#প্রেমপ্রদীপ
part–39
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
আয়না না বলায় সমুদ্র আগুন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। সমুদ্র পারলে এই মূহুর্তে আয়নার চুল ধরে টানাটানি শুরু করবে না বলার দায়ে। কতো বড় সাহস! তাকে এভাবে জনসম্মুখে না বলে দিল! সমুদ্রের বুকের ভেতরটা হাহা করছে সে ড্রয়িং রুমের মাঝখানে সাজিয়ে রাখা টেবিলটায় সজোরে লাথি মারে। এতে দুইটা কাজ হলো৷
১)টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটা আয়নার পায়ে গিয়ে লাগলো। এবং সে ব্যথা পেল। গ্লাসটা কাচের ছিল না। স্টিলের ছিল জন্য বেচে গেছে সে। নাহলে রক্তারক্তি ঘটে যেতে পারত।
২) সমুদ্র ও পায়ে ব্যথা পেল। কাঠের টেবিলে জোড়ে লাথি মারায় নিজের পায়েও লাগলো তার।
রাগ জিনিস টাই এমন! উভয় পক্ষের জন্য ই ক্ষতি বয়ে আনে। এজন্য রাগ থেকে একশ হাত দূরে থাকা দরকার৷
সমুদ্রের নিজেরই খারাপ লাগলো যে সে আয়নাকে আঘাত করেছে। কেননা গ্লাসটা মেয়েটার পায়ে লাগার সঙ্গে সঙ্গে সে ইশ করে শব্দ করে উঠে চোখ বুজে নেয়। আমরা যখন কোন কারনে চোখ বুজে ফেলি, বুঝে নিতে হবে সেই মুহূর্তটা আমরা সহ্য করতে পারিনি। আর যখন অসহায় হয়ে পড়ি। তখন চোখ বুজে সব সহ্য করি।
সমুদ্র তো চায় না আয়না কষ্ট পাক! সে একটা দম ফেলে গটগট করে বাসার বাইরে বের হল। পেছনে থেকে রোদেলা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে, কোথায় যাচ্ছো?
সমুদ্র শুধু বললো, ছাদে।
রোদেলা আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না তাকে।
এবারে সকলের চোখ আয়নার দিকে। তালুকদার সাহেব বলে উঠে, ও তো তোমাকে ভালোবাসে তাহলে তুমি বিয়েতে রাজী না কেন?
আয়না রিনরিনে গলায় বলে উঠে, বিয়ে করতে রাজী না কখন বললাম?
আয়নার দাদা প্রশ্ন করে, মাত্রই তো বললি!
–উহু। আপনি প্রশ্ন করেছিলেন আজকে বিয়ে করতে রাজী কিনা? আমি আজকে এই মূহুর্তে বিয়ে করতে চাই না৷ আমার অনেক দিনের ইচ্ছা পরিবারের সবাইকে নিয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করার! তারপর বিয়ে করার। আমার এই সামান্য শখ কি পূর্ণ করা যাবে না দাদু? (করুন গলায় বললো আয়না)
তালুকদার সাহেব গলে গেলেন। তার এই নাতনী এতো মায়াবি কেন? তালুকদার সাহেবের কান্না পাচ্ছে।এতো কম শখ-আহ্লাদ তার নাতনীর! অথচ তাও পূর্ণ হয় না। এমন সোনা সমতুল্য মেয়ে কই পাবে? শুধু তাদের ঘরেই আছে এমন সোনা-মানিক৷
মেয়েটার আগের বিয়ে রাতারাতি হয়েছিল। বিয়ের কনেও বোধহয় সাজতে পারেনি সে। নাহ এবার সে নিজ হাতে তার নাতনী কে লাল টুকটুকে বউ সাজাবেন। মনের সব আহ্লাদ পূরণ করবেন নাতনীর৷ শুধু গায়ে হলুদ না সব ধরনের রিচুয়াল মোতাবেক আয়নার বিয়ে দিবে সে।
শ্রাবণ আয়নার কথা শুনে বলে, বাহ ভালো তো!
তালুকদার সাহেব বাদে সবাই তার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো।
শ্রাবণ বলে উঠে, আচ্ছা আপনারা সবাই এতো মনমরা কেন থাকেন? এতো কষ্ট-দুঃখ নিয়ে থাকেন কেমনে আপনারা? জীবনে আনন্দ বলে কি কিছু নাই? দেখেন আনন্দ জিনিস টা নিজেকে খুজে নিতে হবে। জন্ম থেকে দেখছি আপনারা মুখ টা বাংলার পাঁচের মতো বানিয়ে রাখেন? কেন ভাই?একটু হাসা যায় না?
আবেগ শ্রাবণের কথায় সায় দিয়ে বলে, শ্রাবণ একদম ঠিক বলেছে। ঝগড়াঝাটি, টানাটানি, মান-অভিমান, রাগ, ভুল বোঝাবুঝি এইসব নিয়েই জীবন টা পাড় হয়ে গেল।
আনন্দ জিনিস টা কি তাই বুঝলামনা। যেহুতু আয়না আর সমুদ্র একজন আরেকজন কে ভালবাসে, বিয়ে করতে চাইছে তাহলে ওদের বিয়ে অবশ্য ই হবে যেভাবে আয়না চায়।
আয়না লাজুক হাসলো।
শ্রাবণ হেসে দিলো এবং বললো, আজকে থেকে আমরা আনন্দ রাজ্যের বাসিন্দা। এখানে সবাইকে হাসিমুখে থাকতে হবে।
তখন তালুকদার সাহেব বলে উঠে, ঠিক বলেছো। যে মুখ ভার করে থাকবে তারই শাস্তি হবে।
আবেগ চোখ ভরে সবকিছু দেখছে। তার ছেলের বিয়ে! বিশ্বাস হতে চাইছে না তার।
রোদেলা আবেগের পাশ থেকে আস্তে করে বলে উঠে, তুমি অসুস্থ এর মধ্যে এইসব,,,,, প্রেসার ক্রিয়েট হবে তোমার জন্য।
আবেগ মুচকি হেসে বলে, আরে ধুর কি যে বলোনা! আর আমার কেমো দিতে আরো এক মাস লাগবে। নাও লাগতে পারে। বডি কনডিশন ভালোই আছে আমার।চিন্তা করবে না৷ আর শুনো রোদেলা!
অসুখের জীবাণু কে প্রাধান্য দিতে হয় না! এদেরকে অবহেলিত করে রাখবা।এতো পাত্তা দিতে যেও না। এরকম কিছু জীবাণু আমাদের বাস্তব জীবনেও আছে।সুতরাং বলা যায় যে, অসুখের জীবাণু এবং বাস্তবে কিছু মানুষ নামক কীটকে পায়ের স্যান্ডেলের নিচে ডেবে রাখবে। উভয়ই কিন্তু পায়ের নিচে চুপচাপ বসে থাকেনা। মাঝেমধ্যে মাথা নাড়া দিয়ে তোমার গায়ে দিয়ে বেয়ে বেয়ে মাথায় উঠতে চায়৷ এখন তুমি যদি এ-সব কীটকে প্রশ্রয় দেও তাহলে তো তারা মাথায় উঠে নাচা শুরু করবেই। এজন্য এদের প্রশ্রয় না দিয়ে পায়ের নিচে পিষে রাখবে তাহলে আর মাথায় উঠার দুঃসাহস পাবে না! নাচানাচি করা তো বহু দূরের কথা! বুঝলে?
রোদেলা মাথা নাড়ালো এবং মুচকি হাসলো।
★★★
আয়নাকে জোড় করে ছাদে পাঠানো হলো। আগামী শুক্রবার তাদের বিয়ে। মোটামুটি ধুমধাম করেই হবে। বুধবার গায়ে হলুদ আর বৃঃহস্পতিবার আইব্রু ভাত আর মেহেদী । বিয়ের পরের দিন সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া হবে। নিজেদের মধ্যে ছোটো খাটো রিসিভশন হবে সেখানে। আলিয়া , পিউ, শ্রাবণ নাকি নাচবেও হলুদে৷ এতো কিছু মোটেও সে আশা করেনি। সবকিছু কি স্বপ্ন?
কিন্তু জনাব তো রেগে গেছে মনে হচ্ছে!
আয়না সিড়ি বেয়ে উঠে দেখে, সমুদ্র রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুকছে।
আয়না শুকনা কাশি কাশলো। সমুদ্র আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে, তাকে দেখে নিয়ে পুনরায় সিগারেট মুখে দিবে তার আগেই আয়না ছো মেরে সিগারেট টা তার হাত থেকে টেনে নিল।
সমুদ্র বোকা বনে গেল। আয়না এমন কিছু করবে আশা করেনি সে।
আয়না বলে উঠে, সিগারেট খেতে বারং করেছিলাম না! তাও কেন খাও? খাওয়ার জন্য রিজন তো থাকা দরকার তাই না! এইসব ছাই পাচ খেয়ে কি পেট ভরে?
সমুদ্র বাকা হেসে বলে, মনের শান্তি পাই।
— খুব কষ্ট বুঝি মনে?
— অবশ্যই! যারে দিয়েছি মন সেই মন নিয়ে ফুটবল খেলে!
আয়না হেসে দিয়ে বলে, আর সেই ম্যাচের রেফারি স্বয়ং আপনি! সুতরাং সবকিছুই আপনার তত্তাবধানে চলছে।
আয়নার হাসিতে ঘায়েল হয় সমুদ্র। ঘায়েল করার ক্ষমতা এই মেয়ের মধ্যে আছে! বারেবারে, ক্ষনেক্ষনে, কারনে-অকারনেই আয়নাতে ঘায়েল হয় সে!
সমুদ্র আয়ুর দুই হাত ধরে ছাদের রেলিং বরাবর তাকে ঘুরিয়ে দিলো এবং নিজে তার কাছাকাছি অবস্থান করে দাতে দাত চেপে বলে, আমাকে বিয়ে করতে না করলে কেন?
আয়ু ঠোঁট চেপে হেসে বলে, কেন? কেন?
সমুদ্র আরো রেগে যায়। সে আয়নার হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরে প্রায় চেচিয়ে উঠে বলে, ওই ব্যাংকার কি আমার চেয়ে বেশি হ্যান্ডসাম ছিলো নাকি? হু? আমি এখন পর! অথচ কিছু হলেই সমুদ্র সমুদ্র করো। বাহ! আয়না বাহ! পল্টি মারলা!
আয়না ফিক করে হেসে দিল।
সমুদ্র বিরক্ত হলো। বহু আগে ঠিক এইভাবেই কারনে -অকারণে তার আয়ু হাসত। আজকেও বহু বছর পর এভাবে হুটহাট হাসছে সে। বাইরে বিরক্তি দেখালেও সমুদ্র ভেতরে ভেতরে অনেক খুশি।
আয়না বলে উঠে, মিস্টি খাবে?
সমুদ্র তিক্ত গলায় বলে, না। মিস্টি কেন খাব?
— মানুষ মিস্টি কখন খায়?
— জানা নেই৷
— কোন সুখবর পেলে মিস্টি খায় মানুষ।
সমুদ্র একধ্যানে আয়ুকে দেখছে। অবশ্যই মুগ্ধ দৃষ্টিতে। ইশ! মেয়েটাকে দেখলেই বুকে কি যেন ঘটে যায়!
সে আয়নার কোমড় চেপে ধরে নিজের আরো কাছাকাছি টেনে আনলো। এরপরে যা ঘটে সেটা সমুদ্র স্বপ্নের মধ্যেও কল্পনা করতে অক্ষম হবে। এতোটাই অবাককর ঘটনা ঘটে যায়। কি এমন ঘটান ঘটলো? তাহলোঃ
হুট করে আয়না সমুদ্রের শার্টের কলার চেপে ধরে এবং তার ঠোঁট আলতো করে সমুদ্রের গালে ছোয়ায়।
সমুদ্রের হাতের বাধন আয়নার কোমড়ে আরো শক্ত হয়ে যায়। সে থমথমে খেয়ে যায়৷
চলবে।
#প্রেমপ্রদীপ
part–40(বোনাস)
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
সমুদ্র সবসময়ই সুযোগ-সন্ধানি। সে সুযোগ পেতেই আয়নাকে আরো শক্ত করে ধরে তার কপালে গভীর ভাবে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে বলে, এই মিস্টিটা ভালো ছিলো।
আয়না লাজুক হাসলো। সে আকাশের দিকে তাকালো। রাতের আকাশে ভরা জোৎস্না। আজকে পূর্নিমা রাত। মুগ্ধতার সাথে চাদের জোৎস্না দেখতে ব্যস্ত সে!
চাদের ঝলমলে আলোয় আয়নার মুখখানা আরো উজ্জ্বল ও মায়াবি হয়ে উঠে। দুইজন দুইরকমের সৌন্দর্য দেখায় ব্যস্ত৷ সমুদ্র ব্যস্ত এক অতি ভয়ংকর রকমের মায়াবিনীকে দেখায় আর আয়না ব্যস্ত চাদের সৌন্দর্য দেখায়।
বসন্তের শুরু জন্য রাতের প্রহরে ফাগুনের হাওয়া বইছে। ফাগুন বাতাস গায়ে মাখতেই আয়না কেন যেন চোখ বন্ধ করে ফেলে৷ হয়তোবা এই মূহুর্তটা সে আরো নিবিড় ভাবে অনুভব করতে চাইছে।
সমুদ্র তার নিকটে দাঁড়িয়ে আছে। আয়নার ইচ এন্ড এভ্রি মুভমেন্ট সে অবজারভেশনে রাখছে। আয়নার এলোমেলো কেশের প্রতি বরাবরই দুর্বল সে। আজকে আরেকদফা এই রাত-বিরেতে তারার মাজারে সে আয়নার প্রেমে পড়ে গেল! এই প্রেমের গভীরতা একটু বেশিই এজন্য উঠতে পারবে না সে তা বোঝা হয়ে গেছে। বরং প্রেমের সাগরে আরো ডুবতে থাকবে। নিজেকে বড্ড ভাগ্যবান লাগছে সমুদ্রের। বারেবারে একজনের প্রেমে পড়ার মতো ভাগ্যের বিষয় আর কি হতে পারে?
চোখ বন্ধ রেখেই আয়না সমুদ্রের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কেদে দেয়। সমুদ্র প্রথমে ভড়কে গেল। মেয়েটা এতোটা ভ্যাসকান্দুরী কেন? তবে আজকের কান্নার মাঝে কি যেন একটা আছে। সমুদ্রের ও চোখ ভিজে উঠতে লাগে। সে আয়নাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলে, আয়ু কিছু হয়েছে কি? মামী বকা দিয়েছে?
আয়না সমুদ্রকে অনুভব করছে। সমুদ্রের হৃদপিন্ড ওঠা-নামার শব্দ সে দিব্যি শুনতে পাচ্ছে।তার কেমন যেন অস্থির লাগছে। চোখের জল বাধ মানছে না।
সমুদ্র আয়নার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, এভাবে কান্না করলে আমার শার্ট ভিজে যাবে তো। নিচে গেলে বাসার সবাই কি ভাব্বে? হু?কাদছো কেন বউ?
আয়না বলে উঠে, তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো তাই না?
— এখনো সন্দেহ হয় এই বিষয়ে? Of course i do love you.
আয়না সমুদ্রের শার্ট খামচে ধরে বলে, ফাহাদ মারা যাওয়ার পর আমি ওদের বাসায় থাকতাম।
সমুদ্র জানে আয়নার স্বামীর নাম ফাহাদ ছিলো। তাই সে ওই ম্যাটারে কথা বলতে বা শুনতে চায় না জন্য আয়নাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, বাদ দাও না। এই মূহুর্তে এইসব শুনতে চাই না। আজকের এই ফাগুনি রাত শুধু তোমার-আমার। তৃতীয়পক্ষের অগ্রাধিকার নেই।
আয়না সমুদ্রের বুকে আরো চেপে এসে বলে, দাদু তোমার আর আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আগামী শুক্রবার বিয়ে।
সমুদ্র জোড়ে করে হাক পেড়ে বলে, আলহামদুলিল্লাহ।
–কিছু সত্য বলতে চাই তোমাকে।
— বলো!
— আগে বলো আমাকে ভুল বুঝবে না।
— না। ভুল কেন বুঝব?
— রাগ করবে না তো?
— তোমার উপর কখনো রাগ করেছি?
আয়না সমুদ্রের বুকে মাথা রেখেই চোখ বন্ধ করে ফেলে। তার বুকের ধুকপুক আওয়াজে আয়নার বাধ্য মনের সমুদ্রে অবাধ্য ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছে।
সে বলে, ফাহাদের মৃত্যুর পরও আমি কয়েক মাস ফাহাদের বাসায় ছিলাম। ওইখানে ওর ছোট ভাই আমাকে খারাপ নজরে দেখত। খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আশেপাশে ঘুরত৷ আমি বুঝতে পারিনি প্রথম প্রথম। এরপরে ফাহাদের মৃত্যুর কয়েকমাসের মাথায় ওর ভাই আমাকে কুপ্রস্তাব দেয়। আমি থ হয়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে আমার শ্বাশুড়িকে জানালে সে বলে, ওনার ছোট ছেলের সঙ্গে নাকি আমার বিয়ে দিবেন উনি। তাই ছেলে ভুল কিছু বলেনি। বিয়ের আগে একটু একা সময় চাইতেই পারে।
আয়না আরো বলতে লাগে,
স্বামী মারা গেলে নাকি ভাবীর দায়িত্ব দেবর নেয়। অথচ আমি শিক্ষিত একজন মেয়ে। এমন কিছু শোনার আশা আমি রাখিনি। ওদের সঙ্গে অনেক তর্ক হয়। এক সময় আমি বাসা থেকে বের হয়ে ঢাকা চলে আসতে চাইলে বাধা দেয় ওরা আমাকে। এরপর গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছিল। আমার জ্ঞান যতোক্ষণ ছিলো আমার সঙ্গে অসৎ কিছু করতে পারেনি ফাহাদের ভাই। কিন্তু সেদিন আমার গায়ে অনেক জ্বর ছিল। গায়ে আঘাত করার পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। এরপর জ্ঞান ফেরার পর হাসপাতালে নিজেকে আবিষ্কার করি। তখন বাবাও ছিল। এরমধ্যে যদি আমার সঙ্গে খারাপ কিছু হয়ে থাকে সে সম্পর্কে আমি অবগত না।
শেষের কথাগুলো শোনার সময় আয়না কান্না করছিল। আয়না বিলাপ ছেড়ে বলে, ওরা আমাকে মানুষ ই ভাবত না। কাজের মেয়ের মতো রেখেছিল। বিয়ের পর খুব আদিখ্যেত করত কিন্তু ফাহাদ মারা যাওয়ার পর খুব বাজে ব্যবহার করত। এমন কি আমার শ্বাশুড়ি এটাও বলত, তার ছেলেকে নাকি আমি খেয়েছি। অলক্ষী আমি! পোড়াকপালি জন্য তার ছেলে আমাকে বিয়ে করে মারা গেছে৷ অথচ সেই আমাকে তার ছোট ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইত।
এতোক্ষনে মুখ খুলে সমুদ্র। সে প্রশ্ন করে, কেন?
আয়না বলে উঠে, পৃথিবীটাতে ভালো মানুষ যেমন আছে খারাপ মানুষ ও তেমনিই আছে। ওরা কেমন ছিলো জানি না। কিন্তু খুব স্বার্থ খুজত। ফাহাদের অফিস থেকে বীমা করা ছিলো। যার জন্য ওর মৃত্যুর পর মোটা অংকের টাকা আমাকে দেওয়া হত ওর অফিস থেকে। এটা জানার পর ওর ভাই আমাকে বিয়ে করতে চাইছিলো।
সমুদ্র আয়নাকে আকড়ে ধরে বলে, তোমার অতীত সম্পর্কে কখনোই কিছু জানতে চাইনি। আমি তোমাকে ভালোবাসি এটা বর্তমান কাল এবং আগামীতেও ভালোবাসব এটাও ভবিষ্যত কাল। এরমধ্যে কোথাও অতীত কাল দেখতে পাচ্ছো কি?
— নাহ।
— সুতরাং আমার মাথা ব্যথা তোমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে। এখানে অতীতের কোন জায়গা নেই।
আয়না জানত তার সমুদ্র এমন কিছু ই উত্তরে বলবে। তারপরও সে জানিয়ে রাখলো। সে সমুদ্রের কাছ থেকে কিছুই লুকাতে চায় না।
সমুদ্র বললো, এবার কান্না থামাও। নাহলে কান্না করার জন্য শাস্তি পাবে?
আয়না স্মিত হেসে দিলো। সমুদ্র বললো, আমাকে ভালোবাসো তো?
আয়না জোড়ে জোড়ে মাথা ঝাকিয়ে বলে উঠে, হ্যা। আমি তোমার সঙ্গে আমার বাকি জীবন কাটাতে চাই।
— ব্যস! বাকি সব বাদ। সব ভুলে যাও।
এমন সময় কল আসলো সমুদ্রের ফোনে।আলিয়া কল করেছে। সমুদ্র ফোন ধরলে,
আলিয়া বলে উঠে, দুলাভাই নিচে আসেন। আমরা সবাই আপনার অপেক্ষায় আছি। একসাথে খাব৷ তাড়াতাড়ি আসেন।
সমুদ্র বলল, আসতেছি শালিকা।
আয়নাকে নিয়ে নিচে নেমে বাসায় ঢুকতেই নাকে বিরিয়ানির গন্ধ আসলো। বাসায় কি বিরিয়ানি রান্না হয়েছে? বিরিয়ানি হচ্ছে সমুদ্রের প্রিয়তম খাবার৷ বিরিয়ানির গন্ধ নাকে আসতেই ক্ষুধা লেগে যায় সমুদ্রের।
সে ডাইনিং রুমে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। আয়না চুপচাপ পিউ আর আলিয়ার কাছে গিয়ে বসল।
সমুদ্র বসতেই পিউ বলে উঠে, বড়রা সবাই খেয়ে নিয়েছে।
সমুদ্র বলে,, ভালো।
তখনি রোদেলা হাতে খাবার নিয়ে রান্নাঘর থেকে আসল। বিরিয়ানির চেহারা দেখেই সমুদ্র বুঝে যায় এটা মায়ের রান্না। মায়ের হাতের বিরিয়ানির চেহারা এমন হয়। আগে মাঝে মাঝেই মা তার জন্য বিরিয়ানি বানাত। স্কুলের টিফিনে তার আর আয়নার জন্য বিরিয়ানি করে দিত।
রোদেলা প্রথমেই সমুদ্রের পাতে খাবার বেড়ে দিলো। সমুদ্র একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে আর দ্বিতীয়বার তাকায় না। খাওয়ায় মনোযোগ দেয়৷
শ্রাবণ বলে উঠে, আমরা তো ডান্স করব। পিউ একাই একটা সোলো ডান্স দিবে৷ আমি চাচ্ছি সবাই মিলে একটা গ্রুপ ডান্স দেই।
— নাচানাচি কিসের জন্য?(সমুদ্র)
শ্রাবণ হেসে দিলো এবং বলল, আপনার হলুদের প্রিপারেশন চলছে মিয়া আর আপনি কিছুই জানেন না! খালি প্রেম করলে হবে?
কথাটা কানে যেতেই আয়না খাওয়া থামিয়ে দেয়। তার বেশ লজ্জা লাগছে।
সমুদ্র ঝাড়ি মেরে বলে, ছোট ছোটর মতো থাকবি।
শ্রাবণ পিউ দুইজন হেসে দিলো।
শ্রাবণ বলল, এখানে একমাত্র একজন ই বিপক্ষ দল।
সমুদ্রঃ যতোদূর জানি আমার বিয়ের কথা চলছে। এখানে তুই পলিটিকস কেন আনছিস?
শ্রাবণ বলল, দেখো আমি আর পিউমনি দুইজন ছেলেপক্ষ। এরপর আলিয়াকে ইন্ডিকেট করে বলে, শুধু একটা কনে পক্ষ।
আলিয়া ভেংচি কেটে বলে, গেট ধরা টাকা সব আমার।
সমুদ্র বললো, এইজন্য এখন আমি দুলাভাই।
আলিয়া বলল, গেট ধরার বাজেট কিন্তু দশ হাজার।
সমুদ্র বলে, গেট ধরতেই হবে? না ধরলে চলে না?
আলিয়া উত্তেজিত হয়ে গেল এবং বলল, নাহ চলে না। শুধু তাই না! হাত ধোয়ার টাকাও নিব আমি।
শ্রাবণ আলিয়ার সঙ্গে তর্ক করার জন্য বলে, বুঝলা সমুদ্র ভাই! তোমার কপাল ভাঙ্গছে। দিন-দুপুরে ডাকাতি করবে তোমাকে তোমার শালিকা। দেখা যাবে বিয়ের পরে শ্বশুড়বাড়ি গেছো তোমাকে বাথরুমে আটকে দিয়ে টাকা চাইবে। হাহ। এমন শালিকা থেকে একশ হাত দূরে থাকব আমি।
সমুদ্র বলে, তাহলে তো তোর এমন মেয়ে দেখে বিয়ে করতে হবে যার কোন ছোট বোন নাই। হয় তোর বউকে একমাত্র মেয়ে হওয়া লাগবে তাহলে সে নিজেই ছোট মেয়ে বাড়ির। এছাড়া শালিকা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় নেই।
শ্রাবণ বলে, বাড়ির একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করব৷
একথা শুনে আলিয়ে রেগে যায়। তার খেতেই মন চাচ্ছে না। অনেক কষ্টে বাকিটা শেষ করে সে।
খাওয়ার পর পিউয়ের রুমে আসর পাতানো হলো।আজকে এই বাসায়ই সবাই থাকবে। রাত ভালোই হয়েছে। তাদের বাসায় এক্সটা রুম আছে গেস্টদের জন্য। ছাদে চিলেকোঠার মতো আছে সেখানে সমুদ্র আর শ্রাবণ থাকবে তাইলে হবে।
গ্রুপ ডান্সে কোন গানে নাচা যায় এটা ঠিক করার জন্য ইউ টিউব ছাড়া হলো। লিস্টে যেই গান সবার আগে আসলো শ্রাবণ সাউন্ড বক্সে সেই গান প্লে করলো।
বেশ ভালোই শব্দ করে গান বাজতে লাগে,
বুক চিনচিন করছে হায়
মন তোমায় কাছে চায়!
তুমি ছুয়ে দিলে হায়
আমার কি যে হয়ে যায়!
পিউ তড়িৎ বেগে কেপে উঠে। এই গান তো ওই ছেলেটা গায়! হুট করে রঙ্গনের কথা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। সে চুপসে গেল। মন ও মস্তিষ্কের মধ্যে রঙ্গন ঘুরছে। চারিদিকে আর হুশ নেই তার।
★★★
পরের দিন সকালে সবাই একসাথে নাস্তা করল। এরপরে পিউ,শ্রাবণ আলিয়া ডান্স প্রাকটিসে মন দিলো। আয়না তাদের সঙ্গে বসে আছে। সমুদ্র হাসপাতালে গেছে।
আবেগ আজকেও অফিস যায়নি। মেঘ আর সে বসে ছিল। তখনি রোদেলা চা নিয়ে এলো।
চা মুখে দিয়ে মেঘ বলে, কালকে সমুদ্র আয়নাকে নিজের বউ বলে দাবি করছিলো,,,,
রোদেল ভাইয়ের পাশে বসে চা খেতে খেতে বলে, ও রেগে গেলে উল্টাপাল্টা কথা বলে। তোর মেয়েকে পছন্দ করে। অন্য জায়গায় বিয়ে হবে এটা শুনে রেগে গিয়ে বলে দিয়েছিল।
মেঘ ভেবে দেখল এমন ও হতে পারে৷ কিন্তু আয়নার অতীত টা জানানো দরকার সমুদ্রের বাবা-মাকে৷
সে গলা খাকিয়ে বলে, আয়নার একটা অতীত আছে। তোমরা কি আমার মেয়েকে নিজের বাড়ির বউ করতে রাজী?
রোদেলা বলল, আয়না আমার মেয়ের মতো। পিউ যেমন আয়নাও তেমনি। আমি ওকে কোন দিন বউ হিসেবে দেখব না। নিজের মেয়ে হিসেবে আগলে রাখব।
আবেগ ও সায় দিয়ে বলে, আমরা বাড়ির বউ আনছিনা বরং বাড়ির জন্য মেয়ে আনছি।
মেঘ এমন কথায় শান্তি পায়। তবুও সত্যটা জানাতে হবে। সে বলা শুরু করে, আয়না তো বিধবা। এর আগেও তার বিয়ে হয়েছিল। হ্যাসবেন্ড মারা গিয়েছে। এখানে তো ওর কোন দোষ নেই। আয়নার সত্যটা জানার পর প্লিজ অমত পোষন করোনা। মেয়েটা আমার জীবনে সুখ পায়নি বললেই চলে।
রোদেলা হতভম্ব হয়ে যায়। নিজের ভাস্তির বিয়ের কথা সে জানত না। এতোটাই পর সে ভাইয়ের কাছে!
আষ্মিকতার চোখে সে ভাইয়ের দিকে তাকালো। মেঘ অপরাধীর ন্যায় মুখ টা নিচু করে ফেলে।
আবেগ বলে, সমুদ্র নিজেই রাজী সেখানে আমরা না করার কে? আজ-কালের যুগে দেখি ছেলে-মেয়েরা রিলেশন করছে তারপর সেই সম্পর্ক ভেঙে গেলে অন্য কাউকে বিয়ে করছে। এরকম কোন সম্পর্কের চেয়ে আয়নার বিবাহিত সম্পর্কই উত্তম ছিল। ব্যক্তিগত ভাবে আমার কোন সমস্যা নাই।
তখনি বেল বেজে উঠল। রোদেলা গিয়ে গেট খুলে দেখে মাঝ বয়সে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটাকে আগে কোন দিন দেখেনি।
রোদেলাকে দেখে নম্রভাবে সালাম দিয়ে বলে, ডাক্তার ইশরাক রহমান আছে?
রোদেলা বলল, ভেতরে আসো৷
রঙ্গন ভেতরে আসলো। সে রোদেলাকে এক দেখায় চিনে গেছে।
বাকা হেসে বাসার ভেতরে ঢুকে আবেগকে সালাম দিয়ে বলে, আংকেল আপনার ক্রেডিট কার্ড পিউ ফেলে দিয়ে এসেছিল। সেটাই দিতে এসেছি। এই নেন।
বলে আবেগকে তার ক্রেডিট কার্ড দিল। আবেগ নিজের নামের ক্রেডিট কার্ড পিউকে দিয়েছিল। বাংলাদেশে এসেছে মেয়ে। যদি কোন প্রয়োজন পড়ে।
আবেগ বলে, তোমাকে তো চিনলাম না৷
রঙ্গন বসে পড়ে এবং বলল, আমাকে চিনবেন না। আমি পিউকে চিনি।
— ওহ আচ্ছা।
রঙ্গন একবার রোদেলার দিকে তাকালো এবং পরবর্তী তে আবেগের দিকে তাকিয়ে বলে, আংকেল আমি পুলিশ।
— ওহ আচ্ছা।
— একটা কথা বলার ছিলো যদি সময় দেন।
আবেগ রোদেলাকে বলল, ছেলেটাকে মিস্টি দাও। ও তো মেহমান।
তারপর রঙ্গনকে উদ্দেশ্য করে বলে, আমার ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে। এজন্য আমরা ব্যস্ত। বল কি বলবে?
রঙ্গনের নজর সম্পূর্ণ রোদেলার দিকে ছিলো। রোদেলা নাস্তা আনার জন্য এ রুম ছাড়লেই সে সুযোগ বুঝে আবেগকে বলল, আংকেল আমি পিউকে খুব পছন্দ করি। ওকে বিয়ে করতে চাই।
আবেগ রঙ্গনের একথা শুনে অতিমাত্রায় অবাক হলো। পাশে থাকা মেঘ ও অবাক৷
রঙ্গন বলল, আমি চাইলেই পিউয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি৷ কিন্তু আমি ওর সাথে হালাল ভাবে প্রেম করতে চাই। এজন্য পিউকে বিয়ে করতে চাই৷ আপনার মতামত কি?
আবেগ বলে উঠে, আগামী সপ্তাহে আমার ছেলের বিয়ে। তুমি নেক্সট ফ্রাই ডে আমাদের বাসায় এসো। এ বিষয়ে কথা বলব। কিন্তু সত্যি তোমার চিন্তাভাবনা দেখে আমি মুগ্ধ।
রঙ্গন হেসে বলে, একটু ওয়াশরুমে যাব?
— সামনে গিয়ে হাতের ডান দিকে।
— ধন্যবাদ।
সে হাটা ধরলো। বাথরুম না খুজে পিউকে খুজতে লাগলো। তার বাথরুমের চাপ পায় নি পেয়েছে পিউয়ের চাপ!
পিউ নাচের স্টেপ তুলছিল। রুমে একা সে। হুট করে অনুভব করল কেউ একজন তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে পেছনে ঘুরতে গিয়ে কারপেটের সঙ্গে পা বেজে পড়ে যেতে ধরলে রঙ্গন তার কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে আটকে ফেলে। পিউ রঙ্গনকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে।
রঙ্গন পিউয়ের দিকে ঝুকে এসে বলে,
আই লাভ ইউ।
চলবে।