প্রেমমোহ পর্ব-০৯

0
415

#প্রেমমোহ
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_৯

গাড়ি থামিয়ে একটা কাগজ বের করে জিজ্ঞাসা করলো স্পন্দন,

–” কে উনি?”

শুভ্রতা কাগজের দিকে তাকিয়ে মুখটা মলিন করে বলল,

–” আমার আব্বু। কেন আপনি দেখছেন না বাবার নামে লিখা?”

–” মূর্খ নই আমি। আপনার আম্মুই তাহলে সেই জাহানারা বেগম? যার জন্য ইমতিয়াজ আহমেদ আমাকে অবহেলা করেছে। তো উনারা কোথায় এখন?”

শুভ্রতা বেশ অবাক হলো। তবে সে স্পন্দনের কথার মানে বুঝতে পারছে না।

–” আমার আব্বু আম্মু মারা গিয়েছেন অনেক আগে। যখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয় তখন ।”

স্পন্দনের চোখ ভিজে উঠলো। কাল বৈশাখীর ঝড়ের মতো বইতে লাগলো মনে। আকাশ ভরা দুঃখ তার মনকে বারবার বলছে,

–” স্পন্দন, দেখ যাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তুই নিজেকে শক্ত,কঠিন, রোবট তৈরি করেছিস এখন সেই মানুষটাই নাকি এই পৃথিবীতে নেই। এখন কি করবি তুই? নিজেকে শক্ত করে তৈরি করার জন্য অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়েছে তোকে। সেই ত্যাগের বিনিময়ে কি পাবি এখন তুই? কিছুই না বরং শুন্য।”

স্পন্দনের ইচ্ছা করছে জোরে চিৎকার করে কান্না করতে। তার চোখের পানিতে যেন তার কষ্টটা হারিয়ে যাক। চিৎকার করে কান্না করলে যদি বুকের ভিতরে থাকা পাহাড় সমান পাথরের ওজন হাকলা হয়ে উঠুক। শুভ্রতা অবাক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার চোখে হাজারো প্রশ্ন। স্পন্দনের সাথে তার বাবা মায়ের কি এমন সম্পর্ক যার জন্য মানুষটি কান্না করছে? স্পন্দন কান্না করার ছেলে নয় তাহলে কি হয়েছে তার?

–” আপনি কান্না কেন করছেন? তাছাড়া আমার বাবা মায়ের সাথে আপনার কি সম্পর্ক?”

রাগী এবং কান্না মিশ্রিত চোখে শুভ্রতার দিকে তাকালো স্পন্দন। তার ইচ্ছা করছে বাবা মায়ের শাস্তি এখন শুভ্রতার উপরে ফেলতে। কথায় আছে বাবা মায়ের পাপের ফল সন্তানে ভোগ করে। আচ্ছা কি সে শুভ্রতাকে খুন করবে? খুন করলে কি আদো তার বুকের ভিতরে জমে থাকা কষ্ট, অভিমান, কাছের মানুষের অবহেলা ভুলতে পারবে? নাহ সে পারবে না। গাড়ির দরজা খুলে ঝুমঝুম বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ নিয়ে চোখ দুটি বন্ধ করে কান্না করছে সে। হ্যাঁ এখন স্পন্দন নীরব কান্না করছে কারণ ছেলেদের কান্না মানায় না তাও আবার একটি মেয়ের সামনে। নীরব কান্নার মাঝে রয়েছে অসংখ্য ঘৃণা। যে ঘৃণার নেই কোনো অভিযোগ আছে শুধু প্রতিশোধ। বৃষ্টির পানির সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে স্পন্দনের চোখের পানি।

শুভ্রতা ভয়ে বের হচ্ছে না। স্পন্দনের ভয়ানক চোখ এখনও তার চোখের সামনে ভাসছে। কিন্তু স্পন্দনকে অনেক্ষন এইভাবে ভিজে থাকতে দেখে সেও আর বসতে পারলো না। দরজা খুলে বের হয়ে গেলো। শুভ্রতার একটুও মনে নেই তার গায়ে সাদা জামা। স্পন্দনের পিছনে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে স্পন্দনের ঘাড়ে হাত রাখতেই স্পন্দন পিছনে ঘুরল। শুভ্রতাকে দেখে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। এক প্রকার নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে জড়িয়ে ধরলো শুভ্রতাকে। জড়িয়ে ধরে বলছে,

–” কেন করলে আমার সাথে এমন? বেঁচে থাকতে আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছো। না ফেরার দেশে চলে গেলে কিন্তু আমি জানি না। তোমাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছা করে চাচ্চু। ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে। আমাকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে মিসেস জাহানারা বেগম। এই মহিলাকে আমি জীবনও ক্ষমা করব না। এই মহিলার কারণেই তোমাকে, আমাকে ছাড়তে হয়েছে। যখন ছোট ছিলাম কাঁধে নিয়ে ঘুরতে যেতে, সব সময় বলতে, আমিই তোমার ছেলে, সাত রাজার মানিক আমি তোমার। আব্বুর থেকে তুমিই ছিলে আমার সেরা বন্ধু। আমাকে ছাড়া তোমার পেটে ভাত যেত না আর সেই আমিটাকে তুমি ভুলে গেলে? নারী যেমন সংসার গড়তে পারে তেমনভাবে নষ্টও করতে পারে। ওই মহিলা তোমার জীবনে আসার পর থেকেই তুমি চেঞ্জ হয়ে গেছো চাচ্চু। এতটাই চেঞ্জ হলে একদম না ফেরার দেশে চলে গেলে এই বুঝি তোমার আমার প্রতি ভালোবাসা। কখনো তোমাদের ক্ষমা করবো না আমি।”

স্পন্দনের কথা শোনে শুভ্রতা যেন পাথর হয়ে গেলো। কি শুনছে ও? তার বাবা স্পন্দনের চাচা। তাহলে তার মা কি করেছিল যার জন্য স্পন্দন তার মাকে দেখতে পারে না। মেয়ে জাতির প্রতি তার এত ক্ষোভ। শুভ্রতা ওর মামীর কাছ থেকে জেনেছে, তার বাবা মায়ের প্রেমের বিয়ে। প্রেমের বিয়েতে আলাদা হবার কি আছে? শুভ্রতার মাথা যেন কাজ করছে না। আর কিছু নিতে পারছে না সে। একের পর এক বজ্রপাত তার উপরে এসে পড়ছে। আকাশের সত্যতা তার জানা উচিৎ এখন আবার নিজের বাবা মায়ের সত্যতা। হঠাৎ তার মনে হলো মিসেস সাবিনা বেগমের কথা। শুভ্রতা মনে মনে বলল,

–” তাহলে কি আন্টি আমার মুখের সাথে আমার আব্বুর মিল পেয়েছিল। হ্যাঁ অনেকে বলতো আমি দেখতে আব্বুর মত হয়েছি। আব্বুর মত হওয়াতে বুঝি আঙ্কেল আমায় পছন্দ করেন না। কিন্তু কেন? ছোট ভাইয়ের প্রতি কিসের ক্ষোভ উনার? জানতে তো আমাকে হবেই।”

স্পন্দন শুভ্রতার থেকে সরে দাঁড়ালো। শুভ্রতার দিকে তাকিয়েই চোখ জোড়া নামিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

–” আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন। আশে পাশে অনেক লোকজন আসা শুরু করেছে।”

স্পন্দনের কথা শোনে শুভ্রতা নিজের দিকে তাকালো। লজ্জায় তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসলো। ওড়না দিয়ে বৃথা চেষ্টা করলো শরীর ঢেকে রাখার। স্পন্দন নিজেকে শান্ত রেখে গাড়িতে উঠে বসলো। স্পন্দনকে দেখে শুভ্রতার ভীষণ অস্বস্তি শুরু হলো। স্পন্দন কিছুটা আঁচ করে গাড়ি থেকে রেইনকোট বের করে শুভ্রতার দিকে না তাকিয়েই বলল,

–” গাড়িতে সব সময় থাকে। কখন কি বিপদ আসে বলা মুশকিল। আপাতত এইটা পরে অস্বস্তি বোধ কাটিয়ে ফেলুন কজ এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

শুভ্রতা কোটটা দ্রুত গতিতে পরে নিল। কাঁপা গলায় বলল,

–” ধন্যবাদ। কিন্তু আমার বাবা মায়ের সম্পর্কে যদি একটু ক্লিয়ার করে কিছু বলতেন ভালো হতো।”

রাগী চোখ দুটি নিক্ষেপ করলো শুভ্রতার দিকে স্পন্দন। শুভ্রতা চোখ দেখেই চুপসে গেলো। কোনো কিছু জানার ইচ্ছা তার মন থেকে নিমিষেই টাটা বায় বায় হয়ে গেলো। ভয়ে ভয়ে বলল,

–” না না কিছু জানার ইচ্ছা আমার নেই। আপনি দুটো চোখ ঠিক করে গাড়ি চালান।”

বিদ্যুতের গতিতে চলছে গাড়ি। শুভ্রতার ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করার উপক্রম। সে ভাবছে এই হয়তো তার মৃত্যু হবে। বিড়বিড় করে বলল,

–” আচ্ছা এখন যদি এই জল্লাদ লোক আর আমি অ্যাকসিডেন্টে করে মারা যাই তাহলে এইটা সুইসাইড হবে? আমি তো নিজের ইচ্ছাতে এখন মরতে চাচ্ছি না। এই জল্লাদ লোকটাই তো মারতে চাচ্ছে। ওয়েট গুগল বাবার কাছ থেকে জেনে আসি।”

গুগলে বিড়বিড় করে ও
কথা বলতে যাবে কিন্তু গুগল বুঝছে না। স্পন্দন শুভ্রতার এমন বিহেভ দেখে জিজ্ঞাসা করলো,

–* সমস্যা কি আপনার?”

–” কই না তো আমি তো গুগলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সে কবে বিয়ে করবে উত্তরে গুগল বলল, হতচ্ছাড়া আমার বিয়ের চিন্তা তোর করতে হবে না।”

শেষের কথাটা জোরে বলাতে গুগলে উঠে পড়ল। হঠাৎ করেই এর উত্তর আসলো,

“মেয়েদের সাথে ভদ্রভাবে কথা বলুন। জানেন না আজকাল মেয়েদের সম্মান কোথায়?”

শুভ্রতার কথা শোনে স্পন্দনের ভীষণ হাসি পাচ্ছে। অবশেষে হাসি আটকে রাখতে না পেরে আকাশ কাঁপানো হাসিতে মেতে উঠলো সে । সন্তোষ কালওয়ার বলেছেন, বিজ্ঞান ভাবতে শেখায় কিন্তু প্রেম হাসি শেখায়।” তাহলে কি স্পন্দন প্রেমে পড়েছে? নাহ সে প্রেমে পড়েনি। হাসিটা ছিল ক্ষণিকের জন্য। ক্ষণিকের জন্য হাসি কখনো প্রেম বলে গণ্য করা হয় না।

— জানেন আপনার হাসিটা ভীষণ সুন্দর। আপনার নিজের হাসির কারণে আপনি জীবনকে আরও সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারবেন। গম্ভীর হয়ে থেকে নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছেন। হাসেন না প্রাণ খুলে।”

শুভ্রতা কথাগুলো মনেই বলল। মুখে বলার সাহস তার নেই। যদি স্পন্দন তাকে রেগে গিয়ে থাপ্পড় মারে তাহলে তো সে শেষ।

চলবে,

বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।