#প্রেমপ্রদীপ
Part–49
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
সমুদ্রের দৃষ্টি আয়নার দিকে। সে ঈগলের মতো সুক্ষ্ম চোখে আয়নাকে দেখছে। আসলে দেখছে না আয়না কি বলবে তা শোনার অপেক্ষায় সে তটস্থ।
আয়না বলে উঠে, আচ্ছা ঠিক আছে নানাভাই।
সমুদ্রের মুখে কালো মেঘ ছেয়ে গেল। সে মুখ কালো করে আয়নার দিকে তাকিয়ে তাকে দেখে নিল। সে বেশ স্বাভাবিকই আছে। কি দরকার ছিল নানাভাইয়ের কথায় রাজী হওয়ার? নানাভাই আয়নাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে যাচ্ছে। কাল বা পড়শু গিয়ে সমুদ্র তাকে আবার আনবে তখন আরেক দফা জামাই আপ্যায়ন করা হবে৷ এই প্রস্তাবে আয়না রাজী হয়ে যায়।
নানি প্রশ্ন করে, সমুদ্র তুমি ও চল!
সমুদ্র কিছুটা ক্ষেপে গেছে আয়নার উপর।খুব কি প্রয়োজন ছিল যাওয়ার জন্য রাজী হওয়ার? তাছাড়া তার শ্বশুড়বাড়ি যেতে লজ্জাও লাগে। তাই সে গম্ভীর গলায় বলে, না। কালকে সকালে আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। সর্যি নানি।
আয়না ডাগর চোখে তার দিকে তাকালো। সমুদ্র তা সম্পূর্ণ ভাবে উপেক্ষা করল। আয়নার চোখাচোখি হতেও তার লজ্জা করছে। বিয়ে করার পর থেকে তার পানি খেতেও লজ্জা লাগছে । কি একটা অবস্থা!
আলিয়া উঠে দাড়ালো। শ্রাবণ তাকে খুব বিরক্ত করছে। সে উঠে এসে আয়নার পাশে বসল। যেহুতু আয়না আর সমুদ্র পাশাপাশি বসা ছিল কাজেই আলিয়া এসে বসতেই সমুদ্র সৌজন্যতামূলক হেসে বলে, আলিয়া নূর জাহান এখন তুমি কেমন আছো?
— এইতো ভাইয়া আলহামদুলিল্লাহ আচ্ছা তুমি আমাকে আমার পুরা নাম ধরে কেন ডাকো?
— যেদিন তোমার সাথে প্রথম দেখা-সাক্ষাৎ হলো সেদিন তোমার নাম যখন জানতে চেয়েছিলাম তখন তুমি তোমার ফুল নেইম বলেছিলে।
— ওহ৷
সমুদ্র উঠে দাড়ালো এবং সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। আয়নাকে নিয়ে এখনি চলে যাবে তারা। সমুদ্র নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
আয়না সবার সামনে না পারছে সমুদ্র কে ডাকতে আর না পারছে সবার সামন দিয়ে উঠে তার কাছে যেতে তাই সে চুপচাপ বসে রইল৷
কিছুক্ষন পর অথৈ মেয়ের কাছে এসে বলে, তোমার ফুপা-ফুপুর কাছে বিদাই নাও। আমরা যাব এখনি।
রোদেলা রান্নাঘরে ছিল। সবার রাতের খাওয়া শেষ। সে প্লেট গুছিয়ে শাড়ির আচলে হাত মুছে ড্রয়িং রুমে আসতেই আয়না তার সামনে এসে বলে, ফুপি আমরা যাব এখন৷
রোদেলা সময় দেখে নিল। দশটার বেশি বাজে।সে বলে উঠে, হ্যা। মা যাও। সমুদ্র কালকে গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবে নাকি ও যাচ্ছে তোমাদের সঙ্গে?
আয়না মন খারাপ করে বলে, নাহ। ও যাবে না।
— আচ্ছা।
রোদেলা ভাইয়ের কাছে গিয়ে বলে, কিভাবে যাবি?
মেঘ হাসি-হাসি মুখ করে বলে, ওই যে শ্রাবণ উবার ডেকে দিচ্ছে।উবারে করে চলে যাব৷
তখনি শ্রাবণ বলে উঠে, আংকেল গাড়ি চলে আসছে। নিচে এসে দাড়িয়েছে।
— আচ্ছা। আচ্ছা। আমরা নামছি। আলিয়া তোমার আপাকে নিয়ে আসো।
আয়না-আলিয়া দুইজনই সবার কাছ থেকে বিদাই নিয়ে রওনা হলো।
শ্রাবণ তার ফোন হাতে নিয়ে সোজা ছাদে উঠে যায়। আজকে সে লাইভে আসবে বহুদিন পর। এইসব কিছু আলিয়ার মন গলানোর জন্য করছে সে। শ্রাবণ ছাদে উঠে সমুদ্র আর পিউকে ম্যাসেজ দিল যেন তারা তার লাইফ দেখে।
শ্রাবণ তার আইফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে লাইভ শুরু করে৷ লাইভে যাওয়ার এক মিনিটে মাত্র পাচজন লাইভ জয়েন করে। সে হতাশ হয়!
তারপর ও বলতে শুরু করে, আসসালামু আলাইকুম এভ্রিওয়ান আমি আরজে শ্রাবণ শিকদার বলছি। অনেক দিন পর আবারো ফিরে এলাম আপনাদের মাঝে। আপনারা সবাই কেমন আছেন?।
একজন কমেন্টে বলে, আরে শ্রাবণ ভাই নাকি? বিশ্বাসই হইতেছে না!
শ্রাবণ হেসে বলে, জি আমি! আজকে প্রায় অনেক দিন পর আবারো ফিরে এলাম আপনাদের মাঝে।
পাচ মিনিটের মধ্যে অনেকেই জয়েন করল।একটা সময় রমরমা ভাব চলে এলো। অনেকে ই অনেক প্রশ্ন করতে লাগলো। শ্রাবণ একে একে উত্তর দিতে লাগে৷
একজন প্রশ্ন করলো, ভাইয়ার কি বিয়ে হয়েছে নাকি?
শ্রাবণ চুল ঠিক করতে করতে বলে, না। আপাতত আমি দেবদাসের মতো ঘুরঘুর করছি কারো পেছনে। তাকে পেয়ে গেলেই শুভ কাজ সম্পন্ন হবে৷ আচ্ছা আপনারা লাইফটা একটু কাইন্ডলি শেয়ার করুন প্লিজ।
শ্রাবণ বলতে লাগলো, আজকের লাইভের পেছনে একটা বিশেষ কারন আছে তাহলো আমি পুনরায় রেডিও স্টেশনে কাজ শুরু করব। এই সময় পিউয়ের কমেন্ট পেল শ্রাবণ সেখানে কংগ্রাচুলেশনস লেখা। শ্রাবণ তা পড়ে বলে, লাউ ইউ পিউমনি।
আরো অনেক কমেন্টস আসতে লাগে। বেশিরভাগই মেয়েদের। সবার একই কথা, শ্রাবণ তুমি আমার ক্রাশ! আমার প্রথম প্রেম হেন-তেন!
তার চোখে পড়লো আয়েশাও লাইভ জয়েন করেছে শুধু তাই না! তাকে আই লাভ ইউ ও বলেছে কমেন্টে। শ্রাবণের মনে হচ্ছে ছেলে হয়ে জন্মানোটাই তার ভুল হয়ে গেল। এতো পাবলিকালি হেনেস্তা সে নিতে পারেনা। ভাগ্যিস আব্বু ফেইসবুক তেমন একটা চালায় না। তা নাহলে এইসব মেয়েদের ম্যাসেজ দেখলে এক্ষুনি তাকে বিয়ে দিয়ে দিত! সে খেয়াল করেছে আলিয়াও লাইভে আছে কিন্তু কিছু বলছে না।
শ্রাবণ বলা শুরু করে, শুধু তাই না আগামী বই মেলায় শেহজাদী বইটার তৃতীয় মুদ্রণ আসছে। শেহজাদী বইটা আমার সব বইয়ের চেয়ে একটু বেশিই প্রিয়! বইয়ের ভেতরের কয়েকটা লাইন শেয়ার করতে চাই!
সে থেমে থেকে বলা শুরু করল,
এবার একটা প্রশ্ন করি তোমাকে।দেখি পারো কিনা! প্রশ্নটা হলো, বেশির ভাগ মৌলিক সংখ্যা কিন্তু বিজোর যেমন– এগারো, তের, সতের, ঊনিশ। তাহলে এক কেন মৌলিক সংখ্যা না? দুই থেকে কেন মৌলিক সংখ্যা শুরু?দুই ফো জোর সংখ্যা। উত্তর টা বাস্তবিক হওয়া চাই। দুই থেকে মৌলিক সংখ্যা শুরু হয় কেন? ।
উত্তরঃ সঠিক উত্তর জানি না। তবে, আমার মনে হয়, একের কোন দাম নাই। তবে দুইটা মন মিলে একটা মৌলিক মন তৈরি হয়। যাকে অন্য কেউ ভাঙ্গতে পারবে না। এজন্য দুই থেকে মৌলিক সংখ্যা শুরু! কেবল মৌলিক মনের অধিকারি কেউ একজন অপরজনকে ভেঙ্গে ফেলতে পারবে।
শ্রাবণ তারপর বলতে লাগলো, আসলে আমি খুব ডিপ্রেশনে ভুগছি। রাত-দিন কিছু ই ভালো লাগেনা। কাল নাগিনী আমি জানি তুমি এখানেই আছো। প্লিজ কাম ব্যাক! আই লাভ ইউ ভেরি মাচ।
অনেক মেয়েই কমেন্টে বলতে লাগলো, শ্রাবণ আমি তোমার কাল নাগিনী! যার কিছু বলার অপেক্ষায় ছিল শ্রাবণ সে কিছু ই বলেনি। কিছুক্ষনের মধ্যে লাইভ শেষ হয়ে যায়৷
লাইভ শেষ হওয়ার খানিকটা বাদেই সমুদ্র ছাদে উঠে এলো। সমুদ্র কে দেখতেই শ্রাবণ এক গাল হাসি হাসে।
সমুদ্র তাকে একটা সিগারেট দিয়ে বলে, মেয়েটাকে আজো ভালোবাসিস?
–হুম।
— শুনে ভালো লাগলো৷ কিন্তু ফোকাস একটা মেয়ের উপরই রাখ। হয় তোর কাল নাগিনী নাহলে আমার শালিকা। দুইজনকে একসাথে মনে রাখার চেষ্টা করলে তোর খবর আছে।
শ্রাবণ মিটিমিটি হেসে বলে, আজকে তো আবার ব্যাচেলার লাইফে ফেরত আসলে! তারপর মিংগেল হওয়ার পর কেমন লাগছে ভাই?
— খুব ভালো। ওকে পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি৷
শ্রাবণ সমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে, তোমাদের জন্য আমি অনেক অনেক হ্যাপি। আমার দেখা বেস্ট কাপল!
— ফুপু তোর জন্য নিচে অপেক্ষায় আছে। আয়।
–চল।
★★★
আয়না বাসায় ফিরে নিজের রুমে ঢুকে পড়ে। রাতে খেয়ে এসেছে।তাই যে যার মতো ঘুমাতে গেল। বিয়ের অনুষ্ঠানের ধকলে সবাই ক্লান্ত।
অথৈ তার রুমে গিয়ে বলে মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলে, শোন?
মেঘ তখন শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। সে তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, কি হলো আবার?
— রোদেলা কি আয়নার উপর রেগে আছে?
— না। না। রেগে কেন থাকবে? তুমি কি সমুদ্রের উপর রেগে আছো বা ক্ষেপে আছো?
অথৈ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, সমুদ্রের উপর রাগবে কেন আমি?
— ওর মাকে তো দেখতে পারোনা।
— দেখো আমার রাগার পেছনে যথেষ্ট কারন ও ছিল কিন্তু।
— বিয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। এখানে অন্য দের কোন হাত নেই। আসো শুয়ে পড়ি৷ আমার এই বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না। কোন এক সময় রোদেলার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিবে৷
অথৈ আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেঘ তার দিকে কঠিন চোখে তাকায়৷ অথৈ কিছু বলল না। তবে রোদেলার সাথে সবকিছু মিটমাট করে নিতে হবে। তার মেয়ে এখন ওদের বাসায় থাকবে। অথৈ চায় না তার জন্য তার মেয়ের কোন অসুবিধা হোক। সে শুয়ে পড়ে বাতি নিভিয়ে দিলো।
আয়না এখনো শুতে যায়নি। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমুদ্র কে কল দিচ্ছে। কিন্তু সে ধরছে না। আয়নাকে কিছুটা চিন্তিত দেখাচ্ছে। সমুদ্র কি রেগে গেল নাকি? সমুদ্রের আচরণ ওমন্নযে বাহির থেকে বোঝাই যায় না তার ভেতরে কি চলছে!
সে আবারো কল দেয়। সমুদ্র এবারে রিসিভ করে।
আয়না বলে উঠে,এতোক্ষন ফোন ধরছিলে না কেন?
–ব্যস্ত ছিলাম।
আয়নার মনটা খারাপ হলো। এতো রাত্ব কিসের ব্যস্ততা তার? তাও আবার আজকে বিয়ের পরের দিন। অফিস থেকে তো ছুটিই নিয়েছে।
আয়নাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে সমুদ্র আহ্লাদি গলায় বলে, জিজ্ঞেস করলে না কেন ব্যস্ত?
আয়না অভিমানী সুরে বলে, কি করছিলে?
— তোমাকে দেখছিলাম।
— মানে?
— মানে হলো কালকের অনুষ্ঠানের ছবি দেখছিলাম ল্যাপটপে তাই ফোনের দিকে নজর ছিল না আর ফোন সাইলেন্ট মুডে আছে৷
— ও।
— এবার খুশি হলে?
–হুম। (আয়না খুশি খুশি গলায় বলে।)
–আজকে সারা রাত কথা বলি ফোনে আয়ু?
আয়না আমতাআমতা করে বলে, ফোনে বেশি টাকা নেই।
–ওহো। ম্যাসেঞ্জারে কল দিচ্ছি।
— আমার একাউন্ট নেই। আগেও বলেছি তো।
–ভুলে গিয়েছিলাম। আয়ু আমাকে পাচ মিনিটের মতো সময় নাও।
— আচ্ছা।
সমুদ্র দ্রুত আয়নার নামে একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলল। নাম দিল আয়না নূর। জাহান বাদ দিল। এরপর প্রোফাইল পিকচারে তাদের হলুদের ছবি আর কভারে তাদের দুইজনের বিয়ের ছবি দিল। তারপর আয়নাকে কল দিয়ে বলে, শোন?
–হুম বল।
— দ্রুত ফেইসবুক এ্যাপে যাও৷
–কেন?
— ডোন্ট আস্ক কুয়েশ্চন।
–আচ্ছা।
আয়না ফোন দিয়ে ফেসবুকে ঢুকল। এরপর সমুদ্র আইডি নাম বলল। আয়না অবাক হয়ে তা লিখল।।। এবার পাসওয়ার্ড দেওয়ার পালা। সমুদ্র বলল, ইংরেজিতে নাইট্রোজেন এরপর স্পেস তারপর একসাথে ৭১৪৷
আয়না এমন পাসওয়ার্ড শুনে হেসে দিল।
সমুদ্র বলল, এসএসসি তে আমার ক্যামিস্ট্রিতে মার্কস ৯০+ ছিল।
— বাহ। আর এইচএসসি তে?
— কাটায় কাটায় এ প্লাস। ৮০। আর ৮২৷
আয়না লগ ইন করে দেখে সমুদ্র তার আইডিতে রিলেশনশীপ স্টাটাসও দিয়ে দিয়েছে।তাদের দুইজনের ছবি দেখে আয়না ফোনেই জিজ্ঞেস করে, এই ছবিগুলো কখন তুললো?
— কি জানি? তুলেছে কোন এক সময়। যাইহোক আজকের পর আর নিজের সিংগেল ছবি প্রোফাইলে দিবে না৷
— কেন?
— বিয়ের পর নিজের একার সিংগেল ছবি দেওয়া আইনত নিষিদ্ধ!
আয়না হিহি করে হেসে দিয়ে বলে, তাহলে তোমার নিজের সিংগেল ছবি দেওয়া কেন প্রোফাইলে?
— আরে,,,ইয়ে,,,চেঞ্জ করব তো!
এভাবেই প্রায় গভীর রাত পর্যন্ত সমুদ্র আর আয়না গল্প করে পার করে দিলো।
★★★
পরের দিন দুপুরের দিকে আবেগের রিপোর্ট আসল। শুধু তাই না, ডাক্তার তাকে ইমেডিয়েটলি তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছে। রোদেলা আর সমুদ্র আবেগকে নিয়ে রওনা হলো হাসপাতালে। পিউ যেতে চাচ্ছিল কিন্তু সমুদ্র বাসায় থাকতে বলেছে। সমুদ্র রা যাওয়ার কিছু সময় বাদে শ্রাবণের ফোনে তার বাবার ম্যাসেঞ্জার থেকে ম্যাসেজ আসে। সেখানে লেখা, শ্রাবণ তুমি দ্রুত তোমার ফুপুর বাসায় আসো।
সে বেশ অবাক হলো। বাবা তো কোন দিন এভাবে ম্যাসেজ দেয় না। হুট করে কি হলো? সে সময় নষ্ট না করে গুলশানের পথে রওনা হলো।
শ্রাবণ ফুপুর বাসায় গিয়ে গেটে বেল বাজাতে লাগে। গেট খুলে দেয় আয়েশা।
শ্রাবণ বিরক্ত মুখ নিয়ে বলে, বাবা কই?
— মামা তো ছাদে গেল।
সে ভ্রু কুচকে বলে, ছাদে কেন?
— আম্মুর সঙ্গে ছাদ দেখতে গেছে৷
— ছাদে দেখার কি আছে?
— আমরা ছাদে ফুলের গাছ লাগিয়েছি অনেক গুলো। ফ্লোরার ও কিনেছি। ওগুলো দেখতে গেছে।
— ও৷
শ্রাবণ বাসায় গিয়ে বলে, বাথরুমে যাব৷
— যাও।
শ্রাবণ বাথরুমে ঢুকে। বাথরুমের বেসিনের কল থেকে পানি পড়ছে না। সে বিরক্ত হয়ে ট্যাপের কল অন করতে গিয়ে ঝর্ণা অন করে নিজেকে।ভিজিয়ে ফেলে। সে শার্ট খুলে রুমের বাইরে আসতেই দেখে আয়েশা রুমের বিছানায় বসে আছে।
শ্রাবণ বিব্রত বোধ করে বলে, হুয়াট?
— শ্রাবণ তুমি এমন কেন করছো?
— কি করলাম আমি?
— এমন কিছু করাটা কি ঠিক?
— আরে? কি ভুল করলাম আমি?
— তুমি বুঝতে পারছো না কেউ দেখে নিলে খারাপ ভাববে?
শ্রাবণ অবাক হয়ে গেল এবং না বুঝেই বলে, কি দেখবে?
— যেটা তুমি করতে চাচ্ছো এটা কিন্তু খুব খারাপ।
শ্রাবণ হা হয়ে যায়। ঠিক সেই সময় শৌখিন রুমে ঢুকে সোজা শ্রাবণের কাছে গিয়ে বলে, কি হচ্ছে এখানে?
— কিছু ই হচ্ছে না৷
ঠাস করে তিনি শ্রাবণের গালে থাপ্পড় বসালো।
★★★
ডাক্তার রিপোর্ট চেইক করে বলে, এগুলো রিসেন্ট কন্ডিশন পেশেন্টের। আই রেফার অপারেশন করে ফেলেন দ্রুত।
সমুদ্রের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। সে মূর্তির মতো হয়ে দাড়িয়ে থাকে।
তিনি বলতে লাগে, ক্যান্সার সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অপারেশন করাতে হবে। এরপরে সিদ্ধান্ত নিব কেমো নিতে হবে কিনা৷
রোদেলা একথা শুনে থরথর কাপতে লাগে।
ডাক্তার বলে উঠে, পেশেন্টের কন্ডিশান খারাপের দিকে যাচ্ছে। যা করার দ্রুত করবেন। সময় নষ্ট করলে আপনাদেরই ক্ষতি।
চলবে।
#প্রেমপ্রদীপ
Part–50
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
রোদেলা টলমলে চোখে আবেগের পানে চেয়ে আছে। তার বুকে ব্যথা করছে। মনটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার। আবেগ বেশ স্বাভাবিক ভাবেই খাটে হেলান নিয়ে বসে আছে। আবেগ ডাক্তারের বলা কিছু ই শুনেনি। তাকে চেক আপ করানোর জন্য অন্য রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। রোদেলা আর সমুদ্র গাড়িতে চুপচাপ ছিল। কেউ কোন কথা বলে নি।
আবেগ জামা-কাপড় বদলে খাটে বসে রোদেলাকে দেখে হালকা হেসে বলে উঠে, এক কাপ চা বানাতে পারবে? হুট করে চা খেতে ইচ্ছা করছে৷
রোদেলা মনের মধ্যে বেদনা চেপে রেখে বলে, আচ্ছা। দশ মিনিট বস। আমি আসছি এক্ষুনি৷
সে রান্নাঘরে গিয়ে এক দফা চাপা কান্না কেদে নিলো। বাসায় কি কেউ নেই? কারো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। পিউ কোথায়? সমুদ্র কোথায়?
সে এক ধ্যানে দুধের দিকে তাকিয়ে থেকে দুধে লিকার দিয়ে চা বানালো। আবেগ চিনি খায় না এখন আর। চিনি ছাড়া দুধ চা খায়। রোদেলা বিস্কিট বের করে প্লেটে সাজিয়ে আবেগের কাছে গেল৷
আবেগ চা হাতে নিয়ে বলে, রোদেলা একটু বস। তোমার সাথে কথা আছে৷
রোদেলা নিজেকে ঠিক রেখে বলে, হ্যা বল!
— আমার পাশে বস৷
— বসাটা কি খুব জরুরি?
— জি। কিছু কিছু কথা বসে বলতে হয়। আসো বস। নিজের জন্য ও চা আনতে৷
রোদেলা হালকা হাসল। এমন খবর শোনার পর কিভাবে সে চা খাবে? এতো শক্ত সে নয়।
আবেগ বলে উঠে, আমি ভেবেছি স্বেচ্ছায় অবসর নিব। আর অফিস ছুটতে পারিনা। ধকল যায় শরীরের উপর দিয়ে। একেবারে কাহিল হয়ে যাই। তার চেয়ে বাসায় আরাম করি। কি বলো?
রোদেলার চোখ ফেটে পানি পড়তে লাগে। আবেগ অনেক পরিশ্রমী ছিল। দিন নাই রাত নাই ওয়াডে ওয়াডে ঘুরত! রাত একটার দিকে রোগী ফোন দিয়ে হাসপাতালে যেতে বললেও সে সব ছেড়ে হাসপাতাল যেত। কাজ সেড়ে পুনরায় পরের দিন সঠিক সময়ে অফিসে যেত৷ আর এখন অবসরের সময় ঘনিয়ে আসার আগেই সে হাপিয়ে উঠল।
রোদেলা কোমল গলায় বলে, তোমার যা ভালো মনে হয়৷
— তাহলে অবসর গ্রহণ করি?
— হুম।
— তুমি কি কাদছো?
রোদেলা শব্দ করে কেদে দিল
আবেগ বিরক্ত হওয়ার ভান করে বলে, আহা! কেন খামোখা কাদছো? আমি রিটায়ার্ডমেন্টের পর সারা দিন বাসায় বসে তোমাদের জ্বালাব এজন্য কষ্টের কান্না কাদছো নাকি?
রোদেলার বেদনা মাখা মুখে ক্লান্তিস্নাত হাসি হাসে।
আবেগ বিস্কুট মুখে দিয়ে বলে, আরো একটা কথা বলার আছে।
— বল।
— পিউয়ের বিয়ের কথা ভাবছি আমি। ছেলেটার তো বিয়ে নিজ চোখে দেখে গেলাম। এবারে মেয়েটার বিয়ে, এরপর এক দন্ড থেমে আবার বলতে লাগলো, মেয়ের সংসার দেখে যেতে পারলে আর কোন আফসোস থাকত না। বলছি কি, পিউ তো আর ছোট নেই। ওর বিয়ে নিয়ে ভাবি আমরা কি বল ?
— তুমি এই বাসার কর্তা। তুমি যা বলবে তাই হবে। এখানে এতো ভাবাভাবির কি আছে ?
— পরিচিত একটা ছেলে আছে। আমার পরিচিত না। পিউয়ের পরিচিত। সেদিন হলুদে এসেছিল। পিউয়ের সাথে ভালোই গল্প-গুজব করল। ছেলেটা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে৷ আমার ওকে খুব পছন্দ হয়েছে। খোজ-খবর নিয়েছি আমি। ছেলে ধানমণ্ডি থানার এসপি। ওর ডিপার্টমেন্ট থেকেও খোজ নিলাম। সবাই ওর খুব প্রশংসা করল৷
— এতো দূর এগিয়ে গেছো তুমি?
— হ্যা৷ কেন? কষ্ট পেলে নাকি তোমাকে জানাই নি জন্য?
— উহু। কষ্ট কেন পাব।
— ছেলেটার মা নেই। বাবা আছে। কালকে ওকে আর ওর বাবাকে দুপুরে খেতে আসতে বলেছি। আলাপ করি। পিউয়ের মতামত নেই। তারপর নাহয় সামনে আগাব৷
রোদেলা বলে উঠে, তোমার কি ইচ্ছা?
— সংসার তো আমার মেয়ে করবে। কাজেই আমার ইচ্ছা দিয়ে কিছু না। মেয়ে যা বলবে তাই। তবে সত্যি বলতে কি, আমি চাই দেশী কোন ছেলের সাথে ই পিউয়ের বিয়ে হোক।
— দেশি ছেলে মানে?
— আমি চাই না আমার মেয়ে আমেরিকার কোন সাদা চামড়ার মানুষ কে বিয়ে করুক।
রোদেলা হালকা হাসল। আবেগকে কিভাবে সত্যটা বলবে? সে যে ভালো নেই! কিভাবে জানাবে?
রোদেলা ভেবে নিল, আবেগকে কিছু বলবে না। তাকে জানালেই সে মনের দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে যাবে। মন ভেঙে পড়লে শরীর ও ভেঙে যায়।
আবেগ হুট করে রোদেলার হাত চেপে ধরে বলে, শোন! আমাকে ক্ষমা করে দাও।
রোদেলা বিচলিত হয়ে গেল এবং বলল, কি হয়েছে? ক্ষমা কেন করব? আর কিসের জন্য করব?
আবেগ উঠে দাড়ালো। সে অনেক দিন ধরেই রোদেলাকে এ-সব কথা বলতে চায়। এ-সব কথা না বলতে পারার জন্য তার মন ভারী হয়ে আছে। ইগো আর অহংকারের জন্য সে রোদেলাকে কিছু বলতে পারেনা। আজকে সব বলবে। মরার আগে আর মানুষের ইগো থাকে না। আবেগের আর অহংকার নেই মনে। এখন শুধু ভয় ভর করে আছে মন ও মস্তিষ্কে৷
জানালার দিকে এগিয়ে গেল আবেগ। বিকেল হয়ে আসছে। কিছু কিছু পাখি আকাশে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উড়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছে। নীড়ে ফেরার পালা তাদের। আবেগের মনে হয়, পাখিদের সাথে মানুষের একটা সুক্ষ্ম মিল আছে। পাখিরাও ভোরে বাসা থেকে বের হয় এবং সারা দিন টৈটৈ করে ঘুরে আবারো বিকেল বেলা বাড়ি ফিরে যায়৷ মানুষ ও ঠিক তাই করে!
কাউকে যদি জিজ্ঞেস করে হয়, আপনার পার্মানেন্ট ঠিকানা কি?
কেউ বলবে, আমার বাসা মিরপুর শেওড়া পাড়া বনফুলের গলির ভেতরে। আবার কেউ বলবে আমার বাসা গুলশান ডিসিসি মার্কেটের অপজিটে৷ কিন্তু আবেগকে যদি এই প্রশ্ন করা হয় সে উত্তরে বলবে, কবর।
আচ্ছা ওইসব পাখির মতো কি তার ও জীবনে বিকেল বেলা চলে এলো? এখন কি তার নীড়ে ফিরে যেতে হবে। তার বুক ধুক করে উঠে। পাখিদের মতো কি সে বুঝতে পারছে যে তার জীবনে বিকেল চলে এসেছে? কি জানি! সে তো পারছে না বুঝতে।
এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে সে বলে উঠে, রোদেলা জানো? ছোট থেকে দেখেছি মা সারাদিন বাসায় থাকে। বাইরে কোন প্রয়োজন ছাড়া বের হননা। আমি এইসব দেখেই অভ্যস্ত। মামী-চাচীরাও মায়ের মতোই সারা জীবন ভাত রান্না করতেই ব্যস্ত — এটা দেখেই বড় হয়েছি। আমার মনে হয়, আমার মতো অনেকেই আছে। তোমাকে প্রথম দেখাতেই খুব পছন্দ হয়। আমার মেডিকেলে পড়তে একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। এটা তো তুমি জানোই! নতুন করে বলার কিছু নেই। ওর সাথে সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর আমার বিয়ের জন্য অনেক মেয়ে দেখা হয়। কাউকে পছন্দ হত না। কিন্তু তোমাকে এক দেখায় পছন্দ হয়ে যায়। দ্রুত বিয়েও হয়ে যায় আমাদের। প্রথম প্রথম ভাবতাম এতো দ্রুত ঝোকের মাথায় বিয়ে করে ভুল করিনি তো? কিন্তু খুব দ্রুত আমার এই ভুল ভাংলো। তুমি খুব সাংসারিক ছিলে। ইনফ্যাক্ট এখনো আছো। কিন্তু প্রথম থেকে তোমার আর আম্মার মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। আম্মা তোমাকে সহ্য করতে পারত না। এর কারন হলো আমার প্রাক্তন। আমার প্রাক্তন আর কেউ না! আমার খালাতো বোন ছিল। আমাদের সম্পর্কের ছিন্নতার জন্য মা আর খালার মধ্যে সমস্যা হয়েছিল। এজন্য আম্মা চাইত আমি যেন ওকেই বিয়ে করি আর সব যেন ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু আমার পক্ষে তাকে বিবাহ করা অসম্ভব ছিল। কারনটা জানতে চেও না প্লিজ। আমি বলতে চাই না। কিছু কিছু কথা বলা যায় না। এটাও তেমনি একটা বিষয়। আম্মা এজন্য তোমাকে দেখলেই রেগে যেত।
— তোমার খালার সঙ্গে যোগাযোগ নেই আর?
— খালা অনেক আগেই মারা গেছেন। আর ওর।বিয়েও হয়েছে। দুইটা মেয়েও আছে। যোগাযোগ হয় না। কিন্তু খবর নিয়েছি৷
— সুলতানা খালার কথা বলছো তাই না?
— হুম।
— ওনার ব্যাপারে আম্মা কোন দিন ই কিছু বলত না। শুধু নামটাই জানি।
— আচ্ছা। এবার শুনো, তোমার সাথে বিয়ের পর আমি খুব সুখী ছিলাম। আমাদের কোল জুড়ে সমুদ্র আসে। খুশির সীমা নেই। এর মধ্যে ইভানার বিয়ে হয়। বাচ্চাও হয় ওর। কিন্তু ইভানা তার হ্যাসবেন্ডর সঙ্গে ঝগড়া করে চলে এলো আমাদের বাসায়। তখন সংসারের দায়িত্ব আমার কাধে। আব্বা অবসরে চলে গেছেন। পেনশনের টাকা আর গ্রামের জমি বেচা টাকায় ইভানার বিয়ে আর ফ্লাট কেনা হয় । দুইটা ফ্লাট কিনেছিল আব্বা। । একটা হচ্ছে এই বাসা যেটায় আমরা থাকছি আর একটা ইভানার জন্য। আব্বার হাত ফাকা তখন। শেষ বয়সে সব সঞ্চয় শেষ করেন তিনি । তার দায়িত্ব স্বাভাবিক ভাবে তার ছেলের । বয়ষ্ক মানুষ তিনি। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকত। তখন আমি মাত্র প্রাকটিস শুরু করেছি। যেখানে বসতাম সেখানে কালে-ভাদ্রে রোগী আসত। তখনো ডাক্তার হিসেবে পরিচিত পাই না। ডাক্তার পেশাটায় অনেক বছরের পরিশ্রমের পরে কেউ সাকসেস হয়। নাম কামায়। অসুস্থ হলে আমরা বেস্ট ডাক্তার খুজি। এই বেস্ট ডাক্তার হওয়ার জন্য আমাদের বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। তখনো আমি সার্জন ডাক্তার হইনি। এমবিবিএস দিয়ে বিসিএস পরীক্ষা দিলাম, টিকে গেলাম আর ভাগ্য সহায় হয়ে সরকারি চাকরি পেলাম। এরপর দিন যেতে লাগে।
সরকারি চাকরি আমার। বেতন খুব বেশিও না। আবার কম ও না। সব মিলিয়ে হিমশিম খেয়ে যাই। আমার খুব শখ ছিল ছেলেকে ভালো নামকরা স্কুলে পড়াব। বেটার লাইফ, বেটার এডুকেশন দিব। এটা সব বাবা-মারাই চায়। এমন সময় আমার শ্বশুড় আব্বা অসুস্থ হয়ে গেল। আমার যা সেভিংস ছিল, বাবার শূন্য হাতে যা ছিল সব মিলিয়ে চিকিৎসা হয়। তখনি ইভানা চলে আসে। আমাদের একটা ক্রাইসিস চলছিল তখন। এরপর আবারো মেঘের আর্থিক সমস্যা হয়। এটার ব্যাপারে তুমি আমাকে কিছু বলো নি। তখন তুমি চাকরি করতে চাইলে। আমি রাজী হলাম। আমার ধারণা ছিল তুমি জব করলে আমরা আরও বেটার লাইফ পাব। আরো আরাম-আয়েশ পাব। জব করলে মন্দ হয় না তো! কিন্তু ওই যে, আমি বাঙালী পুরুষ। ছোট থেকে মাকে-চাচীকে ঘরে দেখেছি। বিয়ের পর অনেক বছর তুমি বাসায় ছিলে। মানে এক কথায়, আমি অফিস যাওয়ার আগে তোমাকে আমার জন্য ব্যস্ত দেখায় অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু তুমি অফিস যাওয়া শুরু করলে আমার সঙ্গে বের হতে। প্রাইভেট জব। মাঝে মাঝে আমার পরে আসতে। তোমাকে আর আগের মতো কাছে পেতাম না। তখন মনে হত, তুমি চাকরি না করলেই বুঝি ভালো হত৷ এর মধ্যে আগমন ঘটে রিশাদের। আমি তো আর সব সত্যি জানতাম না। তুমি নিজেকে অফিসে ডির্ভোসী পরিচয় দিয়ে এটা শুনে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায় আমার। তোমাকে অবিশ্বাস করি। তার মধ্যে তোমার বিদেশ যাওয়ার খবরে রাজী হচ্ছিলাম না। নিজের ইগোতে বাধছিল ব্যাপার টা। তুমি যদি আমাকে প্রথেমেই বলতে অফিসে টাকা লোন নিয়েছো, মেঘের টাকা প্রয়োজন, বা রিশাদের পরিচিত কারো কাছে হেল্প নিচ্ছো এসব জানলে আর কখনোই সন্দেহ করতাম না তোমাকে। কিন্তু তুমি বলো নি। স্বামী হিসেবে আমার বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু আমি রেগে গিয়েছিলাম। বোঝার চেষ্টা করিনি। ওই সময় আমাদের যেমন ফিনালশিয়াল ক্রাইসিস চলছিল তেমনি ইভানার ঘর ভাংবে জন্য মানসিক অশান্তি । এজন্য তুমি হয়তোবা আমার উপর প্রেশার বাড়াতে চাও নি। তুমি তোমার জায়গায় ঠিক ছিলে। আমি তোমার জায়গায় থাকলে অবশ্য ই নিজের ভাই বা বোনের প্রতি দায়িত্ব পালন করতাম। এখানে দোষের কিছু নেই। আমি এটাও জানি সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। যেমন তুমি লোন নিয়েছো এজন্য তোমাদের মূল্যবান সম্পদ কিছু একটা বন্দক রাখতে হবে। ঠিক মতো পেইড না করলে একশন নিবে। তুমি ঝামেলা এড়ানোর জন্য থাইল্যান্ড যেতেও রাজী হয়েছিলে কারণ জব ছাড়ার আগে সব লোন ক্লিয়ার করা লাগে। এগুলো যদি তুমি আমাকে আগেভাগেও বলতে তবে কোন সমস্যা নাই হত না। কিন্তু হয়ে গেছে।
আসলে ফিজিক্সে একটা সূত্র আছে তাহলো আগে Cause পরে Effect. এটাই জগতের নিয়ম। কিন্তু আমাদের বেলায় আগে effect বা প্রভাব পড়েছে পরে কারন জানতে পেরেছি। পর্দাথ বিজ্ঞানের সূত্র না মানলে তো বিনাশ ঘটবেই। আমাদের ও দুর্দশা চাপে এজন্য।
এরপর পিউয়ের জন্ম হলো। মেয়েকে কোলে নিয়ে আমার সব রাগ পড়ে যায়৷ কিন্তু ততোদিনে আমাদের মধ্যে একটা দূরত্ব চলে এসেছিল। রাগ ভাংলেও অভিমান টা যেন মনের ভেতর কেউ খোদাই করে দিয়েছিল।তুমি কল না দিলে আমিও কল দিতাম না নিজ থেকে। এমন ভাবে চলছিল দিন গুলো।
একটা সম্পর্কে অভিমান চলে এলে সেই সম্পর্ক টা টিকিয়ে রাখা দুষ্কর হয়। কারন কি জানো? কষ্ট, দুঃখ, রাগ এইসবই দুই শব্দে মাধ্যমে লিখিত অনুভূতি কিন্তু অভিমান চারটা শব্দ মিলে তৈরি হয়। কাজেই এর পাল্লা অন্য সব অনুভূতির চেয়ে ভারী।
আমরা সেপারেশন নিতে পারিনি। পিউ হওয়ার পর, সমুদ্র আর পিউয়ের জন্য আর সেই পথে আগাই নি।
কিন্তু অনেক বছর আলাদা ছিলাম।ফোনে যোগাযোগ হত। মেয়েকে দেখতে আমি থাইল্যান্ড ছুটে যেতাম।পারলে প্রতি মাসেই একবার যাওয়ার জন্য মন আকুপাকু করত। মেয়ের নরম হাত ছোয়ার জন্য অস্থির থাকতাম৷ কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে প্রতি মাসে থাইল্যান্ড যাওয়া তো আর সম্ভব না। অফিস সামলিয়ে রেগুলার যাওয়া হত না। এরপর পিউ কিছু টা বড় হলে তোমার আমেরিকা পোস্টিং হয়। সমুদ্র তখন তোমার সাথে রাগ করে ছিল। সেই সময় টা আমার ক্যারিয়ারের জন্য গোল্ডেন টাইম ছিল। চিটাগং এ খুব নাম করে ফেলি আমি। সব মিলিয়ে ব্যস্ততার জন্য আমেরিকা যেতে পারতাম না। তুমি আসবে এর ও উপায় নেই। মেয়ের পড়ালেখা শুরু হয়ে যায়। স্কুল, কলেজ, মেডিকেল শেষ করে পিউ অবসর পায়।আর সাথে সাথেই অবশেষে এতো বছর পর ফিরে এলে তোমরা। আমাদের জীবন টা ছন্নছাড়ার মধ্যেই কেটে গেল। দুঃখ হয় মাঝেমধ্যে। ভাবি ইশ যদি তোমাকে অবিশ্বাস না করে একবার বোঝার চেষ্টা করতাম। বসে ঠিক মতো কথা বলতাম। তোমার কথা শুনতাম তাহলে হয়তোবা এমন হত না। জীবন টা অন্য রকম হত আমাদের
ওপাশ থেকে রোদেলার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে আবেগ ও চোখ বুজে ফেলে। সে রোদেলার দিকে তাকালো না। তাকাতে ইচ্ছা করছে না তার। থাক। কাদুক কিছু ক্ষন। কাদলে মন হালকা হবে।
★★★
শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে তার বাবার সামনে। বাবা প্রচুর রেগে আছেন। শ্রাবণ ভয়ে শেষ। আজকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ও মা নেই। কি হবে এখন? এদিকে আয়েশা অযথা কেদেই যাচ্ছে।
সে কেদে কেদে শৌখিন সাহেব কে অভিযোগ করল, শ্রাবণ নাকি প্রায় ই তার সঙ্গে মিসবিহেইভ করে। শ্রাবণের তার নজর ভালো না। সেদিন অফিসে ইচ্ছা করে আয়েশাকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখেছিল।
শ্রাবণ কটমট করে আয়েশার দিকে তাকালো। আয়েশা চোখের পানি নাকের পানি এক করে বলে, আর আজকে,,,,, আজকে তো আমার নিজের বাসায় কুপ্রস্তাব দিচ্ছিলো। ও নাকি আমাকে খুব পছন্দ করে।
ফুপু তেরে এসে বলে, তুই জানিসনা রে ভাই। সেদিন শ্রাবণ আয়েশাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে রেস্টুরেন্টে ওর সাথে খারাপ কিছু করেছে।মেয়ে আমার মুখে কিছু বলে নি৷ কিন্তু আমি তো মা। সব বুঝি। আয়েশা সেদিনের ঘটনার পর কি কান্না বাসায় এসে।
শৌখিন সাহেব ধপ করে বসে পড়ে হতাশ গলায় বলে, আমার ছেলে এমন কিভাবে করতে পারে?
শ্রাবণ কিছু বলবে আর আগেই তার ফুপু বলে উঠে, তোর যুবক ছেলে আর আমার সুন্দরী মেয়ে , কাছাকাছি থাকলে তো এমন ঘটনা ঘটাবেই। আগুনের কাছে কোন দিন কেরোসিন রাখতে নেই৷ আগুন আর কেরোসিনকে পাশাপাশি রাখলে তো কেলেঙ্কারী ঘটবেই!
— এখন উপায়?
— পানি ঢালতে হবে৷
— মানে?
— ওদের বিয়ে দিয়ে দে। তাইলে তোর ছেলে শান্তি পাবে৷
শ্রাবণ একথা শুনে থ হয়ে যায়। তার মনে হচ্ছে, তার পায়ের তলা থেকে মাটি নাই হয়ে গেছে৷
চলবে।