড় হতে হয়েছে ওকে। অন্যায়ের জন্য রাকীনের মারও কম খায়নি। এরা দুই বাবা ছেলে মিলে একদম অসহনীয় করে তুলেছে ওর জীবনটা। এসব ভেবেভেবে গ্লাসের পর গ্লাস ম’দ শেষ করে দিচ্ছিলো নিজাম। পরপর দুবার টেবিলে থাকা টেলিফোনটা বেজে উঠলো। বিরক্তি নিয়ে সেদিকে তাকালো ও। ওরই অধস্তন এক কর্মচারী। পরেরবার বাজতেই সে বিরক্তি রাগে পরিনত হলো নিজামের। রাগে ওটা রিসিভ করে বি’শ্রি এক গা’লি দিয়ে বলে উঠলি,

-শা’লা ***! তোদের জন্য শান্তিতে বসতে পারবো না কোথাও? চাকরিটা খোয়ানোর মন চেয়েছে?

ওপাশ থেকে ভরকে যাওয়া এক কন্ঠে আওয়াজ এলো,

-স্ সরি স্যার। আসলে একটা জরুরি বিষয়েই আপনাকে কল করা। রাকীন স্যারের…

অকথ্য এক গালিতে কল কাটলো নিজাম। লোকটা রাকীনের নাম নিয়েই রাগের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে যেনো। একশ্বাসে সামনে রাখা পুরো গ্লাস শেষ করলো ও। পরপর তিনবার খাওয়ার পর কপাল ঠেকালো সামনের টেবিলে। আজকে শান্তি লাগছে ওর প্রচন্ড। রাকীনের দায়িত্বে ছিলো বলে, মিষ্টিঘরের স্কুলটার কাগজপত্র উনিশবিশ করে দিয়েছে ও। কাজ শেষ হবার পর ইনিশা যতো টাকা পেতো, তার দ্বিগুন বাড়িয়ে লিখে আজকের লাস্ট ডেট বসিয়ে নোটিশ পাঠিয়েছে। যার ফলে টাকা আসবে বেশি, আত্মসাৎ করবে ও, আর দায় পুরোটা পরবে রাকীনের নামে। এমনিতেও খেয়া হাউজিং আর বিয়েটা নিয়ে বাবা ছেলের মাঝে যা চলছে, তাতে এ ঘটনার পর রাজীব মাহমুদ রাকীনকে ক্ষমা করবেন বলে মনে হয় না। মনেমনে খুশি হওয়ার আগে, নিজামের হঠাৎই হুশ আসলো, কর্মদিবস শেষ। এখন অকারনে নিশ্চয়ই কেউ খুজতে আসবে না রাকীনকে। আর তার উপর সে জানে না আজ রাকীনের বিয়ে। বাকা হাসলো নিজাম। নে’শায় বুদ হলেও উদ্দেশ্যহীন হলো না ও। ফোনটা নিয়ে পুনরায় কল করলো ও জামীলকে। বললো,

-কি বলতে চাইছিলি?

-একজন মেয়ে কল করেছিলো। বারবার রাকীন স্যারের সাথে কথা বলতে চাইছিলো।

-মেয়ে? কোন মেয়ে? আর ওয়ার্কিং আওয়ার শেষে, এখন রাকীনের সাথে কি বিষয়ে কথা বলতে চায়?

-মেয়েটা মনে হয় ওই অনাথ আশ্রমের। কি বলবে তা তো জানি না। তবে বারবার করে বলছে খুব জরুরি কথা আছে নাকি।

-ওকে আমার কেবিনে পাঠা। বাকিটা দেখছি আমি।

অনুমতি পেয়ে কেবিনে ঢুকলো খই। দেশের সবচেয়ে নামকরা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি, ইনিশা বিল্ডার্সের অফিস খুজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি ওকে। ট্যাক্সি করে চলে এসেছে সোজা। ততোক্ষনে ইনিশার কর্মদিবস শেষ। হাতেগোনা কিছু স্টাফ রয়ে গেছে শুধু। কেবিনে ঢুকে রাকীনকে আশা করলেও ড্রিংক বানাতে ব্যস্ত নিজামের দেখা মিললো। খই ফাইলটা বুকে আকড়ে রেখে বললো,

-রাকীন শাফায়াত কোথায়?

টলোমলো চোখ তুলে তাকালো নিজাম। শাড়ি পরিহিত মেয়েটার গায়ের রঙটা বেশ চাপা। বিনুনি করা চুল কোমড়ের নিচ অবদি এসেছে একদম। উঠে দাড়িয়ে টলতে টলতে এগোলো নিজাম। রাকীনের নামে এই প্রথমবার কোনো মেয়ে এসেছে ইনিশায়। আর যা রাকীনের নামে হয়, বরাবরই তার প্রতি কেনো যেনো লোভ কাজ করে ওর। নেশালো চাওনিতে আপাদমস্তক দেখে নিলো ও খইকে। খই লক্ষ্য করলো, ঠিকমতো দাড়াতেও পারছে না মানুষটা। এর কাছে স্কুল কেনো, রাকীনকে নিয়ে কথা বলেও লাভ নেই। নিজাম এগিয়ে এসে বিশ্রি একটা হাসি দিয়ে বললো,

-রাকীনকে কি দরকার তোমার?

-দরকারটা না হয় তাকেই বলবো? কোথায় সে?

-ওর তো আজ বিয়ে। ও নিজের দরকারে অন্য কাউকে খুজে নিয়েছে। আসো তোমার দরকারটা আজ আমিই‌ পুষিয়ে দেই না হয়?

পুরোটার বদলে শুধু রাকীনের বিয়ে কথাটা কয়েকবার কানে বাজলো খইয়ের। স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো ও। আজ ও অন্যকারো হতে চলেছে। আর আজকেই রাকীন অন্যকাউকে জীবনসঙ্গীনি করতে চলেছে। এর চেয়ে বড় ঘটনাক্রম আর কি হতে পারে? তাচ্ছিল্যের এক হাসি ফুটলো ওর ঠোটের কোনে। নিজাম এবার আরেকপা এগিয়ে বললো,

-কি বলো? আমি পুষিয়ে দেই তোমার দরকার?

খই নিজেকে সামলালো। এখানে থাকার আর কোনো মানে হয়না ওর। যতো দ্রুত সম্ভব মিষ্টিঘর ফিরতে হবে ওকে। আংটিবদলের সময় হওয়ার আগেই। তাছাড়া এখানে রাকীনকে পাওয়ার কোনো উপায়ও নেই। তাই নোটিশটা সাফোয়ানকে দিয়ে দেওয়াই উচিত হবে। খই নিজামকে শান্তভাবে বললো,

-আপনি যে কোনোকিছু বোঝার অবস্থাতে নেই, তা বেশ বুঝতে পারছি। আর আপনাকে বোঝানোর অনুকুল অবস্থাও আমার না। সরি ফর ইনট্রাপশন। আসছি।

খই পা বাড়াচ্ছিলো চলে আসবে বলে। হুট করেই বলে ওর হাত ধরে পেছন থেকে টান লাগালো নিজাম। খই এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। টান অনুভব করেই হাতের কাছে থাকা বড় ফুলের টবটা একহাতে তুলে ঘুরে উঠে বারি লাগিয়ে দিয়েছে ও। কাধে লেগেছে নিজামের। কাধ চেপে ধরে ওর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো নিজাম। খই টেবিল থেকে পানির গ্লাসের পুরোটা নিজামের মুখে ছুড়ে মেরে বললো,

-নেশা কেটেছে?

মুহুর্তেই রাকীনের কথা মনে পরে গেলো নিজামের। যতোবার রাকীন ওকে নেশা করতে দেখেছে, ততোবার এভাবেই পানি ছুড়েছে ওর মুখে। খইও এটাই করলো। রাগ সর্বোচ্চসীমায় এবার নাজিমের। তেড়ে এগোলো ও খইয়ের দিকে। ওর ঘাড়ের চুল সর্বশক্তিতে মুঠো করে নিলো। খই ব্যথায় কুকড়ে উঠে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো ওর হাত। নিজাম একটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে বললো,

-না কাটেনি নেশা। রাকীনকে খুজতে ইনিশা্ এসেছিলে না? রাকীনের স্টাইলে কাটাতে চাইছিলে আমার নেশা? তবে আজ তোমাকে দিয়েই নেশা কাটাবো যাও! গেট রেডি।

ওর বিদঘুটে হাসিটা দেখে ঘৃনায় বিষিয়ে উঠলো খই। একহাতে থাকা ফাইলদুটো ছেড়ে দিলো এবার। কোনোমতে হাতড়ে টেবিল থেকে পেপারওয়েট নিয়ে একদম কপাল বরাবর বারি লাগিয়ে দিলো নিজামের। আর্তনাত করে খইয়ের চুল ছেড়ে নিজের কপাল চেপে ধরলো নিজাম। কপাল কেটে রক্ত ঝরছে ওর। খই আর একমুহুর্তও দাড়ায়নি। ফাইলদুটো তুলে ছুটে বেরিয়ে আসলো কেবিন থেকে। কোনোদিক না তাকিয়ে, সিড়ি দিয়ে নেমে ইনিশা থেকে মুল সড়কে এসে দাড়ালো ও। নিজামও‌ ছুটেছে ওর পেছনপেছন। ও ভালোমতোই জানে, এই মেয়েকে এভাবে ছাড়লে রাকীন ওকে স্বাভাবিকভাবে ছাড়বে না। আগেরবার লিখনের সাথে যা ঘটেছিলো, তারপর রাকীনের দেওয়া ধমকিগুলো এখনো ভোলেনি ও। নিচে নেমে নিজাম খইকে দেখলো সিএনজিতে চরে বসতে। টবের বারিতে বেকে যাওয়া কাধ আর ফাটা কপাল, দুটো নিয়ে ওউ গাড়ি নিয়ে বেরোলো খইয়ের পেছনপেছন।

#চলবে…