প্রেম আমার পর্ব-৫১+৫২+৫৩

0
6362

#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৫১♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
নীবিড় ভাইয়া আমায় নিয়ে উপরে উঠে আস্তে করে নামিয়ে দিলেন। উনার থেকে ছাড়া পেয়ে আড় চোখে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিতে লাগলাম আমি। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার আমাদের দিকে কেউ তাকিয়েই নেই। বরং সবাই তাকিয়ে আছে সিঁড়ির দিকে। খটকা লাগায় আমি নিজেও সিঁড়ির দিকে তাকালাম। আর তাকাতেই আমার চোখ খুলে হাতে চলে আসার মতো অবস্থা!
.
অগ্নি ভাইয়া ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এক পা এক পা করে ওপরে উঠছে। আর ভাইয়ার পিঠে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে দাঁত কেলিয়ে আছে রুশো ভাইয়া। অগ্নি ভাইয়া কোনোরকমে উপরে উঠতেই লাফ মেরে নেমে গেলো রুশো ভাইয়া। রুশো ভাইয়া নামতেই অগ্নি ভাইয়া পিঠ সোজা করতে যেয়ে “আম্মমায়ায়া রে….!” করে চিৎকার করে উঠলো রুশো ভাইয়া জিহ্বায় কামড় দিয়ে ধরে বললো,
.
—- এইরে! আমার ওয়েট কি বেড়ে গেলো নাকি!
.
অগ্নি ভাইয়া সোজা হয়ে ইটের ওপর বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুশো ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
—- ৬২ কেজি ওজনের বস্তা পিঠে চাপিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠেছিস কোনো দিন? ভাই ঘাট হয়েছে আমার। আর ভুলেও তোকে কোনো দিনো কোলে বসাবো না।
.
রুশো ভাইয়া চোখ মুখ কুঁচকে ঠোঁট উল্টালো। পেছন থেকে হাসতে হাসতে হেলেদুলে পৌঁছোলো নিত্য আপু আর রাত্রি! অগ্নি ভাইয়াকে বসে হাঁপাতে দেখে নিত্য আপু আবারও এক গাল হেসে বলে উঠলো,
.
—- যা বুঝলাম আমার বাবা অনন্যার মতো কপাল নেই যে বরের কোলে চড়ে ঘুরে বেড়াবো! পায়ে ব্যথা হলে হুইলচেয়ারেই ঘুরে বেড়াতে হবে আমায়।
.
অগ্নি ভাইয়া নিত্য আপু কথায় চট করে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,
—- আরে আরে কি যে বলো না! তুমি তো কাগজের মতো হাল্কা। তোমাকে তো কোলে নিয়ে পুরো দুনিয়া ঘুরে বেড়াতে পারবো। ও লম্বা, তাই ওজন বেশি বুঝোনা?
.
নিত্য আপু চোখ ছোট ছোট করে বললো,
—- ওহ তার মানে আমি মোটা হয়ে গেলে আর কোলে তুলতে পারবে না এইতো?
.
অগ্নি ভাইয়া নিত্য আপুর কথায় থতমত খেয়ে গেলো। আমতাআমতা করে ভাইয়া বললো,
—- আরে না না! কোথায় তুমি আর কোথায় রুশো। ও পাতলা হয়েও ভারী। আর তুমি মোটা হলেও আমার কাছে কাগজের মতো হাল্কাই থাকবা। বিলিভ মি!
.
অগ্নি ভাইয়ার কথায় এতোক্ষণের চাপিয়ে রাখা হাসির ফোয়ারা বের হয়ে গেলো সবার। রুশো ভাইয়া হাসতে হাসতে অগ্নি ভাইয়ার কাধে হাত রেখে বললো,
—- কি ব্রো! তুমিও দেখি আজকাল লজিকহীন লজিক ক্রিয়েট করো!
.
অগ্নি ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে রুশো ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁত দাঁত চেপে বলে উঠলো,
—- রুশো ফুশো! বদের হাড্ডিইইইই….! তোর লাফ মেরে পিঠে উঠার জন্য দেখ বউ বিয়ের আগেই ডিভোর্স দিচ্ছে।
.
বলেই তেড়ে রুশো ভাইয়ার পেছনে ছুট লাগালো অগ্নি ভাইয়া। ততক্ষণে রুশো ভাইয়া হাওয়া!
ওদের দৌড়াদৌড়ি দেখে নীবিড় ভাইয়া হাসতে হাসতে বললেন,
—- আবে পড়ে যাবি শালা! ছোটাছুটি অফ কর।
.
নীবিড় ভাইয়ার বলার পরও কারো কোনো রিয়াকশন হলো না। দুজনেই ছোটাছুটি করতে করতে হাপিয়ে গিয়ে একসময় হেসে ধুপ করে বসে পড়লো ঘাসের ওপর।
নীবিড় ভাইয়া কপাল কুঁচকে বললো,
—- ভালো কথা কানে যায়না না? দিলি তো বাকি এনার্জিও ফুরিয়ে। চল জলদি, এদিকটা ঘুরে ফিরে দেখা হলে জাদুঘরে যাবো।
.
অগ্নি ভাইয়া আর রুশো ভাইয়া কিছুক্ষণ বসে জিড়িয়ে নিয়ে উঠে পড়লো। এবার রওনা হলাম আমরা মহাস্থানগড় জাদুঘরের উদ্দেশ্যে।
.
🌹
.
বর্তমানে আমরা মহাস্থানগড় জাদুঘরে অবস্থান করছি। হাস্যকর হলেও আবারও আমায় কোলে করে গোকুল মেড় থেকে নামিয়েছেন নীবিড় ভাইয়াই। কিন্তু এবার রুশো ভাইয়া অগ্নি ভাইয়ার পিঠে লাফ মেরে উঠার সুযোগ পায় নি। রুশো ভাইয়ার থেকে ১০ টা সিঁড়ি পেছনে থেকে নেমেছে অগ্নি ভাইয়া। যাতে ভুলক্রমেও রুশো ভাইয়া লাফিয়ে পিঠে উঠতে না পারে।
.
জাদুঘরের প্রবেশ মূল্য আমাদের বিডি পর্যটকদের জন্য পরেছে ২০ টাকা বাবাদ! এখানেও ফরেইনারদের জন্য চার্জ বেশি। সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য ১০০ ৳ আর সার্কভুক্ত বাদে দেশগুলোর জন্য ২০০ ৳।
সুঙ্গ থেকে মুসলিম আমলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বাক্ষী আজকের মহাস্থানগড় জাদুঘর। এই জাদুঘরে নাকি ওই আমলের ২ হাজার ৬৮৭ টি প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষিত রয়েছে।
সেসবেরই কিছু নিদর্শন দেখতেই জাদুঘরে আসা। শরীরটা ভালো লাগছে না তাই বেশি ঘুরাঘুরি করা হবে না মনে হচ্ছে। জাদুঘরের উত্তরে রয়েছে গোবিন্দ ভিটা। তাছাড়া আরো আছে খোদার পাথর ভিটা, শিলা দেবীর ঘাট, মহাস্থান রেস্তোরাঁ, মানকালীর কুণ্ডু ইত্যাদি।
.
জাদুঘরে ঘুরতে ঘুরতেই চোখে পড়লো কিছু পোড়ামাটির ফলক। যেখানে মানুষের অঙ্গ-ভঙ্গির ছবি লিপিবদ্ধ করা আছে। আরেক ফলকে রয়েছে হাতির চিত্র, তার আরেকটিতে রয়েছে সিংহের গর্জনরীত একটি চিত্র। তার পাশেই খেয়াল করলাম একটা মাটির চুলা! মাটিত চুলা খুব সাধারণ হলেও অদ্ভুতভাবে এই চুলাটা অন্য সব চুলার থেকে ভিন্ন।
.
নীবিড় ভাইয়া এখানকার স্থানীয় মানুষদের কাছে জিনিসগুলো সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করে চলেছেন। রুশো ভাইয়া, অগ্নি ভাইয়া আর নিত্য আপু রৌপ্যমুদ্রাগুলো বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে। আর রাত্রি আমার সঙ্গে রয়েছে। আমরা পাশের সেলের কলসি গুলো সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছি। একটার থেকে আরেকটা বড়! এভাবে সিরিয়ালি সাজানো আছে অনেকগুলো কলসি।
.
অবাক করা বিষয় হলো জাদুঘরে অনেক বিদেশি পর্যটকেরাও এসেছে। অথচ যেখানে বাঙালিদেরই ঐতিহাসিক স্থানগুলোর প্রতি ইন্টারেস্ট কম। এই জন্যেই বোধহয় রুশো ভাইয়াকেও কাউন্টারের লোকটা ফরেইনারই ভেবে নিয়েছিলো। 😅
নীবিড় ভাইয়া হঠাৎ সামনে থেকে পেছনে এসে আমাদের কাছে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমায় দেখে নিয়ে বলে উঠলেন,
.
—- শরীর খারাপ লাগছে?
.
বিনিময়ে আমি শুধু জোড়পূর্বক হেসে দু দিকে মাথা নাড়িয়ে না বোধক জবাব দিলাম। উনি আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অগ্নি ভাইয়াকে একটু জোড়েই ডেকে বললেন,
—- অগ্নি….! লেইট হয়ে গিয়েছে অনেক। আবার বগুড়া থেকে সান্তাহার স্টেশন যেতে লাগবে। চল রওনা দেই।
.
—- আসছি….! আগা তোরা! (অগ্নি)
.
নীবিড় ভাইয়া চোখের ইশারায় সম্মতি জানিয়ে আমার ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে এগোতে লাগলেন। আমিও চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতোই উনার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে লাগলাম। এরকম পাবলিক প্লেসে মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেবার ইচ্ছে নেই আমার। যদি এখন উনার কথার প্রতিবাদ করতে যাই তবে নিঃসন্দেহে সবার সামনে চেঁচিয়ে মার্কেট ফাটিয়ে ফেলবেন উনি!
.
🍁
.
সিএনজি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি সবাই। আবারও সেই একই বিপত্তি এসে হানা দিলো যাত্রা পথে। সিএনজির সিট ৫ টা কিন্তু আমরা মোটে ৬ জন। অগ্নি ভাইয়া তো বোধহয় মাটিতে নাক খড় দিয়ে ফেলেছে এই বলে যে রুশো ভাইয়াকে আর কোলে বসাবে না কোনো কালেই। এদিকে রুশো ভাইয়াও এবার নিজের মান-সম্মানের তোয়াক্কা না করে অগ্নি ভাইয়ার কোলেই বসবে বলে দাঁত কেলিয়ে যাচ্ছে।
.
—- নো নো নো! ন্যাড়া একবারই ব্যাল তলায় যায়। সেই জায়গায় আমি তো দু দুবার গিয়েছি।
.
—- হেই ব্রো! তাছাড়া তো আর উপায়ও নেই। নাও না কোলে প্লিজ প্লিজ প্লিজ….!
.
—- নীবিড়…….! বাঁচা আমাকে এটার হাত থেকে।
.
নীবিড় ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
—- তোরা সামনের সিএনজি রিজাভ নিয়ে ৪ জন উঠ! আমি আর অনন্যা পেছনের সিএনজি রিজাভ নিয়ে যাচ্ছি।
.
নীবিড় ভাইয়ার প্রোপোজাল সবার সেকেন্ডের মধ্যেই পছন্দ হলেও হলো না শুধু আমার। আমি ভাইয়া, আপু আর রাত্রিকে ছেড়ে আলাদা ভাবে আস্ত একটা বিষাক্ত নখ বিশিষ্ট সাদা বিলাইয়ের সাথে যেতে ইচ্ছুক নই মোটেই।
তাই মুখ ফুলিয়ে কেবল না শব্দটা উচ্চারণ করবো তার আগেই বাকিরা সামনের সিএনজি তে উঠে পড়লো। নীবিড় ভাইয়া গম্ভীর কন্ঠে আমায় বললেন,
.
—- তোমাকে না না না বলে গান গাইতে বলা হয় নি। চুপচাপ সিটে বসে পড়ো!
.
কি আর করার শেষমেশ অবাধ্যগত সন্তান হয়েও মুখ বুঝে বাধ্যগত সন্তানের মতো সিএনজির সিটে চেপে বসতে হলো আমায়। আমি বসতেই উনি আমার পাশে উঠে বসে “মামা চলেন…!” বলেই সিটে চোখ জোড়া বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলেন।
আর আমি মুখ ফুলিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চোখ দিয়েই গিলে ফেলতে লাগলাম উনাকে। ভেতরে ভেতরে যত রাগ আছে তা গালাগাল দিয়েও কমানোর ক্ষমতা নেই আমার। কারণ আমি ভালো ভালো গালাগাল দিতেই জানি না!
.
উনি চোখ দুটো বুজে রেখেই বলে উঠলেন,
—- এভাবে দেখিও না। আমার রেস্ট নিতে প্রবলেম হচ্ছে।
.
সাথেসাথেই চোখ বড়বড় হয়ে এলো আমার। এটা মানুষ নাকি সত্যিকারেই বিলাই? চোখ বন্ধ রেখেই বুঝলেন কিভাবে আমি উনাকে দেখছি?
প্রচন্ড রকম বিরক্তি নিয়ে ডান দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাস্তার পাশের শা শা করে ছুটে চলা লম্বা লম্বা গাছগুলো দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমি। যদিও বাস্তবে গাছ গুলো নিজের জায়গাতে স্থির তবে আমার কাছে আপেক্ষিক ভাবে তাদের ছুটন্ত বলে মনে হচ্ছে। চলমান সিএনজির ফলে সৃষ্ট দমকা হাওয়া এসে অবাধ্য চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে আমার। যার দরুন বিরক্ত বোধ করছি আমি আরোও বেশিই। হাতদুটো উঁচু করে হাত খোপা করতে নিলেই এক হাতে কোমড় জড়িয়ে টান মেরে নিজের একদম কাছে নিয়ে এলেন আমায় উনি। আমার মাথা নিজের কাঁধের সাথে ঠেকিয়ে বলে উঠলেন,
.
—- রেস্ট নাও! এন্ড বিরক্ত করো না।
.
—- আরে আরে কি করছেন? ছাড়ুন আমায়!
.
উনি নিজের ক্লান্তিমাখা চোখ দুটো আধখোলা অবস্থায় এনে আমার চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বললেন,
—- অনেক টায়ার্ড আমি। ডিস্টার্ব করো না প্লিজ!
.
আর কিছু বললাম না। উনার ক্লান্তিমাখা মুখটা বড্ড বাঁধা দিলো আমায়। ইচ্ছে হলো না আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করে উনার বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটাতে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার! বিশ্রাম উনি নিলে আমায় কেনো নিজের কাধে মাথা রাখাতে বাধ্য করলেন?
সত্যিই এই মানুষটার মনে যে ঠিক কি চলে তা বোঝা মুশকিল। এক কথায় বড্ড বেশিই মুশকিল!
.
🌸
.
প্রায় ৩ টের নাগাদ বাড়ি পৌঁছোলাম আমরা। ভাইয়ারা বাড়ি এসেই গামছা নিয়ে দৌড় মেরেছে দীঘিতে। এতোদিন অসহ্যকর মনে হলেও আজ যেনো এখান থেকে যাবার ঘন্টা বাজতেই সবার মায়া পড়ে যাচ্ছে গ্রামের পরিবেশে।
আমি রাত্রি আর নিত্য আপুও এই ফাঁকে গোসল সেড়ে নিলাম। চাচিমনি আর বড় চাচি মিলে পাটি বিছিয়ে খাবার এনে রেখেছে। অপেক্ষা শুধু ভাইয়াদের। ওরা এলেই থালায় ভাত বেড়ে দেবে চাচিমনি।
.
আমরা পাটিতে বসেই গল্প করছিলাম, এর মাঝেই দিদুন একটা টিফিন বক্স এনে নিত্য আপুর হাতে ধরিয়ে দিলেন। নিত্য আপু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই দিদুন বললেন,
—- আমসত্ত্ব নাকি ভারী পছন্দ হয়েছে তোমার। তাই বেঁধে দিলাম। বাসায় যেয়ে খেয়ো।
.
নিত্য আপুর খুশিতে চোখ চিকচিক করে উঠলো। সাথে খুশি হলাম আমরা সবাইও। দিদুন নিজের সাথে করে আনা পুরোনো একটা বাক্স নিত্য আপুকে ধরতে বলে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।
.
—- এতে কি আছে দিদুন?
.
দিদুন ইশারায় আপুকে বাক্সটা খুলে দেখতে বললেন। বাক্সটা দুহাত দিয়ে খুলতেই চমকে উঠলো আপু। দিদুন মুচকি হেসে বলতে শুরু করলেন,
.
—- আমার দাদুভাই দের বউদের জন্য একজোড়া করে বালা বানিয়ে রেখেছিলাম আমি। জুঁই কেও দিয়েছি। এখন তুমি তো অগ্নির বউ হতে যাচ্ছো তাই তোমার বালা জোড়া এখনই দিয়ে রাখলাম।
.
নিত্য আপু বালাগুলোয় হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলো। আপুর চোখের কোণে জল জমাট বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে। তবে এ কোনো দুঃখের অশ্রু নয় এতো পরম শুখের নমুনা মাত্র!
.
এর মধ্যেই ধুমধাম আওয়াজে পেছন ফিরে তাকালাম আমরা। অগ্নি ভাইয়া আর রুশো ভাইয়া দুজনেই ভেজা গায়ে একসাথে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে আটকে গিয়েছে।
—- হেই ব্রো….! আমি ছোট আমি আগে ঢুকবো! ছোটরা সব কিছুতে বেশি পায়।
.
—- আমি বয়সে বড়। সবার আগে আমি ঢুকবো! ইয়ায়ায়ায়া…..!
.
ওদের এভাবে ধস্তাধস্তি করতে দেখে চোখ বড়বড় হয়ে এলো সবার। ভাইয়াদের পেছনে ছিলো নীবিড় ভাইয়া। উনি ভাইয়াদের পাগলামি দেখে পেছন থেকে ধাক্কা মারতেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো অগ্নি ভাইয়া আর রুশো ভাইয়া। পড়তে পড়তে আর একটুর জন্যেই বেঁচে গেলো দুজনে। ওদের কান্ড দেখে হাসিতে ফেটে পড়ার বদলে শুধুমাত্র মুখ টিপে হাসতে হলো আমাদের, দিদুনের উপস্থিতির জন্য।
.
কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে এক তাক লাগানো হাসির ঝংকার ভেসে আসলো পেছন থেকে। আমরা অবাক দৃষ্টিতে সেই হাসির উৎসের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলাম। দিদুন ভাইয়াদের কাহিনী দেখে আজ মন খুলে হাসছেন। ১০ বছরেও যেখানে দিদুনকে গম্ভীরতার পাছে হাসতে দেখা যায় নি সেখানে আজ দিদুন প্রাণ খুলে হাসছেন। দিদুনকে হাসতে দেখে চাচিমনি, বড় চাচি আর আম্মুর চোখে নোনাজল এসে বাসা বাধতে লাগলো। দিদুন হাসি থামিয়ে হাতের ইশারায় ভাইয়াদের নিজের কাছে ডাকলেন।
.
ভাইয়ারা ভয়ে ভয়ে দিদুনের কাছে এসে স্ট্যাচুর মতো সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। দিদুন রুশো ভাইয়ার পিঠে থাপ্পড় মেরে বললো,
—- এই আমচোড় টা দেখি বুড়ো বয়সেও বড় হবে না।
আর অগ্নি, দাদুভাই তুমিও ওর সাথে বাচ্চামো শুরু করে দিয়েছো! নাত জামাই, যে কিভাবে তোমাদের সামলায়! যাও তাড়াতাড়ি কাপড় বদলে একেবারে তৈরি হয়েই নামো সবাই।
.

অগ্নি ভাইয়া আর নীবিড় ভাইয়া দিদুনকে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে অবাক হলেও সামলে নেয় নিজেদের। কিন্তু সামলাতে পারে না শুধুমাত্র রুশো ভাইয়া। দিদুনের মুখে এমন মিষ্টি মিষ্টি কথা করলার চেয়েও বোধহয় তেঁতো লাগলো রুশো ভাইয়ার কাছে। যার দরুন বেজায় বিষম খাওয়া শুরু করলো রুশো ভাইয়া। চাচিমনি রুশো ভাইয়াকে কাশতে দেখে পানি ভরিয়ে গ্লাস এগিয়ে দিলো ভাইয়ার দিকে। রুশো ভাইয়া এক নিমিষেই ঢকঢক করে পুরো গ্লাস শেষ করে শান্ত হলো তবে। রশো ভাইয়ার বর্তমান মনোভাব কিছুটা এরকম যে “করলার মধ্যে মধু ঢেলে দিলো কে!”
নীবিড় ভাইয়া আর অগ্নি ভাইয়া রুশো ভাইয়াকে ধরে আরোও কোনো অঘটন ঘটানোর পূর্বেই মুখ লুকিয়ে ঘরে নিয়ে গেলো!
আর এদিকে হাসির বোম্ব ফাটতে শুরু করলো আমাদের পেটের মধ্যে।
.
🍂
.
অতঃপর ঘনিয়ে এলো গ্রাম থেকে বিদায় নেবার চূড়ান্ত মুহুর্ত। সবাই মিলে খেয়ে নিয়ে রেডি হয়ে নিচে নেমে এলাম আমরা। আম্মু আব্বু লাগেজ নিয়ে উঠানে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অপেক্ষায়। আমরা নেমে জুঁই ভাবী, মাসুম ভাইয়া, চাচি আর চাচ্চুদের সাথে কুশল বিনিময় করে নিলাম। দিদুন কে সালাম করে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করলাম,
.
—- মামুন ভাইয়া কোথায় দিদুন?
.
দিদুন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
—- তোমরা গেলে বের করবো ওকে। চিন্তা করিও না।
.
বিনিময়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম আমি। বাড়ি ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় উঠে এক পলক চেয়ে দেখে নিলাম আমরা হীনা খাঁ খাঁ করা বাড়িটা। বাড়ির পাশেই গোয়ালঘরে লালু-ভলুকে ড্যাবড্যাব করে আমাদের দিকে চেয়ে থাকতে দেখলাম আমি। রুশো ভাইয়া ভলুকে এভাবে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাকে ভেঙিয়ে বলে উঠলো,
.
—- হে হেই বুল! এখন কাকে কিক মারবে হ্যা? পচ্চা বুল! বাই দ্য ওয়ে, আই উইল মিস বোথ অফ ইউ। স্পেশালি ইউ মি. বুল! টাডা…..!
.
রুশো ভাইয়ার উচ্চারিত বাক্য বোধগম্য না হওয়ায়, বিনিময়ে লালু ভলু “হাম্বায়ায়ায়ায়ায়….!” করে ডেকে উঠলো। রুশো ভাইয়া ওদের ডাক শুনে ভরকে গিয়ে অগ্নি ভাইয়ার গলা জড়িয়ে চেপে ধরলো ভাইয়াকে। সাথেসাথেই হাসিতে ফেটে পড়লাম আমরা সবাই।
.
চলবে………………💕

#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৫২♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
বর্তমানে সান্তাহার প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে নিজেকে একটা ক্ষুদ্র পিঁপড়ের মতোই লাগছে আমার। আজ প্লাটফর্মেই এতো ভীড় যদি হয় তবে ট্রেনের ভেতরে ঠিক কিরকম ভীড় হবে তা কল্পনা করলেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে আমার। যদিও টিকিট কেটে সিট নেয়া আছে আমাদের তবে সন্দেহ সিট অবদিই পৌঁছোতে পারবো কিনা এই নিয়ে।
তারওপর আজ ট্রেন লেইট! মাত্র খবর নিয়ে জানলাম ট্রেইন জয়পুরহাট ছেড়েছে। অর্থাৎ আগে আক্কেলপুর আসবে তারপর ছাড়বে, অবশেষে পৌঁছোবে সান্তাহার জাংশনে।
.
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আশেপাশের লোকজনদের দেখতে দেখতে এসব ভাবছিলাম ঠিক তখনই পাশ থেকে রুশো ভাইয়ার আতংকিত কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসতে লাগলো,
—- ও ভাই! মারো মুজে মারো! ও মাই গড এত্তো পপুলেশন! হুয়াই হুয়াই?
.
অগ্নি ভাইয়া রুশো ভাইয়ার কথার প্রতিউত্তরে প্লাটফর্মের এন্ড পর্যন্ত হেলে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে উঠলো,
—- খাইছে রে! আজকে রুশো ভর্তা হয়ে যাবে নিশ্চিত। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে নুন, তেল কোথায় পাবো যে ভর্তাটাকে একটু স্বাদযুক্ত বানাবো?
.
রুশো ভাইয়া চোখমুখ কুচকে ঠোঁট উল্টে বললো,
—- উফফ..ব্রো! এই নিয়ে অনেক পঁচাইছো। প্লিজ আর না! প্রেস্টিজ এইবার পাম্পচার না হয়ে প্লাস্টিক হয়ে যাবে নির্ঘাত।
.
রুশো ভাইয়ার কথায় অগ্নি ভাইয়া হো হো করে হাসতে শুরু করে দিলো। চোখ ছোট ছোট করে অগ্নি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে আবারও মুখ ফুলিয়ে বসে পড়লো রুশো ভাইয়া।
.
এই ব্যস্ত স্টেশনে একজনই শুধুমাত্র সেল্ফি তোলায় ব্যস্ত আর সে হলো ওয়ান এন্ড ওনলি আমার বেস্টু রাত্রি। ওর মতে গাল ফুলিয়ে বসে থাকলে তো আর ভীড় কমবে না তাই সেল্ফি তুলেই টাইম পাস করা বেটার। এদিকে নিত্য আপু চোখে চশমা লাগিয়ে এই ব্যস্ততার মাঝে মেসেঞ্জারে ফ্রেন্ডদের পাঠানো মেডিকেল নোটস দেখছে। কিসব হাড্ডি হুড্ডির ছবি রয়েছে তাতে। বর্তমানে আপু সেগুলোই জুম করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আল্লাহ মালুম এই দুই ভাই বোন এতো পড়াশুনো করে কিভাবে! তাও আবার একাডেমিক স্টাডিস! আমি তো একটু ফাঁক পেলেই কমিক্স, গল্পের বই অথবা গোপাল ভাড়ের বই নিয়ে পড়তে বসি। একাডেমিক বই গুলো তো আমার রোজ দিনকার ইন্সট্যান্ট স্লিপিং পিলস! কয়েক লাইন পড়তেই চোখে রাজ্যের ঘুম এসে হানা দেয় যেই আমার, সেই আমিই বা কিভাবে পড়াশুনোর সাথে বন্ধুত্ব করবো? এটা নিছক কল্পনার জগৎেই সীমাবদ্ধ মাত্র।
.
খানিক বাদেই হাতে ৪ টে কোকের বোতল নিয়ে স্টল থেকে ফিরলেন নীবিড় ভাইয়া। আমার পাশের সিটেই বসে পড়ে কয়েক সেকেন্ড জিড়িয়ে নিলেন উনি। অগ্নি ভাইয়া নীবিড় ভাইয়ার হাতে ৪ টে কোকের বোতল দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
.
—- এই রে, কোন অভাগা বা অভাগীরা যে কোকের ভাগ থেকে বাদ পড়বে আল্লাহ মালুম। এই তুই কোক আনলি ভালো কথা বাট মাত্র ৪ টে আনলি কেন, আমরা মেম্বার যেখানে ৮ জন?
.
নীবিড় ভাইয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অগ্নি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
—- বলদের বলদ! আমার কি অক্টোপাসের মতো ৮ টা বাহু যে ৮ টা তে ৮ টা কোকের বোতল পেঁচিয়ে নিয়ে চলে আসবো? শেয়ার করে খাবো, একা কেই বা পুরো বোতল খাবে? আর তোর গরুর পাকস্থলী বিশিষ্ট বোনের জন্য তো পুরো ২ লিটারের পানির বোতল ব্যাগে আছেই।
.
কথাটা যে উনি আমায় ব্যঙ্গ করেই বললেন তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। ইচ্ছেতো করছে উনার মাথাটা পুরো পিস পিস করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলি! আমার গরুর পাকস্থলী? লাইক সিরিয়াসলি!
মেজাজ বেজায় বিগড়ে যাওয়ায় অবশেষে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না আমি। রেগেমেগে দাঁত কটমট করে বলে উঠলাম,
.
—- এই কি বললেন আপনি? আমার গরুর পাকস্থলী?
.
আমার কথাটা যেনো কোনো প্রভাবই ফেলতে পারলো না উনার ওপর। উনি আমার রাগান্বিত রিয়াকশন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ড্রেনে ফেলে দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবেই বলে উঠলেন,
.
—- তা নয় তো কি? কোনো মানুষের পেটে এতো পানি ধরে কিভাবে তার সাইন্স তো আমার জানা নেই। এন্ড যেহেতু গরুর ৪ টে পাকস্থলী সেই হিসেবে মেইবি তোমার গরুর মতোই ৪ টে পাকস্থলী রয়েছে এন্ড দ্যটস হোয়াই অনায়াসেই বালতি বালতি পানি ধারণ করার অসম্ভব ক্ষমতা রাখো তুমি!
.
নীবিড় ভাইয়ার কথা শুনে পাশ থেকে ফিক করে হেসে উঠলো রাত্রি যার ফলস্বরূপ মেজাজটা আমার আগের থেকেও হাই লেভেলে পৌঁছে গেলো। আমি বিনিময়ে রেগেমেগে কয়েকটা কড়া জবাব দেবো তার আগেই উনি উঠে গিয়ে আম্মু আব্বুদের কাছে চলে গেলেন। আমি রেগেমেগে রাগগুলো নিজের মধ্যেই পুষে রাখলাম। উদ্দেশ্য একসময় রাগের জোয়ালামুখি ফাটিয়ে শূন্যে উড়িয়ে পুরো ইউনিভার্স ভ্রমণে পাঠিয়ে দেবো উনাকে।
.
প্লাটফর্মের রাউন্ড সিটে আমার বাম পাশে বসে আছে রাত্রি তার বাম পাশে বসেছে রুশো ভাইয়া, আবার ভাইয়ার পাশে বসেছে অগ্নি ভাইয়া। দেন নিত্য আপু দেন নীবিড় ভাইয়া এন্ড দেন উনার একদম গায়ে ঘেষে একরকম বাধ্য হয়েই বসতে হয়েছে আমায়। আব্বু আম্মুকে একটা কোকের বোতল, অগ্নি ভাইয়া আর নিত্য আপুকে একটা কোকের বোতল, রুশো আর রাত্রিকে একটা কোকের বোতল ধরিয়ে দিয়ে বর্তমানে অবশিষ্ট বোতলের ক্যাপ খুলছেন নীবিড় ভাইয়া। বোতলের ক্যাপটা খুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে উনি শান্ত গলায় বলে উঠলেন,
.
—- খাও!
.
বিনিময়ে আমি উনার থেকে বোতলটা নিলাম না। বরং মুখ ফুলিয়ে ঘুরিয়ে নিলাম আমি। আমার ব্যবহারে নিমিষেই কপাল কুঁচকে এলো উনার। উনি জোড় করে আমার হাতে কোকের বোতলটা ধরিয়ে দিয়ে ধমক দিয়ে উঠলেন,
.
—- নিজ ইচ্ছায় না খেলে কিন্তু জোড় করে খাইয়ে দিতে বাধ্য হবো আমি। এন্ড দেন তোমার এই সুন্দর ড্রেস নষ্ট হলে কিন্তু আমায় দোষ দিতে পারবে না।
.
উনার বিরুদ্ধে আর কিছু বলার সাহস পেলাম না আমি। চুপচাপ কোকের বোতল উঁচু করে কয়েক ঢোক খেয়ে নিলাম। ওমনি আবারও এক ধমক দিয়ে বসলেন উনি,
—- হা করে খেতে বলেছি তোমায়? গায়ে পড়ে যাবে না? চুমুক দিয়ে খাও স্টুপিড!
.
ব্যাস হয়ে গেলো! এটা কোনো কথা যে আমি চুমুক দিয়ে খাবো, উনি আবার সেই বোতলেই খাবেন? কি জানি হয়তো হা করেই খাবেন! যাক গে! আপাতত এতো ভেবে কাজ নেই। ৪৪০ ভোল্ট ওয়ালা এতোগুলো ধমক খেলে আবারও গুলা শুকিয়ে আসবে সাথে মান-সম্মানের ভয় তো আছেই। তাই চুপচাপ বোতলে চুমুক দিয়ে খেতে লাগলাম আমি। ওদিকে অগ্নি ভাইয়া আর নিত্য আপু হেসে এসে গল্প করতে করতে কোক খাচ্ছে। একবার ভাইয়া তো একবার আপু! মাঝে মাঝে একজন থেকে আরেকজনকে কোক পাস করতে করতে দুজনেই টান মেরে একসাথে ধরে ফেলছে বোতলটা। সাথেসাথেই ফিক করে হেসে ফেলছে দুজনেই। কত্তো সুইট একটা কাপল! দেখলেই যেনো চোখ দুটি একদম জুড়িয়ে যায়।
.
আর এদিকে রুশো ভাইয়া আর রাত্রির মধ্যে শেয়ার করে কোক খাওয়া নিয়ে তুমুলযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। রুশো ভাইয়া বলছে আগে রাত্রিকে খেয়ে তারপর নাহয় রুশো ভাইয়াকে দিতে কিন্তু না তাতেও হচ্ছে না রাত্রির। মোটকথায় ও চুমুক না দিয়ে খেতে পারে না, আবার রুশো ভাইয়ার এতে কোনো প্রবলেম না থাকলেও ওর নিজেরই নিজেকে নিয়ে প্রবলেম। শেষমেশ ওদের যুদ্ধে হতাশ হয়ে নীবিড় ভাইয়া গেলেন সামনের স্টলে। হাতে দুটো স্ট্র নিয়ে ফিরলেন উনি।
স্ট্র দুটো ওদের বোতলে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন,
.
—– এর পরেও যদি এনি টাইপ অফ ফাইটিং হয়, তো সিরিয়াসলি আমি এখানেই শহীদ হয়ে যাবো!
.
নীবিড় ভাইয়ার কথায় ঠোঁট উল্টালো রাত্রি। পাশ থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো রুশো ভাইয়া। রাত্রি রুশো ভাইয়ার থেকে বোতল নিয়ে মনের সুখে গলা ভিজাতে লাগলো। আর রুশো ভাইয়া গালে হাত দিয়ে ড্যাবড্যাব করে রাত্রির খাওয়া দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
.
🌸
.
বোতলের অর্ধের কোক খেয়ে বোতলটা পাশে রাখতেই নির্দ্বিধায় বোতলটা হাতে নিয়ে চুমুক দিয়ে কোক খেতে শুরু করলেন নীবিড় ভাইয়া। আমার মুখ লাগানো বোতলে উনাকে নির্দ্বিধায় মুখ লাগিয়ে খেতে দেখে চোখ বড়বড় হয়ে এলো আমার। আমি অবাক চোখে উনার খাওয়া দেখছি বুঝতে পেরে বোতলে চুমুক দেওয়া অবস্থাতেই ভ্রু নাচিয়ে “কি হয়েছে?” জিজ্ঞাস করলেন উনি।
বিনিময়ে নিজের মাথাটাকে ডানে বামে ঘুরিয়ে “কই কিচ্ছু না তো!” বলে চোখ নামিয়ে নিলাম আমি।
মুখ ঘুরিয়ে রাত্রিদের দিকে তাকাতেই বিশাল এক সিক্রেট ক্যাপচার হয়ে গেলো আমার চোখে।
.
রাত্রি স্ট্র দিয়ে অর্ধেক কোক খেয়ে বোতলটা পাশে রাখতেই রুশো ভাইয়া নিজের স্ট্র টা ফেলে দিয়ে রাত্রির ঠোঁট লাগানো স্ট্রটাই মুখে নিয়ে কোক খেতে লাগলো।
রুশো ভাইয়ার কান্ড দেখে আমি আনমনেই ভাবতে লাগলাম “রুশো ভাইয়ার মতোও কেউ বুঝি প্রেমে পড়তে পারে? তাও আড়ালে আড়ালে এতোটা গভীর ভাবে!”
.
🌹
.
দেখতে দেখতে ঢংঢংঢং করে ট্রেনের ঘন্টা বেজে উঠলো। দীর্ঘ ১ ঘন্টা অপেক্ষার পর ভিআইপি তিতুমীর মহাশয় এসে হাজির হলেন অবশেষে।
আমরা তৎক্ষণাৎ উঠে লাগেজগুলো হাত নিয়ে প্লাটফর্মের কিনারার দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের “ঝ” বগির সিট হিসেবে ট্রেনের ঝ বগি সোজা আমাদের অবস্থানরত প্লাটফর্মের এই সাইডেই থামবে। তাই দৌড়াদৌড়ি করার দরকার পড়বে না ভেবেছিলাম সবাই। কিন্তু আমাদের চিন্তামুক্ত থাকতে না দিয়ে আজকে এই ওভার পপুলেশন, ধাক্কাধাক্কির চরম পর্যায়ে নিয়ে এসে ফেললো আমাদের। মানুষের গায়ে ধাক্কা লাগবে তাই নীবিড় ভাইয়া নিজের এক হাত দিয়ে আমায় নিজের সাথে চেপে ধরে আগলে রেখেছেন।
.
ট্রেন এসে থামতেই মানুষজন ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনে উঠতে শুরু করে দিয়েছে। কেউ কোনো বাধাই মানছে না। আব্বু লোকগুলোকে বলছে আগে যাত্রীদের নামতে দিতে বাট না এই অসভ্য লোকগুলো আব্বুর কথা কানেই নিচ্ছে না। এর মধ্যে একজন লোক আমায় ধাক্কা মেরে ট্রেনে উঠতে নিলেই নীবিড় ভাইয়া এবার রেগে গিয়ে ধমকে উঠলেন,
.
—– এই যে আপনারা কি শুরু করে দিয়েছেন হ্যা? এভাবে কেউ ট্রেনে ওঠে? ইডিয়েট! মেয়ে মানুষ আছে চোখে দেখতে পারেন না?
.
এর মধ্যেই এভাবে যাত্রীদের নামতে না দিয়ে আগেই পারাপারি করে ট্রেনে উঠতে দেখে টিটি এসে হুইসেল বাজিয়ে থামতে বললেন সবাইকে। লাঠি হাতে ধমকাতে লাগতেই সবাই চুপ করে থেমে গেলো। ট্রেনে থাকা যাত্রীরা ধীরে সুস্থে ট্রেন থেকে নেমে যেতেই আগে আমাদের মেয়েদের উঠাতে বললেন টিটি। আম্মু উঠতেই আব্বু আম্মুকে ব্যাগগুলো পাস করে দিলো। এরপর রাত্রি, নিত্য আপু আর আমাকে উঠিয়ে দিয়ে নিজেও উঠে পড়লো আব্বু। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আমার বা পায়ের জুতোটা উঠার সময়ই নিচে পড়ে গেলো। এই জ্যামের মধ্যে জুতো তুলাও সম্ভব নয় তাই কাউকে কিছু বললাম না চুপ করেই রইলাম আমি।

একে একে ভাইয়ারাও উঠে পড়লো। সিট গেইটের কাছেই থাকায় বেশিদূর যেতে হলো না আমাদের। এক পায়ে জুতো পরেই মুখ গোমড়া করে উইন্ডো সিটে বসে পড়লাম আমি। অগ্নি ভাইয়া আর নীবিড় ভাইয়ার পেছনে হঠাৎ চোখ যেতেই রুশো ভাইয়াকে না দেখে আমি আতংকিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
.
—- এই রুশো ভাইয়া কোথায়? ওঠে নি?
.
আমার প্রশ্নে বাকিরাও আশেপাশে চোখ বুলিয়ে রুশো ভাইয়াকে খুঁজতে শুরু করলো। অগ্নি ভাইয়া চিন্তিত হয়ে বললো,
—- আমাদের সাথেই তো উঠলো ও। গেলো কোথায়?
.
অগ্নি ভাইয়ার কথা শেষ হতে না হতেই হুইসেল বেজে উঠলো ট্রেনের। সামান্য ঝাঁকুনির সৃষ্টি করে ধীর গতিতে চলমান হতে লাগলো আমাদের অবস্থানরত তিতুমীর এক্সপ্রেস। নীবিড় ভাইয়া আর অগ্নি ভাইয়া কপালে হাত দিয়ে “ওহ শিট!” বলে রুশো ভাইয়াকে খুজতে উল্টো দিকে ফিরেই ছুট লাগাতেই থেমে গেলো। রুশো ভাইয়া হাতে আমার পড়ে যাওয়া জুতোটা ধরে মুখে শুকনো হাসি ফুটিয়ে হাঁপিয়ে যাচ্ছে। টপটপ করে স্বেদজল বেরিয়ে যাচ্ছে ভাইয়ার শরীর থেকে।
.
অগ্নি ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে রুশো ভাইয়াকে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—- নেমে গিয়েছিলিস কেনো তুই? আরেকটু হলেই তো ট্রেনটা মিস করে যেতি! উফফফ কি যে করিস না।
.
রুশো ভাইয়া আমার কাছে এগিয়ে এসে জুতোটা নিচে রেখে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললো,
—- ছুটকির জুতোটা পড়ে গিয়েছিলো ব্রো! ওটাই নিচে পড়ে থাকতে দেখতে পেয়ে আনতে নেমেছিলাম। তুমিই বলো এক পায়ে জুতো ছাড়া যাবে নাকি ছুটকি?
.
রুশো ভাইয়ার কথায় সবাই আমার পায়ের দিকে তাকালো আর আবিস্কার করলো যে আসলেই আমার এক পা উন্মুক্ত! আমি বাম পায়ে জুতোটা পড়ে নিয়ে রুশো ভাইয়াকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম,

—- জুতো পড়ে গেলে গেলো! তাই বলে তুমি ওভাবে নেমে গেলে কেনো ভাইয়া? এই যদি ট্রেনটা ছুটে যেতো! জানো কতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি?
.
রুশো ভাইয়া আমার নাক টেনে দিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
—- তোর সুপার ম্যান রুশো ভাইয়ের কিচ্ছু হতো না। ঠিকই উড়ে এসে উঠে পড়তাম। আপাতত উইংস না থাকায় পা দিয়েই দৌড়ে উঠতে হয়েছে এই যা।
.
খালাতো ভাই-বোন হবার সত্ত্বেও আমাদের মাঝে এতোটা ভালোবাসা দেখে উপস্থিত সবার চোখেই যেনো জলেরা এসে বাসা বাধতে লাগলো। অগ্নি ভাইয়া আর নীবিড় ভাইয়া এসে রুশো ভাইয়ার কাধে হাত রাখলো। অগ্নি ভাইয়া রুশো ভাইয়ার এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলো আরও একটু এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
.
—- তুই আসলেই একটা জিনিস বটে রুশো!
.
বিনিময়ে রুশো ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে দিলো। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে টুপ করে বসে পড়লো রাত্রির পাশে। যা দেখে আমরা সবাই ফিক করে হেসে ফেললাম। মুখ ফুলিয়ে রাত্রি চোখ ছোট ছোট করে রুশো ভাইয়াকে বললো,
—- এই আপনি এতো জায়গা থাকতে আমার পাশেই এসে বসলেন কেনো?
.
রুশো ভাইয়া ঠোঁট উল্টে ফিসফিস করে জবাব দিলো,
—- তা কাপলদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হবো নাকি?
.
বিনিময়ে রাত্রি আবারও মুখ ফুলিয়ে চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে ফোনে মুখ গুঁজে দিলো। আমি মুখ টিপে হেসে দিয়ে পূণরায় আমার উইন্ডো সাইড সিটে বসে পড়লাম আর অগ্নি ভাইয়া গিয়ে নিত্য আপুর পাশে বসে পড়লো। আমি বসতেই ধপ করে আমার পাশে বসে সিটে গা এলিয়ে দিলেন নীবিড় ভাইয়া। চোখ দুটো বুজে নিয়ে ডুব দিলেন কোনো এক অজানা ভাবনার জগতে।
ইচ্ছে করছে উনার সাথে কথা বলতে, হাতটা ধএএ ঝাকিয়ে বিরক্ত করতে। কিন্তু আমি উনার সাথে কথা তো বলবো না। আমার পাকস্থলীকে গরুর পাকস্থলী বলে অপমান? এতো সহজে ভুলবো না তো আমি!
.
🍂
.
অবশেষে ৩ ঘন্টার লম্বা ট্রেন জার্নি করার পর আমরা পৌঁছোলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য রাজশাহী রেইলওয়ে স্টেশনে। ঘড়িতে এখন সময় ১০ টা বেজে ৫ মিনিট।
এবারে ট্রেন থেমেছে সর্ব বামের প্লাটফর্মে। সহজভাবে স্টেশনের হিসেবে ১ নম্বর প্লাটফর্মে। বুক ভরে এক সতেজ শ্বাস টেনে দীর্ঘঃশ্বাস ফেললাম আমি। আমার মতে রাজশাহীর মতো এতো নিরিবিলি শহর সচারাচর হয় না। বিশেষ করে রাতের বেলা রাজশাহী শহরটা দেখতে একদম অন্যরকম লাগে। স্টেশন থেকে বেড়িয়ে আমাদের বাসা অব্দি রাস্তার মাঝের ঝাউগাছ গুলোতে মরিচ বাতি লাগানোর ফলে এক অদ্ভুৎ সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে পুড়ো সড়ক সহ তার চারিপাশ। স্টেশন থেকে বেড়িয়ে বাহিরে আসতেই ড্রাইভার আংকেল কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম আমরা। হয়তো আব্বু গাড়ি নিয়ে আসতে বলেছিলো উনাকে।

আম্মু আজকে রাতটা আমাদের বাসাতেই যেতে বললো নীবিড় ভাইয়া আর নিত্য আপুকে। নীবিড় ভাইয়া না করলেও আম্মুর সামনে উনার মতামত ঠিক খাটলো না। অগত্যাই তাদের আসতে হলো আমাদের বাসাতেই।
মাঝ রাস্তায় এসে রাত্রি চেয়েছিলো নিজ বাড়িতে নেমে যেতে কিন্তু অামি আটকে দেই ওকে। এতো রাতে আংকেল আন্টিকে না বিরক্ত করে একেবারে কাল সকালে যাওয়ার জন্য বলি রাত্রিকে। শেষমেশ আমার জেদের সামনে হার মেনে রাত্রিকেও আসতে হলো আমাদের বাসায়ই।
.
🌹
.
রাত ১১ টা বেজে ৩২ মিনিট।
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম আমরা। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত। একটা জিনিস ইতিমধ্যে আমার বোঝা হয়ে গেছে যে এবরোড গিয়ে ঘুরে বেড়ানো আর যারই হোক আমার কাম্য নয়। টেলিভিশনে দেশ-বিদেশের ছবি, ভিডিও এসব দেখেই পৃথিবীর বাকি সৌন্দর্য উপভোগ করতে হবে আমার।
.
আম্মু এতোক্ষণে ডিনার বানিয়ে ফেলেছে। তারই ডাক পড়ছে নিচ থেকে। আমি রাত্রি আর নিত্য আপুকে নিচে যেতে বলে ভাইয়াদের ডাকার জন্য পাশের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। এদের কানে আম্মুর ডাক যায় না কেনো কে জানে। কানে বোধহয় তুলে গুঁজে রয়েছে ৩ জনই।
.
ভাইয়াদের ঘরে গিয়ে অগ্নি ভাইয়া আর নীবিড় ভাইয়াকে টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে আবিষ্কার করলাম আমি। এতো রাতে শাওয়ার না নিলেই কি হতো না? ঠান্ডা বাধিয়ে ফেললে তখন তো দিব্যি বিছানায় শুয়ে উল্টাউল্টি করা ছাড়া আর গতি থাকবে না।
.
—- এই ভাইয়া, শাওয়ার নিলি কেনো এখন?
.
অগ্নি ভাইয়া বিছানায় বসতে বসতে বললো,
—- ফার্স্টলি রুশো শাওয়ার নিয়েছে দেন ওকে দেখে আমাদেরও ইচ্ছে হলো সো নিয়ে নিলাম। তাছাড়া ঘেমে গিয়েছিলাম কেমন যেনো বিদঘুটে ফিলিংস আসছিলো।
.
পাশে রুশো ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখলাম ভাইয়া ল্যাপটপে খুবই মনোযোগ সহকারে কিছু টাইপ করছে। আশেপাশের কোনো কিছুতেই মন নেই রুশো ভাইয়ার। এতো মনোযোগ সহকারে ঠিক কি টাইপ করছে তা তো দেখতে হচ্ছে! তাই পা টিপে টিপে ভাইয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগলাম আমি। রুশো ভাইয়া ইংলিশে স্টোরি লিখছে। কিন্তু কখনো তো ভাইয়াকে এতোটা মনোযোগ সহকারে স্টোরি লিখতে দেখিনি আমি। তাই আরোও একটু ভালো করে লেখাগুলো পড়ার জন্য হেলে পড়লাম আমি। রুশো ভাইয়া স্ক্রিনে আমার ছায়া দেখতে পেয়ে হকচকিয়ে উঠে তৎক্ষণাৎ ল্যাপটপ সাইডে রেখে দিলো। আমতাআমতা করে ভাইয়া বললো,
.
—- কিরে ছুটকি? এভাবে উঁকি ঝুঁকি মারছিস যে? হোয়াট হ্যাপেন্ড?
.
আমি রহস্য উদঘাটনে ব্যার্থ হয়ে ঠোঁট উল্টালাম। পর মুহূর্তে ব্যাপারটা পরেও দেখা যাবে ভেবে নিয়ে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললাম,
—- খেতে চলো আম্মু ডাকে।
.
রুশো ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
—- তুই যা আমরা যাচ্ছি।
.
আমিও আর কথা বাড়ালাম না। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে নেমে এলাম ডাইনিং রুমে।
.
🍁
.
আমার সামনে জলজ্যান্ত দুধের রাজ্যের রাক্ষসেরা হাউমাউখাউ করে যাচ্ছে। ভয়ে এদিকে আমার গলা শুকিয়ে যাওয়ার সাথে কান্নাও পাচ্ছে বেশ। আমি শুধু কাঁপাকাঁপা ঠোঁটে উচ্চারণ করছি “না….না…না…!” ওমনি রাক্ষসগুলো তাদের ইয়া লম্বা দাঁত বের করে বলছে,
.
—- হাহাহাহা! আজ তোকে কে বাঁচাবে অনন্যা….?
.
🌷
.
—- উফফফ অনু! খেয়ে নে না প্লিজ! দেখ হরকিক্স, কমপ্লান, বুস্ট তিনটে ফ্লেবারই এনেছি তাও তোর দোহাই লাগে দুধটা খেয়ে নে।
.
—- ছুটকি তুই দুধ টা খেয়ে নে, আমি তোর জন্য এত্তোগুলো চকলেট নিয়ে আসবো! তাও প্লিজ খেয়ে নে বোনটি।
.
ওদের কোনো কথাই ইফেক্ট ফেলতে পারছে না আমাতে। অগ্নি ভাইয়া আর রুশো ভাইয়াকে বর্তমানে আমার কাছে দুধের রাজ্যের রাক্ষসই বলে মনে হচ্ছে।ওদের দু হাতে দু দুটো দুধের গ্লাস সাথে একজনের হাতে হরলিক্সের বোয়াম আর আরেকজনের হাতে কমপ্লানের বোয়াম। পেছনে দাঁড়ানো নিত্য আপুর হাতে আছে বুস্ট! বোঝাই যাচ্ছে ফুল প্রিপারেশনের সাথে মেরে ফেলতে এসেছে সবাই আমায়।

পাশের চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে আমাকে দুধ খাওয়ানো অভিযান নিয়ে চলা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হাই তুলতে তুলতে দেখছে রাত্রি। আর দরজায় হেলান দিয়ে আরামে ফোনে মুখ গুঁজে রয়েছেন নীবিড় ভাইয়া।
.
আজকে ডিনারে পর ঘরে কিছুসময় রেস্ট নিচ্ছিলাম ঠি সেই সময়ই দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে আক্রমণ চালিয়ে বসে ভাইয়ারা সাথে নিত্য আপুও। তাদের মেইন অস্ত্র রাইফেল বা গ্রেনেড হলেও হয়তো আমি মুখ বুজে ঠুস করে মরে যেতাম বোধহয় বাট তাদের মেইন হাতিয়ার হচ্ছে দুধ নামক আমার সবচেয়ে ভয়ংকর দুশমন। যাকে দেখলে আমি যুদ্ধ করার বদলে ময়দান ছেড়েই পালিয়ে যাই। সেই দুধকেই খাওয়াতে এসেছে ভাইয়ারা! পালানোর কোনো পথও নেই। দরজা বন্ধ করে রাখা হয়েছে আর তাতেই হেলান দিয়ে রয়েছেন নীবিড় ভাইয়া। আমি শুধু খাবো না বলে না না করতে করতে ঘরের এই দিক থেকে ওইদিক ছুটে চলেছি। আমার পেছন পেছন দুধের গ্লাস হাতে ছুটে চলেছে ভাইয়ারাও।
.
প্রায় ১৫ মিনিট যাবৎ দুধ খাবো না মিশন চলার পর নীবিড় ভাইয়া নিজের ফোনটা পকেটে ভরে নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়ে সিল্কি চুলগুলোতে হাত চালাতে চালাতে বলে উঠলেন,
.
—- তোদের দ্বারা ওটাকে সাইজ করা হবে না বুঝেছি। দুধের গ্লাস রেখে বের হ সবাই। ওটাকে আমি ছাড়া কেউই টাইড দিতে পারবে না।
.
নীবিড় ভাইয়ার কথার ওপর আর কেউ কোনো কথা বললো না। বলবেই বা কিভাবে? টানা ১৫ মিনিট ধরেই তো চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে সবাই। বাট আফসোস কোনো পজিটিভ ফলাফল পায় নি তারা।
রুশো ভাইয়া একবার আমার অসহায় ফেইস দেখে তো একবার নীবিড় ভাইয়ার গম্ভীর ফেইস দেখে নিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো,

—– শেষ শেষ শেষ। আমার ছুটকি আজকে শেষ। ভাইয়ের কথা শুনলি না তো ছুটকি! এবার দেখ ব্রো তোর ওপর হাইব্রিড বোম্ব ফুটাবে!
.
.
.
চলবে………………💕
#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৫৩♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
—- দে…দে..দেখুন একদম এগোবেন না। আমি কিন্তু চেঁচিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নেবো!
.
নাহ এবারও কোনো কাজ হলো না। সেই একই রকম ভাবে ভিলেনি চাহনী যুক্ত করে স্নিগ্ধ মুখখানাটা কে একেবারে ভয়ংকর বানিয়ে এগিয়ে আসছেন উনি আমার দিকে। উনি যতই আমার দিকে এগোচ্ছেন আমি ততই এক পা এক পা করে পিছিয়ে যাচ্ছি। পেছাতে পেছাতে এক পর্যায়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো আমার। উনি ঠোঁটে আবারও সেই মারাত্মক ভাবে ঘায়েল করা বাঁকা হাসির রেশ ফুটিয়ে ঝুঁকে পড়লেন আমার দিকে। সাথেসাথেই ভয়ে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম আমি।
.
—- আবারও জিজ্ঞেস করছি, দুধটা খাবে কি না? ইয়েস অর নো?
.
এবারেও আমি নিজের মাথাটা কে ডানে-বামে নাড়িয়ে অসম্মতি জানালাম।
আবারও সেই একই হতাশা জনক নেগেটিভ উত্তর আসায় চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো উনার। উনি নিজের এক হাত দিয়ে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে হেঁচকা টান মেরে সোজা উনার বুকের ওপর ফেললেন আমায়। ঘটনার আকস্মিকতায় চরমভাবে ভড়কে গেলাম আমি। গলা শুকিয়ে আবারও কাঠ হয়ে এলো আমার। এই মুহুর্তে পানি না পেলে বোধহয় আমি মরেই যাবো! বর্তমানে যদি আমার দুটো পাখা থাকতো তবে উড়ে গিয়ে পানির সন্ধানে “Thirsty Crow!” এর মতো কলসিতে পাথর না ছুড়ে পুরো কলসির মধ্যেই ঢুকে পড়তাম আমি।
.
উনি আমার কোমড়টা আগের থেকেও শক্ত করে চেপে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে নেশাভরা কন্ঠে বলতে লাগলেন,
—- লাস্ট টাইম বলছি খেয়ে নাও৷ নয়তো কন্ট্রোললেস হয়ে পড়বো আমি। প্লিজ ডু ইট ফাস্ট অনন্যা!
.
এবার আমি যে হাত পা ছাড়িয়ে কান্না করবো তারও পথ রাখলেন না উনি। আমি জমে পুরো ফ্রিজড জয়ে গিয়েছি। বুঝতে পারছি আজ হয় দুধ খেয়ে অর্ধমৃত হয়ে থাকতে হবে নয়তো উনার কাছেই খুন হয়ে যেতে হবে আমায়।
অবশেষে যখন আর কোনো পথ খুঁজে পেলাম না তখন শুকনো গলায় কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলে উঠলাম,
.
—- খা…খাবো! পি…প্লিজ এবার সরুন। আমার ভয় করছে!
.
কিন্তু অদ্ভুত, আমার কথাটা যেনো উনি আমার এতো কাছে থেকেও শুনতে পেলেন না। আমার কোমর চেপে ধরেই আরোও গভীরভাবে মিশিয়ে নিলেন আমায় নিজের বুকের সাথে। এদিকে আমার শরীরে মারাত্মক কম্পন শুরু হয়ে গিয়েছে। জানি না কেনো এমন হচ্ছে। উনার সংস্পর্শে আমি এর আগে যে যাই নি এমনটা নয় তবে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে উনার এমন আচরণ ঠিক নিতে পারছিনা আমি। উনি দিন-দুনিয়া ভুলে গিয়ে আলতো করে আমার কানের লতিতে ঠোঁট ছুইয়ে দিলেন নিজের। ভয়ে, আতংকে উনার শার্ট খামছে ধরলাম আমি। এবার একটু জোড়েই বলে উঠলাম,
.
—- ভা..ভা…ভাইয়া….! খুবই পিপাসা পেয়েছে। ছেড়ে দিন আমায়। পানি খাবো!
.
সাথেসাথেই ফট করে ছেড়ে দিয়ে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন উনি। দুহাতে নিজের চুলগুলো টানতে টানতে অস্পষ্ট ভাবে বুলি আওড়াতে লাগলেন। যার মৃদু আওয়াজ আমার কান পর্যন্ত পৌঁছোলেও বোধগম্য হলো না মোটেই।
.
—- হোয়াটস রং উইথ ইউ নীবিড়? কন্ট্রোল কন্ট্রোল! হোয়াই আম বিহেভিং লাইক আ সিক ম্যাড! হোয়ায়!
.
—- ভাইয়া কি হয়েছে আপনার?
.
আমার প্রশ্নে চমকে উঠলেন উনি। টানতে থাকা চুলগুলো থেকে হাত সরিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার মুখ পানে ফিরে তাকালেন উনি। দুধের একটা গ্লাস হাতে নিয়ে উনি বলে উঠলেন,
.
—- নাথিং! খেয়ে নাও চটপট আর আমায় উদ্ধার করো।
.
আবারও দুধের গ্লাসটা দেখেই চোখ টলমল করে উঠতে শুরু করলো আমার। দুধের গ্লাসের দিকে আমায় এভাবে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে উনি আবারও বলে উঠলেন,
.
—- ওভাবে তাকিয়ে থেকে কোনো লাভ নাই। এই দু গ্লাস দুধ খতম না করলে এক ফোটাও পানি পাবে না। আর তুমি নাকি তৃষ্ণার্ত! সো ড্রিংক ইট। ইট উইল রিমুভ ইওর থার্স্টটিনেস ইজিলি।
তা এখন বলো কোনটা মিক্স করবো? হরলিক্স, কমপ্লান অর বুস্ট? নাকি এমনিতেই খেয়ে নেবে, কোনটা?
.
উনার কথায় শুকনো ঢোক গিলে আশেপাশে চোখ বুলাতে লাগলাম আমি। আমায় কিছু খুঁজতে দেখে উনি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
.
—- এদিক ওদিক খোঁজো কি? মেইন জিনিস তো আমার হাতেই৷
.
আমি খানিকটা ইতস্তত বোধ করে আমতা-আমতা করে বলে উঠলাম,
—- ইয়ে মানে লবণ!
.
উনি যেনো আমায় লবণ খু্ঁজতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। খানিক ভেবে নিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
—- লবণ দিয়ে হবে কি?
.
আমি ঠোঁট উল্টে মিনমিন করে বললাম,
—- দুধে গুলাবো, তারপর চামচ দিয়ে এক স্পুন এক স্পুন করে খাবো! নাহলে খেতে পারবো না। হেহে!😅
.
আমার জবাবে ঠাস করে কপালে নিজের হাত দিয়ে চাপড় মেরে দিলেন উনি। হতাশ হয়ে উনি বললেন,
—- এতো কষ্ট করার পর খাবে তো খাবে সাথে দুধের সব গুণাগুণ নষ্ট করেই খাবে।
.
বলেই কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে দরজা খুলে কিচেনে চলে গেলেন উনি। লবণের বোয়াম ধরে সাথে করে নিয়ে এসে ট্রের ওপর রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
—- আমি গুলিয়ে দেবো? নাকি তারও পরিমাণ আপনি করে দেবেন?
.
আমি দাঁত বের করে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললাম,
—- পরিমাণ মতো আপনিই দিয়ে দেন। সমস্যা নেই। আর কমপ্লান বা বুস্ট মেশাতে হবে না। হরলিক্সটাই মিশিয়ে দিন।
.
উনি চোখ মুখ কুঁচকে দুধে হরলিক্স আর লবণ ছেড়ে দিয়ে শব্দ করতে করতে চামচ দিয়ে গোলাতে লাগলেন। যেনো কোনো দুধের গ্লাসে নয় স্বয়ং আমার পেটের রেচন প্রক্রিয়ায় কিডনির বদলে উনিই নিযুক্ত হয়েছেন।😑
.
🌹
.
কোনোরকমে এক গ্লাস হরলিক্স একটু একটু করে চামচ দিয়ে খেয়ে শেষ করে তবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। সাথে থাকা আরো একটা দুধের গ্লাস আমাকে মেরে ফেললেও আর এখন খাওয়াতে পারবেন না বুঝে অগত্যাই নীবিড় ভাইয়াকেই অপর গ্লাসটা শেষ করতে হলো।
কি সুন্দর ঢকঢক করে খেয়ে পুরো গ্লাসটা চোখের পলকে ফিনিশ করে দিলেন উনি। যেনো দুধ নয় অমৃত পান করছেন উনি।
.
ট্রের ওপর গ্লাস গুলো নিয়ে যেতে যেতে উনি বলে উঠলেন,
—- এটা কিন্তু জাস্ট আজকের জন্য নয়। ডেইলি খেতে হবে তোমায়। সো বি প্রিপেয়ার্ড। নিত্য আর রাত্রিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। বেশি রাত জাগবা না। ভার্সিটি যেতে হবে কাল থেকে! আল্লাহ হাফেজ!
.
বলেই দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে শিটি বাজাতে বাজাতে চলে গেলেন উনি সাথে দিয়ে গেলেন এক বুক ফাটা বেদনা। এবার ভীষণ কান্না পাচ্ছে আমার। এরকম অত্যাচার প্রতিদিন সহ্য করতে হবে কল্পনা করতেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
.
🍂
.
ঠোঁট উল্টে দু গালে দু হাত রেখে মুখ ফুলিয়ে বসে রয়েছি আমি। সামনেই নিত্য আপু আয়নার সামনে নিজের লম্বা লম্বা চুলগুলোতে চিরুনি চালিয়ে যাচ্ছে। আর এদিকে রাত্রি আমার মুখ পানে একবার করে তাকাচ্ছে সাথে মুখ টিপে হেসে চলেছে। আমি অনন্যা দুধ খেয়েছি এই নিয়ে বোধহয় ইতিহাস সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে যার দরুন রাত্রির সেই ইতিহাস নিয়ে চরম ইন্টারেস্ট সাথে ফিলিং ফানি মুড তো যুক্ত রয়েইছে রাত্রির।
ওর এই গা জ্বলানো হাসি দেখে ইচ্ছেতো করছে বক্সিং এর মতো ঢিসুম ঢুশুম করে মেরে নাক-মুখ ফাটিয়ে দেই। কিন্তু আফসোস আমার শরীরে বক্সিং করার মতো শক্তির ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই।
.
রাত এখন ১ টা বেজে ১৬ মিনিট…..
হুট করে রাত্রির ফোনের রিং টনের আওয়াজে চমকে উঠলাম আমি। রাত্রি খানিকটা অবাক হলো এতো রাতে কারোও কল করায়। শুয়া থেকে উঠে বসে ফোন টা হাতে নিতেই চোখ বড়বড় হয়ে এলো রাত্রির। এতো রাতে বাসা থেকে ফোন, কোনো সমস্যা হলো না তো? তাই আর দেড়ি না করে চট করে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে ভয়ে ভয়ে রাত্রি বলে,
.
—- হ্যালো আম্মু?
.
ওপাশ থেকে মৃদু সুরে রিমি বলে উঠে,
—- আম্মু না আমি রিমি। কি করছো আপু?
.
রিমির অস্বাভাবিক কন্ঠে বিচলিত হয়ে রাত্রি আবারও প্রশ্ন করে,
—- কিরে তোর গলাটা এমন শুনাচ্ছে কেনো রিমি? কি হয়েছে? এতো রাত অবদি জেগে আছিস কেনো? আম্মু কই?
.
ওপাশ থেকে কাঁপাকাঁপা গলায় রিমি বলে,
—- কিছু হয়নি আপু, ঘুম আসছেনা। জ্বর এসেছে একটু তো তাই। আম্মু মাথায় জলপট্টি দেবে দেখে পানি আর কাপড় আনতে গিয়েছে, তুমি কাল জলদি চলে এসো আপু। তুমি আসলেই আমি সুস্থ হয়ে যাবো দেখো। অনেক মিস করছি তোমায়।
.
রিমির জ্বর কথাটা কান পর্যন্ত পৌঁছোতেই রাত্রির মুখটা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করলো। ছোট বোনটা কে যতই বকা-ঝকা করুক না কেনো বা যতই তার সাথে হুটহাট মারামারি করুক না কেনো দিনশেষে ঠিকই রাত্রি গিয়ে রিমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। একমাত্র আদরের ছোট বোনকে বাইরে থেকে কঠিন রূপ দেখালেও ভেতরে ভেতরে ভালোবাসে রাত্রি। এক কথায় অসম্ভব রকমের ভালোবাসে। তাইতো সামান্য জ্বর নামক শব্দটা শুনেই ঘামতে শুরু করে দিয়েছে সে। রাত্রি ব্যস্ত হয়ে খাট ছেড়ে উঠতে উঠতে রিমি কে বলে,
.
—- আমি আসছি তুই থাক। ১০ মিনিটের মধ্যেই আসছি।
.
বলেই ফোনের লাইনটা কেটে গ্রাম থেকে ফেরার পথে নিজের গুছিয়ে রাখা ব্যাগটা হাতে নিলো রাত্রি৷ আমি আর নিত্য আপু রাত্রিকে এতো ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বেড়োতে দেখে চটজলদি বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লাম। রাত্রির সামনে গিয়ে বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলাম,
.
—- কি হয়েছে? এতো রাতে হন্তদন্ত হয়ে ব্যাগ হাতে কোথায় যাচ্ছিস?
.
রাত্রি কোনোরকমে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
—- রিমির জ্বর! আমাকে বাসায় যেতে হবে। আমার বোনটা অসুস্থ!
.
রিমি অসুস্থ শুনে আমারও মন টা খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু এতো রাতে রাত্রিকে একা বাসায় যেতে দেওয়াও তো যাবে না। হাজার হোক মেয়ে মানুষ। মাঝ রাতে রাস্তায় খারাপ মানুষের আনাগোনা থাকে, তাই রাত্রিকে বাধা দিয়ে বললাম,
—- এতো রাতে বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না রাত্রি, বিপদ হতে পারে।
.
আমায় কথায় নিত্য আপুও শায় দিয়ে বললো,
—- কাল ভোর বেলায় যেও রাত্রি! কিছু হবে না চিন্তা করো না।
.
কিন্তু রাত্রি নাছোড়বান্দা! সে যখন এখন যাবে বলেছে তো যাবেই। আমরা তো আর ওকে এভাবে একা ছাড়তে পারি না তাই নিত্য আপু খানিক ভেবে বললো,
—- তুমি একটু দাঁড়াও, আমি ভাইয়াদের মধ্যে কাউকে বলি তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসতে। আর আমার কাছে মেডিসিন আছে তোমায় দিচ্ছি নিয়ে যেও।
.
বলেই আপু ছুট লাগালো পাশের ঘরে।
.
খানিক বাদেই ভাইয়ারা ঘর থেকে বের হয়ে এলো। এদিকে নিত্য আপু নিজের ব্যাগ থেকে মেডিসিনের একটা পাতা বের করে রাত্রির হাতে ধরিয়ে দিলো। রুশো ভাইয়া শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে এসে বলে উঠলো,
—- চলো এটম বোম্ব তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসি।
.
রুশো ভাইয়া রাত্রিকে নিয়ে যাবে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো রাত্রির। নিমিষেই চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো তার। কিন্তু আপাতত করার কিছুই নেই তাই চুপচাপ ব্যাগ হাতে আমাদের “আল্লাহ হাফেজ” বলে বড়বড় পায়ে বেড়িয়ে গেলো রাত্রি রুশো ভাইয়ার সাথেই।
ওরা যেতে আমরা এক ঘরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম রুশো ভাইয়ার ফেরার। ভাইয়া ফিরলেই একেবারে শুতে যাবো সবাই।
.
🍁
.
গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে সময় লাগবে বিধায় অগ্নির বাইক নিয়েই রওনা দিয়েছে রুশো-রাত্রি। বাইকে রুশোর পেছনে বসতে অস্বস্তি হলেও মনে শুধুমাত্র বোনের অসুস্থতার কথাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে রাত্রির। যার দরুন অস্বস্তিকর ভাবখানা পুরোপুরি গ্রাস করতে পারছে না রাত্রিকে। বারবার শুধু বোনের ভার কন্ঠে বলা কথা গুলোই মনের মাঝে আওড়ে চলেছে সে।
.
অনন্যাদের বাড়ি থেকে মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তার অর্ধেক পাড় করতেই খুব জোড়ে সড়েই বাইকে ব্রেক কষলো রুশো৷ হঠাৎ এমন ঝাঁকুনিতে টাল সামলাতে না পেরে রুশোর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো রাত্রি। রেগে মেগে কেবল রুশো কে হঠাৎ এভাবে ব্রেক কষার কারণ জানতে চাইবে তার আগেই সামনে থেকে এক দল লোকের বিশ্রী হাসির আওয়াজ কানে ভেসে আসলো তার।
.
—- একিরে, এতো পুরো মেঘ না চাইতেই জল মামা! মাঝ রাতে যে আকাশ থেকে চাঁদ একদম রাস্তায় নেমে এসেছে।
.
বলেই সামনে থাকা মাতাল ছেলেগুলো আবারও বিশ্রী ভাবে হাসতে শুরু করে দিলো। মাতাল ছেলেগুলোকে দেখে ভয়ে রাত্রি মুখ লুকালো রুশোর পেছনে। রুশো ছেলেগুলোর পা থেকে মাথা অবদি চোখ বুলিয়ে বলে উঠলো,
—- হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট ব্রোস? এভাবে পথ আটকালেন কেনো? ডোন্ট মেকআপ দ্য রোড প্লিজ , উই আর গেটিং লেইট।
.
ছেলেগুলোর মাঝখানে একজন রুশোকে দেখে বাকিদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
—- এ এবার কে রে? বিদেশি না বাংলাদেশি?
.
৪ জনের মধ্যে আরেকজন বললো,
—- দেখ তুই বিদেশের মাল বিদেশে গিয়ে এসব ইংরেজিতে পকপক করিস। আপাতত পেছনের মাল টাকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে কেটে পর।
.
রুশো মাথা ঘুরিয়ে রাত্রির ভয়ে কুঁকরে যাওয়া শুকনো মুখখানা দেখে নিয়ে ইশারায় নামতে বললো তাকে। রাত্রি অবাক চোখে রুশোর দিকে তাকাতেই রুশো নিজের ঘন পল্লব বিশিষ্ট চোখের পলক ঝাপটে নিশ্চিন্ত থাকতে বললো তাকে। রাত্রি ভয়ে ভয়ে বাইক থেকে নেমে পেছনে গিয়ে দাড়ালো। রুশো বাইকটা স্ট্যান্ড করে রাত্রির সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছেলেগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
.
—- লিসেন টলমলে ব্রোস, আমি দেশের মানুষ দেশেই আছি এন্ড আকাশের চাঁদ ও আকাশেই আছে। বাট এখন যদি তোমরা আমাদের পথ না ছেড়ে স্টিল এভাবেই থাকো দেন তোমরা ঠিক কোন হসপিটালে যাবে বা দেশে যাবে আই রিয়েলি ডোন্ট নো! তাই মানে মানে কেটে পড়ো ভাইয়েরা আমার।
.
রুশোর কথায় রেগে উঠলো ছেলেগুলো। তাদের মধ্যে যে লিডার সে বাকিদের বলে উঠলো,
—- খাড়ায় খাড়ায় তামাশা দেখোস তোরা? যা এটাকে মেরে মালটা কে নিয়ে আয়।
.
“জ্বি বস” বলেই তিনটে ছেলে তেড়ে রুশোর দিকে এগোতেই রুশো দুহাত দেখিয়ে থামতে ইশারা করে আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো,
—- আরে আরে ওয়েট ওয়েট ওয়েট। ওই দেখো, আকাশে হাতি উড়তেছে।
.
রুশোর কথায় অবাক হয়ে ছেলে তিনটে আকাশের দিকে তাকিয়ে উড়ন্ত হাতি খুঁজতে লাগলেই রুশো পেছন থেকে লাথি মেরে তিনজনকেই ফেলে দিলো রাস্তায়।
ওদের বস রেগেমেগে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
—- আবে আহাম্মকেরা, মার শালাকে নাহলে আমার হাতেই মরবি তোরা।
.
ছেলে তিনটি কোনোরকমে কোমড় ধরে উঠে রুশোর দিকে এগোতে নিলেই রুশো উল্টো দিকে ঘুরে ছুট লাগালো। ওর পেছন পেছন ছুট লাগলো বাকি তিনজনও। একটা নির্দিষ্ট জায়গা জুড়ে গোল গোল ঘুরতে লাগলো রুশো। রুশোকে ধরতে ওর পেছন পেছন গোল গোল ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে ধপ করে রাস্তায় বসে পড়লো তিনজনই। রুশো ওদের অবস্থা দেখে ভেংচি কেটে বলে উঠলো,
.
—- ব্যাট্টা মাতালের দল। আমাকে ধরতেই পারছিস না আর তো মারবি? হাহ! আবে এ বুল্ডোজার! চাল জাস্ট তুই বাকি আছিস। কাম কাম….!
.
হাতের ইশারায় ছেলেগুলোর লিডারকে ভেঙ্গিয়ে ডাকলো রুশো। এতে চরমভাবে রেগেমেগে পুরো ফায়ার হয়ে তেড়ে আসলো ছেলেটা রুশোর দিকে।
রুশোর পেট বরাবর পাঞ্চ মারার উদ্দেশ্যে হাত চালাতে নিলেই রুশো ফ্লিপ মেরে ডান দিকে সরে গিয়ে সোজা পা দিয়ে লাথি মেরে দিলো ছেলেটার মেইন পয়েন্টে 😑।
ব্যথায় চেচিয়ে উঠে নিজের মেইন পয়েন্ট ধরে ধুপুস করে রাস্তায় বসে পড়ে ছটফট করতে শুরু করলো ছেলেটা।
.
রুশো হাসতে হাসতে বললো,
—- হেহে দেখ এবার কেমন লাগে! রুশোর পেছনে লাগা তাইনা? গন্ডার!
.
এদিকে রুশোর এরকম ফাইটিং দেখে ভয় পাবার বদলে উল্টো পেট চেপে ধরে হাসতে শুরু করে দিলো রাত্রি। এই ফাঁকে বাকি তিনটে ছেলেদের মধ্যে একজন চুপিচুপি রাত্রির পেছনে গিয়ে রাত্রির হাত চেপে ধরে টানতে শুরু করে দিলো। রাত্রি নিজের হাত ছাড়াতে ছোটাছুটি করতে করতে চেঁচিয়ে রুশো কে ডেকে উঠলো,
.
—– রুশো ভাইয়া……..!
.
রাত্রির চিৎকারে চটজলদি উল্টো দিকে ফিরলো রুশে রক্তচক্ষু নিয়ে। রুশোর চোখদুটো লাল টকটকে বর্ণ ধারণ করলো নিমিষেই। রুশো দৌড়ে গিয়ে সোজা বুক বরাবর লাথি মেরে দিলো ছেলেটার। যার দরুন মুখ থুবড়ে হুমড়ি খেয়ে রোডে পড়ে গেলো ছেলেটা। রুশো হাতের মুঠো শক্ত করে বসে পড়ে ছেলেটার সেই হাত উল্টো দিকে ঘুরিয়ে মুচড়ে দিলো যেই হাত দিয়ে রাত্রির হাত ধরেছিল সে।
এতো জোড়ে হাত মুচড়ে দেওয়ায় চিৎকার করে আঘাতের জানান দিলো ছেলেটি। কিন্তু রুশোর তাতে কোনো যায় ই আসলো না। সে নিজের যতো রাগ আছে তা ঝেড়ে সোজা ফেলতে লাগোলো ছেলেটার ওপর। বুকের ওপর পা তুলে দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে দিলো ছেলেটাকে রুশো। মারতে মারতেই চিৎকার করে বলতে শুরু করলো সে,
.
—- সাহস কি করে হলো তোর আমার কলিজায় হাত দেবার? ভালো ব্যবহার করছিলাম সহ্য হচ্ছিলো না না? সালা…..! লাথো কা ভূত বাতো সে নেহি মানতে! তোকে তো আজকে মেরেই ফেলবো আমি।
.
বলে ক্রমাগত মারতে থাকলো রুশো ছেলেটাকে। এক পর্যায়ে আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করে দিতে থাকলো ছেলেটার শরীর রুশো।
এদিকে রাত্রি রুশোর এমন রূপ দেখে ভয়ে জমে গিয়েছে। থরথর করে কাঁপছে তার পুরো শরীর। কি বললো রুশো রাত্রিকে? রাত্রিকে টাচ করা রুশোর কলিজায় হাত লাগানো হলো কিভাবে? এমন নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো রাত্রির ছোট্ট মাথাটায়!
.
.
.
চলবে……………..💕