প্রেম আমার পর্ব-৫৭+৫৮

0
6640

#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৫৭♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
কেটে গেছে আরো দু দুটো দিন। রুশো ভাইয়া সেদিন বাড়ি ফেরার পর পুরো একটা দিন ঘরবন্দী ছিলো। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনো কাজই হয়নি। রুশো ভাইয়া নিজের মতোই ঘরবন্দী থেকেছে। এদিকে রুশো ভাইয়ার হঠাৎ এরকম আচরণে খালু-খালামুনি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন। কোন বাবা-মাই বা তাদের সন্তানকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখতে পারবে? তাও রুশো ভাইয়ার মতো একজন হাস্যজ্বল প্রাণবন্ত ছেলেকে!
.
সেদিন ক্যাফে থেকে ভাইয়াকে অনেক বুঝিয়ে বাসায় নিয়ে আসি আমরা। ভাইয়াকে স্বাভাবিক করবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাই কিন্তু তার একটাই কথা “আমাকে একটু একা থাকতে দাও প্লিজ”। ভাইয়ার এই কথার ওপর নির্ভর করেই একা থাকতে দেই আমরা তাকে। সাথে বড্ড ভয়ও হচ্ছিলো, যদি কোনো ভুল করে বশে ভাইয়া! কিন্তু আমায় সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে পরের দিন বেলা ১২ টার দিকেই রুশো ভাইয়া হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেড়িয়ে ঠিক আগের রূপে কনভার্ট হয়ে গিয়েছে। যেনো সেদিন সন্ধ্যের কোনো ঘটনাই বাস্তবে ঘটে নি, শুধুমাত্র কোনো এক দুঃস্বপ্ন ছিলো তা।
বর্তমানে রুশো ভাইয়া দৈনন্দিন কাজের অযুহাতেই অফিস গিয়েছে।
.
তবে আর কেউ জানুক বা নাই জানুক আমি জানি রুশো ভাইয়া স্বাভাবিক থেকেও স্বাভাবিক নেই। ভেতর থেকে নির্মম ভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রয়েছে রুশো ভাইয়া। শুধুমাত্র বাইরে থেকেই নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর নিছক অভিনয় মাত্র করে চলেছে সে। রুশো ভাইয়া এরকমই, যেখানে সামান্য আঘাতে কিংবা আরশোলা দেখেই চেঁচিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে সেখানে পাহাড় সমান আঘাতও বুকে পাথর চেপে হাসির আড়ালে লুকিয়ে ফেলে নির্দ্বিধায়।
.
রাত্রি এই নিয়ে আমায় বেশ কয়েকবার ফোন করেছে কিন্তু আমি কল রিসিভ করিনি। বড্ড বেশি অভিমান কাজ করছে আমার। ও কি পারতো না ঠিক করা বিয়েটা ভেঙে ফেলতে? কি কমতি রয়েছে রুশো ভাইয়ার মাঝে? তাছাড়া বিয়েটা তো হয়নি যে রুশো ভাইয়াকে মেনে নিতে ওর খুব বেশি সমস্যা হবার কথা। বিয়ে ঠিক হয়েছে মাত্র। এখনোও হাতে সময় রয়েছে। ও কি পারতো না আমার ভাইটার হাসি কেড়ে নেওয়ার বদলে তা দশগুণ বাড়িয়ে দিতে?
.
এদিকে নীবিড় ভাইয়া, অগ্নি ভাইয়া আর নিত্য আপুও চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। অগ্নি ভাইয়া তো রাত্রিকে হাতের সামনে পেলে বোধহয় তেল ছাড়াই ফ্রাই করে ফেলে এতোটা রেগে আছে। নিত্য আপু বর্তমানে অগ্নি ভাইয়ার এই ফ্রাই করার বদবুদ্ধিটাকে প্রশমিত করে কোনো মানসম্মত সমাধান খুঁজে বের করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছে। আর নীবিড় ভাইয়া রয়েছেন গভীর ভাবনায় মগ্ন। যেনো ক্যালকুলাসের সবথেকে জটিল সমস্যাটা তিনি নিজের ব্রেইনের মধ্যেই খাতা-কলম-ক্যালকুলেটর ছাড়া সলভ করে ফেলবেন।
.
রুশো ভাইয়া বলেছে রাত্রিকে যেনো এই নিয়ে কোনো কথাই না বলি আমরা। ভাইয়ার মতে ভালোবাসার ভুল টা তো সেই করেছে। এখানে রাত্রির দোষ তো নেই। সে কি বলেছিলো রুশো ভাইয়াকে যাতে তাকে ভালোবাসে? বলেনি তো। সেই হিসেবে তার কোনো দায় থাকে না কোনোভাবেই।
হুম মানছি রুশো ভাইয়ার লজিকে যুক্তি রয়েছে কিন্তু ও যেহেতু দিদার ভাইয়াকেও ভালোবাসে না সেই হিসেবে তো চাইলেই রুশো ভাইয়াকে হ্যাঁ বলতে পারতো। বাট শি ডিডেন্ট ডু দ্যট! শি জাস্ট রিফিউজড মাই ব্রাদার!
সেই হিসেবে আমার তো অভিমান করা সাজেই। তাইতো কল ধরছি না ওর। ভার্সিটিও যেহেতু অফ সেহেতু দেখা হবার চান্সও নেই।
.
🌹
.
আমার ভাবনার মাঝেই হন্তদন্ত হয়ে বাসার সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো কেউ। আমার ভাবনায় তার পায়ের খটমটে শব্দে বিচ্ছেদ ঘটায় সচেতন চোখে তাকালাম আমি সেই আগুন্তকঃ এর দিকে।
রাত্রি একপ্রকার ছুটে এসে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বললো,
.
—- কল ধরছিস না কেনো তুই? দু দিন ধরে ফোনে পাচ্ছিনা তোকে আমি! হিসেব আছে?
.
রাত্রির ক্লান্ত মুখটায় এক পলক তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম আমি। ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলাম,
—- হুম হিসেব আছে। তো কি দরকার? বাড়িতে এলি যে?
.
আমার এভাবে পাল্টা প্রশ্ন করাটা একদমই পছন্দ হলো না রাত্রির। রাত্রি আমায় জবাবে কিছু বলবে তার আগেই সোফা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো অগ্নি ভাইয়া। রাত্রির দিকে তেড়ে এসে ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়ে কান ঝালাপালা করে দেবে সেই জন্য এগোতেই পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো নিত্য আপু। টলমলে চোখের ইশারায় অগ্নি ভাইয়াকে বললো “প্লিজ সিনক্রিয়েট করো না!” অগ্নি ভাইয়া নিত্য আপুর কথা অমান্য করতে পারলো না। দাঁতে দাঁত চেপে রাত্রির প্রতি রাগটাকে নিজের মধ্যেই দমিয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে ঘরে চলে গেলো। ভাইয়াকে সামলাতে পেছন পেছন ছুট লাগালো নিত্য আপুও।
.
রাত্রি অগ্নি ভাইয়া আর নিত্য আপুর কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু কুঁচকালো। আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো সে,
—- কি হয়েছে রে সবার? এরকম ব্যবহার করছে কেনো সবাই?
.
রাত্রির এই ছোট্ট প্রশ্নটাই আমার অভিমানের আগুনে ঘি ঢালার জন্য যথেষ্ট ছিলো। আর চুপ করে থাকতে পারলাম না আমি। একপ্রকার চেঁচিয়েই বলে উঠলাম,

—- নিজেই তো সব করলি! এখন জিজ্ঞেস করছিস কি হয়েছে সবার? লাইক সিরিয়াসলি! হাহ! তুই কি জানিস তুই শুধু একটা মন নয়, আমাদের পুরো ফ্যামিলির, প্রত্যেকটা মানুষের মনে আঘাত দিয়েছিস। রুশো ভাইয়া আমার সাথে সবার কলিজার টুকরা! জানিস তো ভাইয়াকে কতোটা ভালোবাসি আমরা। সেই আমরাই কিভাবে তাকে কষ্ট পেতে দেখবো? কিভাবে চোখের সামনে দুমড়ে-মুচড়ে শেষ হয়ে যেতে দেখবো তাকে? যদি সম্ভব হতো তবে নিজের জান দিয়ে হলেও রুশো ভাইয়ার সেই আগের হাসি যার মধ্যে কোনো অভিনয় নেই, নেই কোনো কৃত্রিমতা, সেই হাসিটা ফিরিয়ে দিতাম। কিন্তু আফসোস জান দিলেও আর তা ফেরানো যাবে না। কোনোদিনও না। তোর জন্য, শুধুমাত্র তোর জন্য রুশো ভাইয়া না খেয়ে ঘরবন্দী ছিলো, শুধুমাত্র তোর জন্যই আজ রুশো ভাইয়াকে হাসির আড়ালে কাঁদতে হচ্ছে। আমার ভাইটা আড়ালে আড়লে আর্তনাদ করছে। যার শব্দ বাস্তবে প্রতিফলিত না হলেও আমার বুকের মাঝে এসে বিঁধছে খুবই নির্মম ভাবে।
.
কথাগুলো বলার সময় আমার বুক ফেটে কান্না আসছিলো। উচ্চারণের সময় আটকে আটকে যাচ্ছিলো কথাগুলো। পারছিনা নিজেকে শান্ত করতে। আমায় এভাবে উত্তেজিত হতে দেখে তৎক্ষণাৎ উঠে এসে আমায় এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে শান্ত করবার চেষ্টা চালাতে লাগলেন নীবিড় ভাইয়া। আমি চোখে জমে থাকা টলমলে জলগুলোর সাথে যুদ্ধে শেষমেশ হার মেনে নিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। নিঃশব্দে উনার বুকে মুখ গুঁজে চোখজোড়া থেকে নোনাজল নিসৃত করতে লাগলাম আমি।
.
রাত্রি আমার কথার বিনিময়ে একটা টু শব্দও করলো না। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের কোণে জমা নোনাজলগুলো মুছে নিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে গেলো সে। ধীর পায়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে নিষেধাজ্ঞা আসায় থেমে গেলো। নীবিড় ভাইয়া আমায় জড়িয়ে ধরেই কড়া গলায় “থামো” বলে উঠলেন।
রাত্রি টলমলে চোখে পেছন ফিরে তাকাতেই উনি বললেন,
.
—- ছাদে এসো, কিছু কথা বলার আছে। তারপর যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা তোমার ওপর।
এখানে বাড়ির বড়রা চলে আসতে পারে। আমি চাইনা নতুন করে কোনো সিনক্রিয়েট হোক।
.
🍂
.
বর্তমানে ছাদের রেলিং ধরে দৃষ্টি শুন্যে নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমার থেকে দু হাত দূরত্ব বজায় রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাত্রি। নীবিড় ভাইয়া বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে জোড়ে একটা শ্বাস নিলেন। আমার হাতের ওপর থেকে হাত সরিয়ে সোজাসুজি দাঁড়িয়ে পড়লেন রাত্রির মুখ বরাবর। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে উনি রাত্রিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন,
.
—- যার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সে কি তোমায় আগে থেকেই ভালোবাসে বা তুমি কি তাকে ভালোবাসো?
.
উনার প্রশ্নে ভড়কে গেলো রাত্রি আমতাআমতা করে সে বললো,
—- না মানে, বিয়েটা তো পারিবারিক ভাবেই ঠিক হয়েছে, সেহেতু বিয়ের পর তো….
.
রাত্রিকে থামিয়ে দিয়ে নীবিড় ভাইয়া কড়া গলায় বললেন,
—- আমি এতোকিছু জানতে চাইনি। জাস্ট এন্সার, ইয়েস অর নো?
.
নীবিড় ভাইয়ার এভাবে বলায় ভয়ে আঁতকে উঠলো রাত্রি, এবার চরম অস্বস্তি নিয়ে সে জবাব দিলো,
.
—- না।
.
বিনিময়ে নীবিড় ভাইয়া হাসলেন। আমার কাছে এসে এক হাত দিয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরে বললেন,
—– একটা কথা কি জানো তো, সব মানুষই ভালোবাসা পায় না আবার কেউ কেউ আছে যারা ভালোবাসা পাবার পরও তা পা দিয়ে ঠেলে দেয় আবার ভাগ্যের পরিহাসে আফসোসও কিন্তু তারাই করে। একটা সময় যারা ভালোবাসা চেয়েছিলো কিন্তু পায় নি, তারা দিব্যি স্বাভাবিকতার সাথে খাপ খাইয়েই দিন কাটিয়ে চলে। কিন্তু অপরদিকে যারা ভালোবাসা পাবার পরও তা অগ্রাহ্য করে তারাই সারাজীবন কষ্টটা ভোগে।
আমি বলছিনা এতে তোমার কোনো দোষ আছে। কারণ এমনটা তো না যে তুমি রুশোকে স্বপ্ন দেখিয়ে মাঝপথে ছেড়ে গিয়েছো। আসলে এখানে রুশোরও কোনো দোষ নেই। দোষটা শুধুই অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভুতির। যা হয়ে যায় কোনো ছলে বলে কিংবা কৌশলে নয় বরং অজান্তেই।

একচুয়ালি ভালোবাসা হয় নিঃস্বার্থ। কেউ যদি সত্যিকারে কাউকে মন দিয়ে ভালোবেসে ফেলে তবে অপর পক্ষ থেকে উত্তরটা হ্যাঁ ই আসবে কি না তা না ভেবেই ভালোবাসে।
.
একটু থেমে উনি সোজাসুজি আমার চোখের দিকে তাকালেন। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলতে শুরু করলেন,
—- একটা কথা অনন্যাকেও কখনোও বলা হয়নি যা আজ বলছি, ভার্সিটিতে প্রথম দিন পিঠে ওর হাতের স্পর্শেই শরীরে প্রথম এক শীতল স্রোত বয়ে যায় আমার। তবে সেদিকে খুব একটা পাত্তা দেইনি আমি বরং রেগে গিয়েছিলাম। ওর পরও ও অনেক ভুল করে হোক তা ছোট কিংবা বড়। তবুও অদ্ভুত অদ্ভুত সব কারণে ওর দিকেই মনটা টানতো আমার। ওর করা প্রত্যেকটা ভুলের শাস্তি স্বরূপ আমার নজরের সামনে রাখতাম ওকে। জানি না কেনো হতো এমন, তবে না চাইতেও ওর প্রতি ঝুঁকে পরি আমি। তারপর যখন জানতে পারি ও অগ্নির বোন তখন অজান্তেই একটা খারাপ লাগা কাজ করেছিলো মনের গহীনে। ভেবেছিলাম হয়তো ভুল কাউকে মন দিয়ে ফেলেছি। ভেবেছিলাম অগ্নি মানবে না বরং বন্ধুত্বটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। জানতাম অনন্যাকে পাবো না, ও শুধুই আমার স্বপ্ন মাত্র। তবুও ভালোবেসেছি আমি, জেনেশুনেও ওকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসে গিয়েছি। হয়তো শুধু প্রকাশ করি নি যার কারণেই তা আজো অজানা।
আর আজ দেখো অনন্যা আমারই। উপর ওয়ালা আগে থেকেই আমাদের জুটি মিলিয়ে রেখেছিলো, ওকে পাওয়াটা বোধহয় তারই দৃষ্টান্ত। অগ্নিও আমার মতোই বেস্টফ্রেন্ডের বোনের প্রেমে পড়েছে আর আজ তারাও কিন্তু এক। না আমি আর না অগ্নি কেউই কারো পথে বাঁধা হয়ে দাড়াইনি। কারণ আমরা একে অপরকে চিনি, বিশ্বাস করি। শুধু একজন বেস্টফ্রেন্ড না ভাইয়ের মতো ভালোবাসি যার দরুনই হয়তো আমরা এরকম।
.
এতটুকু বলেই উনি আমায় ছেড়ে দিলেন। দুধাপ রাত্রির দিকে এগিয়ে দুহাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন,
.
—- এখন নিশ্চয়ই ভাবছো, এসব কথা আমি তোমায় কেনো বলছি! অবশ্য কোনো কারণ ছাড়া বলছি না। কথাগুলো বলার যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে।
রুশো ছেলেটাকে আমি এই প্রথম হাসির আড়ালে ভেঙে পড়তে দেখেছি। অথচ যেখানে ওর মুখে হাসি থাকলে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠতো সেখানে আজ ওর মিথ্যে হাসি দেখে সবার মুখভার।
রুশো কিন্তু তোমাকে একবারের বেশি দুবার মানাতে যায় নি। কারণ ও নিঃস্বার্থভাবে তোমায় ভালোবেসেছে। তোমার উত্তরের ভিত্তিতে নয়। ও হয়তো সেদিনও তোমায় মুখ ফুটে কথাটা বলতো না যদি না অনন্যা ওকে জোড় করতো। অনন্যার ধারণা ছিলো তুমি সিটি গোল্ড আর স্বর্ণের মধ্যে পার্থক্য বোঝো। সেই হিসেবে রুশোকে গ্রহণ করতে দুবার ভাববে না তুমি। কিন্তু আফসোস তুমি বুঝোনি।

এতোকিছু বললাম শুধুমাত্র তোমায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করার জন্য। আমি বলবোনা তুমি রুশোকে বেছে নাও অথবা দিদারকেই বিয়ে করো। আমি শুধু চাই তুমি এমন কোনো ডিসিশন নিও না যাতে কি না পাছে আফসোস করতে হয়। নাও চয়েজ ইজ ইয়রস।
এখনো হাতে সময় আছে। ভাবো, নিজেকে সময় দাও। ব্রেইন নয় তোমার মন কি চায় সেদিকে ফোকাস করো।
.
উনার কথা শেষ হতেই ছলছল চোখে উনার স্নিগ্ধ মুখখানায় তাকালাম আমি। এই মানুষটা আমায় এতো আগে থেকে ভালোবাসে তার বিন্দুমাত্রও হাদিস পাই নি আমি! কি অদ্ভুৎ!
উনি নিজের হাত দিয়ে আমার চোখের কোণে জমা জলগুলো মুছে দিয়ে কপালে গভীর চুম্বন এঁকে দিলেন। হাল্কা স্বরে হেসে বললেন, “পাগলী একটা, কেঁদো না!”
.
এতোক্ষণ ধরে নীবিড় ভাইয়ার প্রত্যেকটা কথাই মাথা নিচু করে খুব মন দিয়ে শুনছিলো রাত্রি।
মাথা উঁচু করে আমাদের দিকে এক পলক চেয়ে ছোট্ট করে সে বললো “আসছি!”
বলেই উল্টোদিকে ঘুরে দ্রুত পায়ে হাটা ধরলো সে। এমন সময়ই রুশো ভাইয়া দৌড়ে ছাদে এসে রাত্রিকে না দেখেই আমায় ডেকে বলে উঠলো,
.
—– ছুটকি, পুরো বাড়ি খুঁজেছি আমি তোকে আর তুই এখানে? দেখ আমি তোর জন্য কি নিয়ে এসেছি, তোর ফেভারিট কিটক্যাট আর…..
.
আর বলা হয়ে উঠলো না রুশো ভাইয়ার, রাত্রিকে দেখেই মুখের হাসিটা নিমিষেই মিলিয়ে গেলো ভাইয়ার। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ভাইয়া বললো,
—- ছুটকি আমি টেবিলে রেখে দিচ্ছি নিয়ে নিস। ঘরে গেলাম।
.
বলেই তৎক্ষণাৎ নেমে গেলো ভাইয়া। রাত্রি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থেকেই নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করলো। বড়বড় পা ফেলে বেড়িয়ে গেলো সে বাড়ি থেকে।
.
🌸
.
রাত ৩ টে ৪৬ মিনিট,

রাতের আকাশে আজ নেই কোনো তারা। আর রইলো চাঁদ? সে তো ঢাকা পড়েছে ঘন কালো মেঘের আচ্ছাদনে। হয়তো খানিক বাদেই আকাশের বুক চিরে বর্ষণ শুরু হবে।
চারিদিকে নিস্তব্ধতা ছেয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে বাড়ির পাশের ঝোপঝাড় থেকে একটা-দুটো ঝিঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে। এই ঘন আধারে রাত্রি ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে চোখের জল বিসর্জন দিয়ে চলেছে। দুঃখে-কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে মন খুলে চিৎকার করে কাঁদতে কিন্তু কান্নারাও বড্ড খারাপ সময়েই এসে ঝড়তে শুরু করে, যখন মুখ ফুটে একটু চাপা আর্তনাদ করবারও জো থাকে না।
.
রাত্রি জানে না কেনো কাঁদছে সে, শুধু জানে মনের কোথাও কেউ ক্রমাগত ছুড়ি চালিয়ে যাচ্ছে যার জন্যেই তার এই অশ্রু বিসর্জন। কেনো যেনো এক অদ্ভুত চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার হৃদপিন্ডে। বারবার কেনো রুশোর শুকিয়ে যাওয়া মুখটা ভেসে আসছে তার চোখে?
এই দু দুটো দিন দু চোখের পাতা এক করতে পারে নি রাত্রি। অদ্ভুত এও দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে সে। কেনো হচ্ছে এরকম? কেনো বারবার রুশোর কথা মনে পড়ছে তার? সে তো রুশোকে ভালোবাসে না তবে এই অনুভূতি, এই যন্ত্রণা! সবই কি নিছক সহানুভূতি মাত্র?
.
🌷
.
খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে রাত্রির মুখ ফুলিয়ে রাখা ছবিটার দিকে অপলক চেয়ে রয়েছে রুশো। ছবিটায় আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। সারাদিনের হাসি-তামাশার অভিনয় করতে করতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে রুশো৷ নিজেকে ব্যস্ত রাখার সবরকম পদ্ধতিই প্রয়োগ করে ফেলেছে সে। চাইছে ব্যস্ততার মাঝে রাত্রিকে ভুলে থাকতে কিন্তু এখন? এখন কি করে নিজের দীর্ঘশ্বাস লুকোবে সে? গভীর রাত্রেই যে রাত্রি খুব করে জ্বালাতন করছে তাকে।
.
রুশো চাইছে ছবিটা সরিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে কিন্তু ঘুমেরাও যে বড্ড বেইমান। ইচ্ছে করেই তাকে আরোও বেশি করে কষ্ট দেবার জন্য ধরা ছোঁয়ার বাহিরে চলে গেছে তারা। রুশো বুঝলো, পারবে না সে রাত্রিকে ভুলতে তাই ভোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে বেকার অারোও কষ্ট পাওয়ার কোনো মানেই হয়না। তার থেকে ভালো তার প্রেয়সীর মুখে হাসি দেখে বাকি জীবনটা পার করে দেওয়া। কি এমন হবে যদি রাত্রিকে সে না পায়? কিছু পাওয়ার আশায় তো ভালোবাসে নি সে রাত্রিকে। ভালোবাসার জন্যই ভালোবেসেছে তাকে রুশো।
.
🍁
.
বাড়ি ভর্তি লোক এসেছে আজ, আর আসবে নাই বা না কেনো? আজ যে রাত্রি-দিদারের আংটি বদলের দিন। সকলের মুখেই খুশি খুশি ভাব শুধুমাত্র রাত্রি ছাড়া।
যা লোক এসেছে তা শুধুই আত্মীয়-স্বজনরাই।
বাহিরের কাউকে অবশ্য ইনভাইট না করা হলেও অনন্যাদের পরিবারকে বলেছে রাত্রির মা। কিন্তু মিসেস অনাকমিকা ব্যস্ততার অযুহাতে আসতে পারবে না বলে জানিয়েছে। যাবেই বা কেনো যেখানে তার মেয়েই রাত্রির আংটিবদলের অনুষ্ঠানে যাবার নাম শুনে ফ্লাওয়ার বাজ ছুঁড়ে ফেলে ঘরে দরজা দিয়ে বসেছে?
.
ঘরের এক কোণে মনমরা হয়ে গুটিশুটি মেরে বসে রয়েছে রাত্রি। পার্লার থেকে দুটো মেয়ে এসেছে তাকে সাজাতে কিন্তু রাত্রি সাফ সাফ মানা করে দিয়েছে তাদের। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কারই বা এনগেজমেন্টে সাজতে ইচ্ছে করবে? সেরকমই রাত্রিরও আজ সাজতে ইচ্ছে করছে না। যেখানে সামান্য মার্কেট যাবার পথেই সাজুগুজু করতে করতে ১ ঘন্টা পার করে ফেলে সেখানে আজ মেয়ের মুখে সাজতে অসম্মতি দেখে চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন রাত্রির মা।
হয়তো দিদারের সাথে কোনো কিছু নিয়ে কথা-কাটাকাটি হয়েছে কিনা সন্দেহ করে দিদারকে ডেকে পাঠালেন তিনি। দিদার আসতেই রাত্রির মা করুন চোখে বলে উঠলেন,
.
—- দিদার, বাবা দেখোনা রাত্রি কেমন মুখভার করে রয়েছে। সাজতে চাইছে না, তুমি একটু ওর সাথে কথা বলে বুঝাও।
.
দিদার ফুপির হাতে হাত রেখে তাকে আস্বস্ত করে বললো, ” চিন্তা করো না ফুপি, আমি দেখছি।”
.
ঘর থেকে পার্লার থেকে আসা মেয়েগুলোকে বাহিরে বসতে বলে ঘরে ঢুকলো দিদার। রাত্রি এক ধ্যানে পলকহীন ভাবে আকাশের পানা চেয়ে রয়েছে।
হঠাৎ কাঁধে কারোর স্পর্শ অনুভব করায় ভ্রম কাটলো তার। ব্যস্ত হয়ে বললো সে,
—- একি ভাইয়া আপনি? বসুন বসুন।
.
দিদার রাত্রিকে ব্যস্ত হতে মানা করে সন্দেহের চোখে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো,
—- তুমি কি এই বিয়েতে রাজি নও?
.
বিনিময়ে রাত্রি মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। দিদার নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ মেনে নিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বললো,
—- পারিবারিক ভাবে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার মানে এই নয় যে বিয়েটা করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই।
.
দিদার কথায় চমকে উঠলো রাত্রি। অবাক দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকিয়ে সে কিছু বলবে তার আগেই আবারও দিদার বলে উঠলো,
—- রুশোকে ভালোবাসো রাত্রি?
.
দিদারের এবার প্রশ্নে আগের থেকেও বেশি চমকে উঠলো সে। মুখ ফুটে না বলতে চাইলেও কোথাও একটা বাঁধা দিচ্ছে। রাত্রি এবারও কোনো জবাব দিতে পারলো না। ফ্যালফ্যালে চোখে স্রেফ চেয়েই রইলো সে।
দিদার হাল্কা হেসে বলতে শুরু করলো,
.
—- আমি তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমায় বিয়ে করতে চাইনা রাত্রি।
তুমি হয়তো নিজেই বুঝতে পারছো না তুমি ঠিক কি চাইছো! আচ্ছা আমি তোমায় কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি। তুমি শুধু হ্যা কি না উত্তর দেবে। প্রথমত রুশোকে দেখতে না পেলে কি তোমার কোনো কিছুর শূন্যতা অনুভব হয়? দ্বিতীয়ত সেদিন রুশো তোমায় প্রোপোজ করায় কি তুমি কি ইচ্ছে করেই তাকে উপেক্ষা করবার জন্যে মুখ লুকিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছিলে, আর তৃতীয়ত গভীর রাত্রে তোমার কি তার কথা মনে পড়ে খুব করে?
.
রাত্রি ছলছল চোখে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। দিদার হাসলো। চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে বলে উঠলো,
—– কংগ্রাচুলেশনস! তুমি রুশোকে ভালোবেসে ফেলেছো! আর দেড়ি করো না এক্ষুনি বলে ফেলো ওকে। আমি আগে জানলে সেদিনই তোমায় ওর হাতে তুলে দিয়ে চলে আসতাম। আর দেড়ি যাবে না। আমি নিচে গুয়ে ব্যাপারটা সামলে নিচ্ছি, কেউ বিয়ে ভাঙা নিয়ে তোমায় প্রশ্ন করবে না চিন্তা করো না! গো রাত্রি! ডু ইট ফাস্ট।
.
বলেই হাত দিয়ে “বেস্ট অফ লাক” ইশারা করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো দিদার। রাত্রি এখনোও ঘোরের মধ্যে রয়েছে। তবে কি সত্যিই সে রুশোকে ভালোবেসে ফেলেছে? হ্যা! ভালোবাসে সে রুশোকে। শুধু এতোদিন ধাধার মধ্যে আটকে ছিলো সে।
রাত্রি আর দেড়ি করলো না। এক ছুটে গিয়ে ড্রয়ার থেকে ফোনবুক টা বের করে অনন্যাদের বাড়ির সকলের নম্বর ঘাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। একবার অনন্যা বলেছিলো যদি ওকে ফোনে না পাওয়া যায় তবে এই দুটো নম্বরে কল করতে। ভালো করে নম্বরের পাশের নামগুলো দেখে নিতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো রাত্রির। কারণ ওখানে একটা নম্বর অনন্যার মায়ের আর অপর নম্বরটি রুশোর। রাত্রি ফোনবুক থেকে মোবাইলে নম্বরটা তুলে নিলো তৎক্ষণাৎ। জোড়ে জোড়ে বার কয়েক শ্বাস টেনে নিয়ে ডায়াল করলো রুশোর নম্বরে।
.
🍁
.
অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে রুশো। আকাশে আজো মেঘ করছে ভীষণ। মাঝরাস্তাতেই বৃষ্টি না শুরু হয় এই দোয়া করতে করতেই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে সে।
এমন সময় ফোনের স্ক্রিনে আননউন নম্বর ভেসে উঠায় ভ্রু কুঁচকালো রুশো। আননউন নম্বর দেখে তোয়াক্কা না করে আবারও ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো সে।
রিং বাজতে বাজতে কেটে যেতেই আবারও বেজে উঠায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে কল রিসিভ করলো রুশো। কানে ব্লুটুথ থাকায় ড্রাইভিং এ প্রবলেম হবে না ভেবে গাড়ি থামালো না সে।
.
ওপাশ থেকে চিরচেনা কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই থমকে গেলো রুশো। জোড়ে সড়ে ব্রেক কষে থেমে গেলো সে।
রুশোকে চুপ থাকতে দেখে এবার রাত্রি কান্নাই করে ফেললো,
—- রু..রুশো, আমাকে মাফ করে দিন। আ… আমি অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আপনাকে।
আর কষ্ট দিতে পারবো না আমি কারণ এই কয়দিনে আমি বুঝে গিয়েছি যে আমিও আপনাকে নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি। আই লাভ ইউ রুশো….! ভালোবেসে ফেলেছি আমি আপনাকে!
.
রুশো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কি বলছে এসব রাত্রি? সেও তাকে ভালোবেসে ফেলেছে? একি আদৌ বাস্তব নাকি নিছক স্বপ্ন মাত্র? রুশোর মুখ থেকে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। একরকম ঘোরের মধ্যে ডুব দিয়েছে সে। এমন সময়ই ফুল স্পিডে একটি নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাক রুশোর গাড়ির দিকে এগোতে দেখেই হুশ এলো রুশোর। ট্রাকটি যে ব্রেক ফেইল করেছে তা স্পষ্ট। রুশো “ওহ শিট” বলে গাড়ি ঘুড়িয়ে সরাতে নিলেই প্রকান্ড এক শব্দ আলোড়ন সৃষ্টি করে রাত্রির কানে। রাত্রি উত্তেজিত হয়ে চেঁঁচিয়ে বলে উঠে,
.
—– রুশোওওওও………..!

#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৫৮♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
“রোড এক্সিডেন্ট” শব্দটা কানে পৌঁছোতেই পুরো শরীর নিস্তেজ হয়ে এলো আমার। সামান্য আওয়াজ করবার মতোও শক্তি অবশিষ্ট নেই যেনো।
“এক্সিডেন্ট” শব্দটা আমার ডিকশনারিতে খুবই সুপরিচিত হলেও “রোড এক্সিডেন্ট” শব্দটা না আমার ডিকশনারির পাতা ঘাটলে পাওয়া যাবে আর না আমার কল্পনার রাজ্যে। এই শব্দটাকে আমি ছোট থেকেই বড্ড বেশি ভয় পাই।
আর আজ সেই শব্দটাই আঘাত হানলো রুশো ভাইয়ার ওপর?
.
আজ বিকেলবেলায় অগ্নি ভাইয়া আর আমি বাড়ির দোলনায় গা এলিয়ে দিয়ে প্রকৃতির হাওয়া গা মাখছিলাম। “এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন” লাইনটার সাথেই যেনো মিলে গিয়েছে আজকের দিনটা। যেহেতু নীবিড় ভাইয়া বা নিত্য আপু কেউই ছিলো তাই ভাইয়া আর আমিই বেড়িয়েছিলাম একটু রিল্যাক্স করতে। এমনিতেই কারো মন ভালো নেই রুশো ভাইয়ার চিন্তায়। তারওপর ঘরে বসে একা একা বড্ড তমসাবৃত লাগছিলো।
একটু হাটাহাটি করে ভাইয়া আর আমি দোলনায় বসে প্রকৃতির হিমেল হাওয়ায় গা ভাসাচ্ছিলাম ঠিক তখনই কেউ ঝড়ের বেগে ছুটে আসে আমাদের কাছে। ব্যক্তিটিকে দেখবার জন্য সচেতন চোখে তাকাতেই আঁতকে উঠি আমি। আর যাই হোক রাত্রির ওপর অভিমান থাকলেও ওকে এভাবে কাঁদতে দেখে ধরে রাখতে পারিনি নিজেকে। চটজলদি উঠে পড়ে ব্যস্ত হয়ে “কি হয়েছে?” জিজ্ঞেস করতেই রাত্রি বার কয়েক জোড়ে জোড়ে শ্বাস টেনে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
.
—- রু… রুশো…! রুশোর এ…এ…এক্সিডেন্ট হয়েছে! হয়তো গাড়ি চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ তীব্র আওয়াজে হর্ণ দিতে দিতে বিকট শব্দে ফোনের লাইন কেটে যায়।
আ…আমি সাথেসাথেই ছুটে বেড়িয়ে এসেছি। তোর নম্বরে অনেকবার ডায়াল করেছি কিন্তু তুই ধরিস নি। তোদের কাছে আসার পথেই আবার উনার নম্বর থেকে কল আসে। আমি রুশো ভাইয়া ভেবে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বলে “এই ফোনের মালিক কে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে। রোড এক্সিডেন্টে খুবই বাজে অবস্থা, তাড়াতাড়ি চলে আসুন।”
সেই শুনেই আমি ছুটে তোদের জানাতে এসেছি। প্লিজ তোর যতো রাগ আছে তুই পরে ঝাড়িস। আমাদের রুশোর কাছে যেতে হবে।
.
রাত্রির বলা বাক্যের শুধুমাত্র “রোড এক্সিডেন্ট” শব্দটাই তীক্ষ্ণভাবে আঘাত হানছে আমার মস্তিষ্কে। অগ্নি ভাইয়া রাত্রি পুরো কথা শুনবার আগেই “নাহহহ….!” বলেই চেঁচিয়ে পাগলের মতো হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে গাড়ি বের করতে গিয়েছে। রাত্রিও ছুটেছে ভাইয়ার পেছন পেছন। মাঝখান থেকে শুধু মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছি। রাত্রির পুরো কথাটার অর্থ পুরো ৩ মিনিট পর বুঝতে পেরে কাঁপাকাঁপা পায়ে ছুট লাগালাম আমি। অগ্নি ভাইয়া গাড়ি বের করে আমায় ধরে বসিয়ে দিয়ে স্টার্ট দিলো তৎক্ষণাৎ। এতো স্পিডে গাড়ি এর আগে কোনোদিনোও ভাইয়া চালিয়েছে কিনা স্মৃতির পাতায় নেই আমার। ভাইয়া গাড়ি চালাতে চালাতেই হন্তদন্ত হয়ে আম্মুর নম্বরে ডায়াল করলো। আম্মু কল রিসিভ করতেই অগ্নি ভাইয়া দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে চোখে জমা নোনাজলগুলো গড়তে না দিয়ে বলে উঠলো,
.
—- আম্মু যেখানেই থাকো এক্ষুনি মেডিকেল হসপিটালে চলে এসো। রু..রুশোর এক্সিডেন্ট হয়েছে। আন্টি-আংকেল কে জানিয়ে দিও।
.
বলেই ফোনটা কেটে আবারও তীব্র গতিতে ছুটে চললো হসপিটালের উদ্দেশ্যে। আজ যেনো এতোটুকু পথও বড্ড বেশি বলে মনে হচ্ছে আমার। মাথাটা কেমন যেনো ঝিমঝিম করে চলেছে। রাত্রি এতোক্ষণে কান্না করতে করতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে।
কিছুদূর যেতেই রাস্তার একপাশে ভীড় জমায় ভীরের কেন্দ্রবিন্দুতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম আমি। একটি গাড়ি দুমড়েমুচড়ে উল্টো হয়ে রাস্তার পাশের বটগাছটায় লেগে রয়েছে। গাড়িটা ঠিক কেমন বা কোন কোম্পানির তা চেনারও বিন্দু মাত্র অবকাশ নেই। অগ্নি ভাইয়া ভীড় দেখেও সেদিকে পাত্তা দিলো না। ভাইয়ার কাছে বর্তমানে মূখ্য শুধুই রুশো ভাইয়ার কাছে পৌঁছানো। আর রাত্রি একনাগাড়ে কান্না করছে যার ফলে এদিকটা নজরেই পড়লো না তার। শুধুমাত্র উইন্ডোর পাশ থেকে মাথাটা হাল্কা উঁচু করে দেখলাম আমি। তবে কি এটাই রুশো ভাইয়ার গাড়ি?
.
অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। ২০ মিনিটের রাস্তা ১৫ মিনিটেই পাড় করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম তৎক্ষণাৎ। একই সময় আমাদের সামনে ব্রেক কষলো একটা হোয়াইট কার। গাড়িটা চিনতে বেশি বেগ পেতে হলো না আমার। এই গাড়িতে বহুবার চড়ে চড়কার মতো ঘুরেছি আমি।
নীবিড় ভাইয়া আর নিত্য আপু গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে আমাদের কাছে আসলো। বুঝতে বাকি নেই এই মধ্যে আম্মুই ফোন করে উনাদের জানিয়েছেন। নীবিড় ভাইয়াদের বাসা হসপিটালের খুব কাছে হওয়ার সুবাদেই অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছেন উনারা।
.
নীবিড় ভাইয়া আমার কাছে এসে আমার ডান হাতটা শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় অাঁকড়ে ধরে এগোতে লাগলেন। আমিও উনার সাথে তাল মিলিয়ে এগোতে লাগলাম। বর্তমানে নিজেকে একটা রোবটের মতো বলেই মনে হচ্ছে আমার। কেমন যেনো অনুভুতি শূন্য অনুভূতি! আমি এখনো ঘোরের মধ্যে রয়েছি। বিশ্বাস করতে পারছিনা নিজের কান কে। সবকিছু কেমন যেনো এলোমেলো লাগছে আমার। “অতি শোকে পাথর” টাইপ অবস্থায় উপনীত হয়েছি আমি।
.
হসপিটালে ঢুকেই এক ছুটে রিসেপশনিস্টের কাছে গেলাম আমরা। আমাদের পেছন পেছন নিত্য আপু অগ্নি ভাইয়া আর রাত্রিকে সামলাতে সামলাতে হসপিটালের ভেতর প্রবেশ করলো।
আমাদের দেখে রিসেপশনিস্ট নরম গলায় শান্ত হয়ে বলে উঠলেন,
—- হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?
.
নীবিড় ভাইয়া হসপিটালের রিসেপশনিস্টের কাছে গিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিয়ে ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন,
.
—- র..রুশো…! আই মিন প্রায় একঘন্টা আগে রোড এক্সিডেন্ট কেসে যাকে এডমিট করানো হয়েছে সে কোথায়? আমরা ওর বাড়ির লোক!
.
নীবিড় ভাইয়ার কথায় মাথা নিচু করে ফেললো রিসেপশনের মেয়েটা। এভাবে মাথা নিচু করে চুপ হয়ে যাওয়ায় ক্ষেপে গেল অগ্নি ভাইয়া। রেগেমেগে ভাইয়া বললো,
—- কি হলো চুপ করে আছেন কেনো? বলুন রুশো কোথায়? কোথায় আমার ভাই?
.
মেয়েটা অগ্নি ভাইয়ার ধমক খেয়ে কেঁপে উঠলো, নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় জবাবে বলে উঠলো,
—- আপনারা দেড়ি করে ফেলেছেন। পেশেন্টকে এডমিট করানোর পর আইসিইউ এ নিয়ে যার আগেই উনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
.
একটু থেমে মেয়েটা আবারও বলে উঠলো,
—- বডি রাখা আছে, বাড়ির লোক আসারই অপেক্ষায় ছিলাম আমরা।
.
মেয়েটার বলা বাক্যগুলো মেনে নিতে পারিনি আমরা কেউই। সাথেসাথেই নিস্তেজ শরীরটা ক্রমশই ছেড়ে দিয়ে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লাম আমি। মাথাটা ঘুরছে, চারদিক থেকেই কেমন যেনো আধার ঘনিয়ে আসছ। অগ্নি ভাইয়া রেগেমেগে আবারও মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—- ফাইজলামি করার জায়গা পান না? কি যা তা বলছেন? আপনি একজন রিসেপশনিস্ট হয়ে এইধরনের জঘন্য মিথ্যে বলছেন, আপনার সাহস তো কম না!
.
মেয়েটি ভয়ে ভয়ে অগ্নি ভাইয়াকে শান্ত হতে বলে ডক্টরকে ডাক দিলো। এর মাঝেই উনি আইসিইউর দিকে যেতে গিয়ে ডাক পড়ায় আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। মেয়েটি আজকের এক্সিডেন্ট কেসের পেশেন্টের বডি আমাদের দেখাতে অনুরোধ করতেই মুখ কালো করে ফেললেন ডক্টর। এর মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে আম্মু-আব্বু, খালু-খালামুনি হসপিটালে প্রবেশ করলো। খালামুনি অশ্রুসিক্ত নয়নে অগ্নি ভাইয়াকে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো “রুশো কোথায়? কোথায় আমার ছেলে? কি হয়েছে ওর?”
অগ্নি ভাইয়া খালামুনিকে শান্ত হতে ইশারা করে বলে উঠলো,
—- দেখো না খালামুনি এরা আমাদের সাথে মজা করছে! কি সব আজেবাজে বকছে। বলছে রুশো নাকি আর নেই!
.
বলেই কান্না করতে লাগলো অগ্নি ভাইয়া। এতোক্ষণ ধরে আটকে রাখা নোনাজলগুলো আর বাঁধ মানলো না তার। অঝোরে ঝড়তে শুরু করলো তারা নির্মমভাবে।
রাত্রি একেবারেই স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। এতোবড় শক নিতে পারে নি সে। “সব আমার জন্য হলো! আমি দোষী, খু..খুনি আমি” বাক্যটা বার কয়েক আওড়াতেই জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে পড়ে গেলো রাত্রি। নার্সরা রাত্রিকে সেন্সলেস হতে দেখে ধরে তৎক্ষণাৎ উঠিয়ে একটি কেবিনে নিয়ে যাবার জন্য ছুট লাগালো।

অগ্নি ভাইয়ার বলা “রুশো আর নেই” কথাটা বজ্রপাত সৃষ্টি করলো সকলের ওপর। খালু-খালামুনিরা নিজেদের সামলাতে পারলো না। কোন বাবা-মাই বা জীবিত থাকতে নিজের একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর খবর শুনে নিজেদের ঠিক রাখতে পারবে? আম্মু আব্বু নিজেরাই শোকে ভেঙে পড়েছে। ওদের আর কি সামলাবে? নীবিড় ভাইয়া আমার পাশে বসে পড়ে আমায় নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলেন উদ্দেশ্য আমায় সামলানো। অথচ আমি পাথর! নিত্য আপু কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। আমাদের শোকে শোকাহত যেনো পুরো হাসপাতালের প্রতিটি সদস্য! আমাদের এভাবে ভেঙে পরা অবস্থা দেখে ডক্টর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন,
.
—- আমরা আপনাদের মনের অবস্থা বুঝতে পারছি, কিন্তু প্লিজ আপনারা বাস্তবতা মানতে শিখুন। পেশেন্টের অবস্থা ভীষণ ক্রিটিকাল ছিলো। প্রচুর ব্লাড বেড়িয়েছিলো। সেই হিসেবে আমরা যতদ্রুত সম্ভব তার ট্রিটমেন্ট করাতে আইসিইউতে নিয়ে যাবার আগ মুহুর্তেরই তিনি মারা যান। উই আর সরি! আমাদের হাতে কিছুই করার ছিলো না। জন্ম-মৃত্যু সবই উপর ওয়ালার হাতে।
আপনারা অপেক্ষা করুন। বডি রাখা আছে। একটু পরই আপনাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে।
.
বলেই দুজন নার্সকে বডি নিয়ে আসতে ইশারা করলেন। ডক্টরের আদেশ মতো চোখের ইশারায় সম্মতি জানিয়ে স্থান ত্যাগ করে ছুটলো তারা লাশ নিয়ে আসার জন্য।
আম্মু-আব্বু, খালামুনিকে-খালু সহ সবাই কাঁদছে। অগ্নি ভাইয়া পাগলের মতো আর্তনাদ করে যাচ্ছে। নীবিড় ভাইয়ার বুকের মাঝে মাথা রেখেই উনার ফুপিয়ে কেঁদে ওঠার ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি আমি তীব্রভাবে। আমারও ইচ্ছে করছে কাঁদতে, খুব করে কাঁদতে। কিন্তু না, আমি কাঁদতে পারছিনা। পাথরে পরিণত হয়ে গিয়েছি আমি। আমার প্রাণ থেকেও বোধহয় নেই।

রুশো ভাইয়ার মৃত্যুটা কেউই মানতে পারছে না। আর না পারছি আমি। তবে কি আর কেউ আমায় ছুটকি বলে ডাকবে না? মাঝরাতে ঘুম না আসায় কেউ কি আর বলবে না ” এই ছুটকি আইসক্রিম খাবি?”
অফিস যাওয়ার সময় কি তবে আর কেউ জিজ্ঞেস করবে না “আসার সময় তোর জন্য কি নিয়ে আসবো রে ছুটকি?”
কেউ কি আর মজার মজার জোক্স বলে হাসাবে না? খুশির মুহুর্তে কেউ কি আর হাত ধরে নাচবে না?
কেউ কি আর বাড়িটা মাথায় করে রাখবেনা? মন খারাপের দিনে হুট করেই উদ্ভট সব কান্ডে চমকে দেবে না?
বাড়িটা কি তবে নিঃস্ব হয়ে যাবে? না থাকবে কোনো হাসি আর না থাকবে কেউ খুশি। সারাটা জীবন তবে অশ্রুপাত করেই কি কাটিয়ে দিতে হবে আমাদের?
.
🌸
.
—- ছুটকি…..!!!
.
হঠাৎ সেই চিরচেনা কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই চটজলদি মাথা উঁচু করে সচেতন চোখে তাকালাম আমি। মাথায় ব্যান্ডেজ তার একপাশে জমাট বাঁধা রক্ত, পায়ের হাটুতে প্যান্টের ছিঁড়ে যাওয়ায় ভেতরের ছিঁলে যাওয়ায় ক্ষতটা স্পষ্ট।
রুশো ভাইয়াকে এই অবস্থায় হেটে আরো দুধাপ এগোতে দেখেই হুশ ফিরলো আমাদের। নাহ! এটা কোনো স্বপ্ন নয়, এ বাস্তব! ছেড়ে যায়নি রুশো ভাইয়া আমাদের।
.
রুশো ভাইয়াকে দেখে সবাই যে যার স্থান ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। নীবিড় ভাইয়া অবাক হয়ে হাতের বাঁধন আলগা করতেই আমি এক ছুটে গিয়ে রুশো ভাইয়াকে ঝাঁপটে ধরলাম। ভাইয়ার বুকে কিল ঘুষি মারতে মারতে অবশেষে কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। কান্না করতে করতেই বলে উঠলাম,
.
—- তু… তুমি খুব পঁচা রুশো ভাইয়া! এভাবে কেউ ভয় দেখায়? তুমি জানো না আমরা তোমায় কতটা ভালোবাসি? তাহলে কেনো এভাবে আমাদের একলা ফেলে চলে যাওয়ার অভিনয় করলে? জানো দম বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার!
.
রুশো ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—- কি বলছিস এসব ছুটকি? এইতো আমি! কোথায় যাবো তোদের ছেড়ে বল? তোদের ছেড়ে কি আমি থাকতে পারবো?
.
এর মধ্যেই আম্মু-আব্বু, খালু-খালামুনি, অগ্নি ভাইয়া-নীবিড় ভাইয়া আর নিত্য আপু আমাদের ঘিরে ধরলো। আমি রুশো ভাইয়াকে ছেড়ে দিতেই খালামুনি রুশো ভাইয়ার গালে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। সবার চোখ থেকেই এতোক্ষণ বেদনার অশ্রু ঝড়লেও এখন তা প্রাপ্তির অশ্রুকণায় পরিণত হয়েছে। খুব কাছের মানুষটাকে হারাতে হারাতে আবারও ফিরে পেয়ে সবার চোখ থেকেই খুশির অশ্রুপাত ঘটছে। এর মাঝেই অগ্নি ভাইয়া রুশো ভাইয়ার এলোমেলো চুলগুলো আরোও একটু এলোমেলো করে দিয়ে অগ্নিমূর্তি রূপ ধারণ করলো। তেড়ে গেলো ভাইয়া সেই রিসেপশনিস্ট মেয়েটার কাছে। অগ্নি ভাইয়ার পেছনে ছুট লাগালো নীবিড় ভাইয়াও।
.
—– ইউ ইডিয়ট! জিন্দা মানুষটাকে কিভাবে আপনারা মৃত ঘোষণা করেন? জানেন পরিবারের ওপর দিয়ে ঠিক কি পরিমাণ ঝড় বইছিলো? মানুষের ইমোশন নিয়ে খেলতে আপনাদের লজ্জা করেনা?
.
রিসেপশনের মেয়েটা ভয়ে আঁতকে উঠে আমতাআমতা করে বলে উঠলো,
—- উই আর এক্সট্রেমলি সরি স্যার। কোথাও একটা গন্ডগোল হয়েছে মেইবি।
.
বলেই সেই ডক্টরকে ডেকে পাঠালো মেয়েটা। ডক্টর আসতেই অগ্নি ভাইয়া দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—- আপনারা যে বললেন আমার ভাই এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে? আরে ওইতো আমার ভাই। দিব্যি বেঁচে আছে। কোনোকিছু শিওর না হয়ে একজন জ্যান্ত মানুষকে তার পরিবারের কাছে কিভাবে আপনারা মৃত বলতে পারেন?
.
ডক্টর রুশো ভাইয়াকে দেখে চমকে উঠলেন। বিস্ময়ে বলে উঠলেন,
—- আরে ইনি কেনো ভিক্টিম হতে যাবেন? ইনিই তো ভিক্টিম কে হসপিটালে নিয়ে এসেছেন।
.
তখনই একজন ভদ্রলোক রিসেপশনের সামনে ভীড় জমতে দেখায় এগিয়ে এলেন। আমাদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
—- আপনারা কি আজকের এক্সিডেন্টের ভিক্টিমের বাড়ির লোক? এই ফোনটা এক্সিডেন্ট স্পটে পড়ে ছিলো। আমি ফোনটা তুলে নিয়ে কললিস্টে প্রথম যার নম্বর দেখি তাকেই ফোন করে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু পেশেন্ট তো ট্রিটমেন্টের আগেই মারা গেল।
.
বলেই অগ্নি ভাইয়ার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলেন লোকটি। ফোনটা ভালো করে দেখে নিয়ে ভাইয়া বলোলো,
—- আরে এতো রুশোর ফোন! ওহ গড…..! কি হচ্ছে এসব? এতো কনফিউশন কেনো?
.
রুশো ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাটু চেপে ধরে কয়েকধাপ এগিয়ে গেলো। ফোনটা হাতে নিয়ে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো,
—- এই ফোনটা আমার আংকেল। আপনি মেবি আমার ফোনটা পড়ে থাকতে পেয়ে ট্রাক ড্রাইভারের ফোন ভেবে নিয়েছিলেন।
.
রুশো ভাইয়ার কথায় লোকটা অবাক হয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো,
—- তারমানে আপনি ওই গাড়িতে ছিলেন? আর যিনি ট্রাকচালক ছিলো তিনি মারা গেছেন?
.
বিনিময়ে রুশো ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,
—– জ্বি আংকেল! ট্রাকটা আমার গাড়িতে ধাক্কা মেরে উল্টে ফেলে দিলেও ড্রাইভারেরই মাথায় খুব খারাপ ভাবে চোট লেগেছিলো। আর আমার ফোনটাও তখন আকস্মিক ঘটনায় হাত থেকে পড়ে গিয়েছিলো। আপনি বোধহয় গাড়ির ওমন বাজে অবস্থা দেখে ভেবেছিলেন ভিক্টিম গাড়ির ভেতরে যিনি ছিলো তিনি। বাট একচুয়ালি হয়েছে তার উল্টো। ফোনটা আমার হলেও ভিক্টিম আমি নই।
.
এবার কনফিউশন যেনো আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেলো। মাথার মধ্যে ভনভন করে হাজারো প্রশ্ন জটপাকিয়ে একাকার হতে লাগলো। নীবিড় ভাইয়া অনেক ভেবেও অবশেষে সমীকরণের সমাধান করতে না পেরে প্রশ্ন করলেন,
.
—– তাহলে কিভাবে কি হলো? রুশো ক্লিয়ার করে বলো ফার্স্ট টু লাস্ট!
.
রুশো ভাইয়া সবাইকে শান্ত হতে বলে, জোরে একটা দম ফেলে বলতে শুরু করলো,

—– আজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম এমন সময় রাত্রি আমায় কল করে। কল রিসিভ করে ওর গলা শুনেই আমি গাড়ি থামিয়ে ফেলি। এমন সময় ওর কথার মাঝেই একটা ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঠিক আমার দিকেই আসছিলো। সম্ভবত ব্রেক ফেইল করেছিলো। আমি গাড়ি ঘুড়িয়ে তৎক্ষণাৎ সরে যাবো তার আগেই ট্রাকটা সজোড়ে আমার গাড়িতে আঘাত করে, আমি সুযোগ বুঝে গাড়ির দরজা খুলতেই গড়িয়ে এক সাইডে পরে যাই। ঠিক তখনই ফোনটা আমার হাত থেকে পড়ে যায় যতদূর সম্ভব। আর ট্রাকের আঘাতে গাড়ি উল্টে গিয়ে বেশ কিছুদূর গিয়ে থামে। ট্রাকটা বিপরীত দিকে ঘুরে গিয়ে একটা গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে থেমে যায় কিন্তু ভেতরে ভীষণ বাজে ভাবে চোট পায় ট্রাক ড্রাইভার। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে ট্রাকড্রাইভারের কিছু হয়নি যা হওয়ার গাড়ির ভেতরে যে ছিলো তার হয়েছে বাট ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই আর মাথায় গভীর ভাবে চোট লাগায় প্রচুর ব্লিডিং হয় ট্রাক ড্রাইভারের। কথায় আছে না রাখে আল্লাহ মারে কে! আমার কপালে আর হাটুতে চোট লাগে স্রেফ। নিজেকে সামলে নিয়ে কয়েকজন লোকের সাহায্যে উনাকে তৎক্ষণাৎ হসপিটালে নিয়ে আসি আমি। ট্রিটমেন্টের পেমেন্ট আমি করবো বলেই এডমিট করিয়ে দেই উনাকে। আর আমার ড্রেসিং করিয়ে নেই পাশের কেবিনে। খুব করে প্রে করেছিলাম যাতে উনি বেঁচে যান কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। ট্রিটমেন্ট এর আগেই মারা গেলেন উনি।
.
বলেই ঠোঁট চেপে ধরে চোখ দুটো বুজে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রুশো ভাইয়া। এমন সময় আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে সকলেই নিস্তব্ধ অবস্থায় আবিষ্কার করলাম আমি। হঠাৎ সবার মধ্যে দুজনকে দেখতে না পেয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অভিমানের পাহাড় যেখানে আকাশ সমান ছিলো বর্তমানে তা শুধুই ধোঁয়াশা! আমি ভুল ছিলাম। ভেবেছিলাম কোথাও না কোথাও ভাইয়ার এক্সিডেন্টের পেছনে রাত্রির দোষ রয়েছে। কিন্তু রাত্রির আদৌ কোনো দোষ নেই। গাড়ি স্থির থাকা অবস্থাতেই এক্সিডেন্টটা ঘটে যেহেতু ট্রাকটা নিয়ন্ত্রণহীন ছিলো।
.
—- আম্মুউউ রাত্রি? ও তো সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলো! কোথায় ও? আর নিত্য আপু?
.
ভেতর থেকে একজন নার্স এসে আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
—- একটু আগে যিনি সেন্সলেস হয়ে পড়েন, উনাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে। এমনিতেই শরীর অনেক দূর্বল ছিলো তার ওপর এতোবড় একটা শক নতে পারেন নি।
.
নার্সকে পাশ কাটিয়ে নিত্য আপু আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
—- রাত্রি ভাবছে রুশো ভাইয়ার এক্সিডেন্ট এর জন্য ও দায়ী তাই সেন্স ফেরা মাত্রই সেই এক কথা বলেই ছোটাছুটি করছিলো। এমন চলতে থাকলে আবারও সেন্সলেস হয়ে যেতো। অনেক বোঝানোর পরও ওর সাথে না পেরে ইঞ্জেকশন দিয়ে শুইয়ে রেখেছি। বাড়ি নিয়ে গিয়ে একেবারে রুশো ভাইয়াকে দেখালেই হয়তো শান্ত হবে ও।
.
নিত্য আপুর কথা নিশ্চিত হলাম আমরা। রুশো ভাইয়া হাটু চেপে ধরে ছুটতে ছুটতে কেবিনে গেলো রাত্রির কাছে। ক্ষনিকের মধ্যেই রাত্রিকে কোলে করে নিয়ে ফিরলো রুশো ভাইয়া। যেখানে এমনিতে হাটতেই ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠছে সেখানে রাত্রিকে কোলে নিয়ে কতো সুন্দর নির্দ্বিধায় এগিয়ে চললো ভাইয়া। এর মধ্যে অগ্নি ভাইয়া বিল পে করিয়ে নিলো। হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে রওনা হলাম আমরা সেই আগের ঠিকানায়। আমাদের বাসভবনে!
.
🍂
.
রাত্রিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর হাতটা শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে এক নজরে তার মুখখানায় তাকিয়ে আছে রুশো ভাইয়া। যেনো কতোশত দিন তৃষ্ণার্ত ছিলো এই মুখখানা দেখবার জন্য। খুব কম ডোজেরই ইঞ্জেকশন পুশ করায় কিছুক্ষণের মাঝেই জ্ঞান ফেরার কথা রাত্রির। এই মুহুর্তে রুশো ভাইয়া আর রাত্রিকে নিজেদের মধ্যে স্পেস দেওয়া দরকার তাই আমরা বেড়িয়ে এলাম ঘর থেকে। দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। আন্টির নম্বরে কল করে জানিয়ে দিলাম যাতে চিন্তা না করে, রাত্রি এখানেই আছে।
.
কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ পিট পিট করে খুলতেই রুশোকে এক ধ্যানে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে এক লাফ মেরে উঠে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাত্রি। এভাবে হুট করে জড়িয়ে ধরায় হতভম্ব হয়ে গেলো রুশো। রাত্রি রুশোকে জড়িয়ে ধরেই ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলে উঠলো,
.
—- আ…আপনি ঠিক আছেন রুশো! আ..আমার জন্য আপনার এ..এক্সিডেন্ট হয়েছে! আমি খুনি! আমি মেরে ফেলেছি আপনাকে। আমায় শাস্তি দিন। মেরে ফেলুন আমায়।
.
রুশো বুঝলো রাত্রি তাকে আত্মার সাথে তুলনা করছে মাত্র। ব্যাপারটায় সে নিজেই আহাম্মক হয়ে গিয়েছে রাত্রিকে কি সামলাবে! রুশো জোরে একটা শ্বাস নিলো। সে নিজেও রাত্রিকে নিজের বাহুডোরে শক্ত করে জড়িয়ে আবদ্ধ করে নিলো। রাত্রির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
.
—- আমি বেঁচে আছি এটম বোম্ব! মরে ভূত হয়ে যাইনি। এতো তাড়াতাড়ি তোমার ভালোবাসা না পেয়েই চলে যাবো ভাবলে কি করে?
.
.
.
চলবে……………💕