প্রেমের ঐশ্বর্য পর্ব-৫৩+৫৪

0
232

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৫৩

জঙ্গল ধরে ছুটে চলেছে ঐশ্বর্য ও প্রেম। নিজের হাতটা দিয়ে শক্ত করে ঐশ্বর্যের হাতটা ধরে রেখেছে প্রেম। দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠল তারা। দাঁড়িয়ে পড়ল একটা বড় গাছের নিচে। আঁধার রাতে আশপাশ পুরোটা অন্ধকার। আবছা আলোয় যতটুকু দেখা যাচ্ছে সেটা ধরেই ছুটতে হচ্ছে। ঐশ্বর্য হাঁপিয়ে উঠে বলল,
“হয়েছে। আর দৌড়াতে হবে না। কেউ আসছে না আমাদের পেছনে।”

“এখন অনেক রাত। কত কিছু থাকতে পারে জঙ্গলে তা তো জানা নেই। তাছাড়া ডেভিলদের পানীয় এর সাথে যা মিশিয়েছো সেটা মাত্র দুই প্রহর অবধি কাজ করবে। তারপর সবাই জেগে যাবে। এর মধ্যে অনেক কাজ সাড়ার আছে।”

কথাটা শোনামাত্র সরু চোখে দৃষ্টিপাত করল ঐশ্বর্য প্রেমের দিকে। ফট করে নিজের হাত প্রেমের হাতের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তেতে উঠে বলল,
“অনেক কাজ মানে? কি কাজ সাড়ার আছে আবার? তুমি বলেছো তুমি আমার মা-বাবার সাথে দেখা করাবে। আর কি কাজ করতে চাইছো? তুমি আমাকে মিথ্যে বলে নিয়ে আসো নি তো? তোমার উদ্দেশ্য অন্যকিছু নয় তো?”

এবার হতাশ চোখে তাকালো প্রেম। মেয়েটা এখনো তাকে সন্দেহ করছে। চোখমুখ কুঁচকে বুদ্ধি করে মুখভঙ্গি ফের স্বাভাবিক করে ঐশ্বর্যের দিকে ঝুঁকে পড়তেই চোখ গোল গোল হয়ে এলো ঐশ্বর্যের। চোখমুখ শুকিয়ে এলো। প্রেম ঠোঁট চেপে বলল,
“ঠিকই ধরেছো রাণী সাহেবা! আমার উদ্দেশ্য তো অন্যকিছুই। তবে তুমি আমার উদ্দেশ্য বুঝতে দেরি করে ফেলেছো।”

কথাটা বলেই ঐশ্বর্যের আপাদমস্তক দেখতেই চোখ বড় বড় করে নিজের হাতটুকু নিয়ে ঢাকার চেষ্টা করল ঐশ্বর্য। প্রেম বড় একটা নিশ্বাস নিল অন্যদিক মুখ ফিরিয়ে। অতঃপর এক হাতে ঐশ্বর্যের কাঁধ চেপে ধরল। দাঁতে দাঁত খিঁচে বলল,
“স্টুপিড গার্ল! আমি তোমাকে তোমার মা-বাবার সাথে দেখা করাতেই নিয়ে যাচ্ছি।”

“সত্যি তো?”
তবুও ভ্রু কুঁচকে সন্দেহি নজরে প্রশ্ন করে ঐশ্বর্য। প্রেমের মস্তিষ্ক তখন এলোমেলো হতে থাকে। মেয়েটা দিনকে দিন গোয়েন্দা হয়ে যাচ্ছে। ঐশ্বর্যের হাতের বাহুতে হঠাৎ করে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে নেয় প্রেম। আর বলে ওঠে,
“সত্যি। তোমাকে ছুঁতে বা ভালোবাসতে আমার অন্য কোনো বাহানার দরকার হবে না।”

এতটুকু বলা শেষ করেই ঘাড় কাত করে ঐশ্বর্যের ঠোঁটের এক কোণে নিজের ঠোঁটের পরশ সযত্নে এঁকে দেয় প্রেম। ঘাড় সোজা করে ঐশ্বর্যের ঘোর কাটতে না কাটতে বলে ওঠে,
“যেমন এখনো পড়ছে না।”

থতমত খেয়ে তাকায় ঐশ্বর্য। রীতিমতো কাশতে থাকে। সেই সাথে প্রেমকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,
“আমি শুধু আমার মা-বাবার সাথে দেখা করব বলে চুপ রয়েছি। নয়ত এতোক্ষণে…”

কথাটুকু অসম্পূর্ণ রেখে চোখ রাঙায় ঐশ্বর্য। প্রেম মৃদু হেঁসে বলে,
“কি করতে? মে’রে ফেলতে? এই কথাটা অনেকবার শোনা শেষ।”

ঐশ্বর্য আরো কিছু বলতে চাইলো। তবে প্রেম আশেপাশে তাকিয়ে ঐশ্বর্যের হাতটা পুনরায় নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“সময় নেই। লেটস গো!”

বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে মাধুর্য। মাঝে মাঝে দুর্বলভাবে কেশে উঠছে। পাশেই তার ডান হাতটা ধরে নিজের ঠোঁটের সাথে লাগিয়ে একধ্যানে বসে রয়েছে অনুভব। কপালটা চিন্তায় কুঁচকে গেছে। নীল চোখজোড়া ভীষণ অস্থির ও বিচলিত। নিজের প্রেয়সীর এই অবস্থা চোখে দেখা যাচ্ছে না। পুরোপুরি চোখ খুলতে পারছে না মাধুর্য। বারবার অনুভবের দিকে আধো চোখ মেলে তাকিয়ে আকুতি ভরা কন্ঠে বলে উঠছে,
“ঐশ্বর্য! আমার মেয়েটা কখন আসবে?”

“এসে যাবে। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। রাজবৈদ্য বলেছে, তুমি নাকি বাঁচার আশায় ছেড়ে দিয়েছো। নিজের প্রাণটাকে নিজের থেকে আলাদা করতে চাইছো। কেন এমন করছো মাধুর্য?”

মাধুর্য তার জবাব দিল না। উল্টে দুর্বল গলায় ধীর কন্ঠে বলল,
“আমার ঐশ্বর্য কি আসবে না? তুমি বার বার আমাকে এই কথা বলে রাখছো যে ও আসবে। কিন্তু ও আসছে না। তুমি কেন মিথ্যে বলছো আমাকে?”

অনুভব জবাব দিতে না পেরে চোখ বুঁজে ফেলে। মাধুর্য গতকাল ডেভিল রাজ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল। তবে প্রবেশদ্বারের ভয়াবহ আগুন অতিক্রম করতে পারেনি। যার ফলে সেই আগুনের তাপে তার শরীরে অনেকটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে। আর ডেভিল কিংডমের প্রবেশদ্বারের আগুনের শক্তি অনেকটা। যা একটা ভ্যাম্পায়ারের সহ্য ক্ষমতার বাহিরে। এটি একটা ভ্যাম্পায়ারকে মৃ’ত্যু অবধি দিতে পারে। ঠিক এই কারণেই ভ্যাম্পায়ার কিংডমের কেউই সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। ঠিক তখন থেকেই মাধুর্য বিছানায় পড়ে রয়েছে। অনুভবও কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। প্রেম কেমন আছে, আদেও বেঁচে রয়েছে কিনা সেটারও খবর তার জানা নেই। এই অবস্থায় নিজের মেয়েকে কি করে উদ্ধার করবে সেটার উপায়ও সে জানে না। এবার নিজেকে বাবা হিসেবে ব্যর্থ মনে হচ্ছে। মাধুর্য বিরবির করছে এখনো। চোখ খুলে মাধুর্যের বড় বড় দুটো চোখের দিকে তাকায় অনুভব। হরিণী চোখদুটো নেতিয়ে গেছে। ঠোঁটজোড়া কেমন যেন শুঁকিয়ে গেছে।

ভালো করে মাধুর্যকে পর্যবেক্ষণ করতেই অনুভবের কানে এলো কলিং বেলের শব্দ। তাতেই ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো তার। দেয়ালে থাকা বড় ঘড়ির দিকে তাকালো। অনেক রাত! এতো রাতে কে? চোখ ঘড়ির থেকে সরিয়ে মাধুর্যতে আবারও মনোনিবেশ করল। এই মূহুর্তে তাকে ছেড়ে উঠে যেতে ইচ্ছে করছে না অনুভবের। তবে এতো রাতে কে এসেছে সেটা দেখা প্রয়োজন। কিছুক্ষণ বসে থেকে মাধুর্যের হাতটা বিছানায় রেখে যেই না বসা থেকে উঠতে যাবে তৎক্ষনাৎ ঘরে ঝড়ের মতো প্রবেশ করল এলিনা। চমকে উঠল অনুভব কিছুটা। বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাতেই এলিনা এক নিশ্বাসে বলে উঠল,
“কি…কিং! কে এসেছে দেখুন! অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটেছে।”

একটু থেমে দুর্বল মাধুর্যের দিকে চেয়ে এলিনা উত্তেজনা নিয়ে বলল,
“কুইন, আপনার চোখের মনি আবার আপনার কাছে এসেছে।”

অনুভব কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সন্দিহান নজরে তাকিয়ে থাকতেই দরজার কাছে উপলব্ধি করে কারো উপস্থিতি। ঘার ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায় প্রেম। সে একা নয়। কারো হাত ধরে রয়েছে শক্ত করে। শান্ত ভঙ্গিতে এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে ঘরে পদার্পণ হয় ঐশ্বর্যের। কালো পোশাকে, কোঁকড়ানো খোলা চুলে, বিস্ময় নিয়ে আশপাশ দেখে চলেছে সে। কতদিন পর অনুভব তার মেয়ের দেখা পেল। চোখ, হৃদয় এবং সমস্ত শরীর যেন ঠান্ডা হয়ে এলো। বুক থেকে কেমন যেন ভারি কিছু একটা সরে গেল। কাঁপা সুরে ঐশ্বর্যকে ডেকে উঠল,
“মাই প্রিন্সেস ঐশ্বর্য!”

ঐশ্বর্য এতোক্ষণ বাড়ির আশেপাশের সবটা দেখছিল। মস্তিষ্কে হানা দিয়ে চলেছিল অতীতের সব স্মৃতি। চোখ দুটো ঘোলা হয়ে এসেছিল। তবে যখন কানে ভেসে এলো এক অচেনা তবুও চেনা কন্ঠ উৎকন্ঠা হয়ে তাকালো সামনের দিকে। সে যেন তারই প্রতিচ্ছবি দেখছে। তার মতোই অগভীর নীল কাঁচের পানির মতো নেত্র দুটো! নাক দুটো হুবহু তার মতোই খাঁড়া। ভ্রু দুটো চিকন। ছোট কপাল। এ যেন তারই অনুরূপ। শুধু সামনের মানুষটা পুরুষ। তখনই ঐশ্বর্যের স্মরণে এলো প্রেমের দেখানো ছবিতে এই লোকটিই তো ছিল। প্রেম ঐশ্বর্যের হাতটা সেই মূহুর্তে ছেড়ে দিল। ঐশ্বর্য না চাইতেও এগিয়ে এলো অনুভবের দিকে।

অনুভব বড় একটা দীর্ঘ নিশ্বাসের মাধ্যমে ভেতরে জমে থাকা সমস্ত ভার যেন ছেড়ে নিল। না চাইতেও চোখে টলটল করতে থাকলো পানি। মেয়েকে এগিয়ে আসতে দেখে তার দুটো গালে স্নেহের সাথে হাত রাখলো অনুভব। ঐশ্বর্য অনুভবের অগভীর চোখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে। অদ্ভুত শান্তি উপলব্ধি করতে পারছে সে। হুট করে অনুভব তাকে জড়িয়ে ধরল। আর বিচলিত হয়ে বলল,
“আমি তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। বাবা হিসেবে আমি ব্যর্থ। তোমাকে সেই বিপদ থেকে বাঁচাতে না পেরে আমি ভেতর থেকে ম’রে গেছি। আমি ভাবতে পারিনি প্রেম ফিরিয়ে আনবে। তুমি আমাদের জীবন ঐশ্বর্য মা!”

অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল ঐশ্বর্যের। তার বাবা তাকে জড়িয়ে ধরেছে। ঐশ্বর্য এখনো কিছু বিশ্বাস করতে পারছে না। কিছুক্ষণ নিরব থেকে কিছু একটা ভেবে সে নিজেও বাবাকে জড়িয়ে ধরল। চোখটা বুঁজে এলো আপনাআপনি। চোখের সামনে ভাসমান হলো কিছু অদ্ভুত দৃশ্যের। একটা ছোট্ট মেয়ে! সবে হাঁটতে শিখেছে। কোঁকড়ানো চুল বাতাসে উড়ছে আর শব্দ করে হাসছে। হেঁসে নিজের বাবার দিকে কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে যাচ্ছে সে। তার বাবাও তাকে ধরতে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তখনি ঐশ্বর্যের মনে হলো এইতো তার ছোটবেলা! ছোট্ট ঐশ্বর্য! এটা তো তারই বাবা। যার হাত ধরে সে হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটতে শিখেছে। যার কোলে উঠে কতশত বায়না করেছে। এইতো তার বাবা তাকে জড়িয়ে। হৃদয়ে কম্পন বাড়তেই চোখ মেলল ঐশ্বর্য। আরো জোরে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। গলা থেকে কথা বের হতে চাইছে না। তবুও অস্ফুটস্বরে ডেকে উঠল,
“বাবা!”

প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল অনুভবের মন। কতদিন পর শুনতে পেলো এই মধুর ডাক! ঐশ্বর্য একটু সরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল পেছনে বেডে পড়ে থাকা মাধুর্য উঠে বসতে অনবরত চেষ্টা করছে। আর উৎকন্ঠিত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে ঐশ্বর্যের দিকে। বিরবির করে কিছু একটা বলছে। কেউ শুনতে না পেলেও ঐশ্বর্য শুনতে পাচ্ছে। সে ধীরে মাধুর্যের নিকট এগিয়ে তার কাছে শান্ত হয়ে বসল। মাধুর্যও শান্ত হলো। বিস্মিত হয়ে মেয়ের দিকে তাকালো। অদ্ভুত সাজগোজের মাঝেও নিজের মেয়েকে চিনতে ভুল হয়নি তার। এইতো তার সুন্দর মুখশ্রী। সে উঠে নিজের মেয়েকে ছোঁয়ার চেষ্টা করল। সফল হলো না। তখনি ঐশ্বর্য তার দুটো কাঁধ ধরে উঠে বসতে সাহায্য করল। তারপর দুজনে আবারও শান্ত। মাধুর্যের ধারণা অনুযায়ী ঐশ্বর্যের কিছু মনে থাকার কথা নয়। তাই সে দ্রুত বলে উঠল,
“আমাকে একটু ভালো করে দেখো না ঐশ্বর্য! দেখো আমি তোমার মা। তোমায় জন্ম দিয়েছি। আমাকে চিনতে পারছো না? ভালো করে দেখো না একটু।”

কোনো হেলদোল নেই ঐশ্বর্যের। সে চেয়েই রয়েছে একনাগাড়ে। অন্যদিকে অস্থির মাধুর্য। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাধুর্যকে চমকে দিয়ে সে ভার গলায় বলল,
“নিজের জন্মদাত্রী মাকে কি করে ভুলতে পারি? ক্ষণিকের জন্য না হয় মস্তিষ্ক এলোমেলো করে ফেলেছিল ডেভিলরা। তাতে তোমাদের প্রতি ভালোবাসা একটুও কমাতে পারেনি তারা।”

অস্থির মাধুর্য শান্ত হয়ে যায়। মনে শান্তির বাতাস বয়ে যায়। এতটুকু শুনেই যেন নিজের শক্তি ফিরে পায়। কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারে না। ঐশ্বর্য আবারও বলে ওঠে,
“আমার শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমি তিনজন মানুষকে কখনোই ভুলতে পারব না। এক হচ্ছে ভ্যাম্পায়ার কুইন মাধুর্য, দুই ভ্যাম্পায়ার কিং অনুভব। আর তিন, মি. আনস্মাইলিং!”

এতটুকু বলে আবারও নিরব হলো ঐশ্বর্য। পাশে থাকা র’ক্ত ভর্তি গ্লাসটা নিয়ে মাধুর্যের মুখের সামনে ধরে বলে,
“এটা খেয়ে নাও। শক্তির খুব প্রয়োজন তোমার। নিজের চেহারা দেখেছো?”

মাধুর্য কোনোরকম প্রশ্ন না করে পান করল সেটা। ঐশ্বর্য তার মুখ যত্নে মুছিয়ে দিয়ে বলল,
“খুব করে তো বলতে, আমি তোমাকে সারাজীবন জ্বালিয়ে মে’রে’ছি। আজ যখন তোমার কাছে থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম তখন তো তোমার শান্তি পাওয়ার কথা মা! তবে কেন এতো উতলা হচ্ছিলে?”

“আমার চোখের মণি তুমি। তোমাকে ছাড়া যে এই মা নিঃস্ব। তুমি আমার বাঁচার আশা।”

সকলে স্তব্ধ। মাধুর্যের চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু বলছে না বা বলতে চাইছে না। হোক না মা-মেয়ের কিছু নিজস্ব মূহুর্ত!

এক প্রহর পেরিয়ে গেছে। ঝটপট করে রোজির ঘরে ঢুকে পড়ল প্রেম ও ঐশ্বর্য। আশেপাশে তাকালো। তারপর চোখ পড়ল বিছানার দিকে। ঘুমে মগ্ন রোজি। কোনো হুঁশ নেই। থাকারও কথাও নেই। প্রাসাদের সকলে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। প্রেম তড়িঘড়ি করে খুঁজতে থাকল কিছু একটা। সেই সাথে ঐশ্বর্যও। অবশেষে বড় পালঙ্কের পেছনে তারা আবিষ্কার করল বড় একটা কালো রঙের বাক্স। ভয়ানক কিছু কারুকার্য করা সেখানে। প্রেম তা দেখেই নিচু হয়ে বসে পড়ল। খোলার চেষ্টা করল। তবে তালা দেওয়া সেটাতে। এরপর উঠে ব্যকুল হয়ে খুঁজতে থাকলো চাবি। বিছানার বালিশের নিচেও যখন পাওয়া গেল না তখন সে লক্ষ্য করল ঐশ্বর্য বাক্স ছুঁয়ে দেখছে আর তালা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। হা হয়ে গেল সে। দ্রুত সেখানে ফিরে আসতেই অদ্ভুত রশ্মি বের হলো বাক্সটা থেকে। আর তার মধ্যে খুঁজে পেল একটা মোটা বই “দ্যা ডেভিল বুক”।

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৫৩ (বর্ধিতাংশ)

মোটা আর ভারি বইটি খোলার সাথে সাথে রশ্মি যখন আর তীব্র হয়ে উঠল তখন আর সেটার দিকে তাকাতে পারল না প্রেম। হাত দিয়ে ঢেকে নিল নিজেকের চোখ। চোখ বুঁজে রাখা অবস্থায় কানে এলো ঐশ্বর্যের কন্ঠ। একনাগাড়ে কিছু একটা বলছে সে। চোখ থেকে হাত সরাতেই আবারও যখন রশ্মি চোখে পড়ল চোখ খিঁচে নিল সে। অল্প করে তাকিয়ে দেখল এই তীব্র আলোয় ঐশ্বর্য স্বাভাবিকভাবে তাকিয়ে ‘দ্যা ডেভিল বুক’ এর প্রথম পাতার হাত দিয়ে পড়ছে। নেত্রপল্লব সরু করে শোনার চেষ্টা করল কথাগুলো।
“ডেভিল কিংডম! এক নিষ্ঠুর রাজ্য। মিথ্যে, ছলচাতুরী, প্রাণহীনতায় ভরা এক রাজ্য। ভালোবাসা, মায়া এই শব্দগুলোর ব্যবহার এখানে যেমন নেই তেমনই এখানকার প্রজা হোক বা প্রাসাদের কেউ তাদের মাঝেও নেই। শুধু আছে হিং’স্রতা আর তিক্ততা। আর রয়েছে পৃথিবীতে রাজত্ব করার লালসা। তবে এই স্বার্থ ততক্ষণ অবধি সফল হবেনা যতক্ষণ এই রাজ্যের রাণী না চাইবে। সেই ডেভিল ক্রাউনের অধিকারিনী হবে একমাত্র সেই স্বার্থসিদ্ধির চাবিকাঠি।”

পাতা উল্টায় ঐশ্বর্য। চোখে ভাসমান হয়ে ওঠে এক নারীর ছবি। ছবিতে রঙ না থাকলেও কলমেট কালিতে যেভাবে আঁকা হয়েছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা অপরূপ সুন্দরী ছিল। তার মাথায় রয়েছে সেই মুকুট। ঠিক তেমনই মুকুট যা ঐশ্বর্যের হাতের সেই চিহ্নের সাথে মিলে। প্রেম একটু একটু করে আগ্রহের সাথে এগিয়ে এলো। ঐশ্বর্যের পাশে বসতেই ঐশ্বর্য পড়তে থাকল,
“আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে শেষ রাণীর রাজত্ব ছিল এই রাজ্যে। তবে তিনি ভ্যাম্পায়ারদের সাথে পেরে ওঠেন নি। ভ্যাম্পায়ার কিং প্রলয় উনাকে ধ্বংস করেছিল।”

ঐশ্বর্য চমকে ওঠে। ছবিতে আরেকটু চোখ বুলিয়ে নেয়। এটা তাহলে তার আগে আসা ডেভিল কুইনের ছবি। আর প্রলয় নামটার সঙ্গে সে যেন পরিচিত। ঐশ্বর্যের মাথা কিঞ্চিৎ যন্ত্রণা করে ওঠে। মাথা ঝাঁকাতেই তার স্মরণ হয় এটা তার বাবার বাবা অর্থাৎ তার দাদুর নাম। তার মানে উনিই এই রাণীকে মৃ’ত্যু দিয়েছিলেন? ঐশ্বর্য আবারও বইয়ের পাতায় মন দেয়।
“ডেভিল কুইন কখনো ডেভিল কিংডম থেকে নির্ধারণ করা হয় না। তারা ওয়ারওল্ফ কিংডম নয়ত ভ্যাম্পায়ার কিংডম থেকে পদার্পণ করে। ভ্যাম্পায়ারদের মধ্যে অনেকে ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে কোনো ওয়ারওল্ফ অথবা ডেভিলদের সঙ্গে নিজের জীবন কাটাবে বলে ঠিক করে আর তাদের মাধ্যমেই জন্ম হয় সেই কন্যা যে বড় হয়ে ডেভিল কুইন হবার ক্ষমতা রাখে। আবার অনেক সময় কোনো ভ্যাম্পায়ার ভুলে ওয়ারওল্ফদের ডেভিল পাওয়ার নামক কক্ষে প্রবেশ করলে তার মাঝে প্রবেশ করে শয়’তানি শক্তি। ডেভিল ও ওয়ারওল্ফদের মধ্যে বহু বছরের সখ্যতা। আর একবার কারোর মধ্যে সেই শক্তির প্রবেশ ঘটলে সেটা থেকে যায়। ভালোবাসা নামক এই অনুভূতি নিস্ক্রিয় করার ক্ষমতা রাখে এই শয়’তানি শক্তি। তবে শক্তি মুছে যায় না। বরং প্রবেশ করে তার ভবিষ্যৎ সন্তানের মাঝে! সেখান থেকেও হয়ে ওঠে ডেভিল কুইন। ডেভিল কুইন চেনার উপায় হচ্ছে তার ক্রোধ! তার সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়ার প্রবণতা। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। সেই সাথে হাতে থাকা এক চিহ্ন। সেই চিহ্ন হুবহু হবে ডেভিল ক্রাউনের। একমাত্র সে হতে পারে ডেভিল কুইন। তবে পদ্ধতিটি এতোটা সহজ নয়। যদি ডেভিল কিংডমের কেউ তাকে খুঁজে পাবার আগে তার মনে ভালোবাসার সঞ্চার হয় তবে বিষয়টা ততটাই জটিল হবে। বিবাহ নামক বন্ধন সমস্ত পরিকল্পনা ভাঙতে পারে। একজন স্বামী-স্ত্রীর প্রণয় সবটা ছাড়িয়ে যেতে পারে। যদি সেটা হয় তবে মুছে যাবে সেই চিহ্ন। সেই সাথে ডেভিল কুইন হওয়ার আশঙ্কা।”

এতোটুকু পড়ে থামলো ঐশ্বর্য। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রেমের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল তাদের। ঐশ্বর্য চোখ সরিয়ে নিল। কিছু একটা ভেবে চোখমুখ খিঁচে নিল। স্মরণে এলো তার মা মাধুর্যের বলা সেসব কথাগুলো! মাধুর্য বার বার বলেছিল এই বিয়েটা সে তার ভালোর জন্যই দিয়েছে। কিন্তু সে শোনে নি। পাগল হয়ে গিয়েছিল। মায়ের ওপর রেগে ছিল। অনুতপ্ত বোধ হয় তার মনের মধ্যে। প্রেম তখন শান্ত গলায় বলে ওঠে,
“এরপর পড়তে থাকো ঐশ্বর্য। হাতে একটুও সময় নেই।”

চোখ খুলে আবারও নিজের হাতের চিহ্নের দিকে দৃষ্টিপাত করে ঐশ্বর্য। চিহ্নটা জ্বলছে আপনমনে। তারপর বইয়ের দিকে তাকিয়ে পড়তে থাকে।
“এরপরেও যদি এতোকিছুর পরেও চিহ্নটি থাকে তবেই সম্ভব! মহা অমাবস্যার রাতে যখন চাঁদ সম্পূর্ণভাবে মুছে যাবে ঠিক সেই মূহুর্তে শয়’তানি তলোয়া’র জেগে উঠবে। তা দ্বারা পরপর তিনবার সেই কাঙ্ক্ষিত জনকে আ’ঘাত করলে সে প্রথমবারের মতো ডেভিল রূপ ধারণ করবে। সম্পূর্ণ বিগত জীবনের স্মৃতি তার মস্তিষ্ক থেকে মুছে যাবে। পুরোপুরি ভাবে নয়। এটি ফিরতে পারে একমাত্র তার জন্মদাত্রী মা এবং বাবার সঙ্গে দেখা হলে। তাদের চোখে চোখ রাখলে সবটা স্মরণ হতে পারে। তবে সেটাও ক্ষণিকের জন্য। যতক্ষণ না ডেভিল ক্রাউন রাণীর মাথায় না উঠবে ততক্ষণ সে পুরোপুরি ডেভিল কুইন হয়ে উঠতে পারবে না। তার বিগত জীবন ফিরে পাবার আশঙ্কা থেকেই যাবে। সেই জীবনটা সে ফিরে পেতে পারে এই বইয়েরই পাশে রাখা সেই শয়’তানি তলো’য়ারের মাধ্যমেই। যেই তলো’য়ার তাকে শক্তি দিয়েছে সেই তলো’য়ার-ই তার শক্তি শুষে নেবে। সে আগের মতো হয়ে উঠতে পারে।”

শেষ কথাগুলো ব্যাপকভাবে প্রেমের মস্তিষ্কে নাড়া দিয়ে উঠল। দ্রুত তড়িঘড়ি করে বইটা হাতে নিয়ে নিল নিজে পড়তে। সময় যেন বেশ তাড়াতাড়ি যাচ্ছে। বই থেকে আগত রশ্মি কমেছে। তাই ভালো করে বইয়ের দিকে দৃষ্টি রাখলো প্রেম।

সকাল! পরিষ্কার আকাশ। এ যেন আকাশ নয় নীল রঙের এক মাঠ। মাঠে অসংখ্য সাদা মেঘের ছোটাছুটি এবং খেলাধুলা। গাছের সমারোহে হাঁটতে গিয়েই হোঁচট খেলো প্রেম। সে শুধু আশপাশ দেখছে। এ যেন অন্য জগত। তার হাতে সেই শয়’তানি তলোয়ার। পেছন পেছন আসছে মাধুর্য। ধীর পায়ে হাঁটছে সে। তাকে হাঁটতে সাহায্য করছে অনুভব। তার দুটো কাঁধ ধরে সেও আস্তে হাঁটছে মাধুর্যের পাশাপাশি। এই প্রথম ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে প্রবেশ করেছে প্রেম। তার পাশে দ্রুত হাঁটছে ঐশ্বর্য। চোখেমুখে উৎকন্ঠা। সেই সাথে কপাল কুঁচকানো। তার সমস্ত শরীরে কাঁপুনি ধরেছে। ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে প্রবেশ করবার পর থেকে এমনটা হচ্ছে। সামনে এগোতেই তাদের সামনে পড়ল স্বচ্ছ বহমান নদী। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে গিয়ে জঙ্গলটাকে ভাগ করেছে। এতো সুন্দর স্বচ্ছ নদী মানুষের জগতে দেখা মিলে না সহজে। স্রোত বইছে নদীতে। প্রেমের ধ্যান ভাঙে অনুভবের কথায়।
“আমরা দুঃখিত প্রেম। এই প্রথম তুমি আমাদের রাজ্যে এলে তাও লুকিয়ে। তোমার জন্য কোনো বিশেষ করতে পারলাম না।”

“আয়োজন তো তখন হবে যখন আপনাদের মেয়েকে আপনারা সম্পূর্ণভাবে ফিরে পাবেন। তার আগে নয়। সামান্য বিষয়ে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হবেন না।”

অনুভব আর কথা বাড়ালো না। ঐশ্বর্য ফট করে দাঁড়িয়ে পড়ল। একহাতে তার কপালের সাইডে হাত রেখে ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করল। ফট করেই চোখ খুলতেই তার সাথে থাকা সকলে চমকে উঠল। ঐশ্বর্যের চোখ মূহুর্তে লাল বর্ণ হয়ে এসেছে। প্রেম তড়িঘড়ি করে তার কাঁধে হাত রেখে তাকে একটু ঝাঁকিয়ে ডেকে উঠল,
“ঐশ্বর্য!”

আবারও আগের রূপে ফিরল ঐশ্বর্য তৎক্ষনাৎ। সম্বিৎ ফিরে উত্তেজনা নিয়ে বলল,
“মনে হচ্ছে আমি আবারও ডেভিল রূপে ফিরে যাচ্ছি। আমি ডেভিল কুইন হতে চাই না। আমি আমার অস্তিত্বে বাঁচতে চাই। মি. আনস্মাইলিং যা করার দ্রুত করুন।”

“হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি যেতে হবে প্রাসাদে।”

সকলে প্রাসাদে পৌঁছে। চলে আসে এক কক্ষে। মাধুর্য কাঁপছে। ঐশ্বর্য তার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মায়ের দিকে একনাগাড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলে,
“মা, আমি তোমার মেয়ে হয়ে থাকতে চাই। কোনো ধ্বংসের সূচনা করতে চাই না। আমি এই রাজ্যের প্রতি প্রথমবার এতোটা টান করছি। এটা আমার জন্মভূমি। আমি এই জন্মভূমির জন্য কিছু করতে চাই। আমার অস্তিত্ব আমি হারাতে চাই না। আর এর জন্য যা করার তোমাকেই করতে হবে। ‘দ্যা ডেভিল বুক’ এর কথা অনুযায়ী আমি আগের মতো হবো তখনই যখন আমার নিজের মাতা আমাকে এই তলো’য়ার দিয়ে পরপর তিনবার আঘা’ত করবে ঠিক আমার জন্মস্থানে! এখানে আমার জন্ম হয়েছিল। আর এখানেই আমি আবারও অস্তিত্ব ফিরে পাব তুমি চাও তো!”

অনুভব নিজের বুকের ওপর পাথর রেখে মাধুর্যের কোমল হাতে ধরিয়ে দেয় তলো’য়ার। এই ধারা’লো ও তীক্ষ্ণ অ”স্ত্র দেখে মাধুর্যের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। সে অ’স্ত্র এই প্রথম হাতে নেয় নি। বহুবার নিয়েছে। হাতও চালিয়েছে। তবে এবার যে এটা দ্বারা নিজের নাড়িছেঁড়া মেয়ের ওপর আ’ঘাত করতে হবে! এটা কোন মা পারবে? মাধুর্য সেই মূহুর্তে তলো’য়ার ফেলে দেয়। কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ে নিচে।
“আমি পারব না। আমি তোমাকে ছোট থেকে ছোট্ট একটা আ’ঘাত পেতে দেখতেও পারিনি ঐশ্বর্য। আমি পারব না যেই হাতে তোমাকে নিজে আগলে রেখে বড় করেছি সেই হাতে তোমাকে পরপর তিনবার এই তলো’য়ার এফোঁড়ওফোঁড় করতে।”

মাধুর্যের চোখ দিয়ে পড়ে নোনাজল। অনুভব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর মনে হয় এই তো একমাত্র রাস্তা! আর যে কোনো উপায় নেই। বড় একটা শ্বাস নিয়ে সে মাধুর্যকে বলে ওঠে,
“ভেবে দেখো মাধুর্য। এটা শেষ সুযোগ আমাদের মেয়েকে ফিরে পাবার। তুমি না পারলে করবে না আ’ঘাত। তবে তোমার এই সিদ্ধান্তে আমরা ঐশ্বর্যকে হারাবো চিরদিনের মতো। সেই সাথে একে একে ধ্বংস হতে দেখতে হবে আমাদের রাজ্য।”

“নাহ!”
চিৎকার দিয়ে ওঠে মাধুর্য। দরজার ওপার থেকে তা শুনে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে প্রেমের। সে কক্ষের বাহিরে দাঁড়িয়ে। সে যে নিজেও দেখতে পারবে না তার আ’হত র’ক্তাক্ত প্রেয়সীকে। তার হৃদয় থেকে র’ক্ত ক্ষরণ হবে। তাই তো সে অনুভবের হাতে সেই তলো’য়ার তুলে দিয়ে কোনোরকম কথা না বলে চলে এসেছে কক্ষের বাহিরে। দরজার সাথে ঠেস লাগিয়ে একমনে দাঁড়িয়ে আছে। সর্বাঙ্গ শিউরে উঠছে তার। তবে এটাই যদি তার অর্ধাঙ্গিনীকে ফিরে পাবার একমাত্র উপায় হয়। তবে হক!

মাধুর্য ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়ায় হাতে তলোয়ার নিয়ে। তলো’য়ারটা ভালো করে ধরতেই ঢক গিলে নেয় সে। অশ্রু ভরা আঁখি দুটি ঐশ্বর্যের পানে যেতেই দেখে ঐশ্বর্যের চোখ দুটো আবারও রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। মুখভঙ্গি হয়ে উঠেছে হিংস্র। চোখ খিঁচে বন্ধ করে এক চিৎকারে মাধুর্য সেই তীক্ষ্ণ তলো’য়ার ঢুকিয়ে দেয় ঐশ্বর্যের পেট বরাবর। ফ্যাকাশে এবং শান্ত হয়ে আসে ঐশ্বর্যের মুখশ্রী। অনুভব অন্যদিকে ফিরে নেয় নিজের মুখ। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না। না জানি মাধুর্যের মনে তাহলে কি হচ্ছে। শব্দ করে কেঁদে উঠেই বাকি দুই বারও অ’স্ত্র চালনা করে মাধুর্য। তলো’য়ার বের করবার সাথে সাথে ধপ করে পড়ে যায় ঐশ্বর্য। মাটিতে পড়ে থাকে তার র’ক্তে ভেজা দেহ। মূহুর্তে তৈরি হয় তার র’ক্ত দ্বারা ভর্তি কক্ষ। মাধুর্য চোখ মেলে তাকায়। ঐশ্বর্যকে এমন ভাবে দেখে প্রাণ যেন বেরিয়ে যায়। ধপ করে বসে পড়ে। কোনোরূপ পরিবর্তন না দেখে মনটা যেন বলে ওঠে, তার মেয়ে আর ঠিক হবে না। আর্তনাদ করে ওঠে,
“আমার মেয়ে!”

অনুভব নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে। দেহে যেন তারও প্রাণ নেই। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মাধুর্যের আর্তনাদ শুনে তড়িঘড়ি করে কক্ষে প্রবেশ করে প্রেম। সেই সময়ই ঐশ্বর্যের মাঝ থেকে এক অদ্ভুত রশ্মি বেরিয়ে আসে। লাল সেই রশ্মি বেরিয়ে যায়। অনুভব খেয়াল করে ঐশ্বর্যের হাতে থাকা সেই চিহ্ন আর জ্বলছে না। স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। তার বড় কালো কুচকুচে নখ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। প্রেম কাঁপছিল। সারা মুখে তার আতঙ্ক। ঐশ্বর্যের চোখের পলক পড়তে দেখেই হৃদয়ে যেন প্রাণ সঞ্চার হলো। আনন্দে ভরে গেল চোখদুটো অশ্রুতে। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মুখটা নিচু করে ফেলল সে। মাধুর্য শুনতে পেলো,
“মা, আমার কাছ থেকে মনে হচ্ছে খুব বড় একটা কিছু নেমে গেছে। হালকা বোধ করছি। আমি কি নিজের অস্তিত্ব ফিরে পেয়েছি?”

সেদিন ফিরে পেয়েছি ঐশ্বর্য নিজের অস্তিত্ব। হয়ে উঠেছিল সে ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস। তবে সেই ‘দ্যা ডেভিল বুক’ এ লিখা ছিল ডেভিল কিংডম ধ্বংসের উপায়। সেটা পূরণ করতে তাকে ডেভিল কিংডমে ফিরতে হতো। সব পরিকল্পনা করেই সেখানে ফিরেছিল ঐশ্বর্য। তবে পিছু ছাড়েনি প্রেম। তার সাথে সাথে এই প্রেমিক পুরুষটিও এসেছিল। তবে তার যে প্রা’ণের ঝুঁকি ছিল। সেটা কি সে জানতো না? অবশ্যই জানতো! তবুও সে এসেছিল। তার প্রেয়সীকে রক্ষা করার স্বার্থে।

আবারও ডেভিল কিংডমে প্রবেশ ঘটে তাদের। ভোর হতে আর কিছু সময় বাকি। আর ডেভিলদের ঘুম ভাঙতেও। জঙ্গল পেরিয়ে তাড়াতাড়ি যাচ্ছিল তারা। তখনি ঐশ্বর্য ধরল প্রেমের হাতটা। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
“শুনুন কে যেন আসছে!”

প্রেমও শোনার চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে প্রশ্ন করল,
“আমি তো শুনতে পাচ্ছি না।”

“উফফ…আপনি পাবেন কি করে? আমরা ভ্যাম্পায়ার দূর থেকেও কারো আগমন টের পাই। চলুন ওদিকে গিয়ে লুকাই।”

প্রেম কিছু বলতে চাইলেও সক্ষম হলো না। ঐশ্বর্য তাকে নিয়ে এসে দাঁড় করালো এক ভাঙা কুটিরের কাছে। তারা দেখলো কুটির একেবারে খালি। কেউ থাকে না। তখনি ঐশ্বর্য বলল,
“কিছুক্ষণের জন্য এখানে থাকি? তারপর না হয় প্রাসাদের দিকে যাব। ডেভিলদের মাঝে শুধু প্রাসাদের সকলে ঘুমিয়েছে। প্রজারা নয়।”

প্রেমও কথা বাড়ালো না। তারা কুটিরে প্রবেশ করে। কুটিরের ঘরে রাখা খড়কুটো। আর ধুলোমাখা পরিবেশ। প্রেম কয়েকবার হাঁচি দিয়ে নিল। তারা কুটিরের গভীরে যেতেই দেখতে পায় আরেকটা ঘর। সেখানে প্রবেশ করে ঐশ্বর্য তারাতাড়ি করে। ওখানেই তার সামনে পড়ে লম্বা শিকল। তার মাথায় খেলে যায় ছোট্ট বুদ্ধি। প্রেম কুটিরের আশপাশটা দেখতে ব্যস্ত। এইতো সুযোগ। হাতে ধীরে ধীরে শিকল তুলে নিল ঐশ্বর্য। প্রেমের দিকে এগিয়ে গেল। তাকে শিকল দিয়ে বাঁধতে যাবে সেই সময়ই প্রেম তার দিকে ফিরে তাকে ঘুরিয়ে নিজের সাথে চেপে ধরে কাঁধে থুঁতনি রেখে দাঁত চেপে বলল,
“কি করার চেষ্টা করছো? কি উদ্দেশ্য তোমার?”

ঐশ্বর্য মনে মনে নিজেকে বকে জোরপূর্বক হেঁসে দিয়ে বলে,
“কি করব? কিছুই না।”

“এর ফলাফল ভালো হবে না মাই এ্যাংরি বার্ড। ভয়ানক রোমান্টিক পানিশমেন্ট পেতে হবে!”

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৫৪

“মানে? কি করতে চাইছেন আপনি?”

প্রেম ঐশ্বর্যকে পেঁচিয়ে ধরে তার দুটো হাত নিজের ঠোঁটের কাছে এনে আলতো ভাবে হাত দুটোতে পরশ এঁকে বলে,
“কিছুই না। জানি তোমার হাতে সময় কম। অবাধ্য মন চাইছে আরো কিছুক্ষণ একা তোমার সাথে থাকতে। কিছু মূহুর্ত তোমাতে বিলীন হতে। আরেকটু থাকি?”

ঐশ্বর্য বারণ করতে চেয়েও পারল না। করতে ইচ্ছে করল না। সত্যিই মানুষটাকে অনেকদিন হলো মনোযোগ দিয়ে দেখতে পারে নি। মানুষটার বুকে মাথা রেখে কিছু মূহুর্ত কাটাতে পারেনি। এতো অশান্তির মাঝে ক্লান্ত ঐশ্বর্য খুঁজে চলেছে একটু শান্তি। যা প্রেমের মাঝেই মিলে। প্রেম তার উত্তরের অপেক্ষা না করে খড় বিছিয়ে রাখা মেঝেতে আরো ভালোভাবে একত্র করে বসে পড়ল। তারপর নিজের ঘাড়ে একহাত রেখে ঘাড় কাঁত করে চোখ বুঁজল। ঘাড় ব্যথা করছে। শরীর এতো দখল নিতে পারছে না। কোলের উপর ভার সৃষ্টি হওয়ায় ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে চোখ মেলে তাকায় প্রেম। ঐশ্বর্য তার অনেকটা নিকটে বসেছে। ইতিমধ্যে তার বুকে মাথা রেখে তার দিকে শান্ত নজরে শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি। প্রেম আধশোয়া থেকে বসে মাথা নিচু করে ঐশ্বর্যের কপালে গভীর চুম্বন করে বলল,
“এই চোখের মায়ায় আমি বার বার ডুবে যাই। এই দৃষ্টি আমাকে বার বার এক অন্য দুনিয়ায় পৌঁছে দেয়। সেই দুনিয়ায় শুধু প্রণয়ের ঢেউ দেখতে পাই।”

“আর আমি আপনার বুকে মাথা রাখার জন্য প্রতি মূহুর্তে তড়পে উঠি। আপনার থেকে আসা সেই ঘ্রাণ আমাকে মাতাল করে তোলে। আপনার কৃষ্ণ বর্ণের চোখের ভাষা আমাকে বারংবার অন্য ঘোরে টানে। যেই ঘোরের টানে আমি অন্য অস্তিত্বে প্রবেশ করে আর সব ভুলে গিয়েও এই দৃষ্টি ভুলতে পারিনি।”

প্রেম কিছু বলে না। স্মিত হেঁসে ঐশ্বর্যের মাথা তার বুকের সাথে চেপে ধরে। তারপর নীরবতা! এ যেন দুজনের স্বস্তির সময়! তাদের একান্ত সময়। বিরক্ত করবার কেউ নেই।

চোখ বুঁজে ছিল প্রেম। আধশোয়া হয়ে একহাত মাথার নিচে দিয়ে অন্যহাতে ঐশ্বর্যকে জড়িয়ে ছিল। কি যেন মনে হতেই চোখ খুলে ঐশ্বর্যের দিকে তাকালো সে। মেয়েটা তার ডান হাত দিয়ে বাম হাতের সেই চিহ্নে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। মুখে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট! প্রেমও ভালো করে চিহ্নটির দিকে চোখ রাখল। এই চিহ্নটি যেন সব নষ্টের মূল। এই চিহ্নের জন্য সে তার অর্ধাঙ্গিনীকে হারাতে বসেছিল। হারিয়েও ফেলেছিল। আশার আলো নিভে গিয়েছিল। প্রেমের চিন্তার ঘোর কাটে ঐশ্বর্যের বিরবির করে বলা কথায়।
“এই চিহ্নটা যদি এখনি মুছে যেতো! আমার তো এটা দেখতেই ঘৃণা লাগছে।”

“চিরতরে মিশাতে চাও এই চিহ্ন?”

ঐশ্বর্য প্রেমের কন্ঠে মাথা উঠিয়ে সরু চোখে তাকায়। প্রেম সযত্নে তার হাত দিয়ে ঐশ্বর্যের বাম হাতটা ধরে সেই চিহ্নের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তাহলে দেরি কিসের? ইতি ঘটানো যাক এই তিক্ত চিহ্নের।”

বলেই ঐশ্বর্যের বাম হাত মেলে ধরে তার তালুতে বেশ কয়েকটা ঠোঁটের স্পর্শ আঁকে প্রেম। সেখানেই সে থামে না। আস্তে আস্তে তালু থেকে হাতের উপরে উঠে আসে। ঠোঁট অনবরত চলতে থাকে তার। ঐশ্বর্য শিউরে ওঠে। পরমুহূর্তেই নিঃশ্বাস ঘন হতে থাকে। হাতটা টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রেমের শক্তির কাছে তার শক্তিও বৃথা হচ্ছে। না পেরে প্রেমের ঠোঁটের ওপর অন্যহাতটা রাখে ঐশ্বর্য। গোল গোল চোখে বলে,
“কি করছেন এসব?”

“এখন নিশ্চয় অসভ্য বলবে না আমাকে? নাকি এখনো সেটাই বলবে? যে আমি তোমার সাথে অশ্লীল আচরণ করেছি? আবারও কি এই অপরাধে কারাগারে নিক্ষেপ করবে রাজকন্যা?”

ঐশ্বর্য ঢক গিলে নেয়। লোকটা নিশ্চয় পাগল হয়েছে। চোখের পলক বারবার ফেলে চাপা সুরে জবাব দেয়,
“কি সব বলছেন? আমার সময় হয়ে এসেছে। আমি যাই!”

ঐশ্বর্য তড়িঘড়ি করে উঠতে নিল। বাঁধা হয়ে দাঁড়াল প্রেম। তার কোমড় একহাতে পেঁচিয়ে ধরে বসিয়ে রাখল। একটুও নড়ার মতো পরিস্থিতি থাকল না। ঐশ্বর্য কিছু বলতে উদ্যত হবে তখনি প্রেম মাতাল কন্ঠে বলে উঠল,
“আজকে আসল প্রেম হতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। হতে দেবে না?”

ঐশ্বর্য কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। গলার মাঝেই সব কথা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ঐশ্বর্য উঠে দাঁড়ায় ধড়ফড় করে। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। এলোমেলো কোঁকড়ানো চুল তীব্র হাওয়া আরো এলোমেলো করে দিয়ে যায়। মাথা থেকে পা অবধি কাঁপছে তার। পিছন পিছন প্রেম এগিয়ে আসে। তাকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে ধরতেই ঐশ্বর্য বলে ওঠে,
“আমাকে যেতে হবে। সময় ফুরিয়ে আসছে।”

প্রেম মানতে নারাজ। ঐশ্বর্যের কাঁধে দুইবার ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বলে,
“এতো পালাই পালাই করো কেন আমার থেকে?”

ঐশ্বর্য সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। খানিকটা চুপ থাকলো। ভারাক্রান্ত মনে বলে উঠল,
“আমার সঙ্গে দেখা না হলে আপনার জীবনটা সুন্দর হতো। তাই না?”

প্রেমের ওষ্ঠদ্বয় থামে। মাথা উঠিয়ে তাকায়। ঐশ্বর্যকে সে দেখতে পাচ্ছে না সামনে ফিরে থাকায়। তার কোঁকড়ানো আর নমনীয়, অদ্ভুত মাতাল সুভাস ছড়ানো চুল হাওয়ায় তার চোখেমুখে এসে বিঁধছে। তবে প্রেমের মুখে বিরক্তির লেশমাত্র নেই। রয়েছে শীতলতা, স্নিগ্ধতা! অপরদিকে প্রেমের উত্তর না পেয়ে ঐশ্বর্য আবারও বলতে লাগল,
“আপনার সুন্দর একটা জীবন! আপনার সুন্দর পরিবার। আপনি এতো পরিশ্রমী মানুষ। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ না হলে একটা ভালো আর সুন্দর থেকে মেয়েকে বিয়ে করে কতটা সুখী হতেন তাই না?”

ঐশ্বর্যের এমন কথায় প্রেমের মুখ কালো হলো। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা এক দুষ্টুমির ছাপ নিমিষে বিলীন হয়ে ধরা দিল গাম্ভীর্য! প্রেমের নিস্তব্ধতা দেখে আরো পেয়ে বসে ঐশ্বর্য। নিশ্চয় সে ঠিক বলছে জন্যই প্রেম চুপ। লোকটারও তো ইচ্ছে করে স্বাভাবিক আর সুস্থ জীবনযাপন করতে? ঐশ্বর্যের জীবনে জড়ানোর পর নিশ্চয় সে ফেঁসে গিয়েছে? এবার এসব চিন্তাভাবনা মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই কান্না পায় ঐশ্বর্যের। টান টান নেত্র দুটোতে অশ্রুতে ভরাট হয়। আরো কথা বলতে চেয়েও গলায় দলা পাকায়। কান্না তাকে আঁটকে দিচ্ছে। তবুও সে বলে,
“আমি আপনার জীবন নষ্ট করে দিয়েছি তাই না মি. আনস্মাইলিং?”

ঐশ্বর্যের এমন কন্ঠে প্রেমের বুঝতে দেরি হয় না মেয়েটা সামনে ফিরে অশ্রু ফেলছে। তার কাঁধে হাত রেখে এক প্রকার জোর করে সামনে ফিরিয়ে নেয় প্রেম। সঙ্গে সঙ্গে টুপ করে নোনাজল বেয়ে পড়ে যায় নিচে। টলমল করছে চোখে পানি। চোখের পাপড়ি ভিজে উঠেছে। তার নাকের মাথা লাল টকটকে হয়েছে। কান্না রোধ করতে নাক টানছে অনবরত ঐশ্বর্য। তবে প্রেমের চোখ তো এড়াতে পারলো না সে। প্রেম তার বৃদ্ধা আঙ্গুল ঐশ্বর্যের কানে আর বাকি আঙ্গুল তার কানের নিচে ঘাড়ের কাছে রাখল। তারপর নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়ল। আর বলল,
“লুক এট মি!”

টান টেনে টলমলে দৃষ্টিতে প্রেমের চোখের দিকে তাকালো ঐশ্বর্য। প্রেম ধীর গলায় বলে ওঠে,
“তুমি আমার কাছে রংধনু! সেই রংধনু যে আকাশকে সাতটি ভিন্ন রঙে রাঙিয়ে দেয়। সেই আকাশটা তখন ঐশ্বর্যে অনন্য লাগে। তুমি আমার জীবনের সেই রংধনু। যে আমার জীবনটাকে রাঙিয়ে দিয়েছো।”

প্রেম থামে। তার কপালটা গিয়ে লাগায় ঐশ্বর্যের ছোট্ট কপালে। ছোট ছোট অবাধ্য কোঁকড়ানো চুলগুলো তার কপালকে ছোট করে দিয়েছে। ঢেকে রেখেছে। সেই কপালে ঠেকিয়ে প্রেম থেমে থেমে বলে,
“আমার জীবনটাকে নষ্ট নয়। নতুনভাবে সুখ দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছো। যেই সুখানুভূতি আমি কখনোই অনুভব করিনি। তুমি আমার কাছে বিলে ফুটে থাকা সবার মাঝখানে সেই সুন্দর স্নিগ্ধ পদ্মফুল। যাকে অর্জন করতে আমাকে বহু বাঁধা পার হতে হয়েছে। পানিতে ডুবতে হয়েছে।”

আবারও থামে প্রেম। ঐশ্বর্য বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। ভেতরটা যেন ধড়ফড় করছে। সামনে থাকা মানুষটির কথা বারবার কানে বাজছে। কথাগুলো যে ভয়ানক সুন্দর! যেন মধু মেশানো। মনের মধ্যে সৃষ্টি করছে অন্যরকম উন্মাদনা। চোখ আবেশে বন্ধ করে ঐশ্বর্য। তিরতির করে কাঁপতে থাকে তার ঠোঁট। তবুও ঠোঁট নাড়িয়ে বলে ওঠে,
“আপনি আমার কাছে সেই শান্ত বৃষ্টি। যেই বৃষ্টি বেজায় শান্ত তবে মুগ্ধকর। যেই বৃষ্টি প্রচন্ড নেশালো। সেই নেশায় আমি পাগল হয়ে গেছি। সেই বৃষ্টিতে না ভিজে থাকায় যায় না।”

কথা বলার শেষ মূহুর্তে মিলিত হয় প্রেম ও ঐশ্বর্যের ওষ্ঠদ্বয়। আগলে জড়িয়ে ধরে প্রেম ঐশ্বর্যকে। নেই কোনো দূরত্ব। শুধু বেড়েছে উন্মাদনা আর প্রণয়ের পাগলামি। প্রেম প্রমাণ করেছে শুধু ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস ঐশ্বর্য নয় সেও কত বড় ভালোবাসার কাঙাল! সে কতটা চায় ঐশ্বর্যকে। মৃ’ত্যুর সাথে যুদ্ধ করে ভিনদেশের রাজকন্যাট নিকটে থেকে গেছে।

ঐশ্বর্য মাথা উঠিয়ে তাকায়। দূরে সরে আসার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে বলে,
“কিন্তু আমার জন্য আপনার অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে ভবিষ্যতে। আমি সাধারণ নই আপনি জানেন। আমার জীবনযাপনও অস্বাভাবিক। আপনার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আপনার ভাই আমার জন্য শেষমেশ মৃ’ত্যু উপহার পেয়েছে। কে বলতে পারে ভবিষ্যতে আরো বড় কোনো ক্ষতি…”

প্রেম তাকে মাঝপথে থামিয়ে দেয়। তার ঠোঁট একহাতে চেপে ধরে। মাথা নাড়িয়ে বলে,
“আমি যেমন আমার পরিবারকে ছাড়তে পারব না ঠিক তেমনই তাকেও ছাড়তে পারব না যাকে আমি তিনবার কবুল বলে নিজের করে নিয়েছি। আমি দুজনকেই নিজের সাধ্যমতো সারাজীবন রক্ষা করতে রাজি আছি। ইফানের ভাগ্যই হয়ত এমন ছিল। যার মৃ’ত্যু ঘনিয়ে আসে তাকে যেভাবেই হক যেতেই হয়। আর কোনো কথা নয়। আজ প্রেমের মন গভীরভাবে ঐশ্বর্যকে চাইছে।”

ঐশ্বর্যের ভেজানো দুটো চোখের পাতায় ওষ্ঠ দিয়ে গভীর স্পর্শ করল প্রেম। শীতল সুরে বলল,
“প্রেম যে আজকে সত্যিই এই রাজকন্যাকে নিজের করতে চায়। ভিনদেশী রাজকন্যার প্রতি সে এতোটাই আসক্ত হয়ে পড়েছে যে আর দূরে থাকতে ভালো লাগছে না তার। আজ প্রকৃতপক্ষে তাকে #প্রেমের_ঐশ্বর্য বানাতে চায়।”

ঐশ্বর্য স্তব্ধ। হাতদুটো অনবরত কাঁপছে। কথা বের হচ্ছে না। ঠোঁটজোড়া কেঁপে চলেছে বিরতিহীনভাবে। প্রেম আবারও প্রশ্ন করল,
“তুমি শুধু ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস নও। তুমি #প্রেমের_ঐশ্বর্য। আমার ঐশ্বর্য। অনুমতি পাবে কি এই সাধারণ মানুষটি রাজকন্যাকে গভীরভাবে ছোঁয়ার? তাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে নেওয়ার? আজ আমি এই রাজকন্যাতে বিলীন হতে চাই।”

ঐশ্বর্য মুখ নিচু করল। তাকানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রেম চেষ্টা করল তার চিবুকে হাত দিয়ে চোখের দিকে তাকানোর। এমন চেষ্টায় ফট করে প্রেমের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে তাকে জাপটে ধরল ঐশ্বর্য। মুখ দিয়ে শুধু দুটো শব্দ বের হলো,
“ভালোবাসি আপনাকে!”

প্রেম তার অনুমতি পেয়েছে। কোলে তুলে নিল প্রেম তার অর্ধাঙ্গিনীকে। আজ এই নিষ্ঠুর আর ভালোবাসা বিহীন রাজ্যেই ঘটবে প্রণয়। এক নারী এবং এক পুরুষ মত্ত হবে দুজনের ভালোবাসায়। দূরত্ব থাকবে না। বাঁধা থাকুক শত! তবুও যে তারা একই বন্ধনে বেঁধে!

বর্তমান…
ডেভিল রাজ্যের বাহিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাধুর্য। তার পাশেই রয়েছে অনুভব। সেই সাথে এলিনা সহ তাদের ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের কিছু ভ্যাম্পায়ার। মাধুর্য ধৈর্যহারা। মেয়েটা এখনো ফিরছে না। অথচ সে বলেছিল এই সময়ের মধ্যে ফিরবে। তার কি কোনো বিপদ হলো? এসব ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে তার। অনুভবকে সে বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
“ঐশ্বর্য আর প্রেম এখনো কেন ফিরছে না? পরিকল্পনা বিগড়ে গিয়ে ওদের কিছু হলো না তো?”

অনুভব মাধুর্যের মাথায় হাত রাখে। যেমনটা ছোট বাচ্চার ওপরে বড় কেউ হাত রাখে ঠিক সেভাবে। প্রথম থেকে এতো বছর হয়েছে। বয়স বেড়েছে। চেহারায় না বোঝা গেলেও বেড়েছে সম্পর্কের বয়স। তবুও দুজনে যেন এখনো সেই প্রেমময় দম্পত্তি। তাদের ভালোবাসা অটুট। অনুভব শান্ত সুরে বলে,
“এটা দিয়ে নয়বার তুমি আমাকে একই প্রশ্ন করলে। ওদের কিছু হয়নি। একটু দেরি তো হতেই পারে।”

“তাই বলে এতো দেরি? আমার চিন্তা হয় ওরা বোঝে না?”

“ওরা তো ইচ্ছে করে দেরি করছে না।”

মাধুর্য আরো কিছু বলবে। তৎক্ষনাৎ ডেভিল রাজ্যের প্রবেশদ্বার ভাঙতে শুরু করে। বিকট শব্দ হয়। একটু একটু করে ভেঙে পড়ে পাথর। সকলে পিছিয়ে যায়। ভাঙতে ভাঙতে শেষমেশ তাদের চোখের সামনেই ধ্বংস হতে থাকে প্রবেশদ্বার। এর মানে রাজ্যের বিনাশ ঘটেছে! তবে ঐশ্বর্য আর প্রেম? তাদের কেন দেখা মিলছে না? ওরা কি ওর মধ্যেই…? মাধুর্য আর ভাবতে পারছে না। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। সেই সময় দেখা মিলল দুটো অবয়বের। একটি নারী আর একটু পুরুষের। দুজন দুজনের হাত ধরে আসছে। মাধুর্যের মনটা শান্ত হয়। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসে স্বস্তির শ্বাস। ঐশ্বর্যের আলোর ন্যায় আলোকিত মুখটি স্পষ্ট হতেই এলিনা সহ সকলের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তারা জয়ধ্বনি দিয়ে বলে ওঠে,
“জয় আমাদের ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস এর! জয় হক!”

ঐশ্বর্য অনুভব করে এই প্রথম এক অন্য অনুভূতি। এটাকে বোধহয় গর্বিত হওয়া বলে। নিজের রাজ্যের প্রজা নিয়ে সে গর্বিত। নিজের রাজ্যকে রক্ষা করতে পেরে সে গর্বিত। সে আর প্রেম দ্রুত এগিয়ে এলো। মাধুর্যও দেরি না করে তড়িঘড়ি করে এলো। আর বলল,
“এতোক্ষণে সময় হলো তোমাদের? কত চিন্তা করছিলাম জানো? আর প্রেম? তুমি দ্রুত তোমার মাকে ফোন করো। উনি বেশ চিন্তিত। তোমার খোঁজ না পেয়ে।”

প্রেম মাথা নাড়ায়। অনুভব ফোনটা এগিয়ে দিতেই সরাসরি মাকে ফোন করতে অন্যদিকে চলে যায়। এলিনা বলে ওঠে,
“আমাদের রাজ্য রক্ষা যতটা আমাদের প্রিন্সেস করেছে ততটাই আমাদের প্রিন্সেস এর স্বামী করেছে। উনি যদি না থাকতেন কিছুই সম্ভব হতো না। আমাদের ভবিষ্যৎ কিং বলে কথা! এই সাহস আর এই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি তো থাকতেই হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ কিং আর কুইন মিলে আমাদের রক্ষা করেছে। খারাপকে শেষ করেছে। তাদের উদ্দেশ্য মিশিয়ে দিয়েছে।”

ঐশ্বর্য হাসে। তবুও শেষ কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“না, এলিনা। এই পৃথিবীতে যতদিন ভালোর অস্তিত্ব থাকতে ঠিক ততদিন খারাপের অস্তিত্বও থাকবে। এটাই চরম সত্যি!”

এলিনাও সম্মতি দেয়। অনুভব ঐশ্বর্যের মাথায় হাত রাখে। স্বস্তির সুরে বলে,
“আমার বিশ্বাস ছিল তোমার উপর। আমার প্রিন্সেস এর উপর।”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।]