প্রেমোদ্দীপক পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

0
1318

#প্রেমোদ্দীপক। (অন্তিম পর্ব)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

শরতের এক মধ্যহ্নের কথা। নীলাভ আকাশে টুকরো মেঘের ভেলা। মৃদু বাতাস বয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিতে। বারান্দার স্পাইডার প্ল্যান্টের সবুজ-সাদা মিশেল পাতা গুলো দুলছে এদিক-ওদিক। গ্রীলভেদ করে এক ফালি রোদ এসে পড়ছে বারান্দার মাঝে। আলতোভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে বারান্দার মাঝে লবি চেয়ালে হেলান দিয়ে বসা অভীককে। হাতে বই। মেলা রাখা পাতা গুলো উলটে যাচ্ছে আপনখুশিতে। সেদিকে ধ্যান নেই ওর। মাথাটা কাত করা, চোখ জোড়া বন্ধ। গাঢ় নিঃশ্বাস জানান দিচ্ছে ওর ঘুমের গভীরতা। আকস্মিক তীক্ষ্ম শব্দ এসে ধাক্কা খেল কানে। নেত্রপল্লব নড়ে উঠল, নিঃশ্বাসের গভীরতা কমে এলো। বেড়ে গেল শব্দের দীর্ঘতা। ঘুম ছুটে গেল চোখ থেকে।

আজ ভার্সিটি বন্ধ। কর্মব্যস্ত জীবনের একটু অবসর পেয়ে বই নিয়ে বসেছিল বারান্দায়। আরাম করে হেলান দিয়ে বসে বই পড়ছিল, কখন যে চোখে ঘুম নেমেছে টের পায়নি।

চোখ খুলতেই তীক্ষ্ম আলো এসে লাগল চোখে। চোখ বুজে ফেলল। আবার খুলল। চেঁচামেচির শব্দ কানে এসে ধাক্কা খেল আবার। পরিচিত একটা স্বর ভেসে আসছে কানে। ঘরের খুশির ঝিলিক দুটো ফিরে এসেছে বোধহয়। এসেই চেঁচামেচি শুরু করেছে। আজ কী নিয়ে ক্ষেপেছে কে জানে। দেখা যাক। অভীক উঠে দাঁড়াল। পা বাড়াল ঘরের দিকে।

বসার ঘরের সোফায় বসা বছর দশেকের শ্যামরাঙা একটা মেয়ে। পেশিবহুল মায়াবী চেহারা। পরনে সাদা শার্ট, নেবি ব্লু স্কার্ট। মাথায় দুই ঝুটি বাধা। পাশে ব্যাগ রাখা। সদ্য স্কুল থেকে আসার গাঢ় লক্ষণ।জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে, ভয়ার্ত চেহারা। দৃষ্টি সামনে দাঁড়িয়ে ওর উদ্দেশ্যে বকতে থাকার নারীর দিকে। নারীটির পরনে লেমন কালার শাড়ি, লম্বা চুল খোঁপা করা, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। কপালে টিপ। শ্যামরাঙা চেহারাটা ঢাকা পড়েছে রাগে। চোখ দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে। হাতে স্টিলের স্কেল।
সেটা সামনে তাক করে রাগত স্বরে বলছে,
‘ বাপ প্রফেসর , মা লেকচারার । তাদের মেয়ে হয়ে তুই ফেইল করিস পরীক্ষায়! আমি তো জীবনে ফেইল কী জিনিস চোখেও দেখিনি। আমার মেয়ে হয়ে তুই ফেইল করছিস! তাও চার বিষয়ে! আমি ভাবতে পারছি না। আমার ঘরে আল্লাহ এটা কী দিল! এত বোকা! আমি তো এমন ছিলাম না! কার মত হলি তুই?’

দরজায় দাঁড়ানো অভীক আকস্মিক কেশে উঠল। জ্বর টর তো এলো না। ঠান্ডা ও লাগে নি। হঠাৎ কাশিটা এলো কোথা থেকে! ভাবনার বিষয়। নারীটি অভীককে দেখে থামল। তিরস্কারের সুরে বলল,
‘আসুন, আসুন। দেখুন আপনার আদরের মেয়ের মহান কান্ড?’

অভীক ভেতরে যেতে যেতে বলল,
‘কী করেছে আমার মেয়ে?’

‘পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে আজ। চার বিষয়ে ফেইল করেছে তোমার মেয়ে। কী করব এই মেয়েকে নিয়ে?’ তাহিয়ার রাগের মাত্রা বাড়ছে ক্ষণে ক্ষণে।

অভীকের সুন্দর লাগল দৃশ্যটা। ঠোঁট চেপে হাসল।
তারপর মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘তিহা এবার থেকে পড়া মনোযোগ দিবে, তাই না মা?’

ভীত তিহা বাবাকে জড়িয়ে ধরল। ছোট্টো করে বলল, ‘হু!’

অভীক তাহিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
‘আমার মেয়ে যখন বলেছে পড়ায় মনোযোগ দিবে, তখন দিবে। আর বোকো না মেয়েটাকে।’

তাহিয়ার স্বর থেকে রাগমাত্রা কমার বদলে বেড়ে গেল। নতুন উদ্যমে নতুন টপিকে কথা শুরু করল,
‘ বকব না তোমার মেয়েকে! তোমার মেয়ে শুধু রেজাল্টই খারাপ করেনি। সাথে স্কুল থেকে এক সপ্তাহের জন্য বহিষ্কার ও হয়ে এসেছে। এটুকুনি মেয়ে, নিজে নেতৃত্ব দিয়ে না কি আবার দেয়াল টপকে স্কুল পালায়! কত বড়ো সাহস দেখেছো! হেড মিস যখন আমাকে ডেকে এবার বলল, লজ্জায় আমার মাথা কেটে গেছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! একজন লেকচারারের মেয়ে স্কুল পালানোর দোষে বহিষ্কার হয়! কত লজ্জার কথা। ‘

অভীক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। একবার মেয়েকে দেখছে, একবার মেয়ের মাকে দেখছে। মেয়েটা কিভাবে মায়ের স্বভাব রপ্ত করে ফেলল ! এই বয়সেই!

অভীকের বিস্ময়ের মাঝে তাহিয়া স্কেল তাক করে মেয়েকে আবার শাসাল,
‘ এ্যাই মেয়ে, এ্যাই! পড়ালেখার সাথে কিসের শত্রুতা তোর! ক্লাস ফোরে পড়িস সবে, দেয়াল টপকানোর কথা মাথায় আসে কিভাবে! আবার নেতৃত্ব দিয়ে দলবল নিয়ে বেরুস! কত বড় সাহস! তোর চৌদ্দ গুষ্ঠিতে কেউ তো এমন ছিল না। তোমার বাপ মা এমন ছিল? ছিল না। তুই কার মতো হয়েছিস! আমি তো পুরো শিক্ষাজীবনে দেয়াল টপকে স্কুল পালানো তো দূর, স্কুল পালানোর নাম ও শুনিনি। আমার মেয়ে হয়ে তুই এমন কিভাবে হলি? কে শিখাচ্ছে এসব তোকে?’

তাহিয়া বলে গেল একের পর এক। অভীক আবার কেশে উঠল। কাশছে তো কাশছেই, থামছেই না। ওর এই শুকনো কাশির বর্ষণে তাহিয়ার বকাঝকা থেমে গেল আকস্মিক। ভ্রু কুঁচকে তাকাল অভীকের দিকে। অভীক অনবরত কেশে যাচ্ছে। মুখে হাত চেপে কাশছে, হাসছে ও বোধহয়।

তিহা প্রতিটা মেয়ের মতোই বাবার রাজকন্যা। ওর ভালোবাসাটা মা থেকে বাবার জন্য বেশি। মা বকে ওকে, বাবা বকে না। তাই বাবা সবচেয়ে পছন্দনীয় ব্যক্তি, টানটাও বেশি। বাবাকে কাশতে দেখে মায়ের বকার ভয় পালাল ওর মাঝে।
উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল,
‘কী হয়েছে বাবা? তুমি কাশছো কেন?’

অভীক কোনমতে বলল,
‘গলায় কথা আটকেছে। ‘
ছোট্টো তিহা বুঝল না সে কথার মানে। খাবার আটকে গেলে পানি খাওয়াতে হয় জানে সেটা। সে ধারণা থেকে বলল,
‘আমি তোমার জন্য পানি নিয়ে আসছি। পানি খেলে ঠিক হয়ে যাবে।’

দেরি করল না। দৌড়ে কিচেনে চলে গেল। ফিল্টার থেকে পানি নিতে হবে। মেয়ে দৃষ্টির আড়াল হতেই অভীক হাফ ছাড়ল। কাশতে কাশতে বলল,
‘ আমার বোধহয় যক্ষ্মা হয়ে যাবে হিয়া । এবার দয়া করে থামো। ‘

তাহিয়া অজানার ভান করে বলল,
‘যক্ষ্মা কেন হবে? আমার কথার সাথে তোমার কাশির কী সম্পর্ক!’

অভীকের কাশি থামল। মুখ থেকে হাত সরিয়ে চাপা হেসে বলল,
‘ তুমি যা শুনাচ্ছে শুধু কাশি না, পেট থেকে নাড়িভুড়ি ও বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। পড়াবিষয়ক ফাঁকিবাজিতে পিএইচডি ডিগ্রি নেয়া হিয়া আজ বলছে, ফাঁকিবাজি কী জিনিস জানতো না! কী সাংঘাতিক কথা হিয়া! ‘

তাহিয়া থতমত খেল। লোকটা এতবছর পর পুরনো কথা টানছে! কী বদলোক! জব্দ হয়েও দমল না। চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘তুমি মেয়েকে আস্কারা দিচ্ছি। তোমার লাই পেয়ে মেয়ে বখে যাচ্ছে।’

অভীক ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘আস্কারা তো বছর পনেরো আগে ও কাউকে দিয়েছিলাম। সে তো বখে যায়নি। কলেজের লেকচারার হয়ে গেছে। আমার মেয়েও বখে যাবে না।’

তাহিয়া আবারও জব্দ হলো। এই লোক আজ ওকে জব্দ করার নিয়তে মাঠে নেমেছে। তিহার আসার শব্দ শুনা যাচ্ছে। তাহিয়া উঠে দাঁড়াল। স্কেলটা অভীকের দিকে তাক করে হিসহিসিয়ে বলল,
‘মেয়েকে তো তুমি শাসন করবে না। আমাকেই করতে হবে। এখন আমি কিছু বলতে গেলে, বাধা দিবে না। কাশিটাশি থামাও।’

‘তুমি এমন সব কথা বলছো অতীত চোখে ভাসছে। তারপর কাশিগুলো আপনাআপনি এসে যাচ্ছে। হাসি ও পাচ্ছে কত কী ভেবে! কী করব বলো! দয়া করে এমন কাশিদায়িক কথা আর বলো না! এবার সত্যিই যক্ষ্মা হয়ে যাবে। ট্রাস্ট মি, হিয়া।’ অভীক স্বরে অনুরোধ, ঠাট্টা।

তাহিয়ার চোখে ও অতীত ভাসল আকস্মিক। স্মৃতিচারণ শেষে বিজ্ঞলোকের মতো,
‘ মা বাবাদের সন্তানের সামনে নিজের প্রেস্টিজ রক্ষা করে চলতে হয়। যা থেকে ছেলে মেয়েরা শিখতে পারে। সব মানুষ বাবা মা হওয়ার পর নিজের সব অতীত ভুলে যায়, নিজে ভুল পথে চললেও ছেলেমেয়ে ঠিক পথ দেখাতে হয়। এটা পিতামাতাগত নিয়ম। এখন আমি তো আর মেয়েকে বলতে পারিনা, আমি এসব করেছি, তুই ও কর। আমার মা আমাকে শাসন করেছে, আমি আমার মেয়েকে শাসন করব। এটা মা গত অধিকার।’

তিহা এক গ্লাস পানি হাতে এসে পড়েছে। অভীক আবার কেশে উঠল। কাশির মাঝে হাসি ও আছে। তাহিয়া আরও কিছুক্ষণ বকল মেয়েকে। রেগে আগুন হয়ে চলে গেল শোবার ঘরে। হেড মিসের কথা স্মরণে আসতেই রাগ বাড়ছে। তিহা ও মুখ ফুলিয়ে দাদীর ঘরে চলে গেছে। মা-মেয়ে যেতেই শব্দ করে হেসে দিল অভীক। হাসির শব্দ শোনা ভেসে আসল ডাইনিং রুম থেকেও। অভীক ভ্রু কুঁচকে উঠে এলো। ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি বসে আছেন নীলিমা, মাহমুদা। দুজনেই শব্দ করে হাসছে। অভীককে দেখে মাহমুদা বললেন,
‘যেই মেয়ের স্কুল পালানোর অভিযোগ শুনতে প্রতি সপ্তাহে একবার আমাকে প্রিন্সিপালের রুমে দৌড়াতে হতো, প্রতি পরীক্ষার পর লাল কালি দেয়া প্রোগ্রেস কার্ড লজ্জিত হাতে সাইন করতে হতো। সেই মেয়ে কি না বড়ো হয়ে যখন বলে সে কখনো স্কুল পালানোর নাম ও শুনেনি, ফেইল কী জিনিস জানে না! আল্লাহ, আর কত কী শুনব!’

হেসে উঠলেন মাহমুদা। তার হাসিতে যোগ দিলেন নীলিমা। বাদ গেল না অভীক ও। কসরত তার ও কম করতে হয়নি। চোখের সামনের এই মেয়ের ফাঁকিবাজ কাজ দেখেছে কত! অনার্সে উঠেও তো তিন বিষয় ফেইল করেছে। মেয়েটা সব ভুলে গেল! আশ্চর্য!
হাসির পশরা বয়ে গেল ডাইনিং টেবিলে। রেজাউল আহমেদ অবনীর বাসায়। তিনি থাকলে তিনি যোগ দিতেন। চরম বিনোদন মিস করলেন।

মাহমুদা পাশের ফ্ল্যাটে ছেলে, ছেলে বউয়ের সাথে থাকেন। তুহিন আর তুহিনের বউ, দুজনেই ডাক্তার। সারাদিন তারা হাসপাতালে থাকে, মাহমুদা থাকেন এই বাসায়। বান্ধবী আর নাতনির সাথে সময় কাটান।

তুহিন আজও বদলায়নি, সেই আগের মতোই বোনের প্রতি ভালোবাসা আছে। মেয়ে বিয়ে দিলে একটা বাবা যেই দায়িত্ব পালন করেন, তুহিন ছোটো হয়ে সেই সব দায়িত্ব পালন করেছে। টিউশনির টাকা ঢেলেছে বোনের পিছনে।
শুধুমাত্র বোনের কাছেকাছি থাকার জন্যই পাশের ফ্ল্যাট নিয়ে উঠেছে। এখান থেকে হাসপাতাল অনেকদূর। যাওয়া আসার পরিশ্রমটা একটু বেশি হয়ে যায়। তবুও ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে বাসায় আনার পর মা বোনের সাথে হাসি খুশিতে দুটো কথা বললেই যেন সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। বোনকে হাসিখুশি দেখতে ভালো লাগে, শান্তি লাগে।

ভাইয়ের প্রতি তাহিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ও বদলেছে। ভাইকে ডাক্তারি পড়ানোর খরচটা সেই তো বহন করেছে। নিজের আয়ের টাকা ব্যয় করেছে ভাইয়ের পিছনে।

হাসতে হাসতে কাশি এসে গেছে মাহমুদা আর নীলিমার। হাসির পর্ব শেষে নীলিমা ছেলের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
‘বউটা তোর একার, নাতনি আমাদের দুজনের। তুই গিয়ে বউয়ের রাগ সামলা, আমরা আমাদের নাতনি সামলাচ্ছি। আয় মাহমুদা। ‘ উঠে দাঁড়ালেন নীলিমা।

মাহমুদা ও পা বাড়ালেন নীলিমার ঘরে। অভীক বাধা দিল, ‘ তোমরা থাকো, আমি দেখে আসি।’

মেয়েকে সকালে স্কুলে নিয়ে যায় অভীক। তাহিয়া কলেজ থেকে ফেরার সময় নিয়ে আসে। আজ ছুটি থাকা স্ত্রী মেয়ে দুজনকেই নিজে পৌঁছে দিয়েছে। মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় আইসক্রিম নিয়ে এসেছিল অভীক। মেয়েটার পছন্দ ও ওর মায়ের মতো। মায়ের যা পছন্দ মেয়ের ও তাই পছন্দ। একটা আইসক্রিম নিয়ে মেয়ের ঘরের দিকে এগুলো।

তিহা খাটের উপর গোমড়া মুখে বসে আছে। অভীক গিয়ে পাশে বসল। তিহা অন্যপাশ ফিরে বসল। অভীক আবার হাসল, এই কাজটাও ওর মায়ের। অভীক আইসক্রিমটা নাড়িয়ে বলল,
‘কেউ কি আইসক্রিম খাবে?’

তিহা আড়চোখে একবার তাকাল। তারপর আবার ফিরে গেল। অভীক বলল,
‘কেউ যখন খাবে না, তখন আমিই খেয়ে নিই। ‘

আইসক্রিমটা মুখের দিকে এগিয়ে নিল অভীক। তিহা ঢোক গিলল। এক টানে নিয়ে নিল হাতে। চুপচাপ খাওয়া শুরু করল। কোন কথা বলল না। রাগ পড়ে নি এখনো। অভীক মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু খেল। কোমল স্বরে বলল,
‘বাবা তো কিছু বলেনি, তবে বাবার উপর রাগ কেন?’

গলে গেল তিহা। কথা ফুটল মুখে। অভিমানী স্বরে বলল, ‘মা তো বকেছে। ‘

অভীক মেয়েকে কোলে বসাল। বলল,
‘পড়ালেখায় অমনোযোগী হলে মা তো বকবেই। তুমি যদি পড়ালেখায় মনোযোগী হও, তবে মা আর বকবে না।’

তিহা বিরক্তভরে বলল,
‘পড়ালেখা ভালো লাগে না বাবা! ‘

অভীক হাসল। অভীক মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘তিহার জন্য আমার পক্ষ থেকে একটা লোভনীয় অফার আছে।’

তিহার চেহারা থেকে বিরক্তির আভা সরে গেল। বিস্ময় উঁকি দিল, ‘কী অফার বাবা?’

‘তিহা যদি পড়ায় মনোযোগী হয়, স্কুল পালানো ছেড়ে দেয়,পরীক্ষায় টপ টুয়েন্টিতে আসতে পারে, তবে পুরস্কার হিসেবে একটা স্কেইট স্কুটার পাবে। এখন তিহা যদি স্কুটারটা চায়, তবে তাকে পড়ায় মনোযোগ দিতে হবে। তিহা কি দিবে?’ প্রস্তাবটা রাখল আলতো স্বরে।

বেশ কদিন যাবত, তিহা পিংক কালার স্কেইট স্কুটার কিনে দেয়ার বায়না ধরেছে। তাহিয়া শুনেই নিষেধ করেছে। ওর ভয়, মেয়ে পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙবে। তিহা বলেছে, ছাদে চালাবে অল্পকিছুক্ষণ। তাহিয়ার ভয় লাগে। তাই কিনে দেয়নি। অভীককেও বলেছে। অভীক সুযোগ হাতছাড়া করল না।

ছোটো বাচ্চাদের নীতিজ্ঞানে কাজ হয়না,বুঝার বয়স হয়নি যে। তার চেয়ে কোন পুরস্কারের আশা দেখিয়ে কাজটা সহজে করানো যায়। পনেরো বছর আগে ও এক অফারে মাকে বশে আনা গিয়েছে। অভীকের ধারণা মেয়েকেও মনোযোগী করা যাবে।

তিহা অবিশ্বাস্য স্বরে বলল,
‘ স্কেইট স্কুটার! ওয়াও! বাবা সত্যি দিবে!’

‘হ্যাঁ। আমি কাল শপিংমলে দেখে এসেছি। ওটা তুমি তখনই পাবে, যখন তুমি আমার কথা মেনে চলবে। পড়ায় মনোযোগী হবে। স্কুল পালানো ছেড়ে দিবে।’

স্কুটারটা তিহার ভীষণ পছন্দ, এর জন্য সব করতে পারবে। পড়াটা অপছন্দ, তাও কষ্ট করে পড়বে। পাশ করলেই স্কুটার পাবে। ভাবনা চিন্তা শেষে বলল,
‘ ঠিক আছে আমি আজ থেকে পড়ায় মনোযোগী হবো। ‘

থেমে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
‘মা বকে, টিউটর মারে, পড়তে ভালো লাগে না। পড়ায় মন বসে না। কী করব?’

‘আমি যদি পড়াই, আমার কাছে পড়বে? আমি মায়ের মতো বকব না, টিউটরের মতো মারব না। পড়বে?’ অভীক কোমল স্বরে প্রস্তাব রাখল। তিহা উৎফুল্লতার সাথে বলল,
‘তুমি পড়াবে আমায়!’

‘হ্যাঁ পড়াব।’

বাবার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে তিহার। বাবা বকে না, মারে না। রাগ দেখায় না। চমৎকার করে কথা বলেন। বাবার কাছে পড়াই যায়। তিহা আন্দোলিত হয়ে বলল,
‘তাহলে তো কথাই নেই। আমি তোমার কাছেই পড়ব।’

অভীক হেসে বলল,
‘তাহলে আজ থেকেই শুরু হোক আমাদের পাঠদান?’

তিহা মাথা নাড়াল। ওর হাতের আইসক্রিম খাওয়া শেষ। হাতে লেগে গেছে আইসক্রিম। অভীক ওয়াশরুমে নিয়ে হাত ধুয়ে দিল মেয়ের। টাওয়ালে হাত মুছতে মুছতে বলল,
‘ মিস তো মাকে অপমান করেছো তোমার জন্য। এখন মা কষ্ট পেয়েছে, কাঁদছে বসে বসে। এটা কি তুমি ঠিক করেছো?’ অভীকের উদ্দেশ্য, মেয়ের মনে অনুতাপ জাগানো।

তিহা অনুতপ্ত গলায় বলল,
‘না। আমি আর কখনো কষ্ট দিব না। মাকে গিয়ে স্যরি বলি?’

এখন তিহাকে দেখলে আরও ক্ষেপে যাবে। আগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অভীক বলল,
‘স্কুল থেকে এসে ড্রেস ও চেঞ্জ করো নি। এভাবে মা দেখলে আরও রাগ করবে। তুমি চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর মায়ের কাছে যেও ঠিক আছে?’
‘মা তখন স্যরি একসেপ্ট করবে?’
‘হ্যাঁ।’

তিহা চমৎকার হাসল। অভীক বিস্ময় নিয়ে চাইল। মেয়ের স্বভাব চরিত্র সব মায়ের মতো, এমনকি হাসিটা ও। এই যে এখন হাসছে, হৃদয় শীতল হয়ে যাচ্ছে। অভীক ও হাসল। মেয়ের কপালে চুমু খেল।

অভীকের দুই মা এলেন সেইক্ষণে। অভীকে মেয়েকে তাদের কাছে দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল। মেয়ের মন ভালো হয়ে গেছে। এবার মায়ের মন ভালো করার পালা।

সকালে বুয়া এক গাদা কাপড় ধুয়ে ছাদে শুকাতে দিয়েছিল। গ্রীষ্মের কড়া রোদ্দুরে কিছুক্ষণের মাঝেই শুকিয়ে গেছে। বুয়া যাওয়ার আগে কাপড় এনে খাটের উপর স্তুপ করে গেছে। তাহিয়া এলোমেলো কাপড় ভাজ করতে করায় মন দিল। রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। রাগটা জামা কাপড়ের উপর উঠাচ্ছে। কাপড় ভাজ করছে না এলোমেলো করছে বুঝা যাচ্ছে না। দরজায় দাঁড়িয়ে প্রিয়তমার কাজ দেখে হাসল অভীক। দরজা লক করে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল প্রিয়তমার দিকে। তাহিয়া ওর দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। অভীক আকস্মিক পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। আলতো স্বরে গান ধরল,
‘রাগ করো না সুন্দরী গো
রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো।’

তাহিয়া কাজ থামাল। অভীক থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
‘তুমি ছাড়ো। ধরবে না আমায়। তোমার কারণে সব হয়েছে। মেয়েকে আদর করে বাদর বানিয়েছো। এখন অপমাণিত হতে হচ্ছে আমাকে। মিস আমাকে কতগুলো কথা শুনিয়েছে জানো? জানবে না তো। কথা তো তুমি শুনোনি, শুনেছি আমি। আমার কষ্টটা তুমি বুঝবে না।’

অভীক বাধন শক্ত করল,
‘ মেয়ের জন্য শুনিনি, মায়ের মায়ের জন্য তো শুনেছি। তাই তোমার কষ্ট আমার থেকে ভালো কেউ বুঝবে না।’

তাহিয়া আগ্রহী হলো। রাগ দমিয়ে কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘আমার জন্য! কখন!’

‘তোমার কি মনে হয়, লেকচাচারের স্ত্রীর তিন বিষয় রি-টেইক দেয়ার ব্যাপারটা সবাই সহজভাবে নিয়েছে! অফিস কক্ষে শিক্ষকমহলে হাসির রোল পড়েছিল। একবার চিন্তা করো আমার তখন কেমন লেগেছিল? ‘ করুণ স্বর অভীকের। তাহিয়া বিস্মিত চোখে তাকাল। সে এমন কথা জানতো না।

বিস্মিত আর অনুতাপের চোখে তাকাল। বলল,
‘স্যরি!’
অভীক ভ্রু বাঁকাল,
‘এত বছর পর!’

‘ তোমারও এমন রাগ হয়েছিল নিশ্চয়ই! তবে তুমি আমায় কিছু বলোনি কেন?’
হাত থেকে কাপড় ফেলে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল তাহিয়া।

অভীক ধীর গলায় বলল,
‘কারণ সবসময় রাগ প্রকাশ করাটা সমাধান নয়। রেগে গিয়ে আমি তোমাকে কি বকাঝকা করলে তুমি পড়ায় মনোযোগী হতে? হতে না। উলটো হিতে বিপরীত হতো। বকাঝকার চেয়ে সুন্দর কথায় মানুষকে মানানো যায় সহজে। কোমল সংলাপে সমাধান আসে, রাগ প্রকাশে নয়। তাই আমি সম্পর্কটা সহজ হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। সহজ হওয়ার পর সুযোগের, সুযোগ আসতেই বলেছি। ফলাফল ও পেয়েছি। ‘

তাহিয়া বলল,
‘ আমাকে ঠিক করার জন্য তো আমার মা তোমাকে আমার জীবনে এনেছে। আমার মেয়েকে ঠিক করার জন্য তোমার মতো কাউকে কোথায় পাব আমি?’

অভীক হেসে বলল,
‘ কাউকে খোঁজার দরকার নেই। মেয়ের মাকে যে ঠিক করেছে, মেয়েকেও সেই ঠিক করবে। ‘

‘তুমি ঠিক করবে? পারবে মেয়েকে পড়ায় মনোযোগী করতে? স্কুল পালানো বন্ধ করতে?’ ভ্রু নাড়াল তাহিয়া।

অভীক শব্দ করেই হাসল,
‘ তোমার মতো ফাজিলকে যখন ঠিক করতে পেরেছি তখন তোমার মেয়েকেও পারব। নিজের জীবনের কথা একবার ভাব, কতটা ফাজিল ছিলে তুমি! কতটা নাস্তানাবুদ করেছো আমায়। ‘

তাহিয়া ফিরে গেল অতীতে। সেই বুড়ি সেজে অভীকের সামনে দিয়ে পালানো, পড়তে বসে বাহানা খোঁজা। স্মৃতিরা চোখে ভাসতেই মনটা রঙিন হলো, রাগ সরল। হেসে উঠল শব্দ করে। বলল,
‘একটু বেশিই ফাজিল ছিলাম আমি।’

অভীক কৌতুকের সরে বলল,
‘সেই ফাজিলটাও একদিন মা হয়ে মেয়েকে শাসায়, আমি তো জীবনেও ফেইল করিনি, স্কুল পালানোর নাম ও শুনিনি। কী সাংঘাতিক কথা, হিয়া?’

তাহিয়া খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল। বলল, ‘ প্রেস্টিজ ইস্যু। মা না আমি! মা যত খারাপ হোক ছেলেমেয়ের সামনে ভালো সাজতে হয়। ‘

অভীক হাফ ছাড়ল। যাক মন ভালো হয়েছে। সে কোমল স্বরে ডাকল,
‘ হিয়ারানী!’
তাহিয়া পিছন ঘুরল। অভীকের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘বলো ‘
‘তোমাকে সুন্দর লাগছে, সেই বসন্ত দিনের মতো। ‘
তাহিয়া হাসল। বলল,
‘তোমার নজর সুন্দর। তিহার জন্মের পর কতটা ভুড়িয়ে গেছি আমি। সেই খেয়াল আছে?’
‘যেমনই হও, আমার চোখে তুমি শ্রেষ্ঠসুন্দরী।’

একটা মেয়ের জন্য এটা বড়ো প্রাপ্তি! খুশিতে মন রঙিন হলো। মানুষটা বদলায় নি একটুও। আছে সেই আগের মতো ব্যক্তিত্ববান, প্রেমোদ্দীপক। এমন সঙ্গী ক’জনে পায়! তারাই তো পায় যারা ভাগ্যবতী। নিঃসন্দেহে সে ভাগ্যবতী। তাহিয়া হাসল প্রাণবন্ত। চুপটি করে বুকে মাথা রাখল।

রাগের পাল্লা ছেড়ে বেরিয়ে কিছু চমৎকার সময় কাটিয়ে তাহিয়া মেয়ের কাছে গেল। একটু বেশিই বকে ফেলেছে আজ। মাকে দেখেই তিহা দৌড়ে কাছে এলো। অনুতপ্ত হয়ে বলল,
‘স্যরি মা। আর কখনো এমন হবে না। এবারের মতো মাফ করে দাও!’

তাহিয়া হেসে মেয়েকে কোলে তুলে নিল। ক্লাস ফোরে পরে মেয়েটা। এখনো এইটুকুনী। দেখতে ছোটো খাটো একটা পুতুলের মতো লাগে। বাদামী পুতুল,মায়াবী পুতুল। মেয়ের গালে চুমু খেল কয়েকটা। বলল
‘এবার থেকে মনোযোগ দিয়ে পড়বে, ঠিক আছে? ‘
‘ঠিক আছে। ‘

তাহিয়া আবার চুমু খেল মেয়ের গালে। বকাগুলো চুষে নিচ্ছে যেন। ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে অনুতাপে। কোমল স্বরে বলল,
‘চলো মা, তোমাকে তৈরি করিয়ে দিই।’

‘কোথায় যাব আমরা?’
‘ঘুরতে যাব। পার্কে যাব, রাইডে চড়ব। অনেক মজা করব। আজকের দিনটা আমাদের তিহামণীর।’

তিহা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। মায়ের গালে চুমু দিল। গলা জড়িয়ে মাথা রাখল বুকে। পূর্ণতারা এসে ছুঁয়ে দিল তাহিয়াকে। মাতৃত্ব সুন্দর, একটু বেশিই। মা হওয়ার আনন্দ মনটাকে ছুঁয়ে দিতেই একটা চেহারা চোখে ভাসল। তিহার মায়ের মায়ের চেহারা। মেয়েকে কোলে নিয়ে এগুল বসার ঘরের দিকে।

মাহমুদা বসে আছেন ওখানে। তাহিয়াকে বসল মায়ের পাশে। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘মা, তুমি নিজেও জানো না, কতটা চমৎকার একটা উপহার দিয়েছো তুমি আমায়। জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটা দিয়েছো তুমি আমায়। যা আমার জীবন রাঙিয়ে দিয়েছে। ধন্যবাদ মা, অভীকে আমার জীবনে এনে দেয়ার জন্য। ‘

এত বছর পর মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে আনন্দাশ্রু ঝরল মাহমুদার চোখ থেকে। কান্নাহাসিতে মেতে বললেন,
‘মা বাবা জানে সন্তান কিসে ভালো থাকবে। সন্তানের ভালোর জন্য পদক্ষেপ নেয় তারা। সন্তানরাই আবেগে ভাসে বলে ভালোটা বুঝে না তৎক্ষনাৎ। পরে ঠিকই বুঝে। সুখে থাক সবসময়।’

দুই মা, মেয়েকে নিয়ে বের হলো দম্পতি । লাঞ্চ বাইরে করে বিকেলটা ঘুরাঘুরি করল। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হলো। সিড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠার সময় তাহিয়ার মাথায় একটা পরিকল্পনা এলো। বাসার দরজায় দাঁড়াল। শ্বাশুড়ির কানের গিয়ে বলল,
‘মা, তুমি কি দু’ঘন্টা তোমার নাতনিকে দেখে রাখতে পারবে?’

নীলিমা প্রশ্ন করলেন, ‘কোথাও বেরুবি তুই?’
‘আমি আর অভী বেরুব একটু।’ লাজুক স্বরে বলল তাহিয়া।

নীলিমা হাসলেন। আন্দাজ করলেন কিছু। আর প্রশ্ন করা সাঝে না। অনুমতি দিলেন। ছেলে ছেলে বউকে দরজায় রেখে নাতনিকে নিয়ে ভেতরে গেলেন। অভীক ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। তাহিয়া হাত ধরে ফেলল,
‘আরে! যাচ্ছো কোথায়?’
‘বাসায় যাব না!’ ভ্রু কুঁচকাল অভীক।

তাহিয়া মাথা নাড়ল,
‘নাহ, এখন বাসায় যাওয়া হবে না।’
‘তবে কোথায় যাওয়া হবে?’
‘বাইরে যাওয়া হবে।’
‘ আপনার পরিকল্পনাটা কী মিসেস?’ ভ্রু বাঁকাল অভীক।

তাহিয়া হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। প্রথম দিকের সেই কিশোরী স্বভাব হানা দিল ওর মাঝে। আবদার করে বসল,
‘চাকরি, সংসার, বাচ্চা এসব সামলাতে গিয়ে আমরা নিজেদের সময় দিতে ভুলেই গেছি। কতদিন, কতমাস, কত বছর হলো রাতের শহরে রিক্সা নিয়ে বের হইনি, পড়ন্ত বিকেলে ফুটপাত ধরে হাতে হাত রেখে হাটিনি। সুন্দর সময় সব ফেলে এসেছি। আমি না মিস করি অনেক। চলো না আজ সেই বসন্ত সন্ধ্যার মতো রিক্সায় রাতের শহর দেখি? আবার সেই প্রেমিকযুগল হয়ে যাই?’

অভীক ভ্রু বাঁকিয়ে চাইল তাহিয়ার পানে। চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। আকস্মিক শব্দ করে হেসে উঠল। স্মৃতিরা চোখে ভাসছে। আনন্দ ছুঁয়ে যাচ্ছে মন, লাভটাও এসে হানা দিচ্ছে। এটা লোভনীয় অফার। ফেলে দেয়ার নয়, লুফে নেয়ার। সে ও লুফে নিল আলতো স্বরে। হাত বাড়াল প্রিয়তমার দিকে,
‘চলো, যাওয়া যাক?’

তাহিয়া হাতে হাত রাখল প্রসন্ন মুখে। দুজন বেরুলো। তাহিয়ার পরনে কালো জামদানী, অভীকের পরনে নেবু ব্লু টি-শার্ট। হাতে হাত রেখে হাটল ফুটপাত ধরে।
অভীক আইসক্রিম পার্লার থেকে একটা আইসক্রিম কিনল। তাহিয়ার দিকে এগিয়ে দিল।

স্মৃতিদের পুনরাবৃত্তি দেখে তাহিয়ার হাসি থামছে না আজ। এত আনন্দ হচ্ছে। ফিরে যাচ্ছে সেই বসন্ত সন্ধ্যায়। হারিয়ে যাচ্ছে।

অভীক একটা রিক্সা থামাল, উঠে বসল। প্রিয়তমার হাত ধরে অনন্যচিত্তে উঠাল। আজও সেই চাঁদনী রাত। রূপালী আলো গায়ে মাখিয়ে পাশাপাশি বসেছে দম্পতি। হাতে আইসক্রিম, ঠোঁটে হাসি, চেহারায় খুশি। অভীক তাহিয়ার একটা হাতের ভাজে আঙুল গুজাল। তাহিয়া হেসে মাথা রাখল প্রিয়তমের কাধে। বলল,

‘ একটা ব্যাপার খেয়াল করেছো?’
‘কী?’
‘বিয়ের পনেরো বছর হয়ে গেল। প্রেম হলো, সংসার হলো, একটা বাচ্চা ও হলো। অথচ এখনো আমরা কেউ কেউ কাউকে ‘ভালোবাসি’ বলিনি।’

অভীক হেসে বলল,
‘ গল্প, সিনেমা ছাড়া ‘ভালোবাসি’ শব্দের উচ্চারণের অস্তিত্ব নেই বাস্তবে। যা আছে তা হলো অনুভব, কাজে প্রমাণ। আমরা ভালোবাসি বলায় নয়, অনুভবে বিশ্বাসী। তাই বলা হয়নি। আমার মনে হয়না বলার প্রয়োজন হবে কখনো। তোমার মনে হয়?’

‘আমার ও মনে হয়না। তবে আমার মনে হয়, ‘ভালোবাসি’ না বললে ও অন্য একটা কথা বলা উচিত।’
‘ কী কথা?’ আগ্রহী সুরে জিজ্ঞেস করল অভীক।
তাহিয়া হেসে বলল,
‘আমার তোমাকে জানানো উচিত যে, আমি তোমার সাথে সুখে আছি।’

অভীকের হৃদয়ে প্রশান্তি আভা বয়ে গেল। চেহারায় আনন্দের ঝলকানি দিল। বিয়ের এক যুগ পরে একটা পুরুষের জন্য এই কথা শোনাটা বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার। ‘ভালোবাসা’ বলা নয়, সুখে রাখাটা আসল ভালোবাসা।

রিক্সা ঝাকি দিচ্ছে। অভীক একটা হাত তাহিয়ার পিছনে নিয়ে বাহুতে রাখল। প্রিয়তমা পড়ে না যাওয়ার তীক্ষ্ম ইঙ্গিত ছিল তাতে। চাঁদের রূপালী আলোতে হাতে হাত, চোখে চোখ রেখে সেও হেসে বলল,
‘আমি ও সুখে আছি হিয়ারানীর সাথে। সুখটা ভীষণ। ‘

সমাপ্ত…

গল্পের অন্তিমপাতায় চলে এলাম। প্রতিটা গল্পের ‘সমাপ্তি’ শব্দটা লিখতে গিয়ে হাত আমার হাত কাঁপে। গল্প লিখে শেষ করে রি চেইক দেয়ার আগে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকি। এমন একটা অনুভূতি হয় যে, লিখলেই কিছু প্রিয়জনের সাথে আমার বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। গল্পের দীর্ঘ সফরে কেমন যেন মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম এই গল্পের প্রতি, প্রতিটা চরিত্রের প্রতি। এরা সবাই আমার আপন ভীষণ আপন। প্রতিটা চরিত্রের ভেতর এত বেশি প্রবেশ করে ফেলেছিলাম, যে যাকে তাকে গল্পের চরিত্র ধরেই ডেকে উঠেছিলাম। শেষ পর্ব পোস্ট করে খারাপ লাগছে, শূন্যতা অনুভব করছি।

#গল্পকথা:
গল্প তো শেষ, এবার একটা চমৎকার কথা বলি। আপনারা কি জানেন? আপনাদের পছন্দনীয় ‘অভীক’ চরিত্রের অস্তিত্ব বাস্তবিকে আছে। এই যে হলদেটে মানব ও আছে বাস্তবে, চমৎকার ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষটাও আছে। বাস্তবিকের দায়িত্ববান অভীকের ব্যক্তিত্ব গল্পের চেয়ে হাজার গুনে চমৎকার। আমার মনে হয়, আমি গল্পে সেভাবে ফুটে উঠাতে পারিনি। গল্পে বাস্তবের একাংশ ও আসে নি। তার সুন্দর মন ফুটে উঠেনি পুরোপুরিভাব। হয়তো ফুটে উঠানো সম্ভব ও হবে না আমার পক্ষে। একজন সঙ্গী হিসেবে তার তুলনা নেই। তিনি তিনিই।

শুধু ‘অভীক’ চরিত্র নয়, গল্পের প্রতিটা চরিত্রের বাস বাস্তবিকে আছেন। ‘তাহিয়া’র মতো আবেগী, অল্পতেই কাঁপা-কাঁপি ঘামাঘামি হয়ে যাওয়া পাগলাটে একটা মেয়ে আমার বড্ড পরিচিত।
বলা বাহুল্য, আমি নই তাহিয়ার মত।
মাহমুদার মতো মা দেখেছি হাজার শত। নীলিমার মতো শ্বাশুড়ি ও দেখেছি। রেজাউল আহমেদের মতো শ্বশুর আর অবনীর মতো ননাশ ও দেখেছি অনেক। অয়নের চরিত্রটা ‘আরহাম’কে ঘিরে তৈরি। আর তুহিনের চরিত্রটা আমার টুইনকে ভেবে লিখেছি। মীরার মতো বান্ধবী তো সব সার্কেলে থাকে। গল্পের প্রতিটা চরিত্রের বাস ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন ভিন্ন জীবন কাহিনি নিয়ে। তবে স্বভাবটা একই। তাদের একের সাথে অন্যের জীবনের যোগসূত্র নেই, দেখাও হয়নি হয়তো। আমিই জোড়া করেছি। স্বভাব ছাড়া গল্পের জীবন কাহিনি মিল নেই।

গল্পটা আমি আমার মতো সাজিয়েছি, কিছু জায়গায় বাস্তবতা ঢেলে দিয়েছি, কিছু জায়গায় প্রেম। আমার পরিচিত একজনের বিয়ে দেখেই প্লটটা মাথায় এসেছিল, সেই ভাবনা থেকেই লেখা। গল্পটাকে বাস্তবে মিলিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না।

#লেখক কথা:

বিয়ের পূর্বের প্রেমের কথা সবাই জানে, বিয়ের পরের প্রেমের কথা ক’জন জানে? বিয়ের পরেও প্রেম হয়, হালাল প্রেম। এই প্রেম শিখানোর উদ্দেশ্য লেখা হয়েছে গল্পটা। এই প্রেম হয়, অনেক হয়েছে। শত উদাহরণ আছে আমার কাছে। আমার গল্পে প্রায় সব কিছুই বাস্তবতা থেকে নেয়া। কিছু আমি দেখেছি, কিছু আমি অনুভব করেছি। ‘বাস্তবে এমন হয়?’ এই প্রশ্নটা অনেকেই করেছেন। আমার উত্তর হলো, বাস্তবে এমন হয়। বাস্তবতা অনেক বিচিত্র, আপনাদের অদেখা অনেক কিছু আছে। যা আমার পরিচিত, আমার দেখা। সেই বিষয় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গল্পে।

বিঃদ্রঃ পরীক্ষার কারণে গল্পটা দ্রুত শেষ করেছি। লেখালিখির কারণে পড়া হচ্ছেনা। যদিও কাহিনি এতটুকুই ছিল। তবুও অনেক অনুরোধ করেছেন ওদের সংসার দেখানোর। তাদের অনুরোধের দিকে দৃষ্টি রেখে কথা দিচ্ছি, সময় পেলে বিশেষ পর্ব দিব। ওদের বিয়ে, সংসার খুনসুটিতে ঘুরিয়ে আনব।

ধন্যবাদ।