প্রেমপ্রদীপ পর্ব-২০+২১

0
3496

#প্রেমপ্রদীপ
Part–20
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

আয়না হোটেল রুমের বিছানায় হাটু গেড়ে বসে ডুকরে ডুকরে কেদেই চলেছে। সমুদ্র কেন বললো সে তাকে ভালোবাসে? ভালোবাসা কি এতোই সহজ? মুখে বললেই ভালোবাসা হয়ে যায় কি?

আয়না আবারও কেদে দিলো। সমুদ্রের কাজ আর কথার জন্য কাদছে সে৷ কেন এতো কাছে আসতে চাচ্ছিল সমুদ্র? তাহলে কি এভাবে কাছে আসাই সমুদ্রের কাছে ভালোবাসা?

এখন রাত। আয়না রুমে লাগিয়ে দিয়েছে ভেতর থেকে। আর গেট খুলবেনা। আয়না চোখ বুজে শুয়ে পড়ল। বাসায় যেতে চায় সে। আর থাকবে না এখানে। আয়নার হালকা ক্ষুদা লেগেছে। বিকেলে নাস্তা খেয়েছে তাও ক্ষুধা পাচ্ছে তার৷
তাও ঘুমানোর চেষ্টা করছে সে।

এদিকে সমুদ্র মনে মনে ক্ষেপে আছে। সে আয়নাকে এতো বড় কথা বললো অথচ আয়নার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া নেই! শুধু বললো, আমার লাইফ থেকে চলে যাও! সে কোন দিন তার জীবনে এসেছে?সে তো নিজেই প্রবেশই করলে দিলো না! প্রবেশ করার আগে কিভাবে প্রস্থান করবে সমুদ্র?

আয়নার প্রতি মেজাজটা তার খারাপ হচ্ছে। মেয়ে হয়েও তাকে থাপ্পড় মেরে দিলো? এতো দিন যাবে ফেসবুক গল্পে পড়েছে নায়করা নায়িকাদের ঠাস ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় মারে। তাহলে তার বেলায় কেন উলটা হলো? নাহ! মানা যায়না এমন অবিচার!

সমুদ্র সিগারেট ধরালো। কালকেও আয়নাকে ধরতে হবে। আয়না কোন জবাব দেয় নি। জবাবদিহিতা করতেই হবে তাকে। সমুদ্র ঠিক করেছে আয়নাকে আর আয়ু বলে ডাকবেনা।

কিছু কিছু মানুষ এতোটা ভালোবাসা-প্রায়োরিটি পাওয়ার যোগ্যই না। এই সকল মানুষ কে অতিরিক্ত ত্যালালে এরা গালে থাপ্পড় মেরে বসে!

সমুদ্র তার গালে হাত বুলালো। সে কিছু তেই ভুলতে পারছে না এই ঘটনা! আয়ু! আয়ু তাকে মেরেছে? আয়ুর হাত কাপলো না তাকে থাপ্পড় মারার সময়।

সমুদ্র ভাবছে, ,তার ও ফল্ট আছে। সে কেন আয়নার কাছে যাবে? তাও এতোটা নিকটে? কেন তার উপর চিল্লাবে? কোন মেয়ের এতোটা কাছে গেলে রিয়্যাক্ট করা তো স্বাভাবিক ই।

সে গালে হাত দিয়ে মনে মনে বলে, যাক থাপ্পড় মারার জন্য একটা জিনিস বুঝলাম, তা হলো এখনো তোমার মধ্যে চাঞ্চল্যতা আছে। শুধু প্রকাশের অভাব!

সকালেও আয়না রুম থেকে বের হয় নি।সমুদ্র সবাইকে মানা করেছে আয়নাকে যেন না ডাকা হয়। সমুদ্রের চোখ-মুখ দেখে পিউ, আলিয়া এমন কি শ্রাবণ ও ঘাবড়ে গেছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে প্রচুর রেগে আছে সে। কিন্তু কেন তা সবার অজানা।

সকালের নাস্তা সেরে সবাই হোটেলেই থাকলো।আলিয়ার ডিউটি আজকেও দুপুরে পড়েছে।

দুপুর হওয়ার আগে আগে সমুদ্র বলল,তারাও আলিয়ার সাথে গ্রামে যাবে। সবাই যেন রেডি থাকে। সমুদ্রের কথায় কেউ অমত পোষণ করলো না।

দুপুরের আগেই সমুদ্র পুনরায় আয়নার রুমে গিয়ে নক করে। কিন্তু আয়না গেট খুলে না।এজন্য আরো এক দফা রেগে যায় সমুদ্র।

সে উপায় না পেয়ে স্টাফদের কাছ থেকে এক্সট্রা কি এনে আয়নার পারমিশন ছাড়াই গেট খুলে ঢুকে পড়ে।

আয়না তখন মাত্র গোসল সেরে বের হয়েছে। চুল গুলো টাওয়াল দিয়ে ঝারছিল। খুবই সাধারণ দৃশ্য প্রতি টা মেয়েই এই কাজ করে থাকে। কিন্তু আয়নাকে দেখে সমুদ্রের কি যেন হতে লাগলো। সে বুকে হাত দিয়ে একটা দম নিলো।

আয়না খেয়ালই করে নি সমুদ্র তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে চারপাশে কি হচ্ছে সেদিকে খেয়াল কম রাখে আয়না।

সমুদ্র হুট করে তাকে হ্যাচকা টান মারলো। আচমকা এভাবে টান লাগায় আয়না নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে গেল বিছানায়। সমুদ্রের সেদিকে ভুক্ষেপ নেই। সে চোখ ছোট ছোট করে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।

আয়না ভয়ে ঢোক গিলল। কালকে পর্যন্ত সমুদ্র কে সে বিশ্বাস করত জন্য এতো দূর তার সাথে এসেছিল। কিন্তু বিকেলের ঘটনার পর সে সমুদ্র কে ভয় পায়।

সমুদ্র আয়নাকে প্রশ্ন করে, সকালে খাওয়ার জন্য বের হও নি কেন?

আয়না উত্তর দিলোনা। এবার আর সমুদ্রের রাগ হচ্ছেনা। তার মনেই হচ্ছিলো মেয়েটা তার প্রশ্নের জবাব দিবে না।

সমুদ্র আয়নার দিকে ঝুকে আয়নার ভেজা চুলগুলো স্পর্শ করলো। আয়নার চুল লম্বা হলেও রাফ অনেক। রুক্ষ্ম। সমুদ্র আয়নার চুলে হাত দিয়ে বলে, আমরা এখন বাইরে যাব। রেডি হও।
আয়না বলল, আমি কোথাও যাব না।

সমুদ্র তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, তোমার কাছে পারমিশন চাওয়া হচ্ছেনা। ওডার করছি। যাও ভালো দেখে একটা জামা পড়ে এসো।

— বললাম না আমি যাব না। আমাকে বাসায় যেতে দাও।

— একা যেতে পারলে যাও। পারবা না তো! একা এক পা ফেলতে পারো না আর নেত্রকোনা থেকে সে একা একা ঢাকা যাবে। যাও রেডি হও।

— আমি যাব না।

— বারবার এক কথা রিপিট করবে না। আমি তোমার মতো অশিক্ষিত না আয়না। একবার বললেই বুঝে যাই।

আয়নাকে অশিক্ষিত বলায় আয়না সমুদ্রের দিকে তাকালো। দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়।

সমুদ্র টিটকারি মেরে বলে, বাই এনি চান্স! তুমি কি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পাশ করতে পারোনি আয়না? ফেল করেছিলে নাকি? সাইন্সে তো পড়তা না ফর সিউর! আর্টস থেকে ডাব্বা মেরেছো? ভূগোলে ফেইল করেছিলে?

আয়না কিছু না বলে উঠে দাড়ালো। সমুদ্র সামান্য ঝুকে ছিল না জন্য তাদের মধ্যকার দূরত্ব আরোও কিছুটা ঘনিয়ে এলো। আয়নার যেন এতো দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

— যাক গে! এটা তোমার পারসোনাল ব্যাপার।রেডি হও। আমাকে যেন এই কথা আর একবারও বলতে না হয় আয়না। (ধমক দিয়ে)

আয়নার রাগ লাগছে। সমুদ্র কেন তাকে আয়না বলে ডাকছে? আয়ু বলে ডাকলে কি খুব ক্ষতি হবে?

আয়নার প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে সমুদ্র নিজে ব্যাগ থেকে এক এক করে জামা বিছানায় ফেলতে লাগলো। একটাও সুন্দর না। ভালো না। এবং সব গুলোই পুরাতন। একটা আবার ছিড়াও।

সমুদ্র জিজ্ঞেস করে, এগুলি তোমার জামা-কাপড়?

আয়না মাথা নাড়ল। সমুদ্র কিছু বললোনা। নেড়েচেড়ে দেখে নিল। নাহ এগুলো পড়া যাবে না। সে ব্যাগ থেকে আরো দুইটা কামিজ বের করল। এর মধ্যে সাদা জামাটাই মোটামুটি চলে। এক কালারের সাদা কামিজ, সাদা সালোয়ার ওড়নাটাও সুতির সাদা কাজ করা। এই কামিজ টা আগেও আয়না পড়েছে। সমুদ্র ঠিক করল, সেও সাদা শার্ট পড়বে।

কামিজ টা আয়নাকে দিয়ে বলে, যাও রেডি হও।

— আমি যাব না।

সমুদ্র রেগে গেল। সে আয়নাকে ধমক দিয়ে বলে, আমি তোমার বাবা না যে তোমার এসব ন্যাকামি সহ্য করে মামনি-মামনি করে পিছনে পিছনে ঘুরব। এইসব ঢং আমার জাস্ট অসহ্য লাগে৷

আয়না কেপে উঠে কান্না করে দেয়। এতেও মায়া হলোনা সমুদ্রের। সে আরো জোড়ে ধমক দিয়ে বলে, খবরদার কাদবেনা। কান্না করার মতো কিছু ঘটেনি।

আয়না শব্দ করে কেদে দিলে সমুদ্র বলে উঠে, চোখের পানি যেন না পড়ে। কথায় কথায় কাদাও আমার পছন্দ না। আমার সব অপছন্দের জিনিস ই দেখছি তোমার স্বভাব!

আয়নার হাত ধরে সমুদ্র তাকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে কাপড় ধরিয়ে দিলো। আয়না বাধ্য হয়ে রেডি হলো। তার ভালো লাগছে না তবুও সমুদ্র জোর করে কোথায় যে নিয়ে যাচ্ছে সেটাও সে জানে না।

দুপুরের আগেই সবাই রওনা হলো। আয়না উদাস হয়ে বসে আছে। গ্রামের মাটির রাস্তায় মাইক্রো ঢুকাতে খুব কষ্ট হলো।

গ্রামে আসতেই মন জুড়িয়ে যায় সমুদ্রের। কিন্তু জায়গা টা পুরাই গন্ড গ্রাম। নেত্রকোনা থেকে আরো বেশ খানিকটা পথ পর এই গ্রাম। সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেই জন্য ফ্রিতে ক্যাম্প করা হচ্ছে ইউনিসেফ থেকে। মা ও শিশুর কল্যানের জন্য একটা প্রকল্প বা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আলিয়া কাজে চলে গেল। সমুদ্র আর শ্রাবণ আয়না পিউকে নিয়ে চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। তারপর কি মনে করে সমুদ্র নিজেও ক্যম্পে গেল। সেও কাজ করতে চায়। যেহুতু ডাক্তার সে। এক-দুই জনকে।চিকিৎসা দিলে ক্ষতি তো নেই।

কতৃপক্ষের সাথে কথা-বার্তা বলে রোগী দেখা শুরু করে দিলো সে।

শ্রাবণ আয়না আর পিউকে নিয়ে বসে থাকলো। বিকেলে ক্যাম্প শেষ হলো। শ্রাবণ কোথা থেকে খোজ পেয়েছে পাশের গ্রামে বিরাট মেলা বসেছে। ব্যস, পিউ আর শ্রাবণ সেখানে যাওয়ার জন্য পাগল প্রায়।

আলিয়া ক্লান্ত তাই বললো, না। না। যাব না। প্লিজ চলো হোটেলে যাই।

একথা শুনে শ্রাবণ বাজগাই গলায় বলে, যাদের যাওয়ার ইচ্ছা নেই তারা এখানে থাক। আমরা তো যাবই। যাব মানে যাবই। একমাত্র পৃথিবী ধ্বংস হওয়াই আমাকে মেলা থেকে যাওয়ায় বাধা দিতে পারবে। আর কারো ক্ষমতা নেই।

আলিয়া মনে মনে বলে, একবার খালি তোমার বাবা ফোন দিয়ে ঝাড়ি দিক, ঠ্যালা কি জিনিস বুঝবা। হুহ!

সমুদ্র বলল, আচ্ছা। আমরা সবাই যাব। আলিয়া নূর জাহান মেলায় গিয়ে একটা চেয়ারে বসে থাকবে। চল রওনা দেই।

পিউ আর শ্রাবণ তো খুব খুশি হলো। কিন্তু দুই বোন যে অখুশি তা বোঝা যাচ্ছে।

সবাই গাড়িতে বসার পর সমুদ্র গাড়ি তে ঢুকলো। গাড়ি চলতে লাগলো। পাশের গ্রামে খুব তাড়াতাড়ি পৌছে গেল তারা।

এখানকার মেলা দেখে সন্তষ্ট হলো সমুদ্র। বিশাল বড় মাঠে মেলা বসেছে৷ এক ধারে নদীর পাড় ও আছে। আবার বট গাছ ও আছে। হরেক রকমের মাটির পুতুল, শখের হাড়ি, মাটি ও শলার খেলনা, মেয়েদের সাজ-সরঞ্জাম। এক দিকে খাবারের আসর। বাতাসা, নিমকি-মুড়কি,খৈ ভাজা। পিঠা।

আলিয়া মেলা এসে ক্লান্তি ভাব ভুলে ছোটাছুটি শুরু করে দিলো। তা দেখে শ্রাবণ বলে,আমাদের মধ্যে কে যেন ক্লান্ত ছিল?

আলিয়া রাগী চোখে শ্রাবণের দিকে তাকায়। শ্রাবণ মুখ বাকিয়ে বলে, এখন কেন মেলা দেখে পাগল হয়ে গেলা? যাও! গাড়ি তে বসে রেস্ট নাও। ক্লান্ত না তুমি!

— এই তুমি একদম বেশি কথা বলবা না।

— কেন বলব না? একশ বার বলব!

আলিয়া কথা না বাড়িয়ে পিউয়ের কাছে গেল।

আয়না এক সাইডে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেলার থাকা মানুষ জনকে দেখছে। তখনি সমুদ্র এসে তার হাত ধরল।

আয়না চমকে উঠে তাকিয়ে দেখে সমুদ্র তার ডান হাতে লাল রঙের রেশমি চুড়ি অনেক যত্ন নিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছে। আয়না হাত সরাতে চাইলেও সমুদ্র তার হাতে চুড়ি পড়িয়ে দিয়ে বাম হাতে ও এক ডজন চুড়ি পড়িয়ে। অনেক দিন পর হাতে লাল চুড়ি পড়ল আয়না। সে হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে।

সমুদ্র আয়নাকে বলতে লাগলো, আই এম সর‍্যি। মিসবিহেইভ করেছি তোমার সাথে তাই না?

–হুম।

— কিন্তু আয়ু আমি সত্যি তোকে ভালোবাসি।

আয়না সমুদ্রের কথা এক ফোটা অশ্রু ফেললো।

মেলায় ঘোরাঘুরি করার পর যখন তারা বেরুতে যাবে তখন একটা কান্ড ঘটলো। আজকে নাকি গানের আসর বসেছ গ্রামে। সদর থেকে মানুষ এসেছে সেই আসর দেখতে। ভোর রাত অব্দি চলবে।
গান-বাজনা হবে। গাড়ি পাড় হবে না রাস্তা দিয়ে। রাস্তা ব্লক করে ফেলেছে গ্রামের লোকজন।

একথা শুনে সমুদ্রের মাথায় বাজ পড়লো৷ এখন তিনটা মেয়ে নিয়ে কোথায় রাত পাড় করবে?

গ্রামবাসী দেরকে অনেক অনুরোধ করা হলো। কিন্তু তারা রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। আর যাওয়া যাবে না আজকে। পরে অনেক অনুরোধ করার পর এক বুড়ি মহিলার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা হলো।

★★★

রাত একটার দিকে আয়নার পেট ব্যথা করতে লাগলো। সে বুঝে যায় তার পিরিয়ড হয়ে গেছে। এখন কি করবে সে?

উপায় না পেয়ে অচেনা জায়গায় মধ্য রাতে বাথরুমে যাওয়ার জন্য বের হলো সে। অন্ধকার অনেক। কোন লাইট নেই কোথায়। বাথরুমটা বাসার বাইরে আলাদা ভাবে তৈরি করা হয়েছে৷
আয়না গুটিগুটি পায়ে বাথরুমে গেল। দরজা খুলতেই সে চেচিয়ে উঠে ।

বাথরুমে সমুদ্র ছিলো। সে আয়নাকে দেখে বলে,কি আশ্চর্য! তুমি এভাবে হুটহাট বাথরুমে কেন ঢুকে পড়লে?

আয়না বেশ দ্বিধায় পড়ে গেল। যদিও বা এখানে প্রচুন্ড অন্ধকার তাই কিছু ই দেখা যাচ্ছে না৷ দোষ সমুদ্রের ! সে কেন গেট খুলে বাথরুমে যাবে?

আয়না বলে, আমি ফ্রেস হবো।

–ওহ।

সমুদ্র বাথরুম থেকে বের হলো।তআর খুব লজ্জা লাগছে । বাথরুমের ভেতরে তার ফোনের ফ্লাশ লাইট জ্বলছে। আয়না ধাম করে গেট লাগিয়ে দিলো। সমুদ্র বাথরুমের বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলো।

এমন সময় আয়না বাথরুম থেকে বলে, সমুদ্র?

সমুদ্র চমকে উঠে। এই প্রথম বার আয়না তার নাম ধরে ডেকেছে। সে আবেগে আপ্লূত হয়ে গেল এবং বলল, কি হয়েছে আয়ু?

— তোমার কাছে এক্সট্রা কাপড় হবে?

— এক্সট্রা কাপড়? কাপড় দিয়ে কি করবে?

— নিশ্চুপ রইল আয়না।

সমুদ্র নিজে থেকেই বুঝে গেল তারপর বলল, আমি ডাক্তার। ফার্মেসীর দোকানদার না যে এইসব নিয়ে বসে থাকব। দেখি বের হও। একটা ব্যবস্থা করে দিই।

আয়না গেট খুলে দিল। উপায় ও নেই বাথরুমে । ফোন হাতে নিয়ে বের হতে ধরলে, বাথরুমের উচু অংশের সাথে আয়নার পা বেজে যায় এবং প্রচন্ড জোড়ে ব্যথা পেয়ে সে কুকিয়ে উঠে।

সমুদ্র ব্যতিব্যস্ত হয়ে আয়নার কাছে গিয়ে বলে, পায়ে লেগেছে?

–হু।

–কই লেগেছে দেখাও।

সমুদ্র ফোন হাতে নিয়ে হাটু গেড়ে বসে আয়নার পা দেখতে করতে লাগলো এবং বলল, মচকে গেছে পা।

তারপর আয়নার পায়ে হাত দিয়ে নাড়াতে লাগে এবং প্রশ্ন করে, খুব ব্যথা লাগছে নাকি?

–হ্যা।

— অনেক জোড়ে?

আয়না কেদে দিয়ে বলে, হ্যা।

সমুদ্র আয়নার পা নাড়িয়ে দেখছে, হাড্ডি ভাঙ্গল কিনা!

আয়না কুকিয়ে উঠে বলে, আস্তে আস্তে প্লিজ।

এমন সময় কারো চিল্লা-চিল্লির আওয়াজ পায় সমুদ্র আর আয়না।

সমুদ্র দাঁড়িয়ে যায়। কি হয়েছে দেখার জন্য। এটা তো বুড়ি মহিলার আওয়াজ।

বুড়ি চিতকার দিয়ে বলে, আয়-হায়! আমার পবিত্র বাড়িতে এসব কি অপবিত্র কাজ করছিস তোরা?

সমুদ্র আতকে উঠে। বুড়ি বলে কি?

বুড়ি মহিলা হাক পেড়ে চিতকার করতে করতে বলে, নষ্টামি করার আর জায়গায় পাস না তোরা আমার বাসায় আমার টয়লেটে এসে এসব করছিস?

সমুদ্র বলল, আপনি ভুল ভাবছেন দাদি। এমন কিছু ই না। ওর পিরিয়ড হয়েছে। আমি সাহায্য করতে আসছি।

বুড়ি আরো জোরে চিতকার করতে লাগলো। আশেপাশের বাসা থেকে মানুষ জোড়ো হতে লাগলো। এক মূহুর্তে যেন এসব ঘটে গেল। সমুদ্রের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। মাথা হ্যাং মেরেছে। এদিকে আয়না কেদেই চলেছে৷

রাতারাতি এক পলকের মধ্যে পরিবেশ প্রতিকূলে চলে গেল। শ্রাবণ, পিউ আলিয়া সবাই বাইরে চলে এসেছে। তারাও নিরুপায়। একে অপরের দিকে চাউয়া-চাউয়ি করছে।

গ্রামের মোড়লকে (চেয়ারম্যান) ডাকা হলো মাঝ রাতেই। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, হয় এখুনি এই মূহুর্তে মেয়ে আর ছেলেকে বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হবে আর নাহলে ছেলেকে শাস্তিস্বরূপ একশ ঘা বেত্রাঘাত করা হবে। শুধু ছেলেকে শাস্তি দেওয়া হবে। এটাই নাকি এই গ্রামের অঘোষিত নিয়ম।

সমুদ্র এমন রায় শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। আজকে আয়নার হাতে তার জীবন! আয়না যদি বিয়েতে রাজী না হয় তাহলে তার মৃত্যু হলেও হতে পারে। এতোবড় মুশকিলে পড়বে জানলে কোন দিন আসত না সে এই গ্রামে। তারা পাচজনই নিরুপায়। গ্রামবাসী সমুদ্র আর আয়নার উপর রাগান্বিত। কেউ কেউ বলছে মেয়েকে জোড় করা হয়েছে। আরো কত গুজব! প্রতোক্ষ বা পরোক্ষভাবে সব দোষ সমুদ্রের উপর পড়ছে। আয়না সমানে কান্না করছে। এতে বিরক্ত সমুদ্র। সিগারেট ধরাতে পারলে মাথা কাজ করর তার!

সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এক ঘন্টা সময় দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত কে সবার থেকে দূরে রাখা হলো। এটা নাকি ওই গ্রামের নিয়ম। সমুদ্র চিন্তায় পড়ে গেল। কি সিদ্ধান্ত নিবে সে?

আয়নাকে বিয়ে করে নিবে? সে তো ভালোবাসে আয়নাকে। কিন্তু আয়না তো তার সাথে কথাই বলে না। আয়না কি অন্য কাউকে ভালোবাসে? আয়নাকে বিয়ে করলে পরিনাম কেমন হবে?

চলবে৷

#প্রেমপ্রদীপ
Part–21
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

রাতের শেষ প্রহর তখন। তবুও ঝিঝি পোকা সমানে ডেকেই চলেছে। এতে ক্ষিপ্ত আয়না। তার চিন্তায় হাত-পা বরফ হয়ে যাচ্ছে৷ বাইরে প্রচন্ড শীত। সম্ভবত ১৬° সেলসিয়াসের নিচে। এমন হাড় ভাঙ্গা শীতেও আয়না ঘামছে। গলা পিপাসায় কাঠ হয়ে গেছে। চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে তার। পেছন থেকে দরজা খুলার ক্যাচক্যাচ শব্দ আসছে। এই ঘরে তো সমুদ্র কে রাখা হয়েছিল। তাহলে কি সমুদ্র বের হল সবে রুম থেকে? ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোর শক্তি আয়নার নেই।

সমুদ্র নির্বিকার ভাবে রুম থেকে বের হলো। সবার মধ্যমণি যেন সে। গ্রামের সকলের দৃষ্টি তারই দিকে। সমুদ্র শান্ত ভাবে হেটে হেটে মোড়লের কাছে গেল। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, একশ বেতের আঘাত সহ্য করবে। তবুও আয়নাকে বিয়ে করবেনা। এতো অহংকার আয়নার! একবারও একটা কথা বললো না৷ অথচ সাহায্যের প্রয়োজন যখন ছিল তার ই কাছে এসেছিল।

সমাজে এক প্রকার মানুষ ই আছে, যারা সাহায্যের পর সবকিছু ভুলে অকৃজ্ঞত থাকে।

সমুদ্র জানে গণধোলাইয়ে কেউ কোন দিন মরে না। সাধারণ জনতা রক্ত ভয় পায়। কেউ রক্তাক্ত হলে,তাকে আর জনতা মারধর করতে পারেনা । সমুদ্র ও এখন সাত-আট টা বেতের আঘাত খেয়ে মরে-পরে থাকার অভিনয় করবে। কিন্তু অভিনয় করতে হবে খুবই সুক্ষ্মভাবে যেন ধরা না খায়!

চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে কথা বলল সমুদ্র।চেয়ারম্যান বলে, ঠিক ঠিক বলছেন তো?একশ বেতের আঘাত সহ্য করতে পারবা?

— অবশ্যই পারব। মানুষ পারেনা এমন কোন কাজ নেই। মানুষ ডাইনামিক বানিয়ে পাহাড় ভাঙ্গছে। চাদে যাচ্ছে নিমিষেই, পারমানবিক বোমা বানিয়ে সব তচনচ করছে, এ আবার এমন কি?

চেয়ারম্যান আবারো তাকে বলে, এর চেয়ে ভালো বিয়ে করে নাও। পাপ ধুয়ে যাবে। আল্লাহ পাক চাইলে ক্ষমা করে দিবে। আল্লাহ পাক মহা ক্ষমাশীল।

সমুদ্র একবার আয়নার দিকে তাকালো। আয়নার মধ্যে তার মায়ের রক্ত বইছে। কোন না কোন একদিন সুযোগ পেলে আয়নাও তাকে ছেড়ে চলে যেতে একবার ও পিছপা হবেনা। অতীতে দেখেছে সে। রক্ত এক, কারবার ও এক হবে। সেইম-সেইম ডিএনএ। একই ক্রোমোজম ঘুরপাক খাচ্ছে ফুপু-ভাতিজির গায়ে।

সে চেয়ারম্যান কে বলে, বিয়ে-শাদির চেয়ে একশ বেতেরঘাত উত্তম। শুধুমাত্র উত্তম না। মহা উত্তম ।

— ঠিক আছে বলে চেয়ারম্যান সাহেব হাক পেড়ে বলে,মোকলেস সব ব্যবস্থা কর। পোলা বেতের বারি খাইতে চায়৷

একথা শুনে শ্রাবণ, আলিয়া, পিউ তিনজনই হতবাক। এখন কি হবে! পিউ সঙ্গে সঙ্গে এক দফা কেদে দিলো। তার ভাইয়ার যদি কিছু হয়ে যায়।

শ্রাবণ নিজেও নিরুপায়। সব দোষ তার। সে যদি জেদ না ধরত তবে কোন দিনই এমন হত না। তার ফোনে চার্জ ও নেই। কার কাছে সাহায্য নিবে? বাবার নাম্বারে কল দিবে কি?যদিও এই মূহুর্তে কেউ কিছু করতে পারবেনা৷ বাবা পৌছাতে পৌছাতে সব ঘটে যাবে।

সমুদ্র একবারও আয়নার দিকে আর তাকায় নি।

চেয়ারম্যান সাহেব বললো, জ্যাকেট খুলো৷

সমুদ্র সুন্দরমতো জ্যাকেট খুলে দিলো। চেয়ারম্যান সাহেব এতেও তুষ্ট হলো না। সে আবারো বলে উঠে, শার্ট খানা ও খুলে দাও।

এবারে সমুদ্র তব্দা খেল। এতো গুলো মানুষের সামনে সে কিভাবে খালি গা হবে? মান-মর্যাদা বলেও তো কিছু একটা আছে তার।

সমুদ্র গাই-গুই করতে লাগলো যে শার্ট খুলবেনা। চেয়ারম্যান ও কম না তিনি বলেন, শার্টের উপর দিয়ে মার নাকি গায়ে লাগেনা৷

অগ্যতা, জোড়পূর্বক সমুদ্র শার্ট খুললো।

দুইজন লোক তাকে মাঝখানে নিয়ে গিয়ে মাটিতে বসিয়ে দিলো।

আরেকজন একটা চিকন বেত গরম করে আনলো। সমুদ্র চোখ বন্ধ করে ফেলে এবং আস্তে আস্তে দোয়া পড়তে লাগে।

এদিকে পিউ কান্না করতে করতে আয়নার কাছে গেল এবং কান্নারত সুরে বলে, আপা প্লিজ! ওদেরকে থামতে বলো। নাহলে ভাইয়ার অনেক কষ্ট হবে৷ ও এসব সহ্য করতে পারবেনা। ভাইয়া অসুস্থ হয়ে যাবে।প্লিজ আপা, ওনাদের কে এসব থামিয়ে দিতে বলো।

আয়না নির্লিপ্ত গলায় বলে, আমি বললেই কি থামিয়ে দিবে ওনারা?

তখনই প্রথম বেতের আঘাত লাগলো সমুদ্রের গায়ে। বেশ জোরেই শব্দটা হলো। সবটা আয়নার চোখের সামনে ঘটলো। আয়নার বুক কেপে উঠে। এদিকে সমুদ্রের ডান কাধ বরাবর বেশ বড়সড় একটা লাল চিকন দাগ বসে যায়। সমুদ্র চোখ খিচে বন্ধ করে দাতে দাত চেপে আছে। প্রচন্ড জোড়ে ব্যথা পেয়েছে সে। এতো জোড়ে লেগেছে যে সে কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। সম্ভবত প্রচুর ব্যথা পাওয়ায় মধ্যমস্তিষ্কের নার্ভদ্বয় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে৷

দ্বিতীয় দফা বেতের আঘার পেতেই সমুদ্র আর্তনাদ করে উঠে। প্রথম বারের চেয়ে এবারের আঘাতটার ধক বেশি ছিল। সমুদ্র সহ্য করতে পারছেনা। এতোই ব্যথা পাচ্ছে যে নিশ্বাস নিতে পারছে না সে। জীবনে একবার অংক ভুল করার জন্য টিচারের হাতে স্কেলের মাইর খেয়েছিল। এছাড়া আর কোন দিন মার ভাগ্যে জুটে নি তার।

আয়নার চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। সমুদ্রের এমন পরিনতি তার সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। কি করা উচিত তার? তার হাতে তো কিছুই নেই। এদিকে ক্রমান্বয়ে পিউ কেদেই যাচ্ছে। শ্রাবণের চোখ টলমল করছে৷ আলিয়া তার বোনকে গিয়ে বলে, আপা পিউ ঠিক বলছে।প্লিজ কিছু একটা করো। ভাইয়া বেতের আঘাত সইতে পারবে না৷ মারা যাবে।

মারা যাবে শুনে আয়নার টনক নড়লো। এসব কি বলছে আলিয়া? এমন অমঙ্গল কথা মুখে নিতে নেই।আয়না আলিয়ার দিকে তাকালো।

তখনি তৃতীয় দফায় আঘাত পাওয়ায় সমুদ্র মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ধাম করে পড়ে যায় সে৷ সে এই মূহুর্তে অচেতন হয়ে যাচ্ছে। চারপাশে কি হচ্ছে জানে না সে।চোখ খোলার ক্ষমতা নেই তার। শুধু মন চাচ্ছে ঢক ঢক করে যদি এক গ্লাস পানি খেতে পারত! ইতিমধ্যেই তার হাত অবশ হয়ে গেছে।মস্তিষ্ক কাজ করছে না। সমুদ্র এই মূহুর্তে তার নিজের পুরা নাম ও বলতে পারবে না বোধহয়! আচ্ছা আসলেই তো তার পুরা নাম কি?আসলেই এই মূহুর্তে মনে আসছে না। তবে আম্মু তাকে আদর করে বাবু ডাকত। মাঝে মাঝে ওসেনও বলে ডাকত। ওসেন মানে হলো মহাসমুদ্র।

চতুর্থ ঘাত পড়ার পর সমুদ্রের একেবারেই নাজেহাল অবস্থা। মুখ দিয়ে রক্ত পড়া শুরু করল। কেন করল জানে না কেউ! এর কি কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখা আছে কি? হাতে আঘাত লাগলে মুখ দিয়ে কেন রক্ত পড়বে? ডাক্তার হয়েও কোন উত্তর নেই তার কাছে। মেডিকেল ফোর্থ ইয়ারে প্রোফেসর দেবচন্দ বাবু স্যার বলেছিলেন, There is nothing Fixed in medical Science. Everything can happen at anytime!

সমুদ্রের মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে দেখে আয়নার মাথা ঘুরাতে লাগে। তার প্রচুন্ড কষ্ট হচ্ছে এসব দেখে। আর থাকতে পারছে না সে। অস্থির হয়ে পড়ল আয়না। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদে দিল সে৷

পঞ্চম আঘাত পড়ার আগেই আয়না চিতকার দিয়ে বলে উঠে, থামুন! থামুন! দয়া করে ওকে আর মারবেন না।

আয়নার কথায় সত্যি সত্যি পঞ্চম আঘাত পড়েনি সমুদ্রের উপর। সবাই আয়নার দিকে তাকালো। আয়না একাধারে কেদেই চলেছে।

সে কাদতে কাদতে বলতে লাগলো, প্লিজ ওকে মারবেন না আর৷ ও সহ্য করতে পারছে না।

এক লোক বলে উঠে, ছেলে নিজেই রাজী হইসে একশ আঘাত খাওয়ার জন্য এখন তো থামান যাবে না। আরো পঁচানব্বই আঘাত বাকি! তা আমরা দয়া করে শাস্তি কমায় আনে পঞ্চাশ বেতের আঘাত করে দিচ্ছি।

আয়না জোড়ে জোড়ে বললো, আর একটা বেতের চিহ্ন ও যেন ওর গায়ে না পড়ে৷

গ্রামের পরিবেশ থমথমে হয়ে যায়। চেয়ারম্যান সাহেব বললো, তাহলে তো বিয়ে করতে হবে। তা নাহলে ছেলেকে শাস্তি দিতেই হবে। ওই মোকলেস আবার শুরু কর। এবার আর থামবি না।

আয়না থমথমে গলায় বলে, আমি বিয়েতে রাজী!

আলিয়া বোনের দিকে চোখ বড় করে তাকায়। এমন এক পরিস্থিতি যে আপাকে বিয়ে করতে মানাও করতে পারছে না। আবার বিয়ে হলে কি হবে? আপা পারবে এই বিয়ে মানতে? সব কিছু নতুন করে সাজাতে?

আয়না বিয়েতে রাজী শুনে চেয়ারম্যান খুশিই হলো এবং সমুদ্রের শাস্তি মওকুফ করা হলো৷

আয়না সমুদ্রের কাছে প্রায় এক প্রকার দৌড়ে গেল। সমুদ্র তখনো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। গায়ে ধুলোবালি লেগে আছে। মুখে রক্তের ছিটেফোঁটা। অবচেতনের মতো পড়ে আছে সমুদ্র। তাকে কাছ থেকে দেখতেই আয়নার বুকটা হুহু করে উঠে। সে সমুদ্র কে স্পর্শ করলো। হাত বুলিয়ে দিল তার কপালে।

আলিয়া শ্রাবণ সমুদ্রের কাছে গিয়ে তাকে তুলে ধরে এবং বোতল থেকে পানি বের করে, মুখে ছিটা দেয়।

সে চোখ খুলে। আশেপাশে তাকিয়ে সবকিছু দেখতে লাগলো। হাতের বা দিকে আয়নাকে কাদতে দেখে হতভম্ব হলো সমুদ্র। সে অনেক কষ্টে বলে উঠে, আমি কি বেচে আছি?

আয়না উত্তর না দিয়ে কেদে দেয়। এরপর এক প্রকার ঘোরের মধ্যে থাকলো সে। আশেপাশে কি হয়েছে বা হচ্ছে অর্ধেকই মাথায় ঢুকলো না তার। শুধু তাকে সবাই মিলে ধরে একটা চেয়ারে বসালো। পরনে তখনো কিছু ছিল না। খালি গা। তখন হয়তোবা ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ পাচ্ছ সে। পাখির ডাকের মাঝে কেউ একজন অতি নমনীয় কন্ঠে কবুল বলে। এই কন্ঠস্বরটাকে সে চেনে।

এবার এক ভরাট কন্ঠে কে যেন কি কি সব বললো। তারপর কেউ একজন তার কানের কাছে কবুল বলতে বলে। সমুদ্র কবুল বলে দেয়।

কবুল মাত্র তিন অক্ষরের একটা শব্দ. কবুল এর তিনটা অক্ষরই ব্যঞ্জনবর্ণ। ব্যঞ্জনবর্ণের সংজ্ঞা যেন কি?

যারা স্বরবর্ণের উপর নির্ভরশীল! কবুল শব্দটাই শিখিয়ে দিচ্ছে সামনে থাকা ব্যক্তির উপর তুমি আজ থেকে নির্ভরশীল।

সমুদ্র এতোক্ষনে বুঝতে সক্ষম হলো তার বিয়ে হয়ে গেছে। এমন খালি গায়ে ভোরের আলোর মাঝে খুব কম সংখ্যক মানুষের বিবাহ হয়। সে অতিমাত্রায় ভাগ্যবান! এজন্য এভাবে তার বিয়ে হলো। আলহামদুলিল্লাহ।

বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর, দুইজন মহিলা আয়নাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়।

একজন মহিলা আয়নাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার লাল রাঙা কোন কাপড় নাই?

আয়না থমথমে গলায় বলল, নাহ!

মহিলা ভারী চিন্তিত গলায় বলে, এমন সাদা রঙ পড়ে বাসর করা টা মানায় না। এক কাজ করি,আমার একটা যাকাতের লাল শাড়ি আছে৷ ধোয়া শাড়ি। একদিন পড়ছিলাম। ধোয়ার পর ফেসে গেছিলো। বুড়ি মানুষ লাল পড়িনা জন্য আর পড়া হয় নি। তুলে রাখছি। ওইটা পড়ে নাও।

আরেক মহিলা বলে উঠে, আগে গোসল দিতে কয় তো। নাপাক আছে। আগে পাক হয়ে আসুক।

আয়না একথা শুনে কষ্ট পেল।

দুইজন মহিলার জোড়াজুড়ি তে আয়না গোসল করে লাল রঙের, রঙ উঠা পুরাতন শাড়িটা পড়ে নিল।

বাথরুমের আয়না না থাকায় সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছেনা। অনেক দিন পর লাল রঙের কিছু গায়ে জড়ালো সে। বেশ অস্বস্তি লাগছে তার। তার ও তো লাল রঙের শাড়ি পড়া বারং!

যাকাতের ফেসে যাওয়া লাল শাড়ি পড়ে আয়নাকে আগের আশ্রয় দেওয়া বুড়ি মহিলার বাসায় নিয়ে যাওয়া হলো। এখানেই বাসর করা হবে। সময়টা কেবল ভোর। সকাল হয় নি। কিংবা হয়েছে। কিন্তু সূর্যের আলো এখনো চোখে পড়ছেনা। কুয়াশার জন্য।

আয়নাকে বিছানায় বসিয়ে চলে গেল তারা৷আয়নার হাতে এক হাজার টাকার একটা নোট। এটা নাকি তার দেনমোহর।

আয়না নিজেও এসবের জন্য প্রস্তুত ছিল না। এতো বড় একটা ঘটনা যে ঘটবে সে কালে-ভাদ্রেও কল্পনা করতে পারেনি। সমুদ্র তো তার সম্পর্কে কিছু ই জানে না!

এমন সময় রুমে সমুদ্র আসল। আসার আগে গেট নক ও করেনি সে। আয়না নড়েচড়ে উঠল।

সমুদ্র রুমে এসেই আয়নাকে লাল শাড়ি পড়ে থাকতে দেখে তব্দা খেল। আয়নাকে এই প্রথম সে রংচং কাপড় পড়তে দেখল। তাও আবার শাড়িতে। বেচারির চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। আজকে তাদের সাথে যা হয়েছে এর জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ভবিষ্যতে। কিভাবে সব ঠিক হবে।

সমুদ্র রুমে ঢুকেছে জন্য আয়না ভয় পাচ্ছে। কান্না পাচ্ছে তার।

তখনই সমুদ্র খুক খুক করে কাশলো। এতে কোন ভাবান্তর নেই আয়নার। এজন্য সহসাই খুব স্বাভাবিক ভাবে সমুদ্র আয়নার পাশে গিয়ে বসে তার হাত ধরতে চাইলে আয়না সরে আসে। সে ভ্রু যুগল কুচকে আয়নার দিকে তাকালো।

আয়না সাথে সাথে হাউমাউ করে কেদে দেয়। সমুদ্র ভড়কে গিয়ে আয়নাকে ধরতে গেলে,

আয়না ক্লান্ত গলায় বলে, দূরে থাকো প্লিজ।

এই কথায় সে অপমানিত বোধ করে।

আয়না কেদেই চলেছে। এতে রেগে যায় সমুদ্র। আয়না নিজেই বিয়েতে রাজী হয়েছে৷ সে তো বিয়ে করতে চায় নি! অথচ এখন এমন আচরণ করছে যেন তাকে জোড় করে তুলে এনে বলা হয়েছিল, বল কবুল নাহলে মরো!

সমুদ্র মেজাজ খারাপ করে আয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, এই বেয়াদব মেয়ে, খবরদার আমার সামনে কাদবে না। এসব কান্নাকাটি আমার পছন্দ না৷

— আমি এই বিয়ে মানি না৷

সমুদ্র কিংকর্তব্যবিমৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। এটা কেমন কথা বিয়ে মানে না? এটা তো আর উপন্যাস না। বাস্তব জীবন।এমন নাটকীয় কথা বলার মানে কি?

সমুদ্র আয়নার নিকটে গিয়ে দাড়ালো এবং তার দুই হাত ধরে নরম গলায় বলে, এভাবে বলার মানে কি আয়ু? তুমি কাউকে ভালোবাসো?

আয়না উত্তর দিচ্ছেনা। কিভাবে বলবে সত্যটা সে সমুদ্রকে?।

— কি হলো উত্তর দাও? তোমার জীবনে অন্যকেউ আছে কি?

আয়না আরো জোড়ে কেদে দিলো। মাথা নিচু করে ফেলে সে।

— ভালোবাসলে তা মাথা উচু করে বলতে হয়।এখানে অপমান হওয়ার কিছু নেই৷

আয়না বুঝে পাচ্ছে না কিভাবে সে সমুদ্র কে বলবে, সে বিধবা।

আয়নার উত্তর না পেয়ে সমুদ্র হুংকার দিয়ে বলে, কথা বলোনা কেন মেয়ে? উত্তর দাও।

আয়না কেপে উঠে বলে দেয়, আ,,,,আমি বি,,বিধবা সমুদ্র।

কথাটা শোনামাত্র সমুদ্রের চোখ মুখ আস্তে আস্তে শুকিয়ে আসতে লাগে। তার ভ্রু আপনা-আপনি সংকুচিত হলো। সম্ভবত কথা বলার শক্তিও তার লোপ পেল। আস্তে করে সে আয়নার হাত দুটো ছেড়ে দেয় দূরে সরে আসে।

আয়না চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল মাথা নিচু করে। রুমে পিনপতন নীরবতা। সে মাথা নিচু করে রেখেই শুনতে পেলে রুমের দরজা কেউ প্রচন্ড জোড়ে ধাম করে লাগিয়ে দিল।

শব্দটা এতো জোড়ে ছিল যে আয়না চমকে উঠে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে রুমে সমুদ্র নেই।রুম ফাকা।

সে সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোরে বসে পড়ে হাউমাউ করে কেদে দেয়।

★★★

আবেগ হাসপাতালে বসে আছে৷ সামনে একটা মেডিকেল রিপোর্ট রাখা। এই রিপোর্ট টা তার। সে কাপা কাপা হাতে রিপোর্ট টা হাতে নিয়ে পড়তে আরম্ভ করল। পড়তে পড়তে তার চোখ ভিজে উঠতে লাগে। আবেগ দ্রুত চোখ মুছে নেয়। যআ সন্দেহ করেছিল তাই হলো। আবেগের শরীরে ক্যান্সার বাসা বেধে ফেলেছে। আবেগ চেয়ারে হেলান দিলো। হাত-পা কাপছে তার। সেকেন্ড স্টেজে আছে বোধহয়। কি করবে সে?

সমুদ্র বা বাসার কাউকে জানাতে ইচ্ছুক না সে।

সমুদ্র তো ঘুরতে গেছে। যাওয়ার আগে তাকে ফোন দিয়ে পারমিশন নিল৷ আবেগ খুশিমনেই ছেলেকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। একয়েকদিন তো সুস্থ ই ছিল সে। ক্যান্সার তো আর কালকে বাসা হানে নি । এখন কি করা উচিত তার?

আবেগ বেশ চিন্তিত। মোবাইলের ওয়াল পেপারে তার ছেলে-মেয়ের ছবি। আবেগের বুক কেপে উঠে। সে কি মারা যাবে? মারা গেলে ভালোই হবে। আচ্ছা মারা গেলেও কি সে শান্তি পাবে না? আবেগ কিছু ই চায় না। শুধু চায় এক ফোটা শান্তি আর এক চামচ পরিমাণ সুখ।

চলবে।