প্রেম প্রেম পায় পর্ব-০১

0
511

#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব এক

১.
‘আমি তোমার থেকে ১২ বছরের বড়! আর তুমি আমাকে আবেগ দেখাও?’
গম্ভীরভাবে বলে কিছু একটা লেখায় মন দিল ফায়াদ।
সেই গম্ভীরভাব মনোযোগ দিয়ে দেখছে অপরাজিতা।ইশ মানুষটাকে এতো সুন্দর হতে হবে কেন?যেভাবে দেখে সেভাবেই ভালোলাগে।আর লোকটা বলে কিনা সে আবেগ দেখায়।সে কি জানে তার হাসি,কথা অষ্টাদশী হৃদয়ে ঝড় তুলে! জানে না বোধহয়। জানলে এতো সুন্দর করে হাসতো না,কথা বলতে গিয়ে সহস্রাধিক বার ভাবতো। সে যদি জানতো তার হাসি একজনের বুকে ব্যথা বাড়ায় তাহলে নিজের হাসির উপর সিল করে দিত।

ফায়াদ দেখলো সে মুগ্ধ দৃষ্টি। সে যেনো এই চোখে অনেক ভালোবাসা খুজে পাচ্ছে। ফায়াদ গলা খাকারি দিল।ধ্যান ভাঙলো অপরাজিতার। কিছুটা লজ্জিত ও হলো। ফায়াদ আবার বলল,
‘ পাগলামি না করে বাসায় যাও।’

‘ডাক্তার সাহেব রোগীদের বুঝি এভাবেই তাড়িয়ে দেন।’

‘প্রেম রোগের চিকিৎসা আমার কাছে নেই।’

‘৫০০ টাকা ভিসিট আর ১০০ টাকা গাড়িভাড়া দিয়ে এসেছি।আধাঘন্টার আগে যাবোই না।’

মুচকি হেসে ফায়াদ মানিব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার নোট বের করে অপরাজিতার সামনে রেখে দিল।
‘ক্ষতিপূরণ দিলাম।এবার বাসায় যাও’

অপরাজিতা বিরবির করে বলল,
‘সবচেয়ে বড় ক্ষতির পূরণই তো দিচ্ছেন না।’

ফায়াদের কানে কিছুটা আসে অপরাজিতার বিরবির। সে বলল,
‘যেচে নিজের ক্ষতি করে আমার কাছে ক্ষতিপূরণ আশা করছো?বোকা মেয়ে!’

অপরাজিতা গাল ফুলিয়ে তাকালো।তাকে সবাই বলে সে নাকি খুব চালাক। অথচ এই একটা মানুষ তাকে সবসময় বোকা বলে।

ফায়াদ এবার সোজা হয়ে বসে বলল,
‘এবার এসো তুমি। বাহিরে রোগীরা অনেক্ক্ষণ অপেক্ষা করছে’

অপরাজিতা শান্ত পায়ে বেরিয়ে এলো চেম্বার থেকে।ফায়াদ কাজের ক্ষেত্রে খুব সিরিয়াস সে জানে।
ফায়াদ! ফায়াদ আহমেদ নাম তার। সভ্য আর সুদর্শন এর তালিকায় নিঃসন্দেহে তার জায়গা রয়েছে। আর এই সভ্য যুবক এর উপর নজর পড়েছে চঞ্চল অপরাজিতা ইসলাম এর। কিছু না করেও কিশোরী অপরাজিতার মনে জায়গা করে নিল এই পুরুষ। তাও যেমন তেমন জায়গা নয় একেবারে খুটি গেড়ে বসে আছে। সেই যে কিশোরী বয়সে হানা দিয়েছে এই ব্যক্তি আর বের হচ্ছে না।এতে কি অপরাজিতার দোষ? সে তো বলে নি তার মনে জায়গা করতে। এখন মন এর কথা তো শুনতেই হবে। নাহলে তো মন তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে।ফলে মন তার কথা শুনবে না, ডিপ্রেশন এ ভুগবে ব্লাহ ব্লাহ। না বাবা থাক! অপরাজিতা আবার বড্ড ভালো মেয়ে। সে মন এর কথা শুনবে। যুদ্ধ টুদ্ধের দরকার নেই।

চেম্বায় থেকে বের হয়ে অপরাজিতা রিকশা নিয়ে বাসায় এলো।বাসায় এসে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করেই দিল এক চিৎকার।
‘বাবায়ায়ায়া!’
সোফায় বসে ছিলেন আসিফ ইসলাম।মেয়ের চিতকারে হাত দিয়ে কান ঢেকে হেসে দিলেন৷ অপরাজিতা দৌড়ে এসে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। আসিফ ইসলাম জানতেন মেয়ে যে এমন করবে। বড্ড আদরের মেয়ে। বাবাকে জড়িয়েই বসে রইলো সে।
‘কেমন আছে আমার আম্মিজান?’

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অপরাজিতা অভিমান করে বলল,
‘এত দেড়ি করে এসেছো কেন বাবা?’

মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘কাজ ছিল আম্মিজান।তুমি কোথা থেকে আসলে৷ মাকে নাকি বলে যাও নি। এতো জালাতন কর কেন তোমার মা কে?’

অপরাজিতা দাত দিয়ে জিভ কাটলো। কাউকে তো বলা যাবে না সে যে তার প্রণয় পুরুষকে দেখার তৃষ্ণা মিটাতে গিয়েছিল। বাবার কাছে বলল,
‘জালাই না তো বাবা।আমি তো একটু তিন্নির বাসায় গিয়েছিলাম। ২ মাস পর তো এইচএসসি।একটু নোট লাগতো।’

‘ঠিক আছে কিন্তু মাকে বলে যাবেন পরের বার।এখন রুমে যান।বাহিরে থেকে এসেছেন।’

‘বাবা তোমার কি একটাই সন্তান?’
গাল ফুলিয়ে অভিযোগ করে উঠলো অপরাজিতার ছোট ভাই আবির।

অপরাজিতা ফিক করে হেসে দিল।বাবার কাছে থেকে উঠতে উঠতে বলল,
‘হিংসুটে!’

আবির অভিযোগ এর সুরে ডেকে উঠলো,
‘বাবায়া!’

অপরাজিতা ভেংচি কেটে চলে গেল রুমে।তা দেখে হেসে দিলেন আসিফ ইসলাম।রুমে গিয়ে অপরাজিতা ভাবতে বসে গেলো তার প্রেম রোগের ডাক্তার কে নিয়ে। লোকটার সাথে দেখা হয়েছিল এক বিয়ে বাড়িতে। বাবার বন্ধুর মেয়ের হলুদে ছিল। তখন অপরাজিতা ছিল কিশোরী। দুরন্তপনা যেন তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল। সেখানে আরেক বান্ধবী পেয়ে তার সাথেই ছোটাছুটি করছিল।আবার একা একাও এখানে সেখানে ঘুড়ে বেড়াচ্ছিল।মেয়েটা শাড়ি পড়েও বিনা ভয়ে দৌড়াদৌড়ি করছিল। ঘুড়তে ঘুড়তে এক জায়গায় গিয়ে দেখলো তার বাবার বয়সী লোক একজন যুবক কে কিছু বলছেন।বলছেন বলতে তার কাছে লাগলো ধমকাচ্ছেন।অপরাজিতার আবার ঝগড়াঝাটি দেখতে ভালোলাগে। তাই সে সামনে আগালো দেখার জন্য। সামনে এগিয়ে বুঝলো তারা বাপ ছেলে। বাবা তার ছেলেকে বলছে,
‘দিন দিন বড় হচ্ছো নাকি ছোট হচ্ছো বুঝি না আমি।কোথায় কাজিনের বিয়ে হচ্ছে ঘুরবে মেয়ে পটাবে, তা না করে এক জায়গায় চুপচাপ মোবাইল চালাচ্ছো।বাবা হয়ে এখন আমার তোমাকে গার্লফ্রেন্ড খুজে দিতে হবে? আশ্চর্য!’

ছেলেটা চ জাতীয় শব্দ করে বলল,
‘আহা আব্বু আপনার আমাকে নিয়ে গর্ব করা উচিত উলটা আপনি আমাকে মেয়ে পটানো শিখাচ্ছন!কি আজব বাপ রে! এক কাজ করেন আমাকে না শিখিয়ে আপনি গিয়ে পটান কাউকে৷ আর কেউ পাত্তা না দিলে আম্মুর উপরেই প্রয়োগ করেন এই মেয়ে পটানো টেকনিক।’

বাবা অবাক হয়ে ধমক দিয়ে বললেন,
‘অসভ্য! বলে কিনা আমাকে মেয়ে পটাতে ফাজিল ছেলে! না জানি জীবনে এর বিয়ে দেখতে পারবো কিনা! থাকো তুমি! বউ জুটবে না তোমার বলে রাখলাম!’

বলেই চলে গেলেন তিনি। বাবা চলে যেতেই ছেলেটা আবার মোবাইল এ মনোযোগ দিল।বুঝাই যাচ্ছে তার কাছে খুবই নরমাল এগুলো।সে সামনে এগুতেই অপরাজিতাকে দেখলো মুখে হাত চেপে হাসতে। বুঝতে পারলো তার আর তার বাবার কথা শুনে হাসছে। ছোটখাটো একটা ধমক দিয়ে বলল,
‘আড়িপেতে মানুষের কথা শুনো আবার হাসো! ফাজিল মেয়ে!’

ধমক খেয়ে হাসি বন্ধ হয়ে গেল অপরাজিতার৷ শাড়ি উচিয়ে ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আমিও বললাম বউ পাবেন না দেখিয়েন। হুহ!’

বলেই ভেঙচি কেটে দিল দৌড়। দুদিনের মেয়ে ছেলেটাকে এভাবে ভেঙচি কেটে দৌড় মারলো তা যেন সহ্য হলো না ছেলেটার। অবাক সে৷ মনে মনে বোধহয় ভাবছিল ‘আজকাল এর মেয়ে গুলো বড়দের সম্মান দেওয়া ভুলে গেছে।ফাজিল!’

ভেবেই অপরাজিতে হেসে দিল৷ সেদিন লোকটাকে বলেছিল বউ পাবে না অথচ দেখো সেই লোকটাকেই তার মনে বসিয়ে রেখেছে।পরে অপরাজিতার বাবা যখন তার পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করে কথা বলছিল তখন সে জানতে পেরেছে লোকটা কনের কাজিন ফায়াদ।তবে অনুভুতি সেদিন থেকে শুরু নয়।সেদিনের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল অপরাজিতা৷

ঘুম ভাঙলো ছোট ভাইয়ের ডাকে। ঘড়ি দেখে রাত আটটা। দেখেই লাফিয়ে উঠলো। আজ তার খবর আছে। আবির কে জিজ্ঞেস করলো,
‘মা কই?’

‘আম্মু তোমাকে অনেকবার ডেকেছিল কিন্তু তুমি উঠোনি।’
ঠাস করে থাপ্পড় মারলো আবিরের মাথায়।
‘মারলা কেন আপু?’ গাল ফুলিয়ে বলল আবির।

‘তোকে জিজ্ঞেস করছি আম্মু কই তুই বলোস আম্মু অনেকবার ডাকছে।আমি তো জানি অনেকবার ডাকছে। এই তোরে ক্লাস ফাইবে উঠাইসে কে হ্যা? জিজ্ঞেস করি একটা বলোস আরেকটা।হাট সামনের থেকে!’

গাল ফুলিয়ে চলে গেলো আবির।
অপরাজিতা ফ্রেশ হয়ে নিচে রুম থেকে বের হয়ে দেখে তার বাবা সোফায় বসে চা খাচ্ছে টিভি দেখছে আর মা মিসেস রামিসা টেবিলে খাবার রাখছে৷ রাতের খাবারের সময় হলো বলে।মাকে দেখে অপরাজিতা একটা কিউট হাসি দিল।বিনিময়ে রামিসা চোখ রাঙানি দিলেন। মায়ের কাছে গিয়ে মায়ের গা ঘেসে বলল,
‘আম্মু সর‍্যি তো। আর এভাবে ঘুমাবো না।’

রামিসা বেগম পাত্তা না দিয়ে আসিফ ইসলামকে বললেন,
‘আপনার মেয়েকে বলেন এইখানে কোনো আম্মু নেই। বার বার বলেছি না খেয়ে ঘুমাতে না। সকালেও খাবে না দুপুরেও খাবে না! ভালোই। কালকে থেকে আমি আর রান্নাই করবো না।’

আসিফ ইসলাম রাগী ভাবে মেয়ের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলেন।উদ্দেশ্য স্ত্রী কে সমর্থন করা। কিন্তু মেয়ের অসহায় চেহেরা দেখে আর রাগ দেখাতে পারলেন না।তাই আবারও টিভিতে মনোযোগ দিয়ে বললেন,
‘তুমিই বলো’

রামিসা বেগম চেতে গিয়ে বললেন,
‘হ্যা আমিই তো বলবো।আমারই তো ঠেকা।এগুলার যত্ন নাও, নাহয় অসুস্থ হবে দেখাশোনা কর! তারউপর এরা আবার আমার কথাও শুনবে না। এই শুনেন! আবার যখন ব্যবসায়ীক কাজে যাবেন এই দুইটারে সাথে নিয়ে যাবেন।আমার হইসে যত জালা!’

আবির গাল ফুলিয়ে বলল,
‘আম্মু আমি কি করসি?’

রেগে তাকালেন রামিসা বেগম।ছোট ছেলেটিও হয়তো বুঝলো কথা বললেই এখন বিপদ তাই চুপ রইল সে। অপরাজিতা মাকে আবার ধরে বলল,
‘স্যরি আম্মাজান।সকালে তাড়াহুড়ায় ছিলাম আর বাসায় এসে কিভাবে যে ঘুমিয়ে গেলাম বুঝতেই পারি নি। তুমি তো জানো আমি ঘুমালে সহজে উঠি না।এখন অনেকক ক্ষুদা লাগছে। বাহিরের হাবিজাবি বাদে কিছু পড়ে নাই পেটে খাবার দাও না আম্মাজায়ায়ায়ান!’

দিলেন রামিসা আরেক ধমক,
‘বস!দিচ্ছি। সারাদিন না খেয়ে রাতে এসে চিল্লাবে। আম্মাজান!!!ফাজিল’

শেষ কথাটা ব্যঙ্গ করে বললেন। অপরাজিতা মুখ ফুলিয়ে বসে পড়লো খেতে৷ তা দেখে ফিক করে হেসে দিলেন আসিফ ইসলাম।বউ এর চোখ রাঙানি দেখে আবার চুপও হয়েগেলেন।

খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল অপরাজিতা। এতোক্ষণ ঘুমানোর কারনে ঘুম তো এখন আসবে না। খেয়ে দেয়ে রুম এ আসতে আসতে দশটা বেজে গেল।
মোবাইল হাতে নিল। ঘুম যেহেতু আসবেই না, প্রণয় পুরুষকে একটু জালাত্বন করা যাক। ভেবেই মুচকি মুচকি হাসলো অপরাজিতা।মোবাইল হাতে নিয়েও কিছু একটা ভেবে মোবাইল টা রেখে দিল।আয়নার সামনে গেল। কাজল দিল, লিপস্টিক দিল।হালকা সাজুগুজু করে কল লাগালো।
প্রথমবারে রিসিভ হলো না। দ্বিতীয়বারে বেশ কিচ্ছুক্ষণ পর রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে কেউ তার গম্ভীর সরে বলে উঠলো,
‘মাত্র বাসায় আসলাম। তুমি আমাকে ফ্রেশও হতে দিবে না?জালাতন করবে না।রাখো ফোন!!’

শেষ কথাটা কিছুটা ঝাড়ি দিয়ে বলল। কণ্ঠ শুনেই যেন অষ্টাদশীর হৃদয় জুড়িয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি করে বলল,
‘না না না ফোন রাখবেন না।আজ আমি সাজুগুজু করেছি।’

শুনে ফায়াদ ভ্রু কুচকে বলল,
‘তো?’
অপরাজিতা ফোন এর এপাশ থেকেই লাজুক সরে বলল,

‘আপনি একটু মনের চোখ দিয়ে দেখে বলেন তো কেমন লাগছে আমাকে!’

খট করে ফোনটা কেটে দিল ফায়াদ।ফোন কান থেকে নামিয়ে অপরাজিতা হাসতে হাসতে শেষ।ভাবল,
‘ আজ অনেক হলো জালাতন। এবার বাকিটা রাত নাহয় বইয়ের পাতায় ডুবে থাকি। ফেল করলে যদি এই ডাক্তার আমাকে পাত্তা না দেয়!সর্বনাশ! পড়তে বস অপরাজিতা’
টেবিলে বসে পড়লো অপরাজিতা।টেবিলে বসে একটা স্টিকি নোট এ লিখলো,
‘পাত্তা পেতে হলেও পড়তে হবে’
লিখেই সেটা সামনের দেওয়ালে চিপকে দিল।দেওয়াল টায় শুধু এই একটা নোট না৷ আরো আছে অসংখ্য।কোনোটায় লিখা,’জামাই হিসেবে তাকে পেতে পড়তে হবে’,আবার কোনোটায় লিখা,’ডাক্তারের বউ ফেল্টুস হতে পারে না।’ এরকম অনেক৷ যেন নিজেকে উৎসাহিত করছে পড়তে।আজ আরো একটি যোগ হলো।পাত্তা পেতে হলে পড়তে হবে। তাই পড়ায় ডুবে গেল অপরাজিতা।

(চলবে)