#প্রেমপ্রদীপ
Part–45
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
রোদেলা আর আবেগ ধীর পায়ে স্টেজের দিকে আগালো। সমুদ্র তাদের কে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে গেল সঙ্গে আয়নাও।
আবেগ তাদের কাছে গিয়ে বলে, বসো। বসো। তোমরা।
রোদেলা আবেগের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে খুব মনোযোগ দিয়ে ছেলেকে দেখছে। তার ছেলে আজকে খুব খুশি।
আনন্দ, খুশি আর টাকা আর পেটের বাচ্চা কখনোই কারো কাছ থেকে লুকানো যায় না। কষ্ট আর আর্তনাদ কুয়াচাপা দিয়ে আড়াল করা যায়!
সমুদ্রের প্রফুল্লতাও প্রকাশ পাচ্ছে। তার মুখ থেকে হাসি ভাব সরছেই না।
আবেগ গিয়ে ছেলেকে আর ছেলের বউকে হলুদ মাখিয়ে দুইজনকেই কালো চমচম মিস্টি খাইয়ে দিল। এবারে রোদেলার পালা। সে হলুদ মাখাতে গিয়ে দেখল।,সমুদ্রের মুখে কোন হলুদ নেই। হলুদ মাখিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলছে। আজ-কালের যুগে ছেলে-মেয়েরা এমনই করে। কিন্তু তার যখন হলুদ হয়। সেও শাড়ি পড়েছিল। এই ছাদেই ঘরোয়া করে মা-চাচীরা তাকে মুখ ভর্তি করে হলুদ মাখিয়ে দিয়ে প্রায় এক ঘন্টা তুলতে দেননি। মুখে হলুদ লাগিয়ে রাখা খুব বিরক্তিকর হলেও সেদিন হাসিমুখেই হলুদ লাগিয়ে বসে ছিল সে।
রোদেলা সমুদ্র আর আয়নার গালে হালকা করে হলুদ মাখিয়ে দেয়। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে।
রোদেলা খাবার টেবিলটা থেকে কোপ্তা তুলে সমুদ্র কে খেতে দিল ।
সমুদ্র খুব তৃপ্তি করে কোপ্তা খেয়ে নিল। সবাই খালি মিস্টি খাওয়াচ্ছে৷ মিস্টি খেতে খেতে তার গলা মিস্টি হয়ে গেছে। ঝাল কিছু খেতে পারায় তার শান্তি লাগতে শুরু করে। একমাত্র মা-ই বুঝতে পারল তার এই মুহূর্তে মিস্টি খেতে ইচ্ছা করছে না। কিভাবে বুঝলো? চেহারা দেখে? তার চেহারায় কি লেখা ছিল, আমি এই মূহুর্তে মিস্টি খেতে চাই না। দয়া করে কেউ একটা কোপ্তা খাওয়াও! এই অদৃশ্য লেখাটা কি সামহাউ আম্মু পড়ে ফেলেছিলেন?
ইদানীং আর মাকে দেখলে রাগ লাগছে না সমুদ্রের। সকালে উঠে খাওয়ার টেবিলে মাকে তদারকি করতে দেখতে দেখতে সে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। মানুষ অভ্যাসের দাস! সমুদ্র ও তার ব্যতিক্রম নয়।
তাই তো অফিস থেকে এসেই মায়ের বানানো ট্যাংক বা লেবুর শরবত খাওয়াতেও সে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।এখন অফিস থেকে এসে পানি খেতে ভালো লাগে না।
একে একে সবাই হলুদ মাখালো। হলুদ পর্ব শেষ হতেই নাচার জন্য পিউরা প্রস্তুতি নেয়। স্টেজের সামনে নাচানাচি হবে।
পিউ চোখ ঘুরাতে লাগে। শ্রাবণ ভাইকে খুজছে সে। কোথায় ভাইয়া? এখনি তাদের দুইজনে কাপল ডান্স অথচ মিস্টার শ্রাবণ গায়েব।
নাচের জন্য সাউন্ড বক্স ঠিক করা হলো। এনাউন্সমেন্ট ও করে দিয়েছে। পিউ মুখ কালো করে শ্রাবণ কে বকতে বকতে স্টেজের সামনে যেতে ধরলে পেছনে থেকে কেউ বলে উঠে, তোমার ভাই কই?
পিউ ফিরে তাকিয়ে দেখে রঙ্গন। তাকে দেখতেই পিউয়ের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। মনের মধ্যে কিসব যেন নাচা-নাচি শুরু করল।
সে আমতাআমতা করে বলে, ওকে তো খুজে পাচ্ছি না৷
— হায়! হায়! বলো কি!
তখনি গানের সুর শুরু হলো। পিউ চোখ ঘুরিয়ে শ্রাবণ কে খুজতে লাগলো ।
রঙ্গন বলে, Can i dance with You?
পিউ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। পিউ আর রঙ্গন যখন স্টেজের সামলে গেল তখন ওলরেডি গান শুরু হয়ে গেছে৷
স্টেজে উঠতেই সাউন্ড বক্স থেকে অনেক জোড়ে আওয়াজে বেজে উঠল,
বুক চিনচিন করছে হায়
মন তোমায় কাছে চায়।
গানটা শুনেই রঙ্গন হেসে ফেলে। তাকে হাসতে দেখে পিউ ও হেসে দেয়। এরপর দুইজন মিলে ভুলভাল নাচলো। রঙ্গনের স্টেপ জানা নেই আর পিউ রঙ্গনকে দেখে সব ভুল গেছে। সব মানে সব! নিশ্বাস নিতেও বুঝি ভুলতে বসল সে।
জোরে জোরে আওয়াজে গান বাজছে,
তুমি ছুয়ে দিলে হায়
আমার কি যে হয়ে যায়!
সত্যি সত্যি রঙ্গন নাচতে গিয়ে যখন তাকে ছুয়ে দিল, পিউয়েরও কি যে হয়ে গেল! চোখে পানি চলে আসল তার! সে অদ্ভুত নয়নের মাধ্যমে রঙ্গনকে সিটি স্ক্যান করে নিতে লাগে। ছেলেটা এত্তো সুদর্শন কেন ?
গান শেষ হতেই রঙ্গন চলে যায়। পিউ থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনের অবস্থার বেহাল দশা। সে কি এই ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেছে?
এরপর সমুদ্র আর আয়না গেল স্টেজের সামনে। তারা যেতেই সবাই চিৎকার করতে লাগলো। বর-বউকে ঘিরেই যেহুতু এতোকিছু তাই নজরটাও তাদের উপরেই যেন একটু বেশি৷
জন্ম, বিয়ের দিন আর মৃত্যুর দিনই মানুষ মানুষের কাছে পাত্তা পায়!
সাউন্ড বক্স থেকে গান বাজতে লাগে,
সমুদ্র আয়নার হাতে হাত রেখে সামান্য দুলতে লাগে গানের তালে তালে। দুইজনের চোখ দুইজনাতে আটকা পড়েছে। আয়না মুগ্ধ হয়ে সমুদ্র কে দেখছে। সমুদ্র মুচকি হাসছে। গান বেজেই চলছে।
আমার প্রান ধরিয়া মারো টান, মনটা করে আনচান।
জোয়ার নদীর উতল বুকে প্রেমের নৌকা উজান বায়।
এটুকু অব্দি হাতে হাত রেখে হালকা নাচছিল দুইজন৷ এবারে সমুদ্র তার এক হাত দিয়ে আয়ুর কোমড় জড়িয়ে ধরে এবং অপর হাত দিয়ে আয়ুর হাত ধরে। আয়না কেপে উঠে শুকনো ঢোক গিলে।তার অনেক বেশি লজ্জা লাগছে। সবাই তাদেরকে দেখছে তো! ইশ কি লজ্জা!
সমুদ্র অপলক নয়নে তার ছোট বেলার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে আছে। সে মনে মনে ওয়াদা করে, এই মেয়েকে কোনদিন বিন্দুমাত্র কাদাবে না। এক চুল পরিমাণ ও কষ্ট দিবে না সে।
গান তখনো বেজেই চলেছে।
বারে বারে বন্ধু তোমায় দেখিতে মন চায়।
আমার প্রান ধরিয়া মারো টান মনটা করে আনচান।(২)
জোয়ার নদীর উতল বুকে প্রেমের নৌকা উজান বায়।(২)
বারে বারে বন্ধু তোমায় দেখিতে মন চায়।
হো, আমি তোমার ইচ্ছে ঘুড়ি
যেমন উড়াও তেমন উড়ি,
স্বপ্নগুলো মুঠোয় নিয়ে
কেমন লুকোচুরি।
সমুদ্র আয়নার ডান্স পারফামেন্স শেষ হতেই করতালি হতে লাগলো আয়ু লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। সমুদ্র তাকে নিয়ে স্টেযে গিয়ে বসলো।
এবার শ্রাবণের পালা। পিউ খুজে খুজে শ্রাবণ কে ডেকে এনেছে৷ সে এক কোণায় গিয়ে দেবদাসের মতো বসে ছিল এতোক্ষন৷
পিউ প্রশ্ন করে, কি হয়েছে তোমার ভাইয়ায়া??
শ্রাবণ মুখ গোমড়া করে বলে, বুকটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে রে আমার। আমি নাচব না!
তখনি আয়েশা এসে বলে, সেকি কেন?।
আয়েশাকে দেখে শ্রাবণ রক্ত পানি হয়ে যেতে লাগলো। বাবা এসেছে কিছুক্ষন আগে। ফুপু বাবার সঙ্গে তাকে নিয়ে কিসব অভিযোগ দিচ্ছিল। এ নিয়ে ওলরেডি তার আর বাবার মধ্যে দ্বন্দ লেগে গেছে। শ্রাবণ নাকি বেয়াদব। মেয়েদেরকে সম্মান করতে জানে না। এইসব রাবিশ কথা ফুপুই বাবাকে বলেছে। নিশ্চয়ই আয়েশাই কিছু বলেছে ফুপুকে৷ সবমিলিয়ে শ্রাবণ হাপিয়ে গেছে৷
পিউ বলে, ভাইয়া। এমন করো না প্লিজ। আমরা সবাই কষ্ট পাব।
শ্রাবণ সমুদ্রের দিকে তাকালো। সমুদ্র জোরে করে বলে, কি রে নাচিস না কেন তুই?
ডান্স করার ফালতু আইডিয়া শ্রাবণের ছিল। কেউ প্রথেমে রাজী হচ্ছিলো না। সে সেধে সেধে রাজী করিয়েছে সবাইকে। এখন যদি নিজে না নাচে তাইলে তো হীতে বিপরীত হবে! সবাইকে মিলে ক্যালানি দিবে তাকে। স্পেশাকি সমুদ্র ভাই! ইচ্ছা মতো ঝাড়ি মারবে। নাচানাচি করবে জন্য এক্সট্রা পাচ হাজার দিয়ে এইসব এরেঞ্জ করেছে ভাইয়া।
তাই সে বাধ্য হয়ে আয়েশার সঙ্গে স্টেজের সামনে গেল। তখনই তার চোখ আলিয়ার দিকে পড়ে। মেয়েটা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি কুটকুট করে চাবিয়ে খাবে তাকে৷
শ্রাবণ আয়েশার সঙ্গে নাচা শুরু করে দিল। কাছাকাছি এসে সেই বিখ্যাত স্টেপ দেওয়ার সময় সে ঘাড় বাকিয়ে আলিয়ার দিকে তাকালো । সঙ্গে সঙ্গে শ্রাবণের কি যেন হতে লাগলো। হাসফাস করতে লাগলো সে। সেকি! আলিয়ার চোখে জল! অদ্ভুত তো! মহা আশ্চর্যজনক দৃশ্য৷
শ্রাবণ বিড়বিড় করে বলে, হিসাব তো বনে না!
শ্রাবণ সঙ্গে সঙ্গে স্টেজ থেকে নেমে যায়। আয়েশা পুনরায় হতভম্ব হয়ে গেল। সে কোন দিন ই এই ছেলের হাব-ভাব বুঝে উঠতে পারে না। যেহুতু শেষের দিকে ছিল তাই কেউ বুঝে নি যে শ্রাবণ মাঝপথে চলে এসেছে। সবাই এবারো তালি দিলো। গানটা পপুলার হওয়ায় সবাই গানটা বেশ ইনজয় করেছে।
শ্রাবণ আসতেই পিউ বলল, ভাইয়া তোমার কি খারাপ লাগছে?
— নাহ।
এরপর সে সাউন্ড বক্সের সামনে গিয়ে কি যেন করা শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যে সাউন্ড বক্স থেকে অভিমান গানের সুর বাজতে শুরু করে।
পিউ ভ্রু কুচকে ফেলে। এই গানে আলিয়া নাচতে চেয়েছিল। এটা নাকি ওর প্রিয় গান। পরে কি যেন হলো! ও আর নাচেনি। কিন্তু ভাইয়া এই গান কেন বাজালো? কে নাচবে এই গানে?
শ্রাবণ কোন কিছুর পরোয়া না করে আলিয়ার কাছে গিয়ে তার হাত ধরে টেনে স্টেজের কাছে নিয়ে গেল। আলিয়া যেতে চাচ্ছিল না কিন্তু শ্রাবণের জোড়াজুড়ি তে কিছু করার মতো শক্তি তার লোপ পেয়ে গিয়েছে৷
স্টেজের সামনে এসে দাড়ালো তারা৷ আলিয়া কটমট করে বলে, এইসব কোন ধরনের অসভ্যতামি? এভাবে টেনে আনার মানে কি?
— এখানে অসভ্যতার কি দেখলে? আমরা সবাই নাচা-নাচির করছি। ইনজয় করছি। তুমি কেন বাদ পড়বে। আসো লেটস ডান্স৷
— আমি কোন দিন তোমার সঙ্গে নাচব না!
— তাই? তাহলে আমাকে অন্য কারো সঙ্গে দেখে কান্না করলে কেন? (ভ্রু নাচিয়ে)
আলিয়া চমকে উঠে।
শ্রাবণ বাকা হেসে বলে, ইউ স্টিল লাভ মি না?
তখনিই গান বেজে উঠল,
তুমি বোঝনি, আমি বলি নি
তুমি স্বপ্নতে কেন আসোনি?
শ্রাবণ আলিয়ার নিকটে এসে বলে, আলিয়া! I really love you. বিশ্বাস করো। আমি কখনোই এমন কিছু করিনি। তোমার ক্ষতি করা মানে নিজের ক্ষতি করা! এতো নীচ না আমি। তুমি আমাকে ভুল বুঝেছো।
আলিয়া কাঠ গলায় বলে, তাহলে আমাকে থ্রেট কেন দিয়েছিলে? হুমকি কেন দিয়েছিলে? আমাকে ভাইরাল করার ভয় দেখাও নি?
— বিশ্বাস করো ওইটা আমি ছিলাম না। আমার আইডি হ্যাক হয়ে গিয়েছিল!
— আচ্ছা! আর কত কাহিনি বানাবে তুমি ? মিথ্যা বলতে ভয় লাগে না?
শ্রাবণ হুট করে আলিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে, আমি সত্য কথাই বলছি। এজন্য ভয় করেনা।
এমন সময় গান বাজতে লাগলো,
আমি পারিনি তোমাকে আপন করে রাখতে
আমি পারিনি তোমাকে আবার আমার করে রাখতে!
আলিয়ার চোখ ফেটে জল বের হলো। সে শ্রাবণের সঙ্গে এক প্রকার যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য। শ্রাবণ ও কম না৷
সে বলেই যাচ্ছে, যখন তুমি বলেছিলে এ-সব কাজ তুমি করবে না বিয়ের আগে আমি কিন্তু ভুলেও তোমাকে আর কিছু বলিনি। মাথা থেকে এমন কুচিন্তা ঝেড়ে ফেলেছিলাম। শয়তানের প্ররোচনায় আমি দিশেহারা হয়ে একটা খারাপ চিন্তা করে বসেছিলাম৷ এমন চিন্তা এই সমাজে অনেক ছেলেরাই করে৷ কিন্তু তুমি মানা করার সঙ্গে সঙ্গে আমি সেই পথ থেকে সরে এসে অনুতপ্ত হয়েছি আলিয়া,,,,,,,,,,,
এরমধ্যেই আলিয়া তার হাত ছেড়ে নিয়ে শ্রাবণ থেকে দূরে চলে এলো। শ্রাবণ কে কথা শেষ করতেই দিলো না সে। শুনার ইচ্ছা নেই তার।
খাওয়া-দাওয়ার পার্ট চুকিয়ে রঙ্গন বিদায় নিল। পিউ নিজ থেকে তাকে বিদায় জানায়।
চলবে।
#প্রেমপ্রদীপ
part–46 (বোনাস)
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
তখনো সূর্যের রোদ কড়া হয়নি! নরম আর মিস্টি থাকতে থাকতেই আয়না গোসল সেরে রেডি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু আলিয়ার দেখা নেই। কালকে হলুদের অনুষ্ঠানের পর সেই যে রুমে ঢুকেছে! এখনো বের হয়নি। সকালে নাস্তা রুমে খেয়েছে৷ আয়না অবশ্য জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে। প্রতুত্তরে আলিয়া বলেছে তার মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে৷ আলিয়ার কলেজ থেকেই মাইগ্রেনের ব্যথার সমস্যা আছে৷
আলিয়া হালকা অসুস্থ জন্য আয়নার মন খারাপ। তাদের বাসায় বিয়ে নিয়ে সবচেয়ে এক্সাইটেড সে আর পিউ। অথচ তার ছোট অসুস্থ হয়ে গেল। এখন তাকে সাজাবে কে?কে মজা করবে? কে হাসাহাসি করবে?
আজকে মেহেদীর অনুষ্ঠান। ঘরোয়া করে হলেও হালকা-পাতলা সাজতে তো হবেই। কে সাজিয়ে দিবে তাকে?
তখনি বেল বেজে উঠল। বাইরে থেকে পিউ আর রোদেলার আওয়াজ পেতে লাগে সে। শ্বশুড়বাড়ি থেকে সবাই চলে এলো তবে? আজকে অনুষ্ঠানে মেয়েরা থাকবে শুধু । মেহেদী তে নাকি পুরুষরা থাকে না! দুপুরের অনুষ্টান তাই এখনি তৈরি হচ্ছে সে৷
পিউ তার রুমে এসে জিজ্ঞেস করে, আলিয়া কই?
আয়না মুখ গোমড়া করে বলে, ও তো একটু অসুস্থ! তাই রেস্ট নিচ্ছে। তুমি কি আমাকে হেল্প করতে পারবে?
পিউ মুচকি হেসে বলে, অফ কোস! হুয়াই নট? কি হেল্প লাগবে?
— শাড়িটা পড়িয়ে দিতে হবে আর সাজিয়ে দিতে হবে।
পিউ বলে, আমি তো শাড়ি পড়াতে পারিনা। আম্মু পারে৷ আম্মুকে ডেকে আনছি বলে সে রুমের বাইরে চলে গেল৷
আয়না বাধা দিল কিন্তু সে শুনলো না। আয়না মনে মনে ভাবে, ব্যাপার টা উদ্ভট হয়ে যাচ্ছে না? শ্বাশুড়িমা তাকে শাড়ি পড়িয়ে দিবে? কিন্তু শ্বাশুড়ি হওয়ার আগে তো উনি তার ফুপু হয়। নতুন সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে বলে পুরাতন সম্পর্কে কি ভাটা পড়ে যাবে? কে জানে?
তখনি রোদেলা আর পিউ রুমে প্রবেশ করে। রোদেলাকে দেখে আয়না সুন্দর করে সালাম দিলো।
রোদের এক গাল হেসে বলে, কিভাবে শাড়ি পড়বি রে মা? গ্রাম্য স্টাইলে? এক প্যাচে আচল পেছন দিক থেকে নিবি?
–হুম।
— আচ্ছা৷
এরপর সে আয়নাকে সুন্দর করে পেছন দিক দিয়ে আচল টেনে এক প্যাচে শাড়ি পড়িয়ে দিলো৷ এতেই যেন আয়নার রুপ ঝলসে পড়তে লাগে। আয়না-আলিয়াদের চেহারাটা এমন যে বেশি সাজলে ভালো দেখায় না! রোদেলার চেহারাটাও এমনই! একই বংশের মেয়ে যে তাই হয়তোবা! কিন্তু পিউ ভিন্ন। সে এম্নিতেই দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি সাজলেও তাকে আরো অপূর্ব লাগে! পিউয়ের ফেইসের সঙ্গে সাজ-গোছ মানায় খুব! এবং সে সাজতেও ভালোবাসে।
ইভানাও আয়নার রুমে এলো। আজকে ইভানা আসতে চাচ্ছিল না। জোর করে ইভানাকে টেনে এনেছে পিউ আর রোদেলা।
ইভানা এসে আয়নাকে দেখে বলে, ওমা! কি সুন্দর লাগছে আমাদের মেয়েকে! মনে হচ্ছে রুমের ভেতর চাঁদ উঠেছে।
আয়না মুচকি হাসলো৷ আর সালাম দিলো।
ইভানা বলে, সবাই মিলে ওকে সাজাচ্ছে৷ আমি কেন বাদ যাই। আমিও সাজাই একটু!
আয়না বলে, হ্যা৷ অবশ্য ই।
ইভানা আয়নার সামনে গিয়ে দুইটা মোটা মোটা সোনার বালা পড়িয়ে দিয়ে বলে, আমি সমুদ্রের সেকেন্ড মাদার। ও আমার বড় ছেলে! আর তুমি আমার বড় বউমা। এই যে এটা হচ্ছে ওর মায়ের বালা। বিয়ের পর দুই সেট বালা আমাকে আমার শ্বাশুড়ি দিয়েছিল। এক সেট আমি সমুদ্রের বউয়ের জন্য রেখে দিয়েছিলাম আর এক সেট শ্রাবণের বউয়ের জন্য!
আয়না মায়াময় চোখে সামনে থাকা মহিলাটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার সঙ্গে তেমন কথা হয়নি। কিন্তু সমুদ্র একবার ই তাকে নিয়ে কথা বলেছিল। সে বলেছিল, আমার জীবনে অনেক বড় একটা অংশ জুড়ে ফুপা-ফুপু আর শ্রাবণ জড়িয়ে আছে। সেই অংশটুকু যদি কোন দিন মুছে দেই তবে আমার অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে! আমার পরিবারের সাথে ফুপুর পরিবারের দায়িত্ব ও প্রত্যক্ষ ভাবে আমার৷ ফুপু আমাকে খুব ভালোবাসে৷
আয়না বুঝতে পারে সমুদ্র ভুল বলেনি।
পিউ হুট করে বলে উঠে, ফুপু তাহলে আমার বিয়েতে আমাকে কি দিবে?
ইভানা মজা করে বলে, তোর শ্বাশুড়ি তোকে বালা-চূড়ি দিবে। আমরা কেন দিব?
শ্বাশুড়ির কথা ভাবতেই তার রঙ্গনের কথা মনে পড়ে যায়! নিজেই নিজের ভাবনায় একটা চড় বসালো। বেয়াদব ছেলেটা আসলেই তার মাথায় ঢুকে তান্ডব নাচছে।
পিউ মুখ গোমড়া করে বলে, দ্যাটস নট ফেয়ার ফুপু!
সবাই হেসে দিলো একসাথে। এরমধ্যেই একবার অথৈ এসে সব দেখে গেল।
অথৈ আর রোদেলার চোখাচোখি হয়ে যায়। কেউ কিছু বলব না। অথৈ শুধু স্মিত হাসলো। অথৈ এসেছিল চা-নাস্তা দিতে। আজকে অনেক চাপ। রান্না-বান্না সব তাকেই করতে হবে৷ বাবুচি ডাকা হয়নি। পাচ কেজি পোলাওয়ের চালে কি এতো গুলা মানুষের খাওয়া হবে সেই নিয়ে চিন্তায় আছে সে। গরুর মাংসের বিরিয়ানি তার ভালো হয় না। তাও আজকে সে রাধবে৷ একা একা সব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে অথৈ। আলিয়া অসুস্থ। নাহলে তার সহায়তা নেওয়া যেত। অথৈ দ্রুত রান্নাঘরে গেল। একজন বয়ষ্ক মহিলা অবশ্য আছে তাকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু সে পোলাও রান্না পারেনা৷ অথৈয়ের পোলাও ও নরম হয়৷ ঝরঝরা হয় না৷ কি করবে সে? বড্ড চিন্তায় পড়ে গেল!
রোদেলা অথৈয়ের চিন্তারত মুখ দেখে নিজেও চিন্তায় পড়লো। মেঘ ঠিক আছে তো! আজকাল তার ভাই লজ্জা আর হীনমন্যতায় মুখ লুকিয়ে চলে! কিন্তু ভাই তো আর জানে না! রোদেলা তাকে কতখানি ভালোবাসে। আগে ছোট থাকতে যখন আব্বা বিস্কুট-কেক আনত। সবসময় দুইটা করেই আনত। রোদেলা সবসময়ই ছোট ভাইয়ের জন্য নিজের অধেকটা রেখে দিত। কারন মেঘ এইসব খাবার খুব পছন্দ করত। মুরগি রান্না হলে নিজ ইচ্ছায় মুরগীর রান খেত না। মেঘের জন্য রেখে দিত। মেঘ দুইবেলাতেই মজা করে রান দিয়ে খেত। এগুলো সে ভালোবেসে করত৷ এবং এখনো আগের মতোই ভাইকে ভালোবাসে সে। ভাই তো আর সেটা বুঝে না!
ফাতেমা বেগম ও এসে বসলেন মেয়ের পাশে।
রোদেলা বলল, আম্মা। তুমি সুন্দর করে শাড়ি পড়বে। জুবুথুবু হয়ে থাকা যাবে না। পরিপাটি হয়ে থাকবে৷
ফাতেমা বেগম বলেন, আমি বুড়ি মানুষ। এ-সব আর ভালো লাগেনা৷ আমি বোরখা পড়ব। ব্যস হয়ে গেল। তোর আব্বাকে বল। সুন্দর দেখে যেন একটা পাঞ্জাবি পড়ে৷
রোদেলা নিজেও চুল আছড়াতে আছড়াতে বলল,হ্যা। আব্বার জন্য আমি পাঞ্জাবি কিনে এসেছি। আব্বার নামাজ পড়া হলেই পাঞ্জাবি গায়ে দিতে বলব৷
পিউ হুট করে রুম ছেড়ে বের হয়ে আলিয়ার রুম ধাক্কাতে লাগে। আলিয়া জোড়পূবক গেট খুলে দিল। সে প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে৷ কালকে থেকে সে কান্না করছে৷ পিউকে দেখে বিচলিত হলো সে৷
পিউ হাতে করে আইসকুল এনেছে। সে বলে উঠে, আলিয়া তুমি শুয়ে পড়ো। আমি তোমার মাথা ম্যাসাজ করে দিচ্ছি৷ আরাম পাবে৷
আলিয়া অবাক হলো। কিছু বলতে পারলোনা।
পিউ যে তাকে নিয়ে ভেবেছে এটা ভাবতেই তার খুব ভালো লাগছে।
পিউ যখন তার মাথা ম্যাসাজ করতে করতে বলে, ব্যথা কমেছে?
আলিয়া ভারাক্রান্ত গলায় বলে, মাথা ব্যথা কমলেও মনের ব্যথা কমছে না তো!
— কিসের ব্যথা?
আলিয়া নিজের বুকের বাম পাশ দেখিয়ে বলে ,এই জায়গায় যন্ত্রনা হচ্ছে৷
পিউ সব শুনে ও দেখে বলে উঠে, ওহ মাই গড! এরপর এক দন্ড থেমে বলে, এই! এই! তোমার কি শ্রাবণ ভাইয়ার রোগ ধরলো নাকি?
আলিয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, ওর রোগ ধরেনি! বরং ওই ব্যাটা সাপই রোগটার উৎস!
★★★
দুপুরের পরপর আয়নার দুই হাত ভরে মেহেদী পড়ানো হয়। তাকে অথৈ নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। শুধু অথৈ না! সবাই মিলে তাকে খাইয়ে দেয় হরেক রকমের খাবার!
আয়নার সঙ্গে বাকিরাও মেহেদী পড়লো৷ এমন কি কণের নানিও বাদ যায়নি৷ অতিরিক্ত কান্না করার জন্য আলিয়ার মাথা ব্যথা করলেও পিউ ম্যাসেজ করে দেওয়ার জন্য আর ব্যথা নেই৷ পিউ বলেছে অনুষ্ঠান শেষ হিলে আরেকবার মাথা টিপে দিবে মলম দিয়ে।
আলিয়া মেহেদী পড়া হাতের ছবি স্টোরি দেওয়ার এক সেকেন্ডের মধ্যে শ্রাবণ দশটার মতো লাভ ইমোজি সেন্ড করলো রিপ্লেতে৷ আলিয়া বড্ড বিরক্ত হলো৷ সে ফোন রেখে সবার সাথে আড্ডায় মনোনিবেশ করে৷
নানা বিকেলে সমুচা-শিঙ্গারা কিনে আনলো। বিকেলের পর পর রোদেলা পিউ আর ইভানা রওনা দিলো।
কালকে বিয়ে। অনেক প্রস্তুতি বাকি আছে। যদিও বা বিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে হবে। বিয়ের সব খরচ ছেলে পক্ষ দিবে। রাওয়া ক্লাবে বেশ ঝাকঝমক ভাবেই বিয়ের অনুষ্ঠান করা হবে৷ রাওয়া ক্লাব আয়নাদের বাসা থেকে কাছে হয় জন্য সেখানেই বুকিং করা হয়েছে৷ রোদেলার ইচ্ছা ছিল বসুন্ধরা কমিউনিটি সেন্টারে করবে৷ কিন্তু সবাই এখানেই মত দিলো। সবাই বলতে সমুদ্র আর আবেগ।
রাতের দিকে সমুদ্র তার ফুপুর রুমে এলো। রুম এলোমেলো করে রাখা। সে বলে উঠে, ফুপু আসব?
ইভানা রেস্ট নিচ্ছিল। সমুদ্র কন্ঠস্বর শুনে বলে, আয় বাবা।
সমুদ্র একটা প্যাকেট নিয়ে এসে তার সামনে ধরে বলে, There is a small gift FOR you.
ইভানা অবাক হয়ে প্যাকেট খুলে দেখে একটা বেনারসি লাল শাড়ি। সে হতভম্ব হয়ে যায়।
সমুদ্র আহ্লাদ গলায় বলে, কালকে এই শাড়িটা পড়বে কিন্তু।
— তুই আমার জন্য এটা কিনেছিস রে বাবা?
সমুদ্র মাথা ঝাকিয়ে বলে , পছন্দ নাহলেও কিছু করার নাই এটাই পড়তে হবে।
ইভানা আবেগে ভেসে যেতে লাগলো। সে সমুদ্র কে অনেক দোয়া দিল৷
এবার সে মায়ের রুমে যাবে।তিন টা সেইম লাল শাড়ি কিনেছে সে নিজের স্যালারি দিয়ে। আর একটা মামীকে দিবে কালকে সকালে। মামীও তো এখন তার শ্বাশুড়ি মা হতে চলেছে।
সে মায়ের রুমে ঢুকে বলে।,আপনি কি বিজি?
রোদেলা বলে উঠে, না তো। বিজি কেন হবো?
— একটা কথা বলব। না বলব না বরং কিছু দিব৷
— কি?
সমুদ্র শাড়ির প্যাকেট এগিয়ে দিল। রোদেলা সঙ্গে সঙ্গে প্যাকেট খুলে হতবাক হয়ে যায়৷
সমুদ্র বলে উঠে, জানি আপনার কালেকশনে এর চেয়েও সুন্দর আর দামী শাড়ি আছে। এটা আহামরি তেমন কিছু না।।আমার সাধ্যের মধ্যে এই শাড়িটা কিনেছি। পছন্দ না ই বা হলো কিন্তু এটা কালকের অনুষ্ঠানে আপনি পড়লে আমি খুব খুশি হবো ।
আবেগ পেছন থেকে সবই শুনছিল। সমুদ্র যেতেই রোদেলা বড্ড আগ্রহ নিয়ে আবেগকে শাড়িটা খুলে খুলে দেখাতে লাগে।
রোদেলা বাচ্চাদের মতো উল্লাস প্রকাশ করে বলে, দেখো দেখো আচলটা কতো সুন্দর! কি সুন্দর কাজ করা!
★★★
পরের দিন সন্ধ্যা নাগাদ সবাই হলে উপস্থিত। হলটা সম্পূর্ণ সাদা গোলাপ দিয়ে ডেকোরেশন করা হয়েছে। খাবার মেন্যু সবচেয়ে দামীটা রাখা হয়েছে। নান, কাচ্চি দুইটাই দেওয়া হবে। সঙ্গে গরুর কালো ভুনা, খাসির রেজালা, রোস্ট, কাবাব আর ভেজিটেবল, বোরহানি। ডেজার্টে সমুদের প্রিয় ফিরনি আর মিস্টি পান।
ডেকোরেশন দেখে সবাই মুগ্ধ। বিশাল বড় স্টেজ। আভিজাত্যর শেষ নেই।আভিজাত্যপূর্ণ তো হবেই ঢাকার অন্যতম কমিউনিটি সেন্টার এটা। তাও হাই বাজেটের ইভেন্ট নিয়েছিল তারা। সমুদ্র নিজে তাগদা নিয়ে এখনকার ট্রেন্ডে থাকা ফটোগ্রাফি ম্যানেজমেন্ট থেকে ফটোগ্রাফার হায়ার করেছে। তার লজিক হলো বিয়ের খাওয়া হজম হয়ে যাবে, কাপড় পুরাতন হয়ে যাবে। কিন্তু স্মৃতি হিসেবে ছবি আজীবন রয়ে যাবে। তাই এটার উপর ইনভেস্ট বেশি করতে হবে৷
সাতটার দিকে কনে পক্ষ চলে এলো। আজকে সবাই বিউটি আটিস্টদের কাছে সেজেছে। আয়নাকেও অদ্ভুত সুন্দর লাগে৷ লাল শাড়ি তে তাকে লাল টুকটুকে বউ লাগছে!
আয়নাকে পালকিতে করে স্টেজের সামনে আনা হয়। এরপর ওকে পালকি থেকে নামিয়ে স্টেযে নিয়ে যায় সমুদ্র। প্রতিটি মুহূর্ত ই ক্যামেরা বন্দী হতে থাকে।
আয়নায় মুখ দেখাদেখির রিচুয়াল ও পূরণ করা হয়। আয়না আয়নায় সমুদ্র কে দেখে বলেছিল, সে নাকি তার ভরসার স্থল দেখতে পাচ্ছে৷
সমুদ্র এক গাল হেসে দেয়। এরপর কাজী এসে বিয়ে পড়িয়ে দেয়৷
পুনরায় তিনবার কবুল বলে আয়না। তার মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি জাগ্রত হতে লাগে! আজকে থেকে সে সম্পূর্ণ সমুদ্রের।
এই ভাবেই তিনবার কবুল বলার মাধ্যমে একটা মেয়ে তার পরিবার ছেড়ে অন্য কারো বাসায় নতুন সদস্য হয়ে চলে যায়।কি অদ্ভুত মেয়েদের জীবন! এজন্য ই হয়তোবা নারীদেকে মহা মহান বলা হয়!!!!
চলবে৷