প্রেম এসেছিলো নীরবে পর্ব-২৭ + বোনাস পর্ব

0
786

#প্রেম_এসেছিলো_নীরবে (২৭)
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
তিনদিনে সুন্দরভাবে বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই আরাফ আর হিয়ার বিয়ে সম্পন্ন হলো।আজ সবাই যার যার নিজ ঠিকানায় চলে যাবে।হিয়া হাউমাউ করে কান্না করছে।কতোক্ষন মাকে ধরছে তো এই বাবাকে ধরছে।হেমন্তকে ধরে তো সেই চিৎকার।নিজের কাকা কাকির কাছে গিয়েও কান্না করেছে।
প্রাহির কাছে গিয়ে ওর কানে কানে ফিসফিস করে বলেছিলো,’ আমার ভাইটাকে দেখে রেখো প্লিজ।’ প্রাহি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।প্রাহির চোখ দিয়েও জল পরছে।
সবার শেষে অর্থ’র কাছে গেলো।অর্থ ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।কলিজার বোনটা চলে যাবে।আর কখনো কোন বায়না নিয়ে আসবে ওর কাছে।মুখ ফুলিয়ে অভিমান করবে না ওর কাছে।অর্থ’র কলিজাটা যেন কেউ টেনে হিচঁরে ছিরে ফেলছে।ছেলেমানুষ হয়ে এই একসমস্যা সহজে সবার সামনে কাঁদতে পারেনা।তাহলে যে বাহিরের মানুষদের কাছে সে দূর্বল প্রমান হবে।ছেলেদের তো হতে হয় শক্ত মনের। যারা কঠিন পরিস্থিতিতেও কাঁদে না।অর্থ হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম কন্ঠে বলে,’ কাঁদেনা তো।ভাইয়া আছি তো।আবার কালকেই তো চলে আসবি আমার কাছে।কাঁদেনা।’

হিয়া অর্থকে ঝাপ্টে ধরে কেঁদে দিয়ে বলে,’ আমি যাবো না ভাই।আমি যাবো না।’

অর্থ হিয়াকে ধরে নিয়েই আরাফের সামনে এসে দাড়ালো।তারপর আরাফের হাতে হিয়ার হাতটা তুলে দিলো।আরাফ করুন চোখে তাকিয়ে আছে হিয়ার দিকে।মেয়েটার কান্না একদম সহ্য হচ্ছে না ওর।একদম না।অর্থ ভেজা কন্ঠে আরাফকে বলে,’ আমার বোনটাকে দেখে রাখিস প্লিজ।বড় আদরের তো।কখনো কষ্ট দিস না।তোর কাছে এই ভাইয়ের এক করুন অনুরোধ।’

আরাফ একসাইড থেকে জড়িয়ে ধরলো অর্থকে।বললো,’ কেন কষ্ট পাচ্ছিস।তোর বোনের কান্না থামা প্লিজ।ওকে আমি কতোটা ভালোবাসি সেটা তো জানিস তুই।ওর কান্নায় আমার কলিজা ছিরে যাচ্ছে।’

অর্থ শুকনো ঢোক গিললো।নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়ে আরাফকে কিছু একটা ইশারা করলো।আরাফ ইশারা পেয়েই।হিয়াকে টেনে অর্থ’র কাছ থেকে ছাড়িয়ে কোলে তুলে নিলো।তারপর সাবধানে গাড়িতে উঠিয়ে দিলো।দ্রুত দরজা আটকে গাড়ি স্টার্ট করতে বললো।হিয়া জানালা দিয়ে চেচাচ্ছে, ‘ ভাইয়া! আমি যাবো না ভাইয়া।’

দেখতে দেখতেই চলে গেলো গাড়িটি সুদূরে।ওরাও রওনা হবে।হেমন্ত আর অর্থ নিজের মা, চাচিকে সামলালো।তারপর তাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিলো।হেমন্ত আর ইশিও তাদের সাথে চলে গেলো।আস্তে আস্তে সব মেহমানও চলে গেলো।শুধু রইলো প্রাহি আর অর্থ।অর্থ প্রাহিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তারাও রওনা হলো।পথে একটা কথাও হলো না।গাড়ি যখন ঢাকা এসে পরলো।অর্থ একটা শুনশান খোলা মাঠে গাড়ি থামালো।তারপর হঠাৎ নিজে গাড়ি থেকে নেমে প্রাহিকে নামালো।পরে দ্রুত পায়ে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে প্রাহিকে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেও ঢুকলো।প্রাহিকে একেবারে গাড়ির দরজার সাথে চেপে বসিয়ে দিয়ে।অর্থ প্রাহির কোলে মাথা রাখলো।
আকস্মিক কি হলো প্রাহির সবকিছু মাথার উপর দিয়ে গেলো।প্রাহি অর্থ’র দিকে তাকিয়ে দেখে ওর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।তবে কি লোকটা কাঁদছে?প্রাহি আৎকে উঠে বলে,’ কি হয়েছে আপনার?দেখি সোজা হন তো।’

অর্থ নড়লো না প্রাহির কোমড় আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।ধীর কন্ঠে বলে,’ ডোন্ট মুভ প্রাহি।আমি কিছুক্ষন তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোতে চাই প্লিজ।’

প্রাহি আর কিছুই বললো না।থাক কিছু সময় একান্ত তাদের মধ্যেকার।যেখানে থাকবেনা কেউ।শুধু সে আর অর্থ।প্রাহি মনে মনে বললো,, ‘ হ্যা আল্লাহ্। আমাকে উনাকে সারাজীবন এইভাবেই রেখো।আমরা যেন কোনদিন আলাদা না হই।’

কেটে গেলো কয়েক মুহূর্ত কয়েক ঘন্টা।অর্থ ঘুমিয়ে আছে প্রাহির কোলে ঠিক বাচ্চাদের মতো করে।প্রাহির পা ঝিমঝিম করছে তাও ভালো লাগছে।এইযে লোকটা তার সাথে আছে তার ভালো লাগছে।প্রাহি আলতো হাতে অর্থ’র চুলগুলো নড়াচড়া করছে।কি সুন্দর চুলগুলো অর্থ’র।

প্রায় ঘন্টা খানিক পর উঠলো অর্থ।উঠেই প্রাহির কপালে চুমু খেলো। প্রাহি লাজুক হাসলো।অর্থ ঘড়ির টাইম দেখে প্রাহিকে ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসলো।তারপর রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
—————
পরেরদিন সকালে,,
আজ হিয়া আর আরাফের বউভাত।সবাই রেডি হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার জন্যে।প্রাহি সুন্দর একটা পুরো লাল টকটকে রঙের গাউন পরেছে।রেডি হয়ে নিচে নামতেই অর্থ বাঁকা হেসে ওকে চোখ টিপ মেরে দিলো।প্রাহি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো।অর্থ প্রাহিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।পিছনের সিটে হেমন্ত আর ইশি বসেছে।হেমন্ত বারবার আঁড়চোখে ইশির দিকে তাকাচ্ছে।ইশি মুখটা কাচুমাচু করে বসে আছে।হেমন্ত ওর পাশে বসাতে ওর যেন কেমন লাগছে।আবার ভালোও লাগছে।
অর্থ ড্রাইভিংয়ের ফাকে ফাকে প্রাহির দিকে তাকাচ্ছে।মেয়েটাকে লাল গাউনে যেন একটা ফুটন্ত গোলাপ মনে হচ্ছে।
চোখ সরানো দায় হয়ে পরেছে।
প্রাহি তো লজ্জায় মাথাই তুলতে পারছে না।হেমন্ত আর ইশির সামনে লোকটা কি শুরু করেছে।আবার হাতটাও ধরে রেখেছে।গাড়ির গিয়ারের উপর রেখে তার উপর নিজের হাত রাখা।ইসস, অসম্ভব ভালো লাগছে প্রাহির।কিন্তু আবার লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে।
সেন্টারের সামনে গাড়ি থামতেই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় ওরা।তারপর সেন্টারের মাজে প্রবেশ করে। রায়হানা,হিয়াজ,হেনা, হিয়ান্ত আর ওদের দাদা অনেক আগেই এসেছে সেন্টারে।শুধু ওদেরই আসতে একটু দেরি হয়েছে।
অর্থ আর হেমন্তকে দেখেই হিয়া প্রায় একপ্রকার দৌড়ে গিয়েই ওদের জড়িয়ে ধরে।তারপর কান্না ভেজা গলায় বলে, ‘ আমার কথা বুজি তোমাদের মনে পড়ে না?এতো দেরি করলে কেন?’

অর্থ আর হেমন্ত’র চোখজোড়াও ছলছল করছে।অর্থ হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,’ এইতো এসে গেছি।আজ আমার বোনটাকে নিয়ে যাবো সাথে করে।’

হেমন্ত হিয়ার মন ভালো করার জন্য দুষ্টুমি করে বললো,’ ইসস, কালকের দিনটা অনেক ভালো ছিলো।শাকচুন্নি বাড়িতে ছিলো না।আজ আবার বাড়িতে শাকচুন্নির তাণ্ডব শুরু হবে।’

হিয়া মুখ ফুলিয়ে কাঁদো গলায় বললো,’ ভাইয়া!!!! এই হেমন্ত ভাইয়াকে কিছু বলবে?’

সবাই হেসে দিলো ওদের দুষ্টুমি দেখে।হিয়া গিয়ে প্রাহি আর ইশিকেও জড়িয়ে ধরে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো।আরাফও এসে ওদের সাথে হাসি ঠাট্টায় যোগ দিলো।
প্রাহি এর মাজে পানির তৃষ্ণা লাগায় ও সবাইকে বলে একটু পানি খেতে যায়।যাওয়ার পথে একজন ওয়েটারের সাথে ধাক্কা লেগে ওর গায়ে জুস পরে যায়।ওয়েটারটা দ্রুত বললো, ‘ সরি সরি। সরি ম্যাম।আমি খেয়াল করতে পারিনি।প্লিজ আমাকে ক্ষমা করুন।’

প্রাহি ওর গাউনের জুসগুলো ঝেরে সোজা হয়ে বলে,’ ইট্স ওকে ভাইয়া।আমাকে একটু ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দিন। এতেই হবে।’

‘ সিয়র ম্যাম।চলুন।’

প্রাহি ওয়েটারের সাথে ওয়াশরুমের সামনে আসলে ওয়েটারুটাকে প্রাহি চলে যেতে বলে।তারপর ও ওয়াশরুমে ডুকে পানি দিয়ে নিজের জামা ক্লিন করতে লাগলো।হঠাৎ ওয়াশরুমের লাইট ওফ হয়ে গেলো।প্রাহি আচমকা এমন হওয়ায় ভয় পেয়ে যায়।ঘাবড়ানো গলায় বলে, ‘ এক্সকিউজ মি?প্লিজ?কেউ আছেন?এক্সকিউজ মি?’

প্রাহি দরজার কাছে গিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করলেই দেখে দরজা খুলছে না।প্রাহি অনবরত ডাকতে থাকে। কিন্তু কেউ শুনে না কারন বাহিরে লাউডে গান বাজছে।প্রাহির চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে।প্রাহি পিছাতে গিয়েই কারো সাথে ধাক্কা খায়।আৎকে উঠে পিছনে ঘুরতেই।ব্যাক্তিটি ওর মুখে কিছু একটা চেপে ধরে।প্রাহির চোখ ঝাপ্সা হয়ে আসছে।আস্তে আস্তে চোখ বুজে আসছে।শুধু চোখের সামনে ওর অর্থ’র চেহারাটাই ভেসে উঠছে।প্রাহি চোখ বুজে বিরবির করতে লাগে, ‘ অর্থ ভাইয়া।কোথায় আপনি।প্লিজ জলদি আসুন।’

আস্তে আস্তে চোখ বুজে ফেললো প্রাহি।আর ওই ব্যাক্তিটি বিশ্রি ভাবে হাসতে লাগলো। হাসি থামিয়ে প্রাহিকে কাঁধে তুলে নিয়ে বলে, ‘ তোকে ওই অর্থের সাথে এতো সহজে দিয়ে দিবো কিভাবে?যেখানে তোর দিকে আমার সেই কবে থেকেই।ভাবছিলাম তোকে এই একটা বছর কিছুই করবো না।কিন্তু তোর প্রতি অর্থর ভালোবাসা দেখে সহ্য হচ্ছিলো না।আবার তুইও ওকে ভালোবাসিস।দ্যাট্স নট ফ্যায়ের।আমি একরাত হলেও তোকে চাই।চাই মানে চাই।তুই নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলি। এখন থেকে একটা বছর তুই আমার কাছে থাকবি।পাখিকে খাচায় এমন ভাবে আটকাবো যাতে ও কখনই উড়াল দিতে না পারি।যদি বেশি ফর ফর করে ওর ডানাটাই আমি ভেঙ্গে দিবো।’
——————-
অনেকক্ষন যাবত প্রাহিকে দেখছে না অর্থ।নিজে একা একাই এদিক ওদিক খুজে বেরাচ্ছে।তাও পাচ্ছে না খুজে।অবশেষে একা আর না পেরে হেমন্ত আর আরাফকে জানালো কথাটা।আস্তে আস্তে ওদের পুরো পরিবার জানলো যে প্রাহিকে পাওয়া যাচ্ছে না।সবাই ভয় পেয়ে যায়।পুরো সেন্টার তন্নতন্ন করে খুজতে থাকে।কিন্তু না প্রাহি নেই কোথাও নেই।অর্থরতো পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম।ওর প্রাহি হঠাৎ কোথায় গেলো।কি হলো ওর প্রাহির।এখন কোথায় খুজবে সে।চাইলেও নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না অর্থ।চিৎকার করে কান্না ভেজা কন্ঠে বলে, ‘ প্রাহি, কোথায় গেলে তুমি?আর কোথায় খুজবো তোমাকে।প্লিজ প্রাহি।কোথায় তুমি একবার বলো প্লিজ।আর কোথায় খুজবো।কেন বার বার তোমার সাথেই এমনটা হয়।’

অর্থ কিছু একটা ভেবে চোয়াল শক্ত করে হনহন করে হেটে গিয়ে ইলফার গলা চেপে ধরলো।হুংকার ছুরে বলে,’ কোথায় আমার প্রাহি?কি করেছিস ওর সাথে। বল নাহলে আজ তোকে মেরে ফেলবো।’

ইলফার চোখ উলটে আসছে।শ্বাস নিতে পারছে না।হেমন্ত আর আরাফ গিয়ে ওকে ছাড়িয়ে আনে।হেমন্ত বলে,’ কি করছিস ভাই।ও তো মরে যাবে।’

অর্থ রেগে আগুন হয়ে দাঁত খিচিয়ে বলে, ‘ মরে যাক।ওই আমার প্রাহিকে কিছু করেছে।ওকে বল বলে দিতে আমার প্রাহিকে ফিরত দিতে।’

আরাফ তেড়ে গিয়ে ইলফাকে ঠাস করে একটা চর বসালো।তারপর ওর চুলের মুঠি ধরে বলে,’ ভালোই ভালোই বলে দে প্রাহি কোথায়?নাহলে তোকে এক্ষুনি স্যুট করে দিবো।ভুলে যাবো তুই আমার বোন।’

ইলফা কাঁদছে।সাথে কাঁদছে ওর মা।ইলফা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ বিশ্বাস করো ভাইয়া।আমি কিছু করেনি প্রাহিকে।সেদিনের পর থেকে তো আমি ওর সামনেও যায়নি।ওর ক্ষতি করার কথা সেই কবেই মাথা থেকে ঝেরে ফেলেছি।’

আরাফ আবারও একটা থাপ্পর মারলো।ওর গাল চেপে ধরে বলে, ‘ সত্যি করে বল।প্রাহি কোথায়?’

ইলফা এইবার চিৎকার করে বলে, ‘ আমি কিছু করনি।যা করেছে অন্য একজন করেছে।আমি সত্যি প্রাহির ক্ষতি করতে চেয়েছিলাম।কিন্তু আমাকে একজন ফোন করে থ্রেড দিলো যে প্রাহির কিছু করলে নাকি আমাকে মেরে ফেলবে সেই থেকেই আমি প্রাহিকে ক্ষতি করার চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলেছি।কারন আমার নিজের জানের মায়া আছে।’

অর্থ রাগি কন্ঠে বলে, ‘ কে কি বলেছে।জলদি বল?কে তোকে থ্রেড দিয়েছে?’

ইলফা একবাক্যে বলে দিলো, ‘ ব্লাকহান্টার নামের একজন ফোন করে থ্রেড দিয়েছিলো।’

হেমন্ত, আরাফ আর অর্থ একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলো।আরাফ ইলফাকে প্রায় একপ্রকার ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে।ওরা তিনজন হন্তদন্ত হয়ে সেন্টার থেকে বেড়িয়ে গেলো।এদিকে বাড়ির সবাই চিন্তায় অস্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলো।তবে একজনের মুখে শুধু শয়তানি হাসি।ও ফিসফিস করে বলে৷,’ যতো খোজার খুজে নে।তোরা পাবিনা ওকে কোনদিনই।’

#চলবে________

#প্রেম_এসেছিলো_নীরবে(বোনাস পর্ব)
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
‘ কোথায় আর খুজবো ওকে আমি?কিভাবে খুজে পাবো?না জানি আমার প্রাহিকে ওরা কি অবস্থায় রেখেছে।আমার মাথা কাজ করছে না।’ ধরা গলায় কথাগুলো বললো অর্থ।

হেমন্ত নিজেরও চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।যেতোটুকু পেরেছে প্রায় একপ্রকার তন্নতন্ন করে খুজেছে প্রাহিকে তারা কিন্তু পায়নি। হেমন্ত নিজেকে শান্ত করলো।এই মুহূর্তে ওকে সবটা সামলাতে হবে। নাহলে অর্থ আরো ভেঙে পরবে।হেমন্ত ধীর কন্ঠে বলে, ‘ ভাই চিন্তা করিস না।আরাফ ভাইয়া গিয়েছে তো পুলিশ ফোর্স নিয়ে।আমরা আবারও বের হবো খুজতে।চিন্তা করো না।’

অর্থ চোখ বুজে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিচ্ছে।তারপর উঠে গিয়ে ওয়াশরুমে মাথায় ইচ্ছামতো পানি ঢাললো।মাথাটা প্রচুর ব্যাথা করছে।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসলো অর্থ।ওকে আবারও প্রাহিকে খুজতে বের হতে হবে।তার আগে এই মাথা ব্যাথা কমাতে হবে।অর্থ ওর ড্র‍য়ার থেকে মেডিসিন বের করতে নিলেই।কিছু একটা ওর চোখে পরে।তা দেখেই অর্থ’র চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে উঠে।ওর তো মনেই ছিলো না এটার কথা।দ্রুত পায়ে বাহিরে বের হয়ে হেমন্ত’র কাছে গেলো।গিয়ে বললো, ‘ হেমন্ত চল দ্রুত।আর আরাফকে ফোন করে বলে দে আমার গাড়িকে ফলো করতে।

হেমন্ত কোন প্রশ্ন করলো না।শুধু যা বললো তা কথামতো পালন করলো।তারপর ছুটলো গাড়ি নিয়ে তারা।

————-
চোখজোড়া আস্তে আস্তে খুলে তাকালো প্রাহি।মাথাটা ভার ভার লাগছে প্রচুর।অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে।ঝাপ্সা চোখজোড়া স্পষ্ট হয়ে আসতেই আশেপাশে তাকায় প্রাহি।ক্ষীন আলোয় বুজা যাচ্ছে এটা একটা ছোট খাটো বেডরুম।যেখানে একটা স্টিলের বেড, একটা ছোট টেবিল আর চেয়ার বাদে কিছু নেই।চেয়ারটাতেই ওকে বেধে রাখা হয়েছে।প্রাহি হালকা আওয়াজে বললো,’ কেউ আছেন প্লিজ?আমাকে মুক্ত করে দিন প্লিজ।কেউ আছেন?প্লিজা আমাকে যেতে দিন।’

তারপর হু হু করে কেঁদে দিলো প্রাহি।কি হচ্ছে ওর সাথে এসব?ওর সাথেই কেন সবাই এমন করে?মানুষ ওর ভালো চায়না কেন? প্রাহি আবারও কান্না করতে করতে বললো, ‘ প্লিজ আমাকে যেতে দিন প্লিজ।অর্থ ভাইয়া আপনি কোথায়?আমাকে নিয়ে চলুন প্লিজ?আমার ভয় করছে।’

প্রাহি এইবার জোড়েই কেঁদে দিলো।ঠিক তখনি খট করে দরজাটা খুলে গেলো। আর একটা লোক প্রবেশ করলো।প্রাহি অস্রুসিক্ত চোখে সামনে তাকাতেই।ক্ষীন আলোতে যাকে দেখে তাতে ও অবাক না হয়ে পারে না।অবাকের শেষ সীমান্তে পৌছে গেছে ও।অস্পষ্ট কন্ঠে বলে,’ জয় ভাইয়া, তুমি?’

জয় হাসলো।তারপর প্রাহির সামনে গিয়ে ওর গালজোড়া সজোড়ে চেপে ধরলো।প্রাহি ব্যাথায় কুকরে উঠলো।জয় দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘ কি ভেবেছিস?আমি এখানে দেশে না থাকলেই তুই যা মন চায় তাই করবি?এতোই সোজা?আমার এতোদিনের ভালো মানুষির পিছনে যে উদ্দেশ্য ছিলো তা পূরন না করেই তোকে ওই অর্থ’র হতে দিবো?নেভার এভার।কখনই না।তোকে সুযোগ দিয়েছিলাম।তোর আঠোরো বছর বয়স অব্দি অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম।তোকে বিয়ে করবো ভেবেছিলাম।কিন্তু পাখি যে আমার খাচা ছেড়ে, অন্যের খাচাতে ভালোবেসে ঘর বেধেছে।তা কি করে মেনে নেই।’

কথাগুলো বলেই সজোড়ে প্রাহির গালে চর মেরে দিলো জয়।প্রাহির ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরতে লাগলো।প্রাহি কাঁদছে আর মনে প্রানে অর্থকে ডাকছে। জয় এইবার চুল মুঠি করে ধরলো প্রাহির। প্রাহি চোখ মুখ খিচে রেখেছে ব্যাথায়।প্রাহি ভেজা চোখে তাকিয়ে বলে, ‘ শেষ মেষ তুমিও ভাইয়া। তুমিও আমার ক্ষতিটাই চাইলে?কেন? বলো কেন তোমরা আমার ভালো দেখতে পারো না?কি এমন ক্ষতি করেছি আমি তোমাদের?’

জয় বিকট হাসলো।হাসতে হাসতে বলে, ‘ এতেই এই অবস্থা?যখন সব রহস্যেগুলো জানতে পারবি তখন কি হবে?’

প্রাহি বুজতে না পেরে বলে, ‘ মানে? ‘

জয় ঘারের পিছে হাত রেখে আয়েশি ভঙ্গিতি বলে, ‘ তোকে ছোট থেকে এতোটা আদর করা।বিদেশে গিয়েও অনবরত তোর খোজ খবর নেওয়া।এইগুলো কি আমি শুধু শুধুই করেছি?উহুম নাহ।তোর কাছে ভালো সাজতে চেয়েছিলাম।যাতে তুই আমাকে পছন্দ করিস।তোকে বিয়ে করতে পারি আর তোর নামের সকল সম্পত্তিও আমার হতে পারে।কিন্তু, কিন্তু আমার ওই ইডিয়েট বাবা মা দুটো।গাধাদের মতো কিসব প্লান করে আমার পুরো প্লানটাই উলটে দিলো।আর এই তোকে বিয়ে দেওয়ার মতো গাধামো করলো।তবে এই বুদ্ধি যে দিয়েছে কে সেটা আমি খুব ভালোভাবে জানি।আসছে হয়তো।আমার লোকেরা জানালো।গার্ডেনে আছে।আমি একটু আটকে রাখতে বলেছি।’

প্রাহির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো এক একটা কথা শুনে। কাঁপা গলায় বলে, ‘ মানে মামা মামিও আমাকে আমার সম্পত্তির জন্যে এসব করেছিলো?আর? কে আসবে?আর কে বাকি আছে বলো?আমিও দেখতে চাই।সে সকল জঘন্য মানুষদের চেহারা।যারা যারা এইসব জানোয়ারের মতো কাজ করছিলো।’

জয় ঠাস করে আরেকটা চর লাগালো প্রাহির গালে।তারপর বলে, ‘ তো তুই কি মনে করিস?তোকে এতোদিন বাচিয়ে রেখেছে এমনি এমনি?সবকিছুর পিছনেই সবার উদ্দেশ্য থাকে।আর আমি তো এসবে যুক্ত হয়েছি সবে মাত্র চার,পাচ বছর হবে হয়তো।কিন্তু আসল কাল্প্রিটকে দেখলে তুই কি বলবি?যে এইসব জঘন্য খেলার আসল মাষ্টার মাইন্ড!’

প্রাহি নিজেকে শক্ত করলো।নরম হলে চলবে না।ওকে জানতেই হবে আসল মানুষটি কে যে এইসব জঘন্য খেলাগুলো সাজাচ্ছে। তাই শক্ত কন্ঠে বলে, ‘ কে সে আমি জানতে চাই।’

জয় হেসে দিয়ে বলে, ‘ অবশ্যই জানবি।তুই আমার বউ হতে যাচ্ছিস।তো আমার বউয়ের ইচ্ছা কি আমি অপূর্ণ রাখতে পারি? ওয়েট আসতে বলছি ওকে।’

প্রাহি ঘৃনায় চোখ ঘুরিয়ে নিলো। এই লোকটা যে এতোটা জঘন্য সে আগে জানতো না।প্রাহির সাথে ওর মামা বাসায় একমাত্র ভালো ব্যবহার কতো ওর এই মামাতো ভাই জয়।কিন্তু তার পিছনে যে এরকম জঘন্য উদ্দেশ্য আছে জানতো না।জয় বিদেশ চলে গিয়েছিলো স্টাডি করতে।প্রাহির যখন তেরো বছর বয়স তখনি প্রাহিকে প্রথম দেখেছিলো।একবছর দেশে থেকেছিলো।সেই একটা বছর প্রাহি অনেক শান্তিতে ছিলো।কারন জয়ের কারনে প্রাহির মামা মামি ওকে কিছু বলতে পারতো না।এক বছর পর বিদেশে চাকরি পাওয়াতে আবার চলে যায় ও।কিন্তু প্রাহির অনেক খোজ খবর নিতো। প্রাহিও নিজের বড় ভাইয়ের মতো ভালোবাসতো জয়কে। কিন্তু জয়ের যে এরকম জঘন্য মতলব ছিলো জানতো না সে।

প্রাহির ভাবনার মাজে দরজায় খটখট আওয়াজ হয়।প্রাহি সেদিকেই তাকালো।জয় যখন দরজা খুলে দিলো তখন দরজা দিয়ে যে প্রবেশ করলো।তাকে দেখে যেন প্রাহির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো।এই মানুষটা এসব করতে পারে জীবনে ভাবতেও পারিনি ও।তাহলে শেষ মেষ ওর সকল ধ্বংশগুলো ওর কাছের মানুষরাই করলো?
প্রাহির হাত পা কাঁপছে।এতোটা যন্ত্রনা ও সহ্য করতে পারছে না।ঝাপ্সা হয়ে আসছে চোখ।চোখজোড়া বুজে আসতে আসতেই এস্তে করে বললো, ‘ কেন করলেন এমন?কেন করলেন?অনেক বিশ্বাস করতাম আপনাকে?কেন করলেন এমন? সম্মান করতাম।কেন করলেন?’

#চলবে_______