প্রেমোবর্ষণ পর্ব-০৪

0
159

#প্রেমোবর্ষণ

৪.
উত্তরমুখী একটা শীতল হাওয়া চোখে- মুখে বারি খেল। আলগোছে করা হাত খোঁপাটা বাতাসের ঝাপটায় মুহুর্তেই খুলে গেছে কলির। ছাদের ওপর মেঘাচ্ছন্ন আকাশের সুরমারঙা গৌধূলি বিষন্নতায় মুড়িয়ে দিল মেয়েটাকে। এই বাতাসে ভেসে এলো পাকা কাঁঠালের ঘ্রাণ। এমন দিনে কাঁঠালের ঘ্রাণ বিরক্তির উদ্রেক ঘটিয়েছে তার। কাঁঠাল কাঁঠাল ঘ্রাণ কেবল জৈষ্ঠের প্রখর রোদ্দুরে দুপুরেই মিঠে লাগে। কিন্তু এখন… কলি আরও কিছু ভাবার আগেই মা এলো একবাটি কাঁঠাল হাতে। পেছনে পেছনে হেলতে দুলতে এলো বড় চাচী। বুঝতে বাকি নেই এখন কোন বিষয়ে জ্ঞান প্রদান কার্যক্রম চলবে। লম্বা শ্বাস টেনে প্রস্তুতি নিয়ে নিলো সে।

‘এই নে কলি আশফাক বড় একটা কাঁঠাল এনেছে খেয়ে দ্যাখ খুব স্বাদ।’

হাসি হাসি মুখে মা বাটিটা বাড়িয়ে দিল কলির দিকে। মেজো চাচার বড় ছেলে আশফাক ভাই কাঁঠাল এনেছেন। বাড়িতে এই একমাত্র ভাই যিনি দুনিয়ার সকল প্রকার খাবারের খোঁজ জানলেও বাড়ির আর কোন খোঁজ তিনি রাখেন না। কিন্তু এই মুহূর্তে কাঁঠাল সংক্রান্ত আলাপ খুব একটা হজম হচ্ছে না তার। মায়ের সাথে সাথে চাচীও বলছেন, কাঁঠালের কোয়া বেশ শক্তরে কলি। তুই তো এমনই পছন্দ করিস। তুই হয়েছিস একদম তোর চাচার মত। তোর চাচাও এমনই কাঁঠাল পছন্দ করে…’

‘কিছু কি বলবে তোমরা?’ সরাসরি প্রশ্ন করলো কলি।

‘আকাশটা মেঘলা আজ তো বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে । তোর চাচা মেহমান আসবে বলেছিল এক কাজ করি কাল আসতে বলি।’

চাচী কথাটা বলেই কলির মাকে বলল, তুই কি বলিসরে কেয়ার মা?

‘কিসের মেহমান? তোমরা কি স্পষ্ট করে কিছু বলবে?’

এবার কলির মা নিজেই মুখ খুললেন, ‘তোর বড় চাচার পরিচিত ভাল পাত্র আছে। আজকে আসতে বলতে চাইছেন।’

‘তোমরা কি আমার বিয়ে নিয়ে ভাবছ এখন?’

‘তো আর কার বিয়ে নিয়ে ভাবব? বড় হয়েছিস বাড়িতে বিয়ের যোগ্য এখন তুই আছিস।’ চাচী কথাটা শেষ করতেই কলি বলে উঠল, আরিফ ভাই, আশফাক ভাই নাঈম ভাই তিনজনই ত্রিশের আগে পরে আছেন৷ সিরিয়াল মেইনটেইন করে তাদের বিয়ে দাও চাচী আমার এখনো পড়াশোনা অনেকদূর বাকি।’

কলির কথা মা,চাচী কারোি মনপুত হলো না। চাচী তার নিজের বক্তব্য রাখলেন, ‘পাত্র প্রফেসর তোর অত চিন্তার কারণ নাই। ছেলে নিজেই তোকে শিক্ষিত করাবে। কোন ঝামেলা করিস না পরশ নাকি বাড়ি ছাড়ছে তোর জন্যই কিন্তু তোর মামা মানুষ বেশি ভাল না তাই পরশকে নিয়া ভাবনা আনিস না মনে। এই কলির মা চল আয়োজন শুরু করি আজই আসুক পাত্র গিয়ে বলি তোর ভাইজানরে।’

কলির কাছে আর কোন জবাব শোনার অপেক্ষা না করে বড় চাচী আগের মতোই হেলতে দুলতে চলে গেলেন সিঁড়ির দিকে। অগ্যতা কলির মাও জায়ের পেছনে গেলেন। মেয়ের মন নিয়ে কিছু ভাবতে গেলেই বিপদ। এদিকে সকাল থেকে ভাতিজাটার জন্যও খারাপ লাগছে। সাধাসিধা মানুষ তিনি ঝামেলার আগে পরে থাকতে চান না কিন্তু পরশ তো তার রক্তই তার আপন ভাইপো বলে কথা৷ তিনি লুকিয়ে দু বার ভাবিকে কল দিয়েছেন ভাতিজার খোঁজ জানতে। কিন্তু কোথায় গেল পরশ!
……….

বিকেলে যতোটা মেঘাচ্ছন্ন ছিল অম্বরবক্ষ সন্ধ্যের পর ততোটাই পরিষ্কার। চাঁদ না থাকলেও নক্ষত্রের দেখা মিলল। বড় চাচীর কথা সত্যি হলো সন্ধ্যের পরই চারজন মেহমান এসে হাজির হলো কলিদের ফ্ল্যাটে। পাত্র এসেছে সঙ্গে এসেছে তার ভাই, ভাবী আর ছোট বোন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাপ-চাচার সম্মান বজায় রাখতে কলিও হালকা সাজ, পোশাকে বসার ঘরে হাজির হলো। হাতে গুণে সাত কি আট মিনিট পরই কলিং বেল বাজল। বসার ঘর বরাবরই প্রধান দরজা হওয়ায় কলির মা ইতস্তত করছিলেন দরজা খুলতে যেতে। তা বুঝতে পেরে মেজো চাচী গেলেন। বাড়ির সকল আয়োজনে মস, চাচীরা সবসময়ই একজোট হয়ে কাজ করেন সেই সুবাদেই কলির চাচীরা দুজনই উপস্থিত তাদের ফ্ল্যাটে। মেজো চাচী দরজা খুলতেই বসার ঘরের সকলের দৃষ্টি দরজায় নিবদ্ধ হলো।

‘এ কি তুমি এখানে?’

মেজো চাচীর আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর। ততক্ষণে কলির চোখ জোড়া বিষ্ময়ে বড় হয়ে গেছে।

‘হ্যাঁ চাচী সকালেই এসেছি ঢাকায়। ফুপি কোথায় চাচী আর আপনি কেমন আছেন ?’ পরশ কথাটা বলেই সোফার দিকে তাকালো। উপস্থিত মেহমানদের দেখেও যেন দেখলো না এমন ভাব করেই সে কলিকে ডাকল, ‘কিরে কলি এমন সং সেজে বসে আছিস কেন? ফুপি কই রে আর তুই ফোন তুলছিস না কেন তোর কথাতেই তো ফোন কিনে নিজের ফোন থেকে কল দিলাম।’

পরশের এমন, যে খুশি থাকুক ঘরে আই ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে ঘরের প্রতিটি মানুষ অবাক৷ তবে কলি বিষ্ময় ভাব কাটিয়ে এবার রাগে লাল হলো। বিড়বিড় করে বলল, অসভ্যতা করার জন্য এখন বাড়িতেও এসে গেছে।

কলির মায়ের কানে ভাতিজার কণ্ঠস্বর পৌঁছুতেই তিনি আঁতকে উঠে বড় জায়ের হাত ধরে বললেন, সর্বনাশ!

সর্বনাশটা আসলে কার চিন্তা করে বলেছেন তিনি নিজেও জানেন না। বড় চাচী তখনো খেয়াল করেননি পরশ ভাইয়ের গলা।

‘কিসের সর্বনাশ?’

‘ভাবী পরশের গলা বসার ঘরে। ও ঘরে তো পাত্রও বসে আছে।’

এবার মায়ের সাথে চাচীরও বুক ধড়ফড় করছে। ছেলেটা এখনই কেন বাড়ি এলো!

‘আরে আপনারা কারা?’ পরশ ভাইয়ের প্রশ্ন মেহমানদের উদ্দেশ্যে।

মেজো চাচী বললেন, পরশ এনারা মেহমান কলিকে দেখতে এসেছেন।

‘কি বলেন চাচী কলির না বিয়ে ঠিক আবার কিসের পাত্র আবার কিসের দেখাদেখি? ‘

……..

পরশের বাড়ি ছাড়ার আজ তৃতীয় দিন। পারভেজ রহমান ছেলের ওপর রাগ ঝাড়তে পারছেন না কোন ভাবেই। ধরা ছোয়ার বাইরে গিয়ে ঘাপটি মেরেছে পরশটা। এদিকে ত্রয়ীর বাবা মামলা দিবেন বলে হুমকি দিয়েছেন। তারওপর গতকাল বোনের ভাসুর মানে কলির চাচা ফোন করে যা নয় তাই বলে অপমান করলেন। পরশ নাকি কলির বিয়ে ভেঙে এসেছে। কি হচ্ছে এসব! এদিকে পরশটা টাকি মাছের মত পিছলে পিছলে যাচ্ছে বারবার। পরশু বাসস্ট্যান্ডে একজন দেখলো তাকে তখনই খবর দিলো কিন্তু কিছুতেই ছেলেকে ধরা গেল না। কাল ঢাকার একজন গুপ্তচর লাগিয়ে খোঁজ তো পেলেন কিন্তু ধরার আগেই ছেলে হাওয়া। এত বড় ছেলের সাথে এ বয়সে কি লুকোচুরি খেলতে হবে! কথাটা ভাবতেই মনে পড়লো পরশের মায়ের কথা। পরশ মা ভক্ত ছেলে নিশ্চয়ই কোন না কোন ভাবে মায়ের সাথে যোগাযোগ করবেই। এই সুযোগ…..

-রূবাইবা মেহউইশ