#প্রেমের_সাতকাহন
#পর্ব_১২
#সুমাইয়া_জাহান
—- কাকু আজকে ফুচকা গুলো কি দিয়ে বানাইছো গো!এতো টেষ্ট হইছে বলার মতো না।এই বললা ননদি……..
রিমি কথা গুলো বলতে বলতে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে তূবা কোথাও নেই।ফুচকা খাওয়াতে এতোটাই বিভোর ছিলো যে আশেপাশের কোনো খেয়ালই রাখেনি।হঠাৎ করে তূবাকে না দেখতে পেয়ে ভিষণ ভয় পেয়ে যায়।তূর্য খুব করে বলেছিলো তূবা আশেপাশে এখন নাকি অনেক বিপদ।তবে কি তেমনই কোনো বিপদে পরলো তূবা?রিমির এখন নিজের উপর ভিষণ রাগ হচ্ছে সামান্য একটা ফুচকা খাওয়ায় এতোটাই মনধ্যান দিয়ে দিছে যে তূূবার বিপদের কথা একটুও মাথায় ছিলো না।একটু খেয়াল রাখলেই তো আজ এমন টা হতো না।কেন যে আজ তূবার জেদের কাছে হার মেনে ওকে এখানে আনতে গেলো।আর একটু সতর্ক থাকলে তো এমন টা হতো না।এখন কি করবে রিমি কিছুই বুঝতে পারছে না।দিশেহারা হয়ে চারিদিক খুঁজতে লাগলো। কিছুক্ষণ খোঁজার পরও যখন তূবার কোনো খোঁজ পেলো না তাই ঠিক করলো তূর্য কে ফোন করবে।এতে যদি তূর্য বকাও দেয় তাহলে বকাও খেতে রাজি।কিন্তু তূবাকে এখন যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে।তাই আর কিছু না ভেবে তূর্যের নাম্বার ডায়াল করতে লাগলো।ঠিক তখনই তূবা একটু সামনে থাকা রেস্টুরেন্ট টা থেকে কেমন যেন মনমরা হয়ে বেরতে লাগলো।তূবা একটু এগিয়ে আসতেই রিমি স্পষ্ট দেখতে পেলো তূবার চোখে পানি টলমল করছে।গড়িয়ে পরতে গিয়েও পরছে না।বোঝাই যাচ্ছে চোখের মালিক খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে চোখ দুটোর পানি গুলোকে আটকে রাখতে কিন্তু চোখের পানি গুলো সেই বাঁধা কিছুতেই মানছে না।তূবার এই অবস্থা দেখে রিমির খুব খটকা লাগলো।এইতো একটু আগেই তো কতো হাসি মজা করলো।একটুকু সময়ের মধ্যে কি এমন হলো যে তূবার চোখে একেবারে পানি এসে পরলো।তূবার চোখে খুব সহজে পানি আসে না।কোনো কিছুতে খুব কষ্ট পেলে তবেই চোখে পানি আসে।তারমানে এখন তূবার সঙ্গে এমন কিছু একটা ঘটেছে যার জন্য তূবা খুব কষ্ট পাচ্ছে।বলতে গেলে রিমি তূবাকে নিজের বোনের থেকেই বেশি ভালোবাসে। তাই তূবার কষ্ট পেতে দেখে রিমি দৌড়ে তূবার কাছে গেলো।
💗💗
আজ এমন কিছু শুনতে হবে তা আমার কল্পনাতেও ছিলো না।এমন একটা সত্যি জানতে পেরে নিজের চোখের পানি গুলো শতো চেষ্টা করেও আটকে রাখতে পারছি না।তাই রাহুল নামের ছেলেটার সামনে থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে আসলাম।রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে কিছু দূর আসতেই দেখলাম রিমি আমার দিকে দৌড়ে আসছে।চোখে মুখে অনেক চিন্তার ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।ওকে তো তখন বলেই আসা হয়নি তখন।নিশ্চয়ই আমাকে দেখতে না পেয়ে নিজের এমন অবস্থা করেছে।
রিমি আমার কাছে দৌড়ে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো।আর ব্যস্ত গলায় বলতে লাগলো,
—- কি হয়েছে তোর?এইটুকু সময়ের মধ্যে কি এমন ঘটেছে যার জন্য তুই এমন কষ্ট পাচ্ছিস!আমি তোকে খুব ভালো করেই চিনি তূব তোর চোখে খুব সহজে পানি আসে না।তাই আমার কাছে কিছু না লুকিয়ে সত্যি টা বল।
আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সব খুলে বললাম।আপনাদেরও সব জানতে হলে ঘুরে আসতে হবে কিছুক্ষণ আগে।
ফ্লাশব্যাক……….
আমি আর রাতুল রেস্টুরেন্টে বসে আছি একে অপরের মুখো মুখি।কিন্তু রাতুল কিছুই বলছে না।আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
—- রাতুল আপনি কি আদো কিছু বলবেন?
—- হ্যাঁ হ্যাঁ বলার জন্যই তো ডেকে আনলাম। আসলে কথাটা তোমার মায়ের সম্পর্কে!কিভাবে যে শুরু করবো বুঝতেই পারছি না।
মায়ের সম্পর্কে?এই লোক কি এমন জানে আমার মায়ের সম্পর্কে যা আমি জানি না?এতোক্ষণ বিরক্ত হলেও মায়ের সম্পর্কে বলাতে এখন বেশি অনেক টা আগ্রহ নিয়েই রাহুলের কথা শোনার জন্য ওর উনার দিকে তাকিয়ে আছি।আমার আগ্রহ দেখতে পেয়ে রাতুলের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।এবার নিজেকে প্রস্তুত কর বললে লাগলো,
—- তুমি তো জানো তোমার ছোট্ট বেলায়ই তোমার মা মরা গেছে।কিন্তু কিভাবে মারা গেছে তা কি তুমি জানো?
এবার আমি সত্যি সত্যি চরম বিরক্ত হচ্ছি লোকটার উপর।এই কথা জিজ্ঞেস করার জন্য আমাকে একা এখানে ডেকে এনেছে।নিশ্চয়ই ব্যাটা তাড় ছিঁড়া।এ নির্ঘাত পাবনা থেকে পালিয়ে এসেছে।ভাগ্যিস সেইদিন এর সাথে আমার বিয়েটা হয়নি।না হলে যে বিয়ে দ্বিতীয় দিনই আমার জায়গা হতো পাবনা মেন্টাল হসপিটালে।উফফ একটুর জন্য আমি সেইদিন বেঁচে গেছি। এই পাগলের সাথে আর বেশি কথা বলা যাবে না।তাই ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠতে লাগলাম।
—- আরে কি করছো কি?আমাকে তো কথা বলতে দেবে।
—- আমি ভেবেছিলাম আপনি সত্যি কোনো৷ গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতেই আমাকে ডেকেছেন।আপনার হাতে হয়তো অনেক টাইম আছে তাই টাইম পাস করতে আমাকে ডেকেছেন।সরি আমার হাতে না এতো টাইম নেই তাই আমি বসে বসে আপনার সাথে আড্ডা দিতে পারবো না।আর হে আপনার প্রশ্নের উত্তর টাও দিয়ে যাই হ্যাঁ আমি খুব ভালো করে আমার মা কিভাবে কখন মারা গিয়েছেন।উনি একটা কার এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন।হয়েছে এবার আপনার শান্তি!তাহলে এবার আমি যাই গুত বাই!
কথাগুলো বলেই আমি চলে যেতে নিলে রাতুল পিছন থেকে খুব শান্ত বললো,
—- আমি যদি বলি তোমার মা কোনো এক্সিডেন্টে মারা যায়নি বরং খুন হয়েছে তখন কি বলবে মিসেস চৌধুরী!
আমি আর এক পাও এগোতে পারলাম না। আবার পিছনে ঘুরে রাতুলের সামনে গিয়ে এক ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করলাম,
—- কি বলতে চাইছেন আপনি??
—- দাড়িয়ে দাড়িয়ে শুনবে নাকি?আগে বসো তো!
হাত দিয়ে ইশারা করে বললো রাতুল। আমিও কথা না বাড়িয়ে উনার কথা মতো বসে পরলাম।রাতুল শান্ত ভঙ্গিতেই বলতে লাগলো,
—- খুব অল্প কিছু মানুষ ছাড়া সবাই তোমার মা মানে নীলাশা সিকদারের মৃত্যু টা জানে কোনো একটা কার এক্সিডেন্টে। নীলাশা সিকদারের মৃত্যু কিন্তু একটা খুন।তোমার তখন পাঁচ বছর হবে হয়তো তখন নীর মানে নীর চৌধুরীর নয় বছরের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তোমরা পুরো সিকদার পরিবার গিয়েছিলে। বলা বাহুল্য সেইসময় তোমার বাবা আর নীরের বাবার মধ্যে বন্ধুত্ব সম্পর্ক ছিলো।কিন্তু নীরের বাবা একদম ভালো মানুষ ছিলেন না।নীরের বাবা মানে আশরাফ চৌধুরী সবার সামনে খুব ভালো সেজে থাকলেও আড়ালে তিনি তার কালো ব্যবসা চালাতেন।সেইদিন তোমার মা কোনো ভাবে জেনে যায় উনার ওই কালো ব্যবসার কথা।তোমার মা হয়তো বলেছিলো আশরাফ চৌধুরী এই অপকর্মের কথা সবাই কে বলে দেবে তাই সেইদিন ছেলের৷ জন্মদিনের নিজ হাতে বন্ধুর স্ত্রীকে খুন করে আশরাফ চৌধুরী। তোমার মাকে খুন করার সময় তোমার বাবাও দেখে ফেলে সেইদিন।কিন্তু আশরাফ চৌধুরী তোমার বাবার অনেক কাছের বন্ধু ছিলেন।আরো কিছু কারণে আশরাফ চৌধুরীকে সেইদিন আইনের হাতে তুলে দেননি।তবে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন সেইদিন।সেইদিনের পর থেকেই চৌধুরী বাড়ী আর সিকদার বাড়ী আলাদা হয়ে যায়।ওই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর আশরাফ চৌধুরী একটা এক্সিডেন্টে মারা যায়।তবে কেউ কেউ বলে তার কালো ব্যবসার জন্যই তিনিও খুন হন।আশরাফ চৌধুরী মারা যাওয়ার পর তার সমস্ত কালো ব্যবসা এখন দেখাশোনা করে নীর চৌধুরী। নীরও জানে তোমার মায়ের মৃত্যুর ঘটনাটা তাই ও মনে করে আশরাফ চৌধুরীকে তোমার বাবাই খুন করেছে।তাই ও তোমাকে বিয়ে করেছে নিজের বাবার খুনের বদলা নিতে আর তোমার বাবার সব সম্পত্তি নিজের নামে করতে। আমার জানা মতে তুমি তোমার বাবার কাছে বা ভাইয়ুর কাছে মায়ের মৃত্যুর কথা জিজ্ঞেস করলে ওরা প্রতিবারই এড়িয়ে যেতো।আর তুমি যে তোমার মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে যেটা জানতে ওইটা তোমাদের বাড়ির কাজের লোকের থেকে জেনেছো তাই না!আচ্ছা তোমাকে কয়েকটা ছবি দেখাই।
তারপরই কয়েকটা ছবি আমার সামনে ধরে রাতুল। ছবি গুলো আমার মায়ের। পেটে ছুরি গাঁতা সহ রক্তাক্ত অবস্থায় শুয়ে আছে।চারিদিকে রক্তে লাল হয়ে আছে।আর কিছু দেখতে পারলাম না।একটা মেয়ে আর যাইহোক কখনো তার মায়ের এইরকম ছবি দেখতে পারে না।তাই তাড়াতাড়ি ওখান থেকে বেরিয়ে এসেছি।
ফ্লাশ এন্ড…………
রিমি আমার এদিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
—- ছবি গুলো তো এডিট করাও হতে পারে?
—- না ওগুলো এডিট করা ছিলো না আমি খুব ভলো করেই দেখছি।অনেক পুরনো ছবি ছিলো ওগুলো।
আমার কথা শুনে আবারও আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রিমি। আমি জানি এখন ও কি ভাবছে তাই নিজে থেকেই বললাম,
—- এটাই ভাবছিস তো আমার চোখে পানিটা কেন? কেন আমি কাঁদছি? আমি ওই রাতুল নামের ছেলেটার কথার জন্য কাঁদছি না।ওই ছেলের কোনো কথাই আমি বিশ্বাস করিনি।ও যে আমার আর নীরের সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য কথা গুলো বলেছে ওইটুকু আমি খুব ভালো করেই জানি।ওর ব্যবহারে আর কথা বলার ভঙ্গিতেই আমি বুঝে গেছি খারাপ মতলবেই ও আমাকে এগুলো বলেছে।আর ভাইয়ুর কাছেও আগে থেকে জেনেছি ছেলেটা একদমই ভালো না।তাই ওর কথাগুলো আমি একটুও বিশ্বাস করিনি।তবে আমার মায়ের খুনের কথাটা সত্যি। আমার মা সত্যি খুন হয়েছে।আমি যখনই বাবা বা ভাইয়ুর কাছে মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চাইতাম তখনই এড়িয়ে যেতো।কখনো বলতো না।সত্যি আমি মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে এতোদিন যা জানতাম সবই আমাদের বাড়ির কাজের লোকের থেকে জেনেছি।তবে ভাইয়ু একদিন মায়ের ছবির সামনে দাড়িয়ে খুব কাদঁছিলো আর বলছিলো বলেছিলো ” তোমার খুনিদের আমি যোগ্য শাস্তি দিবো।তারা আর বেশিদিন এই খোলা আকাশের নিচে থাকতে পারবে না।” তখন কিছুটা ছোট্ট ছিলাম তাই তখন ভাইয়ুর কথার মানে টা বুঝিনি।সেদিনের সেই কথা থেকে বোঝা যায় ভাইয়ু জানতো মায়ের খুনি কারা।যদি নীরের বাবাই খুনী হতো তাহলে নীরের সাথে ভাইয়ার কখনো এতো ভালো সম্পর্কে থাকতো না।আর নীরের বাবা তো মারাই গেছে তাহলে কেন বললো খুনিদের খোলা আকাশের নিচে বেশিদিন থাকতে দেবে না?তাই আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছি নীরের বাবা আমার মায়ের খুনি না।ওই ছেলেটা এগুলো বলে আমাকে নীরের থেকে আলাদা করতে চাইছে।প্রতিবারই নীরের নাম মুখে আনার সময় ওর মুখের রং টা বদলে যেতো।
—- উফফ যাইহোক তুই যে ওই ছেলটার কথায় নীরকে ভুল বুঝিসনি এতেই আমি খুশি।তবে আন্টির মৃত্যুর কথাটা শুনে আমারই খুব খারাপ লাগছে।আর তোর তো……..
—- আচ্ছা বাদ দে এসব এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে মামনী খুব চিন্তা করবে।
—- হুম চল।
তারপর আমি আর রিমি বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্য রওনা হলাম।
💗💗
বাড়ি এসেই আমি ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।ফ্রেস হয়ে বের হতে না হতেই মামনী খাবার নিয়ে চলে এসেছে আমার রুমে।মামনীও না!আমি এখন না খাওয়ার অজুহাত দেখাবো তাই নিজেই চলে এসে খাবার নিয়ে।হাতে থাকা তোয়ালে টা এক সাইডে রেখে মুচকি হেসে মামনীর কাছে গিয়ে বললাম,
—- মামনী তুমি এতো কষ্ট করে আমার জন্য রুমে খাবার আনতে কেন গেলে আমি তো এখুনি নিচে যেতামই!
—- হুম তুমি কতো বাধ্য মেয়ে আমার জানা আছে।আমি যদি এখন না আসতাম তহলে না খেয়েই এখনি যে ঘুমিয়ে পরতি আমি খুব ভালো করেই জানি।
তারপর মামনী আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়।আমিও হাসি মুখে মামনীর হাতে খেতে থাকি।খাওয়া শেষে মামনী চলে যেতেই আমি ঘুমিয়ে পরি।
বিকেলে আমার ঘুম ভাঙ্গে ফোনের শব্দে। একটা৷ আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে।কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে ফোন টার দিকে তাকিয়ে থাকতেই কলটা কেটে যায়।তারপর আবার একই নাম্বার কল আসে।এবার আর কিছু না ভেবে কলটা রিসিভ করি।
চলবে,,,,,,