#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
শেষ পর্ব (প্রথমাংশ)
সকলে যখন খুশি মনে জঙ্গলের সেই স্থানটি ত্যাগ করল তখন আড়ালে থাকা কেউ একজন বেরিয়ে এলো। বড় এবং প্রশস্ত গাছের শিকড়ের সাথে পায়ে আঘাত লাগলে উল্টে পড়তে নিলেও নিজেকে সামলে নিল সে। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া সেই ডেভিল রাজ্যের সামনে। সেই প্রবেশদ্বারের সামনে। প্রবেশদ্বার ভেঙে তিন টুকরো হয়েছে। সেই ভাঙা প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রায় ধ্বংস হওয়া রাজ্যে প্রবেশ করল সে। চারিপাশে শুধু আগুন জ্বলছে। সেই তাপ তাকে স্পর্শ করতেই চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। তাপ সহ্য করতে পারছে না সে। তবুও কিছু একটা ভেবে এগিয়ে গেল সে। প্রাসাদ থেকে আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যে এসেছে। সবটা পু’ড়ছে। সে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠল,
“হাহ! এরা নাকি আবার ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেসকে ডেভিল কুইন বানাবে। সামান্য মানুষের সাথে পেরে উঠল না। নিজেরাই পু’ড়ে ছারখার হয়ে গেল! পরিকল্পনা সব ভেস্তে গেল। যত্তসব মূর্খের দল।”
জঙ্গলের গাছগাছালি পেরিয়ে এগিয়ে যেতেই তার চোখে তীব্র রশ্মি লাগল। হাত দিয়ে আগলে নিল তার দুটো চোখ। হাতের আঙ্গুল একটু ফাঁক করে দেখতে চাইলো এই রশ্মির উৎস। আগুনে জ্বল’ছে সেই স্থান। কিন্তু সবখানে আগুন লেগে গেলেও বাদ রয়েছে একটি জায়গা। সেখান থেকেই বের হচ্ছে রশ্মি। কোনোমতে পানি জোগাড় করে দ্রুত আগুন নেভানোর চেষ্টা করল সে। দৃশ্যমান হলো অগ্নি তলো’য়ার। কি সুন্দর দেখতে! চকচক করছে। সুচালো তার মাথা। সেটা হাত দিয়ে তুলে নিল সেই আগন্তুক। এই তলো’য়ার একবার ঘুরিয়ে নিল সে। চোখজোড়া সবুজ হয়ে উঠল তার। আপনমনে বলে উঠল,
“কাজের জিনিস পেয়েছি! এটা দিয়েই তো এবার শুরু হবে আসল খেলা।”
সময় বহমান। কারো চোখের নিমিষে কেটে যায়। আবার কারো কাটতেই চায় না। যাদের জীবন তিক্ত হয়, যারা দ্রুত সময় পেরিয়ে নিয়ে যেতে চায় তাদের সময় এগোয় না। আর সুখময় জীবনের সময় যেন তাড়াতাড়ি এগোয়। এটাই হয়ত নিয়ম!
ঠিক দশ দিন এবং দশটা রাত পেরিয়ে গিয়েছে। প্রেম ও ঐশ্বর্যের কাছে নিমিষে কেটেছে। ভালোবাসাময় হয়ে উঠেছিল প্রতিটা মূহুর্ত! সেই মূহুর্ত হৃদয়ের কুটিরে বন্দি করা। যত্ম করে তুলে রাখা।
পূর্ণিমার রাত। এই রাতে ভ্যাম্পায়ারদের শক্তি বাড়ে। পূর্ণ চাঁদের আলোয় শক্তি দ্বিগুন হয়। রূপালী চাঁদ যেন আকাশ থেকে নেমে ধরা দিয়েছে ভ্যাম্পায়ার কিংডমে। তখন প্রাসাদে হুলস্থুল কান্ড! রাজসভায় জমজমাট আয়োজন। সকলে মিলে হাত লাগিয়ে সভা সাজাচ্ছে। বড় বড় জানালার পর্দা তুলে দিতেই সভায় চাঁদের আলোয় যেমন আলোকিত কচ্ছে ঠিক তেমনই স্বর্ণের মতো প্রাসাদে প্রবেশ করছে জোনাকির দল। রাজসভার পরিবেশ আরো শান্তিপ্রিয় করে তুলে চলেছে। মাধুর্য গুনে গুনে সকলের কাছে গিয়ে দেখছে সকলে ভালো করে পর্দা উঠিয়ে জানালা খুলে দিচ্ছে কিনা। তার শরীর আগের থেকে অনেকটা সুস্থ। আগের মতোই হয়ে উঠেছে ছটফটে। চনমনে স্বভাবের। দ্রুত চোখের পলকেই হেঁটে যাচ্ছে। পেছন পেছন ছুটছে অনুভব। তার শান্তি নেই। এই চঞ্চলিনীকে থামানো যাচ্ছে না। পরণে ইয়া বড় একটা লম্বা বেগুনি পোশাক পড়েও কিভাবে ছুটছে সে। অবশেষে মাধুর্য গিয়ে থামলো একজায়গায়। তবুও ফুলের ডালা নিয়ে পানির মধ্যে ফুলগুলো আর প্রদীপ মতো আলোর মাটির জিনিসটিকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। অনুভব ধীর পায়ে গিয়ে মাধুর্যের ঠিক সামনে দাঁড়াল। মাধুর্য তখনও ব্যস্ত! অনুভব এবার হালকা কেশে অসহায় গলায় বলে উঠল,
“এইযে রাজ্যের রাণী, মনের রাণী! আমার দিকে একটু তো তাকাও। এইযে তোমার সামনে থাকা এই ব্যক্তিটি জন্য কত মনোযোগ দিয়ে তৈরি হয়ে এসেছে। রাণীর চোখ যে তবুও পড়ছে না! এই প্রজার দিকে তাকিয়ে একটু ধন্য করো।”
পানির প্রদীপে আগুন জ্বালিয়ে কড়া দৃষ্টিপাত করল মাধুর্য। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলল,
“ওই মেয়ের সাথে এতো কথা বলার কি আছে? ওকে বুঝি এই রাণীর থেকে বেশি সুন্দর লাগছিল?”
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল অনুভব। ভ্যাবাচেকা খেয়ে উল্টো প্রশ্ন করল,
“কোন মেয়ে?”
“ভুলে গেছেন নাকি নাটক করছেন? ওইতো রাজসভা থেকে বেরিয়ে ছোট বারান্দার দিকে।”
অনুভব মনে করার চেষ্টা করে। মনে পড়তেই মাথা নাড়িয়ে হতবাক হয়ে বলে,
“ওহ ওই মেয়ে? আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিল। অন্য কিছু না।”।
“শুধু সাহায্য? কি যেন বলছিল! ও হ্যাঁ এতো বছর হয়ে গেল আপনি এখনো দেখতে সেই যুবক প্রিন্স চার্মিং ই আছেন। এখনো আপনার ওই নীল চোখের দিকে তাকালে মনে হয় যেন সেই কালে ফিরে গিয়েছি ইত্যাদি ইত্যাদি! এগুলো সাহায্য চাওয়ার নমুনা?”
এবার কপালে হাত চলে যায় অনুভবের। মাধুর্য রাগে কটমট করে সেখান থেকে গটগট করে হেঁটে সরে আসে। অনুভব কিছুটা চেঁচিয়ে বলতে থাকে,
“এতে আমার কি দোষ? আমি তো ওকে কোনো কমপ্লিমেন্ট দিই নি। মাধু! ও মাধু!”
মাধুর্যের পেছন ছুটতে থাকে অনুভব। কি একটা বিপদ!
সুন্দর কারুকার্যে সাজানো কক্ষ। বড় একটা পালঙ্কের পাশে জ্বলছে আগুনের আলো। সাদা পর্দার আস্তরণ দিয়ে ঢাকা বড় জানালাটি। বাম পাশে ঝুলিয়ে রাখা দুটো তলো’য়ার। কক্ষে থাকা সুদর্শনীর হাতে দাসীরা পড়িয়ে দিল সাদা রঙের বড় পাথরের আংটি। তৈরি হওয়া তার শেষ। দাসীদের হাত দিয়ে ইশারা করতেই মাথা ঝুঁকে বেরিয়ে পড়ল তারা। রূপবতী সেই কন্যা ধাবিত হলো জানালার দিকে। দুহাতে সাদা ধবধবে পোশাকটা ধরে এগিয়ে এসে পোশাক ছেড়ে দুদিকে জড়িয়ে দিল সাদা পর্দা। বেরিয়ে পড়ল আকাশ। চকচক করছে কতগুলো তাঁরা। চাঁদ এখনো ঢাকা। সঠিক সময়ে দেখা দেবার পরিকল্পনা করছে হয়ত। আকাশের পানে চাইতেই তার নেত্র যুগল হয়ে এলো সবুজ। চোখ বুঁজে স্বাভাবিক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বড় আয়নার দিকে তাকালো সে। আয়নার কাছে এসে দাঁড়াল। স্বচ্ছ এক রাজকন্যার ন্যায় দেখাচ্ছে। যার প্রতিটা অঙ্গে শুভ্রতার ছোঁয়া। তার হাতটা আয়নায় দিতেই হঠাৎ সে পাল্টাতে লাগল। ভ্রু কুঁচকালো সে। প্রতিচ্ছবিতে যখন তার পরনে পোশাক কালো এবং মাথা থেকে পা অবধি কালোর ছোঁয়া দেখতে পেলো তখন বুঝে নিল সে। স্মিত হাসলো। তবে তার প্রতিচ্ছবিতে হাসি নেই। এই ঘটনা আজ নতুন নয়। এর আগেও ঘটেছে। আজ সে নিজে মুখ খুলে বলল,
“আমি বেছে নিয়েছি আমার অস্তিত্ব। আমি বেছেছি আমার ভালোবাসা। আর ধ্বংস করেছি চির জীবনের মতো তোমায় ডেভিল কুইন ঐশ্বর্য!”
কথাটা বলা মাত্র প্রতিচ্ছবি আবারও বদলাতে শুরু করে। তার সত্যিকারের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে এবার। ঐশ্বর্যের হাসি প্রগাঢ় হতেই সেই প্রতিচ্ছবি আবারও তাকে হতভম্ব করে দিয়ে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস ঐশ্বর্য তুমি ঠিকই বলেছো। অবশেষে তুমি নিজের আসল অস্তিত্ব বেছেই নিয়েছো। সবশেষে তুমি এই রাজ্যের রাণী হতে চলেছো। ভ্যাম্পায়ার ক্রাউন তুমি এবং তোমার স্বামীর মাথায় উঠতে চলেছে। অভিনন্দন তোমায়। জিতে গিয়েছো! তবে এটা মনে রেখো। এটা তোমার শেষ জিত নয়। আরো জিততে হবে। আরো লড়াই করতে হবে। এই রাজ্যের জন্য। আর আমি জানি তুমি তোমার অর্ধাঙ্গের হাত ধরে সফলভাবে জিতবে।”
প্রতিচ্ছবি কথা বলা সমাপ্ত করতেই তার ওপর হাত রাখলো ঐশ্বর্য। মুখটা মলিন হলো। সেও তার প্রতিচ্ছবিকে কিছু কথা বলতে চাইলো তবে হলো না। এই প্রতিচ্ছবি এখন জড়ো তে পরিণত হয়েছে। তখনি দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে পিছু ফিরে তাকালো ঐশ্বর্য। মাধুর্য এসেছে। মেয়ের দিকে এগিয়ে এসে তার চিবুক ধরে মুগ্ধ হয়ে বলল,
“কারো নজর না লাগুক।”
বলে তার চোখের নিচ থেকে কাজল নিয়ে ঐশ্বর্যের কানের পিঠে লাগিয়ে ঐশ্বর্যের চিবুক ছুঁয়ে নিজের হাতে চুমু খেয়ে নিল। তারপর ঝটপট করে বলল,
“তাড়াতাড়ি রাজসভায় এসো। সময় নেই আর হাতে। চাঁদ দেখা দিল বলে! এলিনা সহ মৌবনি আর শার্লিও তোমায় নিতে আসবে। আমার নিচে কাজ আছে। তুমি এসো।”
মাধুর্য তাড়াহুড়ো করে যেতে নেয়। তবে তার হাত ধরে আটকায় ঐশ্বর্য। পিছু ফিরে দেখে ঐশ্বর্যের বড় বড় অক্ষিকোটরের নিষ্পলক দৃষ্টি। কথায় বলে মায়েরা নাকি সন্তানের মন ও চোখের ভাষা খুব সহজে পড়তে পারে! মাধুর্য থমথমে সুরে জানতে চাইল,
“কিছু বলবে তুমি?”
কথাটা বলতেই ঐশ্বর্য বসে পড়ে বিছানায়। কিছু না ভেবে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে,
“মা আমি এই রাজ্যের দায়িত্ব নিতে চাই না।”
চকিতে তাকায় মাধুর্য। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকে পরিবেশ মাধুর্য নিস্তব্ধতা কাটিয়ে প্রশ্ন করে,
“হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন ঐশ্বর্য? আজ তোমার আর প্রেমের অভিষেক। প্রেম তোমার জন্য নিজের স্বাভাবিক জীবন ত্যাগ করে এই রাজ্যের দায়িত্ব নিতে চাইছে। তুমি কেন চাইছো না?”
“আমি ওই মুকুটের যোগ্য নই মা। ওই মুকুটের যোগ্য তুমি। যে সারাজীবন এই রাজ্য আর প্রজাকে এতো সুন্দর ভাবে রক্ষা করে এসেছে। অন্যদিকে আমি কি করেছি? নিজের রাজ্যকে সহ্য করতে পারিনি। নিজের এই অস্তিত্ব প্রাণপণে বিনাশ করতে চেয়েছি। এমনকি নিজের রাজ্য আর এইসব প্রজাদের ধ্বংস করতেও চেয়েছি একটা সময়। কি করে তবে আমি এসবের যোগ্য হতে পারব? এই দায়িত্ব দিও না আমায়।”
মাধুর্য বুঝতে পারে ঐশ্বর্য কি বোঝাতে চাইছে। বড় একটা শ্বাস নিয়ে ঐশ্বর্যের চিন্তিত মুখের দিকে তাকায় সে। তার মাথায় হাত রাখে। আর শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
“তুমি সেসব করেছো কারণ তুমি নিজের মাঝে ছিলেই না। তোমার মধ্যে তখন অন্য এক শক্তি বেড়ে উঠছিল। তুমি তখন নিজের ঘোরে ছিলে না। আচ্ছা একটা রাজা বা রাণীর সবথেকে বড় সার্থকতা কি জানো?”
“কি?”
কৌতুহল ভরা নয়নে মাধুর্যকে জিজ্ঞেস করে ঐশ্বর্য। মাধুর্য আনমনে বলে,
“নিজের রাজ্যকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমস্ত সীমা অতিক্রম করে রক্ষা করা। আর তুমি সেটা করেছো। নিজেকে সেই সীমানায় নিয়ে গেছো। আর কি চাই? একজন যোগ্য রাণী হয়ে উঠেছো তুমি নিজের অজান্তে। সাথে প্রেমও।”
ঐশ্বর্যের মাঝে কেমন যেন আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে। নিজের প্রতি স্বস্তি আসে। অপ্রস্তুত হাসি আসে। মাধুর্যও এমন কান্ডে হেঁসে বলে,
“রাজ্যের সকলে নতুন ভ্যাম্পায়ার কিং আর কুইনের অপেক্ষায়। দ্রুত এসো।”
রাজসভায় একদিকে আগমন ঘটে ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস ঐশ্বর্যের। অন্য প্রান্তে পদার্পণ ঘটে প্রেমের। প্রজারা ভীড় করেছে। তারা আসা মাত্র দুইদল ভাগ হয়ে তাদের যাবার জায়গা করে দিচ্ছে। ঐশ্বর্যের সঙ্গে আসছে মাধুর্য, শার্লি, এলিনা সহ কিছু মেয়েরা। অপরদিকে প্রেমের সঙ্গে আসছে অনুভব, ইলহান সহ কিছু ছেলেরা। দুজন সামনাসামনি হয়। মাথা উঠিয়ে তাকায় ঐশ্বর্য। চোখটা ভরে যায় সামনের মানুষটিকে দেখে। পরনে রাজ পোশাক! নতুন রূপে যেন নতুন প্রেমে পড়ল ঐশ্বর্য। অপলক তার ডাগরডাগর চোখের চাহনি। বিরবির করে বলে উঠল,
“আমার আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মি. আনস্মাইলিং!”
ঐশ্বর্যকেও আগে কখনো এই রূপে দেখে প্রেম। এ যেন সত্যিই এক ভিনদেশের রাজকন্যা! যার প্রতি আসক্তি বাড়তেই থাকে কমে না। তারা দুজনেই উঠে দাঁড়ায় সিঁড়ি বেয়ে। খুশিতে সকলের হেঁসে ওঠে তাদের দেখে। মাধুর্য ও অনুভবও উঠে আসে। তখনি জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে সকলে।
“জয় হোক আমাদের কিং এর! জয় হোক কুইনের।”
তাদেরকে ইশারায় থামতে বলে অনুভব। স্মিত হেঁসে বলে,
“সকলকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের এতোটা ভালোবাসা দেওয়ার জন্য। আমি জানি না আমি কতটুকু দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি এই রাজ মুকুটের। আর আমার রাণীই বা কতটুকু পেরেছে। তবে আজ থেকে দায়িত্ব থেকে বিরতি নিলাম। আজ আমার আনন্দের দিন। আমার মেয়ে এবং আমার মেয়ের স্বামী আমার জামাই প্রেম! যে মানুষ সকলেই জানে তবুও সে এই ভয়ানক দায়িত্ব পিছায় নি। এরা দুজন এখন থেকে আপনাদের সুখদুঃখে পাশে থাকবে। আর আমি এটাও জানি তারা তাদের দায়িত্ব শেষ র’ক্তবিন্দু দিয়ে হলেও পালন করবে।”
সকলে আবারও জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। তাদের ওপর ফুলের বর্ষণ ঘটলো। প্রেম কৌশলে ঐশ্বর্যের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। ঘাড় একটু কাঁত করে ফিসফিস করে বলল,
“আবারও এই শুভ্র নারীর প্রেমের নতুন করে পড়লাম। তুমি যেন সেই স্নিগ্ধ এবং সদ্য ফোঁটা সাদা গোলাপ যাকে নিজের বুকের সিন্দুকে লুকিয়ে রাখলে তবেই শান্তি হতো!”
ঐশ্বর্য মুখ নিচু করল। স্নিগ্ধ মুখে ফুটল সেই আভা। প্রেম আবারও বলল,
“আর কতটা পাগল বানাতে চাও আমায়?”
“যতটা আপনি আমাকে বানিয়েছেন!”
প্রেম প্রতিত্তোরে ঠোঁট প্রসারিত করে হেঁসে উঠল।
এলো সেই মূহুর্ত! সেই ক্ষণ! অনুভব প্রেমের কাছে গিয়ে বলল,
“প্রেম। যাও তোমার সিংহাসন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
প্রেম মাথা নিচু করে ঝাঁকায়। আস্তে করে হেঁটে যায় সিংহাসনের দিকে। অনুভব তাকে ইশারা করে, আস্বস্ত করে। হাত-পা কাঁপছে প্রেমের। কত বড় দায়িত্ব! সেই সিংহাসনে তাকায় একবার। ঢক গিলে সবার দিকে চেয়ে বসে পড়ে সোজা হয়ে রাজ ভঙ্গিতে। জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে প্রেমের নামে। খুশিতে হুল্লোড়ে ভরে যায়। অনুভবও এগিয়ে আসে। তার মাথায় থাকা রাজ মুকুট তুলে নিয়ে প্রেমের মাথায় বেঁধে দিতেই চাঁদের আলো স্পর্শ করে তাকে। যেন প্রেমের আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। তার হাসিতে আস্বস্ত হচ্ছে সকলে। প্রেম ঐশ্বর্যের দিকে উৎসুক নয়নে তাকায়। ঐশ্বর্যও হাসছে। বেশ খুশি এবং আনন্দিত সে। সেও খুশি হয়।
এবার মাধুর্য ঐশ্বর্যকে ইশারা করে। ঐশ্বর্য কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসে। সিংহাসনের দিকে তাকায়। স্বর্ণের সিংহাসন। এতোদিন তার মা বসেছে। আজ তার পালা! মাধুর্য তার কাঁধে হাত রেখে বলে,
“যাও! আজ থেকে ওটা তোমার অধিকার।”
বড় বড় শ্বাস ফেলে এগিয়ে আসে ঐশ্বর্য। সিংহাসনে হাত রেখে ছুঁয়ে দেখতেই বসে পড়ে সে। সকলে উল্লাসে বিভোর হয়ে ওঠে। মাধুর্যের দুচোখ ভরে যায়। সে পেরেছে! তার মেয়েকে তার মতো গড়ে তুলতে পেরেছে। খুশিতে চোখে অশ্রু ভাসতে থাকে। এগিয়ে যায় তার মাথা থেকে হাতে মুকুট নিয়ে। মনোমুগ্ধকর সেই মুকুট নিয়ে ঐশ্বর্যের দিকে এগিয়ে থামলো মাধুর্য। প্রেমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার একটা ইচ্ছে আছে। সেটা হলো ঐশ্বর্যকে মুকুট তার অর্ধাঙ্গ পড়াবে। #প্রেমের_ঐশ্বর্য হয়ে উঠুক সে।”
প্রেম কিছু বলতে চাইলো। তাকে বলতে দেওয়া হলো না। অনুভব তাকে যেতে বলল। প্রেম উঠে দাঁড়াল। তার হাতে ধরিয়ে দিল মুকুট। উত্তেজনা নিয়ে এগোল ঐশ্বর্যের দিকে। ঐশ্বর্য চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে। প্রেম কাছে আসতেই চোখ বুঁজে মাথা এগিয়ে দিল সে। তার মাথায় রাখা হলো সেই মুকুট। ঐশ্বর্যের কর্ণকুহরে ভেসে উঠল প্রেমের বলা কথা।
“জয় হোক আমার রাণী সাহেবার!”
আশ্চর্য রশ্মি ধারণ করল সেই মুকুটে। ছড়িয়ে পড়ল চাঁদের আলো। জোনাকিরাও যেন চারিদিকে নিজের আনন্দে আলো ছড়াতে লাগল। চারিদিকে শুধু আনন্দ আর উত্তেজনা!
শেখ মেনশন! অন্ধকার ঘর। পূর্ণিমার চাঁদের আলো অন্যরকম স্নিগ্ধতা সৃষ্টি করেছে ঘরে। এখানেও আজ পূর্ণিমা। কত সুন্দর চাঁদ। চাঁদকে একনাগাড়ে চেয়ে দেখছে ঐশ্বর্য। মাঝে মাঝে তার রূপটা ফুটে উঠছে। তবে সে আজ লুকাতে ব্যস্ত নয় নিজেকে। বরং তুলে ধরেছে প্রকৃতির সামনে। সকলের সামনে। সে যখন গভীর ভাবনায় মত্ত তখন তার মাথায় হাত রাখলো কেউ। ঐশ্বর্যের মন বুঝতে বিলম্ব করল না মানুষটি কে! তাই কোনো হেলদোল দেখা গেল না তার মধ্যে। মানুষটির উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“চাঁদ কত সুন্দর না? অদ্ভুত সুন্দর! প্রতিদিন নতুন নতুন রূপ দেখায়।”
“কোন চাঁদের কথা বলছো? ওই প্রকৃতির আকাশের চাঁদ? নাকি আমার আকাশের চাঁদ?”
এবার ঘাড় ঘুরিয়ে কিছুটা উচ্ছ্বাসের সাথে তাকায় ঐশ্বর্য। প্রেমের ঠোঁটের কোণে তখন মুচকি হাসি। ঐশ্বর্যের সাথে ঘেঁষে কাউচে বসে পড়ে সে। একহাতে ঐশ্বর্যকে আগলে বলে,
“আমি তো সবসময় আমার আকাশের চাঁদ দেখতে ব্যস্ত থাকি। তাই প্রকৃতির চাঁদ দেখার সময় পাই না। তারই যত রূপ! সুযোগ পাব কোথায়?”
ঐশ্বর্য এবার কপাল কুঁচকে বলে,
“যত রূপ?”
“ইয়েস মাই এ্যাংরি বার্ড।”
“শ্বাশুড়ি আন্টিকে আমার কথা জানিয়েছেন? বা ভ্যাম্পায়ার কিংডমের কথা?”
এবার বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বসে জিজ্ঞেস করল ঐশ্বর্য। প্রেম তখন নীরব। কিছুটা চুপ থেকে উত্তর দিল,
“সেটাই বুঝতে পারছি না। এসব কথা বললে মা কেমন রিয়েক্ট করবে! বিশ্বাস করবেই কিনা। আর কিভাবেই বা বলব কিছুই মাথায় আসছে না।”
ঐশ্বর্যের মুখ তখন ভার হয়ে আসে। থমথমে সুরে বলে,
“তাদের তো ধারণাও নেই এই সম্পর্কে। আর ইফানের কথা…”
ঐশ্বর্য কথাটুকু শেষ করতেও পারল না। প্রেম মাঝপথে বলল,
“ইফানের ডে’ড বডি পাওয়া গেছে। আমার অনুপস্থিতিতে সকলে তার অন্তিম কাজ সেড়েও ফেলেছে। পুলিশ পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কিছু খুঁজেও পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। আর তুমি ইফানের হ’ত্যাকারীকে সেই শাস্তি দিয়েছো যেটা ওর যোগ্য। তবুও কেন তোমার মন থেকে এই বিষয়টা সরছে না? আমি জানি তোমার মনে অনুশোচনা হচ্ছে। বাট লেট মি ক্লিয়ার, আমার রাণী সাহেবা সবসময় সঠিক বিচার করে। সেও ইফানকে ন্যায় বিচার পাইয়েছে। এখন এসব কথা বাদ দাও।”
ঐশ্বর্য সেই বিষয়ে আর কোনো কথা বলে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রেমের কাঁধে মাথা রাখে। প্রেম আরো আগলে নেয় তাকে। অন্যহাতে পকেটে হাত দিয়ে হঠাৎ করে একটা গোলাপ ঐশ্বর্যের সামনে তুলে ধরে বলে,
“দ্যাটস্ ফর ইউ মাই কুইন!”
চমকে উঠে সোজা হয়ে বসে ঐশ্বর্য। ফ্যালফ্যান করে চেয়ে আনন্দিত হয়ে বলে,
“ব্লু রোজ! আমার সবথেকে প্রিয়।”
“অনেকদিন পর অফিসে গিয়েছিলাম। আসার পথে মনে পড়ল এই ফুলটার কথা। আরো একটা জিনিস আছে। ওয়েট!”
কাউচ থেকে উঠে যায় প্রেম। ড্রেসিংটেবিল থেকে কিছু একটা নিয়ে এসে ঐশ্বর্যের মাথায় পড়িয়ে দিতেই ঐশ্বর্য হাতটা নিজের মাথায় হাত রাখল। কোঁকড়ানো চুলের ওপর যে ফ্লাওয়ার ক্রাউন অনুভব করতেই প্রেম বলে উঠল,
“ইউ লুক লাইক ফেইরি কুইন। মাই ফেইরি কুইন।”
ঐশ্বর্য মিষ্টি করে হাসে। তার হাসিতে যেন ঝরছে মুক্ত। হাসতে বাঁধা পড়ে তার। পর্দা এসে পড়ে মুখের ওপর। মুখটা কুঁচকে আসে। বিরক্ত হয়ে বড় পর্দা সরাতে থাকে। তখনি প্রেম একটানে তার মুখের ওপর থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়ে মূহুর্তেই ওষ্ঠদ্বয় ঠেকায় ঐশ্বর্যের কোমল গালে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শ লাগে ঐশ্বর্যের গালে। চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকে সে। থামেনা সেখানে প্রেম। আস্তে আস্তে অন্য গালেও অবিরাম ঠোঁট দ্বারা মৃদু স্পষ্ট দিতে থাকলো সে। প্রেমের গলার কলার খামচে ধরে ঐশ্বর্য। প্রেম সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মুচকি হেঁসে বলে,
“আজকাল লাল হয়ে যাও কেন?”
ঐশ্বর্য চোখ গরম করে তাকাতেই প্রেমের হাসি প্রসারিত হয়। তৎক্ষনাৎ নিজেই উত্তর দেয়,
“আগে তো আমার ভালোবাসা পেতে ছটফট করতে। নিজের মাথাও নিজেই পরিকল্পনা করে ফাটি’য়েছিলে যাতে আমি তোমার কাছে আসি। এখন যখন ভালোবাসতে শুরু করি তখন যেন পালাতে পারলে প্রা’ণটা বাঁচে তোমার!”
এবার হকচকিয়ে ওঠে ঐশ্বর্য। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকায়। আর প্রশ্ন করে ওঠে,
“আ…আপনি করে জানলেন এসব?”
প্রেম নিজের বুকে দুটো হাত জড়িয়ে রেখে সহজভাবে উত্তর দিয়ে বলল,
“ইনায়া আর সানিয়া বলেছে!”
রাগে কিড়মিড় করে উঠল ঐশ্বর্য। আসলে এদের পেটে আদেও কোনো কথা থাকে না। সবসময় কথা বলতেই হবে। আর প্রেমকে পেয়ে সব কথা উগড়ে দিয়েছে। প্রেম আবারও কিছুটা কড়া সুরে বলল,
“নিজে দোষ করে সাপের মতো ফোঁসফোঁস করছো? মনে তো হচ্ছে এখনি নাগিনীর মতো ওদের গিয়ে ছোবল মারবে।”
এবার চোখ দুটো সরু হলো ঐশ্বর্যের। প্রেম শব্দ করে হেঁসে বলল,
“দারুণ একটা বউ পেয়েছি। অল ইন ওয়ান! কখনো রাগিনী, কখনো রাজকুমারী, আবার কখনো লজ্জাবতী। সবশেষে নাগিনীও!”
গাল দুটো ফুলে ওঠে ঐশ্বর্যের। ঐশ্বর্য অনেকদিন পর শাড়ি পড়েছে। লাল রঙের জরজেট শাড়ি। গোল্ডেন পাড়। কানের দুলটা চকচক করছে। হাতে সামান্য চুড়ি। কোঁকড়ানো চুলগুলো ঢেউ খেলাতে ব্যস্ত। কিছু একটা ভেবে ঐশ্বর্যের আঁচলটা ধরে তার মাথার ওপর আঁচলটা তুলে দিতেই উৎসুক নয়নে তাকালো ঐশ্বর্য। প্রেম বলল,
“ওহে সুন্দরী! তোমার এই ঐশ্বর্যের হারাতে আমি জীবন বাজি রাখতেও রাজি।”
ঐশ্বর্য হেঁসে ফেলে। নিচু সুরে বলে,
“জীবন বাজি রাখতে হবে না। কারণ সে আপনারই!”
প্রেমের গান গাইতে ইচ্ছে করল খুব। ঐশ্বর্যের চিবুক ধরে গেয়ে উঠল,
“Baadalon ki tarah hi toh
Tune mujhpe saaya kiya hai
Baarishon ki tarah hi toh
Tune khushiyon se bhigaya hai
Aandhiyon ki tarah hi toh
Tune hosh ko udaaya hai…”
লোকটার মোটা কন্ঠস্বরের পরিবর্তন হয়েছে। কিছুটা মিষ্টি শোনাচ্ছে তার গান। ঐশ্বর্য জিজ্ঞেস করে ওঠে,
“আপনি তো গান গান না। হঠাৎ আজ?”
“নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার যে চাপা উত্তেজনা সেটা তুমি বুঝবে না রাণী সাহেবা। কারণ তুমি যেকোনো কথা হুট করেই প্রকাশ করতে জানো। আমি জানি না। আমার মনে তোমার প্রতি যে উন্মাদনা! সেই পাগলাটে অনুভূতিগুলো আমায় শান্তি দেয় না। শুধু চায় তোমায় টানতে!”
ঐশ্বর্য প্রেমের দুটো গালে আলতো করে হাত রাখে। লাজুক হেঁসে বলে,
“আপনি আমার ইন্ট্রোভার্ট প্রেমিক!”
প্রেম মাথা নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
“তাই?”
ঐশ্বর্য হ্যাঁ বোধক মাথা ঝাঁকাতেই তার মাথায় আঁচলটা দিয়ে ঘোমটা আরো লম্বা করে। সেই আঁচলের নিচে ঢুকে পড়ে। তার ঠোঁটের কোণে আলতো স্পর্শ করে বলে,
“লেটস সি দ্যাট তোমার ইন্ট্রোভার্ট প্রেমিক কতটা রোমান্টিক!”
ঐশ্বর্যের গলা শুঁকিয়ে আসে। ধকধক করে ওঠে বুকের ভেতরটা। প্রেম কাছে আসতে থাকে। তার স্পর্শগুলো গভীর হতে থাকে। সূচনা হয় এক অন্য প্রেমের অনুরক্তির! যেখানে দুজনের মাঝে কেউ নেই। তাদের সাজানো সেই সুন্দর জগতে একমাত্র তারাই!
অনেকটা সময় পেরিয়েছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অনেক কিছু বদলেছে। বদলেছে পৃথিবী! আকাশের রঙটা তবুও তেমনই রয়ে গেছে। অদ্ভুত প্রশান্তির রঙ নীল! তবে ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে তখনও শান্তি ছায়া। একঝাঁক পাখি উড়ে গেল নদীর পাড় থেকে। নদীর পানির রঙটাও রয়ে গেছে কাঁচের মতো স্বচ্ছ। নদী থেকে বেশ খানিকটা দূরে অ’স্ত্র চালনা শেখানো হয়। যুদ্ধের কৌশল শেখানো হয়। সেখানে জমেছে প্রচন্ড ভীড়। সকলে হা করে চেয়ে রয়েছে ময়দানে। নির্দিষ্ট পোশাক পড়ে মুখোমুখি হয়েছে দুজন। একজন নারী আরেকজন পুরুষ। ঠিক নারী বললে ভুল হবে। সে কিশোরী! টানা টানা তার চোখে তখন শুধু সামনের জনকে পরাজয় করার তৃষ্ণা। কি তীক্ষ দৃষ্টি তার সুন্দর চোখে! ফোলা গালে উড়ে এসে পড়ছে বেঁধে রাখা সত্ত্বেও ছোট চুল। ঘন্টা পড়তেই পুরুষটি তলো’য়ার হাতে এগিয়ে এলো কিশোরীর দিকে। তৎক্ষনাৎ সে দিল এক লাফ। তলো’য়ার চালনা ব্যর্থ হলো তার প্রতিপক্ষের। এরপর সেই কিশোরী তলো’য়ার ঘুরিয়ে নিজেও লাফ দিয়ে ঘুরে পুরুষটির গলার কাছে ধরতেই তলো’য়ার পড়ে যায় পুরুষটির হাত থেকে। অর্থাৎ সে ইতিমধ্যে পরাজিত! কিশোরীর মুখে ফুটে ওঠে হাসি। চিকন ঠোঁট যেন কারো অনুরূপ! তার হাসিতে যেন বাতাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে প্রশান্তি। সকলে জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে। জয়ধ্বনি শেষ হওয়া মাত্রই তার ডাক পড়ে। ভীড় থেকে রাস্তা তৈরি হয়। সেখানে পদার্পণ ঘটে কারোর। ডাক শুনে কিশোরী ঘুরে তাকায়। ডাগরডাগর নীলাভ চোখে দৃষ্টিপাত করে কাঙ্ক্ষিত জনের দিকে।
“পুনম!”
চলবে….
#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
শেষ পর্ব (শেষাংশ এক)
পুনম বেশ কয়েকবার চোখের পাতা ফেলে তাকিয়ে রইল। হাতে থাকা তলো’য়ারটি নামিয়ে নিল। হাসিটা প্রসারিত হতেই অস্বাভাবিক বড় নেত্র যুগল ছোট হয়ে এলো। তারপর সামনে ফিরে তার প্রতিপক্ষের হাতে তলো’য়ার ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
“নাও। তোমার আরো অনুশীলনের প্রয়োজন!”
কথা শেষ করেই এবার পিছু ফিরে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। অদ্ভুত সুভাব বইছিল বাতাসে। সেখান থেকে তা তৎক্ষনাৎ মিলিয়ে গেল। ময়দান থেকে বের হতেই তার কান টেনে ধরল কেউ। পুনম চোখমুখ খিঁচে তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল,
“আরে আরে আরে! হোয়াট আর ইউ ডুয়িং মেরি জান? সবাই দেখছে। আমার প্রেস্টিজ চলে যাচ্ছে না?”
তার কানটা ছেড়ে দেওয়া মাত্র কানে হাত বুলাতে থাকল পুনম। বড় বড় দুটো শ্বাস ফেলল। কান থেকে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। সামনে থাকা সেই জনের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো সরু করে বলল,
“সকাল সকাল কোথায় একটু আদর ডেকে খাওয়াবে কি! নয়ত আমার কান ধরতে চলে এসেছো?”
মাধুর্য কড়া চোখে তাকায়। এই সামনে থাকা হাসোজ্জল কিশোরী অর্থাৎ পুনমকে সামলাতে হিমশিম খেতে হয় তার। সে কাঠকাঠ গলায় বলে,
“আমাকে কি এভাবে জ্বালিয়ে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছো? প্রথমে তোমার মা এখন তুমি! মায়ের ছোট্ট একটা স্বভাবও যদি না পেতে! মায়ের কপি তো হয়েই গিয়েছো। তবুও আমার কথা একটু তো রাখার চেষ্টা করো!”
পুনম ঠোঁট উল্টায়। কপাল কুঁচকে বলে,
“ওহ হো! তোমার কথা আমি ফেলতে পারি বলো? কোন কথাটা ফেলেছি? ফেলতে চাইলেও তো কান ধরে করিয়েছো!”
“আজকে তোমার কলেজ যাওয়ার কথা ছিল না?”
জিহ্বা কাটে পুনম। অন্যদিকে চোরের মতো তাকায়। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে মাধুর্যের দিকে চোখ দুটো স্বাভাবিক করে পলকহীন নজরে তাকায়। মাধুর্য তার চোখের দিকে তাকাতেই তার চোখের ওপর হাত দিয়ে ধমকে আবারও বলে ওঠে,
“আমার সঙ্গে এসব চালাকি চলবে না। আমি তোমার মায়েরও মা! সকাল সকাল কলেজ না গিয়ে একে তো ময়দানে চলে এসেছো। তার ওপর আমার মন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছো?”
পুনম কিছু বলে না। চুপসে যাওয়া চোখেমুখে তাকিয়ে থাকে। মাধুর্য এবার কড়া সুরেই বলে,
“এই এলিনাকেও বলেছিলাম তুমি রাজ্য থেকে বেরিয়ে কলেজ গেছো কিনা সেটার খেয়াল রাখতে। আমি ব্যস্ত। এই মেয়েটা যে কি করে!”
পুনমের হাসি পেল। তবে মাধুর্যের সামনে হাসলে যে তাকে আরো কত কথা শুনতে হবে তার ঠিক নেই! আবারও কান টেনে ধরতে পারে। তাই হাসি আটকানোর চেষ্টা করে গেল সে। ফোলা ফোলা এবং টান টান গাল দুটো ফুলে উঠল হাসি আটকানোর চেষ্টায়। পুনমের ভাবভঙ্গি দেখে মাধুর্য কিছু একটা বোঝবার চেষ্টা করল। বুঝেও উঠল। আঁখি দুটো বড় বড় করে তার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“দাঁড়াও! তুমি এলিনাকে নিজের দৃষ্টি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছো নাকি?”
হাসিটা দমিয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকায় পুনম। না বোধক মাথা নাড়ায়। তবে তাকে বিশ্বাস করা যে যাবে না সেটা বুঝতেই পেরেছে মাধুর্য। সে আগের মতোই রেগে রেগে বলে উঠল,
“ঘরে এসো!”
পুনমের বুঝতে বাকি থাকে না যে আজকেও মাধুর্য ঝড় তুলে ছাড়বে। সকলে মাধুর্যকে দেখে মাথা নুইয়ে ফেলে। মাধুর্য হাত দিয়ে ইশারা করতেই সোজা হয়ে দাঁড়ায়। আর দৃঢ় দৃষ্টি পুনমের দিকে রাখতেই মাথা নিচু করে দ্রুত পা চালিয়ে আসে। সকলে সরে যায় তাদের যাওয়ার জন্য।
ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস পুনম! বয়সটা সতেরো হলেও কয়েকদিন পর আঠারোতে পড়বে। তার চেহারার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করলে কোনো দুজনের সম্মিলিত রূপ ভেসে উঠবে। সেই নীলাভ স্বচ্ছ হরিণী নেত্রপল্লব যখন পলক ফেলে তাকায় তখন যেন হুবহু কারোর প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। অ’স্ত্র চালনার সময় যখন প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন #প্রেমের_ঐশ্বর্য এর অনুরূপ! খাঁড়া নাক ও ছোট কপাল স্মরণ করিয়ে দেয় সেই ঐশ্বর্যের প্রেমিক পুরুষটিকে। তার মুচকি হাসিতে যেন দেখা যায় প্রেমকে। তার ঘন কালো ও ঢেউ খেলানো কেশ যেন সমুদ্রের ঢেউ। তবে যেটা তাদের থেকে আলাদা সেটা হচ্ছে এক বিশেষ ক্ষমতা। যে কাউকে কিছু মূহুর্তের জন্য নিয়ন্ত্রণ করার এক ক্ষমতা রয়েছে তার চোখে। তবুও সেই চোখ যে সেই নারীর প্রতিচ্ছবি! পুনম হচ্ছে সেই প্রণয়ের মিলনের প্রমাণ। প্রেম ও ঐশ্বর্যের র’ক্ত!
মাধুর্য প্রাসাদে প্রবেশ করা মাত্র এলিনাকে দেখতে পায়। সে দুপুরের রান্নার জন্য সবাইকে নির্দেশ করছে। কি কি রান্না হবে সেসব বলছে। মাধুর্য এগিয়ে গেল তার দিকে। মাধুর্যকে দেখামাত্র মাথা নুইয়ে নেয় এলিনা। মাধুর্যের পিছন পিছন পা টিপে এসে দাঁড়ায় পুনম। বেঁধে রাখা চুল খুলে ফেলে এলোমেলো চুল এদিক ওদিক করে চোরের মতো তাকিয়ে নখ কামড়ে যাচ্ছে সে। মাধুর্য গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“এলিনা, তোমার না পুনম কলেজ গেছে কিনা সেটা খেয়াল রাখার কথা ছিল? তুমি এখানে কি করছো?”
এলিনা উদ্ভট দৃষ্টিতে তাকায়। মাথা ঘুরে ওঠে। মস্তিষ্কে হানা দেয় স্মরণ হওয়া কথাগুলো। সত্যিই তো! সে এখানে কি করছে? সে কিছু বলতে উদ্যত হয়। কিন্তু মাধুর্য তার আগেই বলে ফেলে,
“থাক তোমায় কিছু বলতে হবে না। আমি জানি এটা পুনমের কাজ।”
“আই এম সরি। আসলে প্রিন্সেস পুনম আমাকে….”
“আমি জানি এলিনা।”
গাঢ় দৃষ্টিতে পুনমের দিকে চোখ রাখে মাধুর্য। জোর সুরে বলে ওঠে,
“নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করছো তুমি? এই শিখিয়েছি তোমায়? তুমি জানো তোমার জন্য তোমার দাদিমাকে কথা শুনতে হয়েছে। একে তো কলেজ করো না। তার ওপর এক্সামে মাত্র ফোরটিন মাকর্স হ্যান্ড্রেড এর মধ্যে! যতটুকু কলেজ করো তাও নাকি এর স্যার ম্যামদের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দাও। কলেজের এক লেকচারার যে তোমাদের ফার্স্ট ক্লাস নেয় সে কাল তোমার দাদীমাকে কল করে ওয়ার্নিং দিয়েছে।”
“এটা নিশ্চয় ওই তামিমের কাজ! সে শুধরাবে না। ম্যাথ এক্সামের আগের দিন ঝগড়া হয়েছিল তারই ফল ওই ফোরটিন মার্কস। ইচ্ছে তো করে নখ বসিয়ে…”
কটমট করে কথাগুলো বলছিল পুনম। মাধুর্য হতবাক! তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই আবার ধমকের গলায় মাধুর্য বলে ওঠে,
“শাট আপ! তুমি নিজে পড়াশোনা না করে স্যারের ওপর দোষ চাপাচ্ছো। আর কোন সাহসে তুমি স্যারের নাম ধরে কথা বলো?”
পুনমের মুখটা বেলুনের মতোই চুপসে যায়। এলিনাও ঢোক গিলে না। মাধুর্য নরম মনের হলেও একবার যদি আগুনের মতো ধপ করে জ্বলে ওঠে তবে তাকে নেভানো মুশকিল! মাধুর্য দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। কিছুটা শান্ত গলায় বলে দেয়,
“আজ থেকে তুমি কলেজ যাবে। তাও প্রতিদিন। এখানে আসবে কম। এখানে এলে পড়াশোনা তো ছুটেই যায় তার ওপর সারাদিন ঘোড়া নিয়ে দৌড়ে বেড়াও নয়ত ময়দানে। দাদীমার কাছে থাকবে। এখন যাও।”
মাধুর্যের পরিষ্কার কথা। পুনম আর কোনো পাল্টা জবাব দিল না। এবার যদি কিছু বলার চেষ্টাও করে কপালে শনি লিখা আছে। এলিনার দিকে তাকাতেই এলিনা তাকে ইশারা করে বলে মাধুর্যের কথা শুনতে।
ভ্যাপসা গরম। চারিদিকটা রোদে খাঁ খাঁ করছে। মাথার একদম উপরে সূর্য মামা। দরদর করে ঘামছে পুনম। একহাতে ছাতা অন্যহাতে পাতলা ব্যাগ আর চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে ক্যাম্পাস দিয়ে হেঁটে চলেছে সে। মুখে থাকা চুইংগাম চিবাতে চিবাতে বিরবির করে বলল,
“আজকে ওই লেকচারারের গলা টিপে ধরে তবেই বাড়ি ফিরব। তারপরেই শান্তি!”
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চুইংগাম দিয়ে একটা বড় বেলুন ফুলিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ল সে। কিছুক্ষণ ফুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। চুইংগাম নাকে মুখে লেগে গেল কাশতে কাশতে মুখ থেকে বাকি চুইংগাম ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“হোয়াট দ্যা…!”
ছাতা ফেলে দিয়ে হাতটা চোখে মুখে রেখে লেগে থাকা চুইংগাম তুলতে চেষ্টা করতে থাকে পুনম। অন্যদিকে কারো বিকট চিৎকার শুনে মুখ থেকে হাত সরিয়ে হকচকিয়ে তাকায় সে। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব সে। চোখ দুটো ভালো করে তাকাতেই সূর্যের তীব্র তাপ এসে তার চোখমুখে পড়ে। চোখমুখ খিঁচে ফেলে সে। চোখ দুটো হালকা খোলা রেখে দেখে সামনে একজন পুরুষকে। চেনা নয় সেই ব্যক্তি। অচেনা! ব্যক্তিটির চোখেমুখে রাজ্যের বিরক্তি। হলুদ ফর্সা ত্বক ইতিমধ্যে ধারণ করেছে রক্তিম বর্ণ। মানুষটাকে আপাদমস্তক দেখে নিল পুনম। পরনে সাদা শার্ট। শার্টের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখা গেল তার খাওয়া চুইংগামটি। এবার বুঝতে দেরি হলো না পুনমের। ব্যক্তিটি ক্ষেপে গেছে এই কান্ডে। সানগ্লাস পড়ে থাকলেও এবার সবটা অস্পষ্ট লাগছে পুনমের। হাত-পা জ্বালা করছে। থাকা যাচ্ছে না সূর্যের তাপ। একহাত দিয়ে অন্যহাত বুলাতেই মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠে তাকায় সে হাতের দিকে। লাল রঙের দাগ ইতিমধ্যে হাতে বসে গেছে। অন্যদিকে কর্ণকুহরে ভেসে আসছে পুরুষটির রূঢ় কন্ঠ।
“হোয়াটস ইউর প্রবলেম? চোখে দেখো না? আমার শার্ট নষ্ট করে দিয়েছো। কোন ইয়ার তুমি?”
পুনমের চোখ জ্বালা করছে। তাকাতে পারছে না। ফট করে পুরুষটিকে অগ্রাহ্য করেই তার পাশ কাটিয়ে ঝড়ের বেগে দৌড় দেয়। চোখের পলকে সামনে থাকা মেয়েটি গায়েব হতেই হতবাক হয় সেই ব্যক্তি। আশেপাশে তাকায়। কোথায় গেল মেয়েটা?
ক্লাসরুমে বসে হাঁপাচ্ছে পুনম। গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। ছাতাটা বাহিরেই ফেলে এসেছে। একটু পানি পেলে খুব ভালো হতো! মাথা নিচু করে নিস্তেজ হয়ে লাস্ট বেঞ্চের দিকে বসে আছে সে। মাঝেমধ্যে প্রায় পুড়ে যাওয়া হাত নাড়ছে। জানালার থাইয়ের দিকে তাকাতেই কিছুটা আঁতকে উঠল সে। গালে লাল লাল দাগ উঠেছে। এজন্য মাধুর্য তাকে বার বার বলেছিল রাস্তায় ছাতা না সরাতে। হঠাৎ তার পাশে এসে দুজন মেয়ে বসে। পুনম মাথা উঠিয়ে তাকায়। তাদের মধ্যে একজন পুনমের ছাতা এগিয়ে দেয়। আর বলে,
“তোমার চোখমুখ, হাত আর গলার অবস্থা অনেক খারাপ। আমাদের ওয়াশরুমে চলো। পানি দিলে ভালো লাগবে। আর ছাতাটা অনিভ্র স্যার দিল তোমায় দিতে। আর তোমায় বেশি করে পানি দিতে বলল!”
এবার দুটো মেয়ের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চাইলো পুনম। তাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলে,
“অনিভ্র স্যার?”
“হ্যাঁ। উনিই তো বললেন তোমার নাকি সমস্যা হয়েছে। ছাতাটাও দিয়ে বললেন এটা তোমার তাই দিয়ে দিতে। ওইযে দাঁড়িয়ে আছেন উনি।”
পুনম কৌতুহলী দৃষ্টিতে বাহিরে তাকালো। ক্লাসরুমের ওপর প্রান্তে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক মানব। এইতো সেই পুরুষ! পুরুষটির চোখ দুটো অশান্ত। উনি তো পুনমকে ঝাড়তেই ব্যস্ত ছিলেন তাহলে তার সমস্যা কখন খেয়াল করলেন?
আকাশে সুন্দর চাঁদ। পরিপূর্ণ চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়েছে কক্ষ। আলাদা করে আলো জ্বালানোর প্রয়োজন হয়নি আর। জোনাকিরাও ভিড় করছে পুনমের আশেপাশে। সে মাধুর্যের কোলে মাথা দিয়ে একমনে জোনাকির খেলা দেখছে। মাঝেমাঝে মৃদু হাসছে। হাসির কারণ সে নিজেই জানে না। শুধু চারিপাশে ভাসছে সেই পুরুষের অশান্ত চোখ। মাঝে মাঝে বুকের বা পাশে হাত রাখছে সে। ধকধকানি বাড়ছে সেই পুরুষের স্মরণে! এর কারণেই বোধহয় এমন হাসি?
পুনমের হাসি খেয়াল করে মাধুর্য তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“কি ব্যাপার? এতো হাসি কেন হঠাৎ?”
পুনম তার হাসোজ্জল মুখ লুকায় মাধুর্যের কোলে। আর চাপা সুরে বলে,
“কিছু না।”
একটু থামে পুনম। আবার জানালা দিয়ে চাঁদের দিকে চেয়ে বলে,
“#প্রেমের_ঐশ্বর্য এর জয়ের গল্পটা আরেকবার শোনাবে মেরি জান? তোমার মেয়ের জয়ের এক আলাদা গল্প?”
মাধুর্য থামে। থমকে যায়। বুকের ভেতরটা হাহাকার দিয়ে ওঠে। পরক্ষণেই মুচকি হাসিতে যেন সব অন্ধকার কাটে। নম্র সুরে বলে,
“প্রতি রাতে এই জয়ের গল্প শুনে কি পাও?”
পুনম হাসে। উঠে সোজা হয়ে বসে। বড় শ্বাস নিয়ে বলে,
“একটা অদ্ভুত শান্তি! একটা অদ্ভুত অনুভূতি! শোনাও না!”
“তবে শোনো। শত বাঁধা পেরিয়ে একজন ডেভিল কুইন যখন হয়ে উঠেছিল ভ্যাম্পায়ার কুইন এবং একজন সাধারণ মানুষ যখন হয়ে উঠেছিল ভ্যাম্পায়ার কিং তখন পাল্টে গেছিল তাদের ভাগ্যের লিখন। এক অদ্ভুত সুখের উল্লাসে ভরে গিয়েছিল এই রাজ্য। সেটা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র তাদের জন্যই। রাণী আগলে রেখেছিল প্রতিটা প্রজাকে নিজের সন্তানের মতো। হয়ে উঠেছিল ঐশ্বর্য থেকে রাণী সাহেবা সেই সাথে #প্রেমের_ঐশ্বর্য।”
অতীত…
প্রেম ও ঐশ্বর্যের অভিষেকের পর সেই সুখময় সংসারের কেটে গেছে চারটি বছর। তখন সবকিছু যেন তাদের মনের মতো। এতোসব ব্যস্ততার মধ্যেও যেন রয়েছে প্রেম ও ঐশ্বর্যের এক অন্য নিজেদের জগত। তাদের নিজেদের এক ছোট্ট পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে শুধু তারা এবং তাদের ছোট্ট প্রিন্সেস পুনম রয়েছে। পুনমের বয়স তখন এক বছরের কাছাকাছি। ভালো করে হাঁটতে শিখেনি এখনো। টলমল করে মেয়েটা। তবুও পুরো প্রাসাদ জুড়ে প্রতিদিন তাকে নিয়ে হুড়োহুড়ি চলে। অন্যদিকে প্রেমের মা মিসেস. পরিণীতা আর সেই সাথে তার বাবাকেও প্রেম জানাতে সক্ষম হয়েছে ঐশ্বর্যের আসল পরিচয়। প্রথম প্রথম তারা আপত্তি করেছিল। ঐশ্বর্যকে দেখে ভয়ে ভয়ে থাকতো। তবে ঐশ্বর্যের নম্র আচরণ সবটা পাল্টে দেয়। তারাও ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি পায়। সেই রাজ্যে তখন সুখপাখির আনাগোনা!
ভ্যাম্পায়াদের জন্য এক অন্যতম রাত হচ্ছে পূর্ণিমার রাত। এই রাতটা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়। মানুষদের জগতে বাস করলে আবার এই রাতটাই ততটায় ভয়ানক হয়ে ওঠে। কারণ চাঁদের আলো যখনই ভ্যাম্পায়াদের ওপর পড়ে তখনই জেগে ওঠে ওদের আসল রূপ। সেদিনও ছিল তেমনই এক রাত। ঐশ্বর্য সেদিন ভ্যাম্পায়ার রাজ্যেই ছিল ছোট্ট পুনমকে নিয়ে। তখন হাত-পা নাড়িয়ে মায়ের কোলে খেলতে ব্যস্ত পুনম। মাঝে মাঝে আপনমনে হেঁসে উঠছে। তার হাসি দেখেই ঐশ্বর্যও শব্দ ছাড়াই হাসছে। যখন মেঘে ঢাকা চাঁদটা পরিপূর্ণ রূপ ধারণ করে তখন জানালার দিকে মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে যায় ঐশ্বর্য। পুনমকে জানালার কাছে দোলনায় শুইয়ে দেয়। রাজকীয় কাজ করা দোলনায়। সাদা রঙের চাদর এবং বালিশ। উপরের অংশটা সাদা ফুল দিয়ে সাজানো। যখন পুনমকে শুইয়ে দেওয়া হয় তখন যেন তাকে শুভ্রতার রাজকন্যা দেখায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকায় ঐশ্বর্য নিজেই। গোলগাল মুখে যখন চাঁদের রশ্মি বর্ষিত হয় তখন মুচকি হেঁসে মেয়ে দুহাত মুঠো করে হাতে আলতো করে চুমু খায় ঐশ্বর্য। আর আপনমনে বলে,
“শুভ্রতার রাজকন্যা পুনম!”
ছোট্ট পুনম কি বুঝল তা জানা নেই। তবে সে শব্দ করে হেঁসে উঠল। দুই গালেই টোল পড়তেই তার হাসির মাধুর্য বাড়ল বেশ। তারপর ঐশ্বর্যের খেয়ালে এলো পুনমের চোখ দুটো। তার চোখ সবুজ বর্ণে পরিণত হচ্ছে। গায়ের রগ গুলো আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে। ঐশ্বর্য তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বেশ ক্লান্ত লাগছে ঐশ্বর্যের। তাই সে পিছু ফিরে গিয়ে বিছানায় বসে। পাশে থাকা চারকোনা আকারের টেবিলে রেখে দেওয়া ছবির দিকে তাকায়। প্রেম আর তার ছবি। প্রেম তার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে। আর ঐশ্বর্য সামনের দিকে। ছবিটা তখনকারই! লোকটাকে মনে পড়ছে ভীষণ। যদি এই মূহুর্তে প্রেমের বক্ষে মাথা রাখতে পারতো তবে এক নিমিষে দূর হতো সমস্ত ক্লান্তি। তবে আজ বোধহয় তা সম্ভব নয়। এসবের বাহিরে তার একটা মনুষ্য জীবন রয়েছে। তার সেই জীবনের কাজকর্মকে প্রধান্য দেওয়া প্রয়োজন! আর ঐশ্বর্য এসবে তাকে বিরক্ত করতে চায় না। একদমই না। তাই সে কোনোরকম অভিযোগও করে না।
রাতটা তখন গভীর হতে থাকে। চোখ দুটো লেগে আসে ঐশ্বর্যের। আধশোয়া হয়ে ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকে তার অজান্তেই। টিমটিম করে জ্বলছে টেবিলের বড় বাটির পানিতে থাকা প্রদীপ। হঠাৎ ঘুমের মাঝেই তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে অদ্ভুত সব দৃশ্য! চারিদিকে দেখতে পায় লা’শের সমাহার। অস্থির হতে থাকে ঐশ্বর্যের মুখভঙ্গি। এদিক ওদিক হাত-পা ছুঁড়তে থাকে। তবুও চোখের সামনে থেকে যায় না সেই দৃশ্য। আর লা’শের প্রতিটা মুখ ঐশ্বর্যের চেনা। সকলে তারই রাজ্যের প্রজা! তারই প্রাসাদের কেউ। মুখ চিনতে পেরে সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে ঐশ্বর্যের। সে পাগলের মতো ডাকতে থাকে সকলকে। কেউ চোখ মেলে তাকায় না। এসব দেখে তার নিঃশ্বাস আঁটকে আসে। চারিপাশ অন্ধকার হয়ে আসে। তখনই চোখেমুখে গরম নিঃশ্বাস আর ঠান্ডা বাতাস অনুভব করতেই ধড়ফড়িয়ে ওঠে ঐশ্বর্য। চোখ দুটো দ্রুত মেলে উঠে বসতে চায়। কিন্তু তার সামনে ভাসছে এক পুরুষালি হাসোজ্জল অবয়ব। খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর প্রশস্ত দেহ চিনতে ভুল হয় না তার। তৎক্ষনাৎ কাঁপা দুটো হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে পুরুষটিকে। তার বক্ষে নিজের মাথা রাখে। চোখ দুটো বুঁজে ফেলে বড় বড় শ্বাস ফেলতে থাকে।
আচমকা ঐশ্বর্যের এই কাজে কিছুটা বিস্মিত হলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয় প্রেম। অতঃপর তার একহাত দিয়ে ঐশ্বর্যের মাথা আর আরেকহাত তার পিঠে রেখে মাথা বুলিয়ে দিতে দিতে থমথমে সুরে প্রশ্ন করে,
“আবারও বুঝি খারাপ স্বপ্ন দেখেছো এ্যাংরি বার্ড?”
ঐশ্বর্য চোখ খোলে। প্রেমকে ছাড়তে চায়। তবে এবার প্রেম ধরে রাখে তাকে। নিজের সঙ্গে আগলে রাখে। ঐশ্বর্য আগের মতোই উত্তর দিয়ে বলে,
“হু!”
ঐশ্বর্য গত কয়েকদিন ধরে অদ্ভুত আর খারাপ স্বপ্ন দেখে চলেছে। আর তা নিয়ে রাতে বিচলিত হয়ে পড়ে। প্রেম তাকে সামলায়। প্রেমের হাতের বাঁধন আলগা হতেই ঐশ্বর্য কিছুটা সরে উঠে বসে বলে,
“আপনার না আজ এখানে থাকার কথা নয়? কাল সকাল সকাল তো মিটিং আছে আপনার। তো এখানে এতো রাতে এলেন যে…?”
“আমি না এলে আমার বদলে অন্য কাউকে তো জড়িয়ে ধরার চান্স নেই। তাই আমিই চলে এলাম। আমার বদলে যদি ভয়ে অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরো? এতো রিস্ক নেওয়ার দরকার কি? আমি আবার এসব ব্যাপারে রিস্ক নিতে চাই না।”
ঐশ্বর্য ঠোঁট চেপে প্রেমের বুকে চাপড় মারতেই প্রেম চোখ গরম করে বলে ওঠে,
“খবরদার, এখানে স্পর্শও করবে না! এখানে আমার প্রেয়সীর বসবাস।”
ঐশ্বর্য স্থির চোখে তাকায় মানুষটির দিকে। কম সময় পার হয়নি। বহু সময় গিয়েছে। তবুও সে পাল্টায় নি। নিজের মতো করে ভালোবেসে গিয়েছে। প্রেমকে কাছে আসতে দেখেই প্রেমের ঠোঁটের ওপর হাত রেখে ঐশ্বর্য ইশারায় দূরে থাকতে বলে। প্রেম মানুষটা এক্ষেত্রে মোটেও শোনার পাত্র নয়। দূরে থাকার পাত্র নয়। তার মুখের ওপর থেকে ঐশ্বর্যের হাত সরিয়ে তা পেছনে চেপে ঐশ্বর্যের দিকে ঝুঁকে পড়া মাত্রই ঐশ্বর্য তড়িঘড়ি করে জানালার কাছে থাকা দোলনার দিকে। তা লক্ষ্য করে প্রেম আরো কাছে এগিয়ে এলো। ঐশ্বর্যের কানের কাছে মুখ রেখে বলল,
“মাই প্রিন্সেস ইজ স্লিপিং। সে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে কারণ সে জানে তার বাবা আর মা একসঙ্গে কিছু সময় কাটাতে চায়। যাতে সে তার জুনিয়র সিস্টার বা ব্রাদার পায়।”
লজ্জায় পরিপূর্ণ হলো ঐশ্বর্যের চেহারা। চোখ মেলাতে পারল না প্রেমের চোখে। মুখ নিচু করে প্রেমের কাঁধে মাথা রাখল। প্রেম হাসি দিয়ে বলল,
“এমন দৃষ্টি আমার এখানে গিয়ে লাগে।”
বলেই নিজের বুকের বামপাশে হাত রাখে প্রেম। ঐশ্বর্য উঠে প্রেমের গালে হাত রেখে একটু উঁচু হয়ে তার গালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছোঁয়ায়। প্রেমের মনে বয়ে যায় বসন্তের হাওয়া। হৃদয়ে তীরের মতো বিঁধে সেই স্পর্শ!
ঘুম ঘুম চোখে তাকায় ঐশ্বর্য। দরজায় কেউ সজোরে কড়া নাড়ছে। চোখ ডলতে ডলতে তাকায় ঘুমন্ত প্রেম এবং মাঝখানে শুইয়ে রাখা পুনমের দিকে। তারপর বাহিরের দিকে দৃষ্টি রাখতেই দেখতে পায় এখনো আকাশের অন্ধকার ভাবটা কাটেনি ভালোভাবে। মানে সবে ভোর। এই ভোরে এতো ডাকাডাকি হজম হলো না তার। কোনো বিপদ হয়েছে নাকি? এই কথাটা ভাবনায় আসতেই বিছানা ছেড়ে ঝড়ের গতিতে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল ঐশ্বর্য। দরজাটা খুলতেই দুটো সৈন্যের বিচলিত মুখ দেখতে পেল সে। ঐশ্বর্য কিছু বলার সুযোগ পেল না। তার আগেই তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল,
“ক্ষমা করবেন এতো ভোরে বিরক্ত করার জন্য কুইন। তবে খুব বিপদ হয়েছে। দীঘিতে একজনের লা’শ পাওয়া গেছে। আমাদেরই কেউ হবে।”
বুকটা ধক করে উঠল ঐশ্বর্যের। র’ক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে যেন! মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে আসছে। কিছু ভেবে না পেয়ে সৈন্যদের উদ্দেশ্য করে বলল,
“এক্ষুনি চলো সেখানে।”
যাবার আগে ঘরে পুনরায় ঢুকে চাদর জড়িয়ে নেয় ঐশ্বর্য। তারপর একপলক প্রেম ও পুনমের দিকে চেয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে দীঘির উদ্দেশ্যে। তার ঘোড়ায় চড়ে রওনা দিল দীঘির দিকে।
আলো ফুটতে শুরু করেছে তখন। দীঘির পাড়ে জমা হয়েছে অনেকে। ভীড় সরিয়ে প্রবেশ করল ঐশ্বর্য। তাকে দেখে মাথা নুইয়ে নিল সকলে। পানিতে ভিজে গেছে লা’শটা। ফুলে উঠেছে দেহ। বোঝায় যাচ্ছে বেশ কয়েকদিন পানির নিচে ছিল। সকলে চেনার চেষ্টা করছে আসলে এই মৃ’ত দেহ কার!
ঐশ্বর্য হাঁটু ভাঁজ করে বসে। হাত রাখে লা’শের ওপর। লা’শ ঘুরাতেই সকলের চোখ বড় বড় হয়। একেবারে মুখে কোনো তলো’য়ার দিকে একটা আঘা’ত হা’না হয়েছে। ঐশ্বর্য হাত রাখে পেটে। শেষ আঘা’ত পেটেই করা। গভীর ক্ষ’ত। বুকের ভেতরটা কাঁপছে ঐশ্বর্যের। কিছু মাথায় আসছে না। মাথা ঘুরছে। চোখটা বুঁজে নিজেকে শান্ত করতে চাইলো সে। আর সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলল,
“এটা কার মৃ’ত দেহ খুঁজে বের করো সকালের মধ্যে।”
মাথা নাড়ালো সকলে। অন্তিম কাজ সমাপ্ত হলো সকালের মধ্যেই। ঐশ্বর্য দূরদৃষ্টি দিয়ে সেদিন দেখেছিল কিভাবে সমাপ্তি ঘটছিল তারই রাজ্যের প্রজার। তাও তার বিচার করতে করতে পারেনি ঐশ্বর্য। পায়নি কোনো রূপ প্রমাণ। সেদিন সে দেখেছিল সেই মৃ’তের কাছের জনদের আর্তনাদ। হৃদয়ে যেন তখন পাথরের বর্ষণ ঘটেছিল!
সেটাই শেষ ছিল না। ভ্যাম্পায়ার কুইন ঐশ্বর্যের দুঃস্বপ্নের মতো একে একে প্রজাদের মৃ’ত দেহ মিলতে থাকল যেখানে সেখানে। চারিদিকে তখন শুধু প্রিয়জনকে হারানোর হাহাকার ঐশ্বর্যের চোখে ভাসতে থাকল। তার মনে হলো সে একেকটা সন্তানকে হারাচ্ছে। ভাঙতে থাকল তার ভেতরটা। সে ধরতে পারল না হ’ত্যাকারীকে। শুধু নিরবে দেখে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না যেন। আর পাগলের মতো খুঁজতে থাকল এর সমাধান ও হ’ত্যাকারীকে সে ও প্রেম।
আজ আবারও মিলেছে আরেকটা লা’শ। গায়ে কাটা দিয়ে উঠেছে ঐশ্বর্যের। সে একটা কক্ষের বাহিরে অপেক্ষা করছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। পায়চারি করতে করতে যখন কক্ষের দরজাটা খুলল তখন কিছুটা শান্ত ও নিরবভাবে প্রবেশ করল ঐশ্বর্য কক্ষে। কক্ষে বসে লা’শটা পরীক্ষা করছিলেন রাজবৈদ্য। সে রাজবৈদ্যের কাছে দাঁড়িয়ে শান্তভাবেই জিজ্ঞেস করল,
“কি দেখলেন আপনি? কিভাবে মৃ’ত্যু হয়েছে এর?”
“বাইরে থেকে দেখলে এর মৃ’ত্যু স্বাভাবিক লাগলেও এর মৃ’ত্যু কিন্তু খুবই রহস্যময় কুইন। এই তলো’য়ারের আঘা’তে তার মৃ’ত্যু হয়নি। তার দেহে বি’ষ ছিল। এক ভয়ানক বি’ষ। শুধু তাই নয় এই দেহ বাহিরে থেকে স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরটা ঝলসে গেছে। আগু’নে পুড়লে যেমন হয় ঠিক তেমন অবস্থা ভেতরটা। সেদ্ধ হয়েছে একদম।”
ঐশ্বর্যের কপালে গভীর ভাঁজ পড়ে। কোনো কথা আসে না। সবটা যেন গোলকধাঁধা! হঠাৎ তার একটা কথা স্মরণে আসতেই অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“অগ্নি তলো’য়ার!”
চলবে…
#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
শেষ পর্ব (শেষাংশ ২)
অমাবস্যার রাত। আজ চারিদিকটা অন্ধকার। চাঁদের আলো নেই। আকাশে তাঁরাও নেই। মেঘলা আকাশ মাঝেমধ্যে চমকাচ্ছে। আকাশের এক প্রান্তে যখন ছলকে উঠছে তখনও নিরব ঐশ্বর্য। প্রাসাদের ছাঁদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থমকে রয়েছে সে। জীবনটা কেমন যেন থমকে গেছে। এই পনেরো দিনে পনেরোটা লা’শ পাওয়া গিয়েছে। প্রজারা রয়েছে আতঙ্কে। সেই সাথে নিরব ঐশ্বর্যের মনটাও হাহাকার দিয়ে উঠছে সেটা কারোর বোঝার ক্ষমতা নেই। সে এখনো শক্ত, অটুট। যেন পাথর দিয়ে তৈরি এক জীবন। জীবন বললে ভুল হবে। তারা তো অর্ধমৃত! মেঘলা আকাশটা যখন চমকে উঠে ডেকে উঠল আকাশের দিকে তাকালো ঐশ্বর্য। নীলাভ চোখ দুটো রাখলো সেই চমকে ওঠা গগনে। বাতাসের বেগ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলো। ঐশ্বর্যের খোঁপা করা চুলটা তার অজান্তেই বাতাসের তীব্রতায় খুলে গেল। তার মনে ঘুরছে একটাই ভাবনা! তা হচ্ছে অগ্নি তলো’য়ার। সেটা কি সেই আগুনে ধ্বংস হয়নি?
“যদি সেই অ’স্ত্র এতোটা কঠিন না-ই হয় তবে সেটার ধ্বংসের উপায় কি? আর সেটা এখন কার অধীনে? কে করছে আমার রাজ্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা?”
বিশ্বাসঘাতকতা বড্ড খারাপ জিনিস। ঐশ্বর্যের জানা মতে সকলে নিজের নিজের রাজ্যকে ভীষণ ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে! কিন্তু এই দ্রো’হী কে? মাথা ভনভন করছে ঐশ্বর্যের। পিছু ফিরে ঝুলিয়ে রাখা ফুলের দোলনা খানির দিকে তাকায় সে। এলোমেলো পায়ে এগিয়ে গিয়ে দোলনায় বসে। সেখানে রাখা ভায়োলেন হাতে তুলে নেয় সে। খারাপ সময়ে এই সুর মনটাকে কেমন যেন মাতিয়ে দেয়। হাতে সেটা তুলে সুর তুলতে আরম্ভ করে ধীরে ধীরে। মুখে আসে গান। গাইতে ক্ষতি কি?
“Kisi roj barish jo ayee
Samajh lena boondon mein main hoon
Subah dhoop tumko sataaye
Samajh lena kirno mein main hoon…”
ঐশ্বর্য থামতেই জবাব আসে পেছন থেকে। গলার সুর মোটা এবং গম্ভীর। ভায়োলেনে সুর তোলা থামায় না ঐশ্বর্য। হক না একটু গম্ভীর সুর। এই সুরটাই যে তার সর্বাঙ্গ মাতিয়ে তোলে।
“Kuch kahun ya na kahu
Tum mujhko sadaa sunte rehna…”
গানটার সুর যখন কাছে বাজতে থাকে তখন ঐশ্বর্য বুঝে যায় লোকটা তার নিকটে আসছে। প্রেম তার সামনে এসে হাঁটু ভাঁজ করে বসে ঐশ্বর্যের একটা হাত সযত্নে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“আজকে হঠাৎ এমন গান আর সুর তুলছো যে?”
ঐশ্বর্য জবাব দিল না। ঘাড় ঘুড়িয়ে অন্যদিক ফিরিয়ে চেয়ে রইল। মুখটা মলিন। ফ্যাকাশে। চোখে নেই সেই তীব্রতা! প্রেম ঐশ্বর্যের গালে হাত রাখে। থেমে থেমে বলে,
“তোমায় কেমন যেন প্রাণহীন লাগছে ঐশ্বর্য। তোমার চোখের সেই তেজ, তোমার সেই মুখশ্রীটা অন্যরকম হয়ে গেছে।”
“আমি তো সত্যিই প্রাণহীন মি. আনস্মাইলিং! আমার মধ্যে তো আদেও আপনাদের মতো কোনো প্রাণ নেই। যতটুকু রয়েছে তাও শুষে আমায় প্রাণহীন করে দিয়ে চলেছে আমার রাজ্যের কেউ। আমিও যে আমার এতো প্রজাদের মৃ’ত্যু দেখে ভেতরে ম’রে যাচ্ছি।”
কথাটুকু বলতে বলতে দুর্বল হয়ে আসে ঐশ্বর্যের কণ্ঠস্বর। খানিকক্ষণের মধ্যে মেয়েটার চোখে অশ্রু বর্ষণ করবে। ইতিমধ্যে করেও ফেলেছে। চোখে টলটল করছে পানি। কথাগুলো বলতে বলতে নিচু হয়ে ঝুঁকে প্রেমের কাছে নিজের মাথা রাখল ঐশ্বর্য। অস্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠল,
“আমি কাউকে সঠিক বিচার পাইয়ে দিতে পারছি না। সকলে রাজসভায় ছুটে আসছে সঠিক বিচার পাবার আশায়। প্রকৃত হ’ত্যাকারীকে ধরতে পারছি না। শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমি পারছি না। এজন্যই মাকে বলেছিলাম আমি কুইন হতে চাই না।”
ঐশ্বর্যের মাথা তুলে প্রেম এবার দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কান্না থামাও ঐশ্বর্য।”
“আমি পারব না এই দায়িত্ব পালন করতে। আমি চাই না ওই সিংহাসন।”
পাগলের মতো প্রলাপ বকে যাচ্ছে ঐশ্বর্য। থামার নাম নেই। প্রেম আবারও শান্ত সুরে বলে,
“স্টপ ঐশ্বর্য।”
“আমি আবার সেখানে ফিরে যাব। মানুষদের জগতে। এই জগতে এতো মৃ’ত্যু দেখতে পারব না।”
“চুপ করো ঐশ্বর্য। স্টপ ইট।”
এবার কিছুটা জোরেসোরেই ধমক দিয়ে ঐশ্বর্যকে থামালো প্রেম। ঐশ্বর্য থেমে গেল। হেঁচকি তুলে কান্না মূহুর্তেই বন্ধ হলো। প্রেম আবারও বড় নিশ্বাস ছাড়ল। নিজের ধূসর বর্ণের অধর এগিয়ে এনে ঐশ্বর্যের গড়িয়ে পড়তে থাকা অশ্রু শুষে নিল। তারপর তার কপাল ও মুখের কাছ থেকে এলোমেলো চুল সরিয়ে কানে গুঁজে দিয়ে বলল,
“ইউ আর অ্যা ভ্যাম্পায়ার কুইন। তোমার চোখে কান্না নয় আ’গুন মানায়। সেই চোখ দিয়ে আ’গুন ঝরবে। সেই দৃষ্টি দ্বারা সেই বিশ্বাসঘাতককে ধ্বংস করবে। মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে। তোমার এই কান্না তোমায় দুর্বল করছে। তোমার দৃষ্টি জাগিয়ে তোলো রাণী সাহেবা। আর মাঝে মাঝে যখন ভেঙ্গে পড়বে। যখন চোখ দুটোতে শক্তি থাকবে না। অশ্রু ঝরবে। ঠিক এভাবেই আমি সেই অশ্রু শুষে নেব।”
ঐশ্বর্য যেন অদৃশ্য শক্তি পায়। প্রেমের বলা প্রতিটা কথা তাকে জাগিয়ে তোলে। সে মাথা নাড়ায়। তারপর প্রেমের দিকে শীতল চাহনিতে তাকিয়ে বলে,
“আপনি তো সেই মানুষ প্রেম! যার সামনে আমি নিজেকে ভেঙ্গে উপস্থাপন করতে পারি। আপনি সেই ব্যক্তি যার সামনে নিজের এই দুর্বল রূপটা তুলে ধরে শক্তি পাই নতুন করে। আপনি আমার সেই শক্তি। সকলে জানে রাণী সাহেবা এখনো কঠিনভাবে সবটা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছে। একমাত্র শেখ আনন প্রেম জানে ভ্যাম্পায়ার কুইন ঐশ্বর্য কতটা ভেঙ্গে পড়েছে।”
বৃষ্টির বিন্দু যখন ঐশ্বর্যের গালে এসে পড়ে বৃদ্ধ আঙ্গুল দিয়ে তা মুছে দেয় প্রেম। তখনি আস্তে আস্তে হুট করেই বাড়ে বৃষ্টির বেগ। আধভেজা হতেই ঐশ্বর্য প্রেমের হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“বৃষ্টি হচ্ছে। ভেতরে চলুন। আপনার ঠান্ডা লাগবে।”
ঐশ্বর্য প্রেমের হাত টেনে ভেতরে যেতে চায়। তবে প্রেম ঠাঁই দাঁড়িয়ে। ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরে লোকটার দিকে তাকায় ঐশ্বর্য। প্রেম উল্টে তার হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলে,
“উঁহু লাগুক ঠান্ডা। আজ বড্ড ইচ্ছে করছে তোমার সেই লাস্যময়ী রূপ দেখতে। যেখানে তোমার গাল বেয়ে পানি পড়বে। চুলগুলো লেপ্টে যাবে গালের সাথে। নাকে জমা হবে বিন্দু বিন্দু পানির কণা। আর এই চিকন গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ওষ্ঠদ্বয় যখন ভিজে যাবে তখন আমি…”
বলে থামে প্রেম। ঐশ্বর্যের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। প্রেম হেঁসে ওঠে। এইতো মেয়েটা আগের রূপে ফিরেছে। প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে মুখশ্রী। ফিসফিস করে বলে,
“থাক বাকিটা কথায় না বলে কাজে করে দেখাই? বাকিটা বললে এবার তোমায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। তখন আবার আরেক বিপদ।”
ঐশ্বর্য হাসি আটকাতে পারে না। তার ভিজে চুল পেছনদিকে সরিয়ে প্রেম আদুরে সুরে বলে ওঠে,
“আমার মিষ্টি ভ্যাম্পায়ার বউ!”
আরো দুই দিন কাটে। এই দুইদিনে আরো দুটো লা’শ পাওয়া গেছে। পুরো রাজ্য বিধ্বস্ত। সকলে আতঙ্কে বসবাস করছে। কেউ কেউ রাজ্য ছেড়ে মানুষদের জগতে থাকা শুরু করে দিয়েছে। নিজেদের প্রা’ণ হারাতে আর কেউই রাজি নয়।
অন্ধকার রাতে। টিমটিমে আলোয় ঘুমন্ত প্রেমের মুখশ্রী অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। হালকা বাতাস তার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো এপার ওপার করছে। সেই চুলে হাত রাখলো কেউ। চুলগুলো সুন্দর মতো ঠিক করে দিয়ে কপালে নিজের অধরের ছোঁয়া দিল। ঘাড় ফিরিয়ে পাশে তাকালো। তৎক্ষনাৎ চোখের পাতা বুঁজে রাখা ছোট্ট পুনম পাশ ফিরল তার। প্রেমের মতোই উপরে একহাত আর আরেকহাত বুকের উপর রেখে আবারও ঘুমে মগ্ন হলো। তাতে হাসি পেল সেই আগন্তুকের। খুব নিচু সুরে বলল,
“বাবা আর মেয়ে একই। শুয়েও আছে একইভাবে। একেই হয়ত বলে বাবার মেয়ে।”
এবার দাঁড়িয়ে যায় সে। খানিকটা নিচু হয়ে মেয়ের দুটো গালে চুমু খেয়ে নেয় ইচ্ছে মতো। চোখ থেকে গড়িয়ে টুপ করে পুনমের গালে যখন পড়ে পুনম কেঁপে উঠতেই সরে যায় সেই আগন্তুক। প্রেমের দিকে তাকায়। আগের মতোই নিচু গলায় বলে,
“আপনি আমার সেই তৃষ্ণা যেই তৃষ্ণা কখনোই মিটবে না। আজও মিটছে না। তাই যেতেও মন চাইছে না।”
একটু থামলো সে। ভেঙ্গে আসছে গলার সুর। ভাঙ্গা সুরে বলে উঠল,
“ভালোবাসি আপনাকে।”
কারো পায়ের আওয়াজ স্পষ্ট যখন সেই আগন্তুকের কান অবধি পৌঁছায় তখনি তড়িঘড়ি করে নিজের চোখের কোণে থাকা অশ্রু একহাতে মুছে নিজের মুখটা ঢেকে নেয় ভালো করে। চোখ ছাড়া তাকে চেনা সম্ভব নয়। দৃশ্যমান সেই চেনা নেত্র দুটো। গায়ে যুদ্ধের পোশাক। দ্রুত বেগে তলো’য়ার ঝুলিয়ে রাখার স্থানে গিয়ে হাত একটা তলো’য়ার নিয়ে নিমিষেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল সে।
আজ রাত জাগছে ইলহান। চোখে ঘুম নেই। পুরো রাজ্য পাহারা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত হয়েছে আজ সে। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাশ দিয়েই সে যাচ্ছিল। হঠাৎ কানে এলো অন্য কারো পায়ের শব্দ। চকিতে তাকায় সে পিছু ঘুরে। আশপাশটা পরিষ্কার। কেউ তো নেই। তবুও ধীর গলায় বলল,
“কে এখানে?”
জবাব এলো না। পায়ের শব্দ যখন আরো দৃঢ় হতে থাকল তখন সতর্ক হলো ইলহান। হাতের তলো’য়ার সাথে নিজের আসল রূপে এলো সে। আশেপাশে ভালো করে দেখতে থাকলো। যখনই সে আবারও কিছু বলতে যাবে তখনি তাকে পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়া হলো। টাল সামলাতে না পেরে তলো’য়ার হাত থেকে ছুটলো এবং উপুড় হয়ে পড়ল। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাতেই চেনা কাউকে দেখে চোখ দুটো চড়কগাছ হলো তার। তড়তড় করে বলে উঠল,
“তু…তুমি এখানে? কি করছো এটা?”
“যেটা করার দরকার সেটাই করছি।”
ইলহানের চেনা সে এগিয়ে এলো তার দিকে। তার হাতের ধারালো তীক্ষ্ণ তলো’য়ার দেখে পিছিয়ে গেল সে। সেই অন্য আগন্তুক তলো’য়ার ঘুরিয়ে নিল। আ’ঘাত করতে প্রস্তুত হলো। সেই মূহুর্তেই চোখের সামনে ঘটল অন্য ঘটনা। পেছন থেকে তার মাথা আঘাত করা হলো। ছিটকে নদীর ধারের কাছে পড়লেও সেই তলো’য়ার হাতছাড়া করল না সে। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চোখ দুটো কপালে উঠল তার। হাতে তলো’য়ার নিয়ে সমানে ফুঁসছে ঐশ্বর্য। মুখ থেকে কাপড় খুলে পড়েছে দ্রুত আসতে। তাকে দেখে আগন্তুক কিছুটা চমকালো।
“কু…কুইন আপনি?”
“হ্যাঁ শার্লি। আমি। ভ্যাম্পায়ার কুইন ঐশ্বর্য। আর তুমি? সেই বিশ্বাসঘাতক যে কিনা নিজের জন্মভূমির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে দিনের পর দিন।”
শার্লি কোনোমতে উঠে দাঁড়ায়। হাতের তলো’য়ার শক্ত করে ধরে। সেই অ’স্ত্রের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় ঐশ্বর্য শার্লির দিকে। শার্লি কঠিনভাবে হাসে। হাসিতে স্পষ্ট হিংস্রতা। হাসি থামিয়ে বলে,
“শেষমেশ আমাকে ধরেই ফেললে রাণী? তোমার বুদ্ধি আছে বলতে হবে। তবে ধরে আহামরি নিজের খুব একটা সুবিধা করতে পারো নি তুমি। কি লাভ হলো? চিনতে পারছো এই অ’স্ত্র?”
ঐশ্বর্য যান্ত্রিক সুরে বলে,
“অ’গ্নি তলো’য়ার। যেটার একেকটা আ’ঘাত শুধু কারোর বাহিরেই নয় ভেতরটাও শেষ করে দেবে। যেই তলো’য়ারের আঘা’তে মৃ’ত্যু হতে পারে যে কারোর।”
“ঠিক ধরেছো। এখন তোমারও হবে মৃ’ত্যু।”
শার্লি দ্রুত এগিয়ে আসে। ঐশ্বর্য থেমে থাকে না। এই মূহুর্তে সে যেন জলন্ত আগু’নের লাভা। সেও তেড়ে আসে নিজের আসল রূপ বের করে। তার হাতে শুধু সাধারণ তলো’য়ার। এই যুদ্ধে কে জয়ী হবে তা বলা যায় না। মাঝখানে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ইলহান। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ভেবে পাচ্ছে না যে এতোদিন সবাইকে খু’ন করে এসেছে সে অন্য কেউ নয় তারই এক বিশ্বস্ত বন্ধু শার্লি। আজ তাকেও মা’রতে হাত কাঁপছিল না ওর। তার ধ্যান ভাঙ্গে ঐশ্বর্য ও শার্লিকে লাগতে দেখে। কেউ কারোর থেকে কম যাচ্ছে না। এবার অন্যকিছু ভাবা বাদ দিয়ে সেও এগিয়ে যায়। তলো’য়ার বের করে আ’ঘাত হানে শার্লির উপর। কিন্তু লাভ হয় না। শার্লি তার সেই প্রধান অ’স্ত্র দ্বারা সরাসরি দুজনকেই ফেলে দেয়। অগ্নি তলো’য়ারের আঘা’তে মূহুর্তেই ভেঙ্গে যায় ঐশ্বর্যের তলো’য়ার। তার বড় নখ তখন বেরিয়ে আসে। সে এগোতেই ইলহান তার হাতে নিজের তলো’য়ার ধরিয়ে বলে,
“কুইন এই নিন। এটা আপনার প্রয়োজন।”
হাতে তলো’য়ার নেয় ঐশ্বর্য। দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে যায়। কিন্তু অ’গ্নি তলো’য়ারের সাথে সেই তলো’য়ারের সংঘর্ষ হতেই সেই তলো’য়ার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়। সেই সুযোগে শার্লি এগিয়ে আসে ঐশ্বর্যের চোখেমুখে আঘা’ত হানতে।
“তোমার এই চাঁদের মতো রূপ! ঐশ্বর্যের পরিপূর্ণ এই মুখশ্রী আমার সহ্য হয় না। এখান থেকেই তোমার মৃ’ত্যু…”
কথাটুকু মাঝপথে থেমে যায়। চিৎকার দিয়ে উঠে নিচে পড়ে যায় ধপ করে শার্লি। হাত থেকে তলো’য়ার ছিটকে যায়। মাথার পেছনে হাত দিতেই অনুভব করে গরম এবং তরল পদার্থ মতো কিছু একটা। র’ক্ত! কোনোমতে ফিরে তাকায় সে। চোখে পড়ে হাতে ভারি পাথর নিয়ে থাকা ইলহানকে। তার থেকে কিছুটা দূরত্বে তার অ’স্ত্র। হাত দিয়ে ধরার আগেই ছোঁ মেরে তা বাতাসের গতিতে হাতে নেয় ঐশ্বর্য। শার্লি তখন পিছিয়ে যায়। তার শরীরের র’ক্ত হিম হয়ে আসে। এই বুঝি প্রা’ণ গেল। ঐশ্বর্য কি তাকে ক্ষমা করবে না? উঁহু, সেই সম্ভাবনাই নেই একদম। সে তার প্রজাদের কিভাবে মে’রেছে। এখন তার কি হবে?
“এখন কেন এই তলো’য়ার দেখে চোখমুখের রঙ ফ্যাকাশে হচ্ছে তোমার? তুমি ঠিক করো নি শার্লি। বিশ্বাসঘাতকতা আমার সবচেয়ে ঘৃণার বস্তু। তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো। তোমার নিজের জন্মভূমির সাথেও করেছো। তুমি বেঁচে থাকার অধিকারই হারিয়েছো।”
“আ…আমায় ক্ষমা করুন কুইন। আমার ভুল…”
ঐশ্বর্য হুংকার দিয়ে ওঠে শার্লির কথায়। তার হুংকারে কেঁপে ওঠে নদীর পানি এবং পাশের জঙ্গল। একপাশ থেকে বাদুড় উড়ে যায়। সে শ্বাসিয়ে বলে,
“আমি ডেভিল কুইন নই ঠিকই। তবে নিষ্ঠুরতা বিন্দুমাত্র কমেনি আমার অন্তর থেকে। আর যে আমার রাজ্য এবং আমার প্রজাকে ধোঁকা দেবে তার একটাই পরিণাম হবে। মৃ’ত্যু।”
কথা বাড়ায় না ঐশ্বর্য। শার্লির মুখ বরাবর তলো’য়ার চালাতেই চোখেমুখে র’ক্ত ছিটকে আসে। শার্লি পড়ে থেকে ছটফট করতে থাকে। গলগল করে পড়তে থাকে র’ক্ত। এবার আরো দুটো আ’ঘাত করে ঐশ্বর্য। আর বলে ওঠে,
“আমি জানি এর থেকে কঠিন শাস্তি আর নেই। তুমি তড়পে তড়পে মর’বে। ভেতরের মাংস সেদ্ধ হয়ে যাবে। বিষটা তোমার শরীর গ্রাস করবে।”
শার্লি কিছু বলতে চায়। তবে পারে না। কোনোমতে এগিয়ে এসে ঐশ্বর্যের পা ধরে। ভাঙ্গা সুরে বলে,
“আমাকে বাঁচান কুইন। নিজের প্রাণ ভিক্ষা চাইছি আপনার কাছে।”
ঐশ্বর্য নিজের পা ছাড়িয়ে তার পা শার্লির উপর তুলে দেয়। তারপর বলে,
“তোমার মৃ’ত্যু আমার শান্তি।”
ইলহানের দিকে তাকায় ঐশ্বর্য। আর শান্ত সুরে বলে ওঠে,
“যাও। প্রাসাদের সকলকে খবর দাও।”
চলবে…
#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
শেষ পর্ব (শেষাংশের সমাপ্তি)
ইলহান মাথা নাড়িয়েই ছুটে যায়। ঐশ্বর্য একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকে অর্ধমৃত শার্লির দিকে। তার চোখে ভাসছে এখনো তার প্রজাদের নির্মম মৃ’ত্যু। চোখ বুঁজে নেয় ঐশ্বর্য। রাগ হয়। ক্রোধের বশে আরো ইচ্ছেমতো তলো’য়ার দিকে আ’ঘাত করতে করতে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে শার্লিকে। শার্লি তখন নিস্তেজ। তবে শ্বাস এখনো চলছে।
ক্লান্ত হয়ে কিছুটা দূরে সরে আসে ঐশ্বর্য। নদীর ধারে এসে নদীর স্বচ্ছ পানিতে ধুয়ে নেয় র’ক্তমাখা তলো’য়ার। আগের মতোই চকচক করতে থাকে সেটি।
সেই বৃষ্টির রাতে শার্লিকে প্রথম রাতের আঁধারে প্রাসাদ থেকে বের হতে নজরে পড়েছিল ঐশ্বর্যের। সেদিন সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও না জেনে তাকে কিছু বলতে পারেনি। তাই সে পরেরদিনই শার্লির অগোচরে তার কক্ষে ঢুকে সারাঘর কিছু না কিছু খুঁজে গেছে ঐশ্বর্য। শার্লির বিছানার নিচে সেদিন ‘দ্যা ডেভিল বুক’ এর ছেঁড়া এক পৃষ্ঠার অংশ পেয়ে সে সেদিনই বুঝেছিল ডেভিলদের সঙ্গে সে নিজেও যুক্ত ছিল। তাই জন্যই সে সেই বইয়ের এক পাতা ছিঁড়েও রেখেছে। পুরো কক্ষ ভালো করে দেখে আর শার্লির একটা ডায়েরির মাধ্যমে সে জানতে পারে শার্লির বাসনা ছিল এই রাজ্যের রাণী হওয়া। যেটা সে পারেনি। তাই প্রথম থেকেই ইলহান আর মৌবনিকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে ঐশ্বর্যকেই মা’রতে চেয়েছিল। কিন্তু ইলহান আর মৌবনি পরে তার সঙ্গে সায় দেয়নি। ফলস্বরূপ শার্লি এই তলো’য়ার পেয়ে হ’ত্যাকান্ড শুরু করেছিল। তবে সেদিন পুরো কক্ষ তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেই অ’স্ত্র হাতের কাছে পায়নি ঐশ্বর্য। তাই তাকে অন্যরকম পরিকল্পনা করতে হয়েছিল। সে সবসময় শার্লির জান্তে অজান্তে নজর রেখেছিল। এর মাধ্যমেই ঐশ্বর্য আরো একটা কথা জানতে পারে। সেটা হচ্ছে শার্লি এতদিন প্রাসাদের সকলকে রাতের খাবারের সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে এসেছে। এই রাজ্যের এক বিশেষ গাছের শিকড়ের ঔষধ। যা ঘুমে মগ্ন করে তোলে সঠিক সময়ে এবং ভোরের আগে ঘুম ভাঙ্গা অসম্ভব। তাই ঐশ্বর্য আজ রাতের খাবার খায়নি ইচ্ছে করেই। আর আজ সেই রাত যেই রাতে ঐশ্বর্য নিজের কাজ সম্পূর্ণ করেছে।
অ’গ্নি তলো’য়ার দুটো হাতে ধরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে ঐশ্বর্য নদীর তীরে। তার কোঁকড়ানো চুল ঢাকা পড়েছে পাগড়ীতে। শুধু টলটলে পানিতে ফুটে উঠেছে তার মুখশ্রী। চোখেমুখে ঘাম ও র’ক্তের সংমিশ্রণে একাকার হয়ে অন্যরূপ ধারণ করেছে। পানিতে থাকা প্রতিচ্ছবির উদ্দেশ্যে ঐশ্বর্য নিজ মনে বলে উঠল,
“অবশেষে রাণী তার সন্তান তুল্য প্রজাদের বিচার করতে পেরেছে। সঠিক বিচার পেয়েছে কিনা জানি না এখনো। কারণ ওরা যেভাবে ছটফট করতে করতে ম’রেছে সেটা আমাকে ভেতর থেকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এতোগুলো প্রাণের পরিবর্তে শুধু একটা প্রা’ণ নিয়ে শান্তি হচ্ছে না আমার। যদি পারতাম ওই বিশ্বাসঘাতকের প্রাণ ফিরিয়ে আবারও মা’রতাম। হাজারবার এমন করতাম। কিন্তু এতো সাধ্যের বাহিরে!”
একটু থামে ঐশ্বর্য। মুখে থাকা এই বিষের চেয়েও বি’ষাক্ত বিশ্বাসঘাতকের র’ক্ত তার ভালো লাগছে না। চোখমুখ জড়িয়ে একটু ঝুঁকে বেশ কয়েকবার পানির ঝাপ্টা দিল সে। মুখে রয়ে গেল বিন্দু বিন্দু পানির কণা। আবারও নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাহলে ভ্যাম্পায়ার কুইন ঐশ্বর্য? তোমার কাজ এখানেই শেষ…?”
তারপর নিজের মুখে লাগাম দিল সে। হালকা হাসলো। হাসিটা কেমন যেন। খুশির নয়! অন্যরকম রহস্যময় হাসি। মাথা নিচু করে বলল,
“না। তোমার শেষ কাজ এখনো বাকি।”
ঐশ্বর্য কোথা থেকে যেন একটা কাগজের টুকরো বের করল। মোড়ানো কাগজের টুকরো ভালো করে খুলে নিল। তবে কাগজটার অর্ধেক অংশ ছেঁড়া। সেই ছেঁড়া কাগজ নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার মৃ’ত্যুই তোমার অন্তিম কাজ। তোমার মৃ’ত্যু এই রাজ্যের জন্য করা তোমার শেষ কাজ।”
বলে উঠে দাঁড়াল ঐশ্বর্য। ডানহাতে তলো’য়ারটি ধরে পুরোটা পর্যবেক্ষণ করল। তারপর শান্ত সুরে বলল,
“ভ্যাম্পায়ার কুইনের সবথেকে বড় ভুল ছিল এই অগ্নি তলো’য়ারকে জীবিত করা। আর সেই ভুলের মাশুল তাকে তার প্রা’ণ দেওয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণ হবে। আর আমি তৈরি।”
নিজের দুটো হাত দিয়েই এবার তলো’য়ার কৌশলে ধরে নিজের দিকেই তাক করল ঐশ্বর্য। পুরো শরীর একবার কেঁপে উঠলেও নিজেকে সরিয়ে নিল না সে। দৃষ্টি এবং লক্ষ্য স্থির করে বলল,
“যেই ভয়ানক অ’স্ত্র আমার স্পর্শে প্রাণ ফিরে পেয়েছে সেই ভয়ানক অ’স্ত্র আবারও প্রাণহীন হবে একমাত্র আমারই ধ্বংসে।”
চোখটা আপনাআপনি বুঁজে এলো ঐশ্বর্যের। নিজেই নিজেকে কি করে আ’ঘাত করতে সেটা তার জানা নেই। মৃ’ত্যু ভয় সকলের থাকে। তারও রয়েছে তবে তা অতিক্রম করেছে তার রাজ্য এবং প্রজাদের প্রতি ভালোবাসা। সে জানে এই অ’স্ত্র যতদিন সচল থাকবে ততদিন রাজ্যে শান্তি মিলবে না। সে আবারও সুখপাখির দেখা চায়। সে চায় ওই নীল আকাশে আবারও যেমন মুক্ত পাখির মতো রাজ্য মেতে উঠুক। চোখের পাতা বন্ধ করতেই যখন তার চোখের সামনে পুনম ও প্রেম ভেসে ওঠে চোখ খোলে সে। হাতটা নামিয়ে নিতে থাকে আস্তে আস্তে। এই কঠিন সময় তার মস্তিষ্কে উঁকি দেয় তার এবং প্রেমের প্রণয়ের মূহুর্তগুলো! সেইসব সুখানুভূতি! প্রেমের সেই স্পর্শ। তার বলা কথা! ঐশ্বর্য থরথর করে কাঁপতে থাকে। চোখে চিকচিক করে পানি। পরক্ষণেই কিছু একটা মনে করে তীক্ষ্ণ হয়ে আসে তার দৃষ্টি। আবারও নিজের দিকে তাক করে।
“আমার মি. আনস্মাইলিং, পুনম, বাবা-মা আর এই রাজ্যের সকলকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে যে আমাকে ম’রতে হবে।”
এবার সজোরে চালিয়ে দিল ঐশ্বর্য নিজের দিকে তলো’য়ার। নিজের শরীরে আ’ঘাত লাগার আগেই ভেসে এলো পুরুষালি কন্ঠস্বর। সে থেমে চোখ খুলে এক পলক সামনে তাকালো। সামনে ছুটে আসা সেই লোকটিকে দেখে চোখ দুটো শান্ত হলো তার। তবে মস্তিষ্ক নয়। মস্তিষ্কের অনুসরণে শান্ত চোখেই অনায়াসে অ’গ্নি তলো’য়ারটা নিজের পেটে এফোঁড়ওফোঁড় করল ঐশ্বর্য। নিশ্বাসটা কেমন যেন আঁটকে এলো। বেহায়া চোখজোড়া তবুও সেই মানুষটির দিকেই স্থির। টাল সামলাতে পারল না ঐশ্বর্য। মুখ দিয়ে তরল জাতীয় কিছু বের হচ্ছে। সে বুঝতে পারল র’ক্ত! শরীর ছেড়ে দিল এবার। দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল হয়ে গেল। ধপ করে পড়ল। মাটিতে রাখল মাথা। নেত্রপল্লব তখনও স্থির। মানুষটি কাছে চলে এসেছে। মানুষটির মুখে কি যে ব্যাকুলতা!
প্রেম নিজের সর্বোচ্চ বেগে ছুটে এসেও লাভ হলো না কোনো। তার প্রিয়তমা ততক্ষণে তার চোখের সামনে নিজের ধ্বংস হওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এ যেন তারই বুকে কেউ লাগামহীন ভাবে ছু’রি চালিয়ে দিল! অচিরেই বুকের ভেতরটা উথাল-পাতাল করতে শুরু করল।
ঘোলা হয়ে আসছে ঐশ্বর্যের দৃষ্টি। তার মাথাটা কোলে নিল প্রেম। তার মুখ থেকে কোনো কথা আসছে না। প্রেমও কোনো কথা না পেয়ে ঐশ্বর্যকে তুলে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল। জাপ্টে ধরল এমনভাবে যেন নিজের থেকে একটু দূরে সরিয়ে দিলেও ঐশ্বর্য কর্পূরের মতো উবে যাবে। ঐশ্বর্যের ক্ষ’ত স্থান থেকে বের হওয়া র’ক্ত মাখামাখি হলো প্রেমের শরীরে। প্রেমের হাতে র’ক্ত আসা মাত্রই চোখ দুটো উল্টে যেতে লাগল। অথচ শান্ত ঐশ্বর্য। প্রেম উপলব্ধি করে ঐশ্বর্য একহাতে তার পিঠ খামচে ধরেছে। ঐশ্বর্যের গালে হাত রেখে সে পাগলের মতো বলে ওঠে,
“এটা কি করলে? কেন করলে? এমনটা কেন করলে? বলো?”
“নিজেকে জয়ী করতে!”
ঐশ্বর্যের নির্বিকার কন্ঠস্বর। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে চলেছে তখন। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। প্রেম ঐশ্বর্যকে ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে বলে,
“কীসের জয়?”
ঐশ্বর্য হাসে। র’ক্তে ভেসে যাচ্ছে আশপাশ। তার ভ্রুক্ষেপ নেই। হাসতে কষ্ট হলেও হাসি পাচ্ছে। হাসিটা আনন্দের বটেই।
“আমার মৃ’ত্যুতেই আসল জয় লুকিয়ে ছিল। এইযে আমার আ’ঘাত করা এই তলো’য়ার দেখছেন। এটার ধ্বংস একমাত্র তখনি হবে যখন এটা দ্বারা তার মৃ’ত্যু হবে যে এই অ’স্ত্র সচল করেছিল। আর আমি বার বার এই অ’স্ত্র দ্বারা আমার রাজ্যকে ক্ষত-বিক্ষত হতে দেখতে পারব না। তাই আমি…”
“নিজেকেই ধ্বংস করলে? কেন ঐশ্বর্য? আমার চাওয়ার দাম নেই তোমার কাছে?”
প্রেম চিৎকার করে করে একেকটা কথা বলছে। ততক্ষণে তার চিৎকারে ইলহান সহ সকলে উপস্থিত হয়ে থমকে গিয়েছে। অন্যদিকে মাধুর্য সেখানে প্রবেশ করেও চমকে ওঠে। সমস্ত শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে! এক চিৎকারে বলে ওঠে,
“আমার মেয়ে কি হলো! কেন হলো!”
সে ছুটে আসে। ঐশ্বর্য প্রেমের গালে হাত রাখে।
“আপনি তো আমার কাছে সবচেয়ে দামি। এই রাজত্ব, মুকুট, সিংহাসনও শেখ আনন প্রেমের কাছে ফিকে পড়ে যায়।”
প্রেমের অশ্রু আর বাঁধা মানে না। চিৎকার করে ওঠে। পাগলামি করে ঐশ্বর্যকে নিজের সাথে চেপে ধরে। সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
“ডক্টর, বৈদ্য কোথায়! যাকে পারো তাকে নিয়ে আসো। আমার ঐশ্বর্যকে বাঁচাতে হবে।”
মাধুর্য দৌড়ে এসে ঐশ্বর্যের কাছে পড়ে। আহ’ত ঐশ্বর্য ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় মায়ের দিকে। তার মা ইতিমধ্যে কান্না করে একাকার করে ফেলেছে। সে উপুড় হয়ে ঐশ্বর্যের মাথা পাগলের মতো বুলাতে বুলাতে বলল,
“কি হয়েছে রে মা! কেন এমন করলে? তোমার কিছু হলে তোমার এই মা বাঁচবে কি করে?”
“আর তোমাদের কিছু হলে আমি কি করে বাঁচব মা? তাই তো এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছি!”
এবার মাধুর্য ঐশ্বর্যকে জড়িয়ে ধরে। শব্দ করে কেঁদে উঠে বলে,
“আমার মেয়েকে বাঁচাও কেউ!”
অনুভব পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। মনের সকল অনুভূতি যেন ম’রে গিয়েছে। তাকে কিছু কেউ বললেও শুনছে না। সকলে ছোটাছুটি করছে বৈদ্য ডেকে আনতে। ঐশ্বর্য সেসবে পাত্তা দিল না। উল্টে বলল,
“আমার পুনমের খেয়াল রাখবে মা। দেখবে ও যেন আমার মতো কোনো ভুল না করে বসে।”
আটকা আটকা গলা ঐশ্বর্যের। বেশ জোর দিয়ে কথাগুলো পড়ছে। এবার বাবার দিকে তাকায় সে। চোখ দুটো ঘোলা হয়ে আসছে। ঠোঁট নীল হয়ে এসেছে বি’ষে। তার রক্তাক্ত হাত বাড়িয়ে ইশারা করে অনুভবকে আসতে বলে কাছে। অনুভব দূরে দাঁড়িয়ে। জোর পায় না হাঁটার। একটু সময় নিয়ে রোবটের মতো ধীর পায়ে হেঁটে আসে। মেয়ের কাছে বসে। ঐশ্বর্য বলে,
“আমাকে যেমন সব কথায় সায় দিয়েছো। পুনমের সব কথায় সায় দেবে না। বুঝলে? আর নিজের খেয়াল রাখবে। সবসময় জেদ করবে না।”
অনুভব কাঁপা হাতে ঐশ্বর্যের কপালে হাত রাখে। কাঁপা সুরেই বলে,
“তোমার কিছু হবে না।”
ঐশ্বর্য কিছু বলে না। এবার তার কান্না আসে। চোখ বুঁজে কান্না লুকায়। প্রেমের পিঠ আরো জোরে খামচে ধরে বড় বড় নিশ্বাস ফেলে বলে,
“মি. আনস্মাইলিং! একবার বলবেন? জয় হক আমার রাণী সাহেবার?”
প্রেম ভাষাহীন। ঐশ্বর্যকে একহাতে ধরে রয়েছে। রাজ্যের সকলে স্তম্ভিত! তারা এখনো বুঝতে পারেনি কি হচ্ছে। প্রেমকে কিছুটা ঝাঁকুনি দিয়ে আবারও বলে,
“বলুন না!”
অনুভব বুঝতে পারে ঐশ্বর্যের কথা। চোখ ইশারায় প্রেমকে বলতে বলে। প্রেম থেমে থেমে বলে ওঠে,
“জয় হোক আমার রাণী সাহেবার!”
ঐশ্বর্য স্বস্তির শ্বাস ফেলে। ভেতরে শান্তি অনুভব করছে। তীব্র যন্ত্রণায় বুঁজে আসছে চোখ। নিস্তেজ গলায় বলে,
“এতোদিন ভ্যাম্পায়ার কুইন হয়ে থেকেছি। শেষ মূহুর্ত #প্রেমের_ঐশ্বর্য হয়ে থাকতে চাই। আমি #প্রেমের_ঐশ্বর্য! আর…”
কথাটুকু সম্পূর্ণ হয় না। দুটো ঠোঁট লেগে যায়। নিস্তেজ হয়ে যায় দেহ। মাধুর্যেরও সবটা ঘোলাটে লাগে। মেয়েকে চোখ বুজতে দেখে মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। চিৎকার দেওয়ার আগেই সে টলে পড়ে। অনুভব তাকে ধরে। অন্যদিকে মেয়ের নিথর দেহের দিকে চেয়ে থাকে। তার অজান্তেই চোখ থেকে গড়িয়ে ঐশ্বর্যের গালে পড়ে অশ্রু! চিৎকার তারও করতে ইচ্ছে করছে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু সে এমন করলে কি করে সামলাবে সবাইকে?
প্রেম পাগলের মতো করে ঝাঁকাতে থাকে ঐশ্বর্যকে। তাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ওঠে। চারিপাশটা কেঁপে ওঠে।
“না তুমি এমন করতে পারো না। পারো না ঐশ্বর্য। পারো না তুমি। এমন করতে পারো না।”
কথা বলার মাঝেই সেই অগ্নি তলো’য়ার থেকে সৃষ্টি হয় এক তীব্র রশ্মি। সকলে সহ্য করতে পেরে চোখ বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে যখন চোখ খোলে তখন আবিষ্কৃত হয় এক কাগজ। তলো’য়ারটা তখন গায়েব। তার বদলে পড়ে আছে কাগজ। র’ক্তে মেখে যাচ্ছে দেখে কাগজটা তুলল ইলহান। সকলের দিকে তাকিয়ে কাগজের ভাঁজ খুলল। জোরে জোরে পড়তে থাকল।
” আমি অগ্নি তলো’য়ার। আমার দ্বারা মৃ’ত্যু অনিবার্য হলেও এর একটি প্রতিষেধক আছে। সেখানেই যাও যেখানে আমায় পেয়েছিলে। সেখানেই লুকিয়ে রাখা সেই প্রতিষেধক! তোমার কাছে সময় মাত্র দুই প্রহর। এর মধ্যে বি’ষ সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়বে। তার আগেই উদ্ধার করো সেই প্রতিষেধক।”
প্রেম যখন উন্মাদের মতো কাঁদছিল তখন তার কর্ণকুহরে কথাগুলো প্রবেশ হতেই ইলহানের দিকে তাকালো সে। তখন বৈদ্য এসে উপস্থিত হয়েছে। ঐশ্বর্যের শ্বাস চলছে মৃদু ভাবে। দ্রুত তাকে নিয়ে রওনা হলো প্রাসাদের দিকে।
প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে ঐশ্বর্যের কক্ষে শুইয়ে দেওয়া হলো ঐশ্বর্যকে। বৈদ্য চিকিৎসা করতে আরম্ভ করল। তবে তিনি কিছুই করতে পারবেন না তিনিও ভালোভাবে জানেন। দরকার সেই প্রতিষেধক। কারোর সঙ্গে কোনোরকম কথা না বাড়িয়ে প্রেম পা বাড়ায় প্রায় ধ্বংসাত্মক ডেভিল কিংডমের দিকে। যাবার আগেই আয়নার দিকে পড়ে তার দৃষ্টি। আয়নায় বড় বড় করে লিখা,
“আপনার সঙ্গে আমার আরো কিছু বছর বাঁচার খুব ইচ্ছে ছিল। আরো কিছু বছর বাঁচতে চেয়েছিলাম। তবে আমার সেই বাঁচার আর্তনাদ কেউ শোনে নি। চেয়েছিলাম আমি আর আপনি মিলে আমাদের ছোট্ট পুনমের বিয়ে দেব। দুজনের একসঙ্গে বয়ষ্ক হবো। আপনার বুকে বৃদ্ধ বয়সেও মাথা রাখতে চেয়েছিলাম। ভাগ্য এতো নিষ্ঠুর কেন বলুন তো?”
প্রেমের ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে যেন। ভেতরে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। হৃদয়ে রীতিমতো ভারী বস্তু দিয়ে আ’ঘাত করছে কেউ। অন্যপাশের আয়নার দিকেও তাকায় প্রেম। সেখানেও লিখা,
“আমার যা ইচ্ছে তাই হয়ে যাক। আমি মাটির সঙ্গে মিশে যাই! তবুও আপনাকে ছাড়ব না। সেই শুরু থেকে ছাড়িনি আজও তা করব না। আমি আপনাতেই শুরু আপনাতেই শেষ!”
প্রেম এবার ছুট লাগায় হাতে তলো’য়ার নিয়ে। সে সেদিন আবারও প্রবেশ করেছিল সেই ভয়ানক রাজ্যে। নিজের প্রেয়সীকে যেকোনো মূল্যে বাঁচাতে। এখানে পৌঁছাতেই তার এক প্রহর যখন পার হয় তখন হৃৎস্পন্দন বাড়তে থাকে। প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাজ্যের প্রবেশ দ্বার নতুন করে তৈরি হয়ে হয়েছিল। ঐশ্বর্য ঠিকই বলেছিল। যতদিন ভালো থাকবে ততদিন খারাপও থাকবে। সে তো সেদিন রাজ্যে থাকা ডেভিলদের শেষ করেছিল। যারা রাজ্যের বাহিরে ছিল তাদের তো কিছুই হয়নি। এই নতুন করে রাজ্য তৈরি ছিল হয়ত তাদেরই কাজ।
প্রেম সেদিন ছদ্মবেশ ধারণ করে রাজ্যে প্রবেশ করে। খুব কাছাকাছি পৌঁছায় লক্ষ্যের তবে বাঁধ সাধে কেউ। যখনই অগ্নি তলো’য়ারের সেই সিন্দুক খুলতে যাবে তখনি ধরা পড়েছিল সে। তার হাতে তলো’য়ারের আঘা’ত করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে যুদ্ধ করেছিল। তবে এক পর্যায়ে হাত থেকে তলো’য়ার ছুটে যায়। এক জায়গায় ছিটকে যায়। সে তাকায় ভালো করে চারিপাশে তাকে ঘিরে রাখা ডেভিল গুলোর দিকে। তাদের মাঝে একজন সিন্দুক থেকে প্রতিষেধক বের করে অদ্ভুত হাসতে শুরু করে। আর প্রেমের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“এটা তোমার চাই?”
“হ্যাঁ চাই। এর বদলে তোমরা যা চাইবে তাই দেব। তবুও আমার কাছে দাও।”
তারা সকলে হাসে। আর বলে ওঠে,
“মগের মুল্লুক নাকি? চাইলেই পাওয়া যায়? হাঁটু গেঁড়ে বস।”
প্রেমের যেকোনো মূল্যে সেই প্রতিষেধক চাই। সে পিছু ফিরল না। হাঁটু গেঁড়েই বসল। সেই কাঙ্ক্ষিত ডেভিল তার থেকে বেশ দূরত্বে প্রতিষেধক রেখে বলল,
“নাও সেই প্রতিষেধক।”
প্রেম যেন চাঁদ পেয়েছে। অন্য কোনো দিকে খেয়াল করল না। তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেল সেটির দিকে। তখনই তলো’য়ার চালানোর শব্দ হয়। ধারালো তলো’য়ার তড়তড় করে প্রেমের পিঠে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কোনোরকম টু শব্দ না করেই পড়ে যায় সে। হাত-পা ছুঁড়ে চেষ্টা করে প্রতিষেধক নিতে তখনও। আবারও তাকে আ’ঘাত করা হয়। সকলে মিলে ইচ্ছেমতো তার ওপর হামলে পড়ে। মারাত্মকভাবে আ’ক্রমণ করে বসে। প্রেম ছটফটিয়ে ওঠে। একা পারে না সকলের সাথে। তবুও প্রেমের দৃষ্টি আঁটকে ছিল সেই প্রতিষেধকের মাঝে।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কক্ষে প্রবেশ করে প্রেম। কপাল থেকে বিরামহীনভাবে ঝরছে র’ক্ত। গালের এক পাশ কে’টে গিয়েছে। পিঠ থেকে এখনো রক্তক্ষরণ থামেনি। কোনোরকমে একটা কাপড় বেঁধে রাখা। হাঁটতে কষ্ট হলেও মুখে হাসি বজায় রেখেছে সে। কারণ তার হাতে প্রতিষেধক। ঐশ্বর্য আগের মতো হবে। তার রাণী সাহেবা তার সাথে বাঁচবে! আর কি চাই?
কক্ষে প্রবেশ করেই এতো এতো ভীড় থেকে বিরক্ত হয় সে। এতো ভীড় কেন? তবে ভীড় হওয়া অযৌক্তিক না। এই রাজ্যের রাণী ঐশ্বর্য। তাকে দেখতে তো এতো এতো ভীড় হবেই। প্রেমকে দেখা মাত্র সকলে মাথা নুইয়ে নেয়। তাকে যাবার রাস্তা করে দেয়। প্রেম এগিয়ে যায়। সকলের কান্নামাখা চেহারা দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়। তবুও এগোতে থাকে। কান্না সুর ততই বেশি গাঢ় হতে থাকে। আপাদমস্তক কাঁপতে থাকে। বিছানা অবধি যেতেই নিজের মা-বাবাকে দেখে কিছুটা হেঁসে ওঠে প্রেম। আর জিজ্ঞেস করে,
“মা-বাবা তোমরা কখন এলে?”
মিসেস. পরিণীতা এবং কবির সাহেব প্রেমের দিকে তাকালো। অশ্রুসিক্ত মিসেস. পরিণীতার দুটো চোখ। প্রেমের ভ্রু কুঁচকায়। তার মা তাকে এমন অবস্থায় দেখা মাত্র এগিয়ে আসে। তার গালে মুখে হাত রেখে বলে,
“এ কি অবস্থা তোমার প্রেম?”
“কিছু না মা। এইতো প্রতিষেধক দেখো! ঐশ্বর্য ঠিক হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মিসেস. পরিণীতা হু হু করে কেঁদে ওঠেন। কান্নার কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে এসে ঐশ্বর্যের পাশে বসে প্রেম। তার হাতের প্রতিষেধক দ্রুত বৈদ্যের কাছে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এই নিন! দ্রুত কাজ করুন। হাতে সময় নেই।”
সকলে স্তব্ধ। মুখে নেই কোনো ভাষা। অন্যপাশে এলিনা ছোট্ট পুনমকে কোলে নিয়ে মুখ গুঁজে কাঁদতে দেখে এলিনাকে প্রেম রাগী সুরে বলল,
“একি! পুনমকে এতো ভীড়ে রেখেছো কেন? নিয়ে যাও এখান থেকে।”
এলিনা দাঁড়াল না। প্রেমের কথায় সত্যিই বেরিয়ে গেল দৌড়ে ঘর থেকে পুনমকে গিয়ে। প্রেমের পিঠে যন্ত্রণা হচ্ছে। পিঠে সে হাত দেওয়ার চেষ্টা করতেই মৃদু চিৎকার হয়ে উঠল। হাত দিতেই বুঝল র’ক্তের স্রোত বইছে। তাতে কি? ঐশ্বর্য ঠিক হলেই নিজের চিকিৎসা করাবে। আগে দেখে নেবে ঐশ্বর্যের হাসোজ্জল মুখ। কিন্তু বৈদ্যকে চুপ থাকতে দেখে প্রেম আবারও বলে উঠল,
“কি হলো? কাজ করছেন না কেন? সময় পেরিয়ে যাবে তবে এই প্রতিষেধক ব্যবহার করবেন?”
“সময় ইতিমধ্যে চলে গিয়েছে কিং। আমায় ক্ষমা করুন। এই প্রতিষেধক আর কোনো কাজে আসবে না।”
প্রেম কিছু বুঝে উঠতে পারে না। বুকে চিনচিন করে ওঠে। নিজের শরীরের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায়। তবুও জিজ্ঞেস করে,
“মানে?”
“আপনি আসতে দেরি করে ফেলেছেন। বি’ষ কুইনের সারা শরীরের ছড়িয়ে গেছে। দুই প্রহর পেরিয়ে গেছে। অর্থাৎ উনি আমাদের মাঝে নেই।”
থরথর করে কেঁপে ওঠে প্রেম। দুই প্রহর পেরিয়ে গেছে? কখন কিভাবে? ঐশ্বর্যের পানে তাকায় সে। অশ্রুসিক্ত নয়ন তার। অশ্রুতে ভরাট চোখেও ঐশ্বর্যকে দেখছে সে। নীলাভ চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে না তার প্রিয়তমার। সে যে চোখ বুঁজে রেখেছে। চোখমুখ নীল হয়ে গিয়েছে। শরীর ছেড়ে দিয়েছে। ঝুঁকে পড়ে প্রেম ঐশ্বর্যের দিকে। তাকে আবারও আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিজের সাথে। তাকে সে নিজের মাঝে মিশিয়ে নিতে চায়। ব্যাস…আর কোনো কথা বলে না। তবে ঐশ্বর্যের কানে কানে বলে,
“আই এম সরি এ্যাংরি বার্ড। আমি আসতে দেরি করে ফেলেছি। তার জন্য এতোই অভিমান?”
কথাগুলো ঐশ্বর্যের কান অবধি পৌঁছায় না। পৌঁছাবেও না। শরীরে এবার বরফের চেয়েও বেশি ঠান্ডা হয়ে এসেছে তার। মিসেস. পরিণীতা এগিয়ে আসে। আর ছেলের পাগলামিতে বলেন,
“ও তো ছেড়ে চলেই গেল বাবা। তুমি নিজের চিকিৎসা করাও। তোমায় বাঁচতে হবে। আমার দোহাই লাগে তোমার।”
“ঐশ্বর্য এটা অন্যায় করেছে মা। খুব বড় অন্যায়। ও তো সকলের ন্যায় বিচার পাইয়ে দেয়। তবে আমার প্রতি এ কেমন অন্যায় রাণী সাহেবার? একদিন সে জোর করেই আমার জীবনে প্রবেশ করেছিল। আবার আজকেও জোর করেই আমার জীবন থেকে চলে যাচ্ছে। কেন আমি সবসময় মেনে নেব? নেব না আমি অন্যায় মেনে।”
মিসেস. পরিণীতা শব্দ করে কেঁদে ওঠেন আর বলেন,
“কিন্তু তুমি এতে কিছুই করতে পারবে না প্রেম। ঐশ্বর্য আর নেই যে!”
প্রেম মাথা উঠিয়ে ঐশ্বর্যের দিকে তাকায়। নয়ন ভরে দেখে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই প্রথম দিনের কথা। সেই উশৃংখল মেয়ের মুখশ্রী! সেই জেদি চোখ। সেই রাগ! সেই পাগলামি। সবকিছু এতো দ্রুত ফুরিয়ে গেল বুঝি?
কবির সাহেব এসে প্রেমকে সরাতে চান। প্রেম সরে আসে। কারো কথা তার কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না। সে বাঁচতে পারতো। পুনমের জন্য বাঁচতে পারতো। তবে তাকেও যে বি’ষ পান করানো হয়েছিল। তার শরীরে তা ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রেমের শক্তি ক্ষয় হতে লাগল। চোখ দুটো বড্ড ক্লান্ত। কখন যেন চিরতরে বুঁজে যাবে। ঐশ্বর্যের কানের কাছে অতি কষ্টে মাথা নিয়ে গেল সে। ফিসফিস করে জোর দিয়ে বলল,
“একসাথে বাঁচতে পারিনি তো কি হয়েছে? তোমার পিছু আমি ছাড়ছি না। ভালোবাসতে বুঝি একাই পারো?”
কবির সাহেব সহ সকলে প্রেমকে ধরে টানাটানি করছে। এক পর্যায়ে প্রেম নিজে থেকে ছেড়ে দেয় বাঁধন। আলগা হয়ে যায়। চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে আসে। অন্ধকার হতে থাকে চারিদিকে। শেষ বারের মতো কানে আসে মায়ের করা চিৎকার! প্রেম শেষ বার হঠাৎ হেঁসে ওঠে। কিছু একটা বলে। কেউ শুনতে পায় না। সে নিজেই বলে এবং শোনে।
“আমার একান্ত একটি পৃথিবী ছিল। ভালোবাসাই মোড়ানো পৃথিবী। সেখানে ছিলাম আমি এবং আমার অর্ধাঙ্গিনী। পৃথিবী আগুনে জ্বলে গেল। ধ্বংস হয়ে গেল চোখের সামনে। তবুও আমি পিছু ছাড়ব না আমার প্রিয়তমার!”
বর্তমান…
“এভাবে তবে শেষ হয়েছিল #প্রেমের_ঐশ্বর্যের এবং ঐশ্বর্যের মি. আনস্মাইলিং এর কাহিনী? এভাবেই বুঝি হেরে গিয়েও জিতে গিয়েছিল তারা?”
আনমনা প্রশ্ন পুনমের। চোখের অশ্রু চিকচিক করছে। কষ্ট না হলেও অদ্ভুত শান্তি পাচ্ছে। তার মা তো জয়ী হয়েছিল। তার মা যে এই রাজ্যের আসল রাণী সাহেবা। মাধুর্য মাথা নাড়ায়। আর বলে,
“হুমম। প্রেমও অবশেষে তার অর্ধাঙ্গিনীর পিছু নিয়েছিল। কেউ তাকে আটকাতে পারে নি।”
“সেটা তো নেওয়ারই ছিল মেরি জান! ভাগ্য কি করে বদলাবে?”
কথার মাঝে এক পুরুষালি কন্ঠ ভেসে আসে। পুনম পুলকিত চোখে পিছু ফিরে তাকায়। কক্ষের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে বিশেষ জনকে দেখে লাফিয়ে ওঠে পুনম। উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেই ভারি গলা প্রশ্ন করে,
“কি হয়ে কথা হচ্ছে আমায় ছাড়া?”
“তোমায় ছাড়া কোনো কথা হতে পারে? তাড়াতাড়ি এসো!”
ছুটে এসে পুনম নিজেই জড়িয়ে ধরে বিশেষ জনকে। সে-ই স্নেহের সাথে পুনমের মাথা হাত রেখে হেসে ওঠে। এবার পুনম কন্ঠস্বর দৃঢ় করে বলে ওঠে,
“মি. অনুভব সিনহা! সারাদিন বিজনেস, রাজ্য না করে একটু নাতনি নাতনি করলেও তো পারেন।”
হাসিটা প্রগাঢ় হয় অনুভবের। শব্দ করে হেঁসে বলে,
“আমার নাতনিকে মিস করছিলাম জন্যই তো ছুটে এলাম।”
“আমার জানা আছে কত নাতনিকে মিস করছিলেন। আমার ঘাড়ে ব’ন্দুক রেখেছেন। আসলে তো নিজের ওয়াইফকে মিস করেছিলেন। তাই তো এতো রাতেও চলে এসেছেন। ওয়াইফ ছাড়া এক রাতও থাকা যায় না তাই না?”
অনুভবের হাসি থামে না। পুনমও হেঁসে দেয়। ঐশ্বর্যের পর যেন তার আরেক সন্তান পুনম। অনুভব পুনমের মাঝে ঐশ্বর্যের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। তাই তো তাকে নিয়েই বেঁচে থাকা।
নিশুতিরাত। আশপাশটা যখন স্তব্ধ তখন এক অদ্ভুত আওয়াজ বেজে ওঠে। নূপুরের আওয়াজ চারিদিকে মাতিয়ে তোলে। এক জোড়া পা এগিয়ে যায় বড় বড় করে টানিয়ে রাখা ছবিগুলোর দিকে। ছবিগুলোর কাছে এসে থামে পুনম। মুখে ফুটে ওঠে হাসির রেখা। তার সামনে বড় একটা ছবি। ছবির নিচে স্পষ্ট লেখা, ‘প্রেমের ঐশ্বর্য’। পুনম তার ডাগরডাগর চোখে তাকায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকে উচ্ছ্বসিত করে। সেই হিংস্র মুখভঙ্গি যেন পুনমের মনে কৌতুহল জাগায়। এই তার মা। হাতে বড় একটা তলো’য়ার। তার দৃষ্টিতেই তো সকলে ঝলসে যাবে। অ’স্ত্রের কি প্রয়োজন? পাশের ছবিতে তাকায় পুনম। তার মা-বাবার একসাথের ছবি। দুজনেই সিংহাসনে বসে। যেন সিংহাসন তাদের জন্যই তৈরি! পুনম মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। অতঃপর বিড়বিড় করে বলে,
“তোমাদের ভালোবাসা সচক্ষে দেখার খুব ইচ্ছে আমার। জানি আদেও সম্ভব নয়। মা খুব ভাগ্যবতী যে এমন একজনকে পেয়েছে যার মায়ের অস্তিত্ব নিয়ে মাথাব্যথাই ছিল না। আর বাবাও ভাগ্যবান মানুষ। নিশ্চয় তুমি খুব ভালো ছিলে বাবা। নয়ত কি করে মায়ের কঠিন মন ভেঙে ভালোবাসার সঞ্চার করতে পেরেছিলে?”
কথাগুলো বলতে বলতে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয় পুনম। চাঁদের আলো এসে পড়ে ছবিগুলোতে। যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে ছবিগুলো। পুনম স্থির চোখে রূপালী চাঁদের দিকে তাকায়। আর আনমনে বলে,
“মা জানো? সবাই বলে আমি নাকি তোমার প্রতিরূপ! সত্যিই কি তাই? আমি জানি সত্যিই সেটা নয়। কারণ তোমার মতো তীব্র সাহস আমার নেই। তুমি তুমিই হতে পারো। অন্য কেউ হতে পারে না। তুমি অনন্য এক নারী! আর সেই নারীর চমৎকার এক প্রেমিক ছিল শেখ আনন প্রেম।”
যেন আকাশে ভাসছে প্রেম এবং ঐশ্বর্যের খুনসুটি। পুনমের চোখে ভেসে ওঠে চাঁদের মাঝেই একজন নারী এবং পুরুষের প্রতিচ্ছবি! ওইযে তারা! হাসিতে মেতে উঠেছে। ঐশ্বর্য শান্তিতে বুকে মাথা রেখেছে তার উম্মাদ প্রেমিক পুরুষের। ওইযে ফুটে উঠেছে সেই উন্মাদ প্রেমিক এবং প্রেমিকার গল্প!
-সমাপ্ত-
[বি.দ্র. অনেকের মেনে নিতে খারাপ লাগবে প্রেম এবং ঐশ্বর্যের পরিণতি। তবে আমি গল্প শুরু থেকে এভাবে সাজিয়েছি। আমি বলেও দিয়েছিলাম গল্পে তিনটা অংশ ফুটে উঠবে। শেষ অংশটিতে ফুটে উঠবে একজন রাণীর তার রাজ্যের প্রতি ভালোবাসা। সেটা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি কিনা জানা নেই। ঐশ্বর্য এমন এক নারী যে কিনা অন্য অস্তিত্বের হলেও ভালোবেসেছে এক সাধারণ মানুষকে। সেই সাধারণ মানুষ প্রেম কতটুকু ঐশ্বর্যের পাশে থেকেছে সেটাও ফুটিয়ে তুলেছি আমি। হয়ত অনেকের কষ্ট লাগবে। খারাপ লাগবে। সেটা মার্জিতভাবে বলতে পারেন। আশা করছি পাঠকমহলের কাছ থেকে কোনো আ’ক্রমণাত্মক মক্তব্য পাবো না। অবশ্যই আপনাদের মত আছে। সেটা ভালো করে বলবেন। গল্পটা নষ্ট করে দিলেন, গল্পটা খারাপ হয়ে গেল এমন মক্তব্য করবেন না। দুঃখের পরিণতি দিলেই গল্প নষ্ট হয় না। গল্পের সমাপ্তি যেমন খুশির হয় তেমনই দুঃখেরও হয়। গল্পের সমাপ্তি আগে থেকেই জানলে সেটা পড়ে লাভ কি বলুন তো? ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক ছিল। আর শেষ পর্বে আশা করছি গঠনমূলক মক্তব্য পাবো।]