#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৪৫♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
নিজের ঘাড়ে ভেজা অনুভব করতেই চমকে উঠলাম আমি। উনাকে ধরে সোজা করে দাঁড় করাতেই নিজের বা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের কোণে জমা জলগুলো মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন উনি!
আমি অবাক হয়ে পলকহীন চোখে দেখছি উনাকে। এই মানুষটার চোখেও জল আসতে পারে? আদৌ কি তা সম্ভব? এমন অসাধ্য সাধন হলো কি করে?
কিন্তু উনি কি জানেন উনার এই চোখের জলগুলো আমার ভেতরটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে, ঝড়াচ্ছে অঝোরে রক্ত!
.
আমি নীবিড় ভাইয়ার পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। উনি আমায় বাধা দিলেন না বরং অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছেন আমি হঠাৎ উনার পায়ের ওপর পা রেখে উঠলাম কেনো!
আমি মেয়ে হিসেবে যেহেতু যথেষ্ট লম্বা, উনার কান পর্যন্ত পৌঁছোই আমি। তাই সহজেই উনার পায়ের ওপর ভর করে উঠায় অনেকটাই মুখোমুখি হয়ে পড়লাম।
.
আমি কিছুক্ষণ উনার ঘন পল্লব বিশিষ্ট চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই সেই চোখে ঠোঁট ছোঁয়ালাম।
আমি হয়তো পড়ে যাবো আশংকা করে উনি দুহাতে কোমড় জড়িয়ে ধরলেন আমার।
আমি নির্দ্বিধায় উনার দু চোখেই আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলাম।
.
উনি মৃদু হেসে আমায় ছেড়ে দিতেই চট করে নেমে পড়লাম উনার পা থেকে! এতোক্ষণ ছিলাম, নিশ্চয়ই ব্যথা পাচ্ছিলেন।
উনার ডান হাত নিজের হাতে মুঠোয় নিয়ে ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
.
—- আপনার চোখে পানি কেনো ভাইয়া? আপনি কি জানেন আপনার চোখে পানি দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো কেউ যেনো ইচ্ছেমতো নির্মমভাবে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করে চলেছে আমার হৃদপিন্ডে। কেনো কাঁদছিলেন বলুন?
.
উনি হা করে আমার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছেন। হয়তো ভাবতেই পারেন নি আমি এমন কিছু করবো। পর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে আকাশের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসলেন উনি। আমিও তৎক্ষণাৎ উনার পাশেই রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লাম উত্তরের আশায়।
উনি হাল্কা হেসে একবার আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবারও আকাশের পানে চেয়ে বলে উঠলেন,
.
—- তুমি কি ওখানে কাউকে দেখতে পাচ্ছো অনন্যা?
.
উনার প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা নেই আমার তাই ফ্যালফ্যাল চোখে আবারও একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকালাম উনার দিকে। উনি আবারও বলতে শুরু করলেন,
—- ওখানে আমার আম্মু থাকে, জানো?
.
উনার মায়ের কথা শুনে নিমিষেই মুখটা মলিন হয়ে এলো আমার। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমিও এবার তাকালাম উনার দেখানো আকাশের থালার ন্যয় চাঁদের সব থেকে নিকটে জ্বলজ্বল করতে থাকা ঐ ছোট্ট তারা টায়! যেটা পৃথিবী থেকে দেখতে পিঁপড়ের মতো ছোট লাগলেও বাস্তবে হয়তো পৃথিবীর থেকে কয়েক হাজার গুণ বড় অথবা পৃথিবীর থেকেও ছোট!
উনি হাতের ইশারায় সেই তারাটিকে দেখিয়ে বলে উঠলেন,
—- জানো ছোটবেলায় আম্মু আমাকে আর নিত্যকে কোলে নিয়ে একটা গল্প শুনাতো, সেই গল্পে যদি কেউ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায় তবে সে নাকি ওই আকাশটায় চলে যায়। একদিন আম্মু বলেছিলো, “যদি আমি কখনো হারিয়ে যাই তবে ভেবে নিবি আমি চাঁদের সব থেকে কাছের তারাটা হয়ে গিয়েছি!”
আমি সাইন্সে পড়াশুনো করি। জানি সেটা হয়তো বা কোনো নক্ষত্র অথবা কোনো গ্রহ যা চাঁদের মতো সূূর্যের থেকে আলো সংগ্রহ করে ছড়িয়ে দিচ্ছে, তবুও কেনো জেনো মনে হয় ওইতো ওটাই আম্মু। দূর থেকে আমাদের দেখছে। তাই রোজ রাতেই একবার হলেও ওই আকাশটায় আমার হারিয়ে যাওয়া আম্মুকে খুঁজে বেরোই আমি।
একটু থেমে আবারও বলতে শুরু করলেন,
— মাঝে মাঝে আকাশেরও মন আমার মতো খারাপ থাকে। তখন আকাশে ভীড় করে ঘন কালো মেঘ। এই মেঘগুলো খুব বাজে হয় জানো? শুধু শুধু আমার আম্মুটাকে ঢেকে দেয়। ওরা কি জানে না আমি প্রতিদিন রাত হওয়ার অপেক্ষা করি যাতে আম্মুকে এক নজর দেখতে পাই?
.
উনার কথার মাঝেই কখন যে টপটপ করে গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে তার খেয়ালই নেই আমার।
নীবিড় ভাইয়া আকাশের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলেন। অস্থির হয়ে তৎক্ষণাৎ কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের একদম কাছে নিয়ে গেলেন আমায়। একহাত দিয়ে আমার চোখের কোণে জমা জলগুলো মুছে দিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
.
—- এই পাগলি, তুমি কাঁদছো কেনো? বোকা মেয়ে একটা! একদম কাঁদবে না, তুমি কি জানো, তোমায় কাঁদলে সিরিয়াসলি পুরো বাচ্চাদের মতো লাগে? অবশ্য এমনিতেও তুমি বাচ্চাই! বড় হলেই বা কোনদিন?
.
উনার কথায় কান্নার বেগ আরোও বাড়িয়ে উনার বুকের কিল-ঘুষি মারতে শুরু করলাম আমি। আমায় উনার বুকে কিল-ঘুষি মারতে দেখে ব্যথা পাওয়ার বদলে হাসির ঝংকার তুলে দিলেন উনি। উনার হাসির আওয়াজে আমি উনার বুক থেকে মুখ তুলে মুগ্ধ চোখে তাকালাম সেই হাসির পানে! চাঁদের আলোয় উনার ঝকমকে দাঁতের ভুবন ভোলানো হাসি দেখে অজান্তেই নিজের ঠোঁটের কোণেও এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো আমার।
আবারও বুকের বাম পাশে সেই চিনচিনে অনুভূতিটা হতে লাগলো! এই হাসি দেখেই না জানি কতো শত প্রাণ খুন হয়ে যেতে পারে নিমিষেই। তা কি উনি জানেন?
ভাবতেই অবাক লাগে এই মানুষটাই আমার স্বামী! যাকে দেখলে আগে আমি দশ হাত দূরে থাকতাম, আজ তার আর আমার মাঝে ১ ইঞ্চিও ফাঁক নেই। বিবাহের মতো পবিত্র সম্পর্কে বাঁধা পড়েছি আমরা পরস্পরের সাথে।
.
নীবিড় ভাইয়া হাসি থামিয়ে চোখ বন্ধ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমার চোখের দিকে তাকালেন। আমি এখনোও বোকার মতো চেয়ে রয়েছি উনার স্নিগ্ধ মুখ খানায়।
উনি মুচকি হেসে সামান্য ঝুঁকে নিজের কোমল অধর আমার ললাটে স্পর্শ করিয়ে এক গভীর চুম্বন এঁকে দিলেন সেথায়। সাথেসাথেই নিজের গোলক রন্ধ্র বন্ধ করে ফেললাম আমি। উনার প্রেমময় স্পর্শে এক অজানা শিহরণ বয়ে গেলো আমার প্রতিটি শিরা-উপশিরায়।
আমায় সোজা করে দাঁড়িয়ে করিয়ে নিজের ডান হাত আমার বাম গালে স্পর্শ করে উনি বলে উঠলেন,
.
—- ঘুমোবে চলো! অনেক রাত হয়েছে।
.
আমার গালে রাখা উনার হাতের ওপর নিজের ডান হাত রেখে আমি বলে উঠলাম,
—- আপনি পারবেন তো সবটা সামলাতে? যদি না পারেন? আমাকে কি একলা রেখে ছেড়ে চলে যাবেন আপনি?
.
উনি নিজের মুখটা আমার মুখের কাছে আরোও একটু এগিয়ে নিয়ে এসে শীতল কণ্ঠে বলে উঠলেন,
—- মৃত্যুর আগ অবদি ছেড়ে যাবো না পাগলি। ওই এক উপর ওয়ালা ছাড়া আর কারো সাধ্য নেই এই নীবিড় কে অনন্যার থেকে দূরে নিয়ে যাবার।
তার প্রেমের থেকে দূরে নিয়ে যাবার।
.
আমি অবাক দৃষ্টিতে উনার দিকে চেয়ে আনমনেই প্রশ্ন করে বসলাম,
—- ভালোবাসেন আমায়?
.
উনি আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিজের কপালের সাথে আমার কপাল ঠেকিয়ে ধীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
—- ভালোবাসলেই বুঝি মুখ ফুটে বলতে হয়? বুঝে নেওয়া যায় না? বা মুখে বললেই বুঝি ভালোবাসা হয়ে যায়? কর্ম দ্বারা কি প্রকাশ পায় না?
.
বিনিময়ে আমি আর কিছু বললাম না। জবাব পেয়ে গিয়েছি আমি। এই মানুষটা আমায় ভালোবাসেন, ভীষণভাবে ভালোবাসেন। ভাবতেই মনের মাঝে সুপ্ত শুকপাখী ডেকে উঠছে আমার। ভালোবাসার অনুভূতি বুঝি এতোটাই সুন্দর? এতোটাই অমায়িক!
.
🍁
.
জানালা ভেদ করে সূর্যের তীর্যক রশ্মি চোখে পড়তেই কপাল কুঁচকে এলো আমার। বাম হাত চোখের সামনে ধরে আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই নজরে পড়লো নিত্য আপুকে।
আপু জানালার পর্দা সরিয়ে তার পাশেই চেয়ার টেনে বসে চায়ের কাপের চুমুক দিচ্ছে। আমায় উঠতে দেখেই মিষ্টি করে আপু বলে উঠলো,
.
—- এইতো পাখিটার ঘুম ভাঙলো তবে! চা খাবে কি অনন্যা?
.
আমি বাম হাত দিয়ে চোখ চুলকোতে চুলকোতে ঠোঁট উল্টালাম। কাচুমাচু করে জবাব দিলাম,
—- আপু, আমি তো গরম চা খাই না।
.
আপু আমার এমন বোকার মতো জবাবে ফিক করে হেসে বলে উঠলো,
—- চা তো গরমই হয়! ঠান্ডা চা খাওয়া যায় নাকি?
.
নিজের বোকামির জন্য নিজেই নিজের মাথায় একটা চাটি মেরে দিলাম। ঘুম থেকে উঠে বোধহয় বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়ে গিয়েছে আমার। এক কথায় বললেই তো হতো যে আমি চা খেতে পারিনা।
নিত্য আপু আবারো হাসলো। হেসে বলে উঠলো,
—- আচ্ছা, ফ্রেশ হয়ে এসো। রাত্রি একটু আগেই ফেশ হতে গিয়েছে।
.
এতো সকালে আপুর হাতে চায়ের কাপ দেখে আমি একটু ভেবে জিজ্ঞেস করলাম,
—- এতো সকালে চা কে বানালো?
.
আপু একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,
—- আমিই বানিয়ে নিলাম। তাছাড়া আজ থেকে সকলের রান্নার দ্বায়িত্ব আমার ওপরে দিয়েছে দিদুন। আরোও ৩ কাপ চা ভাইয়াদের ঘরে দিয়ে এসেছি! আর তোমার ঘুম কাতুরে ভাইকে ডাকার জন্য ভাইয়া গ্লাসে পানি নিয়ে বসে রয়েছে!
.
বলেই হাল্কা স্বরে হাসলো আপু। আমি কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে আপুর নিশ্চিত চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।
না জানি আল্লাহ তায়ালা এই দুই ভাই বোনকে কতোটা ধৈর্য্য দান করে বানিয়েছেন। চরম কঠিন সময়েও কতো স্বাভাবিক থাকে তারা। এমন ভাবটা নেয় যেনো সবকিছু ঠিক আছে, কোথাও কোনো ভুলভ্রান্তি নেই। আর এই স্বাভাবিকতার সাথেই তাল মিলিয়ে বুকে হাজারও চিন্তা, কষ্ট, ক্লান্তি চেপে রেখে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রাখে তারা! অথচ আশেপাশের মানুষেরই তাদের এই দুর্দশায় ঘুম নেই চোখে।
পুরো বাড়ির মানুষের রান্না একা হাতে করাটা কি এতোটাই সহজ? কখোনই না! যেখানে আম্মু, চাচিমনি আর বড় চাচি মিলেও এতো রান্না করতে হিমশিম খেয়ে যায় সেখানে এই বয়সে একা হাতে নিত্য আপু কিভাবে করবে সবটা? এতো আর শহর নয় যে ইন্ডাকশন ওভেন অথবা গ্যাস ওভেনে রান্না চাপিয়ে নিশ্চিন্তে একা হাতে সবটা সামলে নেয়া যাবে। এতো মাটির উনুন। আগুনের সাথে খেলা করে রান্না করতে হয় এখানে। অভ্যেস ছাড়া আপু পারবে তো?
.
🍂
.
আজ নিত্য আপু রুটি আর আলুর তরকারি বানিয়েছে। কষ্ট হয়েছে বানাতে জানি তবুও আপু হাসি মুখেই রেঁধে সবাইকে খাবার বেরে দিচ্ছে। আপুর মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। গা ঘেমে একাকার অথচ তাও আপুর মুখে যেনো প্রাপ্তির হাসি।
আমার পাশেই বসে আছে অগ্নি ভাইয়া। থরথর করে রেগে কাঁপছে ভাইয়ার পুরো শরীর! নিজের চোখের সামনে আপুর এরকম অবস্থা নিতে পারছে না ভাইয়া। এই নিয়ে দিদুনের কাছে কথা বলতেও চেয়েছে কিন্তু আম্মু আব্বু ভাইয়াকে থামিয়ে দিয়েছে। যদি হিতে বিপরীত হয়ে যায় সেই আশংকায়। আমার একদম ভালো লাগছে না এসব। রুশো ভাইয়াও দিদুনের ওপর ভীষণ রেগে গিয়েছে। মাঝখান থেকে শান্ত শুধু নীবিড় ভাইয়া! এখন পর্যন্ত একটা টু শব্দও করেন নি উনি।
.
কোনোরকমে একটু খেয়ে উঠে পড়লাম আমি। আসলে খাওয়ার ইচ্ছেটুকুই নেই। খাবার যথেষ্ট ভালো হয়েছে কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না আমার।
সবার কাছে নিত্য আপুর রান্নার প্রশংসা শুনে আপুর চোখ উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
এতো ভালো হবার পরও দিদুন খেয়ে শুধুমাত্র “চলনসই!” শব্দটি উচ্চারণ করলেন। যেই শব্দটা আপুর কাছে কেমন লেগেছে জানা নেই আমার তবে আমার কাছে এতোটাই কষ্টদায়ক লেগেছে যেন মনে হচ্ছে রান্নাটা আপু নয় আমি করেছি।
.
—- হোয়াট ইজ দিস ছুটকি? এই বুড্ডিটা এতো স্ট্রিক্ট কেনো? ভাবী আগুনে পুরে এতো ভালো রান্না করলো তাও শি জাস্ট সেইড “Passable!”
লাইক সিরিয়াসলি! দ্যটস রিয়েলি নট ফেয়ার!
আমি হলে এতোক্ষণ রেগেমেগে ওই মাটির ওভেনটাই ভেঙে ফেলতাম!
.
—- হুশশশশ…..! ভাইয়া চুপ! আস্তে কথা বলো। দিদুনের কানে গেলে খবর আছে!
.
রুশো ভাইয়া আমার কথায় মুখ কালো করে আবারও চুপ করে রইলো। খাওয়া শেষে দিদুন আবারও নিজের চেয়ারে গিয়ে চোখে চশমা পড়ে বসলেন। পাশে রাখা খবরের কাগজটা উল্টে পাল্টে ভাঁজ করে খবর পড়তে শুরু করলেন দিদুন। দু-এক লাইন পড়ে কাগজে মুখ ডুবিয়েই নীবিড় ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
.
—- একি তুমি এখনো যাওনি? ওহ তোমাকে তো বলাই হয়নি কি করতে হবে! গোয়াল ঘরে গিয়ে লালু ভলুর গলায় বাঁধা দড়ির খুঁটি খুলে মাঠে গিয়ে ঘাস খাইয়ে নিয়ে এসো। আপাতত এটাই করো পরে কি করবে বলে দেবো।
.
বলে আবারও খবর পড়তে শুরু করলেন দিদুন। দিদুনের কথায় করুন চোখে তাকালাম আমি নীবিড় ভাইয়ার দিকে। অথচ উনার মুখে হতাশার কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। যেনো উনাকে সচরাচর করা কাজগুলোর মধ্যেই কিছু করতে দেওয়া হয়েছে বলে এমন স্বাভাবিক রয়েছেন উনি। উনি আমার দিকে এক পলক চেয়ে নিজের ঘন পল্লব বিশিষ্ট চোখজোড়া ঝাপটে নিশ্চিত থাকতে ইশারা করলেন আমায়।
স্বাভাবিক ভাবেই মুচকি হেসে বেড়িয়ে গেলেন সদর দরজা দিয়ে। আমি শুধু অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম উনার যাওয়ার দিকে।
পাশ থেকে রুশো ভাইয়া ভয়ার্ত স্বরে মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠলো,
.
—- ওহ নোউ আবারও সেই লালু-ভলু!
.
.
.
চলবে………………💕
#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৪৬♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
গোয়াল ঘরে চিন্তিত হয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে নীবিড়। সে ভাবছে একসাথে দুজনকে কি করে নিয়ে যাবে। এমনিতেই তো ভলুকে সামলানো দায় সেখানে দু দুটো গরুকে একসাথে নিয়ে যাওয়া এককথায় অসম্ভব প্রায়! যদি হাত ছুটে একবার পালিয়ে যায় তবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে তারা।
.
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে প্রথমে লালুকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে মনস্থির করলো নীবিড়। বিসমিল্লাহ বলে আল্লাহর নাম নিয়ে লালুর দড়ির খুঁটিটা মাটির ভেতর থেকে টেনে তুলে ফেললো সে। দড়িটা শক্ত করে হাতের সাথে পেচিয়ে হেঁচকা টান মেরে লালুকে নিয়ে এগোতে লাগলো নীবিড়। লালু যেহেতু শান্ত স্বভাবের তাই গলায় টান পড়তেই এগোতে লাগলো সে।
.
প্রায় ১০ মিনিটের পথ ৩০ মিনিটে শেষ করে মাঠে গিয়ে খুঁটি গেরে ধপ করে হাটুর ওপরে ভর করে বসে পড়লো নীবিড়। ঘেমে শরীরের সাথে পড়নের শার্টটা একদম লেপ্টে গিয়েছে।
ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘামগুলো ঝেড়ে ফেললো সে। এই খাড়া দুপুরের প্রখর রোদের তীব্র তাপে যেনো ঝলসে যাচ্ছে পুরো শরীর নীবিড়ের। আজ যেনো সূর্যি মামও মনস্থির করেছেন, নিজের সর্বোচ্চ তাপমাত্রাটাই পৃথিবীর বুকে ঢেলে দেবেন।
কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থেকে উঠে দাঁড়ালো নীবিড়। বুক ফুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে আবারও বড়বড় পায়ে হেটে চললো সেই কাঁচা রাস্তায়৷
.
এবার ১৩ মিনিটের মাথায় বাড়ির পাশের গোয়াল ঘরে এসে পৌঁছোলো নীবিড়। শরীর ক্লান্ত থাকায় ১০ মিনিটের জায়গায় ৩ মিনিট বেশিই লেগে গেলো তার।
কিছুক্ষণ ভলুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলো ভলুকে নীবিড়। পর মুহূর্তে নিজেকে শান্ত করে পাশ থেকে আমগাছের পাতার ডালটা থেকে কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ভলুর কাছে। নীবিড়কে নিজের দিকে এগোতে দেখে জোড়ে “হাম্বায়ায়া…!” করে ডেকে উঠলো ভলু।
বুক ফুলিয়ে একদফা সাহস নিয়ে ভলুর থেকে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে একটা পাতা ডান হাতে নিয়ে ভলুর চোখের সামনে ঘোরাতে লাগলো নীবিড়। সেই পাতাটা দেখেই খাওয়ার জন্য নিজের মাথা পাতাটাকে উদ্দেশ্য করে এদিক ওদিকে বাঁকাতে লাগলো ভলু।
এভাবে কিছুক্ষণ পাতাটা ঘুরিয়ে ভলুর মুখের সামনে ধরতেই নিজের লম্বা জিহ্বা বের করে মুখের ভেতর পাতাটা পুরে নিয়ে চাবাতে লাগলো ভলু।
এভাবে বেশ কয়েকবার পাতা খাইয়ে দিলো ভলুকে নীবিড়। পাতাগুলো খেয়ে আগের থেকে অনেকটাই শান্ত হয়ে পড়লো ভলু।
.
নীবিড় সুযোগ বুঝে দড়িতে একবার টান দিতেই আবারও রেগে হাম্বায়ায়ায়া করে ডেকে উঠলো ভলু। নীবিড় বুঝলো এভাবে ভলুকে নিয়ে যাওয়া যাবে না তাই আগে ওকে নিজের বশে আনতে হবে।
এদিকে এতোক্ষণ রোদে থাকায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তার। এই মুহুর্তে এক কি দু গ্লাস ঠান্ডা জল দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নেবার বড্ড দরকার নীবিড়ের। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো নীবিড়।
.
🍂
.
নীবিড় ভাইয়াকে বাড়িতে ফিরতে দেখে চোখ জলে ভরে উঠলো আমার। উনার ক্লান্তিমাখা শুকনো মুখটা সোজা এসে বুকে বিঁধছে। যদি পারতাম তবে,
” তুমি কান্তদুপুরে রৌদ্রমাখা মেঘে ক্লান্তিগুলো দাও ছড়িয়ে,
আমি মেঘলা দিনে হাত বাড়িয়ে দেবো কষ্টগুলো মুছিয়ে!
— আয়ানা জাহান নুসরাত 💕 ”
এই লাইন দুটোর মতো উনার সব দুঃখ,কষ্ট, ক্লান্তি ধুয়েমুছে নিঃশেষ করে ফেলতাম। কিন্তু আফসোস আমি তা পারছিনা।
.
—- কি? পারলে না তো? এতটুকুতেই হার মেনে নিলে?
.
দিদুনের উনাকে ব্যঙ্গ করে কথাটা বলায় মুচকি হেসে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিয়ে নীবিড় ভাইয়া বলে উঠলেন,
—- সবে তো শুরু ডিয়ার দিদুন। আগে আগে দেখো হোতা হ্যায় কেয়া! কি ড্রিমার ঠিক ডায়ালগ দিলাম তো না কি?
.
“কারেক্ট ব্রো!” বলে উনার সাথে হাত উঠিয়ে হাই ফাইভ করলো রুশো ভাইয়া! অগ্নি ভাইয়া পকেট থেকে রুমাল বের করে নীবিড় ভাইয়ার কপালের ঘামগুলো মুছে দিলো। বিনিময়ে নীবিড় ভাইয়া হেসে অগ্নি ভাইয়ার পেটে নিজের হাতের কুনুই দিয়ে গুঁতো মেরে দিয়ে বলে উঠলেন “যা শালা, বোনকে সামলা আমি ঠিক আছি!”
বলেই শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে চলে গেলেন উনি।
.
আমি উনার যাওয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে একবার দিদুনের দিকে তাকালাম। দিদুনের যেনো এতে কোনো হেলদোলই নেই। দিব্যি আগের মতোই বসে রয়েছেন উনি।
দিদুনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বড়বড় পায়ে ঘরে চলে এলাম আমি। কিচ্ছু ভালো লাগছে না আমার। এদিকে নিত্য আপু মাটির উনুনে রান্না চাপিয়ে আগুনের তাপে পুড়ছে ওদিকে নীবিড় ভাইয়া এই রৌদ্রময় দিনে লালু-ভলুকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গেছেন। না জানি কতো কষ্ট হচ্ছে দুজনের!
.
🌸
.
নীবিড় ভলুর পাশে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভাবনা সবকিছুরই একটা বিগ পয়েন্ট থাকে, তাই সে ভলুর বিগ পয়েন্টটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার গায়ে হাত দিয়েছে সে ভলুর। কিন্তু প্রতিবারের মতোই তেড়ে এসেছে ভলু।
বর্তমানে ভলু আরাম করে ডালায় রাখা কচি পাতাগুলো চিবিয়ে যাচ্ছে।
আর এদিকে নীবিড়ের ইচ্ছে করছে ভলু রাগটাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে!
.
—- শালার এতো বদমেজাজি কেনো এই ভলু বল্টুটা আল্লাহ মালুম! লালুটা কতো ভদ্র আর এটা! একদম ঘাড়ত্যাড়া! ডিজগাস্টিং!
.
দাঁতে দাঁত চেপে কথা গুলো বলেই এগিয়ে যেতে লাগলো নীবিড়। ভলুর একেবারে পাশে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে পড়লো নীবিড়। নীবিড়কে পাশে বসতে দেখে ভলু আবারও “হাম্বায়ায়ায়ায়….!” করে নিজের সিং দিয়ে গুঁতো দিতে উদ্দ্যত হবে তার আগেই নীবিড় ভলুর গলা জড়িয়ে ঝাপটে ধরলো ভলুকে।
ভলু ছাড়া পাবার জন্য ছুটাছুটি করছে কিন্তু নীবিড় আর ছাড়বে না বলে পণ করেছে যেনো। নিজের ডান হাতে ভলুর গলার ঝুলন্ত অংশে হাত বুলাতেই ভলু আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে পড়লো। একটা সময় আরাম পেতে পেতে একেবারেই চুপ হয়ে গেলো ভলু! ভলুকে শান্ত হতে দেখে খুশিতে চোখ চিকচিক করে উঠলো নীবিড়ের। হাসতে হাসতে ভলুর গলা জড়িয়ে ধরেই নিজের গালের সাথে ভলুর গলায় ঘষতে শুরু করলো সে।
ভলু যেনো এতে আরো বেশিই আরাম পেলো। সে নিজেও নীবিড়ের সাথে গাল ঘষতে শুরু করলো। নীবিড় ভলুর গলায় হাত বুলাতে বুলাতেই দড়িটা ধরে পিছিয়ে আসতে লাগলো। খুঁটিটা টান মেরে তুলে হাতের সাথে দড়িটা শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে ভলুর গলায় হাত বুলাতে বুলাতেই তাকে মাঠে নিয়ে যেতে লাগলো সে।
.
🌹
.
অগ্নি ভাইয়া আর রুশো ভাইয়া পায়চারী করছে ঘরের এদিক থেকে ওদিক। আমি আর রাত্রি আপাতত গালে হাত দিয়ে তাদের পায়চারীই দেখে যাচ্ছি। অগ্নি ভাইয়া একটু পরপর খাটে অথবা চেয়ারে একটা করে লাথি মেরে দিচ্ছে, এদিকে রুশো ভাইয়া কপাল চাপড়াচ্ছে। মাঝখান থেকে মুখ ফুলিয়ে রেখেছি আমি আর রাত্রি।
নিত্য আপু নিচে রান্নাঘরে রান্না করছে। ভাত আর ডাল হয়ে গিয়েছে, বাকি শুধু মাংস আর মাছ ভাজি!
আর আমরা এদিকে অপেক্ষা করছি নীবিড় ভাইয়ার ফেরার। উনি এলেই ভাইয়ারা উনাকে নিয়ে দীঘির পাড়ে যাবে গোসল করতে।
.
—- অগ্নি…..! রুশো…..! গোসলে যাবি না? দেড়ি হয়ে যাচ্ছে জলদি নিচে আয়।
.
নিচ থেকে নীবিড় ভাইয়ার গলার আওয়াজ পেয়ে রুশো ভাইয়া আর অগ্নি ভাইয়া দুজন দুজনের দিকে এক পলক চেয়ে আলনা থেকে দুটো গামছা হাতের মুঠোয় নিয়ে তৎক্ষণাৎ ঝড়ের গতিতে নিচে নেমে গেলো। পেছন পেছন নেমে এলাম আমি সাথে রাত্রিও।
.
নিচে নেমেই নীবিড় ভাইয়ার মুখটা দেখেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। উনার ফর্সা মুখখানা একদম লাল বর্ণ ধারণ করেছে। কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে উনার। পড়নের সাদা শার্টটা একেবারে ভিজে গায়ের সাথে লেগে গিয়েছে। সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে একাকার। ঘেমে চুলগুলোও ভিজে গিয়েছে উনার। মনে হচ্ছে এইমাত্র গোসল করে গা ভিজিয়ে এসেছেন উনি। কিন্তু এগুলো তো আর পানি নয়, এগুলো উনার শরীর থেকে নিসৃত স্বেদজল!
এতো ক্লান্ত শরীর নিয়েও কতো সহজে মুখে হাসি ফুটে রেখেছেন উনি।
উনার এই শুকনো মুখের ক্লান্তিমাখা হাসিটাও কতোটা স্নিগ্ধ!
.
নীবিড় ভাইয়া আমার দিকে এক পলক চেয়ে ঠোঁটের কোণের ঝুলিয়ে রাখা হাসির সীমারেখা বৃদ্ধি করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। পর মুহূর্তে ভাইয়াদের নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন উনি।
.
—- অনন্যা, চল আমরাও গোসলটা সেরে নেই। আপুর রান্না হলে আবার আপু ঢুকবে তো!
.
আমি রাত্রির দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় সম্মতি জানিয়ে ধীর পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম। আমার পেছন পেছন এলো রাত্রিও।
.
🌼
.
—- দিদুন আসবো?
.
—- আরে আয় আয় খাটে বোস।
.
দিদুনের সম্মতি পেয়ে গম্ভীর মুখে দিদুনের পাশে গিয়ে বসলো মামুন। মামুনের মুখ গম্ভীর দেখে দিদুন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
—- কিরে মুখটা এমন করে রেখেছিস কেনো?
.
মামুন মুখ তুলে দিদুনের দিকে চেয়ে অসহায় দৃষ্টিতে বলে উঠলো,
—- দিদুন, যদি নীবিড় সব পরীক্ষায় পাশ করে যায় তাহলে কি আমি অনন্যা কে আর পাবো না?
.
দিদুনের মামুনের প্রশ্নে ভাবলেশহীন ভাবে খাটের সাথে লাগানো বালিয়ে গা এলিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,
—- পাশ করতে পারলে তো! আমি তোদের বিয়ে যখন দেবো বলেছি, তখন দেবোই। এটাতো কিছুই না। কাল দেখিস কি করি আমি।
.
🌷
.
রাত ১০ টা বেজে ১৫ মিনিট…….
নিত্যর হাতে নিঃশব্দে ঠোঁট বুলিয়ে যাচ্ছে অগ্নি। আর নিত্য গালে হাত দিয়ে অগ্নির পাগলামো দেখে যাচ্ছে।
সবাই ঘুমিয়ে গেলো রুশো আর অগ্নি অনন্যাদের ঘরে গিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে নিত্যর সাথে কিছুক্ষণ একলা থাকার জন্য রাত্রি আর অনন্যাকে কিছুক্ষণ ঘর ফাঁকা করতে বলে ঢুকে পড়েছে অগ্নি। অন্যদিকে রুশো রাত্রির সাথে একটু খুনশুটি করবে বলে বুদ্ধি খাটিয়ে অনন্যাকে নীবিড় ডেকে পাঠিয়েছে বলে নীবিড়ের ঘরে যেতে পাঠিয়ে দিয়েছে। মাঝখান থেকে রাত্রির কোথাও যাবার মতো জায়গা নেই বলে অগত্যাই তাকে রুশোর সাথে যেতে হয়েছে ছাদে। কারণ বাড়িতে যদি ঘুরে বেড়াতে কেউ দেখে ফেলে তবে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
.
—- খুব কষ্ট হয়েছে তাইনা? ইশশশ….! আগুনের আঁচ লেগে কতোটা জ্বলে গিয়েছে দেখেছো তুমি? এইজন্যই বলছি চলো চলে যাই। দিদুন যা ভাবে ভাবুক! আমার এসব ভালো লাগছে না একদম। কিন্তু তুমি আমার কথা শুনছোই না! বারবার বাঁধা দিচ্ছো।
.
নিত্য অগ্নির পাগলামোয় কপালে হাত দিয়ে বলে উঠলো,
—- উফফফ…! অগ্নি! তুমিও না, কাজ শিখতে একটু আধটু চোট তো লাগেই। তেমন কিচ্ছু হয় নি, অনন্যা অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিয়েছিলো তো। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো!
.
—- কাজ শিখতে একটু আধটু চোট লাগবে মানে? কোন কাজটা পারো না তুমি? আর তাছাড়া রান্না পারো তাই বলে এভাবে কষ্ট করে রান্না করতে হবে না তো তোমায়। আর তুমি প্লিজ, দিদুনের হয়ে একটা কথাও বলো না। আমার জাস্ট আর সহ্য হচ্ছেনা।
.
—- আহ….! অগ্নি ছাড়ো তো ওসব কথা। কতোদিন পর তোমাকে একটু কাছ থেকে দেখতে পেলাম। কোথায় একটু রোমান্টিক মুডে থাকবা তা না! হুহ….!
.
কথাগুলো এক নাগারে বলেই মুখ ফুলিয়ে বসলো নিত্য। অগ্নি কি করবে ভেবে না পেয়ে বাচ্চাদের মতো টুপ করে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে নিলো নিত্যর গালে। কিন্তু নিত্যর রাগ ভাঙার বদলে আরোও বেড়ে গেলো। চোখ ছোট ছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অগ্নির দিকে চেয়ে নিত্য বলে উঠলো,
“আস্ত নিরামিষ একটা!”
.
🌺
.
—- ভাইয়ায়ায়ায়া……..!
আমার ডাকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে পড়লেন নীবিড় ভাইয়া। অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
.
—- একি তুমি এখানে? অগ্নি, রুশো গেলো কই?
.
উনার এমন প্রশ্নে নিমিষেই ভ্রু কুঁচকে এলো আমার। আমি পাল্টা প্রশ্ন করে বসলাম,
—- আপনিই তো আমায় ডেকে পাঠালেন! রুশো ভাইয়া তো তাই বললো। আর পাশের ঘরে নিত্য আপুর কাছে অগ্নি ভাইয়া গিয়েছে।
.
আমার কথায় হকচকিয়ে উঠে পর মুহূর্তে নিজেকে শান্ত করে বলে উঠলেন,
—- একটু চোখ লেগে যেতে না যেতেই বান্দর দুটো হাওয়া হয়ে গেলো?
.
আমাকে বোকা বানিয়ে উনার কাছে পাঠানো হয়েছে বুঝতে পেরে ঠোঁট উল্টালাম আমি। উনি কিছু একটা ভেবে হেঁচকা টান মেরে নিজের বুকের ওপর ফেললেন আমায়। দুহাতে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে শীতল কণ্ঠে বলে উঠলেন,
.
—- এবার ঘুমটা ভালো হবে আমার। উফফফ….! কত্তো ধকল গিয়েছে আজ। তুমিও ঘুমোও গুড নাইট!
.
বলে আমায় নিজের বুকে জড়িয়েই চোখ বন্ধ করে ফেললেন উনি। উনার এমন অদ্ভুত কান্ডে হতবাক হয়ে চোখ বড়বড় করে ফেললাম আমি। উনার থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য নড়াচড়া করতেই উনি চোখ বন্ধ রেখেই ধমকে উঠলেন,
—- আহহ! মাছের মতো নড়াচড়া করছো কেনো? ডিস্টার্ব করো না তো। চুপচাপ ঘুমোতে দাও। আম রিয়েলি ভেরি টায়ার্ড!
.
আর কিছু বললাম না আমি। এমনিতেই আজ অনেক পরিশ্রম করেছেন উনি। কিন্তু তাই বলে এভাবে ঘুমোবেন? আমি কি অপদার্থ নাকি যে ওজনশূন্য বলে চুপটি করে বুকের ওপর উঠিয়ে রেখেছেন?
আমার যে বুকের বাম পাশের হৃদপিন্ডের সিস্টোল-ডায়াস্টোল রেট বেড়ে যাচ্ছে তা কি উনি জানেন?
.
🍁
.
—- এই বুড়িটাকে আমার একদম সহ্য হচ্ছে না! ইচ্ছে তো করছে পাতিলের কালি গিয়ে পুরো মুখে লেপে দিয়ে আসি বুড়িটার।
.
রাত্রির কথা শুনে উচ্চস্বরে হো হো করে হাসতে শুরু করলো রুশো। রুশোর হাসি দেখে রাত্রি আগের থেকেও আরোও রেগেমেগে বোম্বাই মরিচের মতো ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলো,
.
—- আপনি হাসছেন? আপনার কি মনে হচ্ছে আমি মজা করছি?
.
রুশো দুহাতে পেট চেপে ধরে হাসতে হাসতে বলে উঠলো,
—- আরে না না! এটম বোম্বের কাছ থেকে এটাই আশা করা যায়। বাই দ্য ওয়ে আই হ্যাভ আ প্লান।
.
রুশোর মুখের প্লানের নাম শুনতেই রাগ ভুলে উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
—- কি প্লান?
.
রুশো নিজের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা পলিথিন বের করে রাত্রির সামনে ধরলো। রাত্রি ভেতরে কি আছে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
—- কি এটা?
.
রুশো ভ্রু নাচিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো, “বিছুটি পাতা!” বিছুটি পাতা সম্মন্ধে রাত্রির জ্ঞানের ভান্ডার শুণ্য তাই ঠোঁট উল্টে সে আবারও জিজ্ঞেস করলো,
.
—- এটা আবার কিসের পাতা! আর এটা দিয়ে হবেই বা কি?
.
রুশো একটা রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
—- এর নাম বিছুটি গাছের পাতা পাতা এর আরেক নাম হলো ছুতরা গাছের পাতা। এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো “Tragia involucrata.”
এই গাছটা “ইউফোরবিয়াসেই” পরিবারের একটি উদ্ভিদ। একে উত্তর বঙ্গের লোকেরা “ছোতরা গাছ” অথবা “চুলচুইল্লাগাছ” বলে থাকে। তবে এর শুদ্ধ নাম বিছুটি গাছ। আর এর পাতা এগুলো দেখেই পাতাগুলোর নাম বিছুটি পাতা।
.
রাত্রি কিছুক্ষণ রুশোর বলা বিছুটি পাতার ডিটেইলস শুনে মাথা ঘুরিয়ে বললো,
—- সে যাই হোক! এটা দিয়ে হবে টা কি?
.
—- আরে মেরি এটম বোম্ব, এটা এমন একটা উদ্ভিদ যার পাতা, রস অথবা পাতার গুড়ো শরীরে লাগলে চুলকানি শুরু হয়। এবার নিশ্চয়ই বুঝে গেছো আমরা ঠিক কি করতে যাচ্ছি!
.
রুশোর আইডিয়া বুঝতে পেরে রাত্রি নিমিষেই চোখ দুটো রসগোল্লার সাইজ বানিয়ে ফেললো!
.
.
.
চলবে……………..💕