প্রেমোবর্ষণ পর্ব-০২

0
178

#প্রেমোবর্ষণ

২.
‘আজই গোছাচ্ছিস সব?’ পরশের মা আমিনা ছেলের ঘরে ঢুকেই প্রশ্নটা করলেন।

‘হু’ পরশের ছোট্ট জবাব।

-এত তাড়া কিসের?

-ঢাকা যেতে হবে আম্মু।

-কলির কাছে?

ভি নেক ফুল স্লিভ কালো টি শার্টটা ভাজ করতে করতে মায়ের দিকে তাকালো পরশ। লুকোচুরির দিন শেষ হয়ে গেছে গত সপ্তাহেই। বাড়িতে এখন সবার জানা পরশের মন মস্তিষ্কের সকল কারসাজি। এদিকে বিয়ে ভাঙার দায়ে ত্রয়ীর বাবা ফোন করে রোজই একদফা ধমকি দেন মামলা করবেন বলে। পরশের সেদিকে খেয়াল নেই সে নিজের মত নিজের একটি মাস পরিকল্পিতভাবে চালিয়ে যাওয়ায় ব্যস্ত।

পরশের মা এক গ্লাস দুধ হাতে ছেলের ঘরে ঢুকেছিলেন ছেলের কথা শুনে হাতের গ্লাস বেড সাইড টেবিলে রেখে ঘর ছাড়লেন। ছন্নছাড়া আচরণে পরশকে বড্ড অবুঝ লাগছে এখন আমিনার। পরিবারে যে তান্ডব শুরু হয়েছে তা যে খুব দ্রুত থামবে না তা বুঝতেই তিনি আগের চেয়েও নিরব হয়ে গেছেন। এ পরিবারে এমনিতেও তিনি এক জড় বস্তুরুপেই আছেন।

পরশের গন্তব্য জাপান বাড়ির সকলে জানে নেদারল্যান্ড। এত বড় মিথ্যেটা পরশ ইচ্ছে করেই বলেছে৷ ত্রয়ীর সাথে এনগেজমেন্টটা ছিল একটা ফেক ডিল৷ ত্রয়ী প্রেগন্যান্ট কিন্তু তার পরিবার সে কথা জানতো না। ত্রয়ীর প্রেমিক প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার ত্রয়ীও হবু ডাক্তার অথচ এরা দুজনই মানুষ নামের নিকৃষ্ট জীব। একজন প্রেমিককে বিয়ের প্রেশার দিতে জবরদস্তি দৈহিক সম্পর্ক করল ফলস্বরূপ নিজের ভেতর নতুন সত্তার আগমন। কিন্তু অদৃষ্ট কখনো মানুষ নিজে ঠিক করতে পারে না। তারা শুধুই কর্মফল ভোগ করে৷ ত্রয়ীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে৷ সে গর্ভধারণ করেছে সে কথা জানতেই প্রেমিকের মন ঘুরে গেছে। এদিকে ঘটকের মাধ্যমে পরশের বায়ো পৌছেছে তার বাড়ি। প্রথম সাক্ষাতেই পরশ ত্রয়ীকে বিয়ে করবে জানিয়েছিল। তাতে কি? ঘটনা গড়িয়েছে রঙিন পর্দার সিনেমার খুব সস্তা কাহিনির মত। ত্রয়ীও মুখের ওপর বলেছিল সেও পরশকে বিয়ে করবে না৷ এক কথা, দু কথায় দুজনে খোলাসা করেছিল ভেতরকার কটুসত্য। বন্ধুর মত একে অপরের সহযোগিতায় তারা এগিয়ে এসেছে। পরশ পিএইচডির প্রসেসিং মাথায় রেখেই ত্রয়ীর সাথে বাগদান করেছে সেই সাথে অপেক্ষা ছিল কলির পক্ষ থেকে কোন প্রকার সংকেত। কিন্তু না তার ভাবনা ভেস্তে গেল কলির নির্লিপ্ততায়। ত্রয়ীর অবশ্য অসুবিধা তেমন নেই৷ তার পরিবার ডাক্তার সাহেবকে কখনোই মানবে না তা সে জানতো আর ডাক্তার সাহেব নিজেও না মানছে নিজ সন্তানকে৷ বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে ত্রয়ী এখন পরশকেই ফাঁসিয়ে দিয়েছে। পরশ দেশ ছাড়ার আগেই সে নিজের পরিবারে নাটক করে বাচ্চার খবর চাউর করল৷ পরশ সেদিকে পাত্তা দিচ্ছে না আপাতত। তার প্রথম কাজ ঢাকায় গিয়ে কলির সাথে সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি করা। বুক ভর্তি হতাশা আর মস্তিষ্ক ভর্তি চিন্তা নিয়ে দেশ ছাড়ার কোনো মানেই হয় না। ওইটুকুনি পুচকো মেয়ে ভালো বাসাবাসির নামে তাকে নাকাল করবে নীরব থেকে এটা সহ্য করা যায় না। যাওয়ার আগে হয় বিয়ে হবে নয় এনগেজমেন্ট। তারপরই মনে পড়লো এনগেজমেন্ট এর ভরসা নেই হবে তো বিয়েই।

‘ভাই ফোন কোথায় তোমার?’ পিয়াল ব্যস্ত পায়ে পরশের ঘরে ঢুকলো। হাতে তার রাজশাহী টু ঢাকা বাস টিকিট।

‘নেই।’

‘নেই মানে কি আমি কতবার কল দিলাম।’

‘নেই মানে নেই। আজাইরা কথা বাদ দিয়ে বল কাজ করছিস?’

‘এই নাও টিকেট কিন্তু…’

‘কিন্তু কি?’

‘এসি বাসের পাইনি এজন্যই কল দিয়েছিলাম।’

‘যা আছে চলবে।’

পিয়াল ভাইয়ের হাতে টিকিট দিয়ে ঘর ছাড়লো। পরশ শেষ বারের মত কাগজপত্র, লাগেজ সব চেক করে বের হলো ঘর থেকে। টাকা পয়সা ক্যাশ না থাকলে কার্ড আছে সাথে তারওপর পিয়াল আছে সাহায্য করতে। বাবা বাড়ি নেই এই সুযোগ হাঙ্গামা ছাড়াই বেরিয়ে পড়ার। মনে করে ভাঙা ফোন থেকে সিম কার্ডও নিয়ে নিলো পরশ। আমিনা চুপচাপ বসেছিলেন সোফায়। তিনি বরাবরই শান্ত আর অন্তর্মুখী মানুষ। জীবন থেকে পাওয়া কিছু তিক্ত স্মৃতি রোমন্থন করেই কাটান দিনের অর্ধেকটা সময়। এ বাড়িতে তিনি কাউকে খুব একটা কিছু বলেন না। এই যে একমাত্র কন্যা পিয়ার বিয়ের দিন বড় পুত্র পরশের কারণে বিশেষ কিছু ঝামেলা সৃষ্টি হলো, ত্রয়ীর বাবা হুমকি ধমকি দিলেন, পরশের মেজো চাচা ক্ষুব্ধ হয়ে পরিবার নিয়ে বিদেশে ফিরে গেলেন তাতেও একটি রা করলেন না পরশের মা। পরশ তার বাবাকে ভালোবাসে না একদমই তবুও অসম্মানও করতে চায় না। কিন্তু এবার সময় বদলেছে, বদলে গেছে পাশার দান। ছেলের কাছেই এবার পারভেজ রহমানকে হারতে হবে। মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে পরশ রওনা হলো ঢাকার পথে।

__________

‘তোর ফোন কোথায় কলি?’

‘চার্জে।’

‘আন্টি কল করেছেন তোর সাথে কথা বলতে চান।’

‘পরে কল দিব।’

‘কি হয়েছে তোর বলতো? সেই যে মুখ ফুলিয়ে বসে আছিস সন্ধ্যে থেকে!’

‘কিছু না৷ তুই এখন যা আমি ঘুমাব’ কথাটা বলেই কলি নিজের বিছানায় কাৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। বাইরে তখন ছিঁচকাদুনে কান্নার মত বৃষ্টি ঝরছে। এ মাস জুড়ে বোধহয় এমনই কাঁদবে আকাশ কখনো মন খুলে কখনোবা জিরিয়ে জিরিয়ে। কলিরও কাঁদতে ইচ্ছে করে আকাশের মত কিন্তু তার বড় ভয় হয় কান্না দেখাতে। পাছে লোক কান্নার কারণ খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে হন্যে হয়ে। সে কাঁদলো না মুখ ফিরিয়ে চোখ বুজলো। কলির বান্ধবী আনিকা থাকে দোতলার শেষ কক্ষে। দু বান্ধবী আলাদা সময়ে হোস্টেলে উঠেছিল তাতে এক কক্ষে থাকার সৌভাগ্য হয়নি। তবুও সময়ে অসময়ে কলির মা আনিকাকেই জ্বালিয়ে মারেন মেয়ের খোঁজে। কলি এখন আর মুখ খুলবে না বুঝতে পেরেই আনিকা ফিরে গেল নিজের কক্ষে। মুড ঠিক হলে আপনাতেই বলবে মন খারাপের কারণ তাই আর জোরাজুরি না করাই উত্তম এমনটাই ভাবলো আনিকা।

হাইওয়েতে বাস চলছে বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে। রাজশাহীর পথে যখন তুমুল বর্ষণ ঢাকার রাজপথ তখন বৃষ্টিহীন শীতল হাওয়ায় মত্ত। পরশের দু চোখ জুড়ে অপেক্ষা গন্তব্যে পৌছানোর অপরদিকে কলির দুচোখের আঁধার নেমেছে নিদ্রায় ডুবে। দু গালে চিক চিক করছে তখনো নোনাজলের ধারা। ফোনের চার্জা পূর্ণ হলেও তা চালু করার ইচ্ছেটা হয়নি বলেই বন্ধ রেখে ঘুমিয়েছে সে। পরশও ভাঙা ফোন বাড়ি ফেলে আসায় আপাতত সংযোগহীন আপন মানুষগুলোর থেকে। হুট করেই বাড়ি ছাড়লো, ঢাকা যাচ্ছে তারওপর ফোন বন্ধ। উপায়ন্তর না পেয়েই পারভেজ রহমান ফোন করেছিলেন কলির মাকে। ভাইয়ের কাছে ভাতিজার সংবাদ পেয়েই তিনি কলিকে ফোন করেছিলেন কথা বলতে। মেয়ের সাথে কথা না হলেও আনিকার মাধ্যমে জানতে পারলেন মেয়ে হোস্টেলেই আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার পূর্বেই কলির বোন ভয় ঢুকিয়ে দিল, ‘আম্মা যদি পরশ ভাই সকালেই কলিকে নিয়ে পালিয়ে যায়!’

-রূবাইবা মেহউইশ